লিখেছেন: ইশরাত জোনাকি

সমপ্রেম বা সমলৈঙ্গিক প্রেম এই শব্দটির সঙ্গে কতজন বাংলাদেশী পরিচিত? আর বাংলাদেশের মানুষেরা কি বিশ্বাস করে যে, সমলিঙ্গের মানুষের মধ্যে প্রেম হয়! তারা তো মনে করে যে, সমলিঙ্গের মানুষ কেবল মাত্র বন্ধু হতে পারে – এই রকম একটা রক্ষণশীল এবং পুরুষতান্ত্রিক বিশ্বাস বাংলাদেশের মানুষের চিন্তা-চেতনায় রয়ে গেছে অনেক আগে থেকেই। আমরা যারা সমপ্রেমী (আমি একজন নারী সমপ্রেমী) তাদের আসল পরিচয় লুকিয়ে রাখতে হয় কিংবা আত্মপরিচয় গোপন করে সাজতে হয় বিষমকামী অর্থাৎ বিপরীত লিঙ্গের মানুষের প্রতি আকৃষ্ট – এরকম ভান ধরতে হয়।

ছবি: ইন্টারনেট থেকে

সমকামী বা সমপ্রেমীরাও স্বাভাবিক মানুষ; আপনি বিষমকামী হতে পারেন, একজন নারী হয়ে একজন পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট হতে পারেন কিন্তু আপনি জানেন না যে কিছু কিছু নারী এবং পুরুষ জন্মগতভাবেই সমকামিতার অঙ্কুর নিয়ে জন্মগ্রহণ করে; আপনি জানেননা যে, একজন নারী একজন পুরুষের প্রেমে যেমন পড়তে পারে ঠিক তেমনই একজন নারী একজন নারীরও প্রেমে পড়তে পারে কিন্তু আমাদের সমাজ সমপ্রেম জিনিসটাকে স্বীকার করেনা, সমাজ এই জিনিসটা ঠিক মতো বুঝেইনা; আমাদের সমাজে প্রেম-ভালোবাসা মানেই তো যৌনতা ধরে নেয় মানুষগুলো যে, প্রেমিক-প্রেমিকারা যৌনতার জন্যই সম্পর্কে জড়িয়েছে। সমাজের খুব কম মানুষই প্রেমের সত্য আবেগ বুঝতে পারে; পুরুষতান্ত্রিক পরিবারে পুরুষতান্ত্রিক বাবা-মা মেয়েকে কিভাবে চাকরিজীবী স্বচ্ছল ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেবে সেই চিন্তায় মগ্ন থাকে, আজকাল যদিও মেয়েদের প্রেমিককে বাবামারা বিয়ে দিচ্ছে কিন্তু যদি কোনো বাবামা জানতে পারেন তাদের মেয়ে সমকামী! তাহলে কি হবে? আপনারা জানেন প্রগতিশীল সমাজেও (আমি বাংলাদেশেরই প্রগতিশীল সমাজের কথা বলছি) সমপ্রেম নিষিদ্ধ একটি বিষয় বা মানুষ জিনিসটা বোঝেনা ভালো করে; তারা পশ্চিমি পর্নোগ্রাফির মতো ‘লেসবিয়ান সেক্স’ -এর চিন্তা করে যে তাদের সমাজের মেয়েটা বখে গেছে। কি রকম আশ্চর্য সমাজব্যবস্থা আমাদের; ওরা এটা বুঝেই না যে একটা ছেলে যেমন একটা মেয়েকে ভালোবাসতে পারে, ওরকমই একটা মেয়েও একটা মেয়েকে ভালোবাসতে পারে। আমাদের পাশের দেশ ভারতে সমপ্রেম আর অবৈধ নয়; মেয়েরা, ছেলেরা যারা সমপ্রেমী তারা অবাধ তাদের প্রেমিকা বা প্রেমিকের সঙ্গে মিশতে পারছে যদিও ভারত এখন পুরোপুরি উদারপন্থী হয়নি তবে তাও আমাদের দেশের মতো নয় যে, রূপবান ধরণের ম্যাগাজিন বের করার কারণে খুন হতে হবে।

আমাদের দেশে যৌনতা জিনিসটাই নিষিদ্ধ, এটা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গে তাও গোপনে; আমাদের দেশের পুরুষতান্ত্রিক প্রেমিকগুলো তাদের প্রেমিকাকে ধর্ষণ করে এরকম খবর আমরা প্রায়ঃশই সংবাদপত্রে দেখি। উন্নত দেশগুলোতে (পশ্চিমি দেশ) তরুণরা তরুণীদের সঙ্গে অবাধে সম্মতি নিয়েই একে অপরের সঙ্গে মিশতে পারছে; প্রেম এবং যৌন দুই ধরণের সম্পর্কেই জড়াতে পারছে; সমকামী সম্পর্কও আছে পশ্চিমি তরুণ-তরুণীদের মধ্যে, কোনো সমস্যা হচ্ছেনা।

আমি কার সঙ্গে প্রেম করবো, বা কার সঙ্গে যৌন সম্পর্কে জড়াবো সেটা আমার স্বাধীনতা – কিন্তু সমাজ আমাকে এই স্বাধীনতাটা দেয়নি; আমাদের বাংলাদেশের সমাজে শুধু ‘নারীসুরক্ষা আইন’ আছে কিন্তু প্রেম-ভালোবাসার এবং যৌনতার স্বাধীনতা নেই। আমি সমপ্রেমী হয়েও সেটা সবার কাছে সত্য প্রকাশ করতে পারিনা সামাজিকতার কারণে, এটা একটা হতাশা, আমাকে আমার সমপ্রেমীর পরিচয় দিতে হয় ঘনিষ্ঠ বান্ধবী হিসেবে।

আমাদের বাংলাদেশের ইতিহাস অনেক পুরোনো যদিও স্বাধীন বাংলাদেশ আমরা পেয়েছি ১৯৭১ সালে; আমাদের সমাজে স্বাধীনতার পর থেকে আমরা কি প্রেম-ভালোবাসা এবং আমাদের ইচ্ছে মতো মানুষের সঙ্গে মেশার স্বাধীনতা পেয়েছি? সোজা উত্তর – পাইনি; সমাজ পুরুষতান্ত্রিক আবার রক্ষণশীল – এদুটো ধ্যান ধারণা বা মতবাদ আমাদের সমাজে অনেক আগে থেকেই বা বলা যায় চিরকালই চলে এসেছে। সামাজিক রক্ষণশীলতা আমরা ভালো করে ভাঙতে পারিনি; পুরুষতান্ত্রিকতা কিছুটা মুছেছে সমাজ থেকে, তবে সেটাও যথেষ্ট নয়।