ওয়াহাবিজমের প্রাথমিক পাঠ-পর্ব ১
ওয়াহাবিজম থেকে আইসিসে উত্তরণ- পর্ব ৩

বিগত দুই শতক ধরে সৌদি আরবে মুসলিমদের প্রধান আচরিত ইসলামী সংস্কৃতি হল ওয়াহাবিজমের চর্চা। ওয়াহাবিজম হল কট্টরপন্থায় ইসলাম অনুসরণ; কোরআন এবং হাদিসের আক্ষরিক বাস্তবায়ন। ওয়াহাবিজমের অনুসারীগণ মনে করেন-যারা কোরআন এবং সুন্নাহর আলোকে ইসলামের চর্চা করে না তারা প্রকৃত ইসলাম থেকে দূরে সরে গেছে এবং তাদের জন্য বরাদ্দ ঘৃণা এবং শত্রুতা। ওসামা বিন লাদেন, জাওয়াহিরি, তালিবান, বাগবাদির দিকে আঙুল নির্দেশ করে সমালোচকরা বলেন ওয়াহাবিজমের উগ্রপন্থার কারণেই ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা করা হচ্ছে এবং ইসলাম বিপথগামী হয়ে গেছে। ওয়াহাবি বিশ্বাসের জীবাণু ক্যান্সারের আকারে ছড়িয়ে পড়ে যখন ১৯৭০ দশকে সৌদি আরব দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলো পৃথিবীব্যাপী মাদ্রাসা এবং মসজিদের মাধ্যমে ইসলাম প্রচার শুরু করে। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শুরু করে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে গেল ধর্মের স্বর্গীয় বাণীর আড়ালে হিংসার ঝর্ণাধারা। সৌদি আরবের বৈচিত্র্যপূর্ণ জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি কিভাবে বদলে গেল জানার জন্য উৎসাহী পাঠকের জন্য বিগত কয়েক দশকের বিশ্ব-রাজনীতির দিকে অনুসন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে পৃথিবীকে বিশ্লেষণ করে দেখার আমন্ত্রণ রইল। একটু সচেতন দৃষ্টি দিলেই আমরা দেখতে পাবো ওয়াহাবিজমের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ।

যদি সৌদি আরবের স্কুলের পাঠ্যবই পড়ে দেখার সুযোগ হয় তবে সেখানে দেখতে পাবেন যারা ওয়াহাবিজম সমর্থন করে না তাদেরকে নবীর উম্মত নয় বলে ঘোষণা করা হয়েছে। পাঠ্যপুস্তকে শেখানো হয় মুসলিমরা দুপক্ষে বিভক্ত হয়ে গেছে। একপক্ষে আছে সালাফি মতাদর্শের ওয়াহাবি যারা বিজয়ী এবং আল্লাহর মনোনীত জনগোষ্ঠী এবং বিনা হিসাবে তারা চিরসুখের বেহেশতে প্রবেশ করবে। আর দ্বিতীয়-পক্ষে আছে আল্লাহর অমান্যকারী বিধর্মী, কাফের-মুরতাদ-মুশরিক-মুনাফেক, খ্রিস্টান, ইহুদী, নাসারা। এমনকি ওয়াহাবিজম সমর্থন করে না এমন মুসলিমরাও আছে তারা অনন্তকাল দোযখে জ্বলতে থাকবে। তারা কাফের হয়ে গেছে কারণ আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করার সাথে সাথে ওয়াহাবিজমের সাথে একাত্মতা পোষণ করে না অথচ মুসলিম হিসেবে তার উপর এই দ্বীনি দায়িত্ব অর্পিত হয়ে যায়। মুসলিম হয়ে জন্ম নিয়েও তারা মুশরিক হয়ে গেছে। সালাফি মতানুসারে নবীর জন্মদিন পালন করা, নবীর রওজা জিয়ারত করাও ইসলাম স্বীকৃত নয়। নবীর জন্মদিন পালনকারী মুসলিমদেরকে ওয়াহাবিজম ভাবধারার ইসলাম প্রকৃত মুসলিম হিসেবে স্বীকার করে না। তাদের জন্য বরাদ্দ আছে শুধু আন্তরিক ঘৃণা, তাদের শরিয়া আইনে বিচার করতে হবে, হত্যা করতে হবে। অসংখ্য ইসলামী চিন্তাবিদ শিয়া এবং অন্যান্য মুসলিম বিভাজনের বিরুদ্ধে ক্রমাগত ফতোয়া জারি করছে। ওয়াহাবিজম ভাবধারার ধর্মীয় উগ্রপন্থার চর্চা ছড়িয়ে পড়ছে পৃথিবীব্যাপী, সেই আলজেরিয়া থেকে আফগানিস্তান, ঢাকা থেকে নিউইয়র্ক পর্যন্ত। সালাফি মতবাদের ওয়াহাবিজমের চূড়ান্ত প্রয়োগ ঘটে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকার টুইন টাওয়ারে হামলার মধ্য দিয়ে। টুইন টাওয়ারে বিমান হামলার সাথে সাথে কয়েকজন সৌদি যুবরাজ বিন লাদেনকে অভিযুক্ত করে। কিন্তু যে মতবাদের উপর ভিত্তি করে এত মানব বিধ্বংসী হামলা চালানো হল সেই মতবাদের বিরুদ্ধে কেউ কোন টু শব্দটি করেনি, তদুপরি মুসলিম বিশ্ব বিন লাদেনকে পালিয়ে বেড়াতে, আত্মগোপন করতে সর্বাত্মক সাহায্য করেছিল। বিন লাদেন ভিন্ন কোন গ্রহ থেকে উগ্রপন্থার শিক্ষা পায়নি, বিন লাদেন সৌদি আরব থেকেই, ওয়াহাবিজম চর্চার মাধ্যমেই মানুষ হত্যার শিক্ষা রপ্ত করেছিল। বিন লাদেনকে দোষারোপ করলেও সেই ওয়াহাবিজমের শিক্ষা কিন্তু এখনো থেমে নেই, বরং বহাল তবিয়তে অসহিষ্ণু উগ্রমতবাদ সৌদি আরবে থেকে ছড়িয়ে পড়ছে দেশে দেশে। ব্যক্তি বিন লাদেনের মৃত্যু হলেও ওয়াহাবিজমের প্রচার থেমে নেই এবং ঘরে ঘরে জন্ম দিচ্ছে নতুন নতুন বিন লাদেন। কেন এবং কেমন করে ছড়িয়ে পড়ছে ওয়াহাবিজমের চর্চা? চলুন দেখি ছোট্ট একটা উদাহরণ; সৌদি আরবের নবম শ্রেণির একজন ছাত্র হাদিসে পড়ছে ইহুদিদের বিরুদ্ধে মুসলিমদের বিজয় ইতিহাস। আমরা সবাই জানি, হাদিস হল নবী মুহম্মদের জীবনাচরণের লিখিত সংকলন যা একজন মুসলিম হিসেবে সবার অবশ্যই পালনীয়। একজন মুসলিম যদি কোরআনের পাশাপাশি হাদিসকেও সত্য বলে স্বীকার না করে তবে সেই ব্যক্তি মুসলিম থেকে খারিজ হয়ে গেল। হাদিসে বলা আছে, “ কেয়ামত আসা পর্যন্ত মুসলিমদেরকে ইহুদিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। যদি কোন ইহুদি গাছ, পাথরের আড়ালে প্রাণের ভয়ে লুকিয়ে থাকে, তবে সেখান থেকে তাদেরকে খুঁজে বের করে হত্যা করতে হবে। তখন গাছ পাথর মুসলিমদেরকে ডেকে ডেকে বলবে, হে আল্লাহর সেবক, এখানে একজন ইহুদী লুকিয়ে আছে, তাকে হত্যা করো। একধরণের গাছ কোন কিছুই বলবে না, আসলে এই গাছগুলো ইহুদি গাছ”। সৌদি আরবের একজন ১৪ বছরের শিক্ষার্থীকে এই শিক্ষায় দেয়া হয়। একবার চিন্তা করে দেখুন কী শিক্ষা লাভ করছে একজন শিশু। ঠিক একই ধরণের শিক্ষা লাভ করে পৃথিবীর সকল মাদ্রাসার সকল শিশু। বাস্তবিক জ্ঞান হওয়ার আগেই সে মানুষকে ঘৃণা করতে শিখছে। ওয়াহাবিজমের মূল কথা হল নবী মুহম্মদের সময়ের ইসলাম ছিল প্রকৃত ইসলাম এবং সেই সময়কার জীবনাচরণে ফেরত যাওয়া।

যখন ১৯৩২ সালে সৌদি রাজপরিবার সৌদি আরবের ক্ষমতায় আসে তখন এই ভূখণ্ডে বিভিন্ন গোত্র, নৃগোষ্ঠী তাদের স্বকীয়তা নিয়ে বসবাস করছিল। তাদের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি করা ছিল রাজ্য শাসনের জন্য রাজপরিবারের জন্য অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। মক্কার মুসলিমদের ইসলাম চর্চা ছিল মরমীবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত। সুফিবাদকে প্রতিহত করতেই ইখওয়ান সম্প্রদায়ের মধ্যে বেড়ে ওয়াহাবি ইসলামের ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করা জরুরী হয়ে পড়েছিল। কারণ শাসকগোষ্ঠী মনে করেছিল ওয়াহাবিজমই প্রকৃত ইসলামকে ধারণ করে। বিশুদ্ধ ইসলাম চর্চার মাধ্যমেই সৌদি আরবের গোত্রগুলোর মাঝে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। ওয়াহাবিজম যে সুফিবাদকে সমর্থন করে না তার প্রমাণ হল ইরানে, আফগানিস্তানে, পাকিস্তানে মাজারে নিয়মিত বোমা হামলা হচ্ছে এবং সম্প্রতি আমাদের দেশের পীর, ফকির, দরবেশদের হত্যা করা হচ্ছে। ধর্মীয় মৌলবাদের মাধ্যমে মানুষকে খুব সহজেই উত্তেজিত করা সম্ভব। একমাত্র ধর্মীয় পবিত্রতা রক্ষার জন্য মানুষ নিজের স্বজাতিকে খুন করতেও দ্বিধা করে না। ওয়াহাবিজম বৈশ্বিক কট্টরপন্থী ইসলাম চর্চা, পৃথিবীর সর্বত্র একরকম। একজন আমেরিকান মুসলিমকে স্থানীয় আমেরিকান পরিচয় এবং সংস্কৃতিকে উপেক্ষা করে তাকে ধর্মীয় পরিচয়ে পরিচিত হতে হয়, আর ঠিক তখনি সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। কারণ ওয়াহাবিজম তার মতাদর্শ অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়। যে আবদ-আল ওয়াহাবের নীতি ও আদর্শ মান্য করে না ওয়াহাবিজম অনুসারে সে বিদআত করছে। সৌদি রাজপরিবারকে রাজক্ষমতায় বসিয়েছিল ওয়াহাবি মতাদর্শের সৌদিআরবের ইখওয়ান গোত্র। তাই ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ওয়াহাবিজমের উপর নির্ভরতা ছিল অপরিসীম। কিন্তু একজন সৌদি রাজপরিবারের কেউ বলবে না “আমরা ওয়াহাবি, তারা দ্বিধাহীন কণ্ঠে বলবে আমরা মুসলিম।” কিন্তু বাস্তবে তারা মুহম্মদ বিন আবদ আল ওয়াহাবের প্রচারিত ধর্মীয় শিক্ষা মেনে চলে।

ওয়াহাবিজমের নবযাত্রা শুরু হয় উপসাগরীয় যুদ্ধের পরে, তখন থেকেই শুদ্ধতম উপায়ে ইসলাম চর্চার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। ইসলামের প্লাটফর্মে ওয়াহাবিজম রাজনৈতিক চিন্তাধারা ও কর্মকাণ্ড প্রসার করতে থাকে, খুব দ্রুত বদলে যেতে থাকে মুসলিম দেশগুলোর রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সামাজিক জীবনাচরণ। ওয়াহাবিজমের ছোঁয়ায় বদলে গেছে আমাদের সামাজিকতা, সৌজন্যতা আদবকায়দা। একটু লক্ষ্য করলেই আমরা দেখতে পাবো বিগত দশ বছর আগের তুলনায় এখন আমাদের দেশে বোরখা, হিজাব, নেকাবের ব্যবহার বেড়েছে, বেড়েছে পাড়ায় পাড়ায় বিলাসবহুল মসজিদের সংখ্যা। আমাদের দেশে শীতকালে ওয়াজ মাহফিল এখন সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। মানুষ টেলিভিশনের পর্দায় জাকির নায়েকের কাছে প্রশ্ন করে একজন অমুসলিমের সাথে একজন মুসলিমের সামাজিকতা কেমন হতে পারে, মুসলিম হিসেবে সে একজন অমুসলিমকে সালাম দিতে পারবে কিনা। ওয়াহাবিজমের চর্চা মানে হল সবকিছুই ইসলাম, কোরআন এবং সুন্নাহ দ্বারা স্বীকৃত হতে হবে। আমাদের দেশের সুপ্রিম কোর্টের সামনে গ্রীক দেবী থেমিসের মূর্তি অপসারণের দাবীও এই ওয়াহাবিজমেরই বাই প্রোডাক্ট। সৌদি আরব থেকে আমদানিকৃত সর্বগ্রাসী মৌলবাদী ওয়াহাবিজমের কাছে বাঙালি সংস্কৃতির পয়লা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা শিরক মনে হয়, নবান্ন উৎসবকে শিরক মনে হয়। একজন অমুসলিমের সাথে বন্ধুত্বকে বে-শরিয়তি মনে হয়। আর দেশজুড়ে উৎপন্ন হয় হেফাজত কিংবা ফরহাদ মাজহার যারা ধর্মীয় উগ্রবাদকে সম্প্রসারণের ঠিকাদারি করে।

ওয়াহাবিজমের মাধ্যমে রাজনৈতিক ইসলামের বাজারজাতকরণ সম্ভব হচ্ছে। বিন লাদেন, আবু বকর আল বাগদাদি, আইমান আল জাওয়াহিরি, মোল্লা ওমর সবাই সেই মার্কেটিং চ্যানেলের একজন করে পরিবেশকমাত্র। ওয়াহাবি মাদ্রাসায় যে শিক্ষা দেয়া হয় সেখান থেকে এরকম হাজার হাজার বিন লাদেন বা মোল্লা ওমরের জন্ম হওয়া শুধু সময়ের ব্যাপার। ওয়াহাবিজমের শিক্ষাটায় এমন যে এই দুনিয়া আখিরাতের শস্যক্ষেত্র এবং ক্ষণস্থায়ী। মৃত্যুর পরবর্তী জীবন অনন্ত সুখের। আজকে যদি ইসলাম প্রচারে নিজের জীবন পর্যন্ত কোরবানি করতে হয় তাতেও কোন সমস্যা নেই, কারণ আল্লাহ অনন্ত সুখের বিজ্ঞাপন দিয়ে রেখেছেন। আর এভাবেই ইসলামের পিঠে চড়ে রাজনৈতিক লক্ষ্য পূরণে এগিয়ে চলছে ওয়াহাবিজম।

ওয়াহাবিজমে নমনীয়তার কোন সুযোগ নেই, সুতরাং ইসলামের সাথে বহির্বিশ্বের সংঘাত অনিবার্য। যখন রাজনৈতিকভাবেই ধর্মকে ব্যবহার করা হয় তখন নিঃসন্দেহে ধর্ম রাজনীতির উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য হাতিয়ার হিসেবে নিরুপায় ব্যবহৃত হয়।

মাদ্রাসা এককভাবে সবথেকে প্রধান ওয়াহাবিজম চর্চা কেন্দ্র। কোমলমতি শিশুদেরকে এখানে ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া হয়। এই শিশুরাই বড় হয়ে একদিন ধর্মীয় নেতা হয়, ওয়াজ মাহফিলে ধর্মীয় বাণী প্রচার করে, ইসলামী চিন্তাবিদ হয়, সমাজের ইসলামী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে আফগানিস্তানের যুদ্ধের পরে দক্ষিণ এশিয়ার আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং দক্ষিণ ভারতে নতুন ধরণের মাদ্রাসা শিক্ষার বিকাশ ঘটে। প্রথাগত ধর্মশিক্ষা ভিত্তিক মাদ্রাসার সাথে এই মাদ্রাসার পার্থক্য হল এখানে সৌদি অর্থায়নে বৃত্তি নিয়ে পড়তে আসে মুসলিম প্রধান দেশগুলোর ছাত্ররা। তারা শুধু ধর্মীয় শিক্ষা অর্জন করে না, তার পাশাপাশি জিহাদি শিক্ষা অর্জন করে। শিক্ষা শেষে তারা আফগানিস্তানে তালিবান বাহিনীতে মিলিত হয়ে যুদ্ধের ময়দানে চলে যায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কারা বৃত্তির টাকা দিচ্ছে, বৃত্তি কারা পাচ্ছে আর বৃত্তি-প্রাপ্ত ছাত্ররা কি শিখছে? আমাদের অনুসন্ধানী চোখে দেখা উচিৎ বৃত্তিপ্রা্প্ত ছাত্ররা কি ধর্মীয় শিক্ষা অর্জন করছে নাকি শান্ত লোকালয়ে গ্রেনেড ছুঁড়ে মারার জন্য দক্ষ হয়ে উঠছে।

১৯৮০ সাল থেকে সৌদি আরব শিয়া অধ্যুষিত ইরানকে কৌশলগতভাবে চাপে রাখতেই ক্রমাগত অর্থ বিনিয়োগ করে যাচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতায় মুসলিম প্রধান দেশগুলোর ছাত্রদেরকে ধর্মীয় শিক্ষাখাতে বৃত্তি প্রদান করছে যে ছাত্ররা আসলে ওয়াহাবিজমের বিরোধিতাকারীদেরকে বিনাশের জন্য প্রশিক্ষিত এবং নিয়োজিত হচ্ছে। তারা ইসলামের মোড়কে উগ্রপন্থী ওয়াহাবিজমের চর্চা করবে, সোভিয়েত কমিউনিস্টদের সাথে গেরিলা যুদ্ধ করবে, অতর্কিত আত্মঘাতী হামলা করে সমূহ ধ্বংস সাধন করবে, শিয়াদেরকে চাপের মুখে রাখবে, সর্বোপরি সৌদি রাজপরিবারের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করবে।

যেকোনো ধর্ম বিশ্বাসে মতবাদ খুব গুরুত্বপূর্ণ। ইসলাম ধর্মমতে আল্লাহ একজন, তার কোন শরীক নেই এবং আল্লাহ নিরাকার, এবং ইসলামের ছায়াতলে সারা বিশ্বের মুসলিমদের একটা যৌথ পরিবার। ইসলাম মুসলিমদের উপর আল্লাহর কাছে শর্তহীন আনুগত্য আরোপ করেছে। আল্লাহ সর্বশক্তিমান, পরম দয়ালু ও ক্ষমাশীল এবং তিনিই একমাত্র উত্তম বিচারক। দুজন মুসলিম নিজেদের মাঝে আলোচনার উদ্দেশ্যেও যদি আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে প্রশ্ন করে তবে কাফের হয়ে যাবে। কোরআনে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষিত হয়েছে। নবী মুহম্মদ কোরআনের মাধ্যমে আল্লাহর বাণী-প্রাপ্ত হয়েছেন। কিন্তু, কোন কিছুর শ্রেষ্ঠত্ব খুব আপেক্ষিক বিষয় এবং প্রমাণ সাপেক্ষ। এবং ইসলামে আল্লাহর উপর কোন বিষয়ে আলোচনার কোন সুযোগ নেই। ওয়াহাবিজম ঠিক একই মতবাদ প্রচার করছে; তারা বলছে, ইসলামে মূর্তি পূজা নিষেধ, মাজারে সিজদা নিষেধ, ফুল দেয়া নিষেধ। এই কারণেই ওয়াহাবিরা মাজার সহ্য করতে পারে না। তারা ইতিমধ্যে ইউনুস নবীর মাজার উড়িয়ে দিয়েছে, গুড়িয়ে দিয়েছে সিরিয়ার ঐতিহ্য এবং প্রাচীন গ্রীক নিদর্শন পালমিরার স্থাপত্য। ঠিক একইভাবে তালিবান যখন আফগানিস্তান দখল করে নেয় তখন আস্ত পাহাড় কেটে বানানো বুদ্ধের ভাস্কর্য এবং শিল্পকর্ম শক্তিশালী বিস্ফোরকক দিয়ে গুড়িয়ে দিয়েছিল। তারা ইমাম হাসান-হোসেনের স্মৃতি বিজড়িত স্থানসমূহ ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। কারণ ওয়াহাবিজম শিক্ষা দেয় ভাস্কর্য এবং শিল্পকর্ম একেশ্বরবাদী ইসলাম প্রতিষ্ঠার সামনে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা। ইসলামধর্মের প্রাণ পুরুষ হযরত মুহম্মদের (সঃ) কবর পর্যন্ত গুড়িয়ে দিতে চেয়েছিল কিন্তু সমগ্র মুসলিম বিশ্বের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া চিন্তা করে সেই কাজে তারা ক্ষান্ত দেয় তারা। ওয়াহাবিজম দক্ষিণ এশিয়াতে প্রসার লাভ করে দেওবন্দ মাদ্রাসার মাধ্যমে। আফগানিস্তান এবং পাকিস্তান অঞ্চলের জনপ্রিয় এবং প্রভাবশালী মাদ্রাসার নাম দেওবন্দ। ভারতের উত্তরাঞ্চলের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় ওয়াহাবিজম দ্রুত বিস্তার লাভ করছে দেওবন্দি মাদ্রাসার আদলে সৃষ্ট কওমি মাদ্রাসা এবং ওয়াহাবি নেতাদের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে।