পাগল শব্দটি বড়ই মজার। তিন অক্ষরের এ শব্দের অভিব্যক্তি বহু বিচিত্র। এটি যেমন ব্যক্তির মানবিক অস্তিত্বের এক বিপর্যস্ত অবস্থাকে নির্দেশ করে থাকে অর্থাৎ যার মাথাটি ফাঁকা তাকে যেমন বুঝায় তেমন যার মাথায় সাধারণের তুলনায় মাল-মশলা একটু বেশি তাদেরকেও বুঝায়। অনেক সৃষ্টিশীল খেয়ালি মানুষ এ শব্দকে নামের আগে খেতাব হিসেবে ব্যবহার করে নিজেকে প্রকাশ করেন। কখনো অপমানজনক গালি হিসেবে এর ব্যবহার হয় আবার এ শব্দ দিয়ে পরম মমতারও প্রকাশ ঘটে। কথনে লেখনে সমাজে সাহিত্যে এ শব্দের ব্যাপক উপস্থিতি। জন্মদাত্রী মায়ের কাছে প্রতিটি সন্তানই পাগল। আমার ‘পাগল ছেলে’ বলে প্রত্যেক মা ই নিজ সন্তানের প্রতি তার শ্রেষ্ঠতম সোহাগটি দান করেন। প্রায় সব বাঙ্গালীই প্রথমবারের মত পাগল খেতাবটি অর্জন করে স্নেহময়ী মায়ের কাছ থেকে। আবার সেই নারীই যখন স্বামী বেচারার বিশেষ একটি সখ বা নেশার প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন-লোকটা এ বয়সেও যাত্রা নাটকের জন্য পাগল’ তখনও পাগল শব্দটির ব্যঞ্জনা অন্য রকম হয়। এরকম ‘গানের পাগল’ ‘বইয়ের পাগল’ সখের বা অর্থের পাগলে সমাজটিই পরিপূর্ণ। সোহাগে আদরেও প্রিয়তমা পত্নীর মানভঞ্জন করতে না পেরে যখন বলে-আহা,পাগলামি করোনাতো তখন পাগলামির আরেক মাত্রা প্রকাশ করে। আবার স্বামীর খুনসুটিতে বিগলিত স্ত্রী যখন বলে-কী পাগলামি শুরু করেছ’ তখন তা হয়ে ওঠে পাগলামির উষ্ণতম এক প্রকাশ। মান্না দে যখন গান ‘তুমি যখন পাগল বলো ধন্য যে হয় সে পাগলামি’ তখন আক্ষরিক অর্থেই সেই পাগলামি রোমান্টিকতার এক অনন্য দ্যোতনা পেয়ে যায়। দিলরুবা খানের ‘পাগল মন’তো এক সময় সকল সঙ্গীত পাগলকেই পাগল করে ছেড়েছিল। লাইলী প্রেমে মজনু পাগল শিরী প্রেমে ফরহাদ পাগল আর নর নারীর পরস্পরের প্রেমে পাগল হওয়ার আকুতি আর আবেগ নিয়ে কত গাঁথা কাহিনী গল্প উপন্যাস কাব্য মহাকাব্য গান রচিত হয়েছে তার পরিসংখ্যান দেয়া কি সম্ভব ? নর নারীর এই পাগলামি হলো ভাবের কিন্তু এই ভাবের পাগল বাস্তব পাগলে রূপান্তরিত হওয়ার নজীরও অনেক। স্কুলজীবনে আমার এক সুন্দরী সহপাঠিনীর প্রেমে পড়েছিলেন এক মেধাবী সিনিওর ভাই। প্রাইভেট পড়ানো থেকে শুরু। দিনে দিনে মেধাবী মানুষটির অন্তরে এই প্রেম মহীরুহ হয়ে ওঠে কিন্তু সহপাঠিনীর বিয়ে হয়ে যায় এক পুলিশ কর্মকর্তার সাথে। কেচ্ছাকাহিনীর মজনুকে দেখেছিলাম এই বড় ভাইয়ের কাছে। তার পড়ালেখা গেল। সম্ভাবনাময় ভবিষ্যত গেল। সমাজ সংসার ভেসে গেল। দেখতাম তসবি জপের মতো তিনি অনবরত সেই প্রেমিকার নাম জপছেন।এই জপতপ করতে করতেই একদিন তিনি ভবলীলা সাঙ্গ করলেন। শরৎচন্দ্রের ‘দেবদাস’ও এক সময় পাগলের চূড়ান্ত পর্যায়েই চলে গিয়েছিল। আর এই পাগলামি যদি উন্মত্ততার পর্যায়ে চলে যায় তখন আরেক বিপদ।তার জলজ্যান্ত প্রমাণ সিলেটের খাদিজার উপর প্রেমিক বদরুলের বেপরোয়া হামলা।সকল বাউল কবিই স্বঘোষিত পাগল।নামের আগে পাগল ভনিতাটি না বসাতে পারলে তাদের বাউল পরিচয়টিই যেন অপূর্ণ থেকে যায়।‘পাগল অমুক বলে’ বাউল গানের এক অতি পরিচিত ভনিতা। উনবিংশ শতকের এক প্রখ্যাত লোককবি কানাই সেখ নাম ধারণ করেন পাগলা কানাই। অষ্টাদশ উনবিংশ শতকে ময়মনসিংহের শেরপুর অঞ্চলে টিপু পাগলা ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে পাগলপন্থী আন্দোলনের সূচনা করেন। অবশ্য গূঢ় বা নিগূঢ় পাগলের কথা আলাদা ‘তিন পাগলে হল মেলা নদে এসে’এর ভাবার্থ জানেন লালন সাইজী।‘হাছন রাজা হইল পাগল লোকের হইল জানা’ বললেও আমরা কি আসলেই জানি তার পাগলামির রহস্য? ‘শহরে এসেছে এক নতুন পাগল’ প্রয়াত সঞ্জীব চৌধুরীর সেই পাগল আমাদের সবার মাঝেই বসবাস করে। উচ্ছ্বল প্রাণবন্ত আমুদে ও সরস মানুষকে আদর করে বলা হয় পাগলা। সিলেটের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তেমনি এক  ছাত্র সুমন দাস নিহত হয়েছিল ছাত্রলীগের আন্তঃকোন্দলে সেই ছেলেটি সবার কাছে পরিচিত ছিল সুমন পাগলা বলে। আধুনিক তুরস্কের জন্মদাতা কামাল পাশার কর্মকান্ডে উচ্ছ্বসিত নজরুলতো তাঁর উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে গিয়ে ‘কামাল পাশা’ কবিতায় লিখলেন-“ঐ ক্ষেপেছে পাগলী মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই”। আবার বিভিন্ন পশুর ক্ষেত্রে পাগলা শব্দটি যথার্থই ক্ষ্যাপা অর্থে ব্যবহৃত হয় যেমন ‘পাগলা কুত্তা’। আমাদের সমাজে কাউকে পাগলা কুত্তা বলা এক জবরদস্ত গালি কিন্তু অনেক দেশে এ শব্দটিকে বীরত্বসূচক বলেই গণ্য করা হয় যেমন মার্কিন জেনারেল জেমস মেটিস যিনি মেডডগ নামে খ্যাত। আবার রূপক অর্থে মনকে অনেক সময় ‘পাগলা ঘোড়া’র সাথে তুলনা করা হয়  যেমন ‘আমার পাগলা ঘোড়ারে কইর মানুষ কই লইয়া যাও’। প্রতিভাবান খেয়ালী মানুষের সৃষ্টিশীল কর্মকান্ডও সাধারণের কাছে ‘পাগলামি’ বলেই পরিচিতি পায়। জুলভার্নের ক্যাপ্টেন নিমো সত্যজিৎ রায়ের প্রফেসর শংকু বা হুমায়ুন আহমদের মিসির আলীও এক ধরণের পাগল বলেই সাধারণ্যে আদৃত।প্রয়াত অভিনেতা খালেদ খানের অনবদ্য অভিনয়ে যে চরিত্রটি আমাদের মনে অম্লান অক্ষয় হয়ে আছে রক্তকরবীর সেই বিশুও অন্যদের কাছে বিশু পাগলা বলেই খ্যাত ছিল। অফিসের বড় সাহেব নিজেতো ঘুষ খানই না অন্য ঘুষখুরের জন্যও যমস্বরূপ,সাধারণ্যে তিনিও পাগল।এ পাগলেরও অন্য রকম মাহাত্য।যাত্রাগানে রাজা বাদশা বা খল নায়কদের অন্যায় অপকর্মের বিরুদ্ধে যে চরিত্রটি গানে গানে অপ্রিয় সত্যগুলো বলে যায় তার নাম বিবেক,এই বিবেকও পাগল।আর এদেরকে ‘দূর হ বনের পাগল’ বলে মঞ্চ থেকে তাড়িয়ে দেয়াই যাত্রাপালার চিরাচরিত রীতি।

এতো গেল মানুষের কথা। প্রকৃতিতেও অনেক সময় পাগলামির লক্ষণ দেখা যায় কিন্তু সেই পাগলামিকে ধরতেও খেয়ালি বা পাগল চোখ আর অনুভূতির প্রয়োজন।‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে পাগল এ মন কেমন করে’ সাদামাটা মাথায় কি খেলতে পারে? আর ‘পাগলা হাওয়ার তরে মাটির প্রদীপ নিভু নিভু করে’ হাওয়ার এমন উন্মত্ত পাগলামিকে বাঙময় করতে জেমসের মতো পাগলা কন্ঠ না হলে কি চলে?

সুনামগঞ্জের একটি ঐতিহ্যবাহী এলাকার নাম পাগলা।এখানকার একটি দৃষ্টিনন্দিত মসজিদের কথা পুরনো দিনের সিলেট জেলার ভূগোলে উল্লেখ থাকত।তো এই পাগলাকে একটি পৃথক উপজেলা করে দেবার ঘোষণা দিয়ে মহা বেকায়দায় পড়েছিলেন প্রয়াত রাজনীতিবিদ ও সাংসদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। বাঙ্গালীর চিরাচরিত চরিত্রানুসারে নামকরণ নিয়ে এলাকাবাসী দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে যায়। একদলের দাবি নতুন উপজেলার নাম হবে এলাকার নামে ‘পাগলা’ আরেক দলের দাবি এর রূপকারের নামানুসারে নাম হবে সুরঞ্জিত নগর। শেষোক্তরা মুলতঃ মোসাহেব শ্রেণীর। শেষমেষ বাকপটু রসিক সেনবাবুই এর সমাধানকল্পে প্রস্তাব করেন-দুইদলের দাবিই ঠিক থাক আর নতুন এই উপজেলার নাম হোক ‘সুরঞ্জিত পাগলা’। বলাবাহুল্য উপজেলাটি শেষতক আর বাস্তবায়িত হয়নি।

বাংলা সাহিত্য বা লোকসাহিত্যে পাগলের সরব উপস্থিতি। বাংলা কারক শিক্ষার সংক্ষেপিত শব্দ পাগুটাদিপতির প্রথম বাক্যটিই ‘পাগলে কি না বলে দিয়ে শুরু।পাগলের সাথে নিরীহ অথচ উপকারী প্রাণী ছাগলকে জুড়ে দিয়ে তৈরি হয়েছে বিশিষ্টার্থক শব্দ পাগল ছাগল।ভবসংসারের সবচেয়ে তুচ্ছাতিতুচ্ছ মানুষের প্রতিশব্দ এটি। পাগলকে নৌকা ডুবাতে নিষেধ করা, আরেকটি বিশিষ্টার্থক শব্দ। ধুম পাগল’ বলে আরেকটি শব্দ আছে যা খেয়ালী ও খ্যাপাটে মানুষকে নির্দেশ করে।নজরকাড়া সুন্দর বুঝাতে ‘পাগল করা’ শব্দটি বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়। আমাদের জাতীয় সঙ্গীতে আছেনা-ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রানে পাগল করে—‘

বাংলা লোকগান বলে ‘পাগল পাগল সবাই পাগল। এক অর্থে আমরা সকলেই পাগল। সবার মাঝেই কিছু না কিছু পাগলামীর ছাট থাকে। খাদ না মেশালে যেমন সোনার স্বর্ণত্ব পূর্নতা পায়না তেমনি ব্যক্তিত্তে কিছুটা পাগলামি না থাকলে তা নিরেট হয়ে যায়। নিরেট মানুষ বললেতো তা মানুষ থাকেনা আবেগ অনুভূতিহীন রোবট বা স্রেফ কাঠ-মানব হয়ে যায়।তবে পাগলামীর মাত্রানুসারে নির্ধারিত হয় লোকটি কতখানি স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিক।পঞ্চাশ মাত্রার নিচের মানুষরাই সম্ভবতঃ সমাজকে পরিচালিত করে বা সৃষ্টিশীল কর্মকান্ডগুলি সম্পাদন করে।অবশ্য ব্যতিক্রম যে হয়না তা নয় কখনো বদ্ধ পাগলের হাতেও সমাজ বা রাষ্ট্রের নেতৃত্ব চলে যায় । রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রকদের এই মাত্রা নির্ধারণ করতে গিয়েও প্রায়শ বিভ্রান্ত হতে হয়।‘আল্লাহর মাল আল্লায় নিয়ে গেছে, লুকিং ফর শ্ত্রুজ, ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার সময় দরজায় ভাল করে তালা মেরে যাবেন, আমরা কারোর বেডরুম পাহারা দিতে পারবনা,শাহবাগের আন্দোলনকারীগণ সবাই নাস্তিক, পিলার ধরে ঠ্যালাধাক্কাই রানাপ্লাজা ধ্বসের অন্যতম কারণ, শেখ হাসিনা তারাবির নামায পড়ে দোয়া করেছেন বলে বাংলাদেশ ত্রিদেশীয় ফাইনালে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, তিনি তাহাজ্জুদের নামায পড়েন বলে আইলার ক্ষয় ক্ষতি কম হয়েছে, উত্তরে ওষুধ মারলে মশা যায় দক্ষিণে,আওয়ামীলীগ ডেঙ্গুজ্বর দিয়ে মানুষ হত্যা করছে,এডিস মশার প্রজনন হার রোহিঙ্গাদের মত এ রকম অসংখ্য বচনামৃত শুনে পাগলামির মাত্রা নির্ধারণ করতে গিয়ে রিতিমত হিমশিম খেতে হয়।

সব পাগলের সূত্রানুসারে এই জগত সংসারকে বলা যায় বিশাল এক পাগলের হাট। কিন্তু এই বিপুল সংখ্যক পাগলকে নিয়ে আলোচনা করতে হলেতো মিলিয়ন মিলিয়ন ভল্যুমের পাগলপিডিয়া রচনা করতে হবে। অবশ্য তথ্য প্রযুক্তির এই সোনালী যুগে তাও অসম্ভব নয়। কিন্তু এই  ক্ষুদ্র আলোচনার উদ্দেশ্য গণ-পাগলের কড়চা রচনা নয় মুলত আসল পাগল নিয়ে দু চার লাইন লেখা। আর এই পাগলদের কথা লিখতে গেলেই প্রথমেই মনে পড়ে যায় হাটের পাগলদের কথা। প্রতিটি হাট বাজার শহর নগরে বনেদি কিছু পাগল থাকে যারা সেই এলাকার দালানকোটা রাস্তাঘাট গাছগাছালির মতোই সত্য। তারা ব্যক্তি হয়েও ব্যক্তিত্বহীন নাগরিক হয়েও ভোটাধিকারবিহীন। তাদের নির্দিষ্ট কোনো আবাস নেই। ঘুমাবার বিছানা নেই। খাবারের টেবিল নেই। খাদ্যের মেন্যু নেই। সময় নেই অসময় নেই। এরাও ‘দুই বিঘা জমি’র উপেনের মতো ‘নিখিলবিশ্বে’র স্বত্তাধিকারী।উপেন বাউন্ডুলে হয়েছিল জমিদারের আগ্রাসনে আর এই শহরকুতুবরা নিজ ভিটেমাটি  নিখিলবিশ্বকে দান করে পথেই গড়েছে  চাল বেড়া আর চাউনিবিহীন অদৃশ্য ঘর।

যারা এই পাগল সংহিতা লেখাটি পড়ছেন  তাদের চোখের সামনেও নিশ্চয় কিছু চিরচেনা অপ্রকৃতিস্থ মানুষের ছবি স্পষ্ট ফুটে উঠছে। আমরা কত মানব মহামানব এমনকি কত চোর বাটপাড়কে নিয়েও লিখি কিন্তু এই মানুষগুলোতো কখনও আমাদের লেখার বিষয়বস্তু হয়না। অথচ এরাও আমাদের মত মানুষ। এদেরও একদিন সমাজ সংসার ছিল। জৈবিক চাহিদা মানবিক সকল অনুভবেই পরিপূর্ণ ছিল তারা কিন্তু মাথার কিছু তার এলোমেলো হয়ে যাওয়াতেই কিনা তারা অন্য মানুষ হয়ে গেল। মানুষ বটে তবুও মানবপংক্তিভুক্ত নয়। ক্ষ্যাপা পাগলে আমার ভয় হয় কিন্তু নিরীহ খেয়ালী পাগলদের প্রতি আমার খুব আগ্রহ। আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে এদের আচার আচরণ পর্যবেক্ষণ করি। জানি এতে এদের কিছু আসে যায়না কিন্তু একটা লাভ হয় অন্তত, আমার দিক থেকে এরা কোনো আক্রমন বা শান্তিভঙ্গের  আশংকা করেনা। আমাকেও তাদের মতই নিরীহ মনে করতে পারে। একবার এক নিরীহ পাগলি কিছু কান্ডজ্ঞানহীন মানুষ দ্বারা উত্যুক্ত হয়ে বিশাল এক মাটির দলা ছুঁড়ে মেরেছিল কিন্তু ঢিলটি উত্যুক্তকারীদের দিকে না গিয়ে ছুটে  আসে আমার দিকে। আমি খুব দ্রুততার সাথে হাত দিয়ে তা প্রতিহত করি। কিঞ্চিত আহত হয়ে পাগলিকে কিছু না বলে আমি যখন উত্যুক্তকারীদের ভর্থসনা করছিলাম তখন সেই পাগলির চোখেমুখে বিপুল বিষ্ময় এবং কৃতজ্ঞতা ফুটে উঠতে দেখেছিলাম। তার অভিব্যক্তি থেকেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম একটুখানি মানবিক আচরণ পেলে তার পাগলামি অনেকটাই কমে যেত। আমি যে ছোট্ট শহরের স্মৃতি বুকে নিয়ে বড় হয়েছি সেই শহরটি খুব পাগলবান্ধব ছিল। পাগলরা বেশ নিরাপদেই সেখানে থাকত কিন্তু বনেদি পাগলরা নতুন পাগলের আগমনকে খুব ভালভাবে নিতনা। এক পাগলের নাম ছিল গোপাল। শহরে নতুন কোনো পাগলের আগমন ঘটলেই গোপাল তাদের লাঠি হাতে তাড়া করত। বলত ‘পুরান পাগলের ভাত নাই নতুন পাগলের আমদানী। পাগল হয়েও কেমন শ্রেণী সচেতন! আরেকজনের নাম ছিল সুরেশ। খুব কামেল পাগল এই ধারণায় মহাজন এবং সাধারণ্যে খুব খাতির ছিল সুরেশের।নবীগঞ্জের কুখ্যাত গণ-হত্যার সময় এই সুরেশও রেহাই পায়নি। যিনি তার লাশটি শাখাবরাক নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন তার মুখ থেকে তার হত্যার বিবরণ শুনে বুকে এতটাই লেগেছিল যে সেই বয়সে পুরো এক গানই লিখে ফেলেছিলাম তাকে নিয়ে। ‘শাখাবরাক নদীরে শুনি তোর দীর্ঘশ্বাস,তোর জলে ভাইসা গেল সুরেশ পাগলার লাশ’ এই রকম। শুধু লিখা নয় সুরও দিয়ে ফেলেছিলাম সে গানের। সম্ভবত জীবনের প্রথম এবং শেষ প্রয়াস। সমসাময়িক আরেক পাগল ছিল নাম চিকন। দোকানীরা বউনির সময় চিকনকে পেলেতো তাদের পোয়াবারো। বদনা থেকে পানি ঢেলে নিজ হাতে চিকনের পা ধুইয়ে সেই ভেজা হাত দিয়ে ক্যাশবাক্সকে মুছে দিলে সেদিন বাণিজ্যলক্ষ্মী একেবারে হুড়মোড় দোকানে ঢুকে পড়বে এই ছিল বহু চর্চিত সংস্কার।সেই চিকনকেও মুক্তিযুদ্ধের পর আর কোথাও দেখা যায়নি। হয়তো সুরেশের মত সেও মৃত্যুর মিছিলে শরিক হয়ে গিয়েছিল। আরেকজন ছিল দশাসই জোয়ান।মুখে ভদ্রগোছের দাড়ি। গায়ে চটের আলখাল্লা। তার হাতে সব সময় একটি লন্ঠন থাকত। কথা বলত ভমভম করে। লণ্ঠন হাতে কেন জিগ্যেস করলে বলত-ডিউটি করছে। লোকটি নাকি সেনা বাহিনীতে ছিল। কিন্তু চাকুরিজীবনের শেষেও তার ডিউটি ফুরায়নি। সে ডিউটি নামেই পরিচিত ছিল। আমার সহপাঠী ভানু, কী চমৎকার ছিল তার গানের গলা।যখন সে ‘মোর প্রিয়া হবে এস রাণী’গানটি গাইতো মনে হত যেন রেডিওতে শুনছি। সেই ভানু একদিন পাগল হয়ে গেল।পাগল হয়েও পুরনো আড্ডার ঠানে আমাদের মাঝে এসে চুপচাপ বসে থাকত।কী কষ্ট হত ভানুর জন্য। ভানুর কাকাত ভাই ভবতারণ আমাদের এক ক্লাশ জুনিওর ছিল সেও ভানুর মত পাগল হয়ে যায়। ভবতারণ আমাদের গ্রামের পাশ দিয়ে যখন শহরের দিকে যেত মনে হত সে শূন্যে হেঁটে যাচ্ছে।যেন তার পদশব্দে ধরণীর ঘুম ভেঙ্গে যাবে এই শংকায় মাটি ছুঁইছেনা তার পা।এর অবশ্য কারণও ছিল।গ্রামের দুষ্ট ছেলেরা দেখলেই যে তাকে তাড়া করবে।ঢিল ছুঁড়বে। কতদিন তাকে গার্ড দিয়ে দিয়ে নিরাপদ এলাকায় পৌঁছে দিয়েছি। এ রকম কত বিচিত্র পাগলকে আমার স্মৃতির শহরে ভিড় করতে দেখেছি তাদের সবার কথা বলে শেষ করা যাবেনা।

জ্ঞানহারা সবাক অথবা নির্বাক মানুষগুলোর এক অংশ রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ায় এবং অসভ্য মানুষের বর্বর আক্রমনের শিকার হয়। অকারণে এদের ক্ষ্যাপায়। ঢিল ছুঁড়ে।পাল্টা ঢিল ছুঁড়লে আঘাতে আঘাতে রক্তাক্ত করে। অন্য অংশকে দৈবজ্ঞানসম্পন্ন মনে করে ভক্তি শ্রদ্ধাও করে। ঢিল ছুঁড়া আর ভক্তি শ্রদ্ধা করা দুই দলই ভ্রান্ত যদিও শেষোক্তদের অজ্ঞতার কারণে অসহায় মানুষগুলো অন্ততঃ দু’মুটো খেতে পায়। একটু আদর আহলাদ ভালোবাসা পায়। কিন্তু এর বিপদ অন্যখানে। মরলে পরে গাভী যেমন দুধেল হয়, কাস্তে হারালে  হয়ে যায় দা তেমনি পাগল মরে গেলে পির হয়ে যায়। তার নানা কেরামতির খবর চার দিকে চাউর হয়ে পড়ে।পাগলের কবর হয়ে যায় মাজার।প্রথমে সেখানে মোমবাতি জ্বলে। মৃত্যুর পর ঘরহীন মানুষটির ঘর হয়। প্রথমে চাপড়া তারপর দালান। সামরিক অফিসার  থেকে শুরু করে ঘুষখুর আমলা টাকার ভান্ডিল নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে মাজারে। কিছু মানুষ রাতারাতি আলাদিনের চেরাগ পেয়ে যায়। সবই হয় পাগলের কল্যাণে। পাগলদের মরণোত্তর আকর্ষণ থেকে আমাদের রাজনীতিও মুক্ত নয়।ভোট এলেই নেতারা দলবেঁধে মাজার মোকামে দোয়া নিতে ছুটে। বিশ্বাস করে বাবার দোয়ায় ভোটারের চোখে সাময়িক ছানি পড়ে যাবে আর অন্ধের মতো তাদের মার্কায় সিল মেরে মেরে ব্যালটবাক্স ‘ফাঁটায়ে’ দেবে।

মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষদের উত্যুক্ত করা আর পূজা সেজদা করা কোনটিই বিজ্ঞানমনস্ক এবং বিবেকসম্পন্ন মানুষের কাজ নয়। পাগল সম্পর্কে আমাদের প্রাচীন ধারণাটিই ভ্রমাত্নক এবং অমানবিক। বাংলা ভাষায় পাগল শব্দের সাথে গারদ শব্দের আত্নীয়তা থেকেই এর প্রমাণ মিলে। গারদতো জেল হাজত আর জেল হাজতেতো বাস করে অপরাধী। পাগল কেন গারদে যাবে? আমাদের সভ্য হওয়ার ইতিহাসটি খুব প্রাচীন নয়। তাই পাগলামিযে অসুস্থতা এবং তার জন্য প্রয়োজন গারদ নয় চিকিৎসা তা বুঝতে আমাদের ঢের বেশি সময় লেগেছে। মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষেরা ইট পাটকেল যেমন প্রত্যাশা করেনা তেমনি পূজার ফুল, মোমবাতি আর টাকার ভান্ডিল তাদের কাছে একটি ঝরা পাতার চেয়েও অর্থহীন। এরা রাষ্ট্রের কাছে চিকিৎসা চায়।কোনো এক টিভি চ্যানেলের সরেজমিন প্রতিবেদনে দেখেছি পাবনায় অবস্থিত দেশের একমাত্র মানসিক হাসপাতালটির খুব দৈন্যদশা চলছে। উন্নয়নের ফুলঝুরি ছুটুক চারদিকে কিন্তু এর ছিটেফোঁটা যেন অসহায় মানুষগুলোর একমাত্র আশ্রয়স্থলেও গিয়ে পড়ে। সে সাথে দেশের বিভিন্ন স্থানে এ রকম আরও গোটা পাঁচেক মানসিক হাসপাতাল গড়ে উঠুক।বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক অবস্থার যে বিপুল বৈষম্য,ভেজালের যে বিস্তৃতি, পরিবেশ দূষণের যে ভয়াবহতা তাতে দেশে মানসিক ভারসাম্যহীনের সংখ্যা দিনকে দিন বাড়তেই থাকবে। আমরা যারা এখনও মানসিকভাবে সুস্থ আছি তাদের সবার উচিৎ পাগল সম্পর্কে সমাজের নেতিবাচক ধারণাগুলোর অবসান ঘটানো।

একটা গল্প দিয়েই শেষ করি।পাগলের গল্প। পূর্বোল্লেখিত সুরেশ আর চিকন এই গল্পের কুশীলব। একবার রথের হাটে দুজনের মাঝে কি নিয়ে যেন লেগে গেল। প্রথমে হাতাহাতি এরপরে লাটালাটি। হাটের মার। মারের চেয়ে সোরগোল কুড়িগুণ বেশি। দুজন মারামারি করতে করতে বাজারের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যায়। উৎসাহী মানুষের জটলা তাদের সাথে সাথে চলে। দুজন রক্তাক্ত হয়ে এক সময় মারামারিতে ক্ষান্ত দেয়। এটি একটি সরল মারামারির কাহিনী কিন্তু এর তাৎপর্য অন্যখানে। চিকন আর সুরেশ দুই সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি। হিন্দু এবং মুসলমানের। কিন্তু তাদের সংঘর্ষটি ছিল একেবারে সমানে সমান। বাস্তবে কি তা সম্ভব? শুধু এ দেশে কেন উপমহাদেশের কোথাও কি এটা সম্ভব? সাতচল্লিশের দেশভাগ দুই সম্প্রদায়ের শক্তির ভারসাম্যে প্রলয় ঘটিয়ে দিয়েছে। তাই এখানে ওখানে যা কিছু ঘটে তা একেবারেই একতরফা। চিকন-সুরেশের  জাত ধর্ম ছিলনা। তারা মানসিক রোগী হয়ে সাম্প্রদায়িকতা নামের আরেক মানসিক রোগ থেকে মোক্ষলাভ করেছিল। কিন্তু আমরা যারা নিজেকে সুস্থ স্বাভাবিক বলে মনে করি তাদের মোক্ষলাভ কীভাবে হবে? আদৌ কি হবে? সাম্প্রতিক প্রিয়া সাহা ইস্যুতে চারদিক যেভাবে তরঙ্গায়িত হয়ে উঠেছে তা থেকে মনে হয় আমাদের মানসিকতার কত গভীরে এই রোগের শিকড় বিস্তৃত।