রাজশুয়োর
আদনান আদনান

উৎসর্গ
মিলান কুন্ডেরা

রঙিন ঘুম
আমাকে পাঠানো হয়েছিলো হিটলারকে হত্যা করার জন্য। আমি যখন তার বাড়িতে পৌছাই, তখন সে বাগানে কাজ করছিলো। ফুল কি সব্জির বাগানে তা আর এখন ঠিক মনে পড়ছেনা। সেদিন ছিলো প্রচন্ড গরম। আমি ঠিক দুপুরের পরপর তার বাড়িতে পৌঁছাই। সে তখন ঘাস নিড়ানি দিতে দিতে ঘেমে একাকার। আমিও তখন পাহাড়ি পথে অনেক পথ হেটে খুব ক্লান্ত। আমাকে দেখেই সে বলে, “আরে আপনি তো দেখছি খুবই ক্লান্ত। অনেক পথ হেঁটেছেন বোঝা যাচ্ছে। আসুন বসুন আমার বারান্দায় একটু বসুন। আমি পানি আনতে বলছি।”
আমি আর কিছু বলার না পেয়ে তার বারান্দায় উঠে বসি।
“তা আপনি কোথায় যাচ্ছেন? আর আপনার নামটা?”
“আমার নাম রাসেল। এই তো পাশের শহরেই যাচ্ছি। আর ঘন্টা দুয়েক হাটলেই বোধহয় পৌঁছে যাবো।”
“তা কি কাজে যাচ্ছেন?”
“তেমন কিছু না। শুয়োরের মাংস কিনতে যাচ্ছি।”
বলতে বলতেই লেবুর সরবত আর বিস্কুট এসে পড়ে। আমি বলি, “এর আর কি দরকার ছিলো? ঠান্ডা পানিতেই তো হতো।”
“কি যে বলেন না। এই গরমে আমি আপনাকে শুধু পানি দিয়েই বিদেয় করে দেব? না তেমন অপমানিত আমি হবোনা।”
আমি তার কথার পিঠে আর কিছু বলতে পারিনা। তাকে আমার দেবতা বলে মনে হতে থাকে। আমার মনে হয় আমি ভুল লোকের বাড়িতে এসে পড়েছি। আমি তার ভিতরে নষ্ট কিছুই খুঁজে পাইনা। আমরা বেশ কিছুক্ষণ ধরে কথা বলতে থাকি। আমার মনে হতে থাকে, এমন ভালো একজন মানুষকে হত্যা করা ঠিক হবেনা। আমি আমার মন পরিবর্তন করি।
“শুনুন, আমি আমার ড্রাইভারকে কল করে দিয়েছি। সে আসছে। ও আপনাকে যায়গা মতো পৌছে দেবে।”
“না না না, তার দরকার নেই।”
“এই যুদ্ধের ভিতরে আপনার মতো একজনের সাথে কথা বলতে পেরে আমার খুব ভালো লাগলো। আপনার মতো মানুষ তো খুব কম দেখা যায় আজকাল। সাবাই তো যুদ্ধে গেছে। এ যে কার যুদ্ধ তাও তারা কিন্তু জানেনা। আমাকে দয়া করে এটা করতে দিন।”
আমি না বলতে পারিনা। না বলতে ঠিক আমার ইচ্ছেও করেনা। তার মতো এমন অমায়িক মানুষ আমি আর আগে দেখিনি।
সে তার ড্রাইভারকে একটা চিঠি দেয়, আর আমাকে আমি যেখানে যেতে চাই নামিয়ে দিতে বলে।
মেইল তিনেক পরে ড্রাইভার রাস্তার পাশে গাড়ি থামায়। আমার দিকে ফিরে সে দাঁত বের করে হাসে।
আমি বলি, “কি ব্যাপার?”
“দেখি চিঠিতে কি লেখা আছে।”
“ও আচ্ছা! ভদ্রলোক তো খুবই অমায়িক। দারূণ মানুষ।”
“চিঠিতে লেখা আছে আপনাকে ছুরি মেরে মেরে হত্যা করার কথা।”
“তার মানে?”
“তার মানে আপনাকে এখন খুব কঠিন একটা মৃত্যু গ্রহণ করতে হবে।”
আমি কিছু বলার আগেই আমাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে রাস্তার পাশে ফেলে রেখে সে চলে যায়। আমি আমার লাশের পাশে বসে বসে নিজের লাশ দেখতে থাকি। বেশ সুন্দর দেখায় আমাকে। শরীরে অসংখ্য লাল নক্ষ্ত্র ফুটে আছে দেখে আমার সুখ লাগে। সে বেশ ভালো ছুরির কাজ জানে। আমার ইচ্ছে করে তার সাথে কোলাকুলি করতে।
আর ঠিক তখনই আমার বিড়ালটা ধড়াম করে কিছুতে যেন ঘা খায় আর ব্যাপক চিৎকার করে ওঠে, আর তা শুনে আমার ঘুম ভেঙ্গে যাই। আমি ঘরের আলো জ্বালাই। ঘরের মেঝেতে বিড়ালটাকে মরে পড়ে থাকতে দেখি। দেখি সে রক্তে ভেজা। আমি ভয় পাই। এতো জোরে কে তাকে আছাড় মারলো দেয়াল-আয়নাই? নাকি সে নিজেই লাফ মেরে জানলার থেকে সরতে গিয়ে আয়নাই বাড়ি খেলো? যদি তা-ই হয় তবে কি তার পক্ষে এতো জোরে বাড়ি খাওয়া সম্ভব? আর আমি কাঁদছিনা কেনো? আমার এতো প্রিয় বিড়ালটা মারা গেলো আর আমি কাঁদছিনা? আমি কি ভয়ে অবশ হয়ে গেলাম? এসব যখন ভাবছি, তখন আমার দৃষ্টি পড়ে জানালার বাইরে। আমার জানালার বাইরের তেঁতুল গাছে একটাও পাতা নেই, শুধু বাদুড়্গুলো ঝুলে আছে। অথচ গত রাতে গাছটিতে ভরা পাতা ছিলো। আমি জানালার কাছে এসে দাড়াতেই, আমার মুখে কি যেন পানিপানি মতোএকটা এসে লাগে। আমি হাত দিয়ে দেখি তা একটা বাচ্চা কবুতরের ছেঁড়া পা। আমার জানালার কার্ণিশে একজোড়া বুনো কবুতর বাসা বেঁধেছিলো। আমি নিচেই তাকাতেই দেখি কবুতর দুটো কাক হয়ে গেছে, আর ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে তাদের বাচ্চা দুটোকে। আকাশ মেঘে ঢাকা। অসংখ্য কাক উড়ে যাচ্ছে পূর্ব থেকে পশ্চিমে। এতো ভোরে এত কাক কেন আকাশে? এখনও তো বাইরে বেশ অন্ধকার? ঠিক তখনই মা দরজার কঁড়া নাড়ে আর বলে, “কি রে তোর কি হলো আজ? দোকানে যাবিনা?”
“বাজে কতো এখন? এখনও তো অনেক অন্ধকার।”
“আকাশে তো মেঘ। প্রায় বেলা দশটা বাজে।”
“বলো কি? আযান শুনেই তো আমার ঘুম ভাঙ্গে প্রতিদিন!”
“তুই উঠে আয়, আমি খাবার রেডি করছি।”
আমি ঘুরে দাড়াতেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ি। আমার চোখ পড়ে আয়নাই। আমি আমার মুখে দেখি এক শুয়োরের মুখ। আমি সেই বার বছর বয়স থেকে সংগ্রাম করে আসছিঃ- আমি কোনোদিন শুয়োর হবোনা। কিন্তু আমি কিভাবে ঘুমের ঘরেই তা-ই হয়ে গেলাম? আমার রাগ হয়না। আমার অবাক লাগে। আমি এতো কষ্টে এতোদিন মানুষ থাকলাম, আর আজ আমার অজান্তেই আমি শুয়োর হয়ে গেলাম! জীবনে কি সবাই শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয় তা সে তা চাক আর না চাক? আমি বাথরুমে যাই। আমি যখন চনচন করে কাজটা সারতে থাকি, আমি বুঝতে পারি আমার একটা ছোট লেজও হয়েছে। আমি আয়নাই লেজটিকে দেখি। দেখে আমার ভালো লাগে। আমি লেজটা কয়েকবার নাড়ি। নেড়ে আমার ভালো লাগে। এতোদিন এমন একটা লেজ না থাকার জন্য আমার খারাপই লাগে। আমি আমার চেহারাটা একটু ভাল করে আয়নাই দেখি। নাকটা আমার ভালো লাগে। আমি সরাসরি একদম ভিতর পর্যন্ত দেখতে পারি। আমার গালও বেশ লাল লাল। আমাকে বেশ দেখায়। আমার মনে হতে থাকে আমি কোনো পোষাক পরে আছি। সত্যি সত্যি আমি শুয়োর হয়ে যায়নি। কিন্তু আমি জানি আমি এখন একজন শুয়োর।
আমার মনে পড়ে মল্লিকার কথা। আজ রাতে আমার তাকে প্রপোজ করার কথা। আমি এই দিনটির জন্য অপেক্ষায় আছি আজ ঠিক ছয় বছর। আর আজকেই আমি কিনা শুয়োর হয়ে উঠলাম! আমি ভেবেছিলাম এমন যদি হয় তো আমি লজ্জায় নিজের মুখ দেখতে পারবোনা। নিজেকে হত্যা করবো। কিন্তু আমার নিজের মুখ দেখতে ভালই লাগে। আমি নিজেকে বলি, “আমি পরাজিত হইনি, আমি আমার পৃথিবীর একজন হয়ে উঠছি”। আমার খারাপ লাগেনা। আমি কি সৃষ্টির শুরুর থেকেই শুয়োর হয়ে উঠছিলাম? আমি কি সব সময় এই পথেরই পথিক ছিলাম? হয়তো আমি শুয়োরের থেকেও শুয়োর হয়ে উঠছিলাম। আর তাই আমার এতদিন লেগে যাই। আমার বেশ লাগে। আমার মনে পড়ে আমি একদিন এক বাদামওয়ালা আমাকে যখন টাকা ফেরত দিয়ে গিয়ে বেশি দিয়ে ফেলে আমি তার তার ভুল ধরিয়ে দিইনা। একবার আমার এক বন্ধুর বাড়ির কাজের মেয়েকে ধর্ষণ করার প্রস্তাব করি আমি। আমার বন্ধু বলে, “এ তুই কি সব বলছিস?” তার কথা শুনে আমার লজ্জা লাগে। আমার ভিতরে একটা অপরাধবোধ হেজে ওঠে। আর ছোটবেলায় আমার চাচা-চাচির করা দেখার একটা অভ্যাস আমার ছিলো। একটা ক্লান্তি নেমে আসে আমার শরীর ও মনে। মনে হয় আমি ভেঙ্গে পড়ে যাবো। কিন্তু তেমন কিছুই হয়না।
মানুষ + নষ্টামি = নতুন জন্ম = শুয়োর

নতুন পৃথিবী
আমি জামা-কাপড় পরে ঘরের দরজা খুলে বের হয়ে আসতেই আমার মার হাতের থেকে ভাতের বাটিটি পড়ে যায়। সে চিৎকার করে ওঠে। আমি দাঁড়িয়ে থাকি চুপচাপ।
মা বলে,“ওরে আমার শুয়োরের বাচ্চারে! কি সুন্দর টুসটুসে লাল গাল হয়েছে রে তোর! তুই বড়ো বেশি দেরি করে ফেলেছিস রে, বড়ো বেশি দেরি করে ফেলেছিস বাছা। তারপরও বলবো যে আমি একজন মা হিসেবে আজ স্বার্থক। আজ আমার জন্ম স্বার্থক। আজ আমার ঘরে এক নতুন শুয়োর, যে আমার গর্ভে জন্মেছিলো একদিন। আজ আমার নতুন জন্মের দিন।”
অনেকদিন আগে, আমার তখন বয়স হবে আটের নিচে, আমার মা একদিন আমাকে বলেছিলো, “তুই বড়ো হয়ে ঘুষ খাবি। আমাদের আর তখন কোনো অভাব থাকবেনা।” আমি মাকে কিছুই বলিনি সেদিন। তবে মনে পড়ে সারারাত কেঁদেছিলাম, আর মনে মনে বলেছিলাম, “আমি কোনোদিন জানোয়ার হবোনা”। আজ আমার হাসি পাই। আমার গতকালের আবেগকেও আমি চিনতে পারিনা। নতুন পৃথিবীতে নিঃশ্বাস নিতে আমার আরাম লাগে। অনেকদিন পরে আমি নিজের ভিতরে একটা ঝলমলে ভাব লক্ষ্য করি। নিজেকে আমার স্বাভাবিক বলে মনে হতে থাকে। আমি বুঝতে পারি এতোদিন আমি অস্বাভাবিক ছিলাম।
আমার বাবা তার ঘরের থেকে বেরিয়ে আসেন। কিছুই না বলে আমার সাথে কোলাকুলি করেণ। তার দু’গাল বেয়ে চোখের পানি নেমে এসে আমার কাঁধে পড়ে। আমি বলি, “অবশেষে আপনার মতো আমিও শুয়োর হলাম।”
বাবা বলেন, “শুয়োরের বাচ্চা কি শুয়োর না হয়ে পারে? আপনি এতোদিন বিভ্রান্ত ছিলেন”।
“আপনি আমাকে আপনি করে বলছেন কেনো বাবা?”
“বাবা তুমি যেদিন একটা শুয়োর জন্ম দেবে সেদিন বুঝবে এর কি সুখ। আজ আমার ঘরে এক মহাশুয়োরের আবির্ভাব। আমি কি তাকে আপনি করে না বলে পারি?”
“আমাকে নিয়ে আপনি অনেক দুঃশ্চিন্তা করেছেন। আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি সব উসুল করে দেবো।”
“আমি জানি। আমি জানি। তুমি তোমার মার সাথে কথা বলো, আমি সবাইকে খবরটা দি। ফোনের বিল অনেক উঠে যাবে, কিন্তু ঘরে যখন এতো বড় একটা শুয়োর, আমার আর চিন্তা কি!”
আমার বড় বোনের মেয়ে আর কাজের মেয়েটি আমার সামনে এসে মেঝেতে বসে পড়ে।
“মামা আপনি কিন্তু আমি যা চাবো তাই কিনে দেবেন আমারে। আমি ফোন করে কাজ ছেড়ে দিয়েছি আপানার শুয়োর হয়ে ওঠার কথা শোনার সাথে সাথেই। ”
“ছোট ভাই আমি কিন্তু আজকের থেকে আপনার সাথে রাতে শোবো!”
আমার মা বলে, “তা তো শুবিই। এ তো তোর কপাল রে মাগী।”
আমার বোনের মেয়েকে আমি আগে বলতাম, “সবাইকে কাজ করতে হবে। কাজ না করে বসে থাকা যাবেনা। কেউ কাজ করবে আর কেউ করবেন তা হবেনা।” সে আমার চাঁপে পড়েই একটা উকিলের অফিসে কাজ নেই। আমি তাকে বলি, “কাজ ছেড়ে কি লাভ? ঐ উকিলের কোলে বসে তার থেকে যা পারো বাগিয়ে নাও।” আমার কথা শুনে ওর চোখমুখ ঝলমল করে ওঠে। আমাকে একটা চুমু দিয়ে সে দৌড়ে ফোনের দিকে যায়।
বাবা ফিরে আসেন। বলেন, “যাও, বাইরে দেখা দিয়ে আসো। নতুন শুয়োরকে দেখা দিতে হয়, তা না হলে কেউ বিশ্বাস করে ওঠতে পারেনা। আর নিজেদের ভিতরের সবাই আসছে সন্ধ্যার পরেই। আমি বাজারে যাচ্ছি। বাকিতে আনবো সব। তুমি কিন্তু আমারে গর্বীত করবা। দামটা তুমিই এক সময় দিয়ে আসবা। আর কোনোদিন যেন আমাকে টাকা দিয়ে বাজার না করতে হয়। তার দিকে খেয়াল রাখবা।”
আমার বাবা একজন খারাপ মানুষ। আমি তাকে সহ্য করতে পারতাম না। আজ তাকে ভালোই লাগে। আগে তাকে ঘৃণা করতাম আর মনে মনে বলতাম, “নিজেরই তো বাপ! তার এতো কিছুর পরেও যখনা তাকে ক্ষমা করতে পারি, তখন অন্য যে কোনো মানুষকে আমি ক্ষমা করতে পারি। আর কিছু না হোক সে আমাকে ক্ষমাশীল করে গড়ে তুলছে।” আজ আমি নিজেকেই নিজে ক্ষমা করতে পারিনা আমার আগের আবেগের কথা চিন্তা করে। আমার বাবা আমার উপরে কখনও হাল ছাড়েননি। আমার আবেগে তার সাথে আবার কোলাকুলি করতে ইচ্ছে করে, কিন্তু আমি তা করিনা। আমি নিজের ভিতরে নিজে কেঁদে ফেলি।
নতুন পৃথিবীতে আমার বেশ লাগে। নিজেকে আমার কেউ একজন বলে মনে হতে থাকে।
মানুষ + নষ্টামি = নতুন জন্ম = শুয়োর

পুরোনো বন্ধুত্বের ব্যাকরণ
বাড়ির থেকে বের হতেই আমার পরিচিত এক রিকশাওয়ালা আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। বলে, “স্যার আপনি আমারে একটা চড় মারেন।”
“কেনো?”
“বলতে পারবো আপনার মতো নামজাদা শুয়োরের চড় আমিই প্রথম খেয়েছি!”
আমি তাকে টেনে একটা চড় মারি। সে আমার হাত টেনে ধরে চুমু খায়।
আমি যখন রিকশা নিয়ে গলির মুখে পৌঁছাই, গলির মুখের দোকানদার আমারে ছালাম দেয়। আগে সে আমারে তার দোকানে গ্রহণ করতোনা। আমি তার দিকে থুতু ছুড়ে মারি। সে তা হা করে মুখে গ্রহণ করে। দোকানের সবাই তার কাঁধে চাঁপড় মারে, আর তার সাথে কোলাকুলি করে।
আমি আমার প্রিয় শিক্ষকের বাড়ির দিকে যাই। “জ্ঞানীরা নাকি অনেক কিছুই আগের থেকে জানতে পারেন?” আমি আমার প্রিয় শিক্ষককে জিজ্ঞেস করি।
“অনেক ক্ষেত্রেই তা পারে।”
“আমি যে শুয়োর হয়ে উঠবো তা কিন্তু আপনি বুঝতে পারেননি।”
“বুঝেছি, কিন্তু বলিনি।”
“কেনো?”
“কোন কারণ নেই। ইচ্ছে হয়নি হয়তো।”
“আপনার পিছনে ঘুরে ঘুরে আমার অনেক সময় নষ্ট হয়ে গেছে।”
“তাই নাকি?”
“আমি অনেক আগেই শুয়োর হয়ে উঠতে পারতাম।”
“তুমি অনেক আগের থেকেই শুয়োর ছিলে।”
“আমাকে আপনি করে বলুন। আমার বাবাও আমাকে আপনি করে বলেন।”
“শুয়োরের মতো শুয়োর তুমি!”
“তোর পতন আসছে।”
“তোমার জন্মের আগের থেকেই আমার পতন আসছে। আসুক। তুমি আমার বাড়ির থেকে এখন যেতে পারো। মানুষ আর শুয়োরের ভিতরে কোন কথা হতে পারেনা।”
“তোর পতন হবেই।”
সে আর কিছু বলেনা। আমি তার বাড়ির থেকে বেরিয়ে যাই।
মানুষ + নষ্টামি = নতুন জন্ম = শুয়োর

মৌলিক ক্ষুধা
আমার ছোট বোনের বাসায় যেতেই তার বর আমার পায়ের নিচে এসে পড়ে। আমি হুবড়ি খেয়ে পড়ে যাওয়ার মতো একটা অবস্থায় পৌঁছায়, কিন্তু পড়িনা। আমাকে সে বলে, “আমি জানতাম আপনি একদিন কি হবেন! যারা চুপচাপ তারা মারে বড়ো কোঁপ। আপনি দেখাবেন। আপনি দেখাবেন। আমি জানি আপনি দেখাবেন।”
“আমি খুব ক্ষুধার্ত”।
“কি খাবেন?”
“শিক্ষা, চিকিৎসা, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, যৌনতা, আর নিরাপত্তা।”
“তা আপনি পারবেন। আপনি যে এতো কিছু খাবেন তা আমি জানতাম। আমি জানতাম।”
“আমাকে খেতে হবে। আমি খুব ক্ষুধার্ত।”
“ঠিক আছে এখন থেকে এইসব বিভাগের কাজ আপনিই পাবেন।”
“তবে মাগীপাড়ার কাজে আমাকে তলে তলে একটু রাখবেন। মাঝে মাঝে যাবো। আপনার বোনে আমার ঠিকমতো হয়না।”
আমি কিছু বলিনা।
আমার বোন এসেই কান্না শুরু করে দেয়। বলে, “ভাইরে আরো আগে যদি হতিস তো আমি আরো বড় কোনো শুয়োরকে বিয়ে করতে পারতাম রে! আমার বর তো একটা পাতি শুয়োর। তুই আমার অনেক ক্ষতি করে দিয়েছিস।” তার বর পাশে দাঁড়িয়ে শোনে, কিছু বলেনা।
“রাতে বাসায় আসিস।”
“আমার ভাই আজ এতো বড়ো এক শুয়োর, আর তার অনুষ্ঠানে আমি না গিয়ে কি পারি?”
“রাতে দেখা হবে। এখন আমাকে একটু যেতে হবে।”
“তা তো যাবিই। শুয়োরদের ব্যস্ত থাকতে হয়। ব্যস্ত না থাকলেও ব্যস্ত ভাব দেখাতে হয়।”
মানুষ + নষ্টামি = নতুন জন্ম = শুয়োর

শুয়োরের দাপট
আমি দূর থেকে দেখি আমার বন্ধুরা আমার জন্য ফুলের মালা নিয়ে দাড়ায়ে রয়েছে। ওরা দৌড়ে এসে আমার গলায় মালা পরায়। আমি প্রায় মাটিতে পড়ে যাবার যো হই। ভারে আমার গলা ছিড়ে পড়ার মতো হয়। আমি কিছু বলিনা। ওদেরকে মজা করার একটু সুযোগ দিই।
“দোস্ত তুমি এ কি দেখালে!”
“তুই তো শালা চাঁপা মাল। তলে তলে এতো দূর? আমরা তো কতো চেষ্টা করে কষ্ট করে তবে শুয়োর হয়েছি। আর তুই ঘুমের ঘরেই…”
“আরে আর পিছনের দিকে দেখা নয়। সামনে দেখতে শেখ তোরা। তা দোস্ত আমদেরকে ভুলোনা যেন। আমরা তোমার উপগ্রহ হয়ে থাকবো।”
“খুব বেশি বড় উপগ্রহ আমরা হবোনা। খুব ছোট ছোট উপগ্রহ হয়ে থাকবো।”
“আমরা তোমার হাতের পুতুল হবো। যেভাবে নাড়াবে সেভাবে নড়বো”
“থাক থাক আমাদের দোস্ত কি আর আমাদের ভুলে যাবে নাকি? যা তোরা মাল তিনটারে নিয়ে আয়। দোস্ত তোমার জন্য একটা কাজের ব্যাবস্থা আমরা করেছি। এটা সব শুয়োরকেই করতে হয়।”
“কি কাজ?”
“কিছু চড় মারতে হবে”।
“আমি তো সকালেই এক রিকশাওলাকে চড় মারলাম।”
“বলেছিলামনা তোদের এ শালা বড়ো শুয়োর হবে। তারপরও আরো কিছু মারো দোস্ত।”
ওরা একটা বৃদ্ধা ফকির, একটা টোকাই, আর একটা হাবিলদার নিয়ে আসে। আমি তাদের একটা করে চড় আর লাথি মারি। আমার বন্ধুরা আনন্দে লাফালাফি করে। আমি বুঝতে পারি, প্রতিটি শুয়োরকেই চড় মারা শিখতে হয়। ছোট শুয়োরেরা চড় মারে, আর মনে মনে ভয় পায়। তারা চড় মারে তাদের থেকে ছোট শুয়োরদেরকে। আর বড়ো শুয়োরেরা চড় মারে যারে-তারে, নির্ভয়ে, আর প্রায়-ই তাদের থেকে বড়ো শুয়োরদেরকে।
মানুষ + নষ্টামি = নতুন জন্ম = শুয়োর

স্বপ্নের ভাঙ্গন
আমি বড়ো হুজুরের সাথে দেখা করতে যাই। আমাকে দেখেই সে বলে, “আপনার অপেক্ষা-ই আসরের নামায কাজা করে বসে আছি। না জানি কখন আসেন! বাবা আপনি বড়ো শুয়োর হবেন। আপনাকে দেখেই বোঝা যায়।”
তার সাগরেত বলে, “আমরা ছোটবেলার থেকে যে রাজশুয়োরের গল্প শুনে আসছি আপনি হবেন সেই রাজশুয়োর।”
বড়ো হুজুর তাকে ধমকে বলে, “মানে আমিই তাই বলছিলাম সকালে আপনার মহান বাবার ফোন পাবার পরে। আপনিই সেই রুপকথার রাজশুয়োর।”
“অনেক বেশি বলে ফেলছেন।”
“এ কি! আপানার ভিতরে দ্বিধা কেনো?”
আমি বুঝতে পারি আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি বলি, “আমি জানি আমি সেই রাজশুয়োর, কিন্তু এখনই আমি তা কাউকে বলতে চাইনা।”
আরো কিছু বাচ্চা হুজুর এসে আমার গালে চুমু খেয়ে আমাকে ঘিরে বসে। তারা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
আমি বলি, “আপনাদের দার্শনিক এ ব্যাপারে কি বলে গেছেন?”
“আমাদের দার্শনিক? সে আবার কে? আমদের তো কোনো দার্শনিক নেই।”
“ঐ মরুবৃদ্ধটির কথা বলছি।”
“আমরা জানতামনা আমাদের একটা দার্শনিক আছে। আপনি আমাদেরকে তা জানালেন। আমরা ধন্য। আমাদেরকে আপনি নতুন কিছু দিলেন। আমাদেরকে আপনি আরো একটু শুয়োর করে তুললেন। আপনিই মহাজ্ঞানী। ঐ মরুবৃদ্ধ তো আমাদের ব্যবসার কাঁচা মাল। আপনি এখন আমাদের আসল ওস্তাদ। আমরা সবাই আপনার শিষ্য।”
“আপনাদেরকে ধন্যবাদ। আমার একটা কাজ আপনাদেরকে করে দিতে হবে।”
“কি কাজ? আমরা তো কাজ করার জন্যই। শুয়োরদের কাজ করি, আর আপনার মতো রাজশুয়োরের কাজ তো করবোই। জীবন দিয়ে হলেও করে দেব।”
“ফরিদ মাষ্টারকে খুন করতে হবে।”
“ঐ বানচোঁদ-ই তো আপনার মাথা খেয়েছিলো। এখনও আরো অনেকের খাচ্ছে। তাকে তো খুন হতেই হবে।”
“তাকে ধরে চৌরাস্তার মোড়ে একটা বাঁশের মাথায় ঝুলিয়ে রাখবেন আজ রাতে। সে ওখানেই না খেয়ে না পানি পান করে রৌদ্রে পুড়ে মরবে। আর সবাই তা দেখবে।”
“হয়েছে। খুব হয়েছে। ভীষন সুখ দিলেন আপনি আমাদেরকে আপানার এই বুদ্ধি দিয়ে। আমরা আজ রাতেই তা করবো। আপনিই রাজশুয়োর। আপনিই রাজশুয়োর।”
আমি বেরিয়ে পড়ি। এখন বেশ সন্ধ্যা। আমার মল্লিকার কথা মনে পড়ে।
মানুষ + নষ্টামি = নতুন জন্ম = শুয়োর

রাজশুয়োর
আমি দূর থেকে মল্লিকাকে দেখতে পারি। সে বসে আছে খোলা আকাশের নিচের রেষ্টুরেন্টটির একদম মাঝের টেবিলটিতে। আমি তাকে পিছন থেকে দেখতে পাই। সে আমাকে দেখতে পায়না। আমার ভয় হয় সে আমাকে গ্রহণ করবে কিনা। সে মানুষ, আর আমি শুয়োর। তার সামনে আসতেই আমি থেমে যাই।
“কি ব্যাপার চমকে গেলে যে!”
“এ কি?”
“আমি তো শুয়োরই ছিলাম।”
“কবের থেকে?”
“নারীকে অনেক কিছুই জানতে হয়। আমি সব সময়ই শুয়োরই ছিলাম। আমার জন্মই হয় এভাবে। শুধু তোমার থেকে লুকিয়ে রেখেছিলাম।”
“আমি শান্তি বোধ করছি। খুব দুঃশ্চিন্তায় ছিলাম এতক্ষণ।”
“আমি তো গত ছয় বছর ধরে দুঃশ্চিন্তায় ছিলাম।”
“তুমি আমাকে বাঁচালে।”
“তুমি আমাকে নতুন জীবন দিলে।”
বাড়ির থেকে মোবাইলে কল আসে। আমি ধরিনা। রাজশুয়োরেরা ফোন ধরেনা, করে।
আমাদের আশেপাশে এখন অনেক শুয়োর। আমি বুঝতে পারি অন্য শুয়োরেরা কিছু একটা দেখতে চায়। আমারও ইচ্ছে হয় কিছু একটা দেখানোর, বেশ দারুনভাবেই দেখানোর। মাদি শুয়োরটারও সেরকম একটা ইচ্ছে হয় বুঝতে পারি। আমি মাদিটির দিকে তাকাই, মাদিটিও আমার দিকে তাকায়। আমি আঙটিটি পকেট থেকে বের করিনা। বের করার প্রয়োজন বোধ করিনা। আমরা দু’জনে অন্য শুয়োরেদেরকে ঐ খোলা আকাশের নিচেই তার যা দেখতে চায় তা দেখাতে শুরু করি। তারা দেখতে থাকে, আর চিৎকার করতে থাকে, “রাজশুয়োর রাজশুয়োর ঘ্যোঁৎঘ্যোঁৎ রাজশুয়োর রাজশুয়োর রাজশুয়োর রাজশুয়োর ঘ্যোঁৎঘ্যোঁৎ রাজশুয়োর রাজশুয়োর রাজশুয়োর রাজশুয়োর ঘ্যোঁৎঘ্যোঁৎ রাজশুয়োর রাজশুয়োর রাজশুয়োর রাজশুয়োর ঘ্যোঁৎঘ্যোঁৎ রাজশুয়োর রাজশুয়োর রাজশুয়োর রাজশুয়োর ঘ্যোঁৎঘ্যোঁৎ রাজশুয়োর রাজশুয়োর রাজশুয়োর রাজশুয়োর ঘ্যোঁৎঘ্যোঁৎ রাজশুয়োর রাজশুয়োর রাজশুয়োর রাজশুয়োর ঘ্যোঁৎঘ্যোঁৎ রাজশুয়োর রাজশুয়োর রাজশুয়োর রাজশুয়োর ঘ্যোঁৎঘ্যোঁৎ রাজশুয়োর রাজশুয়োর রাজশুয়োর রাজশুয়োর ঘ্যোঁৎঘ্যোঁৎ রাজশুয়োর রাজশুয়োর রাজশুয়োর রাজশুয়োর ঘ্যোঁৎঘ্যোঁৎ রাজশুয়োর রাজশুয়োর রাজশুয়োর রাজশুয়োর ঘ্যোঁৎ ঘ্যোঁৎ রাজশুয়োর রাজশুয়োর রাজশুয়োর রাজশুয়োর ঘ্যোঁৎঘ্যোঁৎ রাজশুয়োর রাজশুয়োর রাজশুয়োর রাজশুয়োর ঘ্যোঁৎঘ্যোঁৎ রাজশুয়োর রাজশুয়োর রাজশুয়োর রাজশুয়োর ঘ্যোঁৎঘ্যোঁৎ রাজশুয়োর রাজশুয়োর…ঘ্যোঁৎঘ্যোঁৎ…।

মানুষ + নষ্টামি = নতুন জন্ম = শুয়োর
আর
(শুয়োর – ১০০% মনুষ্যত্ব) + চরম নিষ্ঠুরতা + চরম কপটতা + চরম নির্লজ্জতা
= রাজশুয়োর

খুব ছোটবেলার থেকেই আমার জন্মদিনে আমার মনটা খুব খারাপ থাকে। আমি ঐ দিনটিতে কারোর সাথেই কোনো কথা বলিনা বা দেখাও করিনা। সারাদিন চুপচাপ ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে বসে থাকি। এই গল্পটি, গত বছর, আমার জন্মদিনে লেখা। ই-মেইলঃ [email protected]