লিখেছেন: কাজল কুমার দাস

বিংশশতাব্দীর বিজ্ঞানের এ যাত্রার আপনি হাতের মুঠোয় স্মার্টফোন নিয়ে হয়ত এই মুহুর্তে প্লান করছেন এবার ঈদে স্বামী বা বন্ধুর সাথে ঘুরতে যাবেন ব্যাংককে! অষ্টাদশ শতাব্দীতে একটি মেয়ের কল্পনায়ও এসব আসেনি। তখন বাড়ির বাইরে বের হওয়াটাই তাদের জন্য ছিলো কষ্টকর, স্বাধীনতা তো অনেক দূরের বিষয়। ঠিক সেই সময়ে ফ্রান্সের নিভৃত এক গ্রামে জন্ম নেন জোন ব্যারে। ছোটবেলা থেকেই জোন সমুদ্রের নীল জলের প্রেমে আবদ্ধ হয়ে পড়ে; মাটির একঘেয়ে জীবনে সে বড্ড হাঁপিয়ে উঠেছিলো। আর একদিনের একটা সুযোগ তাঁকে তাঁর জীবনের লক্ষ্যে পৌছে দিলো। একজন বিজ্ঞানী সমুদ্র সফরে যাচ্ছেন অজানা দ্বীপের সন্ধানে, ওনার একজন সহকারী চাই। জোন ব্যারে একটা বুদ্ধি করে মুখে নকল গোঁফ লাগিয়ে, মাথায় টুপি পরে পুরুষ সেজে চাকরি নিলেন সেই উদ্ভিদ বিজ্ঞানীর সহকারী হিসেবে! এমন চটপটে একটি সহকারী পেয়ে দারুণ খুশিও হলেন বিজ্ঞানী। জাহাজের কেউ জানতেই পারলো না তাদের সাথে থাকা মানুষটি একটি রমনী। এদিকে প্রতিদিন নতুন নুতন আবিষ্কারের উত্তেজনায় এবং প্রথমবারের মতো সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার আনন্দে বিভোর জোন ব্যারে।

এদিকে পুরো পৃথিবী ভ্রমন করে অজস্র নাম না জানা উদ্ভিদের নমুনা বোঝাই জাহাজে যখন ফিরছিলেন ব্যারে, তখনই ঘটলো বিপত্তি। মধ্য সমুদ্রে হঠাৎ উঠলো ঝড়; আর সে ঝড়ে- ঢেউয়ের ধাক্কায় কে কোথায় হারিয়ে গেল তাদের আর পাওয়া গেল না। জোন ব্যারে আকস্মিকভাবে প্রাণ বাঁচিয়ে ফিরলেন প্যারিসে, সাথে সেই অজানা সব উদ্ভিদের নমুনা নিয়ে। গেলেন প্রকৃতি বিজ্ঞানের সে সময়কার সবচেয়ে বড় জাদুঘরের কাছে; তারা গুণে দেখলেন ব্যারে প্রায় তিন হাজার অজানা উদ্ভিদের নমুনা নিয়ে এসেছেন, বিজ্ঞানীরা সবাই অবাক, কারণ এমন অনেক উদ্ভিদকে এর আগে দেখেনি কেউ। সবাই যখন তার এই কৃতিত্বের জন্য অভিনন্দন জানাচ্ছিলেন, এমন সময় সকলের সামনে মুখের নকল গোঁফ তুলে ফেললেন ব্যারে, ছুঁড়ে ফেললেন মাথার টুপিও। সবার তো চক্ষু কপালে! ব্যারের কোমর পর্যন্ত দীঘল কালো চুল। সমবেত অতিথিবৃন্দের সামনে ঘোষণা করলেন ব্যারে- “নারীরাও সমুদ্র বিজয় করতে পারে”। শ্রদ্ধায় অবনত হলো উপস্থিত সকলে। সম্মানে এবং পুরষ্কারে ভূষিত হলেন জোন ব্যারে, আর অষ্টাদশ শতাব্দীতে পৃথিবীর বুকে এঁকে গেলেন সাহসিকতার ইতিহাস।

এরকমই আরেকজন ফরাসী বিজ্ঞানী মারি ক্যুরি। ১৮৬৭ সালে পোল্যান্ডের ওয়ার্সাতে মারি ক্যুরি জন্মগ্রহণ করেন। মেধাবী এই ফরাসি বিজ্ঞানী ১৯০৩ সালে তেজস্ক্রিয়তার ওপর গবেষণার জন্য নোবেল পুরস্কার পান। তিনিই ১৯১১ সালে রসায়নে’ও নোবেল পুরস্কার জয় করে প্রথম মহিলা বিজ্ঞানী হিসেবে বিজ্ঞানের দুটি ভিন্ন শাখায় দুবার নোবেল পুরস্কার পাওয়ার ইতিহাস তৈরি করেন। তিনি ছিলেন প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা অধ্যাপক। মারি ক্যুরিই প্রথম মহিলা বিজ্ঞানী যিনি নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

ভোভালেন্তিনা তেরেশকোভার, এ নামটা অনেকেরই শোনার কথা নয়। ১৯৩৭ সালে রাশিয়ার বলশোয়ে মাসলেনিকোতে জন্ম হয় ভোভালেন্তিনা তেরেশকোভার। দশ বছর বয়সে ১৯৪৫ সালে বিদ্যালয়ে যেতে শুরু করেন তিনি; আবার ১৯৫৩ সালে বিদ্যালয় ত্যাগও করেন। এরপর দূরশিক্ষণ পাঠ্যক্রমে ছাত্রজীবন অতিক্রম করেন। শৈশবকালে তিনি প্যারাসুটের মাধ্যমে আকাশে চড়ার স্বপ্ন দেখতেন। ২২ বছর বয়সে, ১৯৫৯ সালে তিনি প্রথম আকাশ থেকে লাফ দেন। এ অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানই তাকে নভোচারী হিসেবে যোগ দিতে ব্যাপকভাবে সহযোগিতা করেছিল। ১৯৬১ সালে তিনি স্থানীয় কমসোমল বা যুব কমিউনিস্ট লীগে যোগ দেন এবং পরবর্তীকালে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টিতে। ১৯৬৩ সালের ১৬ জুন মহাকাশযান ভস্তক ৬ এ করে ৭১ ঘণ্টায় ৪৮ বার কক্ষপথ পরিভ্রমণ করেন ভ্যালেন্তিনা তেরেসকোভা । চার শতাধিক আগ্রহী নারীর মধ্য ভ্যালেন্তিনা তেরেসকোভা বিশ্বের প্রথম নারী যিনি মহাশূন্য অভিযানের জন্য সুযোগ পেয়েছিলেন।

এবার এলিজা কার্সন, অনেকেই বিংশ শতাব্দির এ বিস্ময়কর নামটা শুনে থাকবেন। ২০১৯ সালে দাড়িয়ে তাঁর বয়স খুব একটা বেশি নয়, মাত্র আঠের। পৃথিবীতে নেমে আসা নয়, মঙ্গলের বুকেই হারাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আঠারো বয়সী তরুণী এলিজা। যদিও, মঙ্গলের পথে একমুখী যাত্রা এখনি শুরু হবে না, এই না ফেরার যাত্রা কিংবা নতুন গ্রহে পদার্পণের যাত্রার শুরু হবে ২০৩৩ সালে। তবে এই জন্যে তাকে নিতে হয়েছে কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত। এলিজা বর্তমান নাসার সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। এলিজা জানে না কে তার মা। বাবার কাছেই বেড়ে ওঠা তার; সিঙ্গেল প্যারেন্টস হিসেবে। বাবাই তাকে আলবামার একটি স্পেস ক্যাম্পে নিয়ে গিয়েছিল। শুধু তাই নয়, ১২ বছর বয়সে এলিজা সবচেয়ে কম বয়েসী হিসেবে আলবামা, কানাডার কুইবেক ও তুরস্কের ইজমিরে নাসার তিনটি ভিন্ন স্পেস ক্যাম্পে অংশ নেন। এই ক্যাম্পের অভিজ্ঞতা তার মনোজগতে প্রভাব রাখে। মহাকাশ সম্পর্কে তার অগাধ কৌতুহলের জন্ম হয়। মহাকাশচারী সান্ড্রা ম্যাগনাসের সহযোগিতা তাকে নিজের জীবনের লক্ষ্য নতুন করে চিনতে শিখিয়েছে। একারণেই হয়ত, এই গ্রহের ওপারে যে রহস্য, মঙ্গল জয়ের যে বাসনা, বিজ্ঞানীদের অনবরত যে চেষ্টা তাতে সে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছে। ক্যাম্পগুলোতে থাকার সময় এলিজা শিখেছে মহাকাশ সম্পর্কিত জ্ঞান। জেনেছে মহাকর্ষ বিহীন স্থানে কিভাবে চলতে হয়। রোবোটিকস বিষয়েও সে শিক্ষা নিয়েছে। এমনিতে নাসা সাধারণত ১৮ বছর হবার আগে কাউকে নভোচারী হবার সুযোগ দেয় না। এলিজা সেই সুযোগ পেল। নাসাও চেয়েছে মঙ্গল অভিযান এবং মঙ্গলের বুকে প্রাণের বসতি গড়বার সে নিরন্তর চেষ্টা সেই মিশনে এলিজা প্রস্তুতি গ্রহণ করুক সময় নিয়েই। ২০৩৩ সালে যখন নাসার অভিযান শুরু হবে, তখন এলিজার বয়স হবে ৩২, সেই মুহুর্তে এলিজা মোটামুটি এমন অভিযানে যাওয়ার জন্য বেশ উপযুক্তই হবেন।

এলিজা প্রথম মানবসন্তান হয়ে মঙ্গলের বুকে পা রাখবেন। সেখানে তিনি দুই তিন বছর ধরে বিভিন্ন এক্সপিরিমেন্ট চালাবেন। খাদ্য উৎপাদন করার চেষ্টা চালাবেন, বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা চালানোর কাজ করবেন। মঙ্গলের বুকে প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজবেন, সম্ভাবনা খুঁজবেন। তিন বছর বয়সে ‘দ্যা ব্যাকইয়ার্ডিগানস’ কার্টুন দেখে মহাকাশ সম্পর্কে যে আগ্রহের জন্ম হয়েছিল, বেঁচে থাকলে আর এক যুগের কিছু সময় পর এলিজা সেই স্বপ্নের ভ্রমণে যাবেন। সে লক্ষ্যেই নিজেকে প্রস্তুত করছেন। ট্রেইনিং নিচ্ছেন, বিভিন্ন স্কিল শিখছেন। নাসার মঙ্গলের অভিযানে যাওয়ার পর পৃথিবীতে আর ফেরা হবে না তাঁর; এটা সে মেনে নিয়েছে। সেজন্য তাকে কিছু শর্তেও রাজি হতে চেয়েছে। তাই নাসার সাথে সে একটি সন্মতিপত্রে স্বাক্ষর দিয়ে তাকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হয়েছে যে, সে বিয়ে করতে পারবে না। কোনো প্রকার যৌন সম্পর্ক কিংবা সন্তান ধারণের মতো কোনো কাজ করতে পারবে না। এই বয়সী একটি মেয়ের জন্য এমন সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিনই বটে। পুরো জীবন যার সামনে পড়ে আছে, সে কেন এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে? এতবড় একটা ভাবনা এলিজার- তাই নিজের জীবনের সাথে জড়াননি কাউকে। অন্যান্য টিনএজারের মতো তার জীবন নয়। সবাই যখন নিজের সোশ্যাল লাইফ নিয়ে ব্যস্ত এলিজা তখন নিজের ভবিষ্যৎ মিশন নিয়ে বলছে-“যেখানে আমি যাব সেখানে আগে কেউ যায়নি। এটা ডেঞ্জারাস মিশন। তাই পৃথিবীতে কাউকে ভালবাসার পিছুটান রাখা এই মিশনের জন্য ডিস্ট্রাকশন।”

জোন ব্যারে, মারি ক্যুরি, ভোভালেন্তিনা তেরেশকোভার বা এলিজাদের ভাবনাগুলো এভাবেই আকাশকে ছুঁয়েছে। এ অঞ্চলের একজন সাধারণ বা অসাধারণ নারী হিসেবে আপনি কদ্দুর অবধি যেতে পারবেন আপনার ভাবনার বলয় ভেঙ্গে? কতটা সাহস আছে আপনার ভাবনার? স্বামীর পায়ের নীচে স্ত্রীর বেহেস্ত টাইপের পারিবারিক সংস্কারে বেড়ে ওঠা আপনারা কি ভাবতে পারেন; আড্ডা, বিনোদন, শপিং, প্রেম, বিয়ে, পুরুষের মনোরঞ্জনের জন্য অলংকরণ আর সন্তানোৎপাদনের বাইরেও একটা জীবন আছে! অনেক বড় সে জীবন খুঁজে পেয়েছে এলিজারা, তাঁরা আবিস্কার করেছে নিজেকে। তাইতো যখন এলিজারা মঙ্গলে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছে তখন আমাদের দেশের ফান্ডামেন্টালিস্টরা হুংকার দিচ্ছে নারী শিক্ষার বিরুদ্ধে। বিংশ শতাব্দীর এই আলোতে এসেও অন্ধকারে জন্ম নেয়া আমাদের মগজ ঠুকরে খাচ্ছে ধর্ম নামের আফিম। মাদ্রাসার অন্ধকারে নুসরাতরা আজ পুড়ে মরছে? তনুরা হত্যা হচ্ছে। পাবলিক বাসে দলবেধে হায়নারা ধর্ষন করছে নারীদের। ২ বছরের শিশু হোক বা সত্তর বছরের বৃদ্ধ; কারোরই রেহাই নেই এ অভিশপ্ত ভূমিতে। কুসংস্কারাচ্ছন্ন আর স্থবির আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় বেড়ে ওঠা এসব অসহায় নারীরা নিজেদের চিনতে কি পারবে; কোনদিন?

এই কালো মেঘ কাটিয়ে আমাদের এলিজারা কখনো কি পারবে; শেকল ভেঙ্গে উড়তে নীলাকাশে?