তত্কালে লোকে বিজ্ঞাপন বলিতে বুঝাইতো সংবাদপত্রের ভেতরের পাতায় শ্রেণীবদ্ধ সংক্ষিপ্ত বিজ্ঞাপন, এক কলাম এক ইঞ্চি, সাদা-কালো খোপে ৫০ শব্দে লিখিত– পাত্র-পাত্রী, বাড়িভাড়া, ক্রয়-বিক্রয়, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, চলিতেছে (ঢাকাই ছবি), আসিতেছে (ঢাকাই ছবি), থিয়েটার (মঞ্চ নাটক, বেইলি রোড)– ইত্যাদি।

আমরা যাহারা কচিকাঁচার দল, ইঁচড়ে পাকা বলিয়া খ্যাত, তাহাদের তখনো অক্ষরজ্ঞান হয় নাই। তাই বইপত্র গিলিবার কাল খানিকটা বিলম্বিত হইয়াছিল। মূদ্রিত বিজ্ঞাপনের বিজ্ঞানটুকু বয়ান করিব যথাসময়ে। ভূমিকাপর্বে সংক্ষিপ্ত বাল্যকাল পরম্পরা সারিয়া লই।

সেই বেলা আমার বাবার (আজিজ মেহের, সাবেক নকশাল নেতা, ৮৬ বছর বয়সে গত বৎসর দেহ রাখিয়াছেন) শয়নকক্ষে কাকভোরে বাজিয়া উঠিত প্রমানাকৃতির একখানি ফিলিপস রেডিও। ঘুম ভাঙিত বিবিসি বাংলা অনুষ্ঠানের বাদ্যের শব্দে। মানসী বড়ুয়ার সুমষ্টি কণ্ঠস্বর শুনিতাম ঘুম ঘুম চোখে দাঁত মাজিতে গিয়া। কাঠকয়লাতেই পরিবারের সকলের দন্ত মাঞ্জনের কাজ চলিত।

তবে শৈশবকালেই সাতের দশকে ঢাকার বাসায় কাঠকয়লার তোলা উনোন আর কেরোসিনের কুকারের পাশাপাশি গ্যাস সংযোগ আসিয়াছিল। তখন আমাদিগকে দেওয়া হইয়াছিল টুথপেষ্ট-টুথব্রাশ। এখনো মনে পড়ে, একখানি পেষ্টের নাম ছিল “পিয়া”, উহার রঙখানি ছিল সবুজাভ, এলমুনিয়ামের টিউবের গায়ে একখানি হরিণের ছবি আঙ্কিত হইয়াছিল। টুথপেস্টের সহিত হরিণের কী সর্ম্পক, কে জানে?

শেষ বিকালে আমাদিগের ডিউটি ছিল খেলাধূলা সাঙ্গ করিয়া আট-দশখানি হ্যারিকেনে তেল ভরিয়া চিমনি মুছিয়া বাতিগুলিকে প্রস্তুত করা। তখন এই প্রেতপুরীতে বৈদ্যুতিক সংযোগ আসিয়াছে মাত্র। তবে উহার নিরবিচ্ছিন্নতা ছিল অতি দুর্লভ। তাই এই বিকল্প ব্যবস্থা। হাত পাখাগুলিও হাতের নাগালে থাকিত। যদিও পাকিস্তান আমলের বিশালাকায় জিইসি সিলিং ফ্যানও সদর্পে শোভা পাইতো।

এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে, রেডিও অফিসের আপার ক্লার্ক, কাম কেরানী মাতা সৈয়দা আজগারী সিরাজী (৭৭, গত ১০ বৎসর দুরারোগ্য এলঝেইমারে ভুগিয়া এখন পুরাপুরি স্মৃতিভ্রষ্ট) সন্ধ্যা বেলা বাসায় ফিরিয়া প্রমাণাকৃতির দুই চুলায় আট-দশজনের পরিবারের রান্না বসাইয়াছেন।

রান্না ঘরের মাদুর পাতিয়া আমরা ছোটরা সকলে স্লেট, চক, ছেড়াখোঁড়া বইখাতা গুছাইয়া এক সারিতে পড়িতে বসিয়াছি। মা’র হাতে থাকিত লম্বা একটি বাঁশের হাতা। গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জ হইতে ভাত-তরকারি রান্না করিবার ওইসব হাতার যোগান হইতো, ইহাদের আঞ্চলিক নাম- নাকর। পড়াশোনার গাফিলতি বা দুষ্টুমির শাসন ছিল নাকরের একেকটি মোক্ষম বাড়ি। নাকরের অভাবে তালপাখার হাতলের বাড়িও বিস্তর খাইয়াছি।

বর্ণমালা পরিচিতি, শিশুতোষ ছড়াসমূহ মুখস্ত করিতে করিতে গলা বুজিয়া আসিলে মা’র চিল চিত্কার জুটিত, “শব্দ করিয়া পড় সকলে! নইলে আজ সব্বার ভাত বন্ধ!”

পড়াশোনা শেষে রান্না ঘরেই পাত পড়িত সকলের। অধিকাংশ সময়ই রাতের মেন্যু ছিল মোটা লাল চালের ভাত, আলু দম, কলাইয়ের ডাল। কখনো বা আলু-পটলের ঝোলের সহিত এক-আধখানা ডিম বা মাছের কিয়দাংশ থাকিত। কচুঘেচু, ভর্তা-ভাজিও থাকিত একেক সময়। বিশালাকায় মাছ- হাড়ি ভর্তি মাংসের কথা তেমন মনে পড়ে না। সকলে সোনামুখ করিয়া তাই খাইয়া উঠিতাম। খাবার নিয়া কখনো উচ্চবাচ্চ করি নাই।

আর বিকালে শিশু খাদ্য হিসেবে ছিল এক গ্লাস করিয়া গ্ল্যাক্সো বেবি মিল্ক বা হলুদাভ ওভালটিন। রাতে বলদায়ক হিসেবে বরাদ্দ ছিল জনপ্রতি একখানি করিয়া কর্ড লিভার অয়েলের স্বচ্ছ হলুদ বড়ি।
বাবা কাজে বাইরে গেলে বড় ভ্রাতা-ভগ্নিগণ স্কুল-কলেজ হইতে আসিয়া রেডিও দখল করিতো। একেকদিন সকালে গান শুনিতাম আব্দুল আলীম:

“চিরদিন পুষিলাম এক অচিন পাখি/ভেদ পরিচয় দেয় না আমায়/ ওই খেদে ঝুরে আঁখি/ চিরদিন পুষিলাম এক অচিন পাখি…”

ইহার পর দিনমান নানা নাটক, গান, কথিকা, কৃষিকথা, নাটক, ছায়াছবির গান, সৈনিক ভাইদের জন্য অনুষ্ঠান “দুর্বার”, পরিবার পরিকল্পনার নাটিকা ইত্যাদি তো ছিলই। রবিবার ছিল সরকারি ছুটির দিন। সেইসব দিনের অলস দুপুরে রেডিওখানি থাকিত মা-খালাদের দখলে। পান-দোক্তা মুখে লইয়া শোনা হইতো আকাশবাণী কলিকাতাতে ছিল বিশেষ নাটক। ঢাকার একেকটি নাটক শেষ হইতেই শুরু হইতো কলিকাতার নাটক। সেই সময় রেডিও টিউনিং-এ আমার বিশেষ দক্ষতা ছিল। এই প্রতিভাবলে নাটক-গল্পগাছার অনুষ্ঠান শুনিবার বেলা বিস্তর ডাক পাইতাম।লাল-নীল পেন্সিলে একেকটি স্টেশন দাগাইয়া রাখিতাম।

দোতলার বাসার ছাদে ঘুড়ি উড়াইবার, সাপলুডু আর লাটিম খেলাবার নানা রঙের দিনগুলিতে এই করিয়া রেডিও মিশিয়াছিল দৈনন্দিন জীবন যাপনে। তবে সেই বেলা অনুষ্ঠানাদির বদলে নানান রকম বিজ্ঞাপন আমাদের কচিমাথাগুলি চিবাইয়া খাইয়াছিল। অতি সংক্ষপ্তি রেডিও বিজ্ঞাপনগুলি একেকখানা প্রচার শেষে “টুইট” শব্দে বিজ্ঞাপন বিরতি বুঝাইতো।

সেই সময় না বুঝিয়াই আমরা প্রায়শই কোরাসে ১৮+ রেডিও বিজ্ঞাপন গাহিতাম। ইহার মধ্যে জনপ্রিয় কয়েকখানি ছিল এইরূপ:

“রুমা ব্রেসিয়ার (২)/পড়তে আরাম/দামে কম/সব মহিলার পছন্দ তাই/রুমা ব্রেসিয়ার…”

আরেকখানি:

“আহা মায়া, কি যে মায়া, এই মায়া বড়ি খেলে, থাকে স্বাস্থ্য ভালো সবার…”

বলাই বাহুল্য শেষোক্ত বিজ্ঞাপনখালি ছিল জন্মনিয়ন্ত্রণ বটিকার। এইসব বিজ্ঞাপন সুর করিয়া গাহিবামাত্র বয়স্কদের তীব্র গালমন্দ জুটিত। কিন্তু রেডিওতে প্রকাশ্যে এইসব বিজ্ঞাপন চলিলে তাহা শিশু-সংগীত হিসেবে নিষিদ্ধ কেন, কেহই তাহা খোলাসা করে নাই বলিয়া ধাঁধায় থাকিতাম।
আরো মধুময় রেডিও বিজ্ঞাপন ছিল এইরূপ:

“গ্লোরি বেবি স্যুট! বেবি স্যুট (২)! হৈ (৩)! রৈ (৩)! হরেক রকম বাহারে, গ্লোরি বেবি স্যুট!…”

সুর করিয়া আরো গাহিতাম:

“হাঁটি হাঁটি পা পা চলো না/সোনমনি কোথায় যায় বলো না?/বাটার দোকানে বুঝি যায় রে/ বাংলাদেশে ছোট জুতা/ বাটা বানায়.. “

সংবাদ শুরু হইবার ঢঙে ছিল আরেকখানি বিজ্ঞাপন:
“এখন শুরু হচ্ছে সুন্দরীতে খবর। বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ সুন্দরীরা এখন আমিন জুয়েলার্সে দারুণ ভীড় করেছেন। কারণ বাহারি সব গিনি সোনার গহনা তৈরি করে একমাত্র আমিন জুযেলার্স।নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান, বায়তুল মার্কেট, ঢাকা।”

আরেকখানি টেইলার্সের বিজ্ঞাপনের শেষাংশটুকু মনে পড়িতেছে:

“আধুনিক শার্ট-প্যান্ট, স্যুট-কোটের জন্য আসুন– বস টেইলার্স! ১৪, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, গুলিস্তান, ঢাকা। আমাদের কোথাও কোনো শাখা নেই।…

এই করিতে করিতে রেডিও যুগের আমলেই পাশের বাসায় আসিয়াছিল সাদাকালো টেলিভিশন। ছাদে ছিলো উহার সুইচ্চ এন্টেনা। চারখানি পায়ার উপরে কাঠের বাক্স ও সম্মুখে দুইখানি সাটার সমেত সেই টিভি দেখিতাম আমরা মাদুর পাতিয়া। বাচ্চা ভূতের কাহিনী লইয়া ক্যাসপার কার্টুন শো ছিল জীবনের অধিক প্রিয়। টারজানের জঙ্গল জীবনের বীরত্ব দেখিয়া আঁ আঁ করিয়া চিত্কার করিয়া বাড়ি মাথায় তুলিতাম।

সেই বেলা আরো একখানি ১৮+ টিভি বিজ্ঞাপন আমাদের মগজ দখল করিয়াছিল। ঢাকাই ছবির গানের দৃশ্যের ন্যায় নাচন-কুদন ও বিস্তর রং-ঢং ছিল ইহাতে।

“নায়ক (সুর করিয়া): ও গো সুন্দরী কন্যা, তোমার রূপের বাহার, তোমায় বউ সাজাইয়া লাইয়া যামু আমার বাড়ি।/ নায়িকা (সুর করিয়া): না না না, তোমার বাড়ি যামু না। মালা শাড়ি না দিলে বিয়া বমু না।/ নায়ক: সত্যিইইই?/ নায়িকা: হুমমম।/ নায়ক: বাজার থিকা আনমু কন্যা প্রিয় মালা শাড়ি/ নায়িকা: সেই শাড়ি পইড়া বউ সাইজ্জা যামু তোমার বাড়ি…”

আরো মনে পড়িতেছে “উল্টোরথ” পত্রিকায় সাদাকালো মূদ্রিত বিজ্ঞাপন “এবিসি” এবং “রূপা” অন্তর্বাসের বিজ্ঞাপন চিত্রের কথা। প্রথমটিতে বক্ষবন্ধনীতে নারী যেমন কৌতুহল যোগাইয়াছিল, দ্বিতীয়খানায় জাঙ্গিয়া-স্যান্ডো গেঞ্জিতে নায়কের সুঠাম দেহ তেমনই মন কাড়িয়াছিল। লাস্যময়ী সুন্দরী নারীর গোপন রূপের রহস্য যে “লাক্স” শাবান, কিম্বা “ফরাসী সৌরভে সুরভিত তিব্বত ট্যালকম পাউডার” সেই কালে বিজ্ঞাপনেই এই মহাজ্ঞান লাভ করিয়াছিলাম।

সেই সময় ফকার প্লেন হইতে ঢাকাই ছায়ছবির হ্যান্ডবিল বিলি করা হইয়াছিল। কি তাহার নাম, কি বিষয়, বর্ণনা, এইসব কিছুই আর মনে নাই। ওই হ্যান্ডবিলের পিছন পিছন অনেক দেৌড়াইয়া একখানি সংগ্রহ করিয়া বানান করিয়া পড়িয়া জানিয়াছিলাম ইহা নতুন ছায়াছবির কোনো বিজ্ঞাপন।

তখন প্রেক্ষাগৃহে নতুন ঢাকাই ছবি (তখন অনেকেই ইহাকে “বই” বলিতো, কেন, কে জানে?) শুভমুক্তির বার্তা জানানো হইতো ত্রিমাত্রিক বিজ্ঞাপনে। হুড খোলা ঘোড়ার গাড়িতে দশাসই সিনেমার রঙচঙে বিলবোর্ড লাগাইয়া মাইকে বাজানো হইতো ছবিখানার গান। কখনো কখনো টুকরো সংলাপও থাকিত। আর বিরতিতে চলিত উচ্চস্বরে ব্যান্ড পার্টির বাদ্যবাজনা। এই রূপ বিজ্ঞাপনের আওয়াজ পাইবামাত্র আমরা সব কাজ ফেলিয়া চলিয়া যাইতাম দোতালা বাসার ছাদে। রেলিং হইতে ঝুঁকিয়া দেখিতাম এক সারিতে চলমান বিজ্ঞাপনের ঘোড়ার গাড়ি।

সাদাকালো ছবির বাহিরী সব নাম, “ডাকু”, “গুণ্ডা”, “রংবাজ”, “সখি তুমি কার?”, “রূপবান”, “সাতভাই চম্পা” ইত্যাদি। আংশিক রঙিন (পুরা ছবি সাদাকালো, গানের দৃশ্যগুলি শুধু রঙিন) ছবি “পাতালপুরী রাজকন্যা” শিশুতোষ মনে খুব দাগ কাটিয়াছিল, এখনো মনে আছে।

এইসব নিরীহ বিজ্ঞাপনের সঙ্গে বাস করিতে করিতে আমাদিগের শৈশবকাল ঘুচিতে থাকে। ক্রমেই বাতাসে মিলিয়া যায় পন্ডস ফেস পাউডার, নিভিয়া কোল্ড ক্রিম, তিব্বত স্নো, কসকো গ্লিসারিন সোপ, হাঁস মার্কা নারিকেল তেল, আর গোলাপী গ্লুকোজ বিস্কুটের সুবাস।

…তবু বায়েস্কোপের নেশার মতোই বিজ্ঞাপনের নেশা যেন বুঁদ করিয়া রাখে। এখনো সময় পাইলেই রেডিও-টিভিতে হা করিয়া একের পর এক বিজ্ঞাপন গিলিতে থাকি। ভুলিতে বসি, কি যেন ছাই একখানি অনুষ্ঠান চলিতেছিল! …