পৃথিবীর প্রতিটি শিশু মানুষ হয়ে জন্মায়। কোনো দিন কোনো শিশু ধার্মিক, দেশপ্রেমি, দেশদ্রোহী কিংবা কোনো পক্ষপাতী হয়ে জন্মায় না। জন্মের পর দেশের সংস্কৃতি একটি শিশুকে মানুষ থেকে ধার্মিক, জাতীয়তাবাদী, কিংবা পক্ষপাতী করে তোলে। জাতীয়তাবাদী বা দেশপ্রেমি হওয়া দোষের কিছু নয়। তবে উগ্র দেশপ্রেম ধর্মের মতই মারাত্মক। ধর্ম হল কল্পকাহিনী। দেশপ্রেম কোনো মূলা ঝুলানো কল্পকাহিনী নয়। একটি প্রবাহমান চেতনার নাম দেশপ্রেম। চেতনাকে বুকে লালন করতে হয়। বিপরীতে ধর্মকে বিশ্বাস করতে হয়। ধর্মপ্রেম পরো জগতে সুখে বিশ্বাসী, দেশপ্রেম বর্তমানে সুখের কথা বলে। ধর্ম ঈশ্বরের জন্য, দেশ মানুষের জন্য। দেশপ্রেমের সাথে থাকতে পারে প্রগতিশীলতা, ধর্মপ্রেমের সাথে থাকে প্রতিক্রিয়াশীলতা।

ধর্মতত্ত্ব আবদ্ধ হওয়ার কথা বলে। দেশত্ববোধ সৃষ্টির কথা বলে, মুক্তির কথা বলে। ধর্মের বাণী পরিবর্তনের কোন সুযোগ নেই, গণ্ডী সীমাবদ্ধ। যুগে যুগে ধর্মের বাণী পরিবর্তন না হলেও, একই বাণীর হাজার ব্যাখ্যা এসেছে। বস্তুত, ধর্ম হাজার বছর আগের পুরানো সংস্কৃতি। পুরানো বই পুরানো দিনের প্রগতিশীলতাকে ইঙ্গিত করে। তখনকার প্রগতিশীলতা এখনকার মধ্যযুগ। তবে ব্যক্তিগত ধর্মে বিশ্বাস কারো উপকার না করলেও তেমন অপকার করে না। কিন্তু রাষ্ট্রকাঠামো ধার্মিক হয়ে উঠলে দেশের প্রতিক্রিয়াশিল হয়ে উঠে। সমাজব্যবস্থা চলে যায় ধ্বংসের দিকে।

বাংলাদেশ আমার দেশ। এই দেশ স্বাধীন হয়েছে অসাম্প্রাদায়িকতার কথা বলে। তবে বর্তমান চিত্র, এই দেশে দেশপ্রেম চেতনা থেকে ধর্মীয় চেতনার মূল্য বেশি। এই দেশে এখন কে কতটুকু দেশপ্রেমিক, তার থেকে বড় প্রশ্ন কে কত বড় ধার্মিক! অবশ্যই ধার্মিক হওয়া দোষের কিছু নয়। তবে ধর্ম নিয়ে গোঁড়ামি দেখানোটাই দোষের। ধর্মান্ধ নিজের ধর্মের সমালোচনা সহ্য করতে পারে না। এক সময় সত্য ছিল, বাঙালার মানুষ ধার্মিক, ধর্মান্ধ নয়। বই পত্রে পেয়েছি আমাদের ধর্মীয় গোঁড়ামির ইতিহাসও তেমনটা ছিল না। তবে হিসেব মিলিয়ে দেখলে মনে হয় জাতি প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠছে। তাই বর্তমানে ধর্মের জন্য মানুষ হত্যা করে উল্লাস প্রকাশ করা হয়।

জাতে আমরা বাঙালি হলেও আমাদের ধর্মবোধ এসেছে আরব থেকে। সংস্কৃতি এসেছে সিন্ধুর পার থেকে। ফ্যাশন এসেছে পশ্চিমা থেকে। তাই এখন আমারা বোরকা অন্তরালে পাতলা ফিগারের চমৎকার দেহ চাই। একটু বাড়িয়ে বললে বলা যায়, বাঙালি এখন লিবারেলিজম চায়, ইসলাম চায়, ইংরেজি চায়, মাদ্রাসা চায়, সেক্সি নারী চায়, হেজাব চায়, সুদ চায়, ইসলামিক ব্যাংকিং চায়, ঘুষ চায়, হজ্ব চায়, গীতবিতান, কোরান শরীফ, হারমোনিয়াম, বোরাক, তবলা, কাবাঘর, শাহরুখ, মাধুরী, সালমানশাহ, এঞ্জেলানা জুলি, মক্কা, মুম্বাই, পিস টিভি, এমটিভি, এইচভিও, লাদেন, আমেরিকান গ্রীনকার্ডধারী মেয়ের জামাই সবই চায়। মোট কথা, ধর্ম এবং সংস্কৃতি মিল বন্ধনে এক আজব এক চিড়িয়ার নাম বাঙালি।

বাংলাদেশ এখনও সম্পূর্ণ প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠতে পারে নি। এই দেশের মানুষ আগে ছিল বাঙালি। মুক্তিযুদ্ধের পরে হয়েছে বাঙালি মুসলমান। এখন হতে চায় শুধুই মুসলমান। বাঙালি একাত্তরে যুদ্ধ করেছে জাতীয়তাবাদের চেতনা থেকে। এইভাবে চলতে থাকলে সামনে যুদ্ধ করবে ধর্মীয় চেতনা থেকে। দেশপ্রেম এবং ধর্ম দুটি’র সীমাবদ্ধতা আছে। দুটিই মনকে সংকীর্ণ করে দেয়। তবে সেই সীমাবদ্ধতা ধর্মের ক্ষেত্রে অনেকে বেশি। দেশপ্রেমের প্রধান সীমাবদ্ধতা নিজেকে কাঁটা তারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা। তবে দেশপ্রেম কখনই মাটির প্রতি, নদী-নালা, পাহাড়-পর্বতের প্রতি ভালবাসার মাঝে সীমাবদ্ধ হওয়া উচিৎ নয়। দেশপ্রেম হওয়া উচিৎ দেশের মানুষের প্রতি, লাঞ্ছিত, বঞ্চিত অবহেলিত গণ-মানুষের প্রতি ভালবাসার পাশপাশি, সমগ্র বিশ্বের মানুষের প্রতি আন্তরিকতা।

প্রতিটা মানুষই কোনো না কোনো দেশের নাগরিক। তবে ভালো মানুষ হওয়া এবং সুনাগরিক হওয়ার মধ্যে পার্থক্য আছে। অনেকেই বলে, ঈশ্বর আমাদের যেখানে জন্ম দিয়েছে সেখানে জন্ম নিয়েছি। আমাদের উচিত ঈশ্বর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো। বৌদ্ধ হিন্দুরাও একই দাবী করতে পারে- কর্মবাদের ফলে তাদের জন্ম বাঙলায়। একই দাবী করা সম্ভব একজন নাস্তিকদের ক্ষেত্রেও, বিবর্তনের পর্যায়ে আমাদের এখানে জন্ম হয়েছে, সুতরাং দেশপ্রেমের কিছুই নেই। আমি এখনও খুঁজে পাই না কোন ঈশ্বর আমায় বাঙলাতে জন্ম দিয়েছে, কিংবা বিবর্তনে কোন বানর আমার আত্মীয় ছিল। তবে এসব নিয়ে ভেবেও লাভ নেই। ধর্ম এবং দেশের মধ্যে তুলনা করতে চাইলে দেশ অবশ্যই উপরে। দেশপ্রেমই উত্তম প্রেম। ধর্মটা কোটি মানুষের ক্ষেত্রে কোটি রকম বিশ্বাস হতে পারে। কিন্তু জন্মভূমি একটি দেশের সকল মানুষের ক্ষেত্রে অভিন্ন। এই দেশ জন্ম থেকে স্বাভাবিক মৃত্যু’র আগ পর্যন্ত আমাকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব নিয়েছে।

আমাদের মৃত্যুর পর এই দেশে রেখে যাবো আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে। আমরা আমাদের পরিবারকে ভালোবাসি কারন পরিবার ছোট থেকেই আমাদের দায়িত্ব নেয়। পরিবারের মত সারা দেশের মানুষের দায়িত্ব নিয়েছে নিজের জন্মভূমি। নিজেদের মৌলিক অধিকারের সবটুকুই পূরণ করার সব চেষ্টা করছে আমাদের এই দেশটি। রাজনীতিবিদের ফল দেশ ধ্বংস হচ্ছে, কিন্তু তা তো আমার দেশের দোষ নয়। প্রতিটি মানুষের দেশপ্রেম থাকা উচিৎ, দেশকে ভালোবাসা উচিৎ। তবে তা কখনোই যেন উগ্র না হয়। উগ্র দেশপ্রেমিক জাতিবিদ্বেষি ছিল হিটলার। প্রতিটি মানুষ যদি একবার করে নিজের দেশ ভালোবাসার গুরুত্ব অনুভব করতে পারতো, তবে আজ আমাদের দেশটা থাকতো অন্য উচ্চতায় হয়তো পৃথিবীর সেরা দেশ হয়ে।