লিখেছেন: তালহা জুবায়ের

ধর্মতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদ কতটুকু যৌক্তিক বা অযৌক্তিক সেটি নিয়ে সবসময়ই একটা মতবিরোধ আমাদের কারো না কারোর মধ্যে থাকে৷ মূলত এই লেখাটি ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বের একটা ওভারভিউ নিয়ে যেখানে আমি ধর্মযুদ্ধকে মূল কারণ হিসেবে না নিয়ে সঠিক ও বাস্তবিক কারণ ও প্রভাব নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করেছি৷ আমরা লেখাটিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করবো:

১. ইসরায়েলি ইহুদির পটভূমি
২. ফিলিস্তিন সৃষ্টির পটভূমি
৩. হলোকাস্ট পরবর্তী অবস্থা ও জিওনিজম
৪. ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল সম্পর্ক
৫. মূল দ্বন্দের বিষয়বস্তু ও সমাধান না হবার কারণ
৬. অন্যান্য রাষ্ট্রের প্রভাব

খন্ড ১.

মূলত ইসরায়েল কথাটার আগে আমি আনবো একটি পুরানো ধর্মের কথা যা হচ্ছে জুডাইজম। ইহুদিরা দীর্ঘকাল ইসরায়েল ভূখণ্ডকে তাদের আবাসভূমি হিসাবে বিবেচনা করে আসছে, এমনকি প্রবাসে বাস করার সময়ও। হিব্রু বাইবেল অনুসারে, ইসরায়েলের ভূখণ্ডের সাথে জুডাইজম এবং ইহুদিদের সম্পর্কটি টুকরো টুকরো চুক্তির মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল যখন এই অঞ্চলটিকে কানান নামকরণের মাধ্যমে ইহুদিদের পূর্বপুরুষ আব্রাহাম (নবী ইব্রাহিম) এর নিকট প্রতিশ্রুত হয়েছিলো। অর্থাৎ, ইহুদি ধর্মালম্বীদের নিজস্ব একটা রাষ্ট্র বা দেশ ছিলো, এখনো আছে যাকে আমরা ইসরায়েল বলে জানি ( ইহুদি ঈশ্বরের প্রতিশ্রুতির মধ্যে যে ইসরায়েল দেখানো হয়েছিলো তার মধ্যে ফিলিস্তিন অন্তর্ভুক্ত ছিলো। কানান অঞ্চলটি সামগ্রিক ভাবে বর্তমান ফিলিস্তিন-ইজরায়েল অঞ্চলের প্রাচীন নাম। যেটি নবী ইব্রাহীমের কাছে তার বংশধরদের জন্য তার স্রষ্টার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ দেশ।)। এই আলাদা দেশের প্রয়োজনীয়তার কথাটা পরবর্তীতে ১৯ শতকে একজন ইহুদি দাবী করেছিলেন তার নাম Theodor Herzl, তার এই মতবাদটা অনেকটাই আমাদের দেশভাগ ও “দ্বিজাতিতত্ত্ব” মতবাদের মতোই৷ তো এইসকল মতবাদ এবিং ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে অনেক আগে থেকেই ইসরায়েলে ইহুদিদের মাইগ্রেশন শুরু হয়৷ পূর্বে সেখানে মাত্র ১০,০০০ ইহুদি বাস করলেও ১৮ শতকে তা বাড়তে শুরু করে এবং ১৯ শতকে, ১৮৯৬ সালে জিওনিজম প্রতিষ্ঠিত হবার পরে তা অনেক বেড়ে যায়। এবং এই মাইগ্রেশন ১৯৫৭ পর্যন্ত চলমান ছিলো প্রত্যক্ষভাবে এবং এখনো ইসরায়েলকে “Holly State For Jews” বলা হয়৷ ইসরায়েলে পৃথিবীর মোট ইহুদিদের এর প্রায় ৯০ শতাংশ বসবাসরত এবং ১৯ শতাব্দীর মাঝের দিকে এসে এর পরিমান বেড়েই গেছে৷

খন্ড ২.

ফিলিস্তিন নামক যে খন্ডরাষ্ট্র আসলে একসময় খন্ডরাষ্ট্র বা অনুরাষ্ট্র ছিলো না৷ মূলত আগে এই জায়গাটা ছিলো আরব অঞ্চলের একটি অংশ অথবা আরবের অন্তর্ভুক্ত একটা জায়গা, সহজ কথায় আরবের অধীনে। তো যখন ইহুদিরা ইসরায়েল নামক একটি জায়গায় এসে জড়ো হতে লাগলো তখন তারা এই ফিলিস্তিন নামক জায়গাকে নিজেদের বলে দাবী করলো (আরবের সাথে এই জায়গাতে প্রত্যক্ষ সংঘাত হয়েছিলো বটে, এরপরেই এই জায়গার দাবী তারা করেছিলো)। এখন কথা হচ্ছে এরপরে তারা কী উদ্যোগ নিলো? মূলত তারা এই ফিলিস্তিন নামক এলাকাটাকে নিজেদের জিম্মি করে নিলো এবং সংগত কারণে নিজেদের রাষ্ট্রের অধিভুক্ত করতে পারে নাই কারণ সেই জায়গা আইনত আরবের অন্তর্ভুক্ত ছিলো৷ অর্থাৎ বলাই বাহুল্য, এই ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বটা মূলত “এই ফিলিস্তিন নামক অংশটিকে কে পরিচালনা করবে? আরব না ইসরায়েল?” এই বিষয়টিকে নিয়েই৷ যদিও ইহুদি ও আরব মুসলমান উভয়ই এই ফিলিস্তিনকে কয়েক হাজার বছর পূর্বে থেকেই তাদের নিজেদের বলে দাবী করে আসছে, তবে বর্তমান রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ২০ শতকের গোড়ার দিকে শুরু হয়েছিল। এই নিয়ে কয়েকটি যুদ্ধও হয়েছে। কিন্তু কোনো ফলাফলে এখনো আসা যায় নাই৷ আজকের অবস্থা মূলত দুটি যুদ্ধের ফলাফলকে প্রতিফলিত করে থাকে, যাদের একটি ১৯৪৮ সালে এবং অন্যটি ১৯৬৭ সালে হয়েছিলো৷

খন্ড ৩.

হলোকাস্ট পরবর্তী অবস্থা বলতে ১৯৪৫ এর পরের অংশ বোঝাচ্ছি৷ এইসব ইউরোপ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ইহুদি এই ইসিরায়েল নামক “হলি ল্যান্ড” এ আসতে থাকে৷ জনসংখ্যা ক্রমেই বাড়ে এবং জিওনিজম নামক একটি মতবাদ ও তা সম্পর্কিত মুভমেন্ট প্রত্যক্ষ হয়৷ জিওনিজম এর প্রবক্তা Theodor Herzl হলেও, ১৯১৭ সালে ব্যাপারটি আবার সামনে নিয়ে এসেছিলেন যুক্তরাজ্যের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব Arthur Balfour এবং ইহুদি নেতা Lord Rosthschild এর “বেলফোর চুক্তি”। “বেলফোর” জিওনিজম কে সমর্থন করে তৎকালীন (১৯১৭) ইহুদি নেতা “রথচাইল্ডের” কাছে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন কে ইহুদিদের নিজস্ব আবাসস্থল হিসেবে সৃষ্টি করার পক্ষে মত প্রকাশ করেন৷ এই মতটি সকল ইসরায়েলি ইহুদিরা গ্রহন করেছিলেন। জিওনিজম নামক মতবাদটির সারমর্ম ছিলো, ‘ইহুদীধর্মমত’ একইসাথে একটি ধর্ম এবং জাতীয়তা বা ন্যাশনালিটি অর্থাৎ তারা বোঝালেন যে ইসরায়েল একটি ধর্মশাসিত রাষ্ট্র যেখানকার নাগরিক হিসেবে শুধুমাত্র ইহুদিদের গন্য করা হবে৷সহজ কথায় ইহুদিরা দাবী করলেন “ইসরায়েল একটি ইহুদি পরিচালিত রাষ্ট্র হবে যার রাষ্ট্রধর্ম ‘জুডাইজম’ বা ‘ইহুদীধর্মমত’ এবং এই ধর্মটি একইসাথে জাতীয়তা হিসেবে কাজ করবে।” এই মতবাদটির নাম হচ্ছে ‘জিওনিজম’। এখানে একটি প্রশ্ন থেকেই যায় যে “যারা ইসরায়েলি ইহুদি না তাদের বেলায় কী হবে?” এর উত্তর ইসরায়েলিরা দিতে পারেন না তবে তারা ধরে নেন যে পৃথিবীর সকল ইহুদিই কোনো না কোনোভাবে ইসরায়েলের সাথে সংযুক্ত এবং তাদেরকে নাগরিকের মতোই মুল্যায়ন করেন৷ খাতা কলমে এর অস্তিত্ব কতটুকু আছে তা নিয়ে দ্বিমত আছে। সহজভাবে, এই জিওনিজমের উপর ভিত্তি করে একটি চরমভাবাপন্ন আমলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করলো।

উল্লেখ্য, বেলফোরের চুক্তি প্রকাশিত হয় ১৯১৭ সালে, হলোকাস্টের সময়কালীন না হলেও হলোকাস্ট পরবর্তী অবস্থায় Jews দের কাছে এই চুক্তি সর্বোচ্চ গুরুত্ব পেয়েছিলো এবং এই চুক্তির ওপর বিশ্বাস রেখে তারা ইসরায়েলে গমন করে৷ এরপরে তারা পাকাপোক্তভাবে ফিলিস্তিন দাবী করেন৷ [চিঠির যে চিত্রটি ব্যবহৃত হয়েছে তার উৎসঃ উইকিপিডিয়া] ১৯২৯ থেকে ১৯৩৯ এ জার্মানিতে নাৎসিজম এর উত্থানের জন্য প্রায় ২ লক্ষ ৫০ হাজার ইহুদি ইসরায়েল-ফিলিস্তিনে চলে আসেন। আবার হলোকাস্ট পরবর্তী সময়ে তথা ১৯৪৫ এর পরে, ১৯৪৮ পর্যন্ত প্রায় ১ লক্ষ ১০ হাজার নিপিড়ীত ইহুদি ইসরায়েল গমন করেন। হলোকাস্ট চলাকালীন সময়ে প্রায় সাড়ে ৬ লক্ষ ইহুদি প্রাণ হারান।

খন্ড ৪.

ইসরায়েলের সাথে ফিলিস্তিনের সম্পর্ক এতক্ষনে হয়তো বোঝা হয়ে গেছে। এখন কথা হচ্ছে কেনো আরব তাদের এই জায়গাটিকে নিজেদের করে নিতে পারছেনা এখনো? উত্তর হলো ফিলিস্তিন হচ্ছে প্রায় ৭ লক্ষ আরব মুসলিম জিম্মির বাসস্থান৷ কীভাবে? আমি আগেই বলেছি আরবের সাথে ইসরায়েলের কতগুলো যুদ্ধ ইতিমধ্যে হয়ে গিয়েছে। ফিলিস্তিন নামক এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে হওয়া যুদ্ধে আরব বারবারই পরাজিত হয়েছে এবং এই ধরনের যুদ্ধ ও আরব কর্তৃক “ফিলিস্তিন আমাদের” এইরকম দাবী উত্থাপনের রাস্তা বন্ধ করার জন্য ইসরায়েল এই ফিলিস্তিনে বসবাসরত আরবি মুসলিমদের উদ্বাস্তু বানিয়ে রাখে। কনফ্লিক্টের শুরুটা একেকজন একেকরকম বলেন, কেও বলেন যে আরব প্রথম আঘাতকারী আবার কেও কেও বলেন তার উলটো। আজকের আলোচনার বিষয় “কে প্রথম আঘাত হেনেছে” তা নয় বরং কনফ্লিক্টের শুরু এবং এর মধ্যকার কার্যকলাপ ও প্রভাব নিয়ে৷ মূলত এই দ্বন্দ্বের মধ্যে আরব এবং ফিলিস্তিন একাই সামিল তা নয়। তাদের পেছনে সাপোর্টিং কান্ট্রিও বিদ্যমান৷ একইসাথে আছে হামাস, ফাতাহ, হিজবুল্লা এর মতো নানারকম ও নানা-পন্থী সংগঠন৷ তবে সাধারণত এই সংগঠনগুলো চরমপন্থী এবং এদের মূলভাবও রাষ্ট্রীয় নয় বরং ধর্মীয় বিদ্বেষ সংক্রান্ত৷ ইসরায়েল কেনো এখনো ফিলিস্তিনকে নিজেদের অংশ করে নিতে পারেনাই এবং আরবও কেনো তাদের নেসেসারি স্টেপস নিতে পারছে না এর পেছনেও রয়েছে এইসকল সংগঠনগুলোর প্রভাব। মূলত ইসরায়েলের অনেক জায়গাই তাদের নিজস্ব শাসনে চলে না। একইসাথে ফিলিস্তিনের অনেক জায়গাই ইসরায়েলের শাসনে চলে না৷ ঠিক এখানেই এই সংগঠনগুলোর সার্থকতা। যেমন, ১৯৬৭ সালের যুদ্ধটি আজকের সংঘাতের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, ইসরায়েল আগে থেকেই ওয়েষ্টব্যাঙ্ক এবং গাজাস্ট্রিপ নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল, দুটি অঞ্চল ভূখণ্ডের বিশাল জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। আজ, ওয়েষ্টব্যাঙ্ক নামেমাত্র ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং তা ইসরায়েলীয়দের দখলে রয়েছে। মূলত এই ওয়েষ্টব্যাঙ্ক থেকে ফিলিস্তিনি মানুষেরা চাকরি করে এবং সেনা-প্রশিক্ষন নিয়ে ইসরায়েলি সৈন্য হিসেবে কাজ, এরা ফিলিস্তিনি আন্দোলন এবং কার্যক্রমের উপর ইসরায়েলি সুরক্ষা নিষেধাজ্ঞা জারি করে এবং ইসরায়েলি বসতকারী বা সেটেলার ইহুদিরা যারা ওয়েষ্টব্যাঙ্ক এ চির সম্প্রসারিত সম্প্রদায় গড়ে তোলে যা ফিলিস্তিনিদের ভূমি কার্যকরভাবে অস্বীকার করে। অন্যদিকে গাজাস্ট্রিপ ইসলামপন্থী একটি মৌলবাদী দল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত যার নাম হামাস।

খন্ড ৫.

প্রতিটা কনফ্লিক্টের একটা কারণ থাকে। সাধারণত মুসলিমরা অনেকেই মনে করে যে “ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনের কোন্দলটা ধর্মীয় এবং সেখানে মুসলিম সমাজ নির্দোষ ও অত্যাচারীত। সব দোষ ইসরায়েলের, তারা ইসলামবিরোধী এবং এই কারণে মুসলিমদের উপর অত্যাচার চালাচ্ছে।” আসলে একটি ক্রনিক কনফ্লিক্ট বা দীর্ঘকাল ধরে চলতে থাকা অমীমাংসিত বিবাদের ভিত্তি এত সহজ একটি কারণে হতে পারেনা, এবং উন্নয়নশীল মুসলিম সমাজের এই ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত৷ আমরা জানি ইসরায়েল ইহুদিদের জন্য একটি পবিত্র জায়গা। কিন্তু, ইসরায়েল যতটুক স্থান আশা করেছিলো ততটুকু তারা পায় নাই (হিব্রু বাইবেলে ঈশ্বর যেটুকু স্থানকে প্রতিশ্রুত করেছিলেন অর্থাৎ, কানান রাষ্ট্রটি বর্তমান ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের সম্মিলিত রূপ৷)৷ ব্যাপারটি হচ্ছে এমন যে, একটি ইহুদি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র হিসেবে জুডাইজম সম্পর্কিত সকল নিদর্শন বা সকল পবিত্র স্থান ও উপাসনালয় নিজেদের রাষ্ট্রের অন্তর্গত করতে চেয়েছিলো৷ কিন্তু মাঝখানে যে বাধার তৈরি হয় তা হচ্ছে ফিলিস্তিন। ফিলিস্তিনে কতগুলো ধর্ম-সংশ্লিষ্ট স্থান আছে, এরমধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাটি জেরুজালেম যা একইসাথে মুসলিম এবং ইহুদি উভয়ের জন্য ঐতিহাসিক ভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই এই অন্যতম কারণেই বা গুরুত্বপূর্ণ জায়গার জন্যই এখনো ইসরায়েল ফিলিস্তিনকে জাপটে ধরে আছে। যেহেতু ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র সেই কারণে তারা নিরপেক্ষও হতে পারছে না৷ কনফ্লিক্টের কারণ জানা গেলো, এখন আমাদের মনে প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক যে এই “কনফ্লিক্টতো ফিলিস্তিনকে ইসরায়েলের অংশ করে নাগরিকত্ব প্রদান করে দিলেই হয়৷ সবাই জেরুজালেম সমানভাবে ব্যবহার করবে।” কিন্তু এইখানে একটা সমস্যা আছে তা হলো ইসরায়েলের জনসংখ্যা ৮ লাখ যার প্রায় ১.৫ লাখ মানুষ মাইনরিটি মুসলিম ও বাকি ৬.৫ লাখ মানুষ ইসরায়েলি ইহুদি। আবার ফিলিস্তিনের জনসংখ্যা ৭ লাখ যার সম্পূর্ণটিই মুসলিম। যদি এই ফিলিস্তিনের মানুষদের নাগরিকত্ব দিয়ে দেওয়া হয় তাহলে ইহুদিরা মাইনরিটি বা সংখ্যালঘু উপাধিটি অর্জন করে বসবে৷ ব্যাপারটি হাস্যকর যে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রে রাষ্ট্রধর্মযুক্ত মানুষ মাইনরিটি৷ ঠিক এই কারণেই ইসরায়েল ফিলিস্তিনকে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত করে নিতে পারছেনা এবং এখনো এই মানুষগুলো জিম্মি হয়ে আছে৷এই কনফ্লিক্ট সমাধানের জন্য আরেকটি সল্যুশন দাঁড় করানো হয়েছে৷ তা হচ্ছে “Two State Solution” যেখানে বলা হয়েছে “ইসরায়েল” ও “ফিলিস্তিন” দুটি আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াবে। কিন্তু আগেই বলেছি যে কনফ্লিক্টের শুরুই ফিলিস্তিনে থাকা পবিত্র স্থানগুলোকে নিয়ে তাই ইসরায়েল এই চুক্তিতে দ্বিমত পোষন করে৷ আবার “One State Solution” অর্থাৎ ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলকে এক করে দেওয়ার প্রস্তাবনাও অযৌক্তিক৷ এই নিমিত্তে এখনো পর্যন্ত এই দ্বন্দ্বের কোনো শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব হয় নাই।

খন্ড ৬.

একটি কনফ্লিক্ট সমর্থন ছাড়া চলতে পারেনা৷ এই ইসরায়েল-ফিলিস্তিন কোন্দলেও আরবপন্থী এবং ইসরায়েলপন্থী দেশ বিদ্যমান। প্রতিবেশী দেশগুলো এবং তাদের দৃষ্টিভঙ্গি সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা হলো:

১. সিরিয়া: এরা এন্টি ইসরায়েল রাষ্ট্রে এবং ইরানপন্থী। এদের চিন্তাভাবনার বিষয়বস্তু হিসেবে ফিলস্তিনের উপর অত্যাচার বা সেই সংক্রান্ত কিছুই নয় বরং এরা “গোলান হাইটস” নামক একটি জায়গার শাসনক্ষমতা চায় যা সেনাশক্তির জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এই জায়গার জন্যই এরা ইসরায়েলি বিরোধী আন্দোলনের সাথে যুক্ত।

২. ইরান: এরা মনে করে ফিলিস্তিনদের উপর ইসরায়েলের বিচার ও শাসন সঠিক নয়। ধর্মীয় দিক থেকেই হোক আর রাজনৈতিক দিক থেকেই হোক এরা এদের বিশ্বাসে অটুট। এরা ফিলস্তিনিদের অস্ত্রের ব্যবস্থা করাতেও বিশেষ ভূমিকা রাখে। ইসরায়েল তার সকল বিরোধী রাষ্ট্রের মধ্যে এই ইরানকে সর্বোচ্চ সমীহ করে৷ এছাড়াও ইরান “Axis Of Resistance” নামক একটি সিরিয়ান সংগঠন ছাড়া অন্যান্য সকল ইসরায়েল বিরোধী সংগঠনকে অর্থ সাহায্য করে থাকে৷

৩. লেবানন: লেবানন ‘হিজবুল্লা’ নামক একটি এন্টি-ইসরায়েল শিয়া টেরোরিস্ট সংগঠনের আবাসস্থল। লেবানন এদের অর্থ, বাসস্থান ও অস্ত্র দ্বারা সাহায্য করে৷ এই সংগঠন ও লেবাননের দৃষ্টিভঙ্গি ইসলামিস্টদের মতনই এবং এরা ফিলিস্তিনের মুসলিমদের জিম্মি করে রাখার বিরুদ্ধে দীর্ঘকাল যাবৎ আন্দোলনে যুক্ত।

৪. জর্ডান: এই রাষ্ট্রটি অনেক আগে থেকেই ইসরায়েলের সাথে শান্তিচুক্তিতে আবদ্ধ। নিরপেক্ষ সহচারী ছাড়াও আরেকটি পরিচয় এর আছে, জর্ডান এ থাকা ফিলিস্তিনিয়ান জিম্মির সংখ্যা সর্বাধিক। এরা সকল ফিলিস্তিনি জিম্মিদের নাগরিকত্ব প্রদান করে। তবে জর্ডান প্রশাসন এই ফিলিস্তিনিদের উপর অত্যাচারী হিসেবে পরিচিত৷অভিযোগ আছে এরা জিম্মিদের ঘনবসতিপূর্ণ জায়গায় রাখেন এবং একইসাথে তাদের উপর প্রবল অত্যাচার করে।

৫. সৌদি আরব: এরা ফিলিস্তিনি জিম্মিদের জন্য একটি বিশাল এমাউন্ট ডোনেট করে থাকে। এরা কোনো সংগঠন দ্বারা সাহায্য না করলেও অর্থনৈতিক সহায়তার মাধ্যমে অন্যান্য সংগঠনকে সাহায্য করে থাকে। মূলত এরা একটি নিরপেক্ষ ফিলিস্তিন সমর্থনে যুক্ত আছে।

৬. তুরস্ক: এরা ইসরায়েলের সাথে গাজাস্ট্রিপ সম্পর্কিত কনফ্লিক্টে আগে থেকেই যুক্ত ছিলো৷ তবে ফিলিস্তিনের ব্যাপারে তারা ততটা সক্রিয় নয়৷ বরং তারা একটি নিরপেক্ষ অবস্থানে দাড়িয়ে আছে৷ তবে শোনা যায় এদের নতুন ইসলামিস্ট প্রধানমন্ত্রী ফিলিস্তিনের উপর সামান্য সদয়।

৭. মিশর: এরা ইসরায়েলের সাথে অনেক আগে থেকে শান্তিচুক্তিতে আবদ্ধ।

দেখা যাচ্ছে, অনেকেই এই কনফ্লিক্টে যে কোনো কারণেই হোক ফিলিস্তিনকে সমর্থন করে যাচ্ছে। কিন্তু সমাধান এখনো আসে নাই৷ এই সকল প্রতিবেশী রাষ্ট্র ছাড়াও আরেকটি রাষ্ট্র এইখানে পক্ষপাতিত্ব করে সেটি হচ্ছে আমেরিকা৷ আমেরিকা এই কনফ্লিক্টে ইসরায়েলকে সমর্থন করে৷ সমর্থনের কারণ হিসেবে তুই রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সখ্যতাকে ধরা হয় এবং একইসাথে ধর্মীয় চরমপন্থীতাকেই একটি শক্ত যুক্তি হিসেবে অনেকে মনে করে থাকেন৷ আমেরিকা একটি বিশাল এমাউন্ট ইসরায়েলি সংগঠনদের চ্যারিটি ফান্ডিং হিসেবে ব্যয় করে এবং সৈন্য-অস্ত্র সহযোগীতা প্রদান করে৷

সারমর্ম

আমি এই পুরো লেখাটাতে বোঝাতে চেয়েছি ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বের একটি নিরপেক্ষ ওভারভিউ কেমন হউয়া উচিত৷ ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সরে এসে পুরো লেখাটিকে ছোট করলে দেখা যায় কয়েকটি পয়েন্ট:

ক) ইসরায়েল মূলত ইহুদিদের জন্য একটু প্রতিশ্রুত ও পবিত্র স্থান (অবশ্যই ধর্মীয়দিক থেকে প্রতিশ্রুত, অন্য কোন দেশ বা কোন সংগঠনের কাছে নয়। কাজেই আমরা বাস্তব প্রেক্ষাপটে একে অনেকটাই কাল্পনিক ধরতে পারি, কারণ এটি মূলত তাওরাত নির্ভর, যেটা একান্তই ইহুদিদের জন্য- সবার জন্য নয়। একই কথা সব ধর্মের ক্ষেত্রেই খাটবে। ঈশ্বরের প্রতিশ্রুত কোন ভূমি ফেরত পাওয়ার জন্য আরও প্রাচীন কোন জাতির ভূমি দখল করা যৌক্তিক নয়)৷ আরবের পাশে তারা যখন ইসরায়েল নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে তখন দেখা যায় যে আরবের “ফিলিস্তিন” নামক একটা অংশে তাদের কিছু পবিত্র স্থান দখলকৃত হয়ে আছে। যেহেতু তারা ধর্মকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র তাই তারা এই জায়গাটিকে ছাড়তে চান না। এইটি হচ্ছে কনফ্লিক্ট তৈরির মোটিভ।

খ) ফিলিস্তিন পূর্বে আরব অঞ্চলের একটি অংশ ছিলো৷ অর্থাৎ আরবের এখানে কনফ্লিক্ট শুরু করার কোনো কারণ নাই৷ অর্থাৎ বলাই বাহুল্য কনফ্লিক্ট তৈরির প্রথম স্টেপ নিয়েছিলো ইসরায়েল এবং কারণ ছিলো তাদের ধর্মকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদ এর নামরক্ষা।

গ) এই বিশাল কনফ্লিক্ট সৃষ্টি করার মুহূর্তে ইসরায়েল ৭ লক্ষ জিম্মিযুক্ত ফিলিস্তিনের উপর একটি অধিকার অর্জন করে৷ এই জিম্মিদের কারণে ইসরায়েলকে কেও এই কনফ্লিক্টের উপর ভিত্তি করে আক্রমন করতে পারছে না। এইটা হচ্ছে কনফ্লিক্টের মধ্যে ইসরায়েলের নিজেকে বিপদমুক্ত একটি রাজনৈতিক চাল৷

ঘ) ফিলিস্তিনকে ইসরায়েলের অংশ করে নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হলে তা গৃহীত হলো না কারণ ধর্মিয় জাতীয়তাবাদী একটি রাষ্ট্রে রাষ্ট্রধর্মাবলম্বী মানুষ সংখ্যালঘু হতে পারেনা৷ এইটা হচ্ছে সমাধান না হবার কারণ।

ঙ) এখন ইসরায়েল ও আরবের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ও অন্যান্য রাষ্ট্রের সমর্থন ও অসমর্থন এবং একইসাথে বিভিন্ন চরমপন্থী সংগঠন একে অপরের বিপক্ষে কার্যক্রম চালাচ্ছে৷ এইটা হচ্ছে কনফ্লিক্ট চলার কারণ।

পুনশ্চঃ
১. লেখাটিতে “ধর্মভিত্তিক জাতীতরাবাদ” নামক একটি টার্ম বারবার উল্লেখিত হয়েছে৷ এবং আশা করি আমি দেখাতে সক্ষম
হয়েছি এই টার্মটি কীভাবে প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব চালু রেখেছে।
২. লেখাটিতে আমি এইটা বোঝাতে চাইনাই যে ফিলিস্তিন সঠিক নাকি ইসরায়েল সঠিক। আমার সমালোচনার প্রধান বিষয়বস্তু
ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ৷ এবং দেখা যাচ্ছে যে আন্দোলনকারী সংগঠনগুলো এই জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী৷ অর্থাৎ “ফিলিস্তিনিরা মানুষ তাই আমরা সাহায্য করবো” এই কথাটির পরিবর্তে যে কথাটিতে হামাস, ফাতাহ, হিজবুল্লা বিশ্বাসীতা হচ্ছে “ফিলিস্তিনিরা মুসলিম তাই আমরা তাদের সাহায্য করবো।”
৩. আমি আগেই বলেছি যে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন কনফ্লিক্টটা কোনো ধর্মযুদ্ধ নয় বরং এই কনফ্লিক্টটার চালিকাশক্তি ধর্ম-সম্পর্কীয়৷
৪. এছাড়াও আরেকটি জিনিস এখানে প্রতিফলিত হয় যে “চরমপন্থীতাকে সমর্থনকারী জাতীয়তাবাদই বিশ্ব-শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রধান অন্তরায়৷”