কল্পনা করুন তো আপনি কোথাও খাঁচায় বন্দী আছেন… এমন একটা জায়গা যেখানে আপনাকে আরোপিত সব নিয়মকানুন কঠোরভাবে মেনে চলতে হয় কিন্তু আপনি বাক স্বাধীনতা তো দূরের কথা আপনার অধিকারটুকুও দাবি করতে পারেন না, যেখানে আপনার উপর যতই আঘাত আসুক, যতই নির্যাতন হোক না কেন আপনি কোন অভিযোগ করতে পারবেন না, যেখানে সামাজিক ন্যায়বিচারের দাবি করাটা একটা অপরাধ, যেখানে ভুলকে ভুল বা ফুলকে ফুল বলাটাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ, এমনকি আপনার বিচারের প্রহসনে আপনার মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। মনে করুন তো, এমন একটা জায়গায় বাস করেন যেখানে প্রতি সকালে ঘরের বাইরে পা রাখার পর থেকেই যেকোনো সময় আপনার উপর নেমে আসতে পারে সম্ভাব্য আঘাত, আপনার বাড়ি অথবা পরিবারের সদস্য যখন তখন আক্রমণের শিকার হতে পারে। চিন্তা করুন তো এমন এমন একটা জায়গায় আপনি বাস করেন যেখানে রাতের বেলা যেকোনো সময় আক্রান্ত হতে পারেন আশঙ্কায় আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারেন না, অথবা কেউ কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ আপনার বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দিলো, যেখানে আপনার তার স্কুলে প্রতিদিনই কোন না কোন সমস্যায় জর্জরিত, যেখানে আপনি কিছু নির্দিষ্ট মানুষকে সম্মান করতে বাধ্য, অথবা কোন সামাজিক রীতিনীতি হোক না তা যতই তুচ্ছ, অনর্থক কিন্তু শ্রদ্ধা করতে আপনি বাধ্য। এরকম আরও অনেক দুঃস্বপ্নের মত বাস্তবিক পরিস্থিতি কিন্তু আসলে কাল্পনিক নয়, এটা নিয়ে আপনাকে খুব বেশি চিন্তাও করতে হবে না, এমন ঘটনা কোথায় ঘটে।

জীবনের ১৯টি বছর আমি পাকিস্তানে কাটিয়েছি। পাকিস্তান হলো ইসলামিক রিপাবলিক দেশ। একজন অবিশ্বাসী, সন্দেহবাদী, মুক্তমনা বা নাস্তিকের যদি কখনো সত্যিই জাহান্নাম দেখার বাতিক জাগে তাহলে পাকিস্তানে ঘুরে আসতে পারেন। ইসলাম এখানে চূড়ান্ত সুরক্ষিত, প্রতাপের সাথে রাজত্ব করছে। আমি শুধু নির্দিষ্ট করে পাকিস্তানের কথা বলছি না, আপনি যেকোনো ধর্ম নিয়ন্ত্রিত দেশে বিশেষত ইসলামিক রিপাবলিক দেশে যান, আপনি নিজেকে আবিষ্কার করবেন বোবা, কালা, অন্ধ, চলৎশক্তিহীন, মগজশূন্য একটা জড় বস্তু হিসেবে। ইসলাম নিয়ন্ত্রিত দেশে আপনি প্রকাশ্যে আপনার মতামত ব্যক্ত করতে পারবেন না। কারণ খুব সহজ ইসলামিক রিপাবলিক দেশের শরিয়া আইন এতটাই কট্টর যে বাক স্বাধীনতার সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। আপনি কোন প্রশ্ন করতে পারবেন না, কোন কিছু বিশ্বাস করা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারবেন না যদিও সেই বিশ্বাসের কোন প্রমাণ নেই, ভিত্তি নেই, তবুও সমাজে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। আপনি নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না কিভাবে আপনি জীবন যাপন করতে চান কারণ আপনি যা চিন্তা করতে চান এবং যাপন করতে চান জীবন তার সব সমস্ত নিয়মাবলী আপনার জন্মের কয়েকশ বছর আগেই নির্ধারিত হয়ে রয়েছে। পরিস্থিতিটা যেন এরকম যে আপনি নিঃশ্বাসের বিনিময়ে আপনার জীবন বেচে দিয়েছেন আর বেঁচে আছেন এটাই চরম সুখের আর কী চাই? ইসলামিক রিপাবলিকে বাঁচতে হলে হয় আপনাকে মগজধোলাই করে বানোয়াট কিছু বিশ্বাস ঢুকিয়ে দেয়া হবে খুলিতে এবং বুলি সর্বস্ব ফাঁকা মিথ্যা অহংকার নিয়ে বড় হবেন। গভীরভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা ছোটবেলাতেই দূর করে দেয়া হবে। অথবা অজ্ঞেয়বাদী মুক্তমনা বা নাস্তিক তকমা গায়ে লাগিয়ে প্রতিদিন মৃত্যু ভয় নিয়ে প্রাণ হাতে করে নিয়ে বেঁচে থাকবেন।

কী দেখেছি, কেমন সময় অতিক্রম করেছি আর কী হয়ে গেছি

আমি ছোটবেলায় আমি নিজের শহরেই সেনাবাহিনী পরিচালিত স্কুলে পড়তে যেতাম। সাধারণ ধর্মীয় শিক্ষা বাদেও প্রতি শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে ইসলামিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক। বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হয়ে প্রথম সেমিস্টারের আগ পর্যন্ত আমি ইসলাম শিক্ষা পড়তে বাধ্য হয়েছি। যদি কেউ অমুসলিম হয় তার জন্য ইসলামের পরিবর্তে ঐচ্ছিকভাবে ইংরেজি বিষয়ে পড়ালেখার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু আমার মত মুসলিম পরিবার থেকে এসেছে তাদের জন্য ইসলামিক শিক্ষা মোটেও ঐচ্ছিক বিষয় নয়।

আমি আসলেই কোনদিন ইসলামের ইতিহাস শিক্ষায় মনোযোগ দিতে পারিনি। যারা আমাকে ইসলাম শিক্ষার শিক্ষক ছিলেন তাদেরকে ধন্যবাদ, ইসলামের ইতিহাস নিয়ে পড়তে গিয়ে গভীর আলোচনা, পড়াশোনা না করলে হয়ত আমি আজকে নাস্তিক হতে পারতাম না। কিন্তু আমি দেখেছি ছাত্রদের মাঝে ইসলামকে কীভাবে মহান করে উপস্থাপন করা হয় এবং ছাত্রদেরকে শেখানো মুসলিম হিসেবে জন্মগ্রহণ করে সে কতটা গর্বিত। ইসলামকে একতরফা শ্রেষ্ঠ দাবি করা এবং মুসলিম হিসেবে জন্মগ্রহণ করার ভিত্তিহীন অহংকার স্কুল, পরিবার সমাজ থেকে শিশুদের মনে আস্তে আস্তে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। যেমন, ইসলাম শিক্ষার শ্রেণিকক্ষে এক অধ্যায়ে মুহম্মদ গজনীর হিন্দুদের সোমনাথ মন্দির আক্রমণ নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছিল। শ্রেণি শিক্ষক নিজেও ইসলামের গৌরবের ভারে ভারাক্রান্ত এবং মুহম্মদ গজনীকে তিনি “মহান যোদ্ধা” হিসেবে উপস্থাপন করছিলেন। ইসলাম শিক্ষার সেই অধ্যায়টি পড়ে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে হিন্দুদের নিজের ভূমিতে বংশপরম্পরায় মালিকানার মন্দিরে মুহম্মদ গজনী আক্রমণ করেছিল, অন্যায়ভাবে হত্যা করেছিল মন্দিরের পুরোহিত এবং স্থানীয় হিন্দু অধিবাসী, ধ্বংস করে ফেলে সোমনাথ মন্দিরের মূর্তি, লুণ্ঠন করে নেয় মন্দির এবং এলাকার হিন্দু জনগোষ্ঠীর সোনা, মূল্যবান ধনসম্পদ, রত্ন এবং লুটের সম্পত্তির সিংহভাগ নিজের দখলে রেখে বাকি অংশ গনিমতের মাল হিসেবে মক্কা এবং মদিনায় পাঠিয়ে দেয়। যদি কেউ ন্যূনতম বোধসম্পন্ন, কিঞ্চিত সভ্য আর সুস্থ স্বাভাবিক হয় তাহলে সে সহজেই বুঝতে পারবে, মুহম্মদ গজনী একজন ভাগ্যান্বেষী খুনি বর্বর ছাড়া কিছুই নয়। কিন্তু মুসলিমদের জন্য একজন বর্বরই বিশাল বীর, কারণ সে হিন্দু মন্দির ভেঙে হিন্দুদের দেবদেবীর মূর্তি ধ্বংস করে, হিন্দু সম্প্রদায়কে নির্বিচারে হত্যা করেছিল, তাদের সম্পত্তি লুট করে নিয়েছিল। মুহম্মদ গজনীর লুট করা অর্থেই গড়ে উঠেছে নবী মহম্মদের শহর, নগর। এটা বলা কোনভাবেই অতিরিক্ত বলা হবে না যে মদিনা নগরীর বিলাসী ভবন আর উন্নয়ন হয়েছিল অতীতের অমুসলিমদের রক্তের দামে।

আমি ইসলামের ইতিহাসের এই অধ্যায়ের দিকে তাকিয়ে গর্ব করার মত কিছু খুঁজে পেলাম না।আমি ইসলামের ইতিহাস শিক্ষকের কাছে একটা অতি সাধারণ প্রশ্ন করলাম, “মুহম্মদ গজনী যদি হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে সঠিক কাজ করে থাকে তবে ১৯৯২ সালে হিন্দুরা বাবরি মসজিদ ধ্বংস করলে আমরা সমালোচনায় ক্ষোভে ফুঁসে উঠি কেন?” আমার তো মনে হচ্ছে মুহম্মদ গজনী অতীতে হিন্দু মন্দির এবং তাদের পুরোহিতের সাথে যেটা করেছে হিন্দুরা আমাদেরকে আজকে সেটার জবাব দিয়েছে। এই সাধারণ প্রশ্নের কারণেই, মাসের পর মাস আমার সহপাঠী বন্ধুরা আমাকে উত্যক্ত করতে শুরু করে এবং নাস্তিক বলে গালাগালি দেয়।

বন্ধুরা এক পর্যায়ে বুঝতে পারে তারা আমাকে উত্যক্ত করছে। কিন্তু আমার নিজের কাছে মনে হয় শুধু এক ধর্মের অনুসারী হওয়ার সুবাদে একজনের জঘন্য অত্যাচারের কাজের ইতিহাস জেনে ইতিহাসের সত্য বিস্মৃত হয়ে বেঁচে থাকা যায়। নাস্তিকের তকমা গায়ে লাগিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মুক্তচিন্তার মানুষ হিসেবে ধর্মাশ্রয়ীদের তোপের মুখে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া অনেক সহজ এখানে। শুধু তাই নয়, স্কুলের আমার সব শিক্ষক যারা আমাদের ইসলামের ইতিহাস পড়াতেন তারা সবাই আমাকে পড়াতেন সবাই ঘৃণা করতে থাকেন।

যখন আমি দশম শ্রেণিতে উঠলাম তখন আমাদের ইসলাম শিক্ষার আংশিক বা পুরোটা অধ্যায় জুড়েই থাকত আরবি লেখা কোরআন। আমি আরবির কিছুই জানতাম না। প্রকৃতপক্ষে আমাদের স্কুলের প্রতি ক্লাসের প্রধান দরজার উপরে লেখা থাকত “ইংরেজিতে কথা বল” কিন্তু যদি ছাত্র আরবিতে কোরআন পড়তে না পারত তবে তার জন্য শাস্তির অভাব ছিল না।

সুতরাং পাকিস্তানে বাস করে আমি বুঝে গেলাম আমাকে আরবি শিখতে হবে, অনর্গল কোরআন তেলাওয়াত শিখতে হবে, পবিত্র রমজান মাসের পবিত্রতা রক্ষা করে চলতে হবে, আজানের সময় আজানকে সম্মান দেখিয়ে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকতে হবে এবং অবশ্যই নামাজ পড়তে যেতে হবে। ইসলামিক রিপাবলিক দেশে আপনাকে পুরো রমজান মাসে দিনের বেলায় না খেয়ে থাকতে হবে যাতে আশেপাশের ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত না লাগে, আপনার কারণে যেন তাদের রোজা ভঙ্গ না হয় সেটা খেয়াল রাখতে হবে। এটা শুধু পাকিস্তানের দৃশ্য নয় রমজান মাসের এই চিত্র দেখা যায় মুসলিম অধ্যুষিত সব দেশে। রমজান মাসে প্রকাশ্যে পানাহারের অভিযোগে আপনাকে প্রকাশ্যে পেটানো হতে পারে।

আমরা সামাজিক জীব। পৃথিবীতে মানুষই একমাত্র প্রাণী যাদের মস্তিষ্কের সর্বাধিক বিকাশ হয়েছে। আমরা চিন্তা করতে পারি, প্রচলিত কোন বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করতে পারি, প্রশ্ন করতে পারি, গবেষণা করতে পারি, আবিষ্কার ও উদ্ভাবন করতে পারি। আর এভাবেই মানুষ আজকের উন্নত প্রাণীতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু যদি মানুষকে বলা হয়, আপনারা আর চিন্তা করবেন না। যদি এখন থেকে চিন্তা করেন এবং কোন বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করেন, তবে আপনার সন্দেহ আর চিন্তা মৃত্যুর দিকে ধাবিত করবে। যদি আপনার গবেষণা এবং আবিষ্কারের নেশাকে অনৈতিক এবং ক্ষতিকর মনে করা হয় তখন কেমন লাগবে? যদি আপনার উদ্ভাবনকে মনে করা হয় আইনের পরিপন্থী? কেমন হবে যদি দেখেন আপনার চারিপাশের মানুষ প্রগতিকে পছন্দ করছে না বরং প্রতিনিয়ত তাগিদ দিচ্ছে ৭ম শতকে ফিরে যেতে?

মনে করুণ আপনি কারো ভাই, আপনার ছোট একটা বোন আছে। আপনি বাস করছেন চলমান আতংক মিশ্রিত ভয়ের মধ্যে। কেমন মনে হবে আপনার কাছে যদি দেখেন আপনার ছোট বোনটি হাসপাতালে ভর্তি, তার শরীরে সর্বত্র নির্যাতনের ছাপ স্পষ্ট, তার মুখে পাঁচ আঙুলের চড়ের দাগ, তার পোশাক কেউ ছিঁড়ে ফেলেছে হ্যাঁচকা এক টানে, তার চোখ বলছে বেঁচে থাকার জন্য সে কতটা লজ্জিত? এবং যখন আপনি আদালতে গেলেন, আপনার নির্যাতিত বোনকে বলা হলো কয়েকজন সাক্ষী হাজির করতে যারা দেখেছে তাকে শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়েছে এবং নিশ্চিত করতে হবে যে সে কাপড়ের বস্তার মত বোরখা পরেছিল কিনা? সে যদি চারজন সাক্ষী জোগাড় করতে না পারে তাহলে কোন মামলা দায়ের করা যাবে না। সুতরাং আইনের চোখে কোন ধর্ষণ হয় নি! তখন কি আপনি জনে জনে জিজ্ঞেস করে বেড়াবেন, ভাই, একটু শুনবেন, এই মেয়েটাকে দেখেছেন? সে আমার বোন, আপনি কি দেখেছেন সে ধর্ষিত হয়েছে? প্লিজ ভাই, আমাকে একটু সাহায্য করেন, আমার চারজন সাক্ষী দরকার! অথবা আপনি কি নিশ্চুপ থাকবেন এবং কখনো আপনার বোনকে ভাই হিসেবে আপনার মুখ দেখাতে পারবেন?
যদি আপনি একজন বড় বোন হন এবং দেখেন আপনার ছোট ভাই বাড়িতে ফিরে এসেছে ভাঙা আঙুল নিয়ে, কারণ সে স্কুলে এক-পিস রুটি তুলে খেয়েছিল রমজানের দিনে, অথবা যদি দেখেন আপনি রমজানের দিনে স্কুলে টিফিন দিয়েছিলেন বলে কেউ আপনার ভাইয়ের চোয়াল ভেঙে দিয়েছে কেমন লাগবে আপনার? যদি আপনি এমন একটা সমাজে বাস করেন যেখানে আপনার চারপাশের মানুষের ব্যক্তির প্রতি কোন সম্মান নেই, ব্যক্তি সম্মান নিয়ে কারো কোন মাথা ব্যথা নেই, কারো কোন স্বাভাবিক বিচার বিবেচনা বোধ নেই তখন আপনি কী করতে পারেন? সেখানে কীভাবে বাস করবেন? একজন দাসের মত অনুভূতি নিয়ে বেঁচে থাকা, আপনি যা নিজে অন্তর থেকে ধারণা করেন না তাই অনবরত সেজে থাকার অভিনয় করা, আপনার নিজেকে প্রকাশ করার উপর বিধিনিষেধের অব্যক্ত যন্ত্রণা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না।

মূল লেখার লিংক: Life as an Atheist in an Islamic Republic