দাউদ হায়দারের সাথে কী হয়েছিল, কেন তিনি দেশ ত্যাগ করেছেন তা নিয়ে অনেকেই লিখেছেন। এছাড়া উইকিপিডিয়াতেও কবি সম্পর্কে অনেক তথ্য আছে। দাউদ হায়দারের সাথে কী ঘটেছিল, পত্রিকায় কী ছাপা হয়েছিল সেই বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে বুঝতে পারলাম; কবি সম্পর্কে কিছু ভুল সত্য সব জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। যেমন- বলা হয় কবিকে গ্রেফতার করা হয়েছে ১৯৭৩ সালে। তথ্যটি সম্পূর্ণ ভুল। কারণ কবির সেই আলোচিত কবিতা “কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নায় কালো বন্যায়” ছাপাই হয় ১৯৭৪ সালের ২৪ই ফেব্রুয়ারি ‘দৈনিক সংবাদ’ পত্রিকায়। যাই হোক, কী হয়েছি তখনকার পত্রিকার কী লিখেছিল তা খুঁজে বের করা চেষ্টা করি। স্বাধীনতার পর মৌলবাদী দলগুলোর খুব বেশি শক্তি ছিল না, তারপরও কবিকে দেশে রাখা সম্ভব হয়নি। পত্রিকার পাতায় কী লেখা ছিল তাই দেখার চেষ্টা করব।

স্বাধীনতার তিন বছরের মাথায় ১৯৭৪ সালে দাউদ হায়দারকে দেশ ছাড়তে হয়। ‘কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নায় কালো বন্যায়’ নামে একটি কবিতা লেখেন। দাউদ হায়দার বিভিন্ন ধর্মের নবী ও অবতারদের নিয়ে কবিতাটি লেখেন। শুধু ‘সংবাদের সাহিত্য পাতা’য় ছাপান নি , বলা হয়- কবিতাটি বায়তুল মোকারামের সামনে নিজ হাতে ঝুলিয়ে দিয়ে আসেন। ঝুলিয়ে দেওয়ার গল্পটি সম্ভবত সত্য নয়। সাধারণত পাঠকদের জন্যে ভবনের দেওয়ালে পত্রিকা চিকা মারা হয়ে থাকে। সম্ভবত চিকা মারা কাগজের মধ্যে সেখানে কবির কবিতাটিও ছিল।

যাই হোক, ২৪ ফেব্রুয়ারিতে (১৯৭৪)তে কবিতাটি সংবাদের সাহিত্য পাতায় ছাপা হলে ঢাকা কলেজের এক শিক্ষক কবির বিরুদ্ধে মামলা করেন। এরপরেই কবির বিরুদ্ধে ধর্মবাদীরা কবির বিরুদ্ধে বিভিন্ন কর্মসূচী শুরু করে। ১১ই মার্চ ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের কারণে কবিকে গ্রেফতার করা হয়।

পত্রিকায় লেখা হয় যে, গতকাল (১১ই মার্চ) রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জনাব দাউদ হায়দারকে গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেফতার করে। ‘কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নার কালো বন্যা’ নামে একটি কবিতা লেখার তাকে গ্রেফতার করা হয়। গত ২৪শে ফেব্রুয়ারি দৈনিক সংবাদে কবিতাটি প্রকাশিত হয়। গ্রেফতারের কারণ হিসেবে বলা হয়-দেশের বিপুল সংখ্যক জনসাধারণের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত।দাউদ হায়দার ছিলেন দৈনিক সংবাদ পত্রিকার সাহিত্য বিভাগের সম্পাদক। এছাড়া ১৯৭৩ সালে তরুণ কবি হিসেবে আন্তর্জাতিক পুরষ্কারও লাভ করেন।

কলকাতায়, কবি ছোট মা’য়ের সাথে (দ্বিতীয় মা)

১৯৭৪ সালের ১২ই মার্চ, দৈনিক ইত্তেফাক “কবিতাটি কেন্দ্র করিয়া” নামে একটি সংবাদ উপস্থাপন করে। সেখানে বলা হয়, দৈনিক সংবাদে ২৪শে জানুয়ারিতে দাউদ হায়দারের কবিতা প্রকাশ পাওয়ার পর গত গত (১১ই মার্চ) পাবনায়, রাজশাহী প্রকৌশলী কলেজে পূর্ণ দিবস হরতাল পালন করা হয়। কবিতা ছাপার প্রায় এক মাস বিশ দিন পর পাবনায় হরতাল পালন করা হয়। রাজশাহীর প্রতিবাদ সমাবেশে যোগ দেন ভাসানীর ন্যাপ নেতা মশিউর রহমান। অথচ ফেব্রুয়ারি মাসের কোন পত্রিকায় দাউদ হায়দার কিংবা কবিতাটি নিয়ে কোন রিপোর্ট হয়নি। বিষয়টি স্পষ্টত যে, কবির বিরুদ্ধে মামলা ও ১১ই মার্চে গ্রেফতারের পরই এই ইস্যুতে কিছু জায়গায় হরতাল ডাকা হয়। ১১ মার্চে ইত্তেফাকের রিপোর্টে দেখা যায়; কবিতাটি প্রকাশের জন্যে দৈনিক সংবাদ ক্ষমা চায়। এবং কবিতাটি যারা ছাপিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ারও অঙ্গিকার করে। যদিও ৯ই মার্চ দৈনিক সংবাদে কবি কবিতাটির জন্যে ক্ষমা চেয়ে বলেন, কারো ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেওয়া কবির ইচ্ছা ছিল না। আল্লাহ রসুল ও অন্য ধর্মের প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল। তিনি আরো বলেন কবিতাটি তিনি তার কোন কাব্য গ্রন্থে যুক্ত করবেন না।

ইত্তেফাক পত্রিকা এখানে ভুল করে ২৪শে জানুয়ারি লিখে ফেলে। যদিও অন্য জায়গায় সঠিক তারিখ ২৪শে ফেব্রুয়ারি লেখে।” width=”878″ height=”898″ class=”size-full wp-image-49394″ /> ইত্তেফাক পত্রিকা এখানে ভুল করে ২৪শে জানুয়ারি লিখে ফেলে। যদিও অন্য জায়গায় তারা সঠিক তারিখ ২৪শে ফেব্রুয়ারি লেখে।

১২ই মার্চে বায়তুল মোকারমে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সংবাদ পত্রিকার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। এবং ২৪শে ফেব্রুয়ারির পত্রিকা বাজেয়াপ্ত করার জন্যে সরকারের প্রতি আহবান জানানো হয়। এর পর পত্রিকার কয়েকটি কপিতে অগ্নি সংযোগ করে, একটি মিছিল সংবাদ অফিসের সম্মুখে বিক্ষোভ করে ও ইট পাটকেল নিক্ষেপ করে। বাংলাদেশ সীরাত মজলিস, বাংলাদেশ সাবান শ্রমিক ইউনিয়ন তীব্র নিন্দা জানায়।

ইসলামপন্থীদের বিক্ষোভ

কবি ডালিম হোসেন এক বিবৃতিতে বলেন-আমি ব্যক্তিগতভাবে নবী মুহাম্মদের ভক্ত। অপর দুইজন ব্যক্তির আমার কাছে পরম শ্রদ্ধেয়। বিক্ষুব্ধ দেশবাসীর কাছে আমার আরজ, যে অপরাধ করিয়েছে, সে নিজে অপরাধ স্বীকারপূর্বক ক্ষমাপ্রার্থনা করেছে-এর চেয়ে বড় প্রতিকার ও প্রতিশোধ আর কিছুই হতে পারে না। ক্ষমা ও সহৃদরতা ছাড়া এখন আর কিছুই তার প্রাপ্য নয়। মহানবীর জীবনকালে যদি এ-ঘটনা ঘটত তা হলে অপরাধী যে শুধু ক্ষমা পেত তা নয়, তার প্রিয় ভক্তদের মধ্যে স্থান লাভেও বাধা থাকতো না। আমাদের স্মরণ করতে হবে, মহানবীর সেই প্রিয়তম অনুচর ও সহচরদের কথা-যারা প্রথম জীবনে শুধু তার মতের বিরুদ্ধচারী ছিলেন না, প্রাণের বৈরীও ছিলেন। দাউদ হায়দার অল্প বয়স্ক। এখনো ছাত্র, তাই তার মুক্তি ও পুনর্বাসনের আবেদন জানাচ্ছি। তবে সমীরণ সাহিত্য চক্রের বক্তব্য ছিল- কলমের আঘাত কলম দ্বারা প্রতিরোধ করাই উত্তম। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক কবিতাটিকে অশালীন হিসেবে চিহ্নিত করে ঐতিহাসিক বটতলায় প্রতিবাদ সমাবেশ করে। সভায় দাউদ হায়দারকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবী করা হয়। এছাড়া নাস্তিকতার প্রচার বন্ধের জন্যে বিশেষ পদক্ষেপের আহবান জানানো হয়। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

১৯৭৪ এর ২০শে মে সন্ধ্যায় তাঁকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং ’৭৪-এর ২১শে মে বঙ্গবন্ধুর বিশেষ নির্দেশে সুকৌশলে কলকাতা-গামী একটি ফ্লাইটে তাকে তুলে দেয়া হয়। ওই ফ্লাইটে সে ছাড়া আর কোনও যাত্রী ছিল না। তাঁর কাছে সে সময় ছিল মাত্র ৬০ পয়সা এবং কাঁধে ঝোলানো একটা ছোট ব্যাগ (ব্যাগে ছিল কবিতার বই, দু’জোড়া শার্ট, প্যান্ট, স্লিপার আর টুথব্রাশ।) কবির ভাষায়, ‘আমার কোন উপায় ছিল না। মৌলবাদীরা আমাকে মেরেই ফেলত। সরকারও হয়ত আমার মৃত্যু কামনা করছিল।’

ভারতে গিয়েও রক্ষা পাননি কবি। শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর জিয়াউর রহমান এর নির্দেশে তাঁর পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করা হয়। হাইকমিশনার তাঁর বাসায় গিয়ে, বাসা মানে দাউদ হায়দার ভারতে যাঁর আশ্রয়ে থাকতেন সেই বাড়ীতে গিয়ে পাসপোর্ট নিয়ে আসে। ভারত সরকার তাঁকে ভারত ত্যাগের ফাইনাল নোটিশ দেয়- “… য়্যু হ্যাভ নো কেইস ফর গ্রান্ট অব লংটার্ম ষ্টে ফ্যাসিলিটিজ ইন ইন্ডিয়া এন্ড য়্যু আর দেয়ারফর রিকোয়েষ্টেড টু লীভ ইন্ডিয়া ইম্মিডিয়েটলি উইদাউট ফেইল।” ১৯৮৫ সালে পেন আমেরিকান সেন্টারের ২০০০ লেখকের পক্ষ থেকে ভারতের প্রধান মন্ত্রীর কাছে একটা চিঠি লেখা হয় যাতে দাউদ হায়দারকে ভারতের নাগরিকত্ব দেয়ার অনুরোধ করা হয়। এর পিছনে কবির বন্ধু অন্নদাশঙ্কর রায়ের প্রভাব ছিল।

এর পর নোবেল লরিয়েট জার্মান সাহিত্যিক গুন্টার গ্রাস ভারত সফরে এসে পুরো ঘটনা শুনলেন। কথা দিয়ে গেলেন তাঁকে “তোমার জন্য কিছু একটা করবো। তিনি জার্মান সরকারের উচ্চপর্যায়ে কথা বলে বাংলাদেশ থেকে নির্বাসিত কবিকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়ার ব্যবস্থা করেন। ২২ শে জুলাই ১৯৮৭ এর কোনো এক ভোরে জার্মানির বার্লিনে গিয়ে পৌঁছান কবি দাউদ হায়দার। জাতিসংঘের বিশেষ ‘ট্রাভেল ডকুমেন্টস’ নিয়ে এখন ঘুরছেন দেশান্তরে। সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় এলে তিনি আটক পাসপোর্ট ফেরত চেয়ে আবেদন করেন। তার পাসপোর্ট ফেরতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে এরশাদ সরকারও। এরশাদের আমলে ঘোষণা করা হোল, “এই লোক বাংলাদেশের জন্য সন্দেহজনক”- এই মর্মে পৃথিবীর যেসব দেশে বাংলাদেশ দূতাবাস আছে, সেই সব দেশে নোটিশ পাঠানো হল। নোটিশে বলা হল- “এই ব্যক্তিকে সরকারের পূর্বানুমতি ব্যতিরেকে কোনো পাসপোর্ট প্রদান করা যাইবে না। তাহার নাম সন্দেহজনক ব্যক্তিদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করিতে হইবে।’

বর্তমান সরকারও কবিকে দেশে আসার অনুমতি দেননি। সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ জার্মানি সফরে গেলে বাংলাদেশের নির্বাসিত কবি দাউদ হায়দার তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। কবি দেশে ফেরার ব্যাপারে তার আকুতির কথা জানান মন্ত্রীকে। এরপর তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেন দেশে ফেরার জন্য। কিন্তু সেই আবেদনে সরকার সাড়া দেয়নি। দেশে প্রবেশের সরকারী বাঁধার বিষয়ে কবি বলেন, এই ৪১ বছরেও আমি জানতে পারিনি অথবা জানানো হয়নি কী অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে। এটি সরকারের দায়িত্ব। এখন যেহেতু জাতীয় মানবাধিকার কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাই তাদেরও দায়িত্ব রয়েছে আমাদের মানবাধিকার সুরক্ষায় সহায়তা দেওয়া। চার দশকের বেশি প্রবাসে কাটানো এই কবি জানান, যে কবিতার জন্য উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠীর হুমকিতে পড়েছিলেন তার সেই কবিতা শতাধিক ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের সময় ওইসব দেশের মানুষ তার কবিতা নিয়ে আলোচনা করেন। দেশে ফেরার আগ্রহের বিষয়ে দাউদ হায়দার বলেন, “নিজের জন্মভূমির মাটি, আলো-বাতাসের মত কোনকিছুই আপন হয় না। বার্লিনেও আকাশ রয়েছে, মাটি রয়েছে, গাছপালা রয়েছে। কিন্তু কোনটিই আমাকে আপন ভাবে না। আমিও ভাবতে পারি না। এটি কখনো হয় না। মাটির টান কত যে প্রবল তা বলে বুঝাতে পারব না।”

দাউদ হায়দারকে নিয়ে এতো কথার বলার কারণ হল, তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নির্বাসিত লেখক। যিনি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের কারণে দেশ ছাড়তে হয়েছেন। অনেক বড় ঘরের সন্তান ছিলেন বলে হয় তো সরকার তাকে প্রাণে বাঁচিয়ে দেন। এছাড়া সাপ্তাহিক ২০০০ এ প্রকাশিত হওয়া তার আত্মজৈবনিক লেখা ‘সুতানটি সমাচার” ২০০৭ সালে ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত দেয়ার অভিযোগে সরকার বাজেয়াপ্ত করে।

শিবব্রত নন্দী পুরো কবিতাটাই তাঁর ডায়েরিতে সে সময় টুকে রাখেন। এই কবিতাটা যখন ছাপা হয়, তখন তিনি বাংলাদেশে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। থাকতেন নাজমুল আহসান হলে। তখন নাজমুল আহসান হল টিনশেডের। হলের কমনরুম থেকে কবিতাটা তিনি ডায়েরিতে তুলে নেন। আজ বিয়াল্লিশ বছর পরেও সেই ডায়েরি অক্ষত অবস্থায় রয়েছে তাঁর কাছে। শিবব্রত নন্দী থেকে কবিতাটি সংগ্রহ করেন ফরিদ আহমেদ।

দাউদ হায়দার ‘কালো সুর্য্যের কালো জ্যোত্স্নায় কালো বন্যায়’ নামে একটি কবিতা লেখার কারণে দেশ ছাড়েন। এছাড়াও ১৯৭৩ সালে ‘London Society for Poetry’ তাঁর এক কবিতাকে “the Best Poem of Asia” সম্মানে ভুষিত করে। ঢাকার কোন এক কলেজের শিক্ষক ঢাকার একটি আদালতে এই ঘটনায় দাউদ হায়দারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছিলেন। বলা হয় এই মামলা অতঃপর মৌলবাদীদের হুমকি ধমকি থেকে তাঁকে রক্ষা করার জন্যই ১৯৭৪ সালে কবিকে ‘Protective Custody’ তে নেওয়া হয়। অদ্ভুদ বিষয় হল কালো সুর্য্যের কালো জ্যোত্স্নায় কালো বন্যায় ” কবিতাটি’র বাংলা কবির কাছেও নেই। কবিতাটির ইংরেজী অনুবাদও করা হয়।

কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নায় কালো বন্যায়

দাউদ হায়দার

প্রকাশকালঃ ২৪শে ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪

জন্ম আমার কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নার কালো বন্যায়
ভেসে এসেছি তোমাদের এই তিলোত্তমা শহরে
কল্পিত ঈশ্বর আমার দোসর; পায়ে তার ঘুঙুর; হৃদয়ে মহৎ পূজো
চুনকামে মুখবয়ব চিত্রিত; আমি তার সঙ্গি,
যেতে চাই মহীরুহের ছায়াতলে, সহি নদীজলে; ভোরের পবনে।
ঈশ্বর একান্ত সঙ্গি; জ্বেলেছি ধূপ লোবানের ঘরে। তার পায়ের ঘুঙুর সে
আমাকে পরিয়ে পালালো, আমি উঠলুম আমি।
ভেতরেও সে বাহিরেও সে; আমার আমি হয়ে চলেছি আমি,
মরণের নক্ষত্র দোদুল্যমান কালো ঘণ্টার রাজধানীতে বর্শার মতো দিন।

রাত্রির অলীক নটী, অন্ধদ্বন্দ্বে নাচায় ভাই; আমার বিশ্বাস ছিল
প্রতিধ্বণী নেই, তিমিরে আমার যাত্রা; দেখা হয় আলখেল্লায়
সজ্জিত মিথ্যুক বুদ্ধ; বসে আছে বোধিদ্রুমের ছায়াতলে;
যিশু আরেক ভণ্ড; মোহাম্মদ তুখোড় বদমাস; চোখে মুখে রাজনীতি,
আমি প্রত্যেকের কাছে পাঠ নিতে চাইলুম; তোমাদের চৈতন্যে যে লীলাখেলা
তার কিছু চাই এবেলা। দেখলো ঈশ্বর দেখলো আদম।
আদমের সন্তান আমি; আমার পাশে আমি?
আমি আমার জন্ম জানি না। কীভাবে জন্ম? আতুরের ঘরে কথিত
জননী ছাড়া আরে কে ছিল? আমায় বলে নি কেউ।
আমার মা শিখালো এই তোর পিতা, আমি তোর মাতা।
আমি তাই শিখেছি। যদি বলতো, মা তোর দাসী, পিতা তোর দাস;
আমি তাই মেনে নিতুম। কিংবা অন্য কিছু বললেও অস্বীকারের
উপায় ছিল না।

আমি আজ মধ্য যৌবনে পিতা মাতার ফারাক বুঝেছি। বুঝেছি সবই মিথ্যা
বুঝেছি কেউ কারও নয়; কেউ নয় বলেই তো বলি
একদিন সবকিছুই যাবে চলে (চলে যাবে)।
Every things passes, one day every thing will go yet
We shall not recognise each other, and indirect love
remain hesitant as the desires of life time shall roam
the winds and blue sky.
এই তো সনাতন নিয়ম; ব্যতিক্রম নেই পরিবর্জিত অজাত শত্রু আমার।
প্রেম সে কি? কোথায় থাকে? কার জরায়ু থেকে নেমে আসে?
কেউ নিঃসঙ্কোচে বলতে পারো?
বারবার আমি বেয়োগের চৈতন্যে বাহু রাখি। স্মৃতি আমার অকাল পাথর।
জীবে প্রেম? মানুষে মানুষে ভালবাসা? প্রেম অশ্রু আমার
ভোঁতা। এ্যরিষ্টোটল, প্লেটো, আমার চৈতন্যে; তাদের চৈতন্যই
আমার বিশ্বাস।

নীটসের কথাই ঠিক; ঈশ্বর মরেছে আমার শৈশবে,
অতএব সে আমায় ঘুঙুর পরিয়ে পালালে সে আজ নেই,
তার জারজ সন্তানেরা অলীকের চৌমাথায় বসে পাণ্ডুর প্রেমের কথা বলে।
লোক জমে, বাহবা দেয়; ঔষধ কেনে; ঘরে ফেরে; দেখি সব ফিকে।
আমি জনমে জনমে শূন্য গর্ভে ফিরে আসি।
নূপুর মিশ্রিত অধীর সঙ্গীতের বিরহের কাল বৈশাখীর শ্বাশতের করি না বন্দনা।
আমাতে উল্লাস আছে লগ্ন নেই; সার্থক বুদ্ধিতে বিষ্ণু দে আজ করিঃ
আমার প্রিয়; অপ্রিয় সুধীর দত্তও নয় বটে,
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এড়াতে পারেননি এ বড় দুঃখের কথা।

যুগল স্তনে যৌবন দেখা দিলে তুমি বল প্রেম স্মৃতি।
একি তোমার নিজস্ব অভিলাষ? মাঝে মাঝে রাত্রি কালে হেঁটে যাই;
কোথা যাই সঠিক জানি না।

পথ জানে না আমার গন্তব্য কোথায়; আমি তার কোন কেন্দ্রে গিয়ে
আশ্রয় নেবো। এমন মমতা দেখে খুঁজে ফেরে চরণ চিহ্ন; চরণ চিহ্ন
সহসা হারিয়ে যায়।
শোণিতে খেলা নেই নিস্ক্রিয় নিশ্চল।
আমি তোমায় খুঁজেছি; সীমান্তে আত্মদান করেছ কিনা জানি না,
মহাকাল আমার পদতলে। নিমীলিত চক্ষে আকাঙ্ক্ষার স্পষ্টতা।

পুরানে আমার বিস্ময়; কি করে অসাধ্য সাধন করা যেত?
আমার বন্ধুদের চেয়েও বুদ্ধিদীপ্ত? আপন বিশ্বাসে আমার কাটলো
মিথ্যা তাই বলি, প্রেম মিথ্যা, মিথ্যা, মিথ্যা।
সব কবিই একই ফুটবল নিয়ে ঘুরছেন গোল স্টেডিয়ামে, রেফারী নেই
হ্যান্ডবল, ফাউল ধরছেন কেউ? আমরা দর্শক কিছুই বুঝি না খেলা দেখি
আশা মিটে গেলেই ঘরে ফিরি। গোল করার কায়দাও মনে রাখি না।
কিন্তু সবাই তো চৌকস খেলোয়াড় বলটা কাটতে পারেন ভালো;
তবে কেন ঘুরছেন?

সহীসের ঘোড়ার সাথে জীবনানন্দের দেখা হোলো একদিন
মধ্যরাতে আমার সাথে পাল্লা দিয়ে হেরে গেলো-
মনে তার প্রেম ছিল?
মূল্যহীন মূল্যবোধের কতটুকু বিজয়?
আমি দৃষ্টির আড়ালে উচ্চরিনাঃ বলি বিশাল জনসভায়-
তিমিরে আমাদের যাত্রা; তুমি জানো না জানো কিছুই এসে যায় না
এই উড়ন চণ্ডীর, উড়নচণ্ডীরাই মহাপাগল, পাগলের কথার
দাম বিশ্ব ব্যাংকও জানে না।
সাবিত্রী তুমি কি বহ্নির কাছে নতজানু হবে? অমরত্ব হারাবে,
এসে আমার হাতে হাত রাখো; অমৃতের দিকে চোখ ফিরিও না
তোমায় সামনে বসিয়ে মন্থর করে এঁকে যাবো
সমস্ত শরীর চুল চিবুক।

এখন আকাবোকা সব শেষ
সামনে যে অন্ধকার আগামী উৎসবে আরো দ্বিগুণ হবে।
প্রতীক্ষায় লাভ নেই, আমার বক্ষে মাথা রাখো শোন আগমনী বার্তা
কালো মৃত্যুর দিন সমাগত,
তুমি শান্তির প্রেমের কথা বলো। বলেছে আদমের সন্তানেরা শান্তি কোনদিন
আসবে না, কৌতুক নয়। অন্ধ সংসারে সেই কোরে প্রেম।
পাতালে গিয়েছ কোন দিন? কিংবা আকাশ নীলিমায়?
দেখেছ এ্যাপোলো? মন্বন্তরে সেকি যায়নি ভেসে? স্বরচিত গানে
আনন্দ পাও? ইন্দ্রপাল লক্ষ কোরেছো কোনদিন?
বিজ্ঞাপন বড় সুন্দর একদিন কৃষ্টি হবে পায়রা আসবে কার ঘরে? কোন ঘরে
তোমারই স্মরণে?

তোমার মুখে স্তনে কিসের দাগ? ঘোমটায় কোথায় চলেছো তুমি?
পেছনে আমার ভাই; অন্ধ ছন্দে সেই কৃষ্ণ; রাধা নেই,
আমার পদপ্রান্তে নিঃসঙ্কোচে লুটাক আদমের সন্তান; ঈভের প্রেম
ফাঁদের অলীক প্রেমে আমি আলো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নায় কালো বন্যায়
তোমাদের শ্বাশতীরে খুঁজে পাইনি। কেউ পায়না চলে গেছে,
সব চলে গেছে, চলে যায়; বুঝি তাই বলে যাই
Even when our eyes meet shall not recognise each other
Even we walk past each other we shall not see. One day
Our bodies shall be together. One day we shall be
tern from the struggles of life.
We shall have the silent procession and move
towards a redbirth, and I shall call you again and
again. And when you do not answer I shall
go to that phanton land
when we shall stand face
in perfect union. One day
you and I shall go to that landscape. And
yet no one shall recognize other.



কৃতজ্ঞতা স্বীকার:
পত্রিকার কপি কৃতজ্ঞতায়:PID, Ministry of Information
কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নায় কালো বন্যায়” কবিতাটি সংগ্রহ করেন ফরিদ আহমেদ
কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নায় কালো বন্যায়” ইংরেজী অনুবাদটি সংগ্রহ করেন ওমর ফারুক লুক্স

তথ্য সহায়তায়:
সত্তরের দশকে আসলে কী ঘটেছিল নির্বাসিত কবি দাউদ হায়দারের জীবনে?
দাউদ হায়দার: ৫৫,০০০ বর্গ মাইলের প্রথম নিষিদ্ধ কবি
আয়রে খোকন ঘরে আয়
নির্বাসিত জীবনের যন্ত্রণা অন্যে বুঝবে না: দাউদ হায়দার