আমি রহম বিশ্বাস আমার অগ্রজ রহিম বিশ্বাস।শব্দের ভূৎপত্তিগত বা আত্মীক দিক অনুসারে রহিম-রহমে যেরকম অবিচ্ছিন্ন সম্পর্ক থাকার কথা আমাদের মাঝে কিন্তু তার বিপরীত অবস্থা।আমরা অনেকটা আজম খানের গানে বর্ণিত হাজীচান্দের দুই পোলা আলাল-দুলালের মত।আলাল যদি ডাইনে যায় দুলাল যায় বামে।তবে পার্থক্য আছে।আলাল-দুলালের পাথেয় অবস্থান প্লেক্সিবল।ডাইন-বামে স্থিরতা নেই।একজন একদিকে গেলে অন্যজন যায় বিপরীত দিকে।আমাদের ক্ষেত্রে আমাদের পথের নিশানা একেবারে ফিক্সড।ডান আর বাম।কেউ কারো দিকে একটু নমনীয় হব সে অবকাশটুকুও নেই।তবে মত ও পথের আকাশ-পাতাল পার্থক্য সত্বেও আমরা দুভ্রাতা একই পরিবারে সহাবস্থান করছি এখানেই সম্ভবতঃ রহিম-রহম নামের সার্থকতা।

একদিন আমাদের আগুন-পানির অদ্ভুত শান্তির পরিবারে ছোটখাটো এক প্রলয়কান্ড ঘটে গেল।আর এই কান্ডের কুশীলব বা ভিলেনও বলা যায় আমার ইঁচড়ে-পাকা পিচ্ছি ছেলেটা।নাম তার ফোকলা।এটা তার আসল নাম নয় দাঁতগুলি পোকায় খেয়ে ফেলাতে মুখের ভৌগলিক অবস্থার কারণেই নতুন নামকরণ হয়েছে।তবে নতুন নাম গ্রহণে তার কোনো অসুন্তুষ্টি দেখা যায়নি।বরং হাসি মুখেই তা মেনে নিয়েছে তাই সে ফোকলা নামেই বিখ্যাত।ঘটনার সময় আমি বাড়ির বাইরে ছিলাম কিন্তু বাড়িতে পা দিয়েই আমি আবহাওয়া ঠের পেয়ে গেলাম।একটা গুমোট অবস্থা চারদিকে। বড়সড় ঝড়ের পূর্বাভাস।প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে গিন্নীর দিকে তাকাতেই একটা শক্ত ঝ্যামটা খেলাম।বুঝলাম আবহাওয়া বিগড়ানোর পেছনে অধমেরও কিঞ্চিত অবদান আছে। কী সেটা? স্নেহ।মমতা বা লাই দেওয়া।অর্থাৎ আমিই অধিক আদর আর প্রশ্রয় দিয়ে ফোকলাকে মাথায় তুলেছি সুতরাং ফোকলার যত দোষ তা যুক্তিবিজ্ঞানের সূত্রে আমারও দোষ। আমি অস্বীকার করিনা।এবার তাহলে দোষটা খোলাসা করা হোক।

গিন্নী খোলাসা করেন।আজ ফোকলা হঠাৎ করে আমার বড় ভাইজানকে রামচাচা বলে সম্বোধন করে ফেলেছে।

আমি বিষ্মিত হয়ে বলি-ভাইজানের নামতো রহিম, তাকে রামচাচা বলবে কোন যুক্তিতে?

তা তোমার কামিল ছেলেকেই জিগ্যেস কর।যুক্তিবাদীর ছেলে,নিশ্চয় যুক্তি একটা দিতে পারবে।

আমি ঘটনার ভয়াবহতা আঁচ করতে পারি।আমার ভাইজান আমলদার মানুষ।কথা-বার্তা মুখাবয়বে একটা রুক্ষতাকে তিনি পরমযত্নে ধরে রেখেছেন।সাথে প্রচন্ড হিন্দু বিদ্বেষের মহৎ গুণটিও তার মাঝে বর্তমান।হিন্দুর নাম শুনলেও মনে হয় তার অযু ছুটে যায়।এহেন কট্টর মানুষকে হিন্দুর দেবতার নামে সম্বোধন করার প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে আমি অনুমান করতে পারি।কিন্তু ফোকলা তাকে রামচাচা বলে কেন সম্বোধন করল? তবে কি পাকনাটা আমার আর ভাইজানের মধুর সম্পর্কটা ধরে ফেলেছে এবং যথারিতি পিতৃপক্ষ নিয়ে ভাইজানকে খ্যাপাবার জন্য এই অদ্ভুত সম্বোদন? তাহলেতো এটা মারাত্নক ব্যাপার।আমি তৎক্ষনাৎ ফোকলাকে ডেকে পাঠাই।ফোকলার মুখটি ফোলা ফোলা এবং বিষন্ন।বুঝতে পারি তার উপর দিয়ে ইতোমধ্যে অনেক ঝড় বয়ে গেছে।আমি যেরকম ক্রোধ নিয়ে তাকে ডেকেছিলাম তা মুহুর্তে অধিক উত্তাপে আইসক্রিমের মত গলে গেল।ফোকলার গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে আমার মায়া হল।আমি তাকে কাছে টেনে নিয়ে খুব আদুরে গলায়  জিগ্যেস করি-তোমার চাচার নাম কী বলতো খোকা?

আমার গলার উতরাই ধরতে পেরে ফোকলা এবার সপ্রতিভ হয়ে ওঠে।সে তাৎক্ষণিক জবাব দেয়-রহিম।

আমি বলি-তাহলে তুমি তাকে রহিম চাচা না বলে রামচাচা বললে কেন?

ফোকলা যেন উত্তরটা তৈরি করেই রেখেছিল,প্রশ্নের সাথে সাথেই ঝা-মুক্ত করে দিল।কেন তুমিইতো বলতে বলেছ।

আমি বলতে বলেছি? আমি আকাশ থেকে পড়ি।

তুমি বলেছ আকাশে যে ধনু উঠে সেই বড় ধনুর নাম রামধনু।বড় যে ছাগল-তার নাম রামছাগল।বড় দায়ের নাম রামদা।আমার পাছায় বড় এক চিমটি কেটে বলেছ এটা হল রামচিমটি।তাই বড়চাচাকে আমি বলেছি রামচাচা।

ফোকলার এই জবাবে আমি হাসব না কাঁদব ভেবে পাইনা।এতো ভয়ংকর যুক্তির কথা। বড় ছাগল যদি রামছাগল, বড় ধনু যদি রামধনু বড় দা যদি রামদা হতে পারে তবে বড়চাচার রামচাচা হতে অসুবিধে কোথায়?

গিন্নী এতক্ষণ আড়ালে দাঁড়িয়ে পিতাপুত্রের কথোপকতন শুনছিলেন এবার প্রকাশিত হলেন-পেয়েছ যুক্তি? যেমন গাছ তেমন তার গুটা হবেনা?

অবশ্যই হবে।আলবৎ হবে।আমি ফোকলার পিতা হিসেবে বিপুল গর্ববোধ করি। কিন্তু আপাতত গর্ববোধের চেয়ে বড় কাজ হল উদ্ভুত পরিস্থিতির শান্তিপূর্ণ একটা সমাধান করা।

ভাইজানের অনশন চলছে।অদ্য দ্বিতীয় দিন।বয়স্ক একজন মানুষ না খেয়ে আছেন এই অপরাধবোধ আমাকে খুব বিচলিত করছে।আমি অপরাধীর মত তার ঘরে প্রবেশ করি তিনি আমার দিকে তাকাননা। আমি ফৌজদারী মামলার আসামীর মত নিচুস্বরে ডাক দেই-ভাইজান।বাচ্চা একটা ছেলে কী না কী বলেছে তার জন্য …।

আমি কথা শেষ করতে পারিনা তিনি এবার সশব্দে বিষ্ফোরিত হন।প্রচন্ড চিৎকার করে বলেন-এটা বাচ্চা ছেলের কথা নয় এটা তোর কথা।তোর শেখানো কথা। এবার বাঁধভাঙ্গা পানির মত ভাইজানের মুখ খুলে গেল।তিনি স্বতস্ফুর্ত জলধারার মত হয়ে যান।দুইদিনের উপবাস সেই প্রবাহকে আরও বেগবান করে তুলছে। আমি নির্বিকার তা সয়ে যাই।আমি তার তীব্র বাক্যবাণে কান না দিয়ে তার ঘরের বুকসেলফের দিকে তাকাই।একটা একটা করে তাকের ধর্মীয় বইগুলোর নাম পড়তে চেষ্টা করি।ভাইজান কিন্তু থেমে নেই।তিনি সমানে বয়ান করে যাচ্ছেন।হঠাৎ একটি বইয়ের দিকে তাকিয়ে আমি প্রবলভাবে আলোড়িত হয়ে উঠি।ফোকলা যে যুক্তিতে বড়চাচাকে রামচাচায় রূপান্তর করেছে সে রকম একটা ফর্মুলা উক্ত বই থেকেই টিকরে বেরুচ্ছে। আমি শান্ত গলায় ডাক দিই-ভাইজান।

তিনি সম্ভবত কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন অথবা আমাকে কিঞ্চিত ফ্লোর দেবার মহৎ মানসেই তিনি একটু বিরতি টানেন।এই সুযোগ আমি হাতছাড়া করিনা।তাকে সবিনয়ে জিগ্যেস করি-ভাইজান,মোস্তফা চরিত’ বইটি নিশ্চয় পড়েছেন?

ভাইজান জবাব না দিয়ে এমনভাবে আমার দিকে তাকালেন যেন আমি পৃথিবীর সবচেয়ে তুচ্ছতম প্রশ্নটি তাকে করেছি।আমি গলায় একটা গম্ভীর ভাব নিয়ে বলি-এই বইয়ের লেখক কিন্তু সারাটা জীবন তার নামের সাথে রামকে বহন করে গেছেন কিন্তু একদিনও এ ব্যাপারে তার বিরক্তি বা অনীহা প্রকাশ করেননি।

ভাইজান আমার মুখের দিকে কিছুতেই তাকাবেননা এমন সংকল্প নিয়েই সম্ভবত মাথাটি নিচু করে রেখেছিলেন কিন্তু আমার কথা শুনামাত্রই তিনি সপাং করে খাড়া হয়ে গেলেন।কী বলতে চাস তুই?

আমি তেমনি নিরুত্তাপ গলায় বলি-ভাইজান,আমি মৌলানা আকরাম খাঁর কথা বলছি।তার নামের শেষে কিন্তু রাম আছে।

তিনি রুক্ষস্বরে বলেন-কীসের সাথে কী মেলাতে চাস?

আমি দ্বিগুন উৎসাহে বলি-যে পাকিস্তানী বোলারের সাফল্যে আপনারা এক সময় রাধারাম মিষ্টান্ন ভান্ডারের মিষ্টি বাতাসা বিলাতেন সেই ওয়াসিম আকরামও রামের সাথে সহাবস্থান করছেন ভাইজান।

এইসব তোর খোঁড়া যুক্তি।তার গলার স্বর এবার লক্ষণীয় মাত্রায় নিঁচুতে।সম্ভবতঃ পাকিস্তান প্রেম আর রাধারাম মিষ্টান্ন ভান্ডারের কথায় তিনি কিছুটা নমনীয় হয়ে এসেছেন। এটা ভাইজানের একিলেক হীল  আমি জানি।

আমি এবার তুন থেকে একে একে বাকি তিরগুলি ছুড়তে শুরু করলাম।ভাইজান, যতই চেতেননা কেন রামকে কিন্তু কিছুতেই শরীর থেকে ছাড়াতে পারবেননা।

ভাইজান আমার দিকে কটমট করে তাকান।

আপনি ‘ব্যারাম’ পড়লেন সেখানেও রাম।ব্যরাম থেকে আরাম পেলেন সেখানেও রামের আছর।আপনি হাঁটছেন দৌড়াচ্ছেন এক সময় একটু ‘বিরাম’ দিতে চাইলেন রাম ঠিক হাজির কীভাবে তাকে ছাড়াবেন?

ভাইজান একটা শক্ত পয়েন্ট পেলেন তাই তাৎক্ষণিক তার সদ্ব্যবহার করলেন-আরে রাখ তোর আরাম ব্যারাম।হারামেও রাম আছে এটা জানসতো?

ওলামায়ে কেরামেও আছে।

আমার উত্তরে তিনি খামোশ খেয়ে যান।

ভাইজান এ কথার জবাব দেননা।আমি দরজার ওপাশে তাকিয়ে দেখি তিনি যত নমনীয় হচ্ছেন তার অনশন ভঙ্গের খাদ্যসম্ভার ততই নিকঠবর্তী হচ্ছে।বাড়ির সব সদস্য সেই দৃশ্য মনপ্রাণ দিয়ে উপভোগ করছে।সেই ছোটখাটো দর্শক গ্যালারিতে উৎফুল্ল ফোকলাকেও চোখে পড়ল।

পরিবারের সদস্যদের প্রফুল্ল মুখ দেখে আমিও দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে যোগ করি-ভাইজান,আপনার খাদ্য তালিকার প্রিয় খাবারটি হচ্ছে মুরগীর ভোনা মাংস।এই মোরগের আরেক নাম কী জানেন?

তিনি আমার দিকে কটমট করে তাকান-কী নাম?

রামপাখি।

শব্দটি শুনামাত্র ভাইজানের বিবমিষা পেল।তার চোখ গোল হয়ে এল।তার গলার দিকে তাকিয়ে মনে হল সারা জীবন তিনি যত মোরগ খেয়েছেন সব যেন দল বেঁধে বেঁধে উপরে আসতে শুরু করেছে।আমি কিছুটা ভড়কে গেলাম। কিন্তু না, ভাইজান দ্রুত বিবমিষার ভাব কাটিয়ে গর্জন করে ওঠেন-সব ষঢ়যন্ত্র। বাংলা হল হিন্দু পৌত্তলিকের ভাষা। হিন্দুরা ইচ্ছে করেই বিভিন্ন শব্দে তাদের দেবতার নাম জুড়ে দিয়েছে।

আমি শান্তগলায় বলি-অঘারাম,হাঁদারাম,বোকারাম,রামপাঁঠা ইত্যাদি নেতিবাচক শব্দও এই পৌত্তলিক ভাষারই বিশিষ্টশব্দ ভাইজান।এছাড়া মরু পৌত্তলিকদের ভাষা আরবিওতো একই দোষে দুষ্ট। অনেক আরবি শব্দে রামের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়।বাইবেলে বর্ণিত এরাম হচ্ছে বর্তমান সিরিয়া।মিসরের ফারাও সম্রাট রামেসিসের কথা কে না জানে।

ভাইজান তা লুফে নিলেন।আনন্দে তার মুখটি ঝলমল করে উঠল।

রামের সাথে ফেরাউনের নামের মিল থাকবেনাতো আমার নামের সাথে থাকবে নাকি? কাফেরে কাফেরে মাসতুত ভাই। এই প্রথম তিনি একটু তৃপ্তির হাসি ছাড়লেন।

তা ঠিক কিন্তু শব্দটি যে আরবিজাত এটাতো সত্য।আর শুধু আরবি কেন ইংরেজিতেও কোরাম ফোরাম ইত্যাদি অনেক শব্দেই রামের উপস্থিতি আছে।ফার্সি ভাষাতেও আছে যেমন বাহরাম,বৈরাম।

ভাইজান আর উত্তর খুঁজে পাননা।তিনি লা-জবাব বসে থাকেন।ভাইজানের করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হল তিনি যেন অসহায়ের মত বলছেন-ভাইরে, তাহলে কী করতে হবে আমাকে?

আমি তার অনুচ্চারিত প্রশ্নের জবাবে বলি-আপস আর সমঝোতার বিকল্প নেই ভাইজান।কুপমন্ডুক ছাড়া কেউ আপসহীন হতে পারেনা।মেনে নেয়া আর সমন্বয়ের মজাই আলাদা। এই যেমন-রামরহিম সিং—

আমি কথা শেষ করতে পারিনা।তিনি আসন ছেড়ে লাফিয়ে উঠেন।তিনি হুংকার ছেড়ে বলেন-একটা ভন্ড লম্পট।আল্লাহ পাকের পবিত্র নামের মানহানীর জন্য তার বিরুদ্ধে শতকোটি টাকার আরেকটি মামলা হওয়া প্রয়োজন।

আমি বলি-নামের কোনো মান সম্ভ্রম নেই ভাইজান।নামতো একটা ধারণামাত্র। মেনে নিলাম রামরহিম ভন্ড খুনী এবং ধর্ষক।কিন্তু তার মাঝে একটা সমন্বয়ের ধারণাতো আছে।গোরক্ষক আর গোখাদকদের এই তান্ডবকালে রামরহিমকে একত্রে মেলানোও চাট্টিখানি কথা নয়।বুকে হিম্মত না থাকলে এ সময়ে এটা কল্পনা করা যায়?বেচারা রামরহিম এ কারণেও একটা হাততালি পাওয়ার দাবিদার।

ভাইজান নিশ্চুপ হয়ে যান।দেখতে পাচ্ছি ভাবীর হাতে ধরা ফল ফলাদির পাত্রটি দরজার একেবারে কাছে চলে এসেছে।গেইম ওভার হতে চলেছে এটা দর্শকগ্যালারি ধরেই নিয়েছে।ভাইজানের মুখে স্মরণকালের বিমর্ষতা চেপে বসেছে তাই তাকে একটু অক্সিজেন দিতেই আমি যোগ করি হিব্রুতেও রাম আছে ভাইজান।ইজরাইলের একটি বিখ্যাত হাসপাতালের নাম হচ্ছে রামবাম।

অক্সিজেন তাকে উজ্জিবিত করল।তিনি আনন্দে লাফিয়ে ওঠে বললেন-মুসলমানের জন্মশ্ত্রু হল ইহুদি।সেই ইহুদিরা আজও আমাদের চিরশত্রু ভারতের সাথে হাত মিলিয়ে মুসলমান ধ্বংসের কাজ করে যাচ্ছে।তারা তাদের প্রিয় দোস্ত ইন্ডিয়াকে খুশী করতে একটি হাসপাতাল রামের নামে করবে নাতো জিন্নাহ সাবের নামে করবে?আর এতে তোরওতো খুশী হওয়ার কথা কারণ এর সাথে তোর সিলসিলাও যুক্ত আছে।বাহ, কী নামের বাহার,রামবাম।তিনি আনন্দে হেসেই ফেললেন।

কিন্তু আমি আর সময় দিলামনা। ভাইজানের অনশনের কফিনে ফাইনেল পেরেকটি টুকে দিয়ে বলি-বাদ দেন ইজরাইলের কথা।প্যালেস্টাইন আমাদের একটা স্পর্শকাতর অনুভুতির জায়গা না? সেই প্যালেস্টাইনের একটি বিখ্যাত শহরের নাম হল রামাল্লাহ।এখানে রাম আর আল্লাহ সন্ধীযুক্ত হয়ে হয়েছে রামাল্লাহ।আমাদের মহব্বতের আরব মুলুকেও দেখেন রাম আর আল্লায় কত গলাগলি ভাব।

শেষ প্রচেষ্টা হিসেবে তিনি কাজুমাজু করে বলেন-শব্দটি সম্ভবত নামাল্লাহ ছিল—

আমি জোরে হেসে উঠি।নাম শব্দটি যে বাংলা ভাইজান।স্থানের নামকরণে যদি নামাল্লাহই উদ্দেশ্য হতো তবে আরবিতে তা হতো ইসমাল্লাহ বা বিসমিল্লাহ।

তিনি খামোশ খেয়ে যান।তার স্তব্ধতাই হাল ছেড়ে দেয়ার উৎকৃষ্ট প্রকাশ অতএব দ্রুততম সময়ে ঘরে খাদ্য সামগ্রীর আগমন।আমি লেবুর শরবতের গ্লাসটি ভাইজানের মুখের কাছে তুলে ধরি।তিনি এক নিমিষে গ্লাসটি শূন্য করে ফেলেন।বাড়ির সকলে এই অনশনকান্ডের সফল সমাপ্তিতে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।সবচেয়ে এক্সাইটেড ফোকলা।সে জোশের বশে একটা হাততালিই দিয়ে বসে।ক্রিকেটে চার চক্কা হলে অথবা উইকেট পড়লে যেমন গ্যালারি আন্দোলিত হয় ফোকলার হাততালিতে সে রকমই একটা আলোড়ন উঠে।ভাইজান তাতে রাগ করেননা।

গল্পটির যদি এখানেই শেষ হয়ে যেত তাহলেইতো ভাল হত।যদিও অদ্ভুত সব যুক্তি দিয়ে ভাইজানের মত কট্টর মানুষকে ম্যানেজ করতে হয়েছে।বাস্তবেতো এসব শব্দের সাথে রামায়নের রামের মিল নিতান্তই কাকতালীয়।কিন্তু না, গল্পের যে আরও বাকি আছে।বলাবাহুল্য সেই শেষটি আমার জন্য বড়ই বিব্রতকর আর হতাশার যদিও এই ভয়ানক ট্রেন্টটি এখন খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

তিন

একদিন বিকেলে বাড়ির সামনের গাছতলায় ইজিচেয়ার পেতে একটা হালকা মেজাজের বই পড়ছি হঠাৎ খেয়াল হল সামনের রাস্তা দিয়ে ভাইজান হনহন করে এক রকম ছুটেই আসছেন।তার হাঁটার ক্ষিপ্রতাই বুঝিয়ে দিচ্ছে খুব গুরুতর ঘটনা ঘটে গেছে অথবা উনি নিজেই ঘটিয়ে এসেছেন।তিনি যে বেগে ছুটে আসছেন মনে হচ্ছে ঘরে ঢুকেই তিনি অস্ত্র নিয়ে পেছনে ধাবমান শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়বেন যদিও ঘরে নাতিদীর্ঘ লিকলিকে দুয়েকটি লাটির মওজুত ছাড়া আর কিছুই নেই।তিনি সবেগ ছুটে  আমার সামনে এসে হার্ডব্র্যাক ধরলেন।তিনি দরদর করে ঘামছেন।আমি ত্রস্তে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করি-কোনো সমস্যা ভাইজান?

তিনি ক্রুদ্ধ চোখে আমার দিকে তাকালেন।

খুবতো লেক্সার মেরেছিলে? হিন্দু মুসলমানের মিলনদূত সেজেছিলি।এই দেখ- বলেই তিনি হাতে ধরা এক গাঁদা কাগজ আমার দিকে ছুঁড়ে মারেন।বিকেলের তেজহীন রোদের সাথে হালকা কিছু বাতাস ছিল।কাগজগুলি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল।দুয়েকটিকে ধরে চোখের সামনে মেলে ধরতেই আসল ঘটনা ঠের পেয়ে গেলাম।পত্রিকার ফটোস্টেট করা নিউজকাটিং।কেউ এগুলি তাকে সরবরাহ করেছে।নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে পছন্দের সংবাদকে কপি করে ফ্রী বিলি করার মত মহৎ মানুষের  অভাব নেই এখন। সবগুলি কপিতে অভিন্ন সাবজেক্টের ভিন্ন ভিন্ন সংবাদ।ভারতের কোথায় করসেবকদের দ্বারা মুসলমানদের পিটিয়ে জয় শ্রীরাম বলতে বাধ্য করা হয়েছে তারই পুংখানুপুংখ বিবরণ।এমনকি রামভক্তদের সর্বশেষ নৃশংসতার খবরটিও আছে যেখানে ট্যক্সিচালক আফতাব আলমকে জয় শ্রীরাম বলাতে ব্যর্থ হওয়ায় তাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।আমি কিছু একটা বলার চেষ্টা করছি ঠিক এ সময়ই তিনি পকেট থেকে আরেকটি ভাঁজ করা কাগজ আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে বলেন-দেখ একজন হিন্দু হয়েও উনি কী বলেছেন। আর তুই দয়ার অবতার হয়ে বলেছিস রামের সাথে আপস করতে? ছিঃ।

আমি অনিচ্ছা স্বত্বেও কাগজের ভাঁজ খুলে দেখি ডঃ অমর্ত্য সেনের একটি বক্তব্যের অংশ যেখানে তিনি বলেছিলেন-শ্রীরাম এখন এক আতংকের নাম।বক্তব্যটি আমি অনেক আগেই কাগজে পড়েছি।

আমার কোনো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ শুনার জন্য তিনি এক মুহুর্তও অপেক্ষা না করে সবেগে ঘরে প্রবেশ করেন।আমি নিশ্চুপ বসে থাকি।আমাদের বাড়িটি সাগরের খুব কাছাকাছি।রাতে পরিস্কার সাগরের শব্দ শুনা যায়।সে শব্দ শুনে শুনে আমি ঘুমাই।কিন্তু এখন বিছানায় গিয়ে কান পাতলে সেই শব্দ আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়না। মনে হয় সাগরের বাতাসও এখন দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে।একভাগ বলে-আল্লাহু আকবার, অন্যভাগ হুংকার ছাড়ে-জয় শ্রীরাম বলে।এখন আমার ভাল ঘুম হয়না।