লিখেছেন – অসীম

আজকের সকালটা বেশ সুন্দর মনে হচ্ছে বেণুদির কাছে। ক’দিন বেশ ধকল গেছে। প্রায়ই গাজীপুরে যেতে হয়েছে। গাজীপুরে যাওয়া তো চাট্টিখানি কথা নয়। ঢাকা শহরের এত জ্যাম,এত মানুষ! প্রতিদিনই এর মাত্রাটা বাড়ছে মনে হয়। গাড়ির কালো ধোঁয়া আর ধুলোবালির উৎপাত বাড়তি পাওনা। সারি সারি হাইরাইজ বিল্ডিং দাঁড়িয়ে আছে। ঢাকা শহরটা বেশ ক’বছরে চোখের সামনে দ্রুত পাল্টে গেছে কোন নিয়মের তোয়াক্কা না করে। অফিসে বিদ্যুত নেই প্রায় ঘন্টাখানেক। মনে মনে বিড়বিড় করে,এদেশে বিদ্যুতের সমস্যা আর জনসংখ্যার বিস্ফোরণ কবে সমাধান হবে কে জানে। ভ্যাপসা গরমে অ¯িহরতা অনুভব করে। মেয়েটার মামলাটা মিটেছে কাল। একদিন কাঁদতে দেখেছিল তার দুই বছরের বাচ্চাকে কোলে নিয়ে পারভীন আপার রুমে। পারভীন আপার কাছে যখন সব কিছু খুলে বলছিল, সেদিন বেণুদিও পাশে বসে সব শুনে মামলাটা নিয়েছিল। আজ প্রায় ৬ মাস পর সে সমস্যার সমাধান দিতে পেরে মনটা এক অদ্ভুত ভাললাগায় ভরে উঠল। মহিলা সালিশি কেন্দ্রে অনেক মামলা আসে। কিন্তু কেন জানি এই মামলার নিষ্পত্তি বেণুদিকে কিছুটা হলেও শান্তি দিচ্ছে। একটা প্রচ্ছন্ন ভাললাগায় মনটা ভরে উঠেছে। দশতলা অফিসের স্লাইডিং উইন্ডো খুলে বাইরে তাকায়। আর ভাবে, কত হতভাগী যে এখনো মার খাচ্ছে বাংলাদেশের আনাছে কানাছে – কে জানে! বিড়বিড় করতে থাকে।

চৌধুরী ঢাকা শহরের বড় বিজনেস ম্যান। বয়স পঁয়তাল্লিশের কাছাকাছি। গুলশানে পাঁচ হাজার স্কোয়ার ফিটের বিশাল ডুপ্লেক্স বাড়ি। একছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে সংসার। বড় মেয়েটা সারাক্ষণ ফেসবুকে যে কি করে! ক্লাস নাইনে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া মেয়ের ফেসবুকে অসংখ্য বন্ধু। সারাক্ষণই ল্যাপটপ কোলে নিয়ে অনবরত চ্যাট করতে থাকে। কীবোর্ডে আংগুল চলে সজোরে দীর্ঘ সময় ধরে। চৌধুরী সাহেব বিরক্ত হন। কিছু বলা যায় না। ছেলেমেয়েদের কিছু বলতে গিয়ে থেমে যান – একটা আতংকে ভোগেন। সেদিন তো মেয়ে মুখের উপর বলে দিয়েছে, কম বয়সী এক মেয়ের সাথে লাঞ্চে দেখা গেছে রেস্টুরেন্টে। বন্ধুরা সবাই মিলে খুব ক্ষেপেছিলো বড় মেয়েকে। মিসেস চৌধুরী প্রথম প্রথম এসবের প্রতিবাদ করতেন। কিন্তু কোন পরিবর্তন না দেখে হাল ছেড়ে দিয়েছেন অনেক আগেই।

বর্ষার সকাল। বাইরে অঝোরে বৃষ্টি। ড্রাইভার আসেনি আজ। কিছু একটার অজুহাতে ড্রাইভারের না আসার অভ্যেসটা অনেক পুরোনো । মুখ দিয়ে অস্ফুটে বেরুলো..হারামজাদা। পার্কিং লনে গিয়ে গাড়িটা বের করলো । রাস্তায় এত পানি কিভাবে অফিস যাবে তা ভেবে কোন কুল কিনারা পাচ্ছে না চৌধুরী । আইফোনটাকে মিউট করে ধীরে ধীরে গাড়িটা এগিয়ে নিচ্ছে কোনমতে।

বৃষ্টি মানে নতুন কিছু। প্ল্যানটা মাথায় আসতেই মুডটা নিমিষে ভালো হয়ে যায়। বৃষ্টি আর নতুন সেক্রেটারি -কোথায় যেন একটা মিল খুঁজে পায় চৌধুরী। অফিসের নতুন সেক্রেটারি জয়েন করছে মাস তিনেক হলো। দারুণ স্মার্ট মেয়ে। অল্পেই সব বুঝে নেয়। ঠিক এরকম চেয়েছিলো সে। সহজে সবকিছু বুঝতে পারার নাম বুঝি স্মার্টনেস।

বেণুদির আজ অতসীর কথা খুব মনে পড়ছে। মনে অনেক জমানো কষ্ট নিয়ে অতসী অনেক দুরে চলে গেছে সে। আর কোনদিন এদেশে ফিরবে না বলেছিলো এয়ারপোর্টে। কানাডায় আছে প্রায় তিন বছর। ফেসবুক কিংবা স্কাইপিতে খুব সংক্ষিপ্ত কথা সারে। কি জানি!কত কষ্ট ওর বুকে এখনো জমা আছে । শুধু কষ্ট কেন…সাথে প্রচন্ড ঘৃণাও। বড় বোন হয়ে ওর সমস্যার কোন সমাধান সে সময় দিতে পারেনি । এক জীবনে বোধহয় মানুষ অনেক কিছুর সমাধান করে যেতে পারে না। যা থেকে যায়…সে সব জীবনের শেষ বেলায় শুধু আপসোস বাড়ায়!

অতসী ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করে চাকরি নিয়েছিলো চৌধুরী সাহেবের অফিসে। খুব খুশি হয়েছিল বেণুদি। বেণুদি কাছে রেখে একটু একটু করে বড় করছিল ছোট্ট বোনটিকে । দেখতে দেখতে অনেক বড় হয়ে গেছে অতসীটা। ভালো মাইনের চাকরী – মনটা খুশিতে ভরে উঠছিল। খুব সুন্দরী আর মিষ্টি ছিল অতসী। আজো সে দিনটির কথা কিছুতেই ভুলতে পারে না বেণুদি!

চাকরী পাবার প্রায় পাঁচ মাস পরের ঘটনা। বাইরে অঝোরে বৃষ্টি। কি একটা ফাইলের ছলছুতোয় চৌধুরী সাহেব আটকালেন অতসীকে। অফিস একদম ফাঁকা। অফিস পিয়ন ছাড়া আর কেউ নেই। কলিগরা সবাই বেরিয়ে গেছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। ফাইলটা ভালো ভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল অতসী। কোন ভুল সে দেখতে পাচ্ছে না। একবার ভাবছে..দুর ছাই,বেরিয়ে যাই স্যারকে কিছু না বলে। মনটা খচখচ করছে। মনের মধ্যে কেমন যেন ভয় ভয় করছে অতসীর। অজানা আতংকে গা শিউরে উঠছে। চৌধুরী সাহেবের রুমে গেস্ট। ওরা গেলেই ফাইল নিয়ে যাবে। তারপর দেখিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়বে। দিদি বসে আছে বাসায়। একসাথে ডিনার সারবে। মনটা উতলা হয়ে আছে কখন বেরুবে। অফিস পিয়নটা বাইরে গেছে কি একটা কারণে। ওর আচরণটা কেমন অদ্ভুত ঠেকছে অতসীর কাছে। মুচকি মুচকি হাসছে সে। এরকম হাসি দেখলে গা জ্বলে অতসীর। একদম সহ্য করতে পারে না। কলিংবেল বেজে উঠে। গেস্ট চলে গেছে বোধহয়। অতসী ফাইলটা নিয়ে ঢোকে। দেখানোর উদ্দেশ্যে কাছে যেতেই চৌধুরী ঝুঁকে পড়ে ওর হাতটা শক্ত করে ধরে। কিছুটা হতভম্ব হয়ে যায় সে। ছাড়াতে গিয়ে পারে না। লোকটার গায়ে এত শক্তি! হাসতে হাসতে অতসীকে এক টানে সোফায় বসিয়ে দেয়। সজোরে চাপ দিয়ে ফেলে দেয় চৌধুরী। প্রানপণ চেষ্টা করে অতসী। ঠেলে উঠতে চায়। কিন্তু পারে না। এসব ব্যাপারে চৌধুরী পাকা খেলোয়াড়। কিভাবে কাবু করতে হয় সে কৌশল চৌধুরীর জানা। প্রথমে মেয়েগুলো খুব অনুনয় করে….তারপর ধস্তাধস্তি। একসময় ধীরে ধীরে শক্তি হারিয়ে ছেড়ে দেয়। শক্তি দিয়ে সব কিছু সামাল দিতে হয় এটুকুই। বৃষ্টির দিনে একই কায়দায় অফিসে সন্ধ্যের পর আরো চারজনের সাথে চৌধুরীর প্ল্যানটা সাকসেসফুল হয়েছিল। এবারও চৌধুরী সাকসেস হতে চায়। বৃথা চেষ্টা করে অতসী। টাইয়ের নটটা আর কোমরের বেল্টটা আলগা হয়। হাতে রিমোট টিপে লাইটটা অফ করে চৌধুরী। শুধু অন্ধকার…নিমেষ কালো এ অন্ধকার সব শক্তি শুষে নেয় অতসীর। কিছুই আর অবশিষ্ট থাকে না। এই অন্ধকারে সব হারিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে পড়ে ঢাকার রাস্তায়। সারারাত ধরে কেঁদেছে অতসী। সেকি কান্না! মনটাকে শান্ত করতে পারছিল না বেণুদি। অঝোরে কেঁদেছিল। দু’বোনের সারারাতের কান্না আশেপাশের বাতাসকে ভারী করে তুলেছিলো।

গাড়ি ধীরে ধীরে এগুচ্ছে। হঠাৎ রিক্সা এসে পিছনের বাম্পারে লাগালো। মাথাটা গরম হয়ে যায় রিক্সাওয়ালাদের কারবার দেখলে। যথাসম্ভব মাথা ঠান্ডা রেখে অফিসে পৌঁছতে হবে। জরুরী কয়েকটা মিটিং সারতে হবে। তারপর নতুন সেক্রেটারিকে কয়েকটা ফাইল দিতে হবে। নতুন সেক্রেটারির কথা মনে পড়তেই কেন জানি চৌধুরী সাহেবের মস্তিকে একটা হালকা অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ছে। মেয়েটার সৌন্দর্য্যের প্রশংসা করতেই হয়। মনে মনে ভাবে, সৌন্দর্য্যরে স্বভাবই হচ্ছে মানুষকে কাছে টানা। ইন্টারভিউতে মেয়েটার স্বাভাবিক কথাবার্তা আর স্টাইল মুগ্ধ করেছিল। সেটা চৌধুরী এখনো ভুলতে পারেনি। কানাডায় ছিল প্রায় সাত বছর। গত ডিসেম্বরে দেশে ফিরেছে। দারুণ ঝকঝকে ইংরেজি। একেবারেই সংকোচহীন। নামটা যেন কি মেয়েটার – মনে আসছে না এই মুহুর্তে।

শীতের সকাল। বেণুদির অফিসে ভিজিটিং রুমে একজন ওয়েট করছে। পিয়ন এসে জানালো। দেখা করতে চায়। সাধারণতঃ ভিজিটিং আওয়ার ছাড়া দেখা করে না বেণুদি। সেটা পিয়ন মারফত সবিনয়ে জানানো হলো । কিন্তু মেয়েটি নাছোড়বান্দা টাইপের। দেখা করে যাবেই সে। অগত্যা বেণুদি দেখা করে। মাথায় ছোট চুল। কি জানি কাটটার নাম-মনে করতে চেষ্টা করে বেণুদি। প্রিন্সেস ডায়নার নামে..ডায়না কাট। ভীষণ মিষ্টি চেহারা। জিšস আর হাওয়াই শার্ট পড়ে এসেছিলো। কয়েকদিন হলো কানাডা থেকে ফিরেছে। একটা স্পেশাল এসাইনমেন্ট নিয়ে দেশে এসেছে। অতসীর সাথে পরিচয় হয়েছে কানাডায়। অতসী ওর ভালো বন্ধু। দু’জনে একই রুম শেয়ার করে ডর্মে। বেণুিদ স্বাভাবিক হতে পারে না মেয়েটার সামনে। মেয়েটার স্বতঃফুর্ত ভাব দেখেও বেণুদি কেন জানি গুটিয়ে থাকে। বেণুদির দেখা পেয়ে সে খুব খুশী। এসাইমেন্টটা শেষ করে আবার কানাডা ফিরবে – জানিয়ে যায়।

নিজের মায়ের বোনটাকে কতদিন যে দেখেনি বেণুদি! মনটা হুহু করে উঠে। চোখ ঠেলে পানি বেরিয়ে আসতে চায়।

বিকেলে প্ল্যানটা করে চৌধুরী। বৃষ্টির দিনে অফিসের সব কাজ কর্ম কেমন জানি ঝিমিয়ে পড়েছে। সবার বাসায় যাবার তাড়া। রাস্তায় গাড়ি কমে এসেছে। লাইটপোষ্টের হলুদ বাতিগুলো জ্বলে উঠেছে। রাস্তায় লোক চলাচল নেই বল্লেই চলে। মাঝে মাঝে দ’ু একটা গাড়ির হর্ণ শোনা যাচ্ছে শুধু। এইতো সুযোগ। আজ সেই সুযোগের ব্যবহার করতে চায় চৌধুরী। ভাবতেই মনটা চঞ্চল হয়ে উঠে। নতুন সেক্রেটারি এলিন কে আজ আটকাবে চৌধুরী। কিছু একটা ছলছুঁতো বের করলেই হলো। এক গাদা ফাইল ধরিয়ে দেখতে বলে। কিছু পরে এইসব ফাইলপত্র নিয়ে আলোচনা করবে এলিনের সাথে।

টেলিফোনে কথা দীর্ঘ হয় চৌধুরীর। সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত আসে। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করে এলিন চৌধুরীকে ফ্রি পায় না। চৌধুরী আজ এত তাড়াতাড়ি ফ্রি হতে চায় না। এলিনের অপেক্ষার সময় বেশ দীর্ঘ হতে থাকে। একসময় নিয়ম মাফিক অফিস পিয়ন বিদেয় হয়। যাবার আগে মুচকি হাসি দেয় নতুন ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে।

এলিন খুব বৃষ্টি ভালবাসে। স্কুল ছুটির পর ভিকারুননেসা থেকে সারা রাস্তা বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে ফিরতো টিএন্ডটি কলোনিতে। সারা রাস্তার কাদা আর কাকভেজা হয়ে বাসায় যখন ফিরতো মার সেকি বকুনি। বাসায় শাওয়ারে নিচে দাঁড়িয়ে গোসল করে ফ্রেশ হতে হতো। কখনো কখনো শাওয়ারটাকে বৃষ্টি ভেবে গোসল করতো দীর্ঘক্ষণ। হাসি পায় খুব। পুরোনো কথা মনটাকে এক অজানা ভাললাগায় বুঝি ভরিয়ে দেয়। কতদিন এরকম বৃষ্টি দেখেনি সে। বাইরে গিয়ে খুব ভিজতে ইচ্ছে করে। এলিন আজ অফিস থেকে বেরিয়ে বৃষ্টিতে ভিজবে। ভিজতে ভিজতে পাগল হয়ে যাবে আজ। ভিজে ভিজে হাঁটতে হাঁটতে ঢাকা শহরকে সে দেখবে বলে ঠিক করেছে। এতো পাগল করা বৃষ্টি! একটা অবশ করা অনুভূতি সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে।
অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়। ডাক পড়ে চৌধুরীর রুমে। নিজেকে পরিপাটি করে চৌধুরীর রুমে ঢোকে। চৌধুরী সোফায় বসায়। এলিন কোলের উপর ফাইলটা মেলে ধরে। পাশে চৌধুরী গা ঘেষে বসে। ঝুঁকে পড়ে ফাইল দেখার ভান করে। এক সময় এলিনের হাতটা শক্ত করে ধরে। এলিন ছাড়াবার হালকা চেষ্টা করেও করে না। আজ এলিন কোন বাঁধা দেবে না। ওর যা কিছু আছে সব আজ দেবে চৌধুরীকে । এ দিনটার জন্যই তো এত দিনের অপেক্ষা! এ মূহুর্তগুলোকে সে কল্পনায় কত ভাবে সাজিয়েছে! চৌধুরী নাও! যত ইচ্ছে তোমার নাও।

চৌধুরীকে কোন বাধা দেয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। আজ সে চৌধুরীর, শুধুই চৌধুরীর। চৌধুরী কিছুটা অবাক হয়ে যায়। এতো মেঘ না চাইতে বৃষ্টি! চকিতে এলিনের শার্টের বোতাম খুলে ফেলে । চৌধুরী পাগল উঠেছে। এলিনের ছলাকলায় চৌধুরীর দিগি¦দিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। ওর সমস্ত শরীরে চৌধুরীর হাত খেলা করে। এলিনের শরীর চৌধুরীকে অন্য মাত্রা এনে দেয়। অবিশ্বাস্য! কামনার উম্মত্ততায় চৌধুরীর চাওয়া পাওয়া হিসেব দ্বিগুণ হয়ে উঠে। বাতি নিভাতে দেয় না এলিন। বাতি নিভাতে দেবে না এলিন। বাতির আলোয় সব পেতে চায় সে। এক সময় চৌধুরীর শরীর এলিনকে জড়িয়ে একাকার হয়ে যায়। অদ্ভুত এক ভালোলাগা চৌধুরীকে আচ্ছন্ন করে রাখে। বাইরের প্রবল বৃষ্টি জানালার কাঁচে ধাক্কা মারে। অতসীর কষ্ট মাখা চেহারার অবয়বটা বুঝি জানালার কাঁচে ভেসে উঠেছে। এলিন ভালো ভাবে দেখে ঠাহর করবার চেষ্টা করে।

ধীরে ধীরে উঠে পড়ে এলিন। পেছনে চৌধুরীর সোফায় এলানো উদোম শরীর। ঘৃণা জাগে। দাঁতে দাঁত চেপে চৌধুরীকে একপলক দেখে নেয়। বিড়বিড় করে নিজের অজান্তে বলে উঠে,সান অফ বিচ্। বাথরুমে গিয়ে নিজেকে পরিপাটি করে নেয়। আয়নায় নিজের চেহারাটা ভালোভাবে দেখে নেয়। এই কি এলিন নাকি অতসী! অতসীর কষ্টটা তার বুকটাকে ভারী করে তোলে। ভ্রান্তিবিলাসে মনটা অজানা আবেগে ভরে উঠে। কান্না পায় খুব। এ সময় অতসীকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে খুব। ডর্মে অতসীকে জড়িয়ে ধরে অসংখ্য রাত দু’জনে ঘুমিয়েছে – তার কোন ইয়ত্তা নেই। অতসী যে এলিনের প্রাণের চেয়ে বেশি! মানুষের কল্পনা বুঝি ভৌগলিক দুরুত্বকে হ্রাস করে দেয়।
ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে আসে। আজ শেষ অফিস,বিদায় চিরদিনের মত। কাল কানাডার রিটার্ণ টিকেটটা রিকনফার্ম করতে হবে। বাইরে বৃষ্টি এখনো থামেনি। আজ বৃষ্টিতে ভিজে এই ক্লেদাক্ত শরীরটাকে ¯œাত করতে হবে,শুদ্ধতায় ভরাতে হবে। চৌধুরীর হাতে আর্বজনায় ভরা- এ শরীরের সমস্ত পংকিলতা,ক্লেদ ধুঁয়ে মুছে পরিস্কার করতে হবে ঢাকার বৃষ্টিতে।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মনে পড়ে বেণুদির কথা। বেণুদিকে ফোন করে,
–বেণুদি আমি পেরেছি, আমি সাকসেসফুল। অপরপ্রান্তে বেণুদির অস্ফুট কান্নার আওয়াজ শুনা যাচ্ছে। আজ বেণুদি যত খুশী কাঁদুক,কাঁদো বেণুদি,কাঁদো। যত ইচ্ছে কাঁদো। এদেশের মেয়েদের কান্নাই তো দুঃখ লাঘবের একমাত্র পথ।
স্পেশাল এসাইনমেন্টের কিছু কাজ এখনো বাকি রয়ে গেছে এলিনের। অথচ হাতে সময় খুব কম। বারবার অতসীর কষ্ট মাখানো মুখটা মনে পড়ে মাথার ভেতরে প্ল্যানটাকে ব্যাহত করছে।

আস্তে আস্তে সোফা থেকে নিজেকে তুলে আনে চৌধুরী। আজো সে সাকসেসফুল। সাকসেস বুঝি সব মানুষকে পরিতৃপ্ত করে,করেছে চৌধুরীকে। খুশীতে ডগমগ করে বাথরুমে পা বাড়ায়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে আবিষ্কার করে চৌধুরী। কিছু বুঝে উঠবার আগেই ধব্ করে বসে পড়ে সোফায়। হাতড়ে বেড়ায় সাইড টেবিলে। খুঁজে পেতে চায় ফার্মেসী থেকে কিনে আনা জিনিসটি। খুঁজে পায় না। সমস্ত পৃথিবী মাথার উপর ঘুরতে থাকে। একটু আগে সে ছিল পৃথিবীর সুখী এক মানুষ,পর মূহুর্তেই বদলে যায় তার সেই চিরচেনা পৃথিবীটা। পরাজিত সৈনিকের মত উদভ্রান্ত হয়ে বসে থাকে সোফায় উদোম শরীরে।

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে আলো আঁধারিতে ব্যাগের চেইনটা খুলে ফার্মেসী থেকে চৌধুরীর কেনা অব্যবহৃত কনডমটি খুঁজে পায়। প্রয়োজনহীন বস্তুটিকে ঘৃণাভরে বাইরে বৃষ্টিতে ছুঁড়ে মারে। মোবাইলটা বের করে আনে ব্যাগ থেকে। একটা মেসেজ লিখতে হবে। চৌধুরীর বড় মেয়েকে। খুব সংক্ষিপ্ত মেসেজটা দ্রুত আংগুল চালিয়ে শেষ করে। মোবাইলের বাটনটা সজোরে চেপে ধরে সেন্ড করে। নিশ্চিন্ত হতে চায় অশান্ত মন। খুব শখের লিপিস্টিকটা চৌধুরীর বাথরুমে ফেলে এসেছে। ব্যস্ততায় নিতে ভুলে গেছে। লিপিস্টিকটা দিয়ে বাথরুমের আয়নায় উপরে লেখা আর চৌধুরীর মেয়ের মোবাইলের স্ক্রিনে ভেসে উঠা সংক্ষিপ্ত লাইনটার একই অর্থ,একই ভাষা,একই ব্যঞ্জনা …………………..

এ মূহুর্তে চৌধুরী একজন এইডস রোগী।

তাড়াতাড়ি রাস্তায় উঠে আসে এলিন। প্রচন্ড বৃষ্টিতে পিচঢালা রাস্তায় হাঁটতে থাকে সে। এলিনের যন্ত্রণা,অতসীর কান্না,বেণুদির কষ্ট আর ঢাকার বৃষ্টি যেন একাকার হয়ে যায়।