অনেকের মত আমি সালমান রুশদিকে শুধুই একজন “ইসলামবিরোধী ষড়যন্ত্রী” হিসেবে চিনতাম। ইসলাম ধ্বংস করার জন্য যেই কথিত লৌকিক-পারলৌকিক শক্তিগুলা অহোরাত্রি খাটা-খাটুনি করে যাচ্ছে, তাদের মধ্যে সালমান রুশদির নামটা অবধারিতভাবেই ঢুকে যায়। অন্তত মসজিদের ইমাম আর আশেপাশের মুরুব্বিদের মত “গণ্যমান্য” হিশেবে স্বীকৃত ব্যক্তিত্বদের বয়ান থেকে তাই শিখেছিলাম। যেই বইটা পুড়িয়ে ও যাকে কেন্দ্র করে ফতোয়াবাজি করে ইসলামিস্টরা গোটা বিশ্বের সামনে তাদের কদাকার চেহারা তুলে ধরেছিল, স্বভাবতঃই সেই বইটার প্রতি আমার কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছিল। সাহিত্যের আনাড়ি পাঠক হওয়ার কারণে সব কনটেক্সট-সাবটেক্সট গলাধঃকরণ করতে পেরেছি বলে মনে হয় না, তবে অন্তত এটুকু বুঝেছি যে ইসলামিস্টরা বইটির সম্পূর্ণ ভুল চিত্র তুলে ধরেছে, বইটি নিয়ে ভীষণ নোংরা রাজনীতি হয়েছে। বইটি নিয়ে রুশদির “In Good Faith” প্রবন্ধটি অনুবাদ করার ইচ্ছা ছিল, তবে আমার অনুবাদপ্রচেষ্টায় লেখকের কন্ঠ চাপা পড়ে যাচ্ছে দেখে শেষমেষ নিজের মত করেই প্রবন্ধটা লিখে ফেললাম।

The Satanic Verses বইটা আসলে কী, এই প্রশ্ন একেকজনের কাছে করলে একেকরকম উত্তর পাবেন। কেউ বলে ভ্রান্ত ইতিহাস, কেউ বলে ধর্মবিরোধী পুস্তিকা, কেউ মনে করে একটি পুঁজিবাদী-ইহুদি চক্রান্ত, কারও কারও কাছে এই বইটা হলোকস্টের চেয়ে কোন অংশে কম জেনোসাইডাল নয়। রুশদির কাছে এটি কেবলই একটি উপন্যাস, একজন লেখকের কল্পনার সৃষ্টি। উপন্যাসকে অবশ্য হেলাফেলা করার কিছু নেই। পাঠের যোগ্য উপন্যাস মাত্রই ভাষা, রুপ ও ভাবনাকে ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপন করে, ইংরেজি novel শব্দটি যেন জগতকে নতুন দৃষ্টিতে দেখার উপরই গুরুত্ব আরোপ করে। রুশদি তাঁর সমগ্র লেখক জীবনে সাহিত্যের একটি ভাষা সৃষ্টি করতে চেয়েছেন, সাহিত্যের এমন একটি রুপ যার মাধ্যমে প্রাক্তন উপনিবেশের বাসিন্দারা পূর্নরুপে আত্মপ্রকাশ করতে সমর্থ হবে। স্যাটানিক ভার্সেস যদি কিছু হয়ে থাকে, তবে সেটি হল একজন পরিযায়কের জগতদর্শন, রুশদির ভাষায় a migrant’s-eye view of the world। মূলোৎপাটন, বিচ্ছেদ, রুপান্তর- অভিপ্রয়াণের এই অভিজ্ঞতাকে সম্বল করেই রুশদি উপন্যাসটি লিখেছিলেন। সবাই হয়ত সশরীরে পাসপোর্ট হাতে বর্ডার পার হয় না, তবে ব্যক্তি জীবনে কোন না কোন বর্ডার কমবেশি সবাইকেই অতিক্রম করতে হয়। যৌবন অতিক্রমে করে মধ্যবয়সে পৌছুনোর বেদনাদায়ক যাত্রায় সবাইকেই অংশ নিতে হয়। অভিপ্রয়াণ একটা খুবই লোভনীয় উপমা, যেকোন প্রসঙ্গে যেকোন ব্যক্তির উপর একে প্রয়োগ করা যায়।

উপন্যাসের মূল চরিত্রগুলো ব্রিটিশ মুসলমান, তবে ধার্মিক মুসলমান না। প্রান্তিক এই জনগোষ্ঠীকে সঙ্করীকরণের বিরুদ্ধে লড়তে হয়, তারা পুরাতন ও নুতনের দ্বন্দ্বে ধরাশায়ী হয়। উপন্যাসটির কট্টর সমালোচকরা মনে করেন ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের সাথে মেলামেশা নিজের সংস্কৃতি ধ্বংসেরই নামান্তর। অন্যদিকে স্যাটানিক ভার্সেস সঙ্করতা, তথাকথিত আপজাত্য, সংমিশ্রণ, এবং এসব কিছু থেকে উদ্ভূত নতুন সংস্কৃতি, রাজনীতি, চেতনা, চলচ্চিত্র ও সঙ্গীতকে উদযাপন করে। বইটা সঙ্করীকরণকে উপভোগ করে, পরমকে ভয় করে। এখান থেকে কিছু আর ওখান থেকে কিছু নিয়েই তো দুনিয়াতে নতুন কিছু একটা আসে। রুশদি গণঅভিপ্রয়াণের মাধ্যমে উত্থাপিত এই সম্ভাবনাকে আলিঙ্গন করেন। স্যাটানিক ভার্সেস সঙ্করীকরণের মাধ্যমে পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখে, বইটি সব সঙ্করদের প্রতি নিবেদিত একটি প্রেমগীতি। সব প্রশ্নের উত্তর জানার দাবিদার পরমের শিষ্যরা সঙ্কর জনসাধারণের মাঝে ত্রাস সৃষ্টি করেছে ইতিহাসের পাতায় পাতায়, অস্বীকার করতে চেয়েছে এই সহজ সত্য যে প্রত্যেকটি মানুষ ইতিহাসের জারজ সন্তান। সাদা, কালো, বাদামি একজন আরেকজনের ভেতর প্রবিষ্ট হচ্ছে, যেভাবে নানা পদের মশলা মিশে সৃজন হয় নতুন কোন অমৃত। রুশদি মনে করেন- খাঁটি আর ভেজালের এই প্রাচীন বিরোধ অব্যাহত থাকুক। মানুষ সবসময় নিজেকে এভাবেই বুঝেছে- কোন মানুষ, মূর্তি বা ভাবমূর্তির সামনে প্রণত হয়ে নয়।

রুশদি চেষ্টা করেছিলেন একটি প্রতিবাদী কর্ম সৃষ্টি করতে, যা পাঠকের পূর্বনির্মিত জগতচিত্রকে সংস্কার করবে। এই বইয়ে এমন কিছু নেই যার জন্য রাস্তায় নামতে হবে। মোল্লারা যেই বই নিয়ে বিলাপ করেছিল, ওই বইয়ের অস্তিত্ব নাই। এই বইটা নিয়ে যে ক্যাচাল হয়েছে, সেই ক্যাচালকে রুশদি প্রাচ্য আর পশ্চিমের স্বাধীনতার সংঘাত বলে মনে করেন না(যেমনটা অনেকে পরবর্তীতে দাবি করেছেন), কারণ তার পরিযায়ী অভিজ্ঞতায় তিনি দেখেছেন যে পৃথিবীর সব প্রান্তের মানুষই স্বাধীনতার প্রতি সমানভাবে আসক্ত। নিজেকে স্বাধীন ধরে নিয়েই তিনি স্যাটানিক ভার্সেস লিখতে বসেছিলেন।

মতপ্রকাশের স্বাধীনতাটা আসলে কী? এটা যাই হোক, আঘাত করার স্বাধীনতা না থাকলে এর কোন অস্তিত্বই নাই। সামাজিক-রাজনৈতিক-ধর্মীয় নৈষ্ঠিকতাকে ব্যঙ্গ করতে না পারলে আর্ট টিকবে না, আর্ট না টিকলে নিজেদেরকে “মানুষ” মনে করার একটা যুক্তি গায়েব হয়ে যাবে। স্যাটানিক ভার্সেসের একাংশ একজন ধর্মহীন ব্যক্তির সাথে ধর্মবিশ্বাসের মোলাকাতকে তুলে ধরে। বইটি সর্বাঙ্গে বিশ্বাসের প্রতি বৈরী নয়। এই বইয়েরই একটি ভারতীয় চরিত্র প্রশ্ন করছে, “আমরা যদি প্রথমেই কোন বিশ্বাসকে ভুল ধরে লেখালেখি করি, তবে কি আমরা উন্নাসিকতার দোষে দুষ্ট নই? আমরা কি সাধারণের উপর নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গী চাপিয়ে দিচ্ছি না?”। তবে উপন্যাসটিতে কিছু সংশয়ও আছে, উপন্যাসটি কিছু প্রশ্ন তুলে ধরে যা ধার্মিকদের পছন্দ হবে না। কিন্তু এই ব্যাপারটা খোদ ইসলামী সাহিত্যেই প্রাচীন আমল থেকে প্রচলিত আছে, স্যাটানিক ভার্সেস এদিক দিয়ে অভিনব না।

উপন্যাসটা কিসের প্রতিবাদ করছে? ধর্মবিশ্বাসের অধিকার তো নয়ই। এই গল্প সব ধরণের নৈষ্ঠিকতা ও পরম দাবির বিরোধী। হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার দরকার নাই, বিমান উড়িয়ে দেওয়া শিখ সন্ত্রাসেরও দরকার নাই, হাস্যকর খৃষ্টীয় সৃষ্টিবাদের দরকার নাই, ইসলামের সংকীর্ণ সংজ্ঞারও কোন দরকার নাই। এই প্রতিবাদ আর যাই হোক, খিস্তিখেউড় না। মুসলমানদের এসবে সমস্যা নেই, তাদের সমস্যা হল “রুশদি নবী মোহাম্মদকে সমকামী কইছে”, “রুশদি বলছে যে নবীজি আল্লাহর কাছে ব্যভিচারের অনুমতি চাইছে”, “রুশদি নবীজির স্ত্রীদেরকে বেশ্যা বলছে”, “রুশদি কোরানকে শয়তানের কর্ম বলছে” প্রভৃতি দাবি। এই দাবিগুলার চেয়েও বেশি বিস্ময়কর হল যে এই দাবিগুলো বারবার পুনরাবৃত্তির কারণে সত্যের মর্যাদা পেয়ে গিয়েছে, বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ বইটা না পড়েই বই আর বইয়ের লেখককে গালাগালি করেছে এবং করছে।

স্যাটানিক ভার্সেস দু’টি বিভাজিত সত্ত্বার গল্প। একটি সত্ত্বা হল সালাদিন চামচা, তার ক্ষেত্রে বিভাজনটা সেকুলার ও সামাজিক; সালাদিন বোম্বে ও লন্ডন, প্রাচ্য ও পশ্চিমের টানাপোড়েনের শিকার। অন্যদিকে জিব্রিল ফারিশতার ক্ষেত্রে বিভাজনটি আধ্যাত্মিক; বিশ্বাস হারিয়েও জিব্রিল বিশ্বাস করতে চায়, কিন্তু বিশ্বাস তাকে দেখা দেয় না। এই দু’টি বিভাজিত সত্ত্বার দ্বান্দ্বিকতা ও একাগ্রতা অর্জনের অভিযাত্রাই এই উপন্যাসের আধেয়।

কেন “জিব্রিল ফারিশতা”? “আসল” জিব্রিল ফেরেস্তাকে হেয় করার জন্যই কি এই নাম বেছে নেওয়া হয়েছে?

নাহ। উপন্যাসের জিব্রিল একজন চলচ্চিত্র অভিনেতা। আর দশটা কুশীলব ও ফেরেস্তার মতই উপন্যাসের জিব্রিল আমপাবলিকের মাথার উপরে বসবাস করে, সে অর্ধেক দেবতা আর অর্ধেক মানুষ, সে জীবনের চেয়েও বড়। এই চরিত্রকে একজন ফেরেস্তার নাম দেওয়ার মানে হল তাকে ফেরেস্তাদের আধা-ঐশ্বরিকতার সেকুলার প্রতিমূর্তি প্রদান করা। তবে জিব্রিল যখন বিশ্বাস হারায়, এই নাম তখন তাকে তাড়া করে বেড়ায়।

এই গল্পে চামচা টিকে থাকে। সে প্রেম ও মরণের মত শাশ্বত সত্যকে গ্রহণ করতে সমর্থ হয়, সে পরিশেষে তার শেকড়ে ফিরে এসে একাগ্রতা অর্জন করে। জিব্রিল টিকতে পারে না। সে ইশ্বরের প্রতি ভালবাসা ফিরে পায় না, ইশ্বরপ্রেমকে সে ঐহিক প্রেম দিয়েও প্রতিস্থাপন করতে পারে না, জিব্রিল নির্ধারিত সময়ের আগেই তার জীবনের উপসংহার লিখে ফেলতে বাধ্য হয়।

জিব্রিলের যাতনাগুলো তার কাছে স্বপ্নের রূপে আবির্ভুত হয়। এই স্বপ্নগুলোতে সে নিজেকে সত্যকারের জিব্রিল ফেরেস্তার রুপে আবিস্কার করে, বিভিন্ন ধর্মীয় ন্যারেটিভের সে প্রত্যক্ষ সাক্ষ্মী হয় এবং সেগুলোতে সে অনিচ্ছায় অংশগ্রহনও করে। এই স্বপ্নগুলো অবশ্য পুরোপুরি সংশয়ী মনোভাবের না। একটা স্বপ্নে সে নিজেকে মির্জা সাইদ আকবর নামক এক জমিদারের দেহে আবিস্কার করে। এই জমিদারের গ্রামে হঠাত একদিন একটি রহসময়ী বালিকা আবির্ভূত হয়, সে গ্রামবাসীকে তার সাথে পদব্রজে মক্কায় যাত্রা করার আহবান জানায়, তাদের জন্য আরব সাগর পথ ছেড়ে দাঁড়াবে। পুরো গ্রামবাসী মেয়েটির পেছনে যাত্রা শুরু করে, তাদের সাথে যোগ দেয় জমিদারের ধর্মপরায়ণ, প্রিয়তমা স্ত্রী। জমিদার এই কাফেলার পিছু নেন। তিনি এসব অলৌকিকতায় বিশ্বাস করেন না, নিজের চোখেই তিনি দেখেন তাঁর স্ত্রীসহ গোটা গ্রাম আরব সাগরে ডুবে যাচ্ছে। তবে বহুকাল পরে তিনি বিশ্বাস ফিরে পান। মরণের আগ মুহুর্তে ইশ্বর তাঁকে দেখান যে সেদিন আরব সাগর ঠিকই দু’ভাগ হয়েছিল, তার স্ত্রী ঠিকই সেদিন ইশ্বরের রাজ্যে প্রবেশ করেছিল, সংশয়ের পর্দা ভেদ করে মির্জা সাইদ আকবর এই অলৌকিক পরিণতি অবলোকন করতে পারেননি। জিব্রিলের সবগুলো স্বপ্নই বিশ্বাস ও সংশয়ের মধ্যকার অস্থিরতাটা তুলে ধরে।

জিব্রিলের যে স্বপ্নগুলো নিয়ে গোটা বিশ্বের মুসলিম সমাজে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল, সেই স্বপ্নগুলো জিব্রিলের জন্য সবচেয়ে বেদনাদায়ক ছিল। স্বপ্নগুলোতে জিব্রিল “জাহিলিয়া” নামক এক মায়াবী বালুকা নগরীতে “সাবমিশন” নামক এক ধর্মের উত্থান পর্যবেক্ষণ করে। স্যাটানিক ভার্সেস বইটা নিয়ে যাবতীয় কুৎসা ও আপত্তি এই স্বপ্নগুলোর অধ্যায় থেকেই নেওয়া হয়েছে।

এই স্বপ্নগুলো স্বপ্নদ্রষ্টার জন্য ভয়াবহরকম বেদনাদায়ক ছিল। প্রতিটি রাতে এই স্বপ্নগুলো তাকে তার বিশ্বাসহীনতার জন্য শাস্তি দিত, বিশ্বাস ফিরে পাওয়ার তার প্রাণান্ত প্রচেষ্টার মাঝে তার উপরে সংশয়ের গুরুবোঝা চাপিয়ে দিত। ঘুমের মধ্যে জিব্রিল প্রাণপণে চেষ্টা করত স্বপ্নগুলো হতে মুক্ত হওয়ার জন্য, কিন্তু স্বপ্নগুলো এক সময় সজাগ দুনিয়াতেও জিব্রিলকে গ্রাস করল, জিব্রিল বদ্ধোন্মাদ হয়ে গেল। মক্কা শরিফকে ভেংচি কাটার জন্য এই স্বপ্নের শহরকে “জাহিলিয়া” নাম দেওয়া হয়নি, বরং জিব্রিলকে ওই শহরে জোরপূর্বক পাঠিয়ে তার মানসিক অবস্থা বোঝানোর জন্যই এই নাম ব্যবহার করা। স্বপ্নের এই দৃশ্যগুলোর প্রাথমিক উদ্দেশ্য হল মানবজীবনের উপর ইশ্বরহীনতার বিপর্যয়কর প্রভাবকে তুলে ধরা, ইসলামকে “ভুল” প্রমাণ করা নয়।

এই দৃষ্টিতে “আপত্তিকর” অধ্যায়গুলো দেখলে বাকি জিনিসগুলো নিজ থেকেই পরিস্কার হয়ে যায়। বইটির শিরোনাম “স্যাটানিক ভার্সেস” ইসলামের ইতিহাসের একটি বিতর্কিত অধ্যায়কে ইঙ্গিত করে। বলা হয়ে থাকে যে মোহাম্মদ মক্কার কুরাইশ গোত্রের নেতাদের সাথে একটা বোঝাপড়ায় এসেছিলেন যে মোহাম্মদ কুরাইশদের তিনটি নারী দেবতাকে স্বীকৃতি দিয়ে কোরানের আয়াত নাযিল করালে কুরাইশরা মোহাম্মদের আল্লাহর উপাসনা করবে এবং মুসলমানদের সাথে মক্কায় শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করবে। কিন্তু কুরাইশরা তাদের কথা রাখেনি, তাই মোহাম্মদ পরে শয়তান দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার দাবি করে ওই আয়াতগুলোকে কোরান থেকে বাতিল করে দেন, এর জন্য এর নাম “স্যাটানিক ভার্সেস”। জিব্রিলের সবচেয়ে পীড়াদায়ক স্বপ্নগুলার জন্য রুশদি এই ঘটনাকে বেছে নিয়েছেন কারণ বিশ্বাস ও সংশয়ের দ্বন্দ্বের চরম পরিণতি লেখকের পক্ষে এই ঘটনাটার মাধ্যমেই সবচেয়ে ভালভাবে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব। জিব্রিলের স্বপ্নের এই দৃশ্যগুলোতে পাঠক মোহাম্মদের চরিত্রে “মাহুন্ড”(Mahound) নামক এক চরিত্রকে দেখতে পান, উল্লেখ্য যে সেই সময়কার খৃষ্টানরা অবমাননার উদ্দেশ্যে মোহাম্মদকে এই নামে অভিহিত করত। মাহুন্ডের কর্মকান্ডের প্রতি সংশয় প্রকাশ করে “সালমান দ্যা পারসিয়ান” নামক এক চরিত্র, যার দায়িত্ব ছিল মাহুন্ডের উপর নাযিলকৃত আয়াতগুলো নথিভুক্ত করা। এই চরিত্রটি সাহাবী সালমান-আল ফারিসিকে হেয় করার জন্য সৃষ্টি করা হয়নি, বরং উপন্যাসে রুশদির সরাসরি প্রতিনিধি হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে। রুশদি স্বীকার করছেন যে এই সালমানের মুখ দিয়ে বের হওয়া কথাগুলো অনেক পাঠকের কাছেই কর্কশ মনে হবে, কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে যেই জিব্রিলের স্বপ্নে এই দুর্মুখ ব্যক্তি আবির্ভূত হয়েছে, সেই জিব্রিল নিজেও একজন দুর্মুখ ব্যক্তি, মনযোগী পাঠক মাত্রই তা খেয়াল করবেন। আরেকটা কথা মনে রাখতে হবে যে জিব্রিল তার উন্মাদনার শেষ পর্যায়ে এই স্বপ্নগুলো দেখছে যখন তার জীবনের নিশ্চয়তাগুলো সব একে একে ভেঙে পড়েছে। এই স্বপ্নগুলো তার বাতুলতাকে পরিপূর্ণ করেছে।

তবে রুশদি স্বীকার করেন যে মক্কাবাসীর ওই তিন নারী দেবতাকে মাহুন্ড দ্বারা প্রত্যাখিত হওয়ার মাধ্যমে নারীর প্রতি ইসলামের মনোভাবকেও তিনি খোঁটা দিয়েছেন। এ সংক্রান্ত আয়াতগুলো কোরানে এখনও আছে,

‘Have ye seen Lat and ‘Uzza,
And another, the third (goddess), Manat?
What! for you the male sex, and for Him, the female?
Behold, such would be indeed a division most unfair!” [Qur’an 53:19-22]

সূরা আন-নাজম শুরু থেকে পড়লে প্রেক্ষাপটটা বুঝতে সুবিধা হবে।

আবার জিব্রিলের স্বপ্নের মধ্যেই সালমান দ্যা পারসিয়ান “সাবমিশন” ধর্মের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন যে এই ধর্মটা মানুষের জীবনের প্রত্যেকটি অংশের উপর নিজের আইন চাপিয়ে দিচ্ছে,

“At the oasis of Yathrib the followers of the new faith of Submission found themselves landless, and therefore poor. For many years they financed themselves by acts of brigandage, attacking the rich camel-trains on their way to and from Jahilia. Mahound had no time for scruples, Salman told Baal, no qualms about ends and means. The faithful lived by lawlessness, but in those years Mahound – or should one say the Archangel Gibreel? – should one say Al-Lah? – became obsessed by law. Amid the palm-trees of the oasis Gibreel appeared to the Prophet and found himself spouting rules, rules, rules, until the faithful could scarcely bear the prospect of any more revelation, Salman said, rules about every damn thing, if a man farts let him turn his face to the wind, a rule about which hand to use for the purpose of cleaning one’s behind. It was as if no aspect of human existence was to be left unregulated, free. The revelation – the recitation – told the faithful how much to eat, how deeply they should sleep, and which sexual positions had received divine sanction, so that they learned that sodomy and the missionary position were approved of by the archangel, whereas the forbidden postures included all those in which the female was on top. Gibreel further listed the permitted and forbidden subjects of conversation, and earmarked the parts of the body which could not be scratched no matter how unbearably they might itch. He vetoed the consumption of prawns, those bizarre other-worldly creatures which no member of the faithful had ever seen, and required animals to be killed slowly, by bleeding, so that by experiencing their deaths to the full they might arrive at an understanding of the meaning of their lives, for it is only at the moment of death that living creatures understand that life has been real, and not a sort of dream. And Gibreel the archangel specified the manner in which a man should be buried, and how his property should be divided, so that Salman the Persian got to wondering what manner of God this was that sounded so much like a businessman. This was when he had the idea that destroyed his faith, because he recalled that of course Mahound himself had been a businessman, and a damned successful one at that, a person to whom organization and rules came naturally, so how excessively convenient it was that he should have come up with such a very businesslike archangel, who handed down the management decisions of this highly corporate, if non-corporeal, God”

সালমান এখানে কেবল জিব্রিলকে অত্যাচার করছে না, একই সাথে পাঠককেও খোঁচা দিচ্ছে। এটা একটা ভ্যালিড সমালোচনা, বিদ্বেষ না। কারও কাছে যদি মনে হয় উপরে বিদ্বেষ ছড়ানো হয়েছে, তবে তিনি “বিদ্বেষ” না ছড়িয়ে যৌক্তিক সমালোচনা করার একটা ছহিহ তরিকা বাতলে দিলে সংসারের সকল দুষ্টু লেখকদের সুবিধা হত। যারা এরুপ সমালোচনার জন্য রুশদিকে হত্যা করার পক্ষে সাফাই গেয়েছিলেন, তাদের প্রতি রুশদির প্রশ্ন- ধর্মের বিধান কেন সমালোচনার উর্ধ্বে থাকবে? সমালোচনাই যদি করতে না পারবে, তবে লেখক আর বুদ্ধিজীবিদের কাজটা কী?

তাছাড়া এমন তো না যে মুসলিম দুনিয়ায় ইসলামের বিধি-বিধান নিয়ে বিতর্ক হয় না। মুসলিম ধর্মপতিরা তাদের সুড়সুড়ি বন্ধ করার জন্য নারীদের উপর বোরকা-হিজাব চাপিয়ে দিতে চাইলে অনেক মুসলিম নারী তার প্রতিবাদ করছে, ইসলাম নারীদের সন্তান পালনের উপর গুরত্ব আরোপ করলেও মুসলিম বিশ্বের নারীরা এখন স্বেচ্ছায় কর্মক্ষেত্রে যোগ দিচ্ছে। মুসলিম সমাজ যেহেতু প্রতিদিনই নিজেদের বিধি-বিধান নিয়ে প্রশ্ন করছে, তাহলে ওই একই কাজ করার জন্য একজন ঔপন্যাসিকের কল্লা দাবি করতে হবে কেন?

যাই হোক, টেক্সটে ফেরা যাক। আরেকটা প্রচলিত অভিযোগ হল রুশদি নবীর সাহাবীদেরকে গালাগাল করেছেন। স্বপ্নের যেই দৃশ্যে নবীর সঙ্গীদের “scum” এবং “bums” বলা হচ্ছে, সেগুলো কাফিরদের মুখ নিঃসৃত, লেখকের নয়। জালিমের জুলুমকে বিশদে বর্ণনা না করে কি নিপীড়নকে ফুটিয়ে তোলা যায়? সংশয়ীদের প্রশ্নকে উত্থাপিত না করে কিভাবে আপনি আপনার উপন্যাসে সংশয়কে তুলে ধরবেন?

নবীর স্ত্রীদের নিয়ে করা অভিযোগটাও বিশেষভাবে ব্যাখ্যার দাবি রাখে। জিব্রিলের স্বপ্নের শেষের দিকের দৃশ্যে দেখা যাচ্ছে যে জাহিলিয়াতে সাবমিশন ধর্ম পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর জাহিলিয়াবাসীর জীবনের প্রায় প্রত্যেকটি অংশ ধর্মপুলিশের পর্যবেক্ষণে চলে আসে(এবং সাধারণ মানুষের মাঝে এক প্রকার অস্থিরতা সৃষ্টি হয়), একে একে প্রত্যেকটি ধর্মবিরোধী উপাদানকে নির্মূল করা হয়। রয়ে যায় শুধু একটি পতিতালয়। এমনিতেই উন্মুক্ত যৌনতায় অভ্যস্ত জাহিলিয়াবাসীর উপর জেন্ডার সেগ্রেগেশন চাপিয়ে দেওয়ায় তাদের ভেতরে চাপা ক্ষোভ ছিল, তার উপর জাহিলিয়ার পুরুষদের দীর্ঘ দিনের প্রিয় এই প্রতিষ্ঠানকে উচ্ছেদ করলে তাদের অবদমিত অস্থিরতা বিষ্ফোরিত হতে পারে, এই ভয়ে এই পতিতালয়কে একটি নির্ধারিত সময়ের জন্য জাহিলিয়াতে কাজ করার অনুমতি দেওয়া হয়। এই পতিতালয়ের পতিতারা পুরুষদের উত্তেজিত করার জন্য মাহুন্ডের স্ত্রীদের নাম নেয়, এবং এটাকে ভিত্তি করেই সমালোচকরা ছড়িয়ে দেয় যে রুশদি মোহাম্মদের স্ত্রীদেরকে বেশ্যা বলেছেন। অথচ উপন্যাসে পরিস্কার করেই বলা আছে যে মাহুন্ডের প্রকৃত স্ত্রীরা ঠিকই তাঁর হারেমে “শুদ্ধ” জীবনযাপন করছে, পতিতালয়ের পতিতারা তাঁদের নাম নিয়েছে শুধুই আগত পুরুষদের ফ্যান্টাসিকে তোষণ করার জন্য। এই প্রোভোকেটিভ চিত্রের মাধ্যমে দু’টো বিষয় তুলে ধরা হয়েছে- ১) শাসকদের বিলাসী জীবন নিয়ে শোষিতদের ফ্যান্টাসি ২) পবিত্র আর অপবিত্রতার দ্বন্দ্ব। হারেম আর পতিতালয়- এই দু’টো জায়গাতেই নারীদেরকে ব্যক্তিগত পুঁজি বা সম্পত্তির মত আলাদা করে রাখা হয়, পার্থক্যটা হল যে হারেমে মালিক থাকে স্থায়ীভাবে একজন আর পতিতালয়ে টাকার বিনিময়ে সাময়ীকভাবে প্রভুত্ব কিনে নেওয়া যায়। এই পতিতালয়ে বা’ল নামক এক কবি আশ্রয় নিয়েছিল, কুরাইশদের আমলে মাহুন্ডকে ব্যঙ্গ করে কবিতা লেখার জন্য মাহুন্ড তার উপর ক্ষেপে ছিলেন। একদিকে পতিতালয়ের মত অপবিত্র জায়গায় নবীর পবিত্র হারেমকে সিমুলেট করা, আরেকদিকে এই একই পতিতালয়ে নবীর সমালোচনাকারী এক অপবিত্র কবিকে আশ্রয় দেওয়া- পবিত্র আর অপবিত্রতার মধ্যকার অস্থিরতাটা তুলে ধরাই এখানে রুশদির উদ্দেশ্য। তবে শেষ পর্যন্ত্য পবিত্রতা অপবিত্রতাকে ধ্বংস করে, মাহুন্ড সবার সামনে পতিতা আর কবির মুন্ডু কর্তন করেন।

‘In the old days you mocked the Recitation,’ Mahound said in the hush. ‘Then, too, these people enjoyed your mockery. Now you return to dishonour my house, and it seems that once again you succeed in bringing the worst out of the people.’

Baal said, ‘I’ve finished. Do what you want.’

So he was sentenced to be beheaded, within the hour, and as soldiers manhandled him out of the tent towards the killing ground, he shouted over his shoulder: ‘Whores and writers, Mahound. We are the people you can’t forgive.’

Mahound replied, ‘Writers and whores. I see no difference here.’

পবিত্রতা আর অপবিত্রতার দ্বান্দ্বিকতা সালাদিন চামচা ও জিব্রিল ফারিশতার গল্পেও দেখা যায়। স্যাটানিক ভার্সেস ক্যাচাল নিয়ে লেখা From Fatwa to Jihad বইয়ে লেখক কিনান মালিক বলছেন,

Angels and devils. Myths and monsters. These are at the heart of The Satanic Verses. The struggle of Saladin Chamcha and Gibreel Farishta, with themselves and with each other, is a struggle of the human imagination against the constraints placed upon it. One is a devil, the other an angel, yet they continually betray their own natures. When Saladin is arrested, Gibreel, the angel, refuses to help him. When the two meet up again in riot-torn east London, Gibreel appears as Azraeel, the most terrible of angels, wreaking fire and destruction. But even as he is hunted down by Gibreel, the demonic Saladin risks his life to save a family trapped in a burning house.

What Rushdie wants us to see is that the distinction between devil and angel lies less in their inner selves than in the roles that humans ascribe to them. If religion creates the divine and the Satanic in the image of man, secular society equally makes men in the image of devils and angels. Both religious faiths and secular societies deploy their angels and demons to justify their otherwise unjustifiable actions, to create boundaries that cannot be transgressed.

পতিতালয়ের দৃশ্যটা মোটেই নবীর স্ত্রীদের হেয় করার জন্য নির্মাণ করা হয়নি, বরং নৈতিকতা ও যৌনতা সম্পর্কিত কিছু ভাবনাকে নাটকীয় রুপ দেওয়া হয়েছে। পতিতালয়টির নাম “হিজাব”- একটা আয়রনি, কারণ এই অপবিত্র গৃহে পবিত্রতাকে সিমুলেট করা হয়। এখানে অবশ্য আমি আরেকটা আয়রনি দেখতে পাই যেটা রুশদি নিজের অজান্তেই তুলে ধরেছেন। মেয়েদের জামাকাপড় নিয়ে ঘুম হারাম করা, মেয়েদের “পবিত্রতা” নিশ্চিত করার গুরুভার বহন করা লোকগুলা নিঃসংকোচেই স্বীকার করে যে তাদের উপর তাদের মস্তিস্কের চেয়ে শিশ্নের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা বেশি, ক্ষেত্রবিশেষে শিশ্নই তাদের ঘিলু। জাকির নায়েক যখন দাবি করেন যে মেয়েরা “সংযত” জামা না পড়লে তারা “পাবলিক প্রপার্টি” হয়ে যাবে, তখন তিনি পবিত্রতার ঝান্ডাধারিদের অবচেতন ফেটিশগুলাকে নাঙ্গা করে দেন, তথাকথিত পবিত্রতার ধারণাটার মাঝে অপবিত্রতার প্রতিবিম্ব উদ্ভাসিত করেন- যেই ভাবটা এই গল্পে বারবার উচ্চারিত হয়েছে। এরপরও আপনি আশ্বস্ত না হলে ফেসবুকের ওড়না পেজগুলো ঘুরে আসতে পারেন। যাই হোক, রুশদির উদ্দেশ্য ছিল যৌন সম্পর্কের মধ্যে পরিপৃক্ত ক্ষমতার লড়াইটাকে তুলে ধরা; এই পতিতালয়ে ক্ষমতাহীন পুরুষরা যেন রানীকে অধিকার করার পুলক লাভ করে।

এই পর্যন্ত্য পড়ার পর পাঠকের মনে স্বাভাবিকভাবেই যে প্রশ্নটা জাগে- এরকম উত্তেজক ইমেজারি ব্যবহার করার কী দরকার? “মাহুন্ড” নামটা যে মুসলমানদের খেপিয়ে দিবে এটা তো জানা কথা। আসলে এখানে টেক্সটকে প্রেক্ষাপটের বাইরে নিয়ে যাওয়ার কারণে সমস্যাটা সৃষ্টি হয়েছে। উপন্যাসের ভেতরেই সরাসরি এই প্রেক্ষাপটকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, বই না পড়েই চিল্লাচিল্লি করার কারণে প্রতিবাদকারীরা যেটা বুঝতে পারেনি,

To turn insults into strengths, whigs, tories, Blacks all chose to wear with pride the names they were given in scorn; likewise, our mountain-climbing, prophet-motivated solitary is to be the medieval babyfrightener, the Devil’s synonym: Mahound

উপন্যাসটির একটি কেন্দ্রিয় থিম হল বর্ণবাদী ইংল্যান্ডে অভিবাসীদের অভিজ্ঞতা। এই উপাখ্যানের একটি কেন্দ্রীয় লক্ষ্য হল শত্রুর মুখ থেকে তার ভাষা কেড়ে নেওয়া, অপবাদকে শক্তিতে রুপান্তর করা। “মাহুন্ড” নামটা ব্যবহার করার পেছনে এটা একটা কারণ- যারা একসময় মাহুন্ডকে পাগল বলে অপবাদ দিত এবং মাহুন্ডের ব্যর্থতা সম্পর্কে নিশ্চিত ছিল, তারাই একসময় মাহুন্ডের পদতলে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গিয়েছিল।

আত্মপরিচয় পুনরুদ্ধার করার উপমাটিকে রুশদি অনেক দূর নিয়ে গিয়েছেন। লন্ডনে ল্যান্ড করার সাথে সাথেই সালাদিন চামচা আবিস্কার করে যে তার শিং গজিয়েছে, তার শরীর ক্রমশঃ জানোয়ারের মত হয়ে যাচ্ছে। ঘটনাক্রমে সে অভিবাসন পুলিশের হাতে মার খেয়ে নিজেকে হাসপাতালে আবিস্কার করে। পাশের বিছানাগুলোতে সে অনেকগুলো জানোয়ার দেখতে পায়, অকল্পনীয় সব দৈত্য-দানব। এরা কারা? এরা দাবি করছে যে এরা সব অভিবাসী, এলিয়েন। তদের আশ্রিত দেশ তাদেরকে যে রুপ দিয়েছে, তারা সেই রুপটাই ধারণ করে আছে।

They have the power of description, and we succumb to the pictures they construct.

অভিবাসীদেরকে শয়তান আখ্যা দিলেই তারা শয়তান হয়ে যায় না, আর শয়তান যদি আসলেই শয়তান না হয় তবে ফেরেস্তারাও নিশ্চয়ই আসলে ফেরেস্তা নন? এখান থেকেই রুশদি নৈতিকতার এক্সপ্লোরেশন শুরু করেন যেখানে নৈতিকতা পরম কিছু নয়, সদা পরিবর্তনশীল।

উপন্যাসের শিরোনামটাই পুনরুদ্ধারের দাবি চিৎকার করে জানান দিচ্ছে। “তোমরা আমাদের শয়তান মনে কর তো? ঠিক আছে, তোমাদের দুনিয়া সম্পর্কে শয়তানের ভাষ্যটা একটু শুনো”- একারণেই এই বইটি “স্যাটানিক ভার্সেস” বা “শয়তানের ভাষ্য”। যাদেরকে তাদের otherness এর কারণে তাদের আশ্রিত সমাজ দূরে ঠেলে দিয়েছে, এই বইটা তাদেরই ভাষ্য। এই উপন্যাসের এশীয় শিশুরা সগর্বে শয়তানের শিং পরিধান করে ছুটোছুটি করে। তাদের উপর আরোপিত লেবেলটাকে তারা স্বেচ্ছায় গ্রহণ করে নিয়েছে। এই উপন্যাসে কোরানকে শয়তানের রচনা বলা হয়নি; যুক্তরাষ্ট্রে “ব্ল্যাক” শব্দটা যে প্রক্রিয়ায় বর্ণবাদী অপবাদ হতে সাংস্কৃতিক গৌরবের প্রকাশমাধ্যমে রুপান্তরিত হয়েছিল, এই বইটা সেই প্রক্রিয়ারই স্বাক্ষী।

বইটির মূল বক্তব্যকে এত জঘন্যভাবে বিকৃত করা হয়েছে যে রুশদি আক্ষেপ করে বলছেন যে তাঁর এই সাহিত্যকর্মটি হয়ত চিরতরে ধ্বংস হয়ে গেল। মৌলবাদী ধর্মীয় ব্যক্তিত্বরাই যেন বইটির অর্থোদ্ধার করার ইজারা নিয়েছেন। সঙ্করীকরণ যেহেতু এই উপন্যাসটির নির্মাণের পেছনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুপ্রেরণা, তাই বলাই বাহুল্য যে ইসলাম ছাড়াও আরও অনেক উৎস থেকে উপাদান নেওয়া হয়েছে। প্রাক-খৃষ্টিয় যুগে ইশ্বর আর শয়তানকে একই সত্ত্বা বিশ্বাস করা হত,

It isn’t until the Book of Chronicles, merely fourth century BC, that the word Satan is used to mean a being, and not only an attribute of God.

বইটির পেছনে অনুপ্রেরণা হিসেবে যে দু’টো বই কাজ করেছে তার কোনটার সাথেই ইসলামের সম্পর্ক নেই- উইলিয়াম ব্লেইকের Marriage of Heaven and Hell এবং মিখাইল বুলগাকভের The Master and Margarita। বুলগাকভকে সোভিয়েত রাষ্ট্রযন্ত্রের হাতে নিপীড়িত হতে হয়েছিল, তাঁর দ্বারা অনুপ্রাণিত হওয়া সালমান রুশদিকেও একই পরিণতি বরণ করতে হয়েছে। অনুপ্রেরণা হিসেবে আরও কাজ করেছে মহানগরীর প্রতি তাঁর অনুরাগ। একসময় বোম্বে এবং পরে লন্ডনে বসবাসের অভিজ্ঞতা এই উপন্যাসে একটু হলেও ঢুকে পড়েছে,

The modern city is the locus classicus of incompatible realities. As long as they pass in the night, it’s not so bad. But if they meet! It’s uranium and plutonium, each makes the other decompose, boom.

আধুনিক যুগের একজন শহুরে পুরুষ হিসেবে রুশদির কাছে অনিশ্চয়তাই একমাত্র ধ্রুবক। তরুণ বয়সেই ইশ্বরকে হারালেও তাঁর কিছু আধ্যাত্মিক চাহিদা আছে, এই চাহিদাগুলো তিনি কোন আদি কারণের শরণাপন্ন না হয়েই তুষ্ট করতে আগ্রহী। সারা জীবন নির্ধার্মিক থাকার পরও যখন তাকে “মুরতাদ” ঘোষণা করা হয় তখন তিনি বিচলিত হন, যেই ভাষার সাথে তাঁর কোন সংশ্লিষ্টতা নেই সেই ভাষায় তিনি বর্ণিত হতে চান না। তাঁকে যখন মুরতাদ আখ্যা দেওয়া হয়, তখন তাঁর জন্য যেন একটি মিথ্যা পরিচয় সৃষ্টি করা হয়; বস্তুকে পেছনে ঠেলে যেন ছায়াকে সামনে টেনে আনা হল। মিথ্যা পরিচয় তৈরীর প্রতিযোগীতায় তাঁর বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের জন্য তাঁর উপর ক্ষেপে থাকা ব্রিটিশ মিডিয়াও কম যায় না, অনেক মিডিয়া ব্যক্তিত্ব তাঁকে ইগোম্যানিয়াক, লোভী, ভন্ড হিসেবে অভিহিত করেছে। তারা এও প্রচার করেছে যে সালমান রুশদি তাঁর ওরিয়েন্টাল নামের জন্য লজ্জিত, তিনি Simon Rushton হিসেবে পরিচিত হতে ইচ্ছুক। আর যেহেতু সালমান রুশদি একজন “উন্মাদ”, তাই তিনি আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা করলে সেটি তার মিথ্যা প্রতিবিম্বকেই বৈধতা দিবে। তাঁর এই মিথ্যা প্রতিবিম্ব তাঁর বিরুদ্ধে মুসলিম সহিংসতাকে সহায়তা করেছে। মুসলমান বিশ্বে অনেক পত্রিকাতে তাঁকে পশ্চিমপ্রেমী, মেরুদন্ডহীন, লোভী ব্যক্তি হিসেবে দেখানো হয়েছে যে টাকার বস্তার বিপরীতে ইসলাম ধ্বংস করতে বসেছে। হর্হে লুইস বর্হেস, গ্রাহাম গ্রিনের মত লেখকরা লিখেছিলেন যে তাঁদেরই নাম নিয়ে তাঁদের একটি “other” পৃথিবীতে হেটে বেড়াচ্ছে। রুশদি আশংকা করেন যে তাঁর other হয়ত তাঁকেই নির্মূল করে দিবে।

১৯৮৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারী আয়াতোল্লাহ খোমেনি রুশদির কল্লা চেয়ে ফতোয়া দেওয়ার কয়েক ঘন্টার মাথায় সাংসদ Keith Vaz রুশদিকে ফোন করে তাঁকে সমর্থন জানিয়েছিলেন, তার মাত্র কয়েক সপ্তাহ পর তিনি রুশদির মৃত্যু দাবি করা লোক সমাগমের সামনে বক্তৃতা প্রদান করে স্যাটানিক ভার্সেস নিষিদ্ধ করার দাবি জানান। তার এক বছর আগে গার্ডিয়ানের কলামিস্ট হুগো ইয়াং ব্রিটিশ মুসলমানদের উদ্দেশ্য করে এক অমর বাণী ছেড়েছিলেন, “If not Dagenham, why not Tehran?”, মানে হল “এই দেশ ভাল না লাগলে ফুটো”। ওই একই লোক এক বছর পর মৌলবাদীদের সাথে গলা মিলিয়ে রুশদিকে দোষারোপ করেছিলেন। লর্ড Dacre ঘোষণা করেছিলেন যে রুশদিকে কেউ চিপায় নিয়ে পেটালে তাঁর কিচ্ছু যায় আসবে না। রানা কাব্বানি স্তালিনবাদী ঢংয়ে লিখেছিলেন যে সব লেখককে সমাজের কাছে “জবাবদিহি” করতে হবে। লেখক ব্রায়ান ক্লার্ক Who Killed Salman Rushdie? নামক একটি নাটক লিখে রুশদিকে পড়ার জন্য পান্ডুলিপি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, রুশদির ভাগ্য ভাল সেই নাটক আলোর মুখ দেখেনি। টিভিতে লাইভ অনুষ্ঠানে দর্শকদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিল রুশদির বেঁচে থাকা উচিত কিনা, এমনকি এটা ন্যাশনাল ওপিনিওন পোল পর্যন্ত্য গড়িয়েছিল। খৃষ্টান পাদ্রীরাও ইসলামী মৌলবাদীদের পক্ষ নিয়ে বক্তব্য দিয়েছিল, এক John le Carre দাবি করেছিলেন যে রুশদি সবকিছু “জেনে শুনেই” এই কাজ করেছেন। রুশদি সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন করেন- Osip Mandelstam স্তালিনকে নিয়ে কবিতা লেখার সময় কি জানতেন না যে তাঁকে এর জন্য খুন করা হবে? তাহলে কি তাঁকে খুন করা জায়েজ হয়ে গেল? শিক্ষার্থীরা তো সব জেনে শুনেই তিয়েনআমেন স্কোয়ারে প্রতিবাদ করতে গিয়েছিল, তাদের খুন করা কি তাহলে হালাল হয়ে গেল?

রুশদি মনে করেন- বই তার লেখককে নির্বাচন করে, বই সৃষ্টির প্রক্রিয়াটা পুরোপুরি সচেতন হয় না। তিনি সাহিত্যের মাধ্যমে বিশ্বাসের ক্ষমতা ও গ্রন্থ নাযিলের প্রকৃতি নিয়ে ধ্যান করতে চেয়েছিলেন। আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা অতি অবশ্যই একটি জেনুইন অভিজ্ঞতা। একজন পয়গম্বর যদি সত্যই কোন আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা অর্জন করেন এবং পারলৌকিক জগত বলে যদি কিছু না থেকে থাকে, তবে আসলে ঘটছেটা কী? একজন অবিশ্বাসীর জন্য এটা একটা জটিল প্রশ্ন। এই প্রশ্নটা মাথায় রেখেই তিনি মাহুন্ডের গল্পটি নির্মাণ করেছিলেন। তিনি জানতেন স্যাটানিক ভার্সেসের ঘটনাটা বিতর্কিত, যে মোহাম্মদ নিজেকে একজন সাধারন বার্তা-বাহক দাবি করা সত্ত্বেও তাঁর জীবনচরিতের প্রতি মুসলমানদের সংবেদনশীলতা একটু বেশিই, কিন্তু তিনি ভাবতে পারেননি যে পাঠক জিব্রিলের স্বপ্নের দৃশ্যগুলোর কাঠামো থেকে লেখকের বক্তব্য উদ্ধার করতে ব্যর্থ হবেন। অবশ্য পাঠোদ্ধার করার জন্য তো আগে পাঠ করতে হবে, অনুভূতিতে আঘাত পাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকা লোকজনের পাঠ করার ধৈর্য কই!

জাহিলিয়া একই সাথে মক্কা হয়, এবং মক্কা নয়। জাহিলিয়া নির্মাণের জন্য রুশদি কিছু ঐতিহাসিক দলিলের সাহায্য নিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু একই সাথে এই শহরে একটি ভারতীয় নগরীর ছায়াও রয়েছে। জিব্রিল যখন লন্ডনে যায়, জাহিলিয়া তখন লন্ডনেরও কিছু অংশ শুষে নেয়। ফিকশন ফ্যাক্ট থেকে যাত্রা শুরু করে, কিন্তু ফিকশন মাত্রই ফ্যাক্ট নয়।

রুশদি আসলে কী কী জানতেন? তিনি জানতেন যে মোহাম্মদ একজন রক্ত মাংসের মানুষ, আর দশটা রক্ত মাংসের মানুষের মত তাঁরও নারীপ্রীতি ছিল, মনে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল। তিনি আরও জানতেন যে ইসলাম কোন মতেই সমসত্ত্ব নয়। ইসলামে যেমন কবি ইকবাল, খৈয়াম, ইমাম গাজ্জালির দার্শনিকতা আছে(গাজ্জালিকে অবশ্য ইকবাল, খৈয়ামদের কাতারে ফেলা ঠিক হবে না, আমার তাঁকে কট্টর বৈ কিছু মনে হয়নি), তেমনই ব্র্যাডফোর্ড মসজিদ কাউন্সিলের শাব্বির আখতার কিংবা ইরানপন্থী মুসলিম ইন্সটিটিউটের পরিচালক কলিম সিদ্দিকির সঙ্কীর্ণতাও আছে। জমিদার মির্জা সাইদ আকবর ও গ্রামবাসীর আরব সাগরে ডুব দেওয়ার মুল ঘটনাটাও তিনি জানতেন। এই বিশেষ গল্পটা লেখার সময় রুশদি চেষ্টা করেছিলেন ওই মানুষগুলোর দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বিশ্বাসের ক্ষমতাকে অনুভব করতে, কেন কিছু মানুষ স্রেফ বিশ্বাসের জন্য নিঃচিন্তে আত্মহুতি দিতে পারে। রুশদি যদি তাঁর ভবিষ্যত দেখতে পেতেন, তবে কি তিনি উপন্যাসটির কাহিনী বদলে ফেলতেন?

না। Friedrich Durrenmatt তাঁর The Physicists গ্রন্থে লিখেছিলেন,

What has once been thought cannot be unthought

স্যাটানিক ভার্সেসের ক্যাচালটাকে একটি রাজনৈতিক ঘটনা হিসেবে দেখতে হবে, শুধু ধর্মীয় দৃষ্টিতে দেখলে হবে না। ভারতে মৌলবাদী সাংসদ সৈয়দ শাহাবুদ্দিন এই ক্যাচালকে পুঁজি করে রাজিব গান্ধীর পতনোন্মুখ সরকারকে এক হাত দেখে নিয়েছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম ভোটারদের ক্ষমতা প্রদর্শন করা। কংগ্রেস সবসময়ই মুসলিম ভোটের উপর নির্ভরশীল ছিল। বইটি নিষিদ্ধ করার পরও কংগ্রেসের সেই যাত্রা রক্ষা হয়নি, শাহাবুদ্দিনদের একারণে বিশ্বাস করতে নেই। এই ক্যাচাল দক্ষিণ আফ্রিকার এপার্থিড বিরোধী ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের মুসলিম ও অমুসলিম সদস্যদের মাঝে বিভেদ গড়ে তুলেছিল। পাকিস্তানে নির্বাচনে মাইর খাওয়ার পর স্যাটানিক ভার্সেসকে আঁকড়ে ধরে ইসলামিস্টরা খেলায় ফিরে আসার পায়তারা করেছিল। বইটা পাকিস্তানে প্রকাশিত হবার আগেই নিষিদ্ধ করার পরও পাকিস্তানের জামায়াত ইসলাম আমেরিকান সংস্কৃতি কেন্দ্র ভাঙচুর করেছিল, রুশদির সাথে আমেরিকান সংস্কৃতি কেন্দ্রের সম্পর্ক কী সেটা তারাই বলতে পারবে। ওই মিছিলে পুলিশ গুলি ছুড়েছিল, হুদা কামে কম পক্ষে পাঁচজন মানুষ মারা গিয়েছিল। ইরানে খোমেনির ফতোয়া সদ্য সমাপ্ত ইরান-ইরাক যুদ্ধের লাখ লাখ ইরানী লাশের থেকে মনযোগ সড়িয়ে নিতে সমর্থ হয়েছিল। ব্রিটেনে অভিবাসীদের প্রতিনিধিত্বের অধিকারের জন্য সেকুলার সংগঠনের সাথে ধর্মীয় সংগঠনের প্রতিযোগীতায় ইন্ডিয়ান ওয়ার্কার্স এসোসিয়েশনের মত সেকুলার সংগঠন এগিয়ে ছিল, কিন্তু এই ক্যাচাল মসজিদগুলোর হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়। মসজিদগুলো একারণেই আন্দোলনের ইতি টানতে চায়নি, যদিও অনেক সাধারণ মুসলমানের কাছে প্রতিবাদের ধরণটা বিব্রতকর হয়ে পড়েছিল।

স্যাটানিক ভার্সেসের সাহিত্য মান নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, অনেক রিভিউতে দেখলাম বোদ্ধা পাঠকদের কাছেও বইটা দুর্বোধ্য লেগেছে। বক্তব্যের দিক দিয়ে বইটি দলিত অভিবাসী কমিউনিটির পক্ষে একটি শক্ত দলিল হতে পারত, কিন্তু সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ক্যাজুয়ালটি হয়ে বইটি ওই একই কমিউনিটির কাছে এখন স্রেফ একটি চপেটাঘাত ছাড়া কিছু না। মোল্লাদের মুঠোবন্দি পাঠকরা একটি সম্পূর্ণ নিরীহ ও হিতার্থী টেক্সটকে টুটি চেপে ধরে বধ করেছেন। একজন লেখকের জন্য তাঁর সৃষ্ট কর্মের এই পরিণতি বোধ করি মৃত্যু পরোয়ানার চেয়েও বড় শাস্তি।