“এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ।
মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।।”

ভূমিকাঃ

আজ ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৮। বাংলাদেশে অনলাইন জগতে মুক্তচিন্তা প্রসারের অন্যতম অগ্রপথিক, মুক্তচিন্তকদের লেখালিখির প্রথম অনলাইন প্লাটফর্ম মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা এবং বিজ্ঞান চেতনা বিস্তারের অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা, ডঃ অভিজিৎ রায়ের ৪৭ তম জন্মবার্ষিকী। মুক্তচিন্তা, যুক্তি এবং বিজ্ঞান চেতনা ছড়িয়ে দেয়ার জন্য ডঃ অভিজিৎ রায়ের নাম বাংলাদেশের ইতিহাসে চিরস্মরণীয়, চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।

জীবন বৃত্তান্তঃ

ড. অভিজিৎ রায় ১৯৭১ সালের আজকের এই দিনে আসামের শিবসাগর জেলার নাজিরাতে একটি মাতৃসেবা হাসপাতালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা ডঃ অজয় রায় তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে গিয়ে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী শেফালী রায়কে ভারতে রেখে এসেছিলেন তিনি; এমনকি অভিজিৎ রায়ের জন্মগ্রহণের সময়ে স্ত্রীর পাশে-ও থাকতে পারেননি। পরবর্তীতে, একজন স্বেচ্ছাসেবকের কাছে বাবা হবার খবর জানতে পেরে চৌদ্দ দিন পরে সুযোগ হয় ভূমিষ্ঠ সন্তানকে দেখার, সন্তানকে কোলে তুলে নেবার। সন্তানকে দেখে আবার তিনি ফিরে গিয়েছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে। দেশ স্বাধী হবার পরে ১৯৭২ সালে ১১ জানুয়ারী স্ত্রী-সন্তানকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে এসে আবার যোগদান করেন কর্মস্থলে এবং ফুলার রোডের বাসায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। সেখানেই কেটেছে অভিজিৎ রায়ের ছেলেবেলা, সেখানেই তাঁর বেঁড়ে ওঠা। ছোটবেলার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অভিজিৎ রায় লিখছিলেনঃ

“না বাবা আমাকে রাজপ্রাসাদে রাখতে পারেননি। পারেননি অঢেল বিত্তবৈভবের মধ্যে আমাদের দু ভাইকে বড় করতে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও যেরকম ভাবে মধ্যবিত্ত স্বচ্ছলতাটুকু ধরে রাখতে পারতেন সে সময়, আমাদের পরিবার সেটুকুও পারতো না কখনো সখনো।–বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের এক ছোট্ট বাড়ির নোনাধরা দেয়াল আর স্যাঁতস্যাঁতে ছাদের নীচে থেকে আমরা সেটাকেই আমরা দু-ভাই তাজমহল ভেবেছি। ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসেই ছিলো উদয়ন স্কুল। সেখানে পড়তে গেছি পায়ে হেটে। দূরে কোথাও যেতে হলে রিক্সাই ছিলো অবলম্বন। বাড়ীর পাশেই বিরাট মাঠে ফুটবল ক্রিকেট খেলে কাটিয়েছি। বাবার কাছে বায়না ছিলো ভাল একটা ক্রিকেট ব্যাট। আমার মনে আছে, প্রথম যখন একটা ভাল ক্রিকেট ব্যাট বাবা নিউমার্কেট থেকে কিনে দিয়েছিলেন, আনন্দে প্রায় কেঁদে ফেলেছিলাম। পরে শুনেছিলাম বাবাও নাকি ছাত্রজীবনে ক্রিকেট খেলতেন।”

তাঁর বই পড়ার প্রতি প্রবল আগ্রহ এবং মুক্তচিন্তার হাতেখড়িও বাবা অজয় রায়ের হাত ধরেই। অভিজিৎ রায় এ বিষয়ে লিখেছিলেনঃ

“বাবা আমাকে ‘রাজপুত্রে’র মত বড় করতে পারেননি বটে, কিন্তু বাবাই আমাকে যত রাজ্যের বইয়ের জগতের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। আমাদের শেলফে হাজারো বইয়ের পাশাপাশি ছিলো মুক্তধারার কিশোর –বিজ্ঞানের মজার মজার সমস্ত বই। জাফর ইকবালের ‘মহাকাশে মহাত্রাশ’ কিংবা স্বপন কুমার গায়েনের ‘স্বাতীর কীর্তি’ কিংবা ‘বার্ণাডের তারা’ এগুলো তার কল্যানেই পড়া। বাবাই আমাকে হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন সুকুমার রায়ের রচনা সমগ্র। হযবরল-এর বিড়াল, পাগলা দাশু আর হেশোরাম হুঁশিয়ারের ডায়রীর কথা জেনেছি তার কাছ থেকেই। বাবাই আমার মনে বপন করেছিলেন মুক্তবুদ্ধি আর সংশয়ের প্রথম বীজ। বাবাই আমাকে আবৃত্তি করতে শিখিয়েছিলেন রবিঠাকুরের প্রশ্ন কবিতা।”

বাবার প্রতি তাঁর ছিল প্রবল শ্রদ্ধাবোধ এবং ভালোবাসা। তাঁর চোখে তাঁর বাবা ছি্লেনঃ

“কারো কথায় পরোয়া না করে নিজের বিবেক যা বলে তাই তিনি করেন। ছোটবেলা থেকে তাকে এভাবেই দেখে এসেছি। –আমার বাবাকে ছোটবেলা থেকেই দেখেছি বহির্মুখী স্বভাবের। পেশায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সারা দিন ল্যাব রিসার্চ, ছাত্র-ছাত্রীদের সমস্যা নিয়েই কাটাতেন। কোয়ান্টাম মেকানিক্স আর ইলেক্ট্রম্যাগনেটিজমের সমস্যাগুলো তার ছাত্র-ছাত্রীদের এক নিমেষে বুঝিয়ে দিতে পারলেও সংসারের দৈনন্দিন জীবনের চাল ডালের হিসেবগুলো তার মাথায় কখনোই ঢুকতো না। হয়ত ঢুকানোর চেষ্টাও করতেন না।”

বাবার এই স্বভাবটা পুরোমাত্রায় পেয়েছিলেন তিনি। ছিলেন বাবার মত-ই বিবেকবান এবং বহির্মুখী স্বভাবেরঃ

“এই রোগটা আমার মধ্যেও আছে কিঞ্চিৎ। কারো কথায় পছন্দ না হলে এড়িয়ে যাই, কখনো বা মুখের উপরই বলে দেই সেটা। কারো ধার ধারতে ইচ্ছে হয় না। কোন কোন মহলে ‘অসামাজিক’ হিসবেও কুখ্যাতি আছে আমার। কিন্তু যারা আমার সত্যিকারের বন্ধু তারা আমার এই স্বভাবের জন্যই পছন্দ করে। তারা হয়ত আমার জন্য পারলে জানটাও দিয়ে দেবে। আমি অসামাজিক হতে পারি, কিন্তু তারপরও বন্ধুভাগ্য আমার দারুন ভাল – এ কথা বলতেই হবে। বাবারও বোধ হয় তাই।”

শিক্ষা ও কর্মজীবনঃ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের ভিতরে অবস্থিত উদয়ন স্কুলে পড়াশোনা করেছেন অভিজিৎ রায়। ১৯৮৮ সালে উদয়ন স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেন তিনি। ঢাকা কলেজে থেকে ১৯৯০ সালে এইচএসসি পাশ করার পর বুয়েটে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার পড়ার সুযোগ লাভ করেন।বুয়েট থেকে ডিগ্রী নিয়ে পিএইচডি করার জন্য সিঙ্গাপুর যান তিনি। ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর থেকে বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। আমেরিকায় চলে আসবার পর সেখানে তিনি সফটওয়্যার আর্কিটেক্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন আটলান্টা শহরে।

মুক্তমনা ব্লগ প্রতিষ্ঠাঃ

২০০১ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন প্রথম বাংলা কমিউনিটি ব্লগসাইট ‘মুক্তমনা’। এই ব্লগের মাধ্যমেই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বাংলা ভাষাভাষী মুক্তচিন্তার প্রচুর লেখক ও পাঠকদের একত্রিত করতে সক্ষম হলেন। ক্রমান্বয়ে মুক্তমনা হয়ে উঠল মুক্তচিন্তকদের মিলন মেলা। তিলেতিলে গড়া মুক্তমনা’র আর্কাইভ আজও বাংলা ব্লগে অদ্বিতীয়।

স্বদেশের প্রতি অভিজিৎ রায়ের প্রবল মমত্ববোধঃ

অভিজিৎ রায় বাংলাদেশে বসবাস না করলেও স্বদেশের প্রতি স্বদেশের মানুষের প্রতি ধারণ করতেন অপরিসীম মমত্ববোধ, ভালোবাসা। দেশের মানুষের প্রতি তিনি অনুভব করতেন অদ্ভুত এক টান। তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে সোচ্চার ছিলেন। তিনি স্বপ্ন দেখতেন এক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের; যেখানে সকল শ্রেণীর মানুষ জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমান অধিকার ও সুবিধা নিয়ে বসবাস করার সুযোগ লাভ করবে।

অভিজিৎ রায়ের জীবন দর্শনঃ

ব্যক্তি জীবনে অভিজিৎ রায় ছিলেন নাস্তিক, প্রচলিত কোন ধর্মে-ই তিনি বিশ্বাস করতেন না। তিনি মনে করতেন ধর্মই হচ্ছে বর্তমান পৃথিবীর অশান্তির কারণ। ধর্মের কারণে পৃথিবীতে অশান্তি লেগেই আছে। তাঁর কাছে ধর্ম বিশ্বাস ছিল ভাইরাসের মত। তিনি লিখেছিলেনঃ

“ধর্মের বিস্তার আর টিকে থাকার ব্যাপারগুলো ভাইরাসের মত করেই কাজ করে অনেকটা। ধর্মের তাগুদি বান্দারাই তা বারে বারে প্রমাণ করে দেন। একটি ভাইরাসের যেমন ‘হোস্ট’ দরকার হয় বংশবৃদ্ধির জন্য, নিজেকে ছড়িয়ে দেবার জন্য, ধর্মেরও টিকে থাকার জন্য দরকার হয় এক গাদা অনুগত বান্দা এবং সেবকের, যাদের বুকে আশ্রয় করে ধর্ম টিকে থাকে। শুধু তাই নয়, জীবাণু যেমন নিজেকে রক্ষার জন্য অন্য জীবাণুর সাথে প্রতিযোগিতা করে, ঠিক তেমনি এক বিশ্বাসও প্রতিযোগিতা করে অন্য বিশ্বাসের সাথে। নিজেকে অন্য বিশ্বাসের হাত থেকে রক্ষা করতে চায়। বিশ্বাসী বান্দাদের মনে ঢুকিয়ে দেয়া হয় – ‘অবিশ্বাসীদের কিংবা বিধর্মীদের কথা বেশি শুনতে যেয়ো না, ঈমান আমান নষ্ট হয়ে যাবে।’ ভাইরাস যেমন চোখ বন্ধ করে নিজেকে কপি করে করে সংক্রমণ ছড়িয়ে যায়, প্রতিটি ধর্মীয় বিশ্বাস অন্য বিশ্বাসগুলোকে দূরে সরিয়ে রেখে কেবল নিজের বিশ্বাসের কপি করে যেতে থাকে ঠিক একইভাবে। এভাবেই বিস্তার ঘটাতে থাকে বিশ্বাস নির্ভর সাম্রাজ্যের।”

অভিজিৎ রায়ের স্বপ্নের পৃথিবী হবে ধর্মহীন, বৈষম্যহীন, সকলের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। মানবতাবাদ এবং বিজ্ঞান চেতনা-ই হবে রাষ্ট্রগুলোর চালিকাশক্তি। মানুষ তাঁর নিজস্ব চিন্তা চেতনাকে পরিচালিত করবে বিজ্ঞানের আলোকে, যুক্তির আলোকে, মানবতার আলোকে। বর্তমান সভ্যতার জন্য ধর্মগুলো বিশেষ করে ইসলাম একটা হুমকির নাম। ইসলামের সন্ত্রাসবাদের কারণে পৃথিবী আজ হয়ে উঠেছে অনিরাপদ। সভ্য পৃথিবীর মানুষ আজ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে ইসলাম নামক মধ্যযুগীয় বর্বর আইডোলজির কারণে। অভিজিৎ রায় ইসলাম নামক সন্ত্রাসকে প্রোমোট করা আইডোলজির কট্টর সমালোচক হলেও, এর জন্য তিনি সকল মুসলিমকে দায়ী করেন নি কিংবা তাঁদের প্রতি ঘৃণা বিদ্বেষ পোষণ করতেন না। এ বিষয়ে তিনি লিখেছিলেনঃ

“আমি নাস্তিক। কিন্তু আমার আশে পাশের বহু কাছের মানুষজন বন্ধু বান্ধবই মুসলিম। তাদের উপর আমার কোন রাগ নেই, নেই কোন ঘৃণা। তাদের আনন্দের দিনে আমিও আনন্দিত হই। তাদের উপর নিপীড়ন হলে আমিও বেদনার্ত হই। প্যালেস্টাইনে বা কাশ্মীরে মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর অত্যাচার হলে তাদের পাশে দাঁড়াতে কার্পণ্য বোধ করি না। অতীতেও দাঁড়িয়েছি, ভবিষ্যতেও দাঁড়াবো। এটাই আমার মানবতার শিক্ষা।”

অভিজিৎ রায় ও সমকামীদের অধিকারঃ

বাংলাদেশে সমকামীদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার ছিলেন অভিজিৎ রায়। তিনিই সর্বপ্রথম সমকামিতা সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে একটা পূর্ণাঙ্গ বই লিখেছিলেন ‘সমকামিতা’ শিরোনামে। যে বইতে তিনি সমকামিতার ‘বৈজ্ঞানিক আলোচনার পাশাপাশি আর্থ-সামাজিক, সমাজ-সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক এবং মনস্তাত্ত্বিক বিভিন্ন দিক নিয়েও আলোচনা করেছেন। ২০১৪ সালে সমকামী অধিকার কর্মীদের দ্বারা প্রকাশিত রূপবান ম্যাগাজিনে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন এবং সেটা নিয়ে একটা লেখাও প্রকাশ করেছিলেন মুক্তমনা ব্লগে।

যেভাবে খুন হলেনঃ

২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পিতা ডঃ অজয় রায়ের নিষেধ সত্ত্বেও দেশের প্রতি ভালোবাসা, দেশের প্রতি মমত্ববোধের কারণে বই মেলায় অংশ নিতে বাংলাদেশ ফিরে এসেছিলেন অভিজিৎ রায়। তিনি বুঝতে পারেন নি, তাকে খুন করার জন্য চাপাতিবাজ মুসলিম সন্ত্রাসীরা ওৎ পেতে আছে। তিনি নির্ভয়ে একুশে বইমেলায় নিয়মিত ঘোরাফেরা করছিলেন। পাঠক এবং ভক্তদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করছিলেন। শুভানুধ্যায়ীদের সাথে প্রকাশ্যে কথা বলছিলেন। এভাবেই কয়েকদিন কেটে গেল। ভয়াল ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫। ডঃ অভিজিৎ রায় এবং তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা বইমেলার স্টলে কয়েকজন বন্ধুদের সাথে আড্ডা শেষে বাসায় ফিরছিলেন। ব্যাগের মধ্যে চাপাতি নিয়ে পিছে পিছে ঘুরছিল আততায়ীরা। রাত সাড়ে আটটার দিকে যখন তাঁরা ঢাকা ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের ভিতরে,ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের নিকটে রিকশায় করে বাসায় ফিরছিলেন, এমনি সময়ে পিছু নেয়া ঘৃণ্য বর্বর ইসলামী হায়েনারা চাপাতি হাতে ঝাপিয়ে পড়লো অভিজিৎ- বন্যা দম্পতির উপর। খুনিগুলো একের পর এক কোপ দিয়ে যাচ্ছিল অভিজিৎ রায়ের ঘাড়ে, মাথায়। বন্যা আহমেদের মাথায়ও মারা হয় চাপাতির একাধিক কোপ। অভিজিৎ রায়কে বাঁচাতে তার স্ত্রী বন্যা আহমেদ হাত দিয়ে ঠেকাতে চেষ্টা করলেন, অভিজিৎ রায় কে আগলে রেখে বাঁচাতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু, পারলেন না, তিনি আহত হলেন গুরুতরভাবে। সন্ত্রাসীগুলোর কোপের আঘাতে বন্যা আহমেদের বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল বিছিন্ন হয়ে গেল। আশেপাশে অনেক পুলিশ ছিল, ছিল জনসাধারনের ভিড়, কেউ-ই তাদেরকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলো না। এ অবস্থায় জীবন আহমেদ নামে একজন ফটো সাংবাদিক দ্রুত ছুটে আসলেন। তিনি দুজনকে নিয়ে দ্রুত ছুটলেন হাসপাতালে। হাসপাতালে নেয়ার পরে ডঃ অভিজিৎ রায়কে ডাক্তাররা মৃত ঘোষণা করলেন। রাফিদা আহমেদ বন্যা মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছিলেন। কিন্তু, সৌভাগবশত তিনি বেঁচে গেলেন। কিন্তু আমরা আমাদের প্রিয় অভিজিৎ’দাকে আর ফিরে পেলাম না। আমরা চিরতরে হারালাম আমাদের প্রিয় অভিজিৎ রায়কে, আমাদের অনলাইন বেইজড মুক্তচিন্তা প্রচার ও প্রসারের অন্যতম প্রধান অভিভাবককে। অভিজিৎ রায়কে হত্যা করে ইসলামী সন্ত্রাসীরা নিভিয়ে দেয়ার চেষ্টা করল বাংলার মুক্তচিন্তা জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রকে; যে উজ্জ্বল নক্ষত্র বারবার এই ভূমিতে জন্মায় না।

অভিজিৎ হত্যা ও ইসলামের দায়ঃ

মুসলমানরা দাবি করে যে,‘ইসলাম শান্তির ধর্ম, কোন ধরনের হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন করে না’ তারা এটাও দাবি করে যে, কোন ধরনের খুনোখুনির স্থান ইসলামে নেই।

তাদের এই দাবী আমি আসলে কতটা বাস্তবসম্মত? ইসলামের জন্মলগ্ন থেকে যেটা দেখা যাচ্ছে, সেটা হচ্ছে খুনোখুনির ইতিহাস। ইসলাম কখনোই ভিন্নমত সহ্য করতে পারে না। ভিন্নমতের মানুষের প্রতি ইসলাম বরাবরই নির্মম-সেটা অতীত হোক বা বর্তমান। নবী মোহাম্মদ নিজেই তার জীবদ্দশাতেই যারা তার সমালোচনা করেছে, তাকে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করে কবিতা লিখেছে, তাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে, তাদেরকে হত্যা করার জন্য নির্দেশ দিয়েছে। অনেককে গুপ্তঘাতক পাঠিয়ে হত্যার নির্দেশ দিয়েছে। আবু আফাক, কাব ইবনে আশরাফ, আসমা বিনতে মারওয়ান, আবু রাফে প্রমূখ মোহাম্মদের সমালোচকদের মুহাম্মদ-এর নির্দেশে-ই নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। এইসব বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড গুলো-ই প্রমাণ করে যে ইসলাম নামক আইডোলজি সূচনা লগ্ন থেকেই ভিন্নমতের প্রতি ছিল অসহিষ্ণু এবং সমালোচকদের হত্যা করা ইসলাম ধর্মের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং ধর্মত্যাগের শাস্তি মৃত্যু -এটা তো ইসলামী মতাদর্শে স্পষ্ট করেই উল্লেখ করা আছে। আগে যেটা উল্লেখ করলাম, গুপ্তঘাতক এর মাধ্যমে মানুষকে হত্যা করে ভিন্নমত দমনের প্রক্রিয়াটা ইসলামেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। মোহাম্মদ যেটা শুরু করে গিয়েছেন তার উগ্র অনুসারীরা ধারাবাহিকতা বজায় রাখছে মাত্র। ইসলাম ধর্ম চালু হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত জিহাদের নামে লক্ষ লক্ষ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ভিন্ন মতের মানুষের উপরে বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের খড়গ চালিয়েছে ইসলামিস্টরা। যেখানেই মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেখানেই চলছে সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন, হত্যা ধর্ষণ এবং দেশত্যাগে বাধ্য করার মতো ঘটনার। অভিজিৎ রায় তাঁর ব্লগ সাইট এবং বইয়ে লেখালেখি করে ইসলামের এই বর্বর অধ্যায় বাংলা ভাষায় উম্মেচিত করেছিলেন। আর সেই সত্য প্রকাশটাই যেন হয়েছিল তাঁর অপরাধ। নিজের রক্ত দিয়ে তাকে প্রমাণ করে যেতে হলো যে তিনি ভুল কিছু লেখেন নি, ইসলামের সন্ত্রাস সম্পর্কে তিনি লিখেছিলেন তা সবই সত্য ছিল। ইসলাম আসলে ধর্মে ছদ্মবেশে একটি রাজনৈতিক মতবাদ, যে মতাদর্শের অনুসারীরা মানুষ খুন করে, খিলাফত কায়েমের নেশায় ব্যস্ত। এই ধর্ম মানবতাবিরোধী, সভ্যতাবিরোধী, অমানবিক খুনী-বদমাশদের আড্ডাখানা। অভিজিৎ রায় সহ যে সকল ব্লগার খুন হয়েছেন, এর দায় সরাসরি ইসলাম নামক ধর্মীয় আইডোলজির এবং তাঁর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর আনসার বাংলা-৭ জঙ্গি সংগঠন এই হত্যার দায়ও শিকার করে নিয়েছে।

অভিজিৎ হত্যা ও রাষ্ট্রের দায়ঃ

অভিজিৎ রায়ের খুন বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্য এক লজ্জাজনক ইতিহাস হয়ে চিরকাল বাংলাদেশকে অপরাধী করে রাখবে। অভিজিৎ রায়ের কি অন্যায় ছিল? তিনি দেশের কি ক্ষতি করেছিলেন? কেন তাকে খুন হতে হল?
কেন রাষ্ট্র তাকে রক্ষা করার জন্য কোন ব্যবস্থা নিল না?
তাঁকে খুন করার জন্য ইসলামী সন্ত্রাসীরা বারবার যে প্রকাশ্যে হুমকি দিচ্ছিল, সরকার কেন কোনো ব্যবস্থা ওদের বিরুদ্ধে নেয়নি? অভিজিৎ রায় দেশে আসার পরে, কেন তাকে নিরাপত্তা দেয়া হয়নি?

এই প্রশ্নগুলোর জবাব রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীনদের অবশ্যই দিতে হবে। ইসলাম ধর্ম যেমন এই খুনের পিছনে দায়ী, তেমনি রয়েছে বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের উদাসীনতা, দায়িত্বহীনতা এবং ব্যর্থতা। আজ সরকার ইসলামিস্টদের খুশী রাখতে অভিজিৎ রায়সহ যারা লেখালেখির জন্যে খুন হয়েছেন; সেই খুনগুলোর বিচারকে প্রলম্বিত করছেন, এই খুনগুলো নিয়ে, খুনীদের হোতাদের নিয়ে ধোয়াশা সৃষ্টি করেছেন। খুনিদেরকে বিচারের আওতায় আনতে চাচ্ছেন না। কিন্তু এমনটা তো হবার কথা ছিল না। ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হওয়া পাকিস্তানের মত একটা বর্বর রাষ্ট্র থেকে আলাদা হয়ে যে ধর্মনিরপেক্ষতার মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি, ক্রমান্বয়ে সেই মূল নীতি থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছে এ দেশের শাসক গোষ্ঠী। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র থেকে আজ বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে ধর্মান্ধদের দেশে। এদেশের রাষ্ট্রের-ও আবার ধর্ম আছে! ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম বানানো হয়েছে। সংবিধানে একই সাথে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম যুগপৎ ভাবে বহাল রাখা হয়েছে! এটা আমার কাছে বোধগম্য নয় যে, একটা দেশের সংবিধানে একই সাথে রাষ্ট্র ধর্ম এবং ধর্মনিরপেক্ষতা কিভাবে বহাল থাকে?
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই যারাই ক্ষমতায় এসেছে সবাই ধর্ম ব্যবসায়ী মোল্লাদের তোষণ অব্যাহত রেখেছে। আর এই মোল্লাতোষণ নীতির কারণেই দেশ তার ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র হারিয়েছে। যারাই ক্ষমতায় আসে তারা এই প্রতিযোগিতায় নামে এটা প্রমাণ করতে তারা কতটা মুসলমান, তারা কত বড় ইসলামের সেবক, ইসলামের সেবায় তারা কত বেশি নিবেদিত প্রাণ। এই অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণে দেশে সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান যেভাবে ঘটেছে, একই সাথে ঘটেছে জঙ্গিবাদের ভয়াবহ উত্থান । আর এই জঙ্গিবাদী আদর্শের ধারক উগ্রবাদী সন্ত্রাসীদের হাতে আক্রান্ত হচ্ছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, ভিন্ন মতাবলম্বী মানুষ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, লেখক, কবি, সাহিত্যিক এবং বর্তমান সময়ের ব্লগার-অনলাইন একটিভিস্ট, সমকামী এবং নাস্তিকরা। আওয়ামী লীগ নিজেদেরকে অসম্প্রদায়িক দল হিসেবে দাবি করে, কিন্তু তারা একটানা ১০ বছরের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় আছে, এই সময়-ই নাস্তিক ব্লগার অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট এবং ভিন্ন মতাবলম্বী মানুষ সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে।

সরাসরি ভাবে বললে এই সময়ই জঙ্গিদের হাতে সবচেয়ে বেশি মানুষ খুন হয়েছে। যখন একের পর এক ব্লগার-অনলাইন একটিভিস্ট এবং নাস্তিকরা খুন হচ্ছিল, সরকার জঙ্গিদেরকে গ্রেপ্তার করে মূল হোতাদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়ার পরিবর্তে একদিকে যেমন ক্রসফায়ারে তাদেরকে হত্যা করছিল, অন্যদিকে এসব ঘৃণ্য জঙ্গিদের হাতে যে সকল ব্লগার-অনলাইন একটিভিস্ট এবং নাস্তিক খুন হচ্ছিল, সরকার ভিক্টিমদেরকে কে-ই দোষারোপ করছিল, এমন কি এখনও করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, মুক্ত চিন্তার নামে যা লেখা হচ্ছে তা পর্নোগ্রাফি। মুক্তচিন্তার নামে যা লেখা হচ্ছে তা বিকৃত চিন্তা। কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অধিকার কারও নেই। তার নবীকে কটুক্তি করে কেউ যদি কিছু লেখে তাতে তার অনুভূতিতেও আঘাত লাগে। লেখালেখির জন্য কেউ খুন হলে সরকার তার দায় নিতে পারবে না। এটাই হচ্ছে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য! তিনি যেখানে দেশের সংবিধান অনুসারে সকল নাগরিকের স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি দেবেন, ফ্রিডম অফ এক্সপ্রেশন বা মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করবেন, সেখানে তিনি যা করলেন সেটা হচ্ছে ভিকটিম ব্লেমিং। প্রায় ৫০ জনের অধিক নাস্তিক ব্লগার অনলাইন একটিভিস্টদের দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। কিন্তু তাদের দেশে থাকার অধিকারের বিষয়ে সরকার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র অনুযায়ী একজন মানুষের যেমন ধর্মপালনের অধিকার রয়েছে, তেমনি সে ঘোষণাপত্রে ধর্ম না পালন করাও অধিকারের কথাও বলা হয়েছে। ধর্মত্যাগ ও ধর্ম না পালন করার অধিকারও সার্বজনীন মানবাধিকারেরই অংশ। নিজেদেরকে ধর্মনিরপেক্ষ দাবি করে আওয়ামী লীগ সরকার নাস্তিকদের মানবাধিকার হরণ করেছে। মুসলিম হওয়ার কারণে ভিনদেশী রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে নিজেকে মাদার অফ হিউম্যানিটি ভাবছে শেখ হাসিনা। অন্যদিকে নিজ দেশের নাস্তিকদের মানবাধিকার হরণ করা হয়েছে ওনার আমলেই। সে বিষয়ে মাদার অব হিউম্যানিটির মাথাব্যাথা নেই! ৪৪ বছর আগে ওনার বাবার আমলে মোল্লাদের লম্ফঝম্ফ -হুমকির কারণে কবি দাউদ হায়দারকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছিল। এরপরে নব্বইয়ের দশকে কবি ও লেখক তসলিমা নাসরিনও দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন মোল্লাদের হুমকির কারণে। বর্তমান সময়ে যারা দেশ ছেড়েছেন, তাদের কথা তো আগেই বললাম। মোল্লাদের রোষানলে পড়ে, জীবন বাঁচাতে এতগুলো মানুষকে যে দেশ থেকে পালাতে বাধ্য করা হয়, সে দেশের প্রধানমন্ত্রী কিভাবে নিজেকে মাদার অফ হিউম্যানিটি ভাবেন? ওনার কি একটুও লজ্জা করে না?

রাজীব হত্যা ছাড়া আর একটি মামলারও তেমন কোন অগ্রগতি হয় নি, বিচার হয় নি। রাজীব হত্যার মাস্টার মাইন্ড জসীম উদ্দিন রাহমানীকে যথেষ্ট প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও মাত্র পাঁচ বছরের কারদণ্ড( নাকি আরাম দণ্ড?) দেওয়া হয়েছে। মিডিয়ায় প্রায় খবর আসে, অমুক হত্যার সাথে জড়িত তমুখ জঙ্গিকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়েছে।কিন্তু ব্লগার হত্যাকাণ্ডের মূল হোতাদের পরিচয় আড়ালে থেকে যাচ্ছে। স্বজন হারা মানুষ খুনীদের আসল পরিচয় জানতে পারছে না, ন্যায় বিচার পাচ্ছে না। ভিকটিমদের পরিবারসহ সবারই দাবী খুনীদের আইন- বিচারিক প্রক্রিয়ায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হোক। আমরাও সেটাই চাই।

অভিজিৎ রায়ের লেখালেখি এবং প্রকাশিত বইঃ

১। আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ (২০০৫, অঙ্কুর প্রকাশনী)
২। মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে (২০০৭, অবসর প্রকাশন সংস্থা, সহলেখক: ফরিদ আহমেদ)
৩। স্বতন্ত্র ভাবনা: মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধির মুক্তি (২০০৮, অঙ্কুর প্রকাশনী, মুক্তমনা প্রবন্ধ সংকলন)
৪। সমকামিতা: বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান (২০১০, শুদ্ধস্বর)
৫। অবিশ্বাসের দর্শন (২০১১, শুদ্ধস্বর, সহলেখক: রায়হান আবীর)
৬। বিশ্বাস ও বিজ্ঞান (২০১২, অঙ্কুর প্রকাশনী, মুক্তমনা প্রবন্ধ সংকলন)
৭। ভালবাসা কারে কয় (২০১২, শুদ্ধস্বর)
৮। শূন্য থেকে মহাবিশ্ব (২০১৪, শুদ্ধস্বর, সহলেখক: অধ্যাপক মীজান রহমান)
৯। বিশ্বাসের ভাইরাস (২০১৪, জাগৃতি প্রকাশনী)
১০। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো: এক রবি-বিদেশিনীর খোঁজে (২০১৫, অবসর প্রকাশনা সংস্থা)

বই প্রকাশের বাধাঃ

অভিজিৎ রায়ের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর সরকার শুধু ভিক্টিম ব্লগারদের দোষারোপ করেই ক্ষান্ত হয়নি, অভিজিৎ রায়ের বইগুলোকে বাংলাদেশ থেকে প্রকাশ করার সুযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। অভিজিৎ রায়ের বই যারা প্রকাশ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে দুই জন প্রকাশককে- শুদ্ধস্বরের আহমেদুর রশীদ টুটুল এবং জাগৃতি প্রকাশনের ফয়সাল আরেফিন দীপন- জঙ্গিদের কাছ থেকে হুমকি পাচ্ছিলেন, কিন্তু সরকার তাঁদের নিরাপত্তা দেওয়ার কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করে নি। ২০১৫ সালের ৩০ অক্টোবর অভিজিৎ রায়ের উপরোল্লিখিত দুই প্রকাশকই বর্বর জঙ্গি হামলার শিকার হন। তাঁদের মধ্যে আহমেদুর রশীদ টুটুল ভাগ্যগুণে বেঁচে গেলেও জাগৃতি প্রকাশনের মালিক ফয়সাল আরেফিন দীপন নির্মমভাবে নিহত হন। সেই হত্যাকাণ্ডেরও কোন সুরাহা আজ পর্যন্ত হয়নি, উল্টো বাংলা একাডেমি কর্তৃক আয়োজিত বই মেলায় অভিজিৎ রায়ের বই প্রকাশ ও বিক্রি চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এ বছর, বন্যাদির ফেসবুক স্টাটাসের কমেন্ট থেকে জানতে পারলাম যে তাঁর লেখা “বিবর্তনের পথ ধরে” বইটিও প্রকাশক রিপ্রিন্ট করতে অনীহা প্রকাশ করেছেন।

অভিজিৎ রায় কেন আজও আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক, কেন থাকবেন চিরকালঃ

অভিজিৎ রায়ের লেখালিখি এবং কর্মের জন্য, মুক্তচিন্তার প্রকাশ বিকাশ এবং এর জন্য আমাদের কাছে চিরকাল প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকবেন। তার লেখনীর মধ্যে তিনি যে যুক্তি, বিজ্ঞান চেতনা, মুক্ত চিন্তা ধারণ করতেন তার সাবলীল ভাষায় বাংলা অনলাইন কমিউনিটির কাছে তুলে ধরার জন্য তার লেখনীর মাঝে তিনি চিরকাল বেঁচে থাকবেন। অভিজিৎ রায়ের লেখা পড়ে আমরা যারা অজানাকে জেনেছি, অচেনাকে চিনেছি, বর্তমানে অনেকেই অনলাইনে নতুন করে অভিজিৎ রায়ের লেখা পড়ে বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। অভিজিৎ রায়ের লেখা পড়ে ধর্মীয় কুসংস্কারের শিকল ছিঁড়ে সত্যিকারের মানুষ হওয়ার চেষ্টা করছে। মুক্তমনা ব্লগে সচলায়তন ব্লগে ফেসবুকে এবং বিভিন্ন জায়গায় অভিজিৎ রায়ের লেখা আছে, টিকে থাকবে, তার শক্তিমান লেখনি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করবে, ধর্মীয় অজ্ঞতা কুসংস্কার থেকে মুক্তির পথ দেখিয়ে দেবে।

উপসংহারঃ

অভিজিৎ রায়ের মৃত্যুতেই তো তাঁর শেষ নয়, অভিজিৎ রায়ের পিছনে যে রয়েছে অসংখ্য তরুণ মুক্তচিন্তকদের দল, তাঁদের মাঝেই যে তিনি চিরকাল বেঁচে থাকবেন। অভিজিৎ রায়রা যে চিরন্তন মুক্তিকামী। অভিজিৎ রায়ের লেখনির মাঝে আছে নূতন শক্তি, নূতন জীবন, নূতন আলোক। অভিজিৎ রায়ের শব্দগুলো যে চির অমর!’ সেই শব্দের মাঝে চিরকাল বেঁচে থাকুন প্রিয় অভিজিৎ রায়!