মুজিব রহমান

গিলমামেশকে মহাকাব্যই বলা হয়। এটা আনুমানিক ৪১০০ বছর আগে রচিত হয়। বাস্তবিক এটিই সবচেয়ে প্রাচীন সাহিত্যকর্ম। পারস্য দেশের গল্প। টাইগ্রিস আর ইউফ্রেটিস নদীর অববাহিকাতে রাজত্ব করতেন গিলগামেস। সে দেবী আর মানুষের পুত্র। রাজত্ব, বন্ধুত্ব আর অমরত্ব খোঁজার অলৌকিক গাঁথা। হোমারের ওডিসি আর ইলিয়াড দেবতা আর মানুষের গল্প। দেবতাদের বহুমাত্রিক ষড়যন্ত্রের শিকার হওয়া মানুষদের অবস্থার বর্ণনা। দেবতাদের ইচ্ছা অনিচ্ছা, লোভ-লালসার বলি হতে হয় মানুষকে। আবার মানুষ ও দেবতা/দেবীর প্রণয়ও ঘটে। ভারতের দুটি প্রধান মহাকাব্য হল রামায়ণ ও মহাভারত। রামায়ণ-মহাভারত জুড়েও দেবতা ও মানুষের গল্পই রয়েছে। রামায়ণ ও মহাভারত রচিত হয় খৃস্টপূর্ব তৃতীয়/চতুর্থ শতকে। এ দুটি অবশ্য হিন্দু ধর্মগ্রন্থের মর্যাদা পেয়েছে। তবে এগুলো আসলে সাহিত্য অর্থাৎ মহাকাব্য হিসাবেই খ্যাত। সম্ভবত রামায়ণ মহাভারতের আগে বা সমসাময়িক ছিলেন গৌতম বুদ্ধ। বৌদ্ধ ধর্মকে অনেকে বলেন নাস্তিক্যবাদী ধর্ম। বৌদ্ধ ধর্মের মূল গ্রন্থ ত্রিপিটক। যা সংকলীত হয় গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর পর। অবশ্য প্রধান ধর্মগ্রন্থগুলোর সবই প্রেরিতপুরুষদের মৃত্যুর পরেই সংকলিত হয়েছে। গৌতম বুদ্ধের সম্ভবত হাজার বছর (সাতশ বছরও হতে পারে) পূর্বেই আরবে আবির্ভাব ঘটেছিল মুছা নবীর। তাঁর অনুসারীদের ইহুদী বলা হয়। তাদের ধর্মগ্রন্থ তানাখ বা তাওরাত। মুসলমান ও খৃস্টান সম্প্রদায় এই কিতাবকে স্বীকার করে। প্রচলিত কেতাবী ধর্মগুলোর মধ্যে মুছা নবীর ইহুদী ধর্মই প্রাচীন। মুছা পৃথিবীর মানুষের কাছে দেবদেবীর পরিবর্তে ঈশ্বরের ধারণা দেন। তিনি ঈশ্বরের ডাক শুনেন এবং ইহুদীদের মাঝে গিয়ে ঘোষণা দেন, তিনি ঈশ্বরের প্রেরিত পুরুষ এবং ইহুদীদের রক্ষা করতে এসেছেন। ইহুদীরাও জানতেন তাদের রক্ষা করতে একজন কেউ আসবেন। একই রকমভাবে ইশা বা যিশুও আসেন ঈশ্বর বা আল্লার প্রেরিত পুরুষ হিসাবে। তাঁর ধর্ম খ্রিস্টান এবং ধর্মগ্রন্থ ইঞ্জিন বা বাইবেল। যিশুর ছয় শ বছর পরে আসে ইসলাম ধর্ম। মুসলমানের ধর্মগ্রন্থ কোরআন। মুসলমানরা যদিও দাবী করেন ইসলামই শেষ ধর্ম। তবে বর্তমানে প্রচলিত কয়েকটি ধর্ম এর পরেও এসেছে এবং টিকে রয়েছে। বর্তমান পৃথিবীতে প্রায় ৪৩০০টি ধর্ম টিকে রয়েছে। অনুসারীরা প্রত্যেকটিকেই শ্রেষ্ঠ এবং সঠিক বলেই দাবি করে। অনেক ধর্মেরই গ্রন্থ রয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি গ্রন্থ রয়েছে হিন্দু ধর্মের।

হিন্দু ধর্মের প্রাচীন গ্রন্থ হল বেদ। বেদের কোন রচয়িতা নেই। বলা হয় এগুলো অলৌকিকভাবে সৃষ্টি হয়েছে। বেদ প্রাচীন ঋষিদের ধ্যানে প্রকাশিত হয়েছিল যা সুরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। আবার মহাভারতে বলা হয়েছে ব্রহ্মা সৃষ্টি করেছেন বেদকে। বেদ হল চারটি যথা- ঋগে¦দ, যজুর্বেদ, সামবেদ ও অথর্ববেদ। বেদকে যারা স্বীকার করতো তারাই আস্তিক আর অন্যরা নাস্তিক। বাংলাদেশে যারা নিজেদের আস্তিক দাবি করে তাদের সকলেই কি বেদকে স্বীকার করে নেয়? বাস্তবিক তা নয়- তখনকার হিসেবে আজীবিক, চার্বাক, বৌদ্ধ, জৈন ও লোকায়ত- যাদের কাছে বেদের প্রামাণ্যতা স্বীকৃত নয়, মূলত তারাই ছিল নাস্তিক। হিন্দুদের উপনিষদ রয়েছে ১০৮ টি। এজন্যই হিন্দু ধর্মে ১০৮ সংখ্যাটি গুরুত্বপূর্ণ। তবে উপনিষদের সংখ্যা ২২৩টির তালিকাও পাওয়া যায়। পুরাণ রয়েছে বিভিন্ন রকমের। এরমধ্যে মহাপুরাণ ১৮/২০টি, উপপুরাণ ১৮টি ছাড়াও স্থলপুরাণ, কুলপুরাণ ইত্যাদি রয়েছে। এছাড়া ভগবদ্গীতা ও মনুসংহিতা হিন্দুদের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। তাহলে মহাভারত ও রামায়ণ কি?

মহাভারত ও রামায়ণকে পঞ্চবেদের মর্যাদা দেয়া হয় পরবর্তী কালে। মহাভারত ও রামায়নের চেয়েও বেদ পুরাতন। মহাকাব্যর যে সকল বৈশিষ্ট থাকে তার সবগুলোই রয়েছে মহাভারত ও রামায়ণে। এদুটো যে মহাকাব্য তাতে কারো কোন আপত্তি নেই। সুদীর্ঘকাল এদের জনপ্রিয়তাও ছিল সর্বোচ্চ। এখনো হিন্দু ছাড়াও অন্যদের কাছে এর আকর্ষণ, জনপ্রিয়তা ও গুরুত্ব রয়েছে। কি কারণে দুটি মহাকাব্য ধর্মগ্রন্থ হয়ে গেল আর কিভাবেই মহাকাব্যের চরিত্রগুলোও হয়ে গেল দেবদেবী? না দেবদেবীরাই ঢুকে পড়েছিল মহাকাব্যে? বিভিন্ন গবেষকগণ এ নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন, যুক্তি তুলে ধরেছেন। তাতে নিরপেক্ষ গবেষকগণ মহাভারত ও রামায়ণকে পৃথিবীর সেরা চারটি মহাকাব্যের দুটি বলেই স্বীকৃতি দিয়েছেন। পাশ্চাত্য সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন ইলিয়াড ও ওডিসি কেন ধর্মগ্রন্থ হল না? ইলিয়াড-ওডিসি খৃস্টপূর্ব ৭ম বা ৮ম শতকে রচিত। এই মহাকাব্য দুটির মতোই দেবদেবি ও মানুষের গল্প নিয়ে মহাভারত ও রামায়ন লেখা হয়েছে বলে অনেকে বলেন তা তা ইলিয়াড-ওডিসির অনুকরণেই লেখা হয়েছে। যখন ইলিয়াড-ওডিসি লেখা হয় তখন ইউরোপে ছিল দেবদেবী নির্ভর প্যাগান ধর্ম। সেই ধর্মের দেবতারাই ঢুকে পড়েছিল মহাকাব্য দুটিতে। পরবর্তীতে তৃতীয় শতকে স¤্রাট কনস্টান্টাইন যখন খৃষ্টধর্মকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন এবং ইউরোপ থেকে প্যাগান ধর্মকে বিতাড়িত করতে সক্ষম হন তখন ইলিয়াড-ওডিসি টিকে গেলেও তা ধর্মগ্রন্থের মর্যাদা লাভের সুযোগ হারায়। কিন্তু ভারত বর্ষে আজও সিংহভাগ মানুষ দেবদেবী নির্ভর ধর্মে বিশ্বাসী। মহাভারত-রামায়নে থাকা দেবদেবীদের এখনো আরাধনা করা হয়। মানুষ ভেবে নেয় একগুলো সত্যিকারের ঘটনা। ফলে মহাকাব্য রূপলাভ করে ধর্মগ্রন্থ হিসেবে।


রাম যেকোন মহাকাব্য বা উপন্যাসের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হতে পারত। তিনি যোদ্ধা, স্বয়ম্বরা সভা থেকে বিজয়ী হয়েই সীতাকে জয় করে আনেন। রানীর ষড়যন্ত্রে পিতা যখন বনবাসে পাঠায় তখনও পিত্রাজ্ঞাকেই গুরুত্ব দিয়েছেন। রাবন যখন বোনের অসম্মান আর ভাইয়ের হত্যার প্রতিশোধ নিতে কৌশলে সীতাকে অপহরণ করে নিয়ে যায় সেখানেও তিনি সীতাকে উদ্ধার করে বীরত্ব দেখান। দক্ষিণি সিনেমার চেয়েও শক্তিশালী ও কৌশলী। তবে দেবতা হিসেবে তিনি কি ভুলত্রæটির ঊর্ধ্বে ছিলেন? না মানবিক ভুলকেই বাল্মীকি গুরুত্ব দিয়েছিলেন? সত্য ও দ্বাপর যুগের পরে আসে ত্রেতা যুগ। ত্রেতা যুগে রাম ১১ হাজার বছর রাজত্ব করেন! রাম রাজত্বে রামকে আমরা তার কর্মেই খুঁজে দেখতে পারি।

১। রামের প্রতিনিধি হিসেবে ভরত তখন রামের পাদুকা সিংহাসনে রেখে রাজ্য শাসন করছেন। রাম তখনও বনবাসে। সীতাকে অপহরণ করেছে রাবন। রাম সুগ্রীবের সাথে চুক্তি করলেন- বালীকে বধ করে সুগ্রীবকে কিস্কিন্ধ্যার রাজা করবেন আর সুগ্রীবের স্ত্রীকেও ফিরিয়ে এনে দিবেন। বিনিময়ে বানর সৈন্য দিয়ে সীতাকে উদ্ধারে সুগ্রীব সহযোগিতা করবেন। রাম কৌশলে সুগ্রীবকে বালরি সংগে মল্লযুদ্ধে লাগিয়ে দিলেন। বালীর বর ছিল সামনা থেকে কেউ তাকে হত্যা করতে পারবে না। রাম পেছন থেকে বালীকে হত্যা করলেন। মৃত্যুশয্যায় বালী রামকে দুরাত্মা, অধার্মিক, ক্ষত্রিয়ধর্ম বিরোধী এবং পাপী বলে গালি দিলেন। প্রতিউত্তরে রাম বললেন, ‘ভরত পৃথিবীর রাজা। আমরা তার আদেশে ধর্মবৃদ্ধির অভিলাষে সমগ্র ভূমÐল পর্যটন করছি এবং তোমার মতো অধার্মিককে দÐ করছি।
বালীর সাথে রামের কোন দ্ব›দ্ব ছিল না। বালীকে অন্যায়ভাবেই হত্যা করা হয়েছে। আবার তিনি ভরতের আদেশেও হত্যা করেননি অথচ সেটাই দাবী করছেন।

২। রাম বনবাসের আগে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, তিনি ফলমূল খেয়েই জীবন ধারন করবেন। বনে তারা কুটির নির্মাণ করে থাকতেন। বিভিন্ন পশু শিকার করে ক্ষুধা নিবারণ করতেন। সীতার সতিত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তাকে অগ্নিপরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়। সীতা অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে রাম অগ্নির কাছে প্রতিজ্ঞা করেন, কীর্তি যেমন মানুষের অত্যাজ্য তেমনি সীতাও আমার অপরিত্যাজ্য। অযোধ্যায় ফিরে আসলে এবং সীতার গর্ভলক্ষণ দেখে সে এক সভাসদের কাছে জানতে চায়, সীতার সতিত্ব নিয়ে প্রজারা কি বলে? প্রজাদের একাংশ সীতার বিরুদ্ধে বললে তিনি সীতাকে পরিত্যাগ করেন। লক্ষণকে দিয়ে তপোবনে সীতাকে ছেড়ে দিয়ে আসলেন। রাম তার আর খোঁজ নেননি। বহু বছর পরে যখন জানলেন সীতা বাল্মীকির আশ্রমে জীবিত আছেন। সীতাকে আবারো পরীক্ষার আহŸান জানালে তিনি ধরণীকে বিদীর্ণ হতে বলেন এবং নিজে পাতালে প্রবেশ করেন।
মাংস না খাওয়ার প্রতিজ্ঞা তিনি রক্ষা করতে পারেন নি। সীতার সতিত্ব নিশ্চিত জেনেও তাকে অসম্মান করেছেন আবার পরিত্যাগ না করার প্রতিজ্ঞা করেও পরিত্যাগ করেছেন।

৩। বিশ্বামিত্র তাড়কাবধের জন্য দশরথের কাছ থেকে কিশোর রাম ও লক্ষণকে নিয়ে গেলেন। তখন আর্য সমাজে স্ত্রীবধ রীতি বিরুদ্ধ ছিল। তাড়কা তপোবনে ব্রাহ্মণদের যাগযজ্ঞে নানা প্রকার বিঘœ সৃষ্টি করতো বলে তাকে হত্যা করলেন। রাম দুষ্কর্ম দমনের জন্য পুষ্পক রথে চড়ে অন্বেষণ করতে করতে দেখলেন, এক তাপস বৃক্ষে লম্বমান হয়ে অতি কঠোর তপস্যা করছে। রাম তাকে জ্ঞিাসা করলেন তুমি ব্রাহ্মণ না ক্ষত্রিয়, বৈশ্য না শূদ্র? সত্যবাদী তাপস শম্বুক উত্তর দিলেন, তিনি শূদ্রযোনিতে জন্মেছেন এবং সশরীরে দেবত্ব লাভের ইচ্ছায় কঠোপর তপস্যা করছেন। শূদ্রের পক্ষে তপস্যা করা গুরুতর অপরাধ। তাই রাম শম্বুকের শিরচ্ছেদ করলেন।
নারী ও শূদ্রকে হত্যা করা হয়েছে যারা রামের কোন ক্ষতি করেনি। তাড়কাকে রাক্ষসী বলা হয়েছে। তবুও নারীকে হত্যা ও শূদ্রকে তপস্যা করার অপরাধে হত্যা করা মানানসই নয়।

ইলিয়াড ও ওডেসির অলৌকতা ও দেবতাদের কুটিলতা দেখে আমরা মিলিয়ে নিতে পারি। বাল্মিকী রামায়ণে যে রামকে সৃষ্টি করেছেন তার মধ্যে যেমন সাধুতা রয়েছে তেমনি ভুলত্রæটিও রয়েছে। মহাকাব্য বলেই মানুষের ভিতরের ভাল ও মন্দকে তুলে আনতে পেরেছেন। এমনটা অন্য চরিত্রগুলো সম্পর্কেও বলা সম্ভব।


মহভারত মোটামুটি খ্রিস্টপূর্ব অস্টম শতাব্দী থেকে লোকমুখে প্রচারিত হয়েছিল। খৃস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে প্রথম লেখা হয়। এর আগে পরে মহাভরতের কলেরব বৃদ্ধি পেতে থাকে। সুবিশাল মহাকাব্যটি অবয়ব ও আকর্ষণীয়তায় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ। ধর্মীয় স্বীকৃতি না পাওয়ায় ইলিয়াড-ওডেসির কোন ক্ষতি হয়নি আবার মহাভারত-রামায়ণেরও ধর্মীয় স্বীকৃতি এর কোন উপকারও করেনি বরং অন্য ধর্মাবলম্বীদের কাছে আকর্ষণহীন করেছে। আমার হিন্দু বন্ধুদের এমন কাউকে দেখিনি যারা মভাভারত ও রামায়ণ পড়েছে। তারা হয়তো মনে করেছে অন্যন্য ধর্মগ্রন্থের মতোই এটি রসকসহীন ও প্রাচীন ধর্মীয় বাণিতে পূর্ণ। ভারতে রামায়ণ-মহাভারত যতটা পূজিত ততটা পঠিত হয় না একারণেই। কাশীরাম দাস যতই বলুক ‘মহাভারতের কথা অমৃত সমান’ কেউ শুনে পুণ্যবান হতে চায় না। অবশ্য ব্যাসদেবের মহাকাব্যে এমন বাক্য নেই।

মহাভারত থেকে আমরা খৃস্টপূর্ব ভারতের সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক সম্পর্কে ধারণা পাই। ধর্মীয় চেতনা ও মূল্যবোধ, পারিবারিক দ্ব›দ্ব-সংঘাত, রাজনৈতিক অবস্থা, যুদ্ধের কৌশল ও অস্ত্রের ব্যবহার সম্পর্কে জানতে পারি। উপন্যাসকে আমরা সমাজচিত্র বলি তেমনি মহাকাব্যটি থেকেও ওই সমাজের চিত্র পাই। পারিবারিক মূল্যবোধ, কর্তৃত্ব, নারীর সম্মান ও অধিকার, বড় ভাইর ক্ষমতা ও অধিকার, বর্ণপ্রথার প্রাবল্য, শূদ্রদের অধিকারহীনতা ইত্যাদি বিষয়ে অবগত হই। তবে ধর্মীয় স্বীকৃতি একটা বড় ক্ষতি করেছে। দৈব নির্দেশ অলঙ্ঘণীয় তা মানুষ বিশ্বাস করে বসেছে। মহাভারতের বহু বিষয়ই মনে হয় পূর্ব নির্ধারিত দেবদেবীর অভিশাপ বা ইচ্ছায় সংঘটিত। রয়েছে অসংখ্য অলৌকিক ঘটনা। মানুষ সে ঘটনাকেই বাস্তব বলে বিশ্বাস করে বসেছে। আছে জন্মান্তরের ঘটনা। এক জন্মের পাপের ফল ভোগ করছে অন্য জন্মে। ফলে জন্মান্তরবাদে বিশ্বাস অটুট রেখেছে। অলৌকিক ঘটনা অসংখ্য। মানুষ অলৌকিক ঘটনাকে সত্য ধরে নিয়েছে। অদৃষ্ট খণ্ডানো যায় না এমন ভাবনা তাদের সীমা অতিক্রমে বাঁধা দিয়েছে। সবচেয়ে ক্ষতি করেছে জাতপাতের বিষয়টি।

মহাভারতের অনুশাসনিক পর্বের দশম অধ্যায় থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ শুনি-
ধর্মরাজপুত্র যুধিষ্ঠির গঙ্গাপুত্র ভীষ্মকে জিজ্ঞেস করলেনে, ‘হে পিতামহ, হীনজাতিকে সহৃদয়ভাবে উপদেশ দান করলে শুনেছি দোষের ভাগীদার হতে হয়, এ সম্পর্কে আপনি কিছু বলুন’।
ভীষ্ম বললেন, ‘হ্যাঁ তুমি ঠিকই শুনেছো। শাস্ত্র অনুসারে, হীনজাতিকে উপদেশ প্রদান করলে অপরাধী হতে হয়’।

আমরা কি শিখলাম। শূদ্রদের উপদেশ দান করাও অপরাধ। তাদের শাস্ত্রপাঠ অপরাধ। শূদ্রদের কি পূণ্য হবে মহাভারত পাঠে? এখানেতো শুধু ব্রাহ্মণ আর ক্ষত্রিয়দেরই জয়জয়াকার। তাদেরই শৌর্যবীর্য।


রাক্ষস কি কোন দিন ছিল, না আছে? হনুমানের পক্ষে কি সূর্যকে বগলদাবা করে রাখা সম্ভব? বানরকূল কি কথা বলতে পারতো, না পারে? এমন অসংখ্য প্রশ্ন আসতে পারে। যখন এটা সাহিত্য হয় তখন রূপকথা হিসেবে মানুষ পড়বে ও আনন্দ লাভ করবে। কিন্তু ধর্মগ্রন্থ হিসেবে পড়লে তাকে অবশ্যই পশ্চাৎপদ হতে হবে। ১৯৮৮-১৯৯০ সালে ভারতীয় জাতীয় টেলিভিশনে রামায়ণের সম্প্রচারের পরিণতি আমরা দেখেছি, উগ্র হিন্দুদের দ্বারা বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা। যদি এটাকে ধর্মগ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা না করা হতো তাহলে এতোটা উগ্র হয়ে উঠতো না ভারতের ধর্মান্ধ মানুষ। যুধিষ্ঠির জুয়ায় আসক্ত হওয়া থেকে আমরা কি শিখবো? তিনিতো সবকিছু হারতে হারতে সর্বশেষ নিজের স্ত্রীকেও জুয়ার বোর্ডে তুলে দিলেন। শ্রীকৃষ্ণ তার প্রথম স্ত্রীকে এক স্বয়ংবরা সভা থেকে তুলে এনে বিয়ে করলেন। কি শিখবো নারী সম্পর্কে? ধর্মগ্রন্থতো শাশ্বত, সবসময় শিক্ষা দেয়ার কথা, সে উদাহরণই থাকবে। শ্রীকৃষ্ণ বা অর্জন কি মিথ্যার আশ্রয় নেয় নি? মিথ্যা বলাকে কি সমর্থন করবো?

যখন সাহিত্য হবে, পোৗরণিক কল্পকাহিনী হবে তখন আমরা তুলনা করবো, চরিত্র বিশ্লেষণ করবো। চরিত্রগুলো মন্দ হলেও তা মহৎ মহাকাব্য হতে পারে। সেভাবেই মহাভারত মহৎ মহাকাব্য। কিন্তু ধর্মগ্রন্থ হিসেবে?


অন্ধ কবি হোমারকে সবাই চিনে। তাঁর রচিত মহাকাব্য ওডেসি ও ইলিয়াড জনপ্রিয় হওয়ায় হোমারও শ্রদ্ধেয় বিশ্বব্যাপী। কিন্তু মহাভারত ও আরো আঠারোটি পুরাণের রচয়িতা হওয়া সত্তে¡ও কৃষ্ণ দৈপায়নকে তেমনভাবে কেউ চিনে না। বেদের শ্রেণিবিভাজন করায় তাকে বেদব্যাস বলা হয়। তারই আরেক নাম ব্যাসদেব। মহাভারতে মুণিঋষিগণ খুবই যৌন কাতর। কাকে দেখে কার বীর্য যে কোথায় স্খলন ঘটে আর কার জন্ম হয় তার কোন সীমা নাই। মহাভারতে অযৌনভাবে জন্ম নেয়াদের সংখ্যাও কম নয়। দ্রৌপদীর জন্ম হয় যজ্ঞবেদী থেকে। আবার দ্রৌপদী পঞ্চপান্ডবের অর্থাৎ পাঁচ ভাইর স্ত্রী হন। ব্রহ্মা এক পরমাসুন্দরী নারী সৃষ্টির মানসে অহল্যাকে সৃষ্টি করেছিলেন। দেবরাজ ইন্দ্র অহল্যাকে ধর্ষণ করেছিলেন বলে অহল্যার স্বামী গৌতম মুণি তাকে অভিশাপ দিয়েছিলেন। কুন্তির বিয়ের আগেই এক সন্তানের জন্ম হয়। তার নাম কর্ণ। কর্ণ আবার কুন্তির জননাঙ্গ দিয়ে জন্ম নেয় নি। সে কুন্তির কান দিয়ে জন্ম নিয়েছে বলেই তার নাম কর্ণ। কুন্তির অন্য সন্তানরাও পাণ্ডবের নয়- একেক দেবতার সন্তান একেকজন। যেমন দেবরাজ ইন্দ্রের ঔরসে জন্ম নেয় অর্জুন।

কৃষ্ণ দৈপায়নের জন্মও কি স্বাভাবিক? একদিন পরাশর মুণি অনার্য সত্যবতীর নৌকায় করে নদী পার হওয়ার সময় তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে যৌনমিলনের প্রার্থনা করলেন। সত্যবতী বললেন, তিনি কুমারী, কৌমার্য নষ্ট হলে সমাজ তাকে পরিত্যাগ করবে। পরাশর মুণি বললেন, পুত্রলাভ হলেই তিনি আবারো কুমারী হয়ে যাবেন। সত্যবতী বললেন, দিনের বেলায় মানুষ দেখে ফেলবে তাছাড়া আমার শরীরে মাছের দুর্গন্ধ। কামার্ত পরাশর তখন নিজেদের চারদিকে কুয়াশার আবরণ সৃষ্টি করলেন এবং সত্যবতীর শরীরে মৃগনাভির সৌরভ দিলেন। নদীবক্ষে তারা মিলিত হলে সত্যবতীর গর্ভে ব্যাসদেবের জন্ম হয়। দীপে জন্ম হয় ও গায়ের রং কালো বলে ব্যাসদেবের নাম কৃষ্ণ দৈপায়ন। তার মা সত্যবতী নিজেই মহাভারতের একটি চরিত্র- যুধিষ্ঠির পিতা পান্ডুর ঠাকুমা তিনি। সত্যবতীকে রাজা শান্তনুর বিয়ে করেন। তার দুই পুত্র চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য। দুই পুত্র উত্তরাধিকারী না-রেখেই অকালে মারা যায়। সত্যবতীর সৎ পুত্র ভীষ্মও বিয়ে করবেন না বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তাহলে কুরুবংশ রক্ষা পাবে কিভাবে? উদ্বিগ্ন সত্যবতী তখন তার সেই অবিবাহিতকালীন সময়ে পরাশর মুণির ঔরসে জন্ম নেয়া পুত্র কৃষ্ণ দৈপায়ন ওরফে ব্যাসদেবকে ডেকে আনেন। তাকে নির্দেশ দেন ভ্রাতৃবধূদের গর্ভবতী করার জন্য। ব্যাসদেবের ঔরসেই জন্ম নিল ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডু। ধৃতরাষ্ট্র থেকেই আসলো কৌরব বংশ তথা- দুর্যোধন, দুঃশাসন ও আরো ৯৮ ভাই। আর পাণ্ডু থেকে আসলো পাণ্ডব বাংশ তথা- যুধিষ্ঠির, অর্জুন, ভীম, সহদেব, নকুল। এই দুই বংশের দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিয়েই মহাভারত। অর্থাৎ প্রকৃত প্রস্তাবে ব্যাসদেবের অবৈধ সন্তানরাই বিচরণ করেছে মহাভারতে। এমন যৌনতা, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, অনাচার-মিথ্যাচার-প্রতারণার গল্প কি ধর্মগ্রন্থ হবে? না মহাকাব্যেই সম্ভব।

মহাভারত সুবিশাল। এটি রামায়ণের চারগুণ আর হোমারের ইলিয়াড-ওডেসির মিলিত আকৃতির দশগুণ। এতো বিশাল মহাকাব্য লিখে, বেদের বিভাজন করে এবং গুরুত্বপূর্ণ ১৮টি পুরাণ লেখার পরেও কেন হোমারের মতো এতো সুপরিচিত হলেন না কৃষ্ণ দৈপায়ন? মহাভারত যতটা সুপরিচিত কেন তার শত ভাগের এক ভাগও পরিচিতি নেই কৃষ্ণ দৈপায়নের? কারণ সেই একই- মহাভারতের ধর্মগ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া। ধর্মগ্রন্থ আসে স্রষ্টার কাছ থেকে বা দৈব ভাবে। অনেক ধর্মগ্রন্থ যার উপর নাযিল হয় তারও গুরুত্ব থাকে। তাওরাতের জন্য মুছা, বাইবেলের জন্য মুছা, কোরানের জন্য নবী মহাম্মদ (সা.)‘র গুরুত্ব রয়েছে। কিন্তু কৃষ্ণ দৈপায়ন বা ব্যাসদেবতো প্রকৃতপ্রস্তাবে প্রেরিত পুরুষও নন। শুধু বলতে পারি ধর্মের কারণে বেচারা তার রচনার তুলনায় অনেক ছোট হয়েই থাকলেন। রামায়ণের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।


ভারত ভাগের কারণ কি? কোটি কোটি মানুষকে কেন বাস্তুভিটা ছাড়তে হল? কেন দাঙ্গায় হাজার হাজার মানুষ খুন হয়? সকল প্রশ্নের উত্তর একটিই- ‘ধর্মীয় বিদ্বেষ, হিংষা ও ঘৃণা’। এই ঘৃণা, হিংষা, বিদ্বেষের উৎস কি? উত্তর কি হবে? ধর্মীয় গ্রন্থ! মহাভারত ও রামায়ণের মহাকাব্যিক কল্পকাহিনীতে থাকা যুদ্ধ, হিংষা, বিদ্বেষ এর কি দায় আছে? গবেষকগণ যতই বলুক- এগুলো মহাকাব্য, কল্পকাহিনী। কিন্তু তাতে মৌলবাদী শক্তি কিন্তু থামেনি। তারা এগুলোকে ঐতিহাসিক সত্য বলেই মনে করে আসছে। সেই হিংষা, বিদ্বেষকেই শক্তি হিসেবে নিয়ে তার প্রয়োগ ঘটাচ্ছে। বিশেষ করে রামায়ণের চরিত্র ও স্থানগুলোকে সত্য ধরেই ভারতের ধর্মান্ধ মানুষ রামরাজ্য প্রতিষ্ঠায় দীর্ঘদিন ধরেই তৎপর রয়েছে। অযোধ্যায় রাম জন্মগ্রহণ করেছিলেন তাই সেখানকার বাবরি মসজিদকে ধ্বংস করে রাম মন্দির নির্মাণ করতেই হবে। ভারতের আদালতও রায় দিল- আগে মন্দির ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি তবে মসজিদ সরিয়ে মন্দির নির্মাণ করতে হবে। ভারতের ইতিহাসে তালগাছবাদী তত্তে¡র চূড়ান্ত ব্যবহারিক প্রয়োগ দেখলাম।

মহাভারতের কৃষ্ণ জন্ম নিয়েছেন মথুরায়। সেখানে কৃষ্ণের জন্মস্থান চিহ্নিত করার সুযোগ না থাকলেও, মৌলবাদীরা ধরে নিয়েছে। যে কক্ষে কৃষ্ণের প্রকৃত পিতা ও মাতা কারারুদ্ধ ছিলেন তারও কক্ষ চিহ্নিত করে নিয়েছে ধর্মান্ধরা। তারা দাবী করছে কৃষ্ণের জন্ম ৭ হাজার বছর আগের। কোনরূপ প্রমাণ ছাড়াই শুধু মহাভারতের কল্পকাহিনীর উপর ভিত্তি করেই তারা ব্যবহারিক প্রয়োগ ঘটাচ্ছে। সাম্প্রতিক একটি দাবি দেখছি মথুরার একটি মসজিদকেও মন্দির বানানোর। বিজেপির আগামী অস্ত্র হতে পারে মথুরার মসজিদটিও।

তাহলে অযোধ্যার এই দীর্ঘ হানাহানি, মসজিদ ভেঙ্গে মন্দির বানানো, গোধরার মুসলিম হত্যা এর কারণ অবশ্যই রামায়ণ। আর মধুরার মসজিদ ভাঙ্গার যে দাবী উঠছে তার কারণ মহাভারত। রামায়ণ ও মহাভারত মহাকাব্যদুটি ধর্মগ্রন্থের মর্যাদা দেয়ায় এর ভিতর থেকে রস আস্বাদনের পরিবর্তে আস্বাদিত হচ্ছে হিংষা-বিদ্বেষ ও ঘৃণা। ভালবাসার ও ত্যাগের নজির থাকলেও গৃহিত হয়েছে হত্যা ও ধর্ষণ। দক্ষিণ এশিয়ায় যেখানে যে ধর্মের মানুষ সংখ্যাগরিষ্ঠ সেখানেই তারা দানবের আচরণ করেছে, সংখ্যালঘুদের তাড়িয়ে তাদের জমি/ব্যবসা দখলে নিয়েছে, নারীদের ধর্ষণ করেছে, শিশু-নারী-বৃদ্ধসহ যাকে পেয়েছে তাকেই হত্যা করেছে বা ভয় দেখিয়েছে, নিপীড়ন করেছে।

পশ্চিম পাকিস্তানে ১৯৫১ সালেই হিন্দুদের সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ১.৬% আর পূর্ব পাকিস্তানে ২২%। ১৯৩১ সালে পূর্ববাংলায় হিন্দু ছিল ২৮% ভারত ভাগের আগের এক দাঙ্গাতেই হিন্দু কমে যায় ৬%। এরপর গত শতাব্দী ধরেই হিন্দুরা বাংলাদেশ ছেড়েছে ধারাবাহিক ভাবে। এই শতাব্দিতে এসেই আমরা দেখি হিন্দুদের দেশত্যাগ কমেছে। ১৯৯২ সালের অযোধ্যার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঢেউ লাগে বাংলাদেশে। ধর্মান্ধ জিহাদীদের দৌরাত্মা বেড়ে যায়। বাংলাদেশে ওই সময়ে হিন্দুদের উপর অধিক নিপীড়নের ঘটনা ঘটে, দেশ ছাড়ার গতি বেড়ে যায়। যদি ভারতে আবারও মথুরার মসজিদ বা অন্যকোন ইস্যুতে মুসলিমদের ব্যাপক নিপীড়ন করা হয় তার ঢেউ আবারো আছড়ে পরতে পারে বাংলাদেশেও। মানুষকে বিজ্ঞানমনস্ক করতে না পারলে দক্ষিণ এশিয়ার আকাশ থেকে অন্ধকার মেঘ কাটবে না। ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তানের সুশিক্ষিত সচেতন ও অগ্রসর চিন্তার মানুষ কম নয়। তারা দেশ ছাড়ে কিন্তু দেশের মানুষকে এগিয়ে নিয়ে ধর্মান্ধতা ছাড়াতে ভূমিকা রাখে না। আজকের পৃথিবীতে চলতে হলে, টিকতে হলে বিজ্ঞানমনষ্ক হওয়া ছাড়া কোন বিকল্প নেই।
কৃষ্ণ ও পাণ্ডবরা কতটা ন্যায়যুদ্ধ করেছেন?


ক্যারেন আর্মস্ট্রং তার ‘স্রষ্টার ইতিবৃত্ত’ বইতে লিখেছেন, ‘অলৌকিক বিষয়াদি দ্বারা এখন আর মানুষ পরিবেষ্টিত থাকে না ফলে অনেকেই ধর্মকে অপ্রাসঙ্গিক মনে করতে পারছে। আমাদের বিজ্ঞানভিত্তিক সংস্কৃতি আমাদের চোখের সামনে থাকা ভৌত ও বস্তুজগতের দিকে মনোযোগ দিতে শেখায়’। মানে আমরা যখন অলৌকিক বিষয়ের মধ্যে থাকবো তখন আমাদের বিজ্ঞানমনষ্ক হওয়া সহজ হবে না। তবে আমরা বিজ্ঞানমনষ্কতা দিয়ে যাচাই করতে পারি অলৌকিকতাকে।

মহাভারতে কৃষ্ণ অর্জুনকে বহু উপদেশই দিয়েছেন। একটি উপদেশ এমন, ‘অনেক ক্ষেত্রেই সরাসরি মিথ্যা কথা বলা সম্পূর্ণ ধর্মসম্মত। বিবাহ, রতিক্রীড়া, প্রাণবিয়োগ ও সর্বস্বাপহরণকারে এবং ব্রাহ্মণের নিমিত্ত মিথ্যা প্রয়োগ করলেও পাতক হয় না’। ব্রাহ্মণের হিতের জন্য মিথ্যাকথনকে কিভাবে সমর্থন করি। কৃষ্ণ অর্জুনকে সমস্ত জ্ঞাতিনিধনের উদ্দেশ্যে যুদ্ধে প্রবৃত্ত করাই ছিল মূল লক্ষ্য। এই ভয়ঙ্কর যুদ্ধে কৃষ্ণ নিজে অসংখ্য মিথ্যা ও ছলনার আশ্রয় নিয়েছিলেন। মহাভারত জুড়েই রয়েছে বহু ছলনা। উদাহরণ দিচ্ছি-

দ্রোণাচার্য কর্তৃক একলব্যের আঙুল কাটা কি নৈতিক?
আমরা গুরুর প্রতি একনিষ্ঠ ভক্তির উদাহরণ দিয়ে একলব্যকে ধন্যবাদ দেই। তিনি গুরুদেব দ্রোণাচার্যের কাছে গিয়েছিলেন যুদ্ধবিদ্যা শিখতে। একলব্য ক্ষত্রিয় ছিল না বলে তাকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করতে রাজি হলেন না দ্রোণ। একলব্য দ্রোণকেই গুরু মেনে একমনে যুদ্ধবিদ্যা শিখতে লাগলেন। একলব্য যুদ্ধ বিদ্যায় খুবই পারঙ্গমতা অর্জন করলেন। একদিন দ্রোণ যখন জানতে পারলেন তিনি একলব্যের মানসগুরু। তিনি ছলনার আশ্রয় নিলেন। গুরুদক্ষিণা হিসেবে একলব্যের হাতের বুড়ো আঙুল চেয়ে বসলেন যাতে তার ক্ষত্রিয় শিষ্যরাই বিজয়ী হয়।

জতুগৃহে পুড়িয়ে মারা কি নৈতিক?
দুর্যোধন পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারার জন্য জতুগৃহ নির্মাণ করে সেখানে পাণ্ডবদের পাঠান। যুধিষ্ঠির আগেই জেনে যান ষড়যন্ত্রের কথা। তারা নদীতীর পর্যন্ত একটি সুড়ঙ্গ খনন করেন। পঞ্চপান্ডবদের মা কুন্তি একটি ভোজসভার ব্যবস্থা করেন। নিষাদ জননী ও তার পঞ্চপুত্রদের আপ্যায়ন করে ঘরের মধ্যে রেখে আগুন লাগিয়ে দিয়ে তারা সুরঙ্গ পথে পালিয়ে যান। ঘরে থাকা নিমন্ত্রিত লোকেরা মারা যায়। এতে দুর্যোধন আগুনে পুড়ে যাওয়া মৃতদেহ দেখে ভাববেন যে পাণ্ডবরা সবাই মারা গেছে।

দ্রৌপদীকে মিথ্যা পরিচয়ে বিয়ে করে পাঁচ ভাইর বউ বানানো কি নৈতিক?
রাজকন্যা দ্রৌপদীকে বিয়ে করার জন্য সয়ম্বরা সভায় শর্ত ছিল- শূন্যে ঘুরন্ত মাছের চোখে জলে প্রতিবিম্ব দেখে যে তীর বিদ্ধ করতে পারবে তাকেই স্বামীরূপে বরণ করবে। কর্ণ এই কাজ সম্পাদন করতে পারতেন। কিন্তু দ্রৌপদী আপত্তি করেন, সূতজাতকে বরণ করব না’। কুন্তির বিয়ের আগের পুত্র কর্ণ অর্থাৎ অর্জুনের সৎ ভাই। অর্জুন ছলনার আশ্রয় নেয়। নিজেকে ব্রাহ্মণপুত্র ঘোষণা দিয়ে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে এবং বিজয়ী হয়ে দ্রৌপদীকে বিয়ে করে নিয়ে আসে। কুন্তী বলে, যা এনেছো তাই পাঁচ ভাই ভাগ করে নেও। সে কথাতেই দ্রৌপদী হয়ে গেল পাঁচ ভাইর স্ত্রী।

যুধিষ্ঠির কি দ্রৌপদীর অনুমতি ছাড়া তাকে বাজিতে ধরতে পারেন?
দুর্যোধন পাশা খেলতে জানতেন না। তার মামা শকুনির পরামর্শে তিনি যুধিষ্ঠিরকে আমন্ত্রণ জানান পাশা খেলতে। যুধিষ্ঠির রাজী হয়ে যায়। পাশা খেলায় যুধিষ্ঠির তার রাজ্যপাট হারান। ভাইদের ও নিজেকেও বাজি ধরে হারেন। সর্বশেষ তিনি দ্রৌপদীকেও বাজি ধরেন এবং বাজিতে হেরে হান। দ্রৌপদী তখন পাঁচ ভাইর স্ত্রী। সমান ভাগিদার। তাকে একা কি জুয়া খেলায় বাজি ধরতে পারেন? জুয়ায় হেরে গিয়ে ১২ বছর বনবাস ও ১ বছর অজ্ঞাতবাসের শাস্তি পান। দ্রৌপদীকে জোর করেই সভায় আনা হয়। সেখানে কর্ণের নির্দেশে দুঃশাসন তার বস্ত্রহরণ শুরু করে। শেষ মূহুর্তে কৃষ্ণ ভূমিকা রাখেন তাতে দুঃশাসন কাপড় খুলে শেষ করতে পারেন না। কোন ব্যক্তিকে কি তার অনুমতি ছাড়া অন্যকে জুয়ায় বাজি ধরতে পারেন?

অর্জুনের কি বনবাসের প্রতিজ্ঞা সম্পন্ন হয়েছিল?
যুধিষ্ঠির যখন দ্রৌপদীর সঙ্গে সহবাস করছিলেন তখন অর্জুন ঘরে ঢুকে পড়ে। অর্জন পূর্বশর্ত পালনের জন্য বারো বৎসর বনবাসের প্রতিজ্ঞা করে বেরিয়ে পড়লেন। তিনি প্রথমে গঙ্গাদ্বারে গিয়ে নাগকন্যা উলুপীকে বিয়ে করলেন। এরপর মণিপুরে গিয়ে রাজকন্যা চিত্রাংগদাকে বিয়ে করে তিন বছর মণিপুর রাজপ্রসাদেই বাস করলেন। শেষে দ্বারকায় গিয়ে সুভদ্রাকে হরণ করে বিয়ে করলেন এবং এক বছর তার সঙ্গেই দ্বারকায় থাকলেন। এটাকি বনবাস হল?

ভীমের জরাসন্ধকে হত্যা কি নৈতিক ছিল?
জরাসন্ধ ছিলেন তখন সবচেয়ে পরাক্রমশালী রাজা। তিনি জীবিত থাকতে যুথিষ্ঠির পক্ষে রাজসূয় যজ্ঞ করা সম্ভব ছিল না। এর আগে কৃষ্ণ ও তার জ্ঞাতিরা জরাসন্ধের কাছে বারবার পরাজিত হয়েছেন। কৃষ্ণ, অর্জুন ও ভীম ব্রাহ্মণের বেশ ধরে পেছনের দরজা দিয়ে জরাসন্ধের রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করে তার সামনে উপস্থিত হন এবং তারপর নিজেদের প্রকৃত পরিচয় প্রকাশ করে জরাসন্ধকে মল্লযুদ্ধে আহŸান করেন। জরাসন্ধ তাদের এই ছলনার নিন্দা করলেও ভীমের সঙ্গে মল্লযুদ্ধে সম্মত হন এবং চৌদ্ধ দিন ধরে যুদ্ধ চলাকালে কৃষ্ণ, ভীম ও অর্জুনকে নিরাপদে অতিথি হিসেবে নিজ প্রাসাদে রাখেন। ক্ষত্রিয়রীতিতে ক্লান্ত এবং যুদ্ধবিমুখ যোদ্ধাকে বধ না করে সময দেবার প্রথা ছিল। কিন্তু এরকম অবস্থাতেই কৃষ্ণের কুটিল ইংগিতে ভীম জরাসন্ধকে বধ করেন।

কৃষ্ণ কর্তৃক শিশুপালকে হত্যা করা কি নৈতিক ছিল?
যুধিষ্ঠির তার রাজসূয় যজ্ঞে কৃষ্ণকে শ্রেষ্ঠ অতিথি হিসেবে অর্ঘদান করেছিলেন। শিশুপাল এর বিরোধীতা করে বলেন, যেহেতু কৃষ্ণ রাজাও নন, ব্রাহ্মণও নন তাই এই অর্ঘ্য পাবার কোন অধিকার তার নেই। এছাড়া কৃষ্ণ অন্যায় উপায়ে জরাসন্ধকে বধ করেছেন। তাকে শ্রেষ্ঠ অতিথি করা যুধিষ্ঠির ধর্মাত্মা পরিচয়ই নষ্ট হল। যজ্ঞে উপস্থিত অনেক রাজাই শিশুপালকে সমর্থন করলেন। শিশুপালের সাথে কৃষ্ণের পূর্ব থেকেই শত্রæতা ছিল। সয়ম্বরা সভায় কৃষ্ণের স্ত্রী রু´িণীর পাণিপ্রার্থী ছিলেন শিশুপালও। কৃষ্ণ শিশুপালকে সুদর্শন চক্র দিয়ে শিরñেদ করেন।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কি কৃষ্ণ ও পাণ্ডবরা নৈতিক ছিল?

– ভীষ্মকে পরাজিত করতে পারছিলেন না। ভীষ্মের মহানুভবতার সুযোগ নিয়ে তাকে বধের উপায় জেনে নিয়ে- স্ত্রীলোককে সামনে রেখে আড়াল থেকে অর্জুন শরাঘাতে ভীষ্মকে শরশয্যায় শায়িত করেন।

– দ্রোণকেও পাণ্ডবরা পরাজিত করতে পারছিলেন না। কৃষ্ণ বললেন, দ্রোণের পুত্র অশ্বত্থামা নিহত হয়েছে এমন সংবাদ পেলেই দ্রোণ যুদ্ধ থেকে বিরত হবে আর তাকে হত্যা করা যাবে। যুধিষ্ঠির উচ্ছকণ্ঠে ‘অশ্বত্থামা হত’ ঘোষণা করে অস্ফুট স্বরে ‘ইতি কুঞ্জর’ বললেন। এতে দ্রোণ অস্ত্র ত্যাগ করে যোগস্থ হলে তার শিরñেদ করা হয়। অথচ যুদ্ধের নিয়ম বন্ধনের সময় ঠিক হয়েছিল যে, অস্ত্রহীন কিংবা যুদ্ধে বিমুখ কোন ব্যক্তিকে আঘাত করা হবে না।

– যুদ্ধের রীতি ছিল সূর্যাস্ত হলে যুদ্ধ বন্ধ থাকবে। জয়দ্রথের পরাক্রম পাণ্ডবরা সহ্য করতে পারছিলেন না। তখন কৃষ্ণ মায়া দ্বারা তমসা সৃষ্টি করে সূর্যকে আচ্ছন্ন করলেন। সূর্যাস্ত হয়েছে মনে করে যুদ্ধের রীতি অনুয়ায়ী জয়দ্রথ অস্ত্রসংবরণ করে আকাশের দিকে তাকালেন। আর সেই সুযোগে অর্জুন জয়দ্রথের শিরচ্ছেদ করলেন।

– যুদ্ধের আরেকটি রীতি ছিল- অপরের সাথে যুদ্ধরত ব্যক্তিকে তৃতীয় কেউ আঘাত করবে না। কিন্তু সাত্যকিকে পরাজিত করে তার মুন্ডচ্ছেদনে উদ্যত ভুরিশ্রবাকে অর্জুন আক্রমণ করলেন এবং কৃষ্ণের উপদেশে ভুরিশ্রবার ডানহাত কেটে ফেললেন। এর প্রতিবাদে ভুরশ্রবা অস্ত্র ত্যাগ করে যোগস্থ হলে অর্জুন নিয়ম ভঙ্গ করে তাকে হত্যা করে।

– কর্ণ যখন নিরস্ত্র অবস্থায় রথ থেকে নেমে মাটিতে বসে যাওয়া রথের চাকা তুলবার চেষ্টা করছিলেন, তখন অর্জুন কৃষ্ণের পরামর্শে আবার যুদ্ধের নিয়মভঙ্গ করে শরাঘাতে তাকে বধ করলেন।

– ভীম ও দুর্যোধনের মধ্যে গদাযুদ্ধ চলছিল। কৃষ্ণ বললেন, ন্যায় যুদ্ধে দুর্যোধনকে পরাজিত করা যাবে না। তখন অর্জুনের ইংগিতে দুর্যোধনের উরুভেঙ্গে দেয়া হয় যুদ্ধের নিয়ম লংঘন করে।

– দুর্যোধন কৃষ্ণকে দোষারোপ করলে তিনি বলেন, কৌরব বীরগণ অসাধারণ সমরবিশারদ ও ক্ষিপ্রহস্ত ছিলেন এবং পাণ্ডবরা কখনো তাদের ন্যায়যুদ্ধে পরাজিত করতে পারতেন না। আমি যদি ঐরূপ কুটিল ব্যবহার না করতাম তাহলে তোমাদিগকে জয়লাভ, রাজ্যলাভ ও অর্থলাভ কখনই হইত না।

এখানে স্পষ্ট যে কৃষ্ণ ও পাণ্ডবরা ন্যায়যুদ্ধ করেননি। অনেকে বলতে পারেন মহাভারত জুড়েই একটি ঘটনার পেছনে পূর্বের কোন কারণ রয়েছে। এটা স্পষ্ট হয় তারা একটি মহাকাব্যের চরিত্র বলেই এমনটা করতে পেরেছেন। রামায়ণ ও মহাভারতের চরিত্র ও পটভূমি বিশ্লেষণ করলে মহাকাব্যের সকল উপাদানই তাতে পাওয়া যায়। ধর্মগ্রন্থের মধ্যে থাকে ওই ধর্মের পক্ষে নীতিকথা ও বিধিবিধান। আর তারজন্য আসে কিছু গল্প। রামায়ণ ও মহাভারতে পুরোটাই গল্প। গল্পের কারণেই এসেছে ধর্মের কথা, নীতি কথা। তাই প্রমাণও করা হয় যে রামায়ণ ও মহাভারত অবশ্যই মহাকাব্য- যেখানে ছলনা ও শঠতা থাকবে, যুদ্ধ জয়ের জন্য মিথ্যাচার ও প্রতারণা থাকবে।

তথ্যসূত্র:

মহাভারত- বেদব্যাস
রামায়ণ- বাল্মিকী
মহাকাব্য ও মৌলবাদ- জয়ন্তানুজ বন্দ্যোপাধ্যায়