এরশাদের প্রধান অপরাধ পরিবেশদূষণ: অন্যান্য সরকারগুলো পুরুষদের দূষিত করেছে, এরশাদ দূষিত করেছে নারীদেরও। -হুমায়ুন আজাদ

এরশাদের চরিত্র নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই। বাংলাদেশে ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ করেন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। রাজনৈতিক-স্বার্থেই তিনি এই কাজটি করেন। বাংলাদেশে রাষ্ট্রধর্ম বিল পাস হয় ৭ জুন, ১৯৮৮। এরশাদের মতন এক লম্পটের হাতে রাষ্ট্রধর্ম বিলটি পাস হয়। এরশাদের এই রাজনৈতিক-স্বার্থের বিলটি যখন পাস হয়, তখন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামাতসহ প্রায় সব দলই এর তীব্র বিরোধিতা করে। সবাই স্পষ্ট করে বলেছিল; এরশাদ তার রাজনৈতিক স্বার্থের জন্যে মানুষের অনুভূতিকে পুঁজি করে এই বিলটি সংসদে পাশ করেছে। সে সময় এই বিল পাশের প্রতিবাদে রাজনৈতিক দলগুলো রাজপথে প্রতিবাদ, মিছিল, হরতালসহ বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করে। ২০২০ সালে এসে মানুষ যে পরিমাণ ধর্মান্ধ ও ধর্মের বিষয়ে যেভাবে অসহিঞ্চু আচরণ করছে তা বিচার করলে ৮৮ সালের বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। বাংলাদেশে দুই জেনারেল অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করায় তারা ধর্মীয় ইস্যু নিয়ে নিজেদের জনপ্রিয়তা বাড়াতে চেয়েছেন, রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করে ক্ষমতা সুসংগঠিত করতে চেয়েছেন। জিয়াউর রহমান সংবিধানে “বিসমিল্লাহ” যুক্ত করেন, আর এরশাদ করেন “রাষ্ট্রধর্ম”। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারও দ্বিতীয় মেয়াদে থেকে যখন বিনা ভোটে দেশ চালানো শুরু করা তখন তারাও কথায় কথায় ধর্মকে উপস্থাপন করছে। শেখ হাসিনা সংসদে বলতে শুরু করলেন; দেশ চলবে নবীজীর নির্দেশ মতন ইত্যাদি ইত্যাদি। শুধু আমাদের দেশেই নয় পৃথিবীর সব দেশেই অবৈধ শাসকরা তাদের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্যে, ক্ষমতার বৈধতা আনার জন্যে ধর্মকে ব্যবহার করেছে। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম কিংবা সংবিধানে বিসমিল্লাহ স্থাপন করে জনগণের কোন উপকার করেননি। এগুলো স্থাপন করে দেশে ধর্মীয় রাজনীতি চাঙ্গা করেছে অন্যদিকে জনগণের চিকিৎসা, শিক্ষাসহ মৌলিক অধিকাগুলো কথা এড়িয়ে যাওয়া গেছে।

যাই হোক, রাষ্ট্রধর্ম যেহেতু এরশাদের হাত ধরেই এসেছে তাই প্রথমে এরশাদ সম্পর্কে কিছু কথা বলা উচিত।

১৯৩০ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি রংপুরে মোহাম্মদ এরশাদের হোসেন জন্মগ্রহণ করেন । তার বাবা মোহাম্মদ মকবুল হোসেন কুচবিহারের দিনহাটা থেকে মোহাম্মদ মকবুল হোসেন রংপুর শহরের সেন-পাড়ায় এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন । এরশাদ ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫২ সালে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। মোহাম্মদ এরশাদ হোসেন তার সেনা বিভাগের কমিশন লাভের সময় নাম পরিবর্তন করে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ করেন । ১৯৭১ – ১৯৭২ সালে ৭ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর কমান্ড্যান্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বিভিন্ন তথ্য ও বই পত্রের মাধ্যমে জানা যায়, ৭১-এ স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় এরশাদ বাংলাদেশে কয়েকবার আসেন এবং মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি পাকিস্তানে ফিরে যান। কিছু অফিসারের এরূপ আচরণের জন্য বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সরকার পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসারদের সেনাবাহিনীতে আত্তীকরণের জন্য যে নীতিমালা প্রণয়ন করেন সে অনুযায়ী তার চাকুরীচ্যুতি হওয়ার কথা। একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যারা বাংলাদেশে এসে যুদ্ধে যোগদানের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তানে ফিরে গেছেন তাদেরকে এই নীতিমালা অনুযায়ী অব্যাহতি দেয়া হয়। জনা পঞ্চাশেক অফিসারকে এ কারণে চাকরি হারাতে হয়। কিন্তু একই অপরাধে অভিযুক্ত হওয়ার পরও এরশাদ চাকুরীচ্যুত তো হনই নি বরং প্রমোশনসহ পদে অধিষ্ঠিত হন। এর পেছনে তৎকালীন সেনাপ্রধান ও আওয়ামী যুবলীগের একজন প্রভাবশালী নেতার বিশেষ ভূমিকা ছিল। মেজর (অব:) রফিকুল ইসলাম বলেন- বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর প্রাণভয়ে এরশাদ বাংলাদেশে ফেরত আসেন , এবং চাকুরী ফিরে পাবার জন্য অস্থির হয়ে পড়েন । তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী ও কুড়িগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা রিয়াজ উদ্দিন মিয়া একদিন সন্ধ্যায় এরশাদকে পাজামা- পাঞ্জাবি পরিয়ে তার উপর একটি মুজিব কোট পরিয়ে তার হয়ে তদবিরের জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেন, “আমার ভাগ্নের চাকরিটা না থাকলে যুদ্ধ করে আমার কি লাভ হোল !!” এ কথা বলার সাথে সাথে এরশাদ শেখ মুজিবের পা ছুঁয়ে সালাম করেন । শেখ মুজিব এতে খুশি হয়ে এরশাদের আপাদমস্তক তাকিয়ে দেখে খাটো বাঙ্গালীর মধ্যে লম্বা চেহারার অধিকারী এরশাদের দিকে তাকিয়ে আরও খুশি হয়ে তাকে চাকরিতে বহাল রাখার নির্দেশ দেন ।

কাহিনী শুধু এখানেই শেষ নয়; পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙ্গালি অফিসার ও সৈন্যদের দেশদ্রোহিতার অভিযোগে পাকিস্তানে বিচার শুরু হলে এরশাদ সেই ট্রাইবুনালের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন । এছাড়াও তিনি পাকিস্তানে বসে তার গ্রামের বাড়ি রংপুরে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দামী মূল্যবান সামগ্রী পাঠাতেন। এখানে বলে রাখা ভাল ৭১-পরবর্তী সময় বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের নিয়মিত বিমান চলাচলও ছিল না। কিন্তু তিনি কোন ঝামেলা ছাড়াই তার মূল্যবান পণ্য বাড়িতে পাঠাতে পেরেছেন। কর্নেল শাফায়াত জামিল বলেন- আমার ধারণা এরশাদ ছিলেন পাকিস্তানী ISI আর্শীবাদপুষ্টদের অন্যতম প্রধান। তিনি ১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালে অন্তত চারবার বিমানযোগে বিভিন্ন মূল্যবান সামগ্রী পাকিস্তান থেকে রংপুরে তার বাড়িতে পাঠান। আটকে পড়া বাঙালি সামরিক অফিসাররা তখন তো বিভিন্ন বন্দীশিবিরে নানারকম দুর্ভোগের মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলেন। তখন পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে কোন নিয়মিত বিমান চলাচলও ছিল না। তথাকথিত বন্দি এরশাদের পক্ষে ISI-এর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান ও সার্বিক সহযোগিতা ছাড়া এধরনের কাজ কোনক্রমেই সম্ভব ছিল না। আমার জানা মতে আটকে পড়া প্রায় ১২’শ অফিসারের কারোই তার মতো সুযোগ পাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি।

১৯৭৩ সালের শেষের দিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিভিন্ন পদে কর্মরত বাঙালি অফিসার ও সদস্যদের পাকিস্তান থেকে ফেরত পাঠানো হয়। পাকিস্তান-ফেরত অফিসারদের মধ্যে তৎকালীন লে. কর্নেল এরশাদও আসেন। মাত্র দুই বছরের মধ্যে তিনটি পদোন্নতি পেয়ে মেজর জেনারেল হন। শান্তিকালীন সময়ে এরকম পদোন্নতি নজিরবিহীন। পাকিস্তান ফেরত সেনাবাহিনী ও মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সেনাদের মধ্যে মানসিকভাবে এক-যুদ্ধ চলতে থাকে। এর মূল কারণ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এক সরকারি আদেশে সামরিক ও বেসামরিক পর্যায়ে সরকারী চাকরিজীবী মুক্তিযোদ্ধাদের দুই বছরের জ্যেষ্ঠতা দেওয়া হয়। যা পাকিস্তান ফেরত কোন সেনা অফিসার ও সদস্য মেনে নিতে পারেনি। এখানে বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য যে, এরশাদ বাংলাদেশে আগমনের পর আর্মি হেড কোয়ার্টার-এর প্রথম কনফারেন্সে মুক্তিযোদ্ধাদের দুই বছরের সিনিয়রটিকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন।

এরই ধারাবাহিকতায় সেনাবাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধা ও অ-মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে এক স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা হয়। বিভিন্ন সেনা কর্মকর্তা লিপ্ত হন বিভিন্ন ষড়যন্ত্রে। সেই খেলায় এরশাদও বসে ছিলেন না। শোনা যাক কর্নেল সাফায়াত জামিল (অব:) এর মুখে-“৭৪ সালের শেষ দিকের কথা। মেজর ডালিমের সঙ্গে প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা গাজী গোলাম মোস্তফার একটি পারিবারিক দ্বন্দ্বকে তদানীন্তন কর্নেল এরশাদ ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের মতলব আঁটেন। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তিনি একদল তরুণ অফিসারকে নেতৃত্ব দিয়ে তৎকালীন সেনা উপ-প্রধান মেজর জেনারেল জিয়ার অফিসে যান এবং ঐ ঘটনায় সেনাবাহিনীর সরাসরি হস্তক্ষেপের দাবি করেন। অথচ এরশাদ তখন সেনাবাহিনীর সার্বিক শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত।”

এরপর ঘটে যায় ১৫ অগাস্টেই সেই ভয়াবহ দুঃখজনক ঘটনা। কিছু উচ্ছৃঙ্খল জুনিয়র অফিসারদের হাতে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হন। এরপর খন্দকার মোশতাকের রাষ্ট্রপতির দায়িত্বগ্রহণের পর সেনা প্রধান শফিউল্লাহকে অব্যাহতি দিয়ে তাঁর চাকরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হোল রাষ্ট্রদূত পদে নিয়োগ দিয়ে। উপ-সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান করা হয় এবং তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার এইচ এম এরশাদকে নিয়ম ভেঙ্গে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে উপ-সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ করা হল। ভারতে প্রশিক্ষণে থাকাকালে মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে তিনি কর্নেল থেকে দুইটি পদোন্নতি পেয়ে মেজর জেনারেল হন যা সেনাবাহিনীর ইতিহাসে বিরল ঘটনা। এখানে বলে রাখা ভাল বঙ্গবন্ধু যখন নিহত হন তখন এরশাদ ভারতে প্রশিক্ষণ-রত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু নিহত ও পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধানের দায়িত্ব পেলে এরশাদ কাউকে কিছু না বলে ঢাকায় চলে আসেন। ১৫ অগাস্টের ষড়যন্ত্রের সাথে এরশাদ জড়িত আছে কিনা তা নিশ্চিত করে বলা যায় না কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীদের সাথে মিটিংয়ের জন্য তিনি কাউকে কিছু না বলে ঢাকায় চলে আসেন। শোনা যাক কর্নেল সাফায়াত জামিল (অব:)-এর মুখেই- মেজর জেনারেল জিয়ার সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নেয়ার পরবর্তী দ্বিতীয় দিনের ঘটনা। আমি সেনাপ্রধানের অফিসে তাঁর উল্টো দিকে বসে আছি। হঠাৎ করেই রুমে ঢুকলেন সদ্য পদোন্নতিপ্রাপ্ত ডেপুটি চিফ মেজর জেনারেল এরশাদ। এরশাদের তখন প্রশিক্ষণের জন্য দিল্লীতে থাকার কথা। তাকে দেখা মাত্র জিয়া অত্যন্ত রূঢ়ভাবে জিগ্যেস করলেন, তিনি বিনা অনুমতিতে কেন দেশে ফিরে এসেছেন। জবাবে এরশাদ বলেন- তিনি দিল্লীতে অবস্থানরত তার স্ত্রী জন্য একজন গৃহ-ভৃত্য নিতে এসেছেন। তা শুনে জিয়া রেগে গিয়ে বলেন, আপনার মতো সিনিয়র অফিসারদের এই ধরনের লাগামছাড়া আচরণের জন্যেই জুনিয়র অফিসাররা রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করে দেশের ক্ষমতা দখলের মতো কাজ করতে পেরেছে। জিয়া এরশাদকে পরবর্তী ফ্লাইটেই দিল্লী ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। তাকে বঙ্গভবনে যেতেও নিষেধ করলেন। এরশাদকে বসার কোন সুযোগ না দিয়ে জিয়া তাকে এরকমভাবেই তাড়িয়েই দিলেন। কিন্তু সেনা প্রধানের নির্দেশ অমান্য করে রাতে এরশাদ বঙ্গভবনে যান এবং অনেক রাত পর্যন্ত সেখানে অবস্থারত অভ্যুত্থানকারীদের সঙ্গে বৈঠক করেন। পরদিন ভোরে এরশাদ তার প্রশিক্ষণ-স্থল দিল্লীতে চলে গেলেন ঠিকই, কিন্তু সেনাপ্রধান জিয়ার নির্দেশ অমান্য করে রাতে তিনি বঙ্গভবনে যান। অনেক রাত পর্যন্ত তিনি সেখানে অবস্থানরত অভ্যুত্থান-কারীদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এর থেকেই মনে হয় এরশাদ আসলে তাদের সঙ্গে সলাপরামর্শ করার জন্যই ঢাকায় আসেন। এখানে বলে রাখা ভাল পরবর্তীকালে, জেনারেল এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর অভ্যুত্থান-কারীদের মধ্যে যারা চাকরি করতে চেয়েছিলেন, এরশাদ তাদেরকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চাকরিতে পূর্নবহাল করেন। দ্বিতীয়বারের মতো পুনর্বাসিত হোল ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থান-কারীরা। পোস্টিং নিয়ে তাদের অনেকে বিভিন্ন দূতাবাসে যোগ দেয়। জেনারেল জিয়া ক্ষমতায় থাকাকালে জেনারেল এরশাদ ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রধান উপদেষ্টা হন। যদিও তিনজন সিনিয়র মুক্তিযোদ্ধা অফিসার ঢাকায় চাকরিরত ছিল। অতঃপর জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর এরশাদ নিহত জিয়ার বিচারের নামে এক ষড়যন্ত্রের খেলায় মেতে উঠেন। জিয়া’র বিচারের নামে তিনি সেনাবাহিনীতে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে হয়রানি, বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের বিচার, হত্যা এবং অনেক সেনা অফিসারকে জোর করে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেন। জিয়াউর রহমানের খুনিদের বিচারের নামে জেনারেল মঞ্জুরকে হত্যা করা হয়। বর্তমানে জেনারেল মঞ্জুর মামলার কোর্টে বিচারাধীন অবস্থায় রয়েছে। এবং এরশাদ এই মামলার একজন আসামী। জিয়া হত্যার সুযোগে এরশাদ ও কিছু অ-মুক্তিযোদ্ধা সিনিয়র সেনা অফিসার পাকিস্তান-প্রত্যাগত মেজর জেনারেল (বর্তমানে অব:) সামাদকে সভাপতি করে প্রহসনমূলক-ভাবে মুক্তিযোদ্ধা আর্মি অফিসার ছাঁটাই করার জন্য একটি বোর্ড গঠন করা হয়। এ বোর্ডের মাধ্যমে আরও প্রায় ৬০ জন মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে বিভিন্ন অজুহাতে সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কার করা হয়। এ ছাড়া আরও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে অবসর গ্রহণে বাধ্য করা হয়। অদ্ভুত বিষয় হল পরবর্তী সরকারগুলো এসব মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে কেন ও কি কারণে ফাঁসি, জেল ও চাকরীচ্যুত করা হোল তা কোন নিরপেক্ষ তদন্তের অগ্রহণ দেখায়নি কিংবা একটুও উদ্বেগ প্রকাশ করেননি। তবে এরশাদের মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসার বিদ্বেষ এখানেই শেষ নয় তিনি প্রেসিডেন্ট থাকাকালে এক অলিখিত নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও নিকট আত্মীয়দের সেনাবাহিনীর অফিসার কোরে যোগদান নিষিদ্ধ করেছিলেন। পক্ষান্তরে একাত্তরে পরাজিত পাকবাহিনীর দোসরদের সন্তানদের জন্য সেনাবাহিনীর দুয়ার অবারিত করা হয়। এভাবেই ক্ষমতার লোভে সেনাবাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তানদের বিপক্ষে আরেকটি প্রতিপক্ষ সৃষ্টি করে সবসময় ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন উচ্চাভিলাষী এরশাদ। আর এভাবেই স্বার্থে খেলায় ক্ষমতার দ্বন্দ্বে সেনাবাহিনীতে অসংখ্য অফিসার সৈনিকের প্রাণ যায়। দেশ প্রেমিক সৈন্যদের রক্তে রঞ্জিত হয় পবিত্র ভূমি।

এখানে একটি তথ্য দিয়ে রাখি-জিয়াউর রহমান ছিলেন জেনারেল শফিউল্লাহ থেকে সিনিয়র কিন্তু তাকে সেনাপ্রধান না করে আওয়ামী সরকার সেনাপ্রধান করেছে শফিউল্লাহকে। কারণ হিসেবে বলা হয়- জিয়াউর রহমান ছিলেন উচ্চাভিলাষী তাকে সেনা প্রধান করা হয় নাই। জিয়া যখন রাষ্ট্রপতি হলেন তখন তিনিও সিনিয়রটি ভঙ্গ করে জেনারেল এরশাদকে সেনাপ্রধান করেছিলেন যেখানে জেনারেল দস্তগীর ছিলেন এরশাদের সিনিয়র।

কৃতজ্ঞতায়-
এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য- মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী (অব:) বীর বিক্রম-
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর- কর্নেল সাফায়াত জামিল (অব:)
তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা- লে: কর্নেল (অব) এম.এ.হামিদ পিএসসি
আনোয়ার কবির-সশস্ত্র বাহিনীতে গণহত্যা
বিরোধের প্রথম প্রহর – মেজর (অব:) রফিকুল ইসলাম ।

এরশাদের আমলে একটা স্বাভাবিক নাটক ছিল তিনি বিভিন্ন মসজিদে গিয়ে বলতেন গত কাল স্বপ্নে দেখেছি এই মসজিদে আমি নামাজ পড়ছে তাই আজ পড়তে আসলাম। অন্যদিকে সাধারণ লোকজন বলতেন; আমরা তো এক সপ্তাহ আগ থেকে জানি আপনি আসবেন! কারণ গোয়েন্দা বিভাগের লোকজন এক সপ্তাহ ধরে এখানে নিরাপত্তা খতিয়ে দেখছে। উপরের ছবিটি লালবাগ শাহী মসজিদের এরশাদের নামাজ পড়া ছবি।

রাষ্ট্রধর্ম বিলটির প্রতিবাদে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া- ধর্মের নামে জাতিকে বিভক্ত করার চেষ্টা। বিল পাশের প্রতিবাদে মিছিল ও বিভিন্ন যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এছাড়া ঢাবির শিক্ষার্থীরা এর প্রতিবাদ করে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা বলেন; সংবিধানের সংশোধনী জনগণ মানবে না।

বিল পাস করার পর এরশাদ তার সেই পুরাতন কৌশল অবলম্বন শুরু করেন। তিনি বিভিন্ন মসজিদ ও পীরের আখড়ায় যাওয়া শুরু করেন। উপরের ছবিতে আটরশি পীরের এলাকায় যান।

রাষ্ট্রধর্ম বিল পাস হওয়ার কারণে নাস্তিক ও মৌলবাদীরা প্রতিহত হবে! বলছেন; জাতীয় পার্টির নেতা মোয়াজ্জেম। অন্যদিকে বিল পাশের পক্ষে জাতীয় পার্টির মিছিল।

সরকারের গৃহপালিত হিন্দু সংগঠনের অভিনন্দন।

রাষ্ট্রধর্ম বিল পাসের বিরোধী শুধু আওয়ামী লীগ, বিএনপি করেনি জামাতও করেছিল। তারা বলছে; রাজনৈতিক প্রয়োজনেই এরশাদ এই বিলটি পাস করে। সরকার তার গণবিরোধী কার্যকলাপে ঢাকা দেওয়ার জন্যে ইসলামের নাম ব্যবহার করছে। ইসলাম কায়েম সরকারের উদ্দ্যেশ নয় বরং ইসলামী আন্দোলনের অগ্রগতি প্রতিহত করাই তাদের উদ্দ্যেশ। এছাড়া তারা গোলাম আযমের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার দাবী জানায়।ৱ

আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রতিবাদ

সে সময় শেখ হাসিনা বলেন, সুযোগ পেলেই এই আইনটি তিনি বাতিল করে দেবেন। তিনি আরো বলেন; ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্যে এরশাদ এই আইনটি করে।

 

যে জামাত এক সময় রাষ্ট্রধর্ম বিলের বিরোধীতা করেছিল তারাই আবার রাষ্ট্রধর্ম বাতিল ইস্যুতে হরতাল ডাকছে।

বর্তমানে এতোটুকু স্পষ্টভাবে বলা যায় তৎকালীন সময় মানুষ ও দলগুলোর যে অবস্থান ছিল সেই অবস্থান এখন আর নেই। বরং প্রতিটি দল আর ধর্মের নামে আরও বেশি সক্রিয় হয়ে উঠেছে। একটা রাষ্ট্রে রাষ্ট্রভাষার প্রয়োজন হয় কারণ রাষ্ট্রীয় অফিস আদালতে কাজ করার জন্যে একটি ভাষা কিংবা মাধ্যমের দরকার হয় কিন্তু রাষ্ট্রধর্মের প্রয়োজন পড়ে না। আজ এই করোনা মহামারিতে বিনা চিকিৎসায় হাসপাতালের দুয়ারে, রাস্তা-ঘাটে মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে। সংবিধানে বিসমিল্লাহ কিংবা রাষ্ট্রধর্ম থাকা না থাকাতে জনগণের কিছু যায় আসে না। কিন্তু প্রতিটি রাজনৈতিক দল বোকা জনগণকে বিভিন্ন ইস্যু দিয়ে ব্যস্ত রাখে। বোকা জনগণ রাষ্ট্র ধর্ম ও বিসমিল্লাহ প্রতিষ্ঠান আনন্দে মেতে থাকে আর ভুলে যায় নিজের মৌলিক অধিকারের কথা। রাষ্ট্র ধর্ম থেকে বেশি জরুরী ছিল; রাষ্ট্রের সব মানুষের চিকিৎসা ও শিক্ষা।