ক’বছর আগে দেশে বৈশাখী উৎসবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঘটে যাওয়া খুব মন খারাপ করা একটি ঘটনা শুরুতেই মনে করিয়ে দিচ্ছি। এই ঘটনায় কয়েকজন উচ্ছল তরুণীকে অত্যন্ত কুৎসিত যাবে যৌন হয়রানি করা হয়েছিল। জনসমক্ষে তাঁদের জামাকাপড় ছিঁড়ে ফেলা হয়েছিল। তরুণীদের শরীরগুলোর উপর চালিয়েছিল নির্যাতন। নিদারুন ভাবে তাঁদের লাঞ্ছনা করা হয়েছিল। অনেকগুলো বদমাশ ওই নিরীহ মেয়েগুলোকে ঘিরে রেখেছিল যাতে সেই বৃত্তের ভেতর আক্রমণ নির্বিঘ্ন হয়। এই লাঞ্ছনা করা হয়েছিল বাঙালি সংস্কৃতির খুব আনন্দের একটি উৎসবে, আরব সংস্কৃতির একটি অত্যন্ত কুৎসিত লম্পটে খেলাকে অবিকল নকল করে। বুক ভেঙে যাবার মত একটি ঘটনা। যারা এমন জঘন্য ঘটনা ঘটিয়েছিল তাদের সেই সাহস হয়েছিল কী করে? আরব সংস্কৃতির এত জঘন্য এই লাঞ্ছনার খেলা ‘তাহরুশ’ ঘটাবার সাহস পেল কী করে বদমাশগুলো? নারী কি এখন বাংলাদেশে নিরাপদ? বাঙালি নারীরা, প্রগতিশীল মানুষেরা কি যথেষ্ট শক্তিশালী হতে পেরেছে নারী নির্যাতনের ভয়ঙ্কর ঘটনাপ্রবাহ ঠেকাতে? তেমন মনে হচ্ছে না তো। প্রতিদিন এখনো চলছে দেশ জুড়ে নানা পদ্ধতিতে নারী নির্যাতন। নির্ভয়ে চলছে ফতোয়া দেওয়া, বাঙালিকে বিভ্রান্ত করা আর অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া। তরুণ তরুণী, কিশোর কিশোরী, নারী পুরুষ, মানুষ, যেখানে সেখানে লাঞ্ছিত হবার ঘটনার কথা তো এখনো দেখছি, শুনছি। ধর্মের অনুশাসনের নাম সেগুলো ভয়াবহ তীব্রতা পেয়েছে এখন, আর সাধারণ মানুষ সেই সব মেনে নিয়ে বদলেও যাচ্ছে। কী বেদনাদায়ক। এর শেষ কিছু আছে কী? নারীদের উপর ধর্মের শাসন যেন খুব সন্তর্পনে, সাংগঠনিক ও পরিকল্পিত ভাবে, সর্বক্ষেত্রে অনেক দিন ধরে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

ছবি: ইন্টারনেট থেকে

কিছুদিন আগের খবরে দেখা গেল বাংলাদেশে বিয়ে রেজিস্ট্রেশন করা নিয়ে শরিয়া আইন অর্থাৎ ইসলাম ধর্মের আইন নির্ভর রায় হয়েছে আদালত থেকে। বলা হয়েছে, মহিলা কাজী, মানে বিয়ের কাজীর দায়িত্ব কোন নারী পালন করতে পারবে না। বিয়ের জন্য কাজী হবেন তিনিই, যিনি বিবাহ রেজিষ্ট্রি করে দেবার ক্ষমতা রাখেন। তাঁর এই রেজিস্ট্রেশনের কাজে বিয়ে পড়ানোর কোন বাধ্যবাধকতা নেই। তো কেন নারী এই ম্যারেজ রেজিস্ট্রির কাজটি করতে পারবেন না? কারণ দেখানো হয়েছে যে নারীর মাসিক চলা কালে তিনি নাকি অপবিত্র, সুতরাং এটি তিনি করতে পারবেন না। মহিলা কাজী হয়ত বিয়ে পড়াচ্ছেন বা পড়াচ্ছেন না, হয়ত অন্য যে কোন মুরুব্বি পড়াচ্ছেন কিন্তু ভদ্রমহিলার মূল কাজ হচ্ছে ইতোমধ্যে ধর্মীয় ভাবে পড়ানো বিয়েকে শুধুমাত্র যথাযথ ভাবে লিপিবদ্ধ করে প্রত্যায়ন করে দেওয়া ও তা জানিয়ে দেওয়া। জেনে রাখা দরকার যে বিয়ে পড়ানোর এই কাজটি কিন্তু যে কোন পুরুষ যে কোন অবস্থায় ও সময়ে করতে পারেন। ম্যারেজ রেজিষ্টারের প্রত্যয়ন দেশের যে কোন জায়গায় আইনতঃ গ্রহণযোগ্য, এমনকি বিদেশেও। এখন এইটুকু যে দাপ্তরিক কাজ, সেই’টি নাকি নারীরা আর করতে পারবেন না।

রায়ে বলা হয়েছে যে নারী অপবিত্র অবস্থায় মসজিদে প্রবেশ করতে পারেন না আর তাই মসজিদে বিয়ে হলে নারী সেখানে ঢুকতে পারবে না, সুতরাং দেশের কোন নারীই এই কাজীর কাজটি করতে পারবে না। এটি হাইকোর্টের রায়। কম কথা নয় মোটে। প্রশ্ন আসতেই পারে যে কজন’ই বা মসজিদে গিয়ে বিয়ে করে আর কজন’ই বা নারী ম্যারিজ রেজিস্টার আছেন গোটা দেশে? আদৌ আছেন কি না ইত্যাদি। কোন অর্থ নেই, তবু তর্কের খাতিরে ধরেও যদি নিই যে মাসিক চলাকালে নারী অপবিত্র তবুও আরো অনেক প্রশ্ন উঠতে পারে, সেগুলোর থেকে দু একটি প্রশ্নের নমুনা দিই:

১. মসজিদে ইমাম সাহেব বা অন্য যে কোন পুরুষ বিয়ে পড়ানোর পর যদি মসজিদের বাইরে অপেক্ষমান নারী ম্যারেজ রেজিষ্টার তা রেজিস্ট্রি করে দেন তা’হলে কী অসুবিধে? তিনি তো মসজিদে ঢুকছেন না, তবু তাকে একেবারে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হল কেন? ইসলামের আইন দেখিয়ে?

২. বিভিন্ন আদালতে তো অনেক ঋতুমতী নারী বিচারক ও ম্যাজিস্ট্রেট আছেন, তাদের মাসিক হয় বলে ওই এক’ই কারণে তারা কী পবিত্র আদালতে কাজ করতে অযোগ্য ঘোষিত হবেন ভবিষ্যতে?

৩. সারা দেশে বিপুল সংখ্যক ঋতুমতী নারী কর্মকর্তা রয়েছেন, শপথ বাক্য উদ্ধৃত করে তাদের অনেককেই নানা দাপ্তরিক কাজ কর্ম সম্পাদন করতে হয়, দেশজুড়ে সেই সব কর্মকর্তা কী চাকুরী হারাবেন, সেই একই কারনে? ইত্যাদি ইত্যাদি,

আরো আরো বহু প্রশ্নই তোলা চলে। তবে অপবিত্রতাই যখন মূল বিবেচ্য তখন একটি প্রশ্ন তো অবশ্যই করা চলে, অপবিত্র দেহ কী? ইসলামে এটি কিভাবে কোথায় সংজ্ঞায়িত? নারী কর্মকর্তার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র বিবাহ আইনই কী ইসলামের শরিয়া মোতাবেক চলবে না’কি অন্য আইনেও ওই উল্লেখিত অপবিত্রতা ‘কারণ’ ধর্তব্যের মধ্যে থাকবে?

দেশে কী শরিয়া আইন চলে এলো না কী? নিজে নিজে কী করে সহজে কোথায় পড়বেন এসব বিষয়ে? ইসলামী আইন বা শরিয়ার আইনটাই বা কী? ইসলামী আইনে অপবিত্রতা কী? সহজ করে বললে মনে হয় অত্যুক্তি হবে না যে কোরান হাদিসের আলোকে তৈরী আইন’ই ইসলামী আইন, শরিয়া আইন। সহি হাদিস, ভুয়া হাদিস, আলেমদের হাদিস, অপব্যাখ্যা, অতিরিক্ত ভাবার্থ ইত্যাদি ইত্যাদি সব যদি বাদ দিয়েও দেওয়া হয় তা হলে রইলো কী? রইলো কোরান, অপরিবর্তনযোগ্য কোরান শরীফ। শেষমেশ তাহলে তো কোরান শরীফের উপরই ভরসা করতে হয়, তাই না? এই গ্রন্থ তো বাংলা অথবা ইংরেজিতে বাংলাদেশেই পাওয়া যায় অনায়াসে, পড়াও যায় সহজে, এবং বুঝতেও চেষ্টা করা যায়, নয় কি? তো কোরানে অপবিত্রতার সংজ্ঞা কী? কোথায় লেখা আছে এই সব?

কোরানের নানা সূরায়, নানান আয়াতে আছে লেখা অনেক অনেক কথা। নিজেদের চেষ্টায় খুঁজে বের করে নেওয়াই ভাল। তবে ঠিক এই অপবিত্রতা প্রসঙ্গে ইচ্ছে হলে চট করে দেখবার মত দুটো সূত্র দেওয়া যাক, ইচ্ছে হলে দেখে নেওয়া যাবে। কোরানের পাঁচ নম্বর সূরা আল মাদিয়াহ’র ছয় নম্বর আয়াতে লেখা আছে কিভাবে আর কখন ধার্মিক অপবিত্র হয় আর কিভাবে পবিত্র হতে হয়। অন্যটি আছে নারীর জন্য অস্বস্তিকর ও বিরক্তিকর ওই মাসিক চলাকালীন সময়টাতে পুরুষরা যেন তাঁদের বিরক্ত না করে, যৌনকর্মে যেন আহ্ববান না করে সেই বিষয়ে লেখা, এইটি আছে কোরানের দ্বিতীয় সূরা আল বাকারার দুই’শ বাইশ নম্বর আয়াতে। দেখে নিন। এখানে দেখা যাবে যে এই সময়ে নারীদের ধর্মকর্ম করতে কিন্তু তেমনি করে নিষেধ করা হয় নি। পরিষ্কার পরিচ্ছন হয়ে নিলেই হল। এ’সব কথা কেন লেখা হচ্ছে এখানে? কথাগুলো বলবার কারণ ধর্মের বিভ্রান্তিকর অনুশাসন যেন প্রয়োজনে যাচাই করা যায়। আমাদের প্রিয় জন্মভূমির নারীদের উপর খুব চালাকি করে এই সব চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, এমনকি উচ্চ আদালত থেকে রায়ও বেরুচ্ছে এই গ্রন্থের ব্যক্ষ্যা দিয়ে। এ’সব ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে খুব কম সময়েই। এগুলোর মহাবিপদ সম্পর্কে জানা থাকা দরকার। আজ এটা, তো কাল ওটা, আর এমনি করেই রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়বে ভয়াবহ শরিয়া শাসন। এইসব ঠেকাতে নারী পুরুষ নির্বিশেষে সুসংগঠিত হয়ে বিপুল শক্তি নিয়ে প্রতিবাদ করে জীবন যাপন ঠিকঠাক করতে হবে, তা না হলে এক পা এগুনো অর্জন প্রতি মুহূর্তে একশ পা করে পিছিয়ে যাবে।

নাগরিকের প্রতি অন্যায়, নারীদের প্রতি অন্যায়, দুর্বলের উপর সবলের নির্যাতন এসব নতুন কিছু নয়। মানুষ, নাগরিক, জনগণ যদি চায় এভাবেই চলবে সবকিছু তা’হলে আর কিসের কী। বালুর ভেতর মুখ লুকিয়েই থাকুক তারা। নিজেদের মঙ্গল মনে মনে চাইলেই কী পাওয়া যাবে না’কী সচেতন হয়ে সেই সব নিজেদেরকেই প্রতিষ্ঠিত করে নিতে হবে, সেটা ভাবুক দেশের নাগরিক।

জন্মভূমিতে এমনিই নানা আইন আছে, সেই ব্রিটিশ আমলের আইন, হিন্দু ও মুসলমানদের জন্য বিবাহ ও পারিবারিক আইন, বিভিন্ন প্রশাসনিক আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। আশা করা যাক যে আইনের প্রয়োগ হবে সুন্দর ও প্রয়োজনীয় পরিমার্জন পরিশোধন পরিবর্তন হবে জনস্বার্থে। জনপ্রতিনিধিরা ভাবুক নাগরিক স্বার্থে উপযুক্ত কী হবে এবং যথোপযুক্ত কাজগুলো করুক। ‘ধর্ম আইন’ না হয়ে আইন হোক নাগরিক কল্যাণের।