রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হিন্দু সমাজের বলি প্রথা অর্থাৎ কোরবানি প্রথার বিরোধিতা করে রচনা করলেন ‘বিসর্জন’ নাটক। এর জন্যে অবশ্য তাকে মুসলিম সমাজের লেখকদের মতন নিগৃহীত হতে হয়নি। যেমন- মীর মশাররফ হোসেন তার গো-জীবন প্রবন্ধ লেখার জন্যে পেয়েছেন কাফের উপাধি, এমনকি মুসলিম ধর্মসভা তাঁর স্ত্রী তালাকে ফতোয়া জারি করতে চেষ্টা করে। তারপরও গোঁড়া মুসলিম সমাজের বিরুদ্ধে মুসলিম প্রগতিশীল লেখকরা হাতে তুলেন নেন যুক্তির কলম, প্রকাশ করতে থাকেন তাদের নিজস্ব ভাবনা। কিন্তু মুসলিম সমাজের প্রতিক্রিয়াশীলতা ও ফতোয়া-জারির কারণে অনেক লেখকে মৃত্যু হয়। অনেক সময় শারীরিকভাবেও লেখকদের হত্যা করার ফতোয়া জারি কিংবা হামলার ঘটনাও মুসলিম সমাজে ঘটেছে। লেখার কারণে আহমদ শরীফের বাসায় বোমা হামলা করা হয়। ব্রিটিশ আমলে নজরুলের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারির মতন করে বলা হল-“খাঁটি ইসলামী আমলদারী থাকলে এই ফেরাউন বা নমরুদকে শূলবিদ্ধ করা হইত বা উহার মুণ্ডপাত করা হইত নিশ্চয়। একজন লেখক, মওলানা আকরাম খাঁর মাসিক মোহাম্মদীতে লিখলেন,সুতরাং বর্তমান যুগে তিনি যে এছলামের সর্বপ্রধান শক্র তাহাতে আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই।” ১৩২৯ (বাংলা)-এ নজরুল সম্পর্কে মৌলভি মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দীন আহমদ লিখেছেন: “এই উদ্দাম যুবক যে ইসলামী শিক্ষা আদৌ পায় নাই, তাহা ইহার লেখার পত্রে পত্রে ছত্রে ছত্রে প্রকাশ পাইতেছে। হিন্দুয়ানী মাদ্দায় ইহার মস্তিস্ক পরিপূর্ণ। হতভাগ্য যুবকটি ধর্মজ্ঞানসম্পন্ন মুসলমানের সংসর্গ কখনও লাভ করে নাই।… দুখের বিষয় অজ্ঞান যুবকটি এখনও আপনাকে মুসলমান পরিচয় দিতেছে।…নরাধম ইসলাম ধর্মের মানে জানে কী? খোদাদ্রোহী নরাধম নাস্তিকদিগকেও পরাজিত করিয়াছে। লোকটা শয়তানের পূর্ণাবতার। ইহার কথা আলোচনা করিতেও ঘৃণা বোধ হয়।…এইরূপ ধর্মদ্রোহী কুবিশ্বাসীকে মুসলমান বলিয়া গ্রহণ করা যাইতে পারে না, পুনর্জন্মে-বিশ্বাসী কাফের বলিয়াই পরিগণিত হইবে। খাঁটি ইসলামী আমলকারী থাকিলে এই ফেরাউন বা নমরুদকে শূলবিদ্ধ করা হইত বা উহার মুণ্ডুপাত করা হইত নিশ্চিত।

লেখকের লেখক-সত্ত্বাকে হত্যা করলে লেখক হয়তো শারীরিকভাবে বেঁচে থাকে কিন্তু সেক্ষেত্রে হারিয়ে যায় লেখক প্রতিভাটি। যেমনটি হয়েছিল মীর মশাররফ, আবুল হুসেনের ক্ষেত্রে। সমাজের প্রতিক্রিয়াশীলতায় তাদের লেখক সত্ত্বার মৃত্যু ঘটে। শামসুর রাহমান তাঁর “আমাদের সমাজ ও লেখকের স্বাধীনতা”য় মুসলিম সমাজের লেখকদের নিগৃহীত হওয়ার ইতিহাস বর্ণনা করেছেন। জেনে নিই; ধর্মবাদীদের হাতে আবুল হুসেনের অপমানিত এবং নিগৃহীত হওয়ার ইতিহাস।

কাজী আবদুল ওদুদের ‘সম্মেহিত মুসলমান’ এবং আবুল হুসেনের ‘নিষেধের বিড়ম্বনা’ ও ‘আদেশের নিগ্রহ’ প্রবন্ধ দুটির জন্যে ঢাকার রক্ষণশীল সমাজ বিচলিত এবং অপ্রসন্ন হয়ে বলিয়াদির জমিদার খান বাহাদুর মৌলবি কাজেমুদ্দিন আহমদ সিদ্দিকীর বৈঠকখানায় মিলিত হন। সেখানে আলোচনা-সভার অংশগ্রহণের জন্যে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের সেই দুই নেতাকে আসতে হয়। কাজী আবদুল ওদুদ এবং আবুল হুসেনের প্রসন্ন হওয়ার মতো কিছুই ঘটেনি। তাঁরা দু’জনই বিরক্ত হয়ে, অপ্রসন্নচিত্তে দুটি ঘোষণাপত্র লেখেন। আবু হুসেনকে স্পষ্ট ভাষায় সমাজের কাছে অপরাধ স্বীকার ক’রে মার্জনা ভিক্ষা করতে হয়। কাজী আবদুল ওদুদকেও বলতে হয়-“ঘটনাক্রমে আমার লেখা মুসলমান সমাজে এক বিষম অসন্তোষ ও মনঃক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। এর জন্যে কি কথা বলে যে আমি নিজের দুঃখ, লজ্জা ও ব্যথা প্রকাশ করব তা ভেবে পাই না”

আবুল হুসেন নিজের একটি ‘কৈফিয়ত’ ও প্রকাশ করেন, যাতে বলা হয়-“বলা বাহুল্য, আমরা কোরানকে খোদার বাণী বলে স্বীকার করি এবং বিশ্বাস করি এবং আরো বিশ্বাস করি যে, ধর্ম ও নীতি সম্পর্কে কোরান সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ এবং হযরত মুহাম্মদ সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মসংস্কারক ও সকল ধর্মপ্রবর্তকদের মধ্যে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ, তাঁর পর কোন ধর্ম প্রবর্তনের আবির্ভাব হবে না অর্থাৎ হওয়ার দরকার হবে না কারণ তার প্রচারিত ধর্ম ও নীতিকথা মানবসমাজের পক্ষে যথেষ্ট। যতদিন মানুষের সমাজ থাকবে ততদিন কোরান ও হাদিসের যুগ-ধর্মসঙ্গত নব নব ব্যাখ্যা মানুষের সকল সমস্যার সমাধান সহজ করতে সক্ষম হবে একথা আমরা দৃঢ়কন্ঠে ঘোষণা করি। হযরতকে আমরা ধর্ম ও নৈতিক জীবনে যাপনে সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ বলে বিশ্বাস করব, কিন্তু আধুনিক ও ভবিষ্যৎ জীবন-ধারার সকল বিষয়েও তাঁকে চরম গুরু বলে ধরলে আমরা নব-নব সমস্যায় নব নব সমাধান উদ্ভাবন করতে পারব না। কারণ, আর্থিক, রাষ্ট্রিক বা সামাজিক প্রয়োজন প্রতিদিন পরিবর্তন লাভ করছে। সে-প্রয়োজন মিটাতে হবে আমাদের জ্ঞান বুদ্ধি খাটিয়ে। কিন্তু তা না খাটিয়ে তার সমাধান যদি আমরা তাঁর মহাজীবনে খুঁজতে যাই তাহলে বিফল-মনোরথ হবই।”

আবুল হুসানের ‘কৈফিয়ত’ পশ্চাৎপদ, রক্ষণশীল ব্যক্তিদের খানিকটা হলেও সন্তুষ্ট করেছিল। কিন্তু ঢাকার প্রগতিশীল তরুণগণ অসন্তুষ্ট হন। তাঁদের কাছে এটা অনাবশ্যক মনে হয়েছিল। কিন্তু তাঁরা এটা বুঝতে ভুল করলেন নিযে, আবুল হুসেন এক সীমাহীন অভিমানে আন্দোলিত হয়েই ‘কৈফিয়ত’ প্রকাশ করেন। হয়তো তিনি ভেবেছিলেন, এখন আর রক্ষণশীল মুসলমানরা তাঁদের জন্যে কোনও সমস্যা সৃষ্টি করবে না। কিন্তু তা হবার নয়। আবুল হুসেনের “আদেশের নিগ্রহ” প্রবন্ধটি পত্রিকায় প্রকাশিত হবার পরেই প্রতিক্রিয়াশীল শোরগোল শুরু করে দেয়। ঢাকার নবাববাড়ি আহাসান মঞ্জিলের আঞ্জুমান অফিসে বসবাসকারী সবাই উর্দুভাষায় কথা বলেন। বাংলা জানেন না তাঁরা। অন্তত সেকালে জানতেন না। তাঁদের কী উল্টোপাল্টা বোঝানো হয়েছিল, তা যাঁরা এবং যাঁদের বোঝানো হয়েছিল শুধু তারাই বলতে পারতেন। অন্য কেউ নয়। সভায় যাঁরা হাজির হয়েছিল তাঁদের হম্বিতম্বির দরুন আবুল হুসেনকে একটি ক্ষমাপত্র লিখতে হল বাধ্য হয়ে। তাঁকে কয়েকটি বাক্যের সঙ্গে একথাও লিখতে হল,-“ঐ প্রবন্ধের (আদেশের নিগ্রহ) ভাষা দ্বারা মুসলমান ভ্রাতৃবৃন্দের মনে যে বিশেষ আঘাত দিয়েছি, সে জন্যে আমি অপরাধী।”

এই অপমান মেনে নেওয়ার পর আবুল হুসেন ‘মুসলিম সাহিত্য-সমাজে’র সম্পাদক পদে ইস্তফা দেন। ইস্তফা পত্রে তিনি লেখেন-“ এই পদত্যাগ করার আসল উদ্দেশ্যটি এই প্রসঙ্গে ব’লে দেওয়া দরকার মনে করি। ‘সাহিত্য সমাজে’র উদ্দেশ্য ছিল চিন্তা করা। কিন্তু বর্তমান মুসলমান সমাজের চিন্তা-চর্চা করা অসম্ভব বলে মনে করি। আর সম্ভব হলেও যে উপায়ে চিন্তা চর্চা করলে বর্তমান মুসলমান সমাজের বাহবার পাত্র হওয়া যায়, তাকে প্রকৃতপক্ষে চিন্তা-চর্চাই রুদ্ধ হয়। সম্প্রতি আমার ‘আদেশের নিগ্রহ’ নিয়ে যে-আন্দোলন হয়েছে তাতে আমি এটুকু বুঝতে পেরেছি যে, সমাজের প্রকৃত কল্যাণাকাঙ্ক্ষী দার্শনিকের কথায় কেউ কর্ণপাত করবে না, বরং তার কথায় উল্টা অর্থ করে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করবে। আমার position ঠিক দার্শনিকের নয়, আমার position কতকটা কল্যাণপিপাসু সামান্য কর্মীর। কর্মের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করাই আমার সর্বপ্রথম কর্তব্য। সেজন্যই আমার চিন্তা-চর্চা করা। এখন আমার চিন্তার ফল যদি জনসাধারণকে কর্মের প্রতি আগ্রহান্বিত না করতে পারে, বরং তার প্রতি আরও বেশি উদাসীন করে তোলে, তাহলে আমার উদ্দেশ্যটি ব্যর্থ হবে। গতকল্য সন্ধ্যার পর ‘আহসান-মনজিলে’ একটি ছোটখাটো মজলিস হয়েছিল। ঢাকার মুসলমান সমাজের Representative লোক অনেক সেখানে ছিলেন। তাদের নিকট উর্দুতে ‘আমাদের নিগ্রহ’ প্রবন্ধটির অর্থ করা হয়েছে। তাকে সমবেত ব্যক্তিবর্গ একবাক্যে যে রায় দিলেন সেটা এই-‘আমি ইসলামে (?) শত্রু। ইসলামকে নিয়ে উপহাস করেছি। মুসলমানের কল্যাণ আমি চাই না। অন্য সম্প্রদায়ের নিকট মুসলমান সমাজকে ঘৃণ্য বলে প্রতিপন্ন করবার জন্যে এই প্রবন্ধ লিখেছি, তা না হলে ‘শান্তি’তে, সম্পাদক যোগেশচন্দ্র দাস, ঐ লেখাটি প্রকাশিত হবে কেন? এই রায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা নিরর্থক। কালই এর পুনর্বিচার করবে। তবে এখন মুসলমান সমাজের মধ্যে থেকে যখন আমি কাজ করতে চাই, তখন বাধ্য ঞয়ে আমাকে এই রায় মাথা পেতে নিতে হবে এবং আমি নিয়েছি। আমি বলেছি-আমি অপরাধী(?)। এর পর আমি আর সাহিত্য সমাজের’র সম্পাদক থাকা ত দূরের কথা, সভ্য থাকাও আমি সঙ্গত মনে করি না। বর্তমান মুসলমান সমাজকে নিয়ে কি উপায়ে কল্যাণের পথ প্রশস্ত করা যায়, তারই চিন্তা করা ছাড়া গত্যন্তর কি?

এখানেই শেষ নয়, শিখা’র টাইটেল পৃষ্ঠায় একটি ক্ষুদ্র রেখা-চিত্র ছিল। তা আবুল হুসেন এঁকেছিলেন। একটি খোলা কোরান শরীফে। মানব বুদ্ধির আলোর স্পর্শে কোরানের বানী প্রদীপ্ত হয়ে উঠেছে, এ-ছিল রেখাচিত্রটির মর্ম। কিন্তু এর একটা কদর্থ বের করতে বিরুদ্ধবাদীদের বেগ পেতে হয়নি। তাঁরা এর অর্থ রটাল, মুসলিম সাহিত্য সমাজের সমর্থকরা কোরানকে পুড়িয়ে ফেলে শুধু মানব বুদ্ধিকেই দাঁড় করাতে চাচ্ছে।

আবুল হুসেনকে যেভাবে অপমানিত এবং নিগৃহীত হতে হয়েছে তা আমাদের মনে করিয়ে দেয় অতীতের আরেকটি ঘটনা। মীর মশাররফকে গো-জীবন লেখার অপরাধে তওবা করতে বলেছিল গোঁড়া মুসলমানরা। ধর্মসভার আয়োজন ক’রে তাঁর স্ত্রী-তালাকের প্রস্তাব করেছিল। এভাবেই মুসলমান সমাজ বারবার লেখকের স্বাধীনতার ওপর কালো থাবা বসানো হয়েছে। বেগম রোকেয়াকে যে তাঁর একটি বিশেষ প্রবন্ধের কিছু অংশ বর্জন করতে হয়েছিল রক্ষণশীল, গোঁড়া মুসলমানদের প্রবল প্রতিবাদের মুখে-এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাও আমরা ভুলিনি।

ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত এই প্রগতিশীল সাহিত্য সংগঠনে বাষিক সম্মেলনে কবি নজরুল অসুস্থ অবস্থায় যোগদান করেন। বার্ষিক সভায় নজরুল দৃপ্ত সানন্দে কণ্ঠস্বরে বললেন- আজ আমি এই মসলিসে আমার আনন্দবার্তা ঘোষণা করছি। বহুকাল পরে কাল রাত্র আমার ঘুম হয়েছে। আজ আমি দেখেছি এখানে মুসলমান নূতন অভিযান শুরু হয়েছে। আমি এই বার্তা চতুর্দিকে ঘোষণা করে বেড়াব। আর একটি কথা-এতদিন মনে করতাম আমি একাই কাফের, কিন্তু আজ দেখে আমি আশ্বস্ত হলাম যে মোঃ. মনোয়ারুল কাদীর প্রমুখ গুণী ব্যক্তি দেখছি আস্ত কাফের। আমার দল বড় হয়েছে এর চেয়ে বড় সান্ত্বনা আর আমি চাই না।

কিন্তু মুসলিম সাহিত্য সমাজই বলি আর শিখা-গোষ্ঠীই বলি, এই গোঁড়ামি এবং প্রতিক্রিয়াশীলতার ভিত কাঁপানো সংগঠনটি বেশিদিন টেকেনি। কয়েকটি দীপ্র, সুন্দর পাখি এক জায়গায় সমবেত হয়ে সৌন্দর্য ছড়াবার কালে হিংস্র শিকারির গুলির ধমকে যেমন ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে তেমনি রক্ষণশীল মুসলমানদের উৎপীড়নে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনে’র নায়করা নানা দিকে ছড়িয়ে পড়লেন।