আর্য কারা,তাদের আদি বাসস্থান কোথায়,ভারতীয় উপমহাদেশে কবে তাদের আগমন,প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতায় তাদের কি অবদান-এই বিষয়গুলি নিয়ে একের পর এক বিতর্ক হয়েছে কিন্তু কোন নিশ্চিত সমাধানসূত্র আজও অধরা।প্রাথমিক পর্বে মনে করা হত যে শ্বেতগাত্রবর্ণ,টিকালো নাসিকা,প্রশস্ত ললাট ও দীর্ঘদেহী ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য সম্বলিত মানবপ্রজাতির একটি গোষ্ঠী হল আর্য। এই তত্ত্ব বেশ প্রভাবও বিস্তার করেছিল এবং এর ভিত্তিতে অনেকেই বলতে শুরু করেন যে আর্যরা হলেন নরডিক জাতির মানুষ।কিন্তু এই কাল্পনিক তত্ত্বের ফানুস ফুটো হয়ে যায় ইরান থেকে বেহিস্তান শিলালিপি আবিষ্কৃত হওয়ার পর।যীশুর জন্মের প্রায় ৪৮৬ বছর আগে উৎকীর্ণ এই লেখতে পারস্য সম্রাট দারায়ুস নিজকে দাবী করেন-‘’ A Persian, a son of a Persian and an Aryan of Aryan Descent’’ হিসেবে। ব্যাস এরপরই ঐতিহাসিক মহলে তীব্র আলোড়নের সৃষ্টি হল এবং আর্য জাতির সাথে সম্পৃক্ত দেহসৌষ্ঠব সংক্রান্ত তত্ত্ব এক লহমায় বাতিলের খাতায় চলে গেল।

নিঃসন্দেহে আর্য জাতির শ্রেষ্ঠ সাহিত্য কীর্তি হল বেদ।সংস্কৃত ভাষায় বিরচিত বেদ এক বিস্ময়কর গ্রন্থ। ধর্ম ও দৈনন্দিন জীবনের নানা দিকের অপূর্ব সংমিশ্রণ এই গ্রন্থে লক্ষ্য করা যায়।ষোড়শ শতাব্দীর সময়ে ভারতে আগত ইউরোপীয় পর্যটক ও ধর্মপ্রচারকদের মধ্যে ভারতীয় ধর্ম, বিশেষত বেদ নিয়ে তুমুল উৎসাহ দেখা দেয়।এরাই প্রথম সংস্কৃত,ইরানীয় ও ইউরোপীয় বেশ কিছু ভাষার মধ্যে সামঞ্জস্য লক্ষ্য করেন।যেমন গোয়াতে আগত ব্রিটিশ জেসুইট পাদ্রী থমাস স্টিফেন্স ১৫৮৩ সাল নাগাদ তাঁর ভাইয়ের উদ্দেশ্যে প্রেরিত এক চিঠিতে সংস্কৃতের সাথে গ্রীক ও ল্যাটিন ভাষার সাদৃশ্যের কথা উল্লেখ করেছিলেন।অন্যদিকে ইটালির ফ্লোরেন্সীয় বনিক ফিলিপো সসেটি বানিজ্য সংক্রান্ত কাজে গোয়ায় এসেছিলেন।তিনি এসময় এক স্থানীয় গোয়ান পণ্ডিতের কাছে সংস্কৃত ভাষার অধ্যয়ন করেছিলেন।এরপর ১৫৮৫ তে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে তিনি বেশ কিছু সংস্কৃত ও ইটালীয় শব্দের সাদৃশ্য উপস্থাপন করেন,যেমন – Deva(Sans.) / Dio(Ita.), Sapta(Sans.)/ Sette(Ita.), Ostta(Sans.)/ Otto(Ita.) ইত্যাদি।যদিও স্টিফেন্স ও সসেটি কেউই এই সামঞ্জস্যের কারন অনুসন্ধানের প্রয়াস করেননি।কিন্তু তাঁরা নিজেদের অজান্তেই আর্য সংক্রান্ত গবেষণায় এক নয়া সম্ভাবনাময় দিকের উন্মোচন করেছিলেন।এভাবে ভাষাতাত্ত্বিক প্রেক্ষিতে,সম্পূর্ণ এক নতুন আঙ্গিকে আর্যদের ইতিহাস বিশ্লেষণের প্রক্রিয়া শুরু হয় যা প্রায় বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত বজায় ছিল কিন্তু এই পদ্ধতিও শেষ পর্যন্ত সমাধানসূত্র নির্ণয়ে ব্যর্থ হয়।

ফরাসী জেসুইট পাদ্রী গ্যাস্টন লরেন্ট দক্ষিন ভারতে ধর্মপ্রচারকালে তেল্গু ভাষা শিখেছিলেন।তিনি ‘তেলেগু-ফরাসী-সংস্কৃত’ একটি অভিধান রচনা করেন এবং এখানে এই তিন ভাষার মধ্যে ভূরি ভূরি সাদৃশ্য তুলে ধরেন।তাঁর এই অভিধানটি আজও ভাষাতত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে আর্য অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে ‘বাইবেল’ হিসেবে বিবেচিত হয়।তাই ম্যাক্সমুলারের মত যশস্বীও তাঁকে ‘তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের জনক’ হিসেবে অভিহিত করেন।গ্যাস্টনের পরবর্তীকালে জেমস পারসনস উল্লেখ করেন যে,ইউরোপ ও এশিয়ার অনেকগুলি ভাষার উৎপত্তি নিহিত আছে এক আদিম ভাষার মধ্যে।একই ভাবে ডাচ ভাষাবিদ মার্কুস জুয়েরিয়াস বক্সহর্ন এই ভাষাগত সাযুজ্যের ভিত্তিতে ‘স্কিথিয়ান’ নামে এক আদিম ভাষার অবতারনা করেন এবং এই থেকেই বিভিন্ন ভাষার উৎপত্তি হয়েছে বলে দাবী করেন।এভাবে আর্য সংক্রান্ত যে এক নতুন সংজ্ঞা নির্ধারিত হয় তা হল – আর্য একটি ভাষাগোষ্ঠীর নাম।ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত সংস্কৃত,গ্রীক,ল্যাটিন,জার্মান,পারসিক ও কেলটিক এই সকল ভাষার মধ্যে যে কোন একটি যদি কোন ব্যক্তির মাতৃভাষা হয়,তবে তিনি আর্য।এই ইন্দো-ইউরোপীয় শব্দদ্বয় ব্রিটিশ গবেষক থমাস ইয়ং সর্বপ্রথম তাঁর প্রবন্ধে উল্লেখ করেছিলেন ,বিভিন্ন ভাষার মধ্যে সমজাতীয়তার ভিত্তিতে। বিস্ময়কর ভাবে ‘হিব্রু’ ভাষাকে এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।যদিও বর্তমানে হিব্রু ও তামিল ভাষার মধ্যে বেশ কিছু মিল দেখা যায়।যেমন তামিলে ময়ূরকে ‘টোকেই’ রূপে উল্লেখ করা হয়,তেমনই হিব্রু ভাষায় ময়ূরের নাম হল ‘টুকি’।

জার্মান ভাষাতাত্ত্বিক আন্দ্রেস জাগার ককেশাস অঞ্চলে একদা বিরাজমান এক প্রাচীন ভাষার ধারনা প্রদান করেন,যা থেকে গ্রীক,স্ল্যাভিক,পারসিক ও কেল্টো-জার্মান বা স্কিথিও-কেলটিক ভাষার উৎপত্তি হয়েছে বলে দাবী করেন।ডাচ পণ্ডিত জোসেফ স্ক্যালিগার আবার চারটি প্রাচীন ভাষাগোষ্ঠীর অবতারনা করেছিলেন এবং সেগুলি হল-সেমাইট (আরবীয় ভাষাসমূহ ও হিব্রু),হ্যামাইট (ইজিপ্সিয় ও কুশাইট ভাষাসমূহ),জ্যাফেটিক এবং গ্রীক-ল্যাটিন-জার্মান-ভারতীয় ভাষাসমূহ সম্বলিত একটি গোষ্ঠী।ডেনমার্কের গবেষক রাসমুস ক্রিস্টিয়ান রাস্ক নরওয়েজী,গথিক,লিথুয়ানিয়ান,গ্রীক,ল্যাটিন ও সংস্কৃত ভাষার মধ্যে সাযুজ্য উপস্থাপন করেন।প্রত্যেক ভাষাবিদই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ভাষাগুলির জন্মদাত্রী রূপে এক প্রাচীন ভাষার উল্লেখ করেছেন এবং এই প্রাচীন ভাষাটিকে বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়েছে।তবে ভাষাতাত্ত্বিক প্রেক্ষিতে প্রথম যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা প্রদান করেন কলকাতা উচ্চন্যায়ালয়ের পূর্বতন প্রধান বিচারপতি তথা বেঙ্গল এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা উইলিয়াম জোন্স।তিনি সংস্কৃত,গ্রীক ও ল্যাটিন ভাষার ক্রিয়াপদ ও ব্যকরণগত সাযুজ্যের উল্লেখ করে,এই তিন ভাষার উৎসক্ষেত্র রূপে এক আদি ভাষার অবতারনা করেন।ফরাসী পণ্ডিত বার্নফ এবং তাঁর দুই অনুগামী রথ ও ম্যাক্স মুলার বৈদিক সাহিত্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেন।তাঁরাই প্রথম ‘ইন্দো-এরিয়ান’ বা ‘ইন্দো-আর্য’ শব্দদ্বয়ের উল্লেখ করেন এবং বিভিন্ন ভারতীয় ভাষাগুলি এই ‘ইন্দো-আর্য’ ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত।ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে আলেকজান্ডার স্লাইকার ‘Genealogical Tree Theory’ বা G.T.T তত্ত্ব উপস্থাপনের মাধ্যমের এক নয়া মাত্রা সংযোজিত করেন।এই তত্ত্ব অনুসারে একটি প্রাচীন ভাষা ভেঙে কতগুলি নতুন ভাষার উৎপত্তি হয় এবং পরবর্তীতে প্রতিটি নতুন ভাষা ভেঙে আরও অনেকগুলি ভাষার সৃষ্টি হয়।যদিও প্যাট্রিক ম্যালোরী ও ডগলাস অ্যাডামস, ভাষা বিভাজনের এই অতি সরলীকরণ প্রক্রিয়ার বিরোধিতা করেন।এক্ষেত্রে তাদের যুক্তি ছিল ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠী থেকে সৃষ্ট ভাষাগুলির প্রকৃতি সব জায়গায় এক নয় এবং এগুলি থেকে উৎপত্তিলাভ করা উপভাষাগুলিও সবক্ষেত্রে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার সাথে সংযুক্ত নয়।জার্মান ভাষাবিদ জোহানেস স্মিথ আবার ‘Wave Theory’ উপস্থাপন করেছিলেন,যার মূল বক্তব্য ছিল- জলে পাথর ফেললে একটি কেন্দ্র বরাবর ঢেউ যেমন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে,তেমনই একটি আদিম ভাষা থেকে নতুন নতুন ভাষার উৎপত্তি হয়।আর্যদের উৎস বিশ্লেষণে ভাষাতাত্ত্বিক পদ্ধতি খুব একটা কার্যকরী হয়নি।এই তত্ত্বের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হল আর্যদের বাসস্থান কোথায় ছিল,তা নির্ণয় করা যায় নি।সংস্কৃতের সাথে অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষার ব্যাপক সাদৃশ্যের প্রেক্ষিত্তে অনেকেই ভারতকে আর্যদের আদি বাসভূমি রূপে অভিহিত করেন।যদিও ট্রটম্যানের মত অনেকেই মনে করেন যে ল্যাটিন,কেলটিক,ইরানীয় ও জার্মানের সাথে সংস্কৃতের সাযুজ্য প্রমান করে যে, আর্যরা অভারতীয়।একদা এই বিশাল ভাষাগোষ্ঠী একটি অঞ্চলে বসবাস করলেও পরবর্তীতে তারা বিভক্ত হয়ে যায় এবং একদল ভারতে প্রবেশ করে বৈদিক সভ্যতার জন্ম দেয়।

Centum_Satem_map
ছবি: খ্রিস্টপূর্ব পাঁচশ বছর আগে ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষার বিস্তৃতি

দীর্ঘ দুই শতাব্দী ব্যাপী আর্যদের উৎপত্তি সংক্রান্ত প্রেক্ষিতে ভাষাতত্ত্বের কচকচানি চললেও কোন সমাধানসূত্র তো দূরে থাক বরং সমগ্র বিষয়টিই আরও জটিল হয়ে যায়।একের পর এক কল্পনা ও তত্ত্বের সমাহারে বিতর্ক ঘোরালো হয়ে ওঠে।এমন এক দিশাহীন পরিস্থিতিতে আনাতোলিয়া বা তুরস্কে ও ভারতে কয়েকটি নতুন সভ্যতার আবিস্কার পুনরায় আর্য বিতর্কে নয়া মাত্রা সঞ্চার করে।এশিয়া মাইনরে অবস্থিত ভোগসকাই যা একদা হিত্তিয়দের রাজধানী ছিল,সেখান থেকে প্রাপ্ত একটি লেখতে ইন্দ্র,ব্রুন,মিত্র ও নাসাত্য- এই চারটি নাম পাওয়া যায়,যারা আবার বৈদিক সাহিত্যে দেবতা হিসেবে স্থান পেয়েছেন।এছাড়া এই লেখটি থেকে ঘোড়া বা অশ্বের প্রশিক্ষন সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যায় এবং এই সম্পর্কিত একই গ্রন্থের উল্লেখও পাওয়া যায়।এই অশ্বের তথ্য এক নতুন সমস্যার জন্ম দেয়।হিন্দু মৌলবাদী ঐতিহাসিকরা আর্যদের ভারতীয় রূপে অভিহিত করলেও,অশ্বের সুপ্রাচীন নিদর্শন ভারতে পাওয়া যায়নি।আর্যরা এমন এক জাতি অশ্ব ও অশ্ব-চালিত রথে অভ্যস্ত ছিল অথচ ভারতীয় সভ্যতার সুপ্রাচীন নিদর্শন হরপ্পা সভ্যতাতে অশ্বের নিদর্শন নেই।ফলে ভারত আর্যদের আদি বাসস্থান নয় এই তত্ত্বে বিশ্বাসীরা ‘আর্য-অশ্ব’ একদম সমার্থক করে ফেলেছেন।ফলে লাভ কিচ্ছু হয়নি বরং এই দৃষ্টিভঙ্গিগত সীমাবদ্ধতা প্রকৃত ইতিহাসকে বিকৃত করে ফেলেছে। ভোগসকাই লেখর ভিত্তিতে ঋগ্বেদ রচনার যে সময়কাল নির্ণীত হয়েছে তা হল যীশুর জন্মের প্রায় পনেরোশো বছর পূর্বে ও ঋগ্বেদের একদম প্রাথমিক পর্যায় তুরস্কে রচিত হয়েছিল এবং বারশো খৃস্ট পূর্বাব্দে তুরস্ক থেকে আর্যরা ভারতে প্রবেশ করে। মারিয়া গিমবুটাস ‘কুরগান সংস্কৃতি’ র ওপর ভিত্তি করে ককেশাস অঞ্চলে আর্যদের আদি বসতি ছিল বলে মনে করেন।আসলে কুরগান হল সমাধি সংক্রান্ত এক রীতি;এই রীতি অনুসারে সমাহিত ব্যক্তির সাথে অশ্ব সহ অন্যান্য গবাদি পশুকেও সমাধিস্থ করা হত।তবে ককেশাস আর্যদের আদি বসতি কিনা তা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় না,কারন এই অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত সমাধিগুলিতে যে মনুষ্য দেহাবশেষ পাওয়া গেছে তা আবার নরডিক জাতির মানুষের সাথে সমজাতীয়।

দক্ষিন রাশিয়ার কাজাখস্তান থেকে আবিষ্কৃত ‘আন্দ্রনোভো সংস্কৃতি’র ক্ষেত্রে দেখা যায় যে,এই সভ্যতার অন্তর্গত পশুপালক গোষ্ঠী অশ্বের সাথে সুপরিচিত ছিল এবং এই অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত গবাদিপশুর দেহাবশেষের মধ্যে আশি শতাংশই অশ্বের।এই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এলিনা কুজমিনা উল্লেখ করেছেন যে, পন্টিক-কাস্পিক অঞ্চল হল আর্য বা ইন্দো-ইউরোপীয় গোষ্ঠীর আদি বাসভূমি এবং এখান থেকেই একটি শাখা ইউরোপে চলে যায় ও আরকটি শাখা ইরানে চলে যায়।ইরানের শাখাটি থেকে ভেঙে আরেকটি শাখা আবার ভারতে প্রবেশ করে।ইউরোপে যে আর্যদের একটি শাখার অভিপ্রয়ান হয়েছিল তা নিয়ে কোন সন্দেহই নেই এবং পরবর্তীকালে হিটলারের সময়ে ‘জার্মানরা আর্য’ এই জাতীয় ধারনা গড়ে উঠেছিল।সমস্যা হল আর্যদের যে শাখাটি ইরান বা তদানীন্তন পারস্যে প্রবেশ করেছিল তাদেরকে নিয়ে।প্রাচীন পার্সিদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ হল ‘জেন্দ আবেস্তা’ যার সাথে বৈদিক সাহিত্য সম্ভারের প্রচুর সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়।তবে যেখানে ‘দেব’ শব্দটি বেদে অত্যন্ত পবিত্র সেখানে আবেস্তাতে ‘দেব’ শব্দতি নেতিবাচক অর্থ বহন করে এবং ‘অসুর’ সত্ত্বার প্রতি স্তুতি বর্ষিত হয়েছে।সর্বোপরি বৈদিক দেবতা বরুণের সম্বন্ধে আবেস্তা ঋণাত্বক মনোভাব প্রকাশ করেছে।সম্ভবত ইরানে প্রবেশের পর আর্যদের মধ্যে ধর্মীয় বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছিল,তাই একটি গোষ্ঠী ভারতে চলে এসে ইরানীয় আর্যদের বিপরীত এক ধর্মীয় ব্যবস্থা পত্তন করে।যদিও এই বিষয়টি এতটা সরল নয়।কারণ বেদে অনার্য মুণ্ডারী ও দ্রাবিড় ভাষার প্রায় তিনশোটি শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়।তাই অনেকেই মনে করেন আর্যরা ভারতীয় এবং ভারত থেকেই তারা সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল।জেন্দ আবেস্তা ও ঋগ্বেদের সময়কাল প্রায় একই হওয়ায় এই প্রশ্নের সমাধান বেশ কঠিন।

আর্যরা ভারতীয় না অভারতীয় সেই বিতর্কে ঐতিহাসিক মহলে নানা মুনির নানা মত।তবে সংখ্যাগরিষ্ঠই আর্যরা অভারতীয় এই মতে বিশ্বাসী।জ্যোতির্বিদ রাজেশ কোচাহার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ‘বেদাঙ্গ জ্যোতিষ’ গ্রন্থের বিশ্লেষণ করে দেখেছেন যে,এই গ্রন্থে সর্বদীর্ঘ দিন ও ক্ষুদ্রকালীন রাতের যে তথ্য রয়েছে,তার অনুপাত করলে হয় ৩ঃ২।এই প্রকার বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন অঞ্চলের সম্ভাব্য অবস্থান হতে পারে ৩৫ডিগ্রি উত্তর অক্ষরেখা।একমাত্র হরপ্পা সভ্যতার শোরটুগাই ছাড়া আর অন্য কোন অঞ্চল এত উচ্চ অক্ষরেখায় অবস্থিত নয়,সুতরাং সামগ্রিক ভাবে আর্যরা ভারতীয় হতে পারে না। আবার কলিন রেনফ্রিউ এর মতে,ঋগ্বেদে কোথাও বলা হয়নি যে আর্যরা বহিরাগত সুতরাং এটার সম্ভবনাই প্রবল যে আর্যরা বেদ রচনার বহু পূর্বেই ভারতে এসে বসতি স্থাপন করেছিল।কিন্তু আর্যরা অভারতীয় এই তত্ত্বটা সর্বজনগ্রাহ্য নয়, কারন এর পশ্চাতে বেশ কিছু যুক্তি আছে,যা অস্বীকার করার মত নয়।বেদে বার্চ গাছের উল্লেখ পাওয়া যায় আর এই গাছ আবার ককেশাস ও স্তেপ অঞ্চলের স্বাভাবিক উদ্ভিদ। অন্যদিকে নব্য প্রস্তর যুগীয় কাশ্মীরের একটি প্রত্নতাত্ত্বিক ক্ষেত্রের নাম হল বুর্জাহাম,যেখান থেকে যীশুর জন্মের পূর্ববর্তী প্রায় দু-হাজার পাঁচশো বছরের প্রাচীন বার্চ গাছের অবশেষ পাওয়া গেছে।সর্বোপরি আমুদরিয়া নদীর উচ্চ উপত্যকায় প্রাপ্ত ‘অক্সাস সভ্যতার’ সাথে হরপ্পার বস্তুগত সাযুজ্য লক্ষ্য করা যায়।ঐতিহাসিক অ্যাসকো পারপোলা, ভিক্টর সরিয়ানিধি এরা মনে করেন যে দু-হাজার খৃস্ট পূর্বাব্দে অক্সাসের বাসিন্দারা হল আর্য ও তারা মেহেরগড়ে বসতি স্থাপন করেছিল এবং এই মেহেরগড়-ই হরপ্পা সভ্যতার পটভূমি রচনা করেছিল।বিস্ময়কর ভাবে অক্সাস অঞ্চলে অশ্বের কোন অবশেষ পাওয়া যায় নি,কেবল মাত্র একটি মৃৎপাত্রে অশ্বের চিত্র পাওয়া গেছে।সুতরাং আর্য আর অশ্ব পরস্পরের সাথে কতখানি সম্পৃক্ত তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। ঋগ্বেদের ভাষ্যে দেখা যায় যে নদীগুলির নামোল্লেখ রয়েছে সেগুলি পূর্ব থেকে পশ্চিমে অর্থাৎ গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতী।তাই এই থেকে অনুমান করা যায় যে,আর্যরা পূর্ব থেকে পশ্চিমে গমন করে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল।তবে ভারত যদি আর্যদের আদি আদি বাসভূমি হয়,তাহলে ভারতের কোথায় তাদের বাসস্থান ছিল তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে।কেউ মনে করেন হিমালয়ের পাদদেশীয় অঞ্চল ও তিব্বত,আবার কারো মতে গঙ্গা-যমুনা উপত্যকা,আবার অনেকে মুলতান ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলকে আর্যদের বাসভূমি রূপে অভিহিত করেছেন।একই ভাবে আর্যরা যদি বহিরাগত হয়,তাহলে কোথায় তাদের বসতি ছিল তা নিয়েও ভিন্নতার অভাব নেই।কেউ দক্ষিন রাশিয়া ও ইউক্রেন,কেউ পামীর উপত্যকা আবার কেউ পোল্যান্ড ও ইউরেশিয়া অঞ্চলকে আর্যদের আদি বাসভূমি রপে বিবেচনা করেছেন।

আর্য বিতর্ক ইতিহাসের এমন এক অধ্যায় যা’র সঠিক সমাধানসূত্র নির্ণয় অত্যন্ত দুরহ,তবে অসম্ভব নয়।সর্বপ্রথম সীমাবদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি অতিক্রম করে এই সমস্যাকে আরও বৃহত্তর প্রেক্ষিতে যুক্তি-সংগতভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে।আর্যরা যে অভারতীয় এই বিষয়টি বেশ স্পষ্ট।সেক্ষেত্রে মধ্য এশিয়ায় এদের উৎস অনুসন্ধান করলে তা সফল হবে।আর্য সমস্যার সমাধানের সবচেয়ে কার্যকরী পদ্ধতি হল নিরবিছিন্ন অনুভূমিক উৎখনন,বিশেষত তুরস্ক,ইরান,ইরাক এই সকল অঞ্চলে আর্য সভ্যতার প্রচুর উপাদান এখনও লুক্কায়িত রয়েছে।এটা কোন কাল্পনিক অবতারনা নয়,সাম্প্রতিক কালে তুরস্কের গোবেকেলি টেপে অঞ্চলে আবিষ্কৃত প্রায় সাত হাজার বৎসরের প্রাচীন মন্দির ও ইউক্রেনে প্রাপ্ত স্বস্তিকা প্রতীক আর্য ইতিহাসকে এক নতুন আঙ্গিকে দেখার সুযোগ করে দিয়েছে।সর্বোপরি হরপ্পা সভ্যতায় আর্য প্রভাব খোঁজার প্রয়াস বৃথা।কারন বেদে ইন্দ্রকে ‘পুরন্দর’ রূপে অভিহিত করা হয়েছে,কারন তিনি ‘হরি-গুপয়’ এর যুদ্ধে পুর বা নগর ধ্বংস করেছিলেন;আর এই হরি-গুপয় হল হরপ্পা।হরপ্পার বেশ কিছু সাইটে প্রাপ্ত কঙ্কালগুলির আঘাত পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে অতর্কিত আক্রমণে এদের মৃত্যু হয়েছে।তাছাড়া অনেক জায়গায় কঙ্কালের স্তুপ পাওয়া গেছে,যা থেকে বোঝা যায় যে এগুলির রীতি মেনে সৎকার হয়নি।হরপ্পার পতনের পশ্চাতে যে বৈদেশিক আক্রমণকে দায়ী করা হয়,সেই আক্রমণকারীরা আর অন্য কেউ নয়,তারাই হল আর্য।সুতরাং আর্যরা বিদেশী এবং শুনতে খারাপ লাগলেও মেনে নিতেই হয় যে বৈদিক সভ্যতার জন্মদাতারা ভারতের সুপ্রাচীন নগরসভ্যতার নির্মম ধ্বংসকারী ছিল এবং তারা কোনদিনই নগর সভ্যতার নিরিখে প্রাচীন ভারতীয়দের সাথে পাল্লা দিতে পারেনি।

সায়ন দেবনাথ, এম ফিল, প্রথম বর্ষ
প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।