বাঙালি মুসলমান জীবিত প্রতিভাকে লাশে পরিনত করে, আর মৃত প্রতিভার কবরে আগরবাতি জ্বালে।-হুমায়ুন আজাদ

মীর মশাররফ হোসেন তাঁর বিষাদ-সিন্ধুর জন্যে এই ভারতীয় উপমহাদেশে অমর হয়ে আছেন। শিয়া পরিবারের জন্ম নেওয়া, মুসলিম ভাব-ধারার মানুষ হওয়া সত্ত্বেও ধর্মবাদী সমাজের কাছ থেকে সইতে হয়েছে অপমান,পেয়েছেন কাফের ফতোয়া। তৎকালীন মুসলিম সমাজ থেকে শুধু মীর মশাররফকে নয় নজরুলকেও অপমান নির্যাতন সইতে হয়েছে। নজরুলের বিভিন্ন চিঠি পত্রে তার প্রমাণ পাওয়া যায়।

১৯২৭ সালে শ্রদ্ধেয় প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খান কে কবি কাজী নজরুল বলেছেন- “বাঙালি মুসলমান সমাজ ধনে কাঙাল কিনা জানিনে, কিন্তু মনে যে কাঙাল এবং অতিমাত্রায় কাঙাল, তা আমি বেদনার সঙ্গে অনুভব করে আসছি বহুদিন হ’তে। আমায় মুসলমান সমাজ কাফের খেতাবে যে শিরোপা দিয়েছে, তা আমি মাথা পেতে গ্রহণ করেছি। এক আমি অবিচার বলে কোনদিন অভিযোগ করছি বলে তা মনে পড়ে না। তবে আমার লজ্জা হয়েছে এই ভেবে, কাফের-আখ্যায় বিভূষিত হবার মতন বড় ত আমি হইনি। অথচ হাফেজ খৈয়াম-মনসুর প্রভৃতি মহাপুরুষদের সাথে কাফেরের পঙক্তিতে উঠে গেলাম।”

নজরুল আরো বলেন-“হিন্দু লেখকগণ তাঁদের সমাজের গলদক্রটি-কুসংস্কার নিয়ে কি না কশাঘাত করেছেন সমাজকে;-তা সত্ত্বেও তাঁরা সমাজের শ্রদ্ধা হারান নি। কিন্তু এ হতভাগা মুসলমানের দোষ-ত্রুটির কথা পর্যন্ত বলার উপায় নেই। সংস্কার ত দূরের কথা, তার সংশোধন করতে চাইলেও এরা তার বিবৃত অর্থ ক’রে নিয়ে লেখককে হয়তো ছুরিই মেরে বসবে।”

নজরুলের লেখার তৎকালীন মুসলিম সমাজের চিত্র ও মানসিকতা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠে। চলুন দেখি; ধর্মবাদীদের হাতে মীর মশাররফের অপমান নির্যাতনের ইতিহাস। শামসুর রাহমান তাঁর “আমাদের সমাজ ও লেখকের স্বাধীনতা” প্রবন্ধে মীর মশাররফ হোসেন-এর বিরুদ্ধে ফতোয়া জারির ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন।

মীর মশাররফ হোসেন তাঁর “গো-জীবন” প্রবন্ধ লেখার জন্যে ফ্যাসাদে পড়েছিলেন। গো-জীবন-এর শুরুতেই বলা হয়েছে, আমাদের মধ্যে ‘হালাল’ এবং ‘হারাম’ দুইটি কথা আছে। হালাল গ্রহণীয়, হারাম পরিত্যাজ্য। একথাও স্বীকার্য যে গোমাংস হালাল, খাইতে বাধা নেই।…খাদ্য সম্বন্ধে বিধি আছে যে খাওয়া যাইতে পারে-খাইতেই হইবে, গো-মাংস না খাইলে মোসলমান থাকিবে না, মহাপাপী হইয়া নরকযন্ত্রণা ভোগ করিতে হইছে….একথা কোথাও লিখা নাই।…“এই বঙ্গরাজ্যে হিন্দু-মোসলমান উভয় জাতিই প্রধান। পরস্পর এমন ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ যে, ধর্ম ভিন্ন, কিন্তু মর্মে ও কর্মে এক-সংসার কার্যে, ভাই না বলিয়া আর থাকিতে পারি না। আপদে, বিপদে, সুখে দুঃখে, সম্পদে পরস্পরের সাহায্য ভিন্ন উদ্ধার নাই। সুখ নাই, শেষ নাই, রক্ষার উপায় নাই।..এমন ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ যাহাদের সঙ্গে, এমন চিরসঙ্গী যাহারা, তাহাদের মনে ব্যথা দিয়া লাভ কী?..আরবে কেহই গরু কোরবানি করে না। ধর্মের গতি বড় চমৎকার। পাহাড় পর্বত, মরুভূমি সমুদ্র, নদ-নদী ছাড়াইয়া মোসলমান ধর্ম ভারতে আসিয়াছে, সঙ্গে সঙ্গে কোরবানি আসিয়াছে। এদেশে দোম্বা নাই-দোম্বার পরিবর্তে ছাগ, উঠের পরিবর্তে গো, এই হইল শাস্ত্রকারদিগের ব্যবস্থা।…গরু কোরবানি না হইয়া ছাগলও কোরবানি হইতে পারে। তাহাতেও ধর্ম রক্ষা হয়।”

কী উদার, অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ, যুক্তিবাদী বক্তব্য মীর মশাররফ হোসেনের। মনে হয় বর্তমান কালের কোনও আধুনিক ব্যক্তি এসব কথা বলছেন। হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতি যে কল্যাণকর, এ-কথা তিনি খুন সন্দর এবং জোরালোভাবে উচ্চারণ করেছেন। ফলে তাঁর অসাম্প্রদায়িক চেতনারই পরিচয় পাই আমরা। যদি তাঁর মতো ব্যক্তি এই সম্প্রদায়ের মধ্যে অনেক বেশি সংখ্যায় থাকতেন, তা হ’লে এই উপমহাদেশে এত রক্তপাত এবং ঐতিহাসিক ট্রাজেডি ঘটত না। যা হোক, বিষাদ-সিন্ধুর অমর স্রস্টাকে এই বক্তব্যের জন্যে বেশ খেসারত দিতে হয়েছে, সইতে হয়েছে অপমান। রক্ষণশীল, গোঁড়া মুসলমানরা খেপে গিয়ে গো-জীবন-এর ব্যঙ্গাত্মক প্রতিবাদ তো করেইছে, ধর্মসভা ডেকে মীর মশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে কাফের ও তার স্ত্রী হারাম জারি করে। লেখককে ‘তওবা’ করতেও বলা হয়। অপমানিত বিষণ্ণ লেখক ফতোয়াবাজদের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেন। আখেরে ব্যাপারটি চুকে-বুকে যায়, মীর মশাররফ হোসেন বলেন যে তিনি গো-জীবন পুনর্বার ছাপাবেন না।

গো-জীবন পুনর্বার না ছাপার আশ্বাস দিয়ে বিষাদ-সিন্ধুর লেখক কিন্তু তাঁর শিল্পী-সত্তা বজায় রাখতে পারেননি। নির্বান্ধব, নিঃসঙ্গ, ভগ্নহৃদয় মীর মশাররফ হোসেন ফতোয়াবাজদের প্রদর্শিত পথে হাঁটতে শুরু করেন, রুদ্ধ হয়ে যায় তাঁর সৃজনশীল লেখনীর গতি। এরপর তাঁর লেখনী থেকে যা নিঃসৃত হল তাতে আর মীরের শৈল্পিক ঝলক রইল না। আরও কয়েকটি বই প্রকাশিত হল বটে। কিন্তু আত্মিক মৃত্যু ঘটল লেখকের। শহিদ বুদ্ধিজীবী এবং প্রতিভাবান লেখক মুনীর চৌধুরী তাঁর মীর-মানস গ্রন্থে লিখেছেন-

“১৮৯২ থেকে ১৯০২ এই দশ বৎসরে একমাত্র রচনা গাজী মিয়ার বস্তানী। এটি পরিবেশের প্রতি বীতশ্রদ্ধ ও রুষ্ট মীর-মানসের এক প্রতিশোধাত্মক দপ্তর। ১৯০৩ থেকে ১৯১০। রজসার সংখ্যাধিক্যে উর্বরতম এই অন্তিম পর্বে মীর-মানস, শিল্পবিচারে অবসন্ন ও উদাসীন। মানব-জীবনের রহস্য আর তাঁকে শিল্পনুপ্রেরণা যোগায়নি, ধর্ম জীবনের গভীরতর উপলব্ধি তাঁকে উৎকণ্ঠিত করেনি। বেশিরভাগ রচনাই অলৌকিকতামন্ডিত, কিংবদন্তী-পূর্ণ, অসংস্কৃত পুঁথি সাহিত্যে ইসলামের পুনর্নির্মাণ। আংশিক ব্যতিক্রম “এসলামের জয়’’, আত্মজীবনীমূলক রচনা “আমাদের জীবন’’…।

এছাড়া কায়কোবাদের মতন মতন লেখকরাও ধর্মবাদীদের নিন্দা সহ্য করতে হয়েছে। তবে তওবা করার হুকুম কায়কোবাদ পাননি। তবে এই ক্ষেত্রে নজরুলকে অনেক অপমান, আঘাত সহ্য করতে হয়েছে। ফতোয়া জারি করার ভঙ্গিতে নজরুলের বিরুদ্ধে বলা হয়-“খাঁটি ইসলামী আমলদারী থাকলে এই ফেরাউন বা নমরুদকে শূলবিদ্ধ করা হইত বা উহার মুণ্ডপাত করা হইত নিশ্চয়। একজন লেখক, মওলানা আকরাম খাঁর মাসিক মোহাম্মদীতে লিখলেন,সুতরাং বর্তমান যুগে তিনি যে এছলামের সর্বপ্রধান শক্র তাহাতে আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই।”

নজরুল প্রায় এক’শ বছর আগে যে মুসলিম সমাজের জন্যে হতাশা ব্যক্ত করেছেন বর্তমান মুসলিম সমাজ অতীতের মুসলিম সমাজ থেকে খুব একটা উন্নত পর্যায় যেতে পারেনি। ফলে ধর্মের সমালোচনার জন্যে বই লেখা তো দূরে থাক ফেসবুকে স্ট্যাটাস লেখার কারণে খুন হচ্ছে হচ্ছে তরুণ প্রজন্মকে।