অনেক বছর আগের কথা। আশির দশকের শুরুর দিক। থাকতাম তখন খিলগাঁওয়ে। কিশোর বয়স আমার। গল্পের বই পড়ার প্রবল নেশা তখন। কিন্তু নেশার উপকরণ নেই। অত্যন্ত দরিদ্র একটা পরিবারে জন্ম আমার। একবেলা খাবার পরে পরের বেলা খাবার জুটবে কি না, সেই দুশ্চিন্তা যেখানে কুরে কুরে খায়, সেখানে বই নামের নেশাতো অন্যভূবনের উপকরণ। ভাত খাবারই পয়সা নেই যেখানে, সেখানে বই এর আশাতো দূরাশামাত্র। তবে, শুধু অর্থনৈতিক কারণই একমাত্র কারণ ছিল না এই প্রতিবন্ধকতার পিছনে। পরিবারের কর্তার গড়পড়তার চেয়ে নিম্নমানের বুদ্ধিমত্তার কারণে পাঠ্য বইয়ের বাইরের সব বইকেই ধরা হতো আউট বই হিসাবে। আমার জনক এমন ঘেন্নার সাথে নাটক-নভেল পড়ে কথাটা বলতেন যে, সেটা শুনলে মনে হবে যেন উপন্যাস পড়াটা পৃথিবীর জঘন্যতম কোনো কাজ। এই পশ্চাদপদ মানসিকতার বদমেজাজী গৃহকর্তাটির ভয়ে আমাকে অনেক লুকিয়ে চুরিয়ে বই পড়তে হতো। কখনো লেপের নীচে লুকিয়ে, কখনই পাঠ্য বইয়ের নীচে রেখে, কখনো বা তিনি যখন বাসায় থাকতেন না সেই সুযোগে, কখনো বা আব্রাহাম লিংকনের মত সন্ধ্যার পরে বাইরে কোনো ল্যাম্পপোস্টের নীচের আধো আলো আধো অন্ধকারে বসে। গল্পের বইসহ কখনো হাতেনাতে ধরা পড়লে বইয়ের জীবনতো পুরোপুরি শেষ হতোই, আমারটাও পিটিয়ে আধমরা করে ছাড়তেন আমার আব্বাজান।

তখন মূলত সেবার বই পড়তাম। দস্যু বনহুর, দস্যু বাহরাম আর নীহাররঞ্জনের কীরিটি রায় পেরিয়ে আমার উত্তরণ ঘটেছে মাসুদ রানায়। কিন্তু, এই বইগুলো ছিল অনেক দুর্লভ। সেবার বই, বিশেষ করে মাসুদ রানাকে তখন প্রাপ্তবয়ষ্কদের বই মনে করা হতো। আমাদের মত কিশোরদের হাতে এই বই দেখলে বড়রা সবাই হাহা করে উঠতো এই বলে যে, দেশ, সমাজ সব একেবারেই রসাতলে গেলো। কেউ বা কান মুচড়ে কেড়ে নিতেন হাত থেকে, বদরাগী কেউ হয়তো সমাজটাকে উচ্ছন্নে যাওয়া থেকে রক্ষা করার মহান উদ্দেশ্যে আমাদের গালে সজোরে চড় কষে দিতেন। আমাদের সমবয়েসী কেউ-ই তখনো মাসুদ রানা কেনার দুঃসাহস দেখায় নি। তারপরেও আমার হাতে মাসুদ রানা এসে পড়েছিল একজন বয়ষ্ক লোকের কল্যানে। আমাদের এক বন্ধুর বাসায় তাদের দূর সম্পর্কের এই লোকটি আশ্রিত অবস্থায় থাকতেন। আমাদের বন্ধুটি জ্যাঠা বলে ডাকতো। তার দেখাদেখি পাড়ার সব কিশোরেরাই তাকে জ্যাঠা বলে ডাকতাম। এই জ্যাঠার মাসুদ রানা পড়ার বাতিক ছিল। তখন প্রতিমাসে একটা করে মাসুদ রানার বই বের হতো। জ্যাঠা প্রতিমাসে নিয়ম করে সেই মাসুদ রানাটি কিনতেন। এই জ্যাঠার সংগ্রহশালা থেকেই আমার মাসুদ রানা পড়ার শুরু। তবে, জ্যাঠাও অনেক সময়ে জ্যাঠামি করতেন। বই আনতে গেলে তিনি সব বই নিতে দিতেন না। এইটা পড়ে তুমি বুঝবা না, কঠিন হয়ে যাবে, এইরকম একটা না একটা অজুহাতে মাসুদ রানার অনেক বই-ই তিনি আমাকে পড়তে দিতেন না। তারপরেও যে দুই চারটা পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম, তাতেই নেশা ধরে গিয়েছিল আমার।

নেশা মেটানোর সুযোগ সীমিত। তাই মনমরা হয়ে এর ওর কাছ থেকে ধার করে পানসে পানসে বই পড়ে দিন কাটছিল আমার। ঠিক এরকম সময়েই খোঁজ পেলাম যে অন্য পাড়ায় এক ছেলে বই ভাড়া দেয়। তার কাছে মাসুদ রানার সব বই-ই আছে। শোনামাত্র ওই বাসা চেনে এমন একজনকে পাকড়াও করে হাজির হলাম সেখানে। আসলেই অনেক বই। দুটো শেলফ ভর্তি থরে থরে করে সাজানো। ইচ্ছামত যেটা খুশি সেটা নেওয়া যায়। কোনো ধরণের সেন্সরশীপের ব্যাপার-স্যাপার নেই।

একটা ডিপোজিট দিয়ে একাউন্ট খুললাম। কত টাকা দিয়েছিলাম, এখন আর খেয়াল নেই। কত ভাড়া ছিল বইগুলোর তাও মনে নেই এখন আর। আট আনা বা এক টাকা করে হবে হয়তো। মোটামুটি আয়ত্তের মধ্যে। পয়সা দিয়ে বই কেনার মত অসহনীয় এবং ক্ষমতার বাইরের ব্যাপার নয়।

ওখান থেকে বই এনে নেশা মিটাচ্ছিলাম নিয়মিতভাবেই। একদিন ওই বাসায় গিয়ে একটা নির্দিষ্ট বই খুঁজছিলাম। কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ওই সময় ওই ছেলে হঠাৎ একটা শক্ত বাধাই এর বই দেখিয়ে বলে যে, এই বইটা পড়েছো। একজন নতুন লেখকের লেখা। অনেক সুন্দর। এটা নিতে পারো। আমার তখন বই এর বিষয়ে এই ধারণা যে, পেপারব্যাক বই মানেই হচ্ছে আসল বই, উত্তেজনাকর বই। বাধাই বই মানেই হচ্ছে নিরস ধরণের সামাজিক বই। পয়সা দিয়ে এটা নেওয়ার চেয়ে মাসুদ রানার আরেকটা বই নেওয়াটা আমার জন্য অনেক বেশি আকর্ষণীয়। আমার মনের ভাবনা আর অনিচ্ছা টের পেয়েই তড়িঘড়ি করে ছেলেটা বলে যে, এর জন্য তোমাকে পয়সা দিতে হবে না। আমি ফ্রি দিচ্ছি। পড়ে ফেরত দিয়ে যেও। বইটা ছিল হুমায়ূন আহমেদের লেখা নন্দিত নরকে। আজকে এতদিন পড়ে ছেলেটার অনুভূতিটা টের পাই। কোনো ভালো বই পড়লে, এটা অন্যকে পড়ানোর জন্য এক ধরণের আকুলিবিকুলি প্রায় সব মানুষের মধ্যেই তৈরি হয়। তবে, ছেলেটার একটা কথা ঠিক ছিল না। বলেছিল যে, নতুন লেখকের নতুন বই। এই বইটা হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন একাত্তর সালে। বই আকারে কবে প্রকাশ হয়েছে তা জানি না। বইটা লেখার এক দশকেরও পরের সময়ে একে আর নতুন বই বলা যায় না। কিন্তু, তখন পর্যন্ত এটা মানুষের চোখের আড়ালে ছিল বলেই হয়তো বইটাকে নতুন বলে মনে হয়েছিল ছেলেটার কাছে।

বাসায় এসে আগে মাসুদ রানাগুলো শেষ করি। সবশেষে শুধু কিছু করার নেই এবং বই পড়ার নেশার কারণে হাতে তুলে নেই নন্দিত নরকে। নরক থেকে একটানে এই বই তুলে আনে আমাকে স্বর্গরাজ্যে। এর আগেও অনেক বই পড়ে কেঁদে ভাসিয়েছি আমি। কিন্তু এই প্রথম বই পড়াকালীন কান্নার সাথে সাথে অদ্ভুত ধরণের এক দীর্ঘস্থায়ী বিষণ্ণতা ছেয়ে ধরে আমাকে। বুকের মধ্যে চেপে ধরা কষ্ট নিয়ে বেশ অনেকগুলো দিন কাটে আমার। এই বইগুলো ফেরত দেওয়ার সময়ে ওই ছেলে জিজ্ঞেস করে, কেমন লেগেছে বইটা? খুব ভালো বলতেই উজ্জ্বল হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে যায় তার মুখ। বলে যে, এই লেখকের আরেকটা বই আছে। সেটা এরকমই সুন্দর। নেবে? এবার আর কোনো দ্বিধা নেই আমার। সঙ্গে সঙ্গেই বগলদাবা করে ফেলি ওটাও। আগেরটার মতই অসম্ভব সুন্দর একটা কাব্যিক নাম। শঙ্খনীল কারাগার।

শঙ্খনীল কারাগার পড়েও সেই একই অনুভূতি আমার। একই রকমের চাপা কষ্ট বুকের ভিতরে, একই রকমের বিষণ্ণতা জেকে বসা হৃদয় জুড়ে। আজ এতদিন পরেও জানি না, দুটো বই পড়ে একই রকমের অনুভূতি কেন হয়েছিল? অন্যদের কী রকম হয়? জানি না। তবে আমার কাছে নন্দিত নরকে আর শঙ্খনীল কারাগার জমজ উপন্যাস বলে মনে হয়েছে সবসময়ই। দুটোর লেখার স্টাইল, বিষয়বস্তুর মিলতো রয়েছেই, দুটো উপন্যাসে হুমায়ূন আহমেদ চরিত্রগুলোর হুবহু একই নাম রেখেছেন। হতে পারে যে, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে অত্যন্ত কাছাকাছি সময়ে তিনি দুটো উপন্যাসকে লিখেছিলেন। সেকারণেই একই আদলে গড়ে উঠেছে উপন্যাস দুটি।

এই দুটো উপন্যাস হুমায়ূন আহমেদের অত্যন্ত তরুণ বয়সের লেখা উপন্যাস। কোনটা প্রথম আর কোনটা দ্বিতীয় বলা মুশকিল। যতদূর মনে পড়ে হুমায়ূন আহমেদ কোথায় যেন বলেছিলেন যে, নন্দিত নরকে ছাপা হয়েছে আগে, কিন্তু শঙ্খনীল কারাগার লেখা হয়েছিল নন্দিত নরকের আগে। সে কারণেই আমি এই দুটোকে একসাথে তাঁর প্রথম উপন্যাস বলে বিবেচনা করে থাকি। মজার বিষয় হচ্ছে যে, অপরিণত বয়সে লেখা এ দুটো উপন্যাসই হুমায়ূন আহমেদের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। এই দুটো উপন্যাসের পরে যদি তিনি আর কিছু না লিখতেন, তবে বাংলা সাহিত্য তাঁকে পুজো করতো অসামান্য প্রতিভাবান একজন মানবিক লেখক হিসাবে। তাঁর দুর্ভাগ্য তিনি আরো অসংখ্য উপন্যাস লিখেছিলেন, যেগুলোর বেশ কিছু ভালো মানের আর অধিকাংশগুলোই বস্তাপচা। এই বস্তাপচাগুলোর ক্ষোভেই লোকে তাঁকে নামিয়ে দিয়েছে সাধারণ একজন লেখকের কাতারে। অথচ তারা ভুলে গেছে যে, শঙ্খনীল কারাগার আর নন্দিত নরক ছাড়াও তিনি লিখেছেন মধ্যাহ্ন, জোছনা ও জননীর গল্প, কবি, মাতাল হাওয়া, কোথাও কেউ নেই, আগুনের পরশমণি, বাদশাহ নামদার, শ্যামল ছায়ার মত উপন্যাসসমূহ। হুমায়ূন আহমেদের সেরা দশটি উপন্যাস বাছাই করে নিয়ে এক পাল্লায় ফেলে যদি বলা হয় যে গত চল্লিশ বাংলাদেশের বাকি সব সাহিত্যিকদের সব লেখা থেকে বাছাই করে নিয়ে এসে অন্য পাল্লায় ফেলা হোক, আমার নিশ্চিত বিশ্বাস হুমায়ূন আহমেদের পাল্লাই ভারি হবে। তারপরেও এই ভদ্রলোককে নিয়ে আমাদের কত কত আজেবাজে কথা। তার সৃষ্টির সাহিত্যমূল্য দিতে কী অপরিসীম কার্পণ্য আমাদের।

নন্দিত নরকে এবং শঙ্খনীল কারাগারের পরে দীর্ঘদিন তিনি আর কিছু লেখেন নি। বিদেশে ছিলেন। পড়াশোনা শেষ করে যখন দেশে ফিরে আসেন, তখন তাঁর হাত শূন্য। এই সময়েই কেউ একজন তাঁকে পরামর্শ দেয় কাজী আনোয়ার হোসেনের কাছে যেতে। সেবা প্রকাশনীই বাংলাদেশের একমাত্র প্রকাশনী যারা বাড়িতে গিয়ে হলেও লেখকদের দেনা-পাওনা মিটিয়ে দেয়। কাজী আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে দেখা করার পরে তাঁর হাতে গছিয়ে দেওয়া হয় এ জে কুইনেলের ম্যান অন ফায়ার বইটি। এই বই অবলম্বনে একটা থ্রিলার উপন্যাস লিখে দেবেন হুমায়ূন আহমেদ, এটাই ছিল প্রত্যাশা। এই বইয়ের অনুসরণে হুমায়ূন আহমেদ ছোট্ট একটা উপন্যাস লেখেন অমানুষ নামে। এটি দুটি খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছিল রহস্য পত্রিকায়। হুমায়ূন আহমেদের এই কাজে সন্তুষ্ট হতে পারেন নি কাজী আনোয়ার হোসেন। পরে তিনি এটাকে অবলম্বন করে মাসুদ রানা সিরিজে বই লেখেন অগ্নিপুরুষ নামে। অগ্নিপুরুষ রানা সিরিজের অন্যতম সেরা একটা বই। কাজী আনোয়ার হোসেন হুমায়ূন আহমেদের কাজে অসন্তুষ্ট হলেও তাঁদের মধ্যে সম্পর্কচ্যূতি ঘটে নি। হুমায়ূন আহমেদের প্যারাসাইকোলজির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা সিক্যুয়েল উপন্যাস দেবী এবং নিশীথিনী প্রথম পেপারব্যাকে প্রকাশিত হয় সেবা থেকেই। এই দুই উপন্যাস দিয়েই জন্ম হয় বাংলা সাহিত্যের অসাধারণ এক চরিত্র মিসির আলীর। সুকঠিন যুক্তিবাদী এবং অসাধারণ কোমল মনের একজন মানুষ তিনি।

শুধু মিসির আলীই নয়, হুমায়ূন সৃষ্টি করেছেন হিমুর মত এক অযুক্তিবাদী চরিত্র। হিমু আর কেউ নয়, মিসির আলীরই বিপরীত চরিত্র। মিসির আলীর প্রতিটা কাজ যেখানে হিসেবী, হিমু সেখানে চরম বেহিসেবী এক চরিত্র। মিসির আলী যেখানে যুক্তির বাইরে এক পাও নড়েন না, হিমু সেখানে নির্দ্বিধায় অযৌক্তিক কাজ-কারবার করে বেড়ায়। মিসির আলী বা হিমুর বাইরে তিনি সৃষ্টি করেছেন শুভ্র নামের এক অসম্ভব রূপবান তরুণকে। যে তার নামের মতই শুচিশুভ্র, পবিত্র। জগতের কোনো কালিমা তাকে স্পর্শ করে নি।

এগুলো হচ্ছে সিক্যুয়েলের চরিত্র। একটা মাত্র বইয়ে এরা সীমাবদ্ধ নয়। এই চরিত্রগুলো নিয়ে তিনি অসংখ্য বই লিখেছে। এর বাইরেও অসংখ্য স্মরণীয় চরিত্র এঁকেছেন তিনি। তাঁর সৃষ্ট অয়োময়ের মির্জা, লাঠিয়াল সর্দার, কোথাও কেউ নেই এর বাকের ভাই বা মুনা, বহুব্রীহির মামা, নান্দাইলের ইউনুস, এইসব দিনরাত্রির টুনি, নন্দিত নরকের রাবেয়া বা মণ্টু আমাদের মানসপটে উজ্জ্বল হয়ে ভেসে আছে।

আশির দশক হচ্ছে হুমায়ূন আহমেদের দশক। এই এক দশকেই তিনি পালটে দিয়েছেন অনেক কিছু। একের এক বই লিখে জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে গেছেন তিনি। হুহু করে বিক্রি হয়েছে তাঁর বই। তৈরি হয়েছে অসংখ্য পাঠক সারাদেশ জুড়ে। এর আগে বাংলাদেশের বাজার ছিল পশ্চিম বঙ্গের বুদ্ধিবেনিয়াদের দখলে। হুমায়ূন একাই সবগুলোকে কুপোকাত করে ছাড়েন। বাংলাদেশের মানুষ আগে বাংলাদেশের লেখকদের বই কিনতো না, কিনতো পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের বই। হুমায়ূন সবাইকে ধাক্কিয়ে পিছনের সারিতে নিয়ে যান। বই মেলা জমে উঠে হুমায়ূনের বই দিয়ে।

আশির দশকের শেষের দিকে আর নব্বই এর শুরুর দিকে আন্নার সাথে চুটিয়ে প্রেম করছি আমি। ওকে খুশি করার জন্য নানান রকমারি উৎসবের দিনে বই উপহার দিয়েছি তখন। এর সবগুলোই হুমায়ূন আহমেদের বই। সাত বছর আগে শেষবারের মত দেশে গিয়েছিলাম আমি। গিয়ে দেখি আমার শ্বশুরবাড়িতে সেগুলো খুব যত্নে আরো অনেক বইয়ের সাথে রাখা। ওই বইগুলো খুলে আমার কানটান লজ্জায় লাল হবার দশা। সব বইয়ের শুরুতে প্রথম তারুণ্যের ভালোবাসার উচ্ছ্বাসে রোম্যান্টিক রোম্যান্টিক কি সব কথাবার্তা লেখা রয়েছে। বিব্রত হয়ে আমি আন্নাকে বলি যে, “এগুলো কি আমি লিখছিলাম।“ ও গলায় নিমের শরবত ঢেলে বলে যে, “জ্বী, জনাব। আপনিই ওইগুলো লিখছিলেন। তখনতো প্রেমিকা ছিলাম। কোকিলের কুহুতান বের হতো আপনার গলা দিয়ে। এখন বান্দি হইছি। তাই কাকের মত কর্কশ চিৎকার বের হয়। আমাকে দূর করতে পারলেই বাঁচেন আপনি।“

তাঁর হাত দিয়েই প্রথম বেরিয়ে আসে বাংলাভাষার সত্যিকারের সায়েন্স ফিকশন। অনেকেই হয়তো আশ্চর্য হবেন। এই কৃতিত্বটা মুহাম্মদ জাফর ইকবালকে দিতেই উন্মুখ আমরা। কিন্তু সত্যি কথা হচ্ছে বাংলা ভাষার সত্যিকারের কল্পবিজ্ঞান লেখার জনক তিনি। তাঁর লেখা তোমাদের জন্য ভালবাসা, ফিহা সমীকরণ কিংবা  ইরিনা মন কেড়ে নেবার জন্য যথেষ্ট।

শুধু বইয়ের জগত নয়। টেলিভিশনও দখল নিয়ে নেন তিনি। একের পর এক জনপ্রিয় ধারাবাহিক রচনা করে মাত করে দেন মধ্যবিত্তকে তিনি। টিভি নাটকে সত্যিকারের হাস্যরসও তাঁর অবদান। তাঁর আগে আমজাদ হোসেন জব্বার আলী নামের এক অখাদ্য এবং স্থূল রুচির নাটক দিয়ে ভাঁড়ামো করে লোক হাসানোর চেষ্টা করতেন। হুমায়ূন আহমেদ এসে দেখিয়ে দিলেন সূক্ষ্ণ রসবোধ কাকে বলে। তাঁর নাটক দেখে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে নি, এমন লোক ওই দশকে একজনও পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ আছে।

তবে এগুলোর কোনোটাই নয়। আমার কাছে হুমায়ূনের সেরা কাজ হচ্ছে তাঁর ছোটগল্প। অন্যসব বিশাল কাজের ডামাডোলে খুব নীরবে তিনি লিখে গেছেন অসংখ্য অসাধারণ ছোটগল্প। গত চল্লিশ বছরে তাঁর সমতুল্য কেউ আসে নি এই ক্ষেত্রে। কোনো যাদু বাস্তবতা নয়, নয় কোনো পরীক্ষা নিরিক্ষা, খুব সহজ সরল ভাষায় সাধারণ সব মানুষকে চরিত্র করে অনন্য সব গল্প লিখে গেছেন তিনি।  চোখ, জলিল সাহেবের পিটিশন, ১৯৭১ এর মত গল্পগুলো অনেক অনেক বছর পরে তাঁদের সঠিক মূল্যায়ন পাবে বলেই আমার বিশ্বাস।

হুমায়ূন আহমেদের মানের পতন ঘটেছে জনপ্রিয়তার শীর্ষে ওঠার পরে। এর জন্য আমি কোনো দোষ দেই না। জনপ্রিয় একজন সাহিত্যিককে অনেক চাপ সামলাতে হয়। অসংখ্য লোক লেখার বায়না নিয়ে বসে থাকে। কেউ কেউ অগ্রিম টাকা পর্যন্ত দিয়ে আসে জোর করে। এইসব ফরমায়েশি লেখার মান এর থেকে ভালো কিছু হবার কথা নয়। সে কারণেই তিথির নীল তোয়ালে বা হিমুর হাতে কয়েকটি নীল পদ্মের মত আবর্জনা তৈরি হয়। এই সমস্যাতে শুধু হুমায়ূন আহমেদ না, তসলিমাকেও পড়তে দেখেছি আমরা। তসলিমার প্রায় সব উপন্যাসগুলোই ফরমায়েশি লেখা। প্রকাশকরা লেখার আগেই জোর করে টাকা রেখে যেতো তসলিমার বাসার টেবিলের উপর। সে কারণেই আমরা দেখি তসলিমার উপন্যাসগুলোর কী করুণ দশা।

তবে, এই সমস্ত লেখার জন্য কোনো ভাণ-ভণিতা হুমায়ূন আহমেদ কখনোই করেন নি। লেখা দিয়ে সমাজ পালটে দিতে হবে, এই সমস্ত সস্তা চটকদার সংলাপে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না। স্মৃতি যদি প্রতারণা না করে তবে আমার মনে পড়ে যে একসময় কয়েকটা নাটকের শুরুতে তিনি বিদ্রুপ করে লিখে দিয়েছিলেন যে, এখানে শিক্ষণীয় কিছু নেই। তাঁর একটা বই দেখে একবার আহমেদ ছফা (বেজায় ঠোঁটকাটা লোক ছিলেন তিনি) তাঁকে সরাসরি বলেছিলেন যে, এই সব ছাইপাশ লিখছেন কেন? হুমায়ূন আহমদে কোনো মিথ্যা অজুহাত তৈরি করেন নি। সরাসরি বলেছিলেন যে, টাকার জন্য লিখেছি। ওটা লিখে যে টাকা পেয়েছি তা দিয়ে বাচ্চাদের জন্য রঙিন টেলিভিশন কিনেছি। এরকমই স্পষ্টভাষী ছিলেন তিনি।

একটা জিনিস এখানে বলে যাই। হুমায়ূন আহমেদের বইগুলোর মধ্যে প্রিয় কোনটা জিজ্ঞেস করলে বেশিরভাগ লোকই নন্দিত নরকে আর শঙ্খনীল কারাগারের কথা বলবে। আমার এ দুটো অবশ্যই পছন্দের। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সেরা পছন্দ হচ্ছে আগুনের পরশমণি নামের মাঝারি আকৃতির উপন্যাসটি। এই উপন্যাসের পটভূমি আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। ঢাকায় আরবান গেরিলাদের আক্রমণ উঠে এসেছে এখানে। একজন নির্লিপ্ত আরবান গেরিলার এক নিম্নমধ্যবিত্ত বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে শহরে নানান ধরণের আক্রমণ পরিচালনার গল্প এটি। কী যে দারুণ মুন্সিয়ানা আর দরদ দিয়ে হুমায়ূন ফুটিয়ে তুলেছেন মুক্তিযুদ্ধকে, মুক্তিযোদ্ধাদের আর দেশের প্রতি মমতা মাখানো সাধারণ মানুষদের। অতুলনীয়। কত কত অসংখ্যবার যে আমি পড়েছি এই উপন্যাসটা তার ইয়ত্তা নেই। কত যে চোখের কোণ ভিজেছে আমার উপন্যাসটা পড়তে গিয়ে তার কোনো হিসেব নেই আমার কাছে। এক সময় স্বপ্ন দেখতাম ফিল্ম বানাবো। যদিও এর ধারে কাছেও যাওয়া হয় নি আমার। ওই স্বপ্নের সাহসেই হয়তো মনে মনে এই উপন্যাসের চিত্রনাট্য সাজাতাম আমি। একদিন হুট করে শুনি হুমায়ূন আহমেদ নিজেই এই উপন্যাস নিয়ে চলচ্চিত্র বানানোর ঘোষণা দিয়েছেন। একজন প্রথিতজশা সাহিত্যিক, যাঁর চলচ্চিত্র বানানোর কোনো অভিজ্ঞতা, শিক্ষা বা অতীত আগ্রহ নেই, নিজের উপন্যাস নিয়ে চলচ্চিত্র বানানোতে নেমে পড়াটা একটা বিরল ঘটনা।

পরিচালক হবার জন্য এফডিসিতে বিভিন্ন পরিচালকদের সমন্বয়ে গড়া একটা বোর্ডের সামনে তাঁকে পরীক্ষাও দিতে হয়েছিল। সেই পরীক্ষায় তেত্রিশ পেয়ে কোনো রকমে পাশ করেছিলেন তিনি। ফেলই করার কথা ছিল অবশ্য। তাঁকে চাষী নজরুল ইসলাম প্রশ্ন করেছিলেন যে, একজন পরিচালকের কী কাজ? এর উত্তরে হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন যে, কিছু না, শুধু নায়িকার সাথে ফস্টিনস্টি করা। এই উত্তরের পরে তাঁকে যে পাশ করিয়ে দেওয়া হয়েছিল, এটা ভাগ্য। ভাগ্য বলছি এ কারণে যে, আগুণের পরশমণি ছাড় পাবার পরে তা শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসাবে জাতীয় পুরষ্কার পেয়েছিল। সৃষ্টিশীলতা যে পাঠ্যবই পড়ে হয় না, বা পরীক্ষা পাশ করে হয় না, এই বিষয়টা আমাদের শিল্পাঙ্গনের লোকেরাও মনে হয় জানেন না।

আমার অবশ্য এই ছবিটা বেশি পছন্দ হয় নি। আগুনের পরশমণি উপন্যাস হিসাবে যে রকম, ঠিক সেই আমেজটা আমি চলচ্চিত্রে পাই নি। চাঁদ, জোছনা, বৃষ্টি এগুলোর প্রতি হুমায়ূন আহমেদের অতিরিক্ত প্রীতি আর চরিত্র অনুযায়ী শিল্পী নির্বাচনের ব্যর্থতা চলচ্চিত্রের গতিকে ব্যহত করেছে। তাঁর সব চলচ্চিত্রের মধ্যে, আমার মতে, সেরা কাজ হচ্ছে শ্রাবণ মেঘের দিন। এইটা একটা সিনেমা বটে। কী যে দরদ দিয়ে বানিয়েছেন তিনি এই চলচ্চিত্রটি।

জোছনা আর বৃষ্টির গল্প যখন এলো, তখন একটু বলেই ফেলি। আজকে বাংলাদেশে তরুণ তরুণীদের মধ্যে জোছনাস্নাত হওয়া বা বৃষ্টিস্নাত হওয়ার যে একটা রোম্যান্টিক ভাবনা ব্যাপকভাবে কাজ করে, এর পিছনে একক অবদান হচ্ছে হুমায়ূন আহমেদের। তাঁর অত্যন্ত শখের এই জিনিসগুলো তিনি বার বার তাঁর গল্প, উপন্যাস, নাটক আর চলচ্চিত্রে ব্যবহার করে, এই সময়ের ছেলেমেয়েদের মগজের মধ্যে তা গেথে দিয়েছেন। মানুষকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা তার অপরিসীম। সে কারণে আজকাল অনেক ছেলেপেলে হিমুর মত হলুদ পাঞ্জাবি পরে খালি পায়ে রাজপথে হেটে যায়।

আমি সাহিত্যবোদ্ধা নই। খুব বেশি সাহিত্যপঠনও আমার হয় নি। কিন্তু, অসংখ্য সাহিত্যিকের বইয়ের গাদা থেকে বই বাছাই করে আমাকে যদি পড়তে বলা হয়, তবে আমি প্রথমে তিনজন লেখকের বই বেছে নেবো। এই তিনজন হচ্ছেন হুমায়ূন আহমেদ, মুহাম্মদ জাফর ইকবাল এবং কাজী আনোয়ার হোসেন। নাহ! এই তিনজনকে আমি শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক বলে মনে করি না। কিন্তু এই তিনজনের ভয়ংকর শক্তিশালী একটা অস্ত্র আছে, যা বাংলা ভাষার অন্য কোনো সাহিত্যিকের নেই। সেটা হচ্ছে ভাষা। এই তিনজনের গদ্যশৈলী অসম্ভব ঝরঝরে, ছুটে চলা ঝরনার মত ঝিরঝির বহমান, অতি সাদামাটা, আটপৌরে, অলংকরণ শূন্য, নিরাভরান, বাহুল্যবর্জিত ছিপছিপে মেদহীন, কিন্তু মোনালিসার হাসির মতই মোহনীয়, সম্মোহনশক্তিসম্পন্ন। বইয়ের প্রথম লাইন পড়লে আর থামা যায় না। অনেকটা সিডনি শেলডনের বইয়ের মত। ভাষাই টেনে নিয়ে যেতে থাকে লাইন থেকে লাইনে, পৃষ্ঠা থেকে অন্য পৃষ্ঠায়, এক বই থেকে আরেক বইয়ে।

জীবনের শেষ দিকে এসে তাঁর ব্যক্তিজীবন নিয়ে খুব বেশি টানাটানি করেছে লোকে। একজন মানুষের ব্যক্তিগত জীবন যে তাঁর নিজস্ব একটা বিষয়, সেই বোধটা আমাদের অনেক লোকের মধ্যেই খুব একটা বেশি নেই। আমরা আমাদের নৈতিকতার স্ট্যান্ডার্ডকে দাঁড় করিয়ে দেই একজন সফল মানুষের সামনে। তারপর সেই মাণদণ্ড দিয়ে বিচার করতে চাই তাঁর জীবনকে। হুমায়ূন আহমেদ কেন মেয়ের বান্ধবীকে বিয়ে করলো, কেন এতো প্রেম করে বিয়ে করা  আর চার সন্তানের জননী স্ত্রীকে ছেড়ে দিয়ে ওই কচি মেয়েকে বিয়ে করলো, ইত্যাকার নানান সমালোচনায় তাঁর জীবনটাকে বিষিয়ে দিয়েছে মানুষ। এগুলো যে তাঁর ব্যক্তিগত বিষয়, সেই বোধটা কারো মধ্যে জন্মায় নি কখনো। তাঁর এই নৈতিক অধঃপতনও (!) তাঁর জনপ্রিয়তা কমে যাওয়া এবং অসংখ্য সমালোচক তৈরি হবার অন্যতম একটা কারণ।

হুমায়ূন আহমেদ তাঁর বাদশাহ নামদার উপন্যাসের ভূমিকাতে হুমায়ূনকে নিয়ে উপন্যাস লেখার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন এভাবেঃ

হুমায়ূন অতি বিচিত্র এক চরিত্র। যেখানে তিনি সাঁতারই জানেন না। সেখানে সারা জীবন তাঁকে সাঁতরাতে হয়েছে স্রোতের বিপরীতে।

সম্রাট হুমায়ূন বহুবর্ণের মানুষ। তাঁর চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে আলাদা রঙ ব্যবহার করতে হয় নি। আলাদা গল্পও তৈরি করতে হয় নি। নাটকীয় সব ঘটনায় তাঁর জীবন পূর্ণ।

আমাদের এই হুমায়ূনেরও তাই। নাটকীয় সব ঘটনায় তাঁর জীবন পূর্ণ। বর্ণিল তাঁর কর্মকাণ্ড। এখানে তাঁকে ফুটিয়ে তুলতে আমার আলাদা কোনো ব্রাশ দিয়ে রঙ ছড়াতে হয় নি। হুমায়ূন আহমেদ নিজেই এমন সাতরঙের সমাহার যে, তিনি আপন বৈশিষ্ট্যেই ফুটে উঠেছেন এখানে।

আজ অনেকদিন পর বাদশাহ নামদার বইটা খুলতে গিয়ে একটা জিনিস চোখে পড়লো। আগেও দেখেছি, কিন্তু মনোযোগ দেই নি এতে। এই বইটা তিনি উৎসর্গ করেছেন তাঁর শিশুপুত্র নিনিতকে। সেই উৎসর্গপত্রটা এখানে তুলে ধরার লোভ সামলাতে পারছি না। উৎসর্গপত্রটা এরকমঃ

আমার কেবলই মনে হচ্ছে পুত্র নিনিত পিতার কোনো স্মৃতি না নিয়েই বড় হবে। সে যেন আমাকে মনে রাখে এইজন্যে নানান কর্মকাণ্ড করছি। আমি ছবি তুলতে পছন্দ করি না। এখন সুযোগ পেলেই নিনিতকে কোলে নিয়ে ছবি তুলি। এই বইয়ের উৎসর্গপত্রও স্মৃতি মনে রাখা প্রকল্পের অংশ।

হুমায়ূন আহমেদ তাহলেও নিজেও আশংকা করেছিলেন যে, আর বেশিদিন টিকবেন না তিনি। তাই সত্যি হলো। মৃত্যুর আগেও তাঁর প্রবল রসবোধ কমে নি। নিউইয়র্ককে লোকজনকে দাওয়াত করে বলতেন যে, আমার চল্লিশা খেয়ে যান। মরার পরেতো পারবো না, তাই আগেই খাইয়ে দিচ্ছি আপনাদের।

মৃত্যুকে নিয়ে এমন প্রবল রসিকতা শুধু হুমায়ূন আহমেদই করতে পারেন। কুর্নিশ আপনাকে বাদশাহ নামদার।