সব গানেই তো কিছু নিয়ম থাকে। সেই নিয়মগুলোকে একজন গায়ক/গায়িকা কতটুকু এদিক-সেদিক করতে পারেন ? নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে মুন্সিয়ানা চলে, কিন্তু নিয়ম ভেঙ্গে বেরিয়ে এলে, তখন একে নূতন নামে আখ্যা দিতে হয় । রবীন্দ্র সঙ্গীতের ক্ষেত্রে সে-রকমটি ঘটেনি। সুর পালটে দিয়েও , বলা দেয়া হচ্ছে রবীন্দ্র সঙ্গীত।
এই ধারা শুরু হয়েছে, রবীন্দ্র সঙ্গীতের উপর থেকে কপিরাইট উঠে যাবার পর। আগে যে, একটুখানি এদিক-সেদিক হয়নি , তা নয়। কিন্তু আমূল পালটে দিয়ে, একে রবীন্দ্র সঙ্গীত বলে চালিয়ে দেবার কথা কেউ ভাবতে পারত না তখন । যেহেতু কপিরাইট নেই, তাই পারছে । তা তারা করতেই পারেন । কিন্তু সুর পালটে দিয়ে; যে ধারা শুরু হয়ে গেছে, একে আর যে নামেই ডাকা হোক না কেন, রবীন্দ্র সঙ্গীত বলা যায় না। সুর পরিবর্তনকারীদের এইটুকু কাণ্ডজ্ঞান এখনও চোখে পড়েনি। তারা যা-নয়, তাকে তা-বানিয়ে দিয়ে; দিব্যি বলে যাচ্ছে , এই হল রবীন্দ্র সঙ্গীত । এ তো গেলে কাঠামোর কথা।
ভাবের কথা বলতে গেলে, আমার পক্ষে সবটুকু প্রকাশ করা সম্ভব নয়। খুব সংক্ষেপে, কোন একটি সমাজের মানস গঠনে, ঐ সমাজের নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক কাঠামোই নির্ধারক ভূমিকা পালন করে। পণ্য, প্রতিযোগিতা, ফাস্ট লাইফ –নামক নানা উৎপাতে সমাজে যে দ্রুতগতির সঞ্চার হয়, তা সামন্ত সমাজে অকল্পনীয় ; তার মানে এ-ও , সে-সমাজে শোষণ পীড়ন ছিল না। ছিল। প্রসঙ্গ সেটি নয়। ধীর গতির সে-জীবনের ছাপ পাই, ভাটিয়ালী, ভাওইয়া সহ নানা লোকগানে । এই ধীর লয় নিয়ে, পণ্যবাহী সমাজে টিকে থাকা দায়; তাই ধীর লয়কে পালটে দিয়ে, একে পণ্যবাহী সমাজের প্রতিযোগিতামূলক আচরণের আভরণে ঢেকে, দ্রুত-গতি দানের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে গায়ককূলের মাঝেও । পণ্যবাহী সমাজ ভাবের ধার ধারে না, তার দরকার চাকচিক্য; এই চাকচিক্যের উৎকট প্রকাশ দেখতে পাই, বলিউডের গানসহ , পাশ্চাত্য গানে । আর ভাববাহী সামন্ত সমাজের ভাবের ছবিটা আমরা দেখতে পাই, সে-সময়কার কথা, সুর ও গায়কীর ভেতর।
ভাবের কথা থাক।
সুর সামান্য পালটে দিয়ে গাইবার স্বাধীনতা চেয়েছিলেন, দিলীপ কুমার রায়।
রবীন্দ্রনাথকে অনুরোধ করেছিলেন, অন্তত একবার শুনে নিতে । রবীন্দ্রনাথ দিলীপ কুমারের কণ্ঠে গান শুনলেন। শুনে , বললেন, তুমি গেয়েছো ভাল, তবুও বলব গেয়ো না। ।
বাকী কথাগুলো আমার মনে নেই। একবার অনুমতি দিয়ে দিলে, এ ধারা কোথায় গিয়ে পৌঁছবে, তা ভেবেই হয়ত , রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আতংকিত হয়ে পড়েছিলেন।
ভাগ্যিস রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বেঁচে নেই ।
তাঁর ‘সঙ্গীতচিন্তা’ থেকে ।
“আমার গান যাতে আমার গান বলে মনে হয় এইটি তোমরা কোরো। আরো হাজারো গান হয়ত আছে – তাদের মাটি করে দাও না, আমার দুঃখ নেই । কিন্তু তোমাদের কাছে আমার মিনতি – তোমাদের গান যেন আমার গানের কাছাকাছি হয়, যেন শুনে আমিও আমার গান বলে চিনতে পারি । এখন এমন হয় যে, গান শুনে নিজের গান কিনা বুঝতে পারি না। মনে হয় কথাটা যেন আমার , সুরটা যেন নয়। নিজের মুখে রচনা করলুম, পরের মুখে নষ্ট হচ্ছে, এ যেন অসহ্য। ”
জানকিনাথ বসুকে লেখা চিঠিতে, “গায়কের কণ্ঠের উপর রচয়িতার জোর খাটে না, সুতরাং ধৈর্য ধরে থাকা ছাড়া অন্য পথ নেই। আজকাল অনেক রেডিয়োগায়কও অহংকার করে বলে থাকেন, তাঁরা আমার গানের উন্নতি করে থাকেন। মনে মনে বলি, পরের গানের উন্নতি সাধনে প্রতিভা অপব্যয় না করে নিজের গানের রচনায় মন দিলে তাঁরা ধন্য হতে পারেন। সংসারে যদি উপদ্রপ করতেই হয় তবে হিটলার প্রভৃতির ন্যায় নিজের নামের জোরে করাই ভালো । ”
সেই তিনিই আবার সর্ব সাধারণের কথা বিবেচনায় রেখে বলেছেন, ” সকলেই আমার গান করুক, আমার গান সকলের জন্য, না গাইলে আমার মন আরো হাজারো গান হয়ত য়আছে – তাদের মাটি করে দাও না, আমার দুঃখ নেই। খারাপ করে । গান ঘরের মধ্যে মাধুরী পাওয়ার জন্য, বাইরের মধ্যে হাততালি পাবার জন্যে নয়। ওস্তাদ যাঁরা তাঁদের জন্য ভাবনা নেই; ভাবনা হচ্ছে যারা গানকে সাদাসিধে মনের আনন্দের জন্য পেতে চায় তাদের জন্য। যেমন তোমাদের টি-পার্টি যাকে বলে, সেখানে যারা সাহেবি মেজাজের লোক তাদের কানে কি ভালো লাগবে ? এখানে রবীন্দ্র হালকা গান, সহজ সুর, হয়ত ভাল লাগবে । তাই বলি আমার গান যদি শিখতে চাও, নিরালায়, স্বগত, নাওয়ার ঘরে, কিংবা এমনি সব জায়গায় গলা ছেড়ে গাইবে। আমার আকাঙ্খার দৌড় এই পর্যন্ত – এর বেশী ambition মনে নাই বা রাখলে।”

শিল্পী হিসাবে ,একজন শিল্পীর আবেদন মনে রাখা যায় কি না, ভেবে দেখতে পারেন রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পীগণ।

( #Sneha Bhattacharjee Swarna এর স্ট্যাটাস থেকে রবীন্দ্রনাথের ‘রঙ্গীত চিন্তা’ বিষয়ক উদ্ধৃতিগুলো নেয়া হয়েছে )