করোনা ভাইরাস কি মৃত্যু সম্পর্কে মানুষের মনোভাব বদলে দেবে? সম্পূর্ণ বদলে যাবে মৃত্যু ভাবনা, নাকি ঘটবে তার উল্টোটা? করোনা ভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারী কি আমাদেরকে নিয়ে যাবে দীর্ঘদিনের প্রচলিত এবং ধর্ম স্বীকৃত মৃত্যুর ধারণার আরও কাছাকাছি? নাকি আমরা দীর্ঘজীবন বা মৃত্যুকে জয় করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবো?

A worshipper sits in Westminster Cathedral in central London on 17 March 2020. Photograph: Tolga Akmen/AFP via Getty Images

আধুনিক পৃথিবী আমাদের মনে এই সাহস যুগিয়েছে যে মানুষ চিকিৎসা বিজ্ঞানে এত উন্নতি করেছে যে মৃত্যুকে পর্যন্ত জয় করতে সক্ষম। জীবন এবং মৃত্যুর প্রতি এটা আমাদের যুগান্তকারী বিপ্লবী মনোভাব। সুদূর অতীত থেকে দেখা যায় মানুষ মৃত্যুর কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করেছে। আধুনিক যুগের আগ পর্যন্ত বেশীরভাগ ধর্ম এবং ধর্মীয় বিশ্বাস মৃত্যুকে দেখেছে আমাদের অলঙ্ঘনীয় ভাগ্য লিখন এবং আমাদের জীবনের অর্থপূর্ণ উৎস ও উদ্দেশ্য। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে কেউ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পরে। কেবল মৃত্যুর পরেই কেউ জানতে পারবে জীবনের গোপন রহস্য ও অর্থ। মৃত্যুর পরেই ঘটবে মানুষের চিরমুক্তি, মোক্ষলাভ বা নরকের অনন্ত শাস্তিভোগ। এই পৃথিবীতে মৃত্যু ব্যতীত এবং মৃত্যুর পরে স্বর্গ, নরক বা জন্মান্তর ছাড়া খ্রিস্টান, ইসলাম বা হিন্দু ধর্মের কোন মানে নাই। ইতিহাসের পাতা জুড়ে মহৎ প্রাণ মানুষেরা মৃত্যুকে অর্থপূর্ণ করতে ব্যস্ত কিন্তু কেউ মৃত্যুকে জয় করতে চেষ্টা করেনি।

মেসোপটেমিয়ার গিলগামেশ মহাকাব্য, অর্ফিউস এবং ইউরিদাইসের অমর প্রেমোপাখ্যান, বাইবেল, কোরআন, বেদ এবং অন্যান্য হাজারো পবিত্র গ্রন্থ অথবা রূপকথায় বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে যে হতভাগ্য মানুষ মরে যায় কারণ মৃত্যু ঈশ্বরের ইচ্ছা। অন্যভাবে বলা যায় মহাবিশ্ব, মাতা প্রকৃতির ইচ্ছা, দয়া বা দোয়াতে আমাদের বরং মৃত্যুকে প্রসন্ন মুখে গ্রহণ করা উচিৎ। মরণরে তুঁহু মম শ্যাম সমান। হয়ত ঈশ্বর একদিন তার অদ্ভুত মহাজাগতিক ইশারায় মৃত্যুকে রহিত করে দেবেন যেমনটা যিশুকে মৃত্যুর পরে আবার বাঁচিয়ে তুলেছিলেন, আবার ফিরিয়ে ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু মহাপ্রলয়ে আমাদের সবাইকে মেরে ফেলাটা ঈশ্বরের কেমন পরিকল্পনা সেটা আমাদের মত রক্ত মাংসের মানুষের চিন্তার বাইরে।

এরপরে এলো বিজ্ঞানের বিপ্লব। বিজ্ঞানীরা ঘোষণা করলেন, মৃত্যু কোন ঐশ্বরিক সিদ্ধান্ত নয়, বরং মৃত্যু হল মানুষের শরীরের যান্ত্রিক ত্রুটি। মানুষ মরে যায় কারণ এটা নয় যে মানুষের মৃত্যু ঈশ্বরের ইচ্ছা বরং মানুষ মরে যায় মানুষের শরীরের যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে। মানুষের হৃদযন্ত্র একদিন শরীরে রক্ত সরবরাহ বন্ধ করে দেয়, ক্যান্সার হয়ত ধ্বংস করে দেয় মানুষের যকৃৎ, মরণঘাতী ভাইরাস বাসা বাঁধে ফুসফুসে, সেখানে দিব্যি বংশ বিস্তার করে। কিন্তু কী কারণে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়? অন্য আরও কিছু ত্রুটির কারণে বড় ত্রুটি দেখা দেয় এবং তখনই অনর্থটা ঘটে। হৃদযন্ত্র রক্ত পাম্প করা বন্ধ করে দেয় কারণ হৃদযন্ত্রের মাংসপেশিতে যথেষ্ট অক্সিজেন পৌঁছে না। যকৃতে ক্যান্সার কোষ অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়তে শুরু করে, কারণ ক্যান্সারাক্রান্ত কোষের জেনেটিক মিউটেশন। করোনা ভাইরাস ফুসফুসে বাসা বাঁধে কারণ কেউ হয়ত হাঁচি দিয়েছিল এবং হাঁচির মাধ্যমে জীবাণু ফুসফুসে প্রবেশ করেছে। এখানে কোন ঐশ্বরিক রহস্য নেই।

Joe Coleman from Dublin at Knock Shrine, Co Mayo, May 2010, when he claimed that an apparition would take place, directly linked to the second coming of Christ on Earth. Photograph: Julien Behal/PA

বিজ্ঞান বলছে প্রতিটি যান্ত্রিক ত্রুটির কারিগরি সমাধান আছে। মৃত্যুকে জয় করতে আমাদের যিশুর দ্বিতীয়বার ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করার দরকার নেই। কয়েকজন বিজ্ঞানী ল্যাবে বসেই এটা করে ফেলতে পারে। পক্ষান্তরে প্রচলিত ধারণা হল মৃত্যু নিয়ে কাজ করবে কালো আলখাল্লা গায়ে গির্জার ফাদার বা ধর্মীয় পণ্ডিত। কিন্তু বর্তমানে মৃত্যুকে রোধ করতে ল্যাবে কাজ করে যাচ্ছে বিজ্ঞানীরা সাদা অ্যাপ্রোন গায়ে। যদি হৃদযন্ত্র রক্ত পাম্প করা বন্ধ করে দেয় তবে পেসমেকার ব্যবহার করে নিশ্চল হৃদযন্ত্রে স্পন্দন ফিরিয়ে আনতে পারি, এমনকি হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপন করতে পারি। যদি ক্যান্সার যকৃৎ অকেজো করে দিতে চায় তো আমরা আক্রান্ত কোষ কেমোথেরাপি দিয়ে মেরে ফেলতে পারি। যদি ফুসফুসে ভাইরাস বেড়েই চলে লাগামহীন তবে নতুন কোন ওষুধ দিয়ে দমন করতে পারি।

হ্যাঁ, এটা সত্যি যে আমরা এই মুহূর্তে মানুষের সব শারীরিক সমস্যা সমাধান করতে পারছি না কিন্তু আমরা সমস্যা নিরসনে নিরলস কাজ করে যাচ্ছি। মহৎপ্রাণ মানুষেরা এখন আর মৃত্যুর অর্থ খুঁজে বৃথা সময় নষ্ট করে না। তারা কীভাবে জীবনের আয়ু বৃদ্ধি করা যায় সেই চিন্তায় বিভোর। তারা গবেষণা করছে মাইক্রোবায়োলজি, শারীরবৃত্ত, এবং জিনতত্ত্ব নিয়ে। খুঁজে দেখছেন রোগব্যাধি ও বার্ধক্যের কারণ এবং আবিষ্কার করছেন নতুন নতুন ওষুধ এবং যুগান্তকারী চিকিৎসা ব্যবস্থা।

জীবনের আয়ু বৃদ্ধির প্রচেষ্টাতে মানুষ অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। গত দুই শতাব্দীতে পুরো পৃথিবীতে মানুষের গড় আয়ুষ্কাল ৪০ থেকে লাফিয়ে ৭২ বছরে পৌঁছেছে, উন্নত দেশগুলোতে গড় আয়ু দাঁড়িয়েছে ৮০ বছরের উপরে। দেশে দেশে শিশুরা রক্ষা পেয়েছে মৃত্যুর করাল গ্রাস থেকে। বিংশ শতাব্দীর আগে কমপক্ষে এক তৃতীয়াংশ বালক সাবালক হওয়ার আগেই মারা যেত। আমাশয়, হাম, গুটিবসন্তে প্রতিনিয়ত মারা যেত হাজার হাজার শিশু। ১৭ শতকে ইংল্যান্ডে প্রতি হাজারে ১৫০ জন শিশু জন্মের প্রথম বছরেই মারা যেত এবং মাত্র ৭০০ জন ১৫ বছরের চৌকাঠ পার করতে পারতো। কিন্তু আজকের দিনে হাজারে মাত্র ৫ জন শিশু জন্মের প্রথম বছরে মারা যায় এবং ৯৯৩ জন শিশু তাদের ১৫তম জন্মদিন উদযাপন করতে পারে। সমগ্র পৃথিবীতে এখন শিশু মৃত্যুর হার ৫ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে।

মানুষ মানুষের জীবনের সুরক্ষায় এবং আয়ুষ্কাল বৃদ্ধিতে এতটাই সফল হয়েছে যে জীবন ও মৃত্যু সম্পর্কে পৃথিবীর দৃষ্টিভঙ্গি আমূল বদলে গেছে। যখন প্রচলিত ধর্মগুলো মনে করছে মৃত্যুর পরেই জীবনের সার্থকতা তখন ১৮ শতক থেকেই উদার মানবতাবাদ, সমাজতন্ত্র এবং নারীবাদ মৃত্যুর পরবর্তী জীবন সম্পর্কে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। একজন কম্যুনিস্টের মৃত্যুর পরে কী হয়? কেমন হয় মরে যাওয়ার পরে একজন পুঁজিবাদীর জীবন? অথবা একজন নারীবাদীর মরার পরে কী দশা হয়? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য কার্ল মার্ক্স, অ্যাডাম স্মিথ বা সিমোন দ্য বুফোয়ারের লেখা তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়ানো নিতান্ত অর্থহীন।

আজকের আধুনিক সমাজে শুধু জাতীয়তাবাদের আদর্শে মৃত্যু এখনো কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে এবং পুরষ্কারের আশ্বাস দেয়। জাতীয়তাবাদে মৃত্যুকে উপস্থাপন করা হয় কাব্যিক-ভাবে এবং প্রতিশ্রুতি দেয় দেশ ও জাতির জন্য নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই। আত্মাহুতি দেয়া মানুষটি দেশের মানুষের অন্তরে চিরকাল বেঁচে থাকবে শ্রদ্ধার সাথে। জাতীয়তাবাদ এত ঝাপসা প্রতিশ্রুত দেয় এবং উত্তেজিত করে যে জাতীয়তাবাদী বুঝে উঠতে পারে না কীভাবে জীবন দিতে হবে। মানুষ কীভাবে অন্যের স্মৃতিতে বেঁচে থাকে? কেউ যদি মরেই যায় তাহলে সে কীভাবে বুঝবে অন্য মানুষ তাকে স্মরণ করল কী করল না? উডি অ্যালেন’কে এক সাক্ষাৎকারে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, “সিনেমা প্রেমীদের মনে আপনি চিরদিন বেঁচে থাকবেন এমন প্রত্যাশা করেন কিনা” অ্যালেন উত্তর দিয়েছিলেন, “আমি বরং আমার অ্যাপার্টমেন্টে বেঁচে থাকতে চাইবো।” বর্তমান পরিস্থিতিতে এমনকি অনেক প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাসও তাদের ধর্মীয় মূল আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে। মৃত্যুর পরবর্তী জীবনে চাওয়া পাওয়ার খতিয়ানের স্বপ্ন না দেখিয়ে বরং এই জীবনকেই কীভাবে অর্থপূর্ণ করা যায় সে প্রসঙ্গে গুরুত্বারোপ করেছে।

বর্তমানের বৈশ্বিক মহামারী কি মৃত্যু সম্পর্কে মানুষের মনোভাব পরিবর্তন ঘটাতে পারবে? সম্ভবত পারবে না। বরং ঘটবে তার উল্টোটা। কোভিড-১৯ ভাইরাস সংক্রমণের ফলে মানুষের জীবন রক্ষার প্রচেষ্টা দ্বিগুণ হয়ে যাবে। আমাদের সহমর্মিতা আর পারস্পরিক সহযোগিতার মানবিক ও সাংস্কৃতিক চর্চায় কোভিড-১৯ মহামারীতে আমরা হাল ছেড়ে দিতে পারি না। বরং আমরা সাহসী এবং আশাবাদী হয়ে উঠি।

আধুনিক পূর্ব সমাজে যেমন মধ্যযুগের ইউরোপে মহামারী দেখা দিলে, মানুষের মাঝে অবশ্যই মৃত্যুভয় দেখা দিয়েছিল, প্রিয়জনের মৃত্যুতে তখনকার মানুষের জীবনে নেমে এসেছিল অবর্ণনীয় হতাশা ও ধ্বংস, কিন্তু তখনকার সামাজিক বাস্তবতায় হাল ছেড়ে দেয়া ছাড়া কোন উপায় ছিল না। মনোবিজ্ঞানীরা সেই অবস্থাকে বলছেন ‘সচেতন অসহায়ত্ব’। মানুষ নিজেদেরকে সান্ত্বনা দিতো, এই মহামারী নিশ্চয় ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই হচ্ছে। কেউ ভাবতো এই মহামারী আসলে ঈশ্বরের তরফ থেকে গজব, মানুষের পাপের শাস্তি। নিশ্চয় ঈশ্বর সবকিছু ভালো জানেন। আমাদের মত পাপী মানুষের জন্য এটাই যোগ্য ফলাফল। ঈশ্বর যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন এবং এই মহামারী শেষে আমাদের জন্য ভালো কিছু অপেক্ষা করছে। মৃত্যুতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, ভালো মানুষেরা স্বর্গে ঠিক ভালো কাজের প্রতিদান পাবেন। সুতরাং ওষুধের খোঁজে বৃথা সময় অপচয় করার কোন দরকার নেই। এই মহামারী ঈশ্বর পাঠিয়েছে আমাদেরকে শাস্তি দেয়ার উদ্দেশ্যে। যারা চিন্তা করছে মানুষ তার মেধা দিয়ে মহামারী জয় করে ফেলবে তারা শুধু তাদের অপরাধের পাল্লা ভারি করছে। ঈশ্বরের পরিকল্পনা বাধাগ্রস্ত করার আমরা কে?

কিন্তু বর্তমানে অসুখ সম্পর্কে মানুষের চিন্তা অতীতের ঠিক বিপরীত মেরুতে। যখনই কোন স্থানে আগুন লেগে বা ঘূর্ণিঝড়ের প্রাকৃতিক দুর্যোগে অথবা ট্রেন দুর্ঘটনায় অনেক মানুষ মারা যায় তখন আমরা কারণ অনুসন্ধান করি এবং মনে করি দুর্যোগ মোকাবেলা করতে না পারাটা মানুষের ব্যর্থতা। অলঙ্ঘনীয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ কোন ঈশ্বরের পাঠানো শাস্তি নয়। যদি ট্রেন কর্তৃপক্ষ দুর্ঘটনা প্রতিরোধে নিরাপত্তা বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ নিশ্চিত করে, যদি স্থানীয় সরকার প্রশাসন আগে থেকেই আগুন নিয়ন্ত্রণের যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা রাখে, সঠিক নীতিমালা প্রণয়ন করে এবং সরকার যদি দ্রুত আক্রান্ত এলাকার সাহায্যে এগিয়ে আসে তাহলে আক্রান্ত মানুষকে বাঁচানো সম্ভব। ২১ শতকে অনেক মানুষের মৃত্যুর ঘটনা নিঃসন্দেহে আইনি তদন্তের বিষয়।

[Port Vila, Vanuatu, after Cyclone Pam struck in March 2015. Photograph: Dave Hunt/Getty Images]

মহামারীর ক্ষেত্রেও আমাদের মনোভাব এবং অবস্থান একই রকম। কিন্তু এই সময়ে এগিয়ে আসে কিছু ধর্মীয় গুরু, পুরোহিত, ফাদার, সাধু। তারা সাহায্য হিসেবে নিয়ে আসে গালি আর বলে সমকামীদের শায়েস্তা করতেই ঈশ্বর এই শাস্তির ব্যবস্থা করেছে। আধুনিক সমাজ ক্ষমার দৃষ্টিতে তাদের এসব পাগলামিপূর্ণ মৌলবাদী বয়ান এড়িয়ে যায়। বর্তমানে এইডস, ইবোলা বা সাম্প্রতিক করোনা ভাইরাসের মহামারীর বিস্তার দেশের সাংগঠনিক ব্যর্থতা। আমরা মনে করি মহামারী নিয়ন্ত্রণ করার মত যথেষ্ট জ্ঞান এবং আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম মানুষের আছে। এমনকি যদি সংক্রামক রোগব্যাধি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলেও যায় তবুও সেটা মানুষের সীমাবদ্ধতা সেখানে কোন রাগান্বিত ঈশ্বরের হাত নেই। এক্ষেত্রে কোভিড-১৯ কোন ব্যতিক্রম নয়। সংকট অনেকদূর শাখা প্রশাখা বিস্তার করে ফেলেছে সেই সাথে বেড়েছে মানুষের একের উপর অন্যের দোষ চাপানোর বালিশ বদল খেলা। সমস্যার সমাধান না করে ইতিমধ্যে করোনা মহামারীর জন্য একদেশ অন্যদেশকে দায়ী করছে। শত্রুভাবাপন্ন রাজনীতিবিদগণ দায়িত্ব অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে যেন হাত বদল করছে পিন খোলা গ্রেনেড।

এমন ক্ষোভের মধ্যেও পাহাড় সমান আশা আছে। আমাদের নায়কেরা গির্জার ফাদার বা মন্দিরের সাধু নয় যারা শুধু লাশ দাফন করে, পাপের শাস্তির ভয় দিয়ে বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের অজুহাত দিয়েই ক্ষান্ত হয়ে যাবে। আমাদের নায়ক স্বাস্থ্যকর্মী, যারা জীবন বাঁচাতে জীবন বাজি রাখছেন। আমাদের মহানায়কেরা হলেন বিজ্ঞানী যারা গবেষণাগারে নিরন্তর পরিশ্রম করছেন। বিজ্ঞানের কল্প গল্পের সিনেমার দর্শকরা যেমন জানেন স্পাইডার-ম্যান বা ওয়ান্ডার ওম্যান স্বাভাবিকভাবেই ধ্বংস করে দেবে অশক্তি এবং শেষ পর্যন্ত রক্ষা করবেন আমাদের পৃথিবী, তেমনিভাবে আমরা নিশ্চিতভাবেই জানি কয়েকমাস বা বছরের মধ্যেই গবেষণাগারে আবিষ্কৃত হয়ে যাবে কোভিড-১৯ ভাইরাসের কার্যকরী চিকিৎসা এবং প্রতিষেধক টিকা। তখন এই বিশ্রী করোনা ভাইরাসকে দেখিয়ে দেব এই পৃথিবীতে কারা শ্রেষ্ঠ। হোয়াইট হাউজ থেকে ওয়াল স্ট্রিট, ইটালি, স্পেন, আমেরিকার প্রতিটি বাড়ির গৃহবন্দী মানুষের মুখে একটাই প্রশ্ন “কখন আসবে প্রতিষেধক টিকা, কখন? কিন্তু যদি প্রতিষেধক আবিষ্কার না হয়?

যখন সত্যিই প্রতিষেধক চলে আসবে এবং মহামারীও বিদায় নেবে তখন মানুষের প্রধান আলোচ্য বিষয় কী হবে? বোধ করি হওয়া উচিৎ মানুষের জীবন বাঁচানো এবং সুরক্ষার জন্য আরও বেশি বিনিয়োগ। আমাদের প্রতিষ্ঠা করতে হবে বেশি বেশি হাসপাতাল, বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, প্রশিক্ষিত নার্স, আমাদের বেশি বেশি মজুদ করতে হবে কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস যন্ত্র, জীবাণু থেকে সুরক্ষার জন্য বিশেষায়িত পোশাক এবং সংক্রমণ পরীক্ষার কিট। অনাগত দিনে আরও জীবাণু আঘাত হানবে মহামারী আকারে, সম্ভাব্য জীবাণুর আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য আমাদেরকে বিনিয়োগ করতে হবে আগে থেকেই এবং প্রস্তুত রাখতে হবে চিকিৎসা ব্যবস্থা। আমাদের আর অরক্ষিত থাকা চলবে না।

কেউ কেউ হয়ত তর্ক জুড়ে দিতে পারেন। এটা ভুল শিক্ষা যে, সংকট আমাদেরকে মানবতা, বিনয় শিক্ষা দেবে। আমরা এখনো নিশ্চিত নই প্রকৃতির শক্তি এবং বিপর্যয়কে কীভাবে বশীভূত করা যায়। যারা আমাদের সমালোচনা করতে চান তাদের অনেকেই এই আধুনিক যুগেও ধারণ করে মধ্যযুগের অন্ধকার, যারা বিনয়ের ধর্মীয় জ্ঞান দেয় তারাও শতভাগ নিশ্চিত যে তারা সঠিক উত্তরগুলো জানে। কিছু অতি গোঁড়া ধার্মিক তারা অন্ধ নির্বুদ্ধিতার পরিচয় না দিয়ে থাকতে পারে না। এইতো যেমন ট্রাম্পের মন্ত্রীসভায় যে পালক (প্যাস্টর) সাপ্তাহিক বাইবেল পাঠের আসর পরিচালনা করে সে বলেছে, সমকামিতার জন্যই করোনা ভাইরাস হল ঈশ্বরের অভিশাপ। কিন্তু যদিও বেশীরভাগ ধর্মীয় নেতাগণ ইদানীং ধর্মের পবিত্রবাণী ছেড়ে বিজ্ঞানের উপর ভরসা স্থাপন শুরু করেছেন।

করোনার সময়ে ক্যাথোলিক চার্চ ভক্তদেরকে পরামর্শ দিয়েছে চার্চে জমায়েত না হওয়ার জন্য। ইজরায়েল সমস্ত সিনেগগ বন্ধ করে দিয়েছে। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান তার নাগরিকদেরকে মসজিদে না আসার জন্য পরামর্শ দিয়েছে। মন্দিরগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান তাদের উপাসনালয়ে প্রার্থনা ও অনুষ্ঠান বাতিল করেছে। কারণ বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন গণজমায়েতে করোনা ছড়ায়, তাই এইসব পবিত্র-স্থান বন্ধ করার সুপারিশ করেছে।

অবশ্য সবাই যে মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের অহংকার বা আত্মবিশ্বাস মধ্যযুগে নিয়ে যাচ্ছে সে বিষয়ে সতর্ক করেছেন তা কিন্তু নয়। বিজ্ঞানীগণও একমত হবেন আমাদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তিতে বাস্তবিক বোধ সম্পন্ন হওয়া উচিৎ। ফলে আমাদের অন্ধবিশ্বাস করা উচিৎ হবে না যে চিকিৎসকদের অতিমানবিক ক্ষমতা আছে এবং তাদের পরশপাথরের সাহায্যে আমাদের জীবনের সব দুর্দশা থেকে আমরা সুরক্ষা পেয়ে যাবো। সামগ্রিকভাবে মানবজাতি অতীতের যেকোনো সময়ের থেকে এখন বেশি শক্তিশালী, কিন্তু ব্যক্তি মানুষ এখনো মৃত্যুর ছোবল থেকে মুক্ত নয়। কিন্তু আগামী এক বা দুই শতাব্দীর মধ্যেই বিজ্ঞান মানুষের আয়ুষ্কাল বাড়িয়ে দেবে নিশ্চয়, যদিও সেই সুদিন এখনো আসেনি। দুই একটা হাতেগোনা ভাগ্যবান ধনকুবেরের ঘরে জন্ম নেয়া শিশু বাদে সবাইকেই গড় আয়ুর মধ্যেই মরে যেতে হবে। আমাদের সবাইকেই হারাতে হবে প্রিয়জন। আমাদের সবাইকেই ক্ষণস্থায়ী জীবন মেনে নিতে হবে।

An empty mosque in Shahr-e-Ray, south of Tehran, on a Friday in March 2020. Photograph: Ebrahim Noroozi/AP

শতাব্দীর পর শতাব্দীর ধরে মানুষ ধর্মকে ব্যবহার করছে মৃত্যুর পাহারাদার হিসেবে, তাদের বিশ্বাস এই জন্মে সুখে দুঃখে যত দিনই বাঁচুক না তার জন্য মৃত্যুর পরে অপেক্ষা করছে অনন্ত জীবন। কিন্তু মানুষ এখন ধর্ম থেকে বেরিয়ে বিজ্ঞানকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে বেঁচে থাকার জন্য। মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে ডাক্তার তাদেরকে বাঁচিয়ে দেবে এবং অনন্তকাল তাদের সুখের অ্যাপার্টমেন্টে সুস্থ দেহে বসবাস করতে পারবে। আমাদেরকে এই পরিস্থিতিতে একটা মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে হবে। আমাদেরকে মহামারীর মত প্রতিকূলতা রোধ করতে বিজ্ঞানের উপর আস্থা আনতে হবে কিন্তু তদুপরি মেনে নিতে হবে প্রত্যেকের ঘাড়ের উপর মৃত্যুর গরম নিঃশ্বাস, মেনে নিতে হবে আমাদের ক্ষণস্থায়ী জীবন।

বর্তমান সংকটে প্রতিটি মানুষ জেনে গেছে জীবনের চরম সত্য, মানুষের জীবন কত ছোট এবং মানুষের কী অর্জন। তবুও আমাদের আধুনিক সভ্যতা সামগ্রিকভাবে বিপরীত দিকেই অগ্রসর হবে। ক্ষণস্থায়ী জীবন আর মৃত্যু চিন্তা স্মরণে রেখেই মানুষ গড়ে তুলবে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা। করোনা সংকট কেটে যাওয়ার পর আমি মনে করি না রাষ্ট্রব্যবস্থা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের বরাদ্দ বাড়িয়ে দেবে কিন্তু আমি বাজি ধরে বলতে পারি আমরা দেখতে পাবো দেশে দেশে সরকার মেডিকেল স্কুল এবং স্বাস্থ্যখাতে বিপুল পরিমাণ বরাদ্দ বাড়িয়ে দেবে।

মানুষ হিসেবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা। কোন সরকারই বিশেষ কোন দর্শনের পৃষ্ঠপোষক নয়। দর্শন প্রচার সরকারের কাজের ক্ষেত্রও নয়। সত্যিকার অর্থেই সরকারের উচিৎ স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি করা। কেউ যদি চায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে নিজে দার্শনিক চর্চা করবে, তো করতে পারে। ডাক্তাররা ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে কী নাই সেই রহস্যের সমাধান আমাদের দিতে পারে না। কিন্তু ডাক্তাররা আমাদেরকে ঈশ্বর সংক্রান্ত সন্দেহের দ্বন্দ্ব ও দ্বৈরথ নিয়ে আরও কিছুদিন বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। আরও কিছুদিন বেঁচে থেকে আমরা কী করবো সেটা আমাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত বিষয়।

মূল প্রবন্ধ: Yuval Noah Harari: ‘Will coronavirus change our attitudes to death? Quite the opposite

হারারির অন্যান্য অনুবাদ প্রবন্ধগুলো:
করোনাভাইরাস মহামারী নজরদারিতে ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন এঁকে দেবে
ইউভাল নোয়া হারারিঃ করোনা পরবর্তী পৃথিবী
মানুষ হলো সত্য বিবর্জিত প্রাণী: ইউভাল নোয়াহ হারারি
আমরা ক্রমাগত ঈশ্বরে পরিণত হওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি: ইউভাল নোয়াহ হারারি
জঙ্গিবাদের নাট্যমঞ্চ-নোয়াহ হারারি