কাবেরী গায়েনের ‘আকতার জাহানের সুইসাইড নোট’ লেখাটা পড়ে মনে হয়েছিল একদম ঠিক কথা বলেছে ও। কিন্তু তারপরও আমার মনের মধ্যে কেমন যেন একটা ছোট্ট ‘কিন্তু’ উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল। সেই ছোটবেলার অসীম আনন্দের উৎস রাশিয়ান উপকথার বোকা আইভানের মত আমারও রাত পোহালে বুদ্ধি খোলে। তাই আজ সকালে উঠেই সেই আহা মুহুর্তটি দরজা খুলে সামনে এসে দাঁড়ালো। বুঝলাম কোথায় ছোট্ট ‘কিন্তুটা’ বিশাল হয়ে আমাকে খোঁচাচ্ছিল।

কাবেরীর সাথে আমার অনেক বছরের পরিচয়। গত বছর প্রথমবারের মতো দেখা হলেও ওর সাথে ১০-১২ বছর আগে অনেকবার ফোনে কথা হয়েছিল। আমি ওর লেখা পড়ি এবং আমরা বিভিন্ন বিষয়ে যেমন একমত হই, তেমনি আবার দ্বিমতও পোষণ করি, আলোচনাও হয় মাঝে মাঝে সেগুলো নিয়ে। কাবেরীর এই লেখাটার মূল বক্তব্যের সাথে আমি একমত। আমি যদি আগে এই লেখাটা লিখতাম তাহলে কাবেরীর উপসংহারটা হয়তো আমার লেখারও উপসংহার হত। আমাদের দেশের শিক্ষিত, ক্যারিয়ারে প্রতিষ্ঠিত মেয়েদের প্রতি আমিও একই আহ্বান জানাতাম।

null
বন্যা আহমেদ

তবে আমি ওই লেখাটা লিখলে মাঝখানে আরও একটি বা দুটি প্রসঙ্গ হয়তো যোগ করতাম – এ প্রসঙ্গে আমার ‘কিন্তুটা’ ছিল সেখানেই। আবার অনেকেই দেখলাম কাবেরীর লেখাটা সমালোচনা করছেন, তার সংবেদনশীলতা নিয়ে প্রশ্ন করেছেন। তারা সমালোচনা করে ভুল করেছেন বলছি না; সমালোচনা যে কেউ যেকোনো কিছুর করতে পারেন। আমি বিশ্বাস করি এই জাতীয় ডায়ালগগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমি ওই সমালোচনাগুলোর সাথে সম্পূর্ণভাবে একমত নই সেটা বলাই আমার উদ্দেশ্য।

এই বাইনারি ব্যাপারটা আমি কখনই বুঝি না। কাবেরীর লেখায় যদি কিছু বাদ পড়ে গিয়ে থাকে, বা সঠিক পরিমাণ সমবেদনা বা সংবেদনশীলতা প্রকাশ না পেয়ে থাকে তাহলেই তার লেখার মূল বিষয়বস্তু ভুল হয়ে যায় না। কলমের এক আঁচড়ে ভুল বা ঠিক বা চিন্তা-পদ্ধতিতে শুধু সাদা-কালোর ব্যাপারটা আমার কাছে সব সময়েই দুর্বোধ্য। ধর্মীয় মৌলবাদ নিয়েও আমি যেমন অনেকদিন ধরেই বলে আসছি, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলেই মৌলবাদের গলায় মালা পরানো আবশ্যক নয়। দুটোর বিরুদ্ধেই একসাথে যুদ্ধ করা সম্ভব।

কথা বলা ছাড়া উপায় নেই আমাদের। অবলা অপবাদ ঘুচানোর উপায় বলা, বলে যাওয়া। কেউ শুনলো কী শুনলো না, মানলো কী মানলো না, খারাপ বললো কী বললো না, তাতে দমে গেলে চলবে না। একইসঙ্গে নিজেদের বলাগুলোকেও নিজেরা পর্যালোচনা করতে হবে। আকতার জাহানকে নিয়ে যারা লিখছেন, তাদের সবার লেখাকে, তাদের এগিয়ে এসে বলাকে তাই স্বাগত জানাই।

যাহোক, এই লেখাটার মূল কথায় ফেরত আসি। এ প্রসঙ্গে কয়েকটা অত্যন্ত ব্যক্তিগত প্রসঙ্গের অবতারণা করছি যেটা এতোদিন কোথাও করিনি। কেন যেন মনে হচ্ছে এখন এটা শেয়ার করলে খারাপ হয় না। ভাবলাম হয়তো উপদেশের চেয়ে উদাহরণই বেশি কাজের হবে, অথবা দুটোই একসাথে।

আমার প্রথম বিয়েটা (অভিজিতের আগে) ভেঙ্গেছিল ২০০০ সালে। সম্পর্কটা বহু বছর ধরে বিভিন্ন কারণে খারাপ হতে হতে মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতনের পর্যায়ে চলে এসেছিল। ঘটনাগুলো শুরু হওয়ার এক বছর পরে আমার মেয়েও হয়েছে এবং আমি তারপরও ৩-৪ বছর সেই সম্পর্কে থেকেছি। থেকেছি ভীষণভাবে খারাপ থেকেই। বারবার ছেড়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েও বের হতে পারিনি। আমার এক বান্ধবীর কাছে এক পর্যায়ে এমনকি লজ্জাজনকভাবে এ কথাও বলেছি যে, আমি যদি আমার মেয়ের দোষ ত্রুটিকে মাফ করে দিতে পারি, তাহলে কেন তাকেও মাফ করে দিতে পারবো না? আমি ৯১ সালে কানাডায় স্নাতক পর্যায়ে পড়তে এসে তার সাথে কয়েক বছর স্বাধীনভাবে প্রেম করে বিয়ে করেছিলাম। আমার কিন্তু সামাজিক, অর্থনৈতিক বা অন্য কোন নির্ভরতা ছিল না সে সময়েও। আমি নিজেকে সবসময়েই খুব স্বাধীন একজন মানুষ হিসেবেই গণ্য করেছি। তারপরেও থেকেছি।

null
আকতার জাহান
তাই আমার মনে হয় যে দু’টো মানুষের সম্পর্কের ডায়নামিক্স খুব জটিল একটা জিনিস। আর মানুষের আবেগ-অনুভূতিগুলো ভীষণই জটিল এবং অবোধ্য এক বিনিসূতোয় গাঁথা। সবসময় তা সরলরৈখিকভাবে চলে না। যুক্তি-তর্ক-শিক্ষা- সঠিকতা-বাস্তবতা সবকিছু জেনে বুঝেও, সেই তালে তাল মিলিয়ে চলতে চেয়েও আপনি প্রায়শই হোঁচট খেতে পারেন। আর তার উপরে আমাদের সমাজের মতো যদি সেখানে থাকে অসহনীয় সামাজিক, পারিবারিক, ধর্মীয় চাপ, তাহলে সেটা একজন নারীর (কিংবা পুরুষ) মন-বাস্তবতাকে যে কিভাবে আক্রান্ত করতে পারে সেটার হিসেব নেওয়া খুব কঠিন একটা ব্যাপার।

আমাদের দেশের মতো সমাজে একজন নারী ক্রমাগতভাবে তথাকথিত ‘ভালো মেয়ে’র পরীক্ষা দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে উঠতেই পারে। সমাজের-পরিবারের-রাষ্ট্রের নিত্য অন্যায্য দাবীর সাথে নিজের জীবনটাকে মানিয়ে নিতে নিতে সে কোথায় এসে ক্লান্তির ভারে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে সেটা নিয়ে আমি প্রশ্ন করতে দ্বিধাবোধ করি। সেটার কারণেই আমি আকতার জাহানকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবো না।

২০০০ সালে আমি সপরিবারে কানাডা থেকে আমেরিকার আটলান্টা শহরে আসি চাকরির সূত্রে। আমার বাবা তখন কয়েক বছর ধরে চাকরির কারণে এই শহরে বাস করছিলেন, আমার মা তখনো দেশে তার আইনজীবী পেশা চালিয়ে যাচ্ছেন। মাঝে মাঝে আসেন আটলান্টায়। আমি সে বছরই তাদের কাছে গিয়ে বিবাহ বিচ্ছেদের ইচ্ছার কথা বলেছিলাম। আমার লিবারেল-প্রগ্রেসিভ বাবা (যিনি আমাকে ছোটবেলা থেকে সব কিছুকে প্রশ্ন করতে শিখিয়েছেন, যেই বাবা ২৫ বছর বয়সে আমি বিয়ে করতে চেয়েছিলাম বলে ‘এতো কম বয়সে বিয়ে কেন’ বলে আতঁকে উঠেছিলেন) আহা, উহু, করে তার সাড়ে তিন বছরের নাতনীর জীবনটা ধ্বংসের কথা ভেবে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন।

কিন্তু আমার মা আমাকে ডেকে নিয়ে একটা কথাই জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কী চাও’। আমি বলেছিলাম আমি এতোদিন পারিনি, কিন্তু এখন আমি কিছুতেই এই সম্পর্কে থাকতে চাই না। আমার মা বলেছিল, তুমি একজন স্বাধীন এবং প্রতিষ্ঠিত মেয়ে। তুমি যা চাইবে তাই হবে, তোমার মহা লিবারেল বাবার আহা উহুকে উপেক্ষা করে। আমার প্রাক্তন স্বামী জেদের বশে আমার বাড়িঘর ভেঙ্গে তছনছ করেছিল, আমাকে খুন করে হলেও একসাথে রাখবে বলেছিল, আটলান্টার বাঙালি সমাজে বলে বেড়িয়েছিল আমি নাকি পরকিয়া করে চলে গেছি। কিন্তু আমার তাতে কিসসু এসে যায়নি – কারণ ওই শহরের বাঙালি সম্প্রদায়ের আর তাদের সামাজিকতার মুখ না দেখেও আমার জীবন দিব্যি চলে যাচ্ছিল। আমার মা পরে এ নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, আইনজীবী হিসেবে আমি দেশে কত নির্যাতিত মেয়ের ডিভোর্সের কেস করেছি, সেখানে আমার মেয়ের ডিভোর্সের সময় তার পাশে না দাঁড়াতে পারলে কী লাভ হলো?

আমি তখন আমার চাকুরিস্থলে সদ্য ম্যানেজার পদে উন্নীত হয়েছি। আমার টিমে কাজ করতো ১৪ জন পুরুষ ফাইবার অপটিক্স ইঞ্জিনিয়ার। তারা আমাকে এসে বলেছিল ‘তুমি কিছুতেই তোমার স্বামীকে তোমার কেনা নতুন বাসায় ঢুকতে দেবে না। তুমি না পারলে আমরা সবাই মিলে একদিন এসে তোমার নতুন বাড়ির ইলেকট্রিক সব সংযোগ, ব্লাইন্ড, পর্দা সবকিছু লাগিয়ে দেব’। আমাকে বারবার খুন করার হুমকি দেওয়া হচ্ছিল দেখে আমার ডিরেক্টরের আদেশে অফিসের গার্ড প্রতিদিন সকালে অফিসের গাড়ি থেকে নামার পর পার্কিং লট থেকে অফিসের দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিত। নিজেই বেশ কয়েকটা পরকিয়া করা স্বামী মহোদয় কোর্টে উলটো আমার চরিত্র নিয়ে বিভিন্ন কিছু বলেছিল। তবুও আমার মেয়ের প্রাইমারি কাস্টডি সে পায়নি। আমি কোনভাবেই বলছি না যে পাশ্চাত্যে ইতোমধ্যে মেয়েদের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে – সেই দিল্লি এখনো বহুত দূর। কিন্তু এতোটুকু আমি পেয়েছিলাম যেটা মানসিক এবং শারীরিকভাবে বিপর্যস্ত আকতার জাহানের জন্য ছিল অকল্পনীয়।

এখানেই আমার প্রশ্নটা। সেজন্যই আমি যত না আকতার জাহানের আত্মহত্যাকে প্রশ্ন করি, তার চেয়ে অনেক বেশী প্রশ্ন করতে চাই ‘সব জেনেও চুপটি করে থাকা বন্ধুদের’। একজন খুব সমবেদনা নিয়ে লিখেছেন, ‘বলতাম না কিছুই। এই সবকিছুই জানে সবাই। জেনেও চুপ করে থাকে। থেকেছে।’ উনার সমবেদনার আন্তরিকতা নিয়ে আমার কোন প্রশ্ন নেই, প্রশ্ন হচ্ছে ওই ‘চুপ করে থাকা’ নিয়ে।

কেন থেকেছেন? তর্কের খাতিরে (উনাকে আমি চিনি না বলে ‘তর্কের খাতিরে’ বলছি) না হয় ধরেই নিলাম তার স্বামী মেল শভেনেস্টিক শর্ট টেম্পার্ড পশ্চাৎপন্থী অনগ্রসর পুরুষ। আমাদের সমাজের অনেক পুরুষই তো কমবেশী তাই। সে জন্যই তো তাকে ছেড়েছিলেন আকতার জাহান। চার বছর পরেও সেই ব্যক্তি কেন তার উপর এতোটাই মানসিক চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে? ছেলের কারণে?

তাহলে কেন আপনারা বললেন না, তুমি এই অন্যায়ের বিচার চাও, আমরা তোমার পাশে আছি। আপনারা কী বলেছিলেন, ‘সোয়াদ তো ক্লাস এইটে পড়ে, ও কোর্টে গিয়ে সাক্ষ্য দিতে পারে, ওর গলায় ওর বাবার ছুরি ধরার বিরুদ্ধে কেস কর, আমরা যাবো তোমার সাথে’। নাকি ম্যালামাইনের প্লেটে খেতে দেখে চোখের জলে ভাসতে ভাসতে নিজের মনে বা একজন আরেকজনের কাছে শুধু ফিসফিস করে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন? একবার ভেবে দেখুন আপনারাও কি সেইদিন ‘ভালো মেয়ের’ সিংহাসন থেকে নামতে ভয় পেয়েছিলেন, শুধু চুপ করেই ছিলেন সব জেনেও?

আকতার জাহানের বন্ধুরা সমবেদনা জানাচ্ছেন, বলছেন এবং ভালোবেসেই বলছেন (ম্যালামাইনের প্লেটে খেতো, এই টাইপের অসার ন্যাকামির বক্তব্যগুলো বাদ দিলে)। আকতার জাহান ওদেরকে শাশুড়ির কালো মেয়ে বলে খোটা দেওয়ার কথা বলেছেন (আমিও শুনেছি এটা ছোটবেলায়। আমার অন্য দুইবোন ‘ফর্সা’ বলে আমার সামনেই আমার মাকে বলতো, আহা আপা আপনার দুইটা মেয়ে ফর্সা খালি বড়টা কালো হয়ে গেল!) , স্বামীর বিভিন্ন বিষয়ে, কাজে-অকাজে বাধা দেওয়া নিয়ে বলেছেন, সন্তানের সাথে দেখা করতে বাধা দেওয়ার কথা বলেছেন। কেন ওকে এই কথাগুলো চুপচাপ বন্ধুদের কাছে বলতে হলো, কেন উনি কাজে, বাসায়, পরিবারের কাছে প্রকাশ্যে বলতে ভয় পেলেন? কেন তার পরিবার-বন্ধুরা তার পাশে এসে দাঁড়ালেন না?

তার চেয়ে বড় কথা আপনারা যারা ওকে ভালোবাসতেন তারা এটাকে কেন শুধু একে ফিসফিসানির তরঙ্গেই বেঁধে রাখলেন, কেন এটাকে চিৎকারের শব্দ তরঙ্গে উঠিয়ে নিয়ে এলেন না? আমাদের সমাজে কেন এগুলো বললে ‘খারাপ মেয়ে’ হয়ে যেতে হবে, কেন আমাকে তারা সামজিক বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেবে সেটা নিয়ে চিৎকার করলেন না?

আপনারা ওকে বলেছিলেন কি, এই পৃথিবীটা একটা নিষ্ঠুর অসম যুদ্ধক্ষেত্র? এখানে কখন কোন বিক্ষিপ্ত তীরের আঘাতে আহত হয়ে পড়ে যাবেন, এমনকি বধ হবেন তার কোন নিয়ম নেই – কিন্তু সেই যুদ্ধক্ষেত্রে তুমি একা নও। এই বিক্ষিপ্ত জীবনযুদ্ধে জেতাটাও যেমন সম্ভব, তেমন হেরে যাওয়াটাও সম্ভব। হেরে গেলে আবার উঠে দাঁড়াতে যে শক্তি দরকার সেটা প্রকাশ্যেই আমরা তোমাকে দেব? তুমি কি শারীরিক, মানসিকভাবে ঠিক আছো? তোমার কি সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো দরকার? আমরা যাবো তোমার সাথে ডাক্তারের কাছে। সেটা জানাজানি হয়ে গেলে তোমার যদি কোন অসুবিধা হয় তাহলে আমরা একসাথে যুদ্ধ করবো সেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে?

আমার এবং অভিজিতের উপর ২৬ শে ফেব্রুয়ারির আক্রমণের পর থেকেই আমাকে ডাক্তাররা পিটিএসডির (পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিস-অর্ডার, যুদ্ধক্ষেত্র ফেরত সৈন্যদের এটা প্রায়ই হয়) পর্যবেক্ষণে রেখেছে। তারা মনে করে আমি শক্তভাবে উঠে দাঁড়িয়েছি ঠিকই, কিন্তু এখনো আমার যে কোন সময় ধুপ করে পড়ে যাওয়ার বিশাল সম্ভাবনা আছে।

কারণটা শুধু অভিজিতের মৃত্যুই নয়, কারণ অনেক – যেরকম নৃশংসভাবে আক্রমণটা ঘটেছে, যেভাবে আমার মাথার চার চারটি ৫-৭ ইঞ্চি চাপাতির কোপ দেওয়া হয়েছে, যার কারণে আমি নিত্য মাথাব্যথায় ভুগি, যেভাবে আমার মেরুদণ্ডের একাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, দুহাতে চাপাতি আঁকড়ে ধরার কারণে যেভাবে হাতের বেশীরভাগ আঙ্গুল-শিরা উপশিরা-স্নায়ুগুলো কেটে গেছে, যে কারণে আমি এখনো রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে থাকি। এখন যদি ধরেন আমি পড়েই যাই পিটিএসডিতে ধপাস করে এবং কাবেরী গায়েন বলে যে ‘বন্যার মতো মেয়ের কাছ থেকে আমরা এটা আশা করি না, তার উঠে দাঁড়ানো উচিত’। তাহলে আমি তাকে বলবো, ঠিক বলেছো, আমিও তাই মনে করি। কিন্তু তারপরেই তাকে আমি প্রশ্ন করবো, আমার পাশে তুমি কিভাবে দাঁড়াবে, কিভাবে আমাকে সাহায্য করবে এটা থেকে উঠে দাঁড়াতে?

যাক, আকতার জাহানদের প্রসঙ্গে ফেরত আসি। আরেক ধাপ বাড়িয়ে আরেকটা ‘অসংবেদনশীল’ প্রশ্ন করি। আমাদের দেশের অন্যান্য সব আইন আধুনিক সেক্যুলার আইন অনুযায়ী লেখা হলেও পারিবারিক আইন আবার যার যার ধর্মীয় আইন অনুসরণ করে চলে। আমাদের দেশের সংবিধান নারী-পুরুষের সমানাধিকারের কথা বললেও কেন একটা মেয়ে তার ভাইয়ের অর্ধেক সম্পত্তি পায়? এখনো, এই আধুনিক পৃথিবীতেও কেন ছেলে না থাকলে বাবা-মার সম্পত্তির একাংশ মামা-চাচাদের হাতে চলে যায়? (আমরা তিন বোন হওয়ায় পাড়ার খালারা আমাদের সামনেই আমার মাকে এমন প্রশ্নও করতেন যে, আপা আপনার তো ছেলে নেই, আপনার সম্পত্তি কে খাবে?)।

সন্তানসহ ডিভোর্স হলে কেন একজন প্রতিষ্ঠিত মাও শুধু সাত বছর বয়স পর্যন্ত তার ছেলে সন্তানের জিম্মাদার হয়ে থাকেন, আর মেয়ে সন্তানের ক্ষেত্রে বয়ো:সন্ধিকাল পর্যন্ত? কেন আদালতে গিয়ে আইনি লড়াই করতে হয় এটা বদলাতে হলে? আমাদের নারী প্রধানমন্ত্রীরা তো ধর্মীয় নিয়মকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে রাষ্ট্রপ্রধান হচ্ছেন, কিন্তু আবার তারাই কেন এমন বৈষম্যময় আইনগুলোর বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটাও করেন না?

আমরা নারীরা হাজার হাজার বছর ধরেই তো কত ফিসফিস করলাম। নিজেরা ‘ভালো মেয়ে’র টোপর পরে সমবেদনা আর চোখের পানিতে ভাসতে ভাসতে অসহায়ভাবে প্রিয় ‘ভালো’ মেয়েটাকে চিতায় উঠে যেতে দেখলাম। আসুন না এবার আমরা সম্মিলিতভাবে ‘খারাপ’ মেয়ে হওয়ার শক্তি অর্জন করি, ফিসফিস করে যে ভুল করেছি সেই দায়িত্বটা সম্মিলিতভাবে নিতে শিখি। ‘খারাপ’ মেয়ে হয়ে চিৎকার করে প্রতিবাদ করতে শিখি। আমাদের ন্যয্য দাবীগুলো প্রতিষ্ঠা করতে সোচ্চার হয়ে উঠি।

শুধু একজন ব্যক্তিকে কাঠগড়ায় না দাঁড় করিয়ে সমাজের যে নিয়মগুলো সেই পুরুষটির মত হাজারো পুরুষ তৈরি করে তার বিরুদ্ধেও দাঁড়াতে শিখি। আকতার জাহানদের অমূল্য আত্মাহুতিগুলোকে শুধু জাতীয় হা-হুতাশের উৎস না বানিয়ে সমানাধিকার চাওয়ার তীব্র অনুপ্রেরণায় পরিণত করি। ফিসফিসানির নিম্ন-তরঙ্গ থেকে উত্তরিত হয়ে চিৎকারের উচ্চ-তরঙ্গের বর্ণালীতে বিদীর্ণ করতে শুরু করি আমাদের সমাজকে, রাষ্ট্রকে – হাজার বছরের নিপীড়নের ইতিহাসকে।

***লেখাটি সর্বপ্রথম ওমেনচ্যাপ্টারে প্রকাশিত।***