সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদন বলছে বায়ুতে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ আবারও বেড়ে গেছে। এই নিয়ে প্রতিবছর মে মাসে পরপর কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে পেতে বর্তমানে বায়ুতে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ রেকর্ড সংখ্যক।

গত মাসে (মে-তে) কার্বন ডাই অক্সাইডের গড় মাত্রা ছিল ৪১৪.৭ পার্টস পার মিলিয়ন। যা গত বছরের ওই সময়ের কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণের চেয়ে (৪১১.২ পিপিএম) ৩.৫ পিপিএম বেশি ছিল। আর ১১ই মে, ২০১৯ তারিখে পাওয়া গিয়েছিল বায়ুতে রেকর্ড সংখ্যক কার্বন ডাই অক্সাইড। এই প্রথমবারের মত বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ ৪১৫ পিপিএম ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

মেটেওরোলজিস্ট এরিক হলথাস টুইট করেছিলেন, “এই প্রথমবারের মত মানবেতিহাসে আমাদের গ্রহের আবহাওয়ায় ৪১৫ পিপিএম এরও বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড পাওয়া গেল। এটি কেবল ইতিহাসে সব থেকে বেশি কার্বন ডাই অক্সাইডেরই রেকর্ড নয়, কেবল ১০,০০০ বছর পূর্বে কৃষির আবির্ভাবের পর থেকেই এতি বাতাসের সব থেকে বেশি পরিমাণে কার্বন ডাই অক্সাইড নয়, বরং আধুনিক মানুষের অস্তিত্বেরও লক্ষ লক্ষ বছর পূর্বেও বাতাসে এত বেশি পরিমাণে কার্বন ডাই অক্সাইড ছিল না। আমরা এরকম গ্রহ চাইনা।”

এই উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে NOAA এর মনা লোয়া এটমসফেরিক বেজলাইন অবজারভেটরি থেকে যা হাওয়াই এর বিগ আইল্যান্ডে অবস্থিত। এখানে ৫০ এর দশক থেকে বিজ্ঞানীগণ বাতাসের মান পর্যবেক্ষণ করছেন।

প্রতিবছরে মে মাসেই বায়ুতে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ সব থেকে বেশি থাকে। এর আগের মাস বা ঋতুগুলোতে গাছপালা এবং মাটি কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ করতে থাকে যার ফলে সেগুলো জমতে জমতে মে মাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ সর্বোচ্চ হয়। মে এর পরের মাসগুলোতে গাছপালার কারণে আবার কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ কমতে শুরু করে। তাই মে মাসেই প্রতি বছরে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণের সর্বোচ্চ মানটি পাওয়া যায়।

NOAA এর গ্লোবাল মনিটরিং বিভাগের সিনিয়র সাইন্টিস্ট পিয়েটার ট্যানস বলেন, “জীবাশ্ম জ্বালানী কত দ্রুত আমাদের পরিবেশকে পরিবর্তন করে ফেলছে তা বোঝার জন্য কার্বন ডাই অক্সাইড এর সঠিক ও দীর্ঘমেয়াদী পরিমাপ করা খুবই দরকার। এগুলো হল আসল আবহাওয়ার পরিমাপ। এগুলো কোন মডেল এর উপর নির্ভর করে না, কিন্তু আমাদেরকে জলবায়ুর মডেল ভবিষ্যদ্বাণীগুলোর সত্যতা নিরুপন করতে সহায়তা করে।”

বিভিন্ন চলক ও ফিডব্যাক লুপের কারণে ভবিষ্যতের জলয়ায়ু পরিবর্তনের ভবিষ্যদ্বাণী করা খুব কঠিন। সাম্প্রতিক গবেষণাগুলো বলছে আগের হিসাবগুলো খুব রক্ষণশীল ছিল এবং তাই তারা ভুলও করেছে। গত বছর, ইন্টারগভার্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ বা আইপিসিসি একটি মাইলফলক প্রতিবেদন তৈরি করেছিল, যেখানে ২১০০ সালের আগে প্রি-ইন্ডাস্ট্রিয়াল লেভেলের চেয়ে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেলে কী বিপর্যয়কারী পরিণাম দেখা যাবে তা নিয়ে সতর্ক করেন, সেই সাথে সেখানে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ২ ডিগ্রী সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেলে কী হবে সেটাও বলা হয়।

এরই মধ্যে কিছু অতি সাম্প্রতিক জলমায়ুর মডেল ভবিষ্যদ্বাণী করেছে যে এই শতকের মধ্যেই আমাদের জলবায়ুর তাপমাত্রা ৩ থেকে ৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রেরই বছরে ২৩ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ হবে (যা বর্তমান বিশ্বের সম্পূর্ণ জিডিপির এক তৃতীয়াংশ, এবং ২১০০ সালে বৈশ্বিক জিডিপি এর ৭ শতাংশেরও বেশি হবে)।

এই খবরগুলো শোনার পরও যদি আপনার পা থরথর করে না কাপে তাহলে আরেকটি প্রতিবেদনের কথা শুনুন। এই সপ্তাহেই একটি থিংট্যাংক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যেখানে বলা হচ্ছে, যদি খুব দ্রুত কোন জরুরি পদক্ষেপ নেয়া না হয় তবে ২০৫০ সালে মানব সভ্যতার ধ্বংস হয়ে যাবার উচ্চ সম্ভাবনা রয়েছে!!

শিল্প বিপ্লবের সময়ের পর থেকে বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ ১৪০ পিপিএম বেড়ে গিয়েছে। ১৭০০ সালে এর পরিমাণ ছিল ২৭৫ পিপিএম, এবং গত দুই বছরের বাতাসে ৫ পিপিএম পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড বৃদ্ধি পেয়েছে। যার ফলে গত ৮০০,০০০ বছরেরও অধিক সময় থেকে এখন পর্যন্ত সময়ের মধ্যে এই সময়েই বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ সব থেকে বেশি। বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের বৃদ্ধি এই হাড়ে চলতে থাকলে, অনেকে ভবিষ্যদ্বাণী করেন, এই শতকের শেষের দিকেই বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ ১,০০০ পিপিএম কার্বন ডাই অক্সাইডে গিয়ে ঠেকবে।

এ প্রসঙ্গে জেনে রাখা ভাল যে, শেষ যেবার বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ ১,০০০ পিপিএম ছিল, সেবার এন্টার্কটিকা মহাদেশে বনাঞ্চল ছিল, এবং পশ্চিম ইউরোপ ও নিউজিল্যান্ডে বাৎসরিক তাপমাত্রা এখন যা দেখা যায় তার থেকে ১০ থেকে ১৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস বেশি ছিল। এই পরিস্থিতি ছিল আজ থেকে ৫৬ থেকে ৪৮ মিলিয়ন বছর পূর্বে প্যালিওজিন পিরিয়ডের সময়।

সেই সময় থেকে ৪৫ মিলিয়ন বছর পরবর্তী সময়ে গ্রহটি ছিল প্লিওসিন যুগে, তারপর সিএনএন রিপোর্ট অনুযায়ী বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ ৩১০ থেকে ৪০০ পিপিএম এর মধ্যে চলে আসে। অর্থাৎ, বর্তমানে বাতাসে যে পরিমাণে কার্বন ডাই অক্সাইড দেখা যাচ্ছে সেসময় কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ তার থেকেও কম ছিল। আর তখনও বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা আজকের তাপমাত্রার চেয়ে ২ থেকে ৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস বেশি ছিল। সেইসময় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ছিল আজকের সমুদ্রপৃষ্ঠের থেকেও ২৫ মিটার বা ৮২ ফুট উঁচুতে।

মনা লোয়ায় বছরের পর বছর ধরে সংগৃহীত উপাত্তগুলো দেখাচ্ছে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ স্থিতিশীলভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। শুরুর দিকে প্রতি বছরে বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইড গড়ে ০.৭ পিপিএম হাড়ে বৃদ্ধি পেত। আশির দশকে দেখা গেল প্রতি বছরে গড়ে ১.৬ পিপিএম হারে বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইড এর পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। নব্বই এর দশকে এই বৃদ্ধির হার একটি কমে গেল, তখন বছরে ১.৫ পিপিএম হাড়ে কার্বন ডাই অক্সাইড বৃদ্ধি পেত। একবিংশ শতকের শুরুর দিকে এই হাড় পুনরায় বৃদ্ধি পায়, প্রতি বছর কার্বন ডাই অক্সাইড বৃদ্ধির হার বছরে ২.২ পিপিএম-এ গিয়ে পৌঁছায়। ২০১৪ সালের মে মাসে কার্বন ডাই অক্সাইড এর পরিমাণ প্রথমবারের মত ৪০০ ছাড়িয়ে যায়।

ট্যান্স বলেন, এই বিষয়ে যথেষ্ট পরিমাণে ও উপসংহার টানার মত সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে যে বর্ধিত পরিমাণে কার্বন ডাই অক্সাইডের নিঃসরণের কারণেই বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইড বৃদ্ধির হার বৃদ্ধি পাচ্ছে।

যদিও এই কথাগুলো আসলে পরিসমাপ্তি বা ডুমসডে এর মত শোনালেও গবেষকগণ বলছেন, এখনও আমাদের কিছু করার সময় রয়েছে। ইউএন এনভায়রনমেন্ট ডেপুটি এক্সেকিউটিভ ডিরেক্টর জয়েস মোসুইয়া বলেন, “বিজ্ঞান এখানে পরিষ্কার, আমরা এপর্যন্ত জলবায়ু সম্পর্কিত উচ্চাকাঙ্ক্ষী কার্যক্রম দেখেছি সরকারগুলোকে এর চেয়েও বেশি দ্রুতগতিতে এবং আরও গুরুত্বের সাথে এটি নিয়ে কাজ করতে হবে।… আগুন নেভানোর উপকরণ যেখানে আমাদের হাতের কাছেই আছে সেখানে আমরা আগুনে আরও জ্বালানী দিচ্ছি।”

তথ্যসূত্র:
1. https://www.noaa.gov/news/carbon-dioxide-levels-in-atmosphere-hit-record-high-in-may
2. https://scripps.ucsd.edu/programs/keelingcurve/
3. https://twitter.com/EricHolthaus/status/1127681719216353280
4. https://www.esrl.noaa.gov/gmd/obop/mlo/aboutus/aboutus.html
5. https://www.sciencedaily.com/releases/2019/06/190604140109.htm
6. https://www.reuters.com/article/us-climatechange-temperatures/global-warming-may-be-more-severe-than-expected-by-2100-study-idUSKBN1E02J6
7. https://www.scientificamerican.com/article/climate-science-predictions-prove-too-conservative/?redirect=1
8. http://www.ipcc.ch/report/sr15/
9. https://www.iflscience.com/environment/landmark-un-climate-change-report-act-now-to-avoid-climate-catastrophe/
10. https://www.sciencedaily.com/releases/2019/06/190604140109.htm
11. https://www.un.org/en/climatechange/
12. https://www.unenvironment.org/news-and-stories/press-release/nations-must-triple-efforts-reach-2degc-target-concludes-annual
13. https://www.weforum.org/agenda/2018/05/earth-just-hit-a-terrifying-milestone-for-the-first-time-in-more-than-800-000-years
14. https://www.bristol.ac.uk/news/2018/july/co2-levels-paleogene-period.html
15. https://edition.cnn.com/2019/05/13/health/carbon-dioxide-world-intl/index.html