“তাহমিনা” তোমার আত্মপ্রত্যয় জয় করুক দগ্ধ জীবনের ভয়াবহ যন্ত্রণা—-

গত ৮ মার্চ ছিল আন্তর্জাতিক নারী দিবস। সকালে নারায়ণগঞ্জের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রফিউর রাব্বীর বড় ছেলে তানভীর ইসলাম ত্বকীর মৃত্যুর খবর শুনে ভীষণ বিপর্যস্ত ছিলাম। সেদিনই এসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশন (এএসএফ) এর আমন্ত্রণে মশাল মিছিলে অংশগ্রহণের জন্য বিকাল ৫টায় আসাদ গেইট সংলগ্ন প্রধান সড়কে গেলাম। সেখানে গিয়ে অনেক এসিড সারভাইভারদের সাথে দেখা হয়ে গেল। পেছনে ফেলে আসা এএসএফ-এর সাথে সেই চলার দিনগুলোর কথা খুব মনে পড়ছিল। সাধারণত পুরুষরাই সামাজিক এবং পারিবারিক শক্তিবলেও তারা সহিংস হিসেবে নিজেদের গড়ে তোলে নিজের অজান্তেই। পেশীশক্তির বলে নারীর প্রতি নির্যাতন করে। ২০০২ সাল থেকেই এএসএফ পুরুষ সমাবেশের আয়োজন করত নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধের একটি রোল মডেল হিসেবে। দীর্ঘ একযুগের এই কর্মকা-, সচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রচারের মাধ্যমে এসিড সহিংসতা এখন আমাদের দেশে অনেকটা প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে।

এবারে দিবসটি উদযাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সম্মিলিতভাবে, সাথে আছে অনেক দাতা সংস্থা ও উন্নয়ন সংগঠন। আমি এএসএফ-এর প্রাক্তন সহকর্মী। তাই সারভাইভারদের সাথে ব্যানার হাতে মানব বন্ধনে দাঁড়িয়ে গেলাম। শ্লোগান চলছিল আমাদের এক অঙ্গীকার / নারী নির্যাতন নয় আর। শাহবাগেও গণজাগরণ মঞ্চে চলছিল সেদিন নারী ও দেশ জাগরণের শ্লোগান। একটু পরেই মশাল চলে আসল, ভেতরের আগুন আরো জ্বলে উঠল মশাল হাতে নেবার পর। কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারলাম, আমি নিরাপদ নই। শুকনা বাঁশের তৈরি কাঠামো এবং ভেতরে তরল দাহ্য পদার্থ (সম্ভবত: কেরোসিন অথবা ডিজেল জাতীয় পদার্থ হতে পারে) থাকায় আগুনের সংস্পর্শে মুহুর্তেই কয়েকটিতে আগুন ধরে উঠল। দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার আগেই আমি খুব সাবধানতার সাথে তা নিভিয়ে ফেললাম। এরই মধ্যে হৈ-চৈ, শুনলাম মশাল থেকে একজনের গায়ে আগুন লেগে গিয়েছে। একটু আগেই আমার পাশ থেকে দুইজন সারভাইভার রুনা আর তাহমনিা দৌড়ে গিয়েছে মশাল হাতে নেবে বলে! তারপরই এএসএফ-এর কর্মীদের পানির বালতি নিয়ে ছুটে যাওয়া দেখে বুঝার বাকী রইল না সে একজন এসিড সারভাইভার, দৌড়ে গিয়ে দেখি তাহমিনার গায়ে আগুন লেগেছিল, সে রাস্তাায় অর্ধদগ্ধ অবস্থায় গুটিসুটি অবস্থায় বসে কাঁপছে; এএসএফ-এর কর্মীরা তাৎক্ষণিক পানি ঢালছে; মুহুর্তের জন্য হলেও নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না!

উল্লেখ্য তাহমিনার শরীর এসিডে মারাত্মকভাবে দগ্ধ। আর দুর্ভাগ্য হল একযুগেরও আগে তার এক সহকর্মীর প্রেমিক রাতের আঁধারে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে প্রেমিকাকে এসিড নিক্ষেপ করে। কিন্তু এসিডটা লাগে একই রিক্সায় পাশে বসে থাকা তাহমিনার গায়ে। যার ভয়াবহতা তাহমিনাকে আজও বয়ে বেড়াতে হচ্ছে! তার দেহে কম করে হলেও দশবার অস্ত্রপচার করা হয়েছে; শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে চামড়া এনে মুখাবয়ব ফিরিয়ে আনার অসাধ্য সাধনা করেছেন দেশী-বিদেশী প্লাস্টিক সার্জনরা। প্রথম সাক্ষাৎকারে সে বলেছিল এক-একটি অপারেশন এক-একটি মৃত্যুযন্ত্রণা। সেই যন্ত্রণাকে জয় করে তাহমিনা সারভাইভার হয়ে এএসএফ-এর পুনর্বাসন বিভাগে অন্য সারভাইভারদের সেবায় কাজ করে যাচ্ছে। বিয়ে করে সুখে সংসার করা না হলেও ওর একটি ফুটফুটে ছেলে আছে, নাম “বিন্দু”।

তাহমিনার গায়ে পানি ঢালা হচ্ছে অনবরত কিন্তু সামান্য সময়ের আগুনের লেলিহান শিখা আবারও ওর অনেক ক্ষতি করে ফেলল। ওর মুখ, গলা, বুক থেকে চামড়া খসে খসে পড়ছিল। একবারের জন্য আর্তনাদ না করে সে শুধু বলে যাচ্ছিল আমাকে আরো পানি দাও; কারণ সে জানে এসিডদগ্ধ হবার পর তাৎক্ষণিক পানি না ঢালায় তার অপুরণীয় ক্ষতি হয়েছে। আর এক মুহুর্ত দেরী না করে তাহমিনাকে গাড়িতে উঠানো হল এএসএফ-এর হাসপাতালে জরুরীভিত্তিতে চিকিৎসা দেবার জন্য। তাহমনিাকে নিয়ে গাড়ি চলে যাচ্ছে আর এএসএফ-এর সকল নারী কর্মীরা চিৎকার করে কাঁদছে আর বলছে: তাহমিনার গায়ে কেন আগুন লাগল; ওর এসিডদগ্ধ শরীরেতো কোনো জায়গা নেই; এই আগুন কেন আমাদের শরীরে লাগল না। একটা ইস্যুকে এগিয়ে নেয়ার জন্য কতটা সহমর্মী হলে সহকর্মীরা এতটা আবেগপ্রবণ হতে পারে! আমি গর্বিত বোধ করলাম তাদের জন্য।

সবচেয়ে অবাক হলাম অন্যান্য আয়োজক সংস্থাগুলো বিষয়টাকে আমলে নিল না। একে তো অন্যায় করা হয়েছে কোনো বিবেচনা না করে এই ধরনের মশাল হাতে তুলে দিয়ে। তার উপর কোনো দায়িত্ব পালন না করে বলা হল: “আপনারা কেউ ভয় পাবেন না এবং শঙ্কিত হবেন না; মশাল থেকে একজনের গায়ে আগুন লাগলেও তা নিভিয়ে ফেলা হয়েছে। এখনই মশাল মিছিল শুরু হবে।” এবং তারা চলে গেলেন নির্বিকারচিত্তে সেই মশালগুলো হাতে নিয়ে শ্লোগান করতে করতে; তাদের সাথে চলে গেলেন সকল গণমাধ্যমকর্মীরাও। অনেক চেনা মুখ ছিল সেখানে, তাদের কোনো উদ্যোগই দেখা গেল না তাহমিনাকে রক্ষার। মশাল মিছিল চলে গেলে একটি ছেলে এসে আমাকে মোবাইলে তুলে রাখা সেই ফুটেজটি দেখালো। দেখে আরো বিস্মিত হলাম, কী অবলিলাক্রমে মশালের দাহ্য পাত্রটি আরেকজন অসতর্ক নারী ফেলে দিচ্ছেন একজন এসিড সারভাইভারের গায়ে। আবারও তাহমিনা দুর্ভাগ্যের শিকার; অন্যের অসাবধানতা আর আয়োজকদের অবহেলার জন্য আবার দগ্ধ জীবনের যস্ত্রণা! নারী দিবসে এসে এমন অন্যায়, অবজ্ঞা আর অবহেলা দেখবো তা ভাবিনি। যদি হয় এই ধরণের আয়োজন শুধুমাত্র প্রতিযোগিতামূলক প্রচারের জন্য; তবে তা মানবতা বিরোধী।

তাহমিনা এক কঠিন সময় কাটাচ্ছে হাসপাতালে শুয়ে। দ্বিতীয়বার দুর্ঘটনার শিকার ও দগ্ধ হয়ে তাহমনিা প্রথমে খুব ভেঙ্গে পড়লেও অনেকটা সামলে নিয়েছে নিজেকে। ওর আবার অপারেশন হয়েছে: মুখে, ঘাড়ে, হাতে ও বুকে। যেনো ইনফেকশন না হয়; তাই আমাদের প্রত্যাশা। তোমার পক্ষ থেকে আমার প্রতিবাদ এই ধরনের নারী আন্দোলনের প্রতি যা আমাদের এক কদম এগিয়ে দশ কদম পিছিয়ে দিচ্ছে পুরুষশাসিত সমাজের কাছে যা আমাদের একদমই কাম্য নয়। তাহমনিা তোমার জন্য আমাদের সর্বাঙ্গীন শুভকামণা। তুমি এবারও নিশ্চই তোমার দগ্ধ জীবন ও অপার বেদনাকে জয় করতে পারবে।।

রচনাকাল এপ্রিল ২০১৩

খালেদা ইয়াসমিন ইতি
ডিসকাশন প্রজেক্ট