(আগের পর্বের পর…)

২.০ : চার্বাক নামের উৎস

ভারতীয় দর্শন সাহিত্যে বস্তুবাদী দর্শনটির নজির যত প্রাচীনই হোক-না কেন, এ মতবাদের চার্বাক নামকরণ সে তুলনায় অর্বাচীন। অষ্টম-নবম শতকের আগে দর্শন সাহিত্যে এ নামের কোন উল্লেখযোগ্য নিদর্শন চোখে পড়ে না। প্রাচীনেরা এ মতটিকে প্রধানত লোকায়ত নামেই উল্লেখ করেছেন। ওই অষ্টম-নবম শতক থেকেই বস্তুবাদী অর্থে লোকায়ত বা চার্বাক মতের সমালোচনায় বিশিষ্ট ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা যায় বিভিন্ন মতের দার্শনিকগণকে। এদের মধ্যে নবম শতকের ন্যায় দার্শনিক জয়ন্ত ভট্ট প্রধানতম। অন্যরা হলেন অষ্টম শতকের বৌদ্ধ আচার্যদ্বয় শান্তরক্ষিত ও কমলশীল এবং জৈন দার্শনিক হরিভদ্র সূরী।
.
লোকায়ত নামে চার্বাক মতের প্রাচীনতম অন্তর্ভুক্তির নিদর্শন হরিভদ্র সূরীর ‘ষড়দর্শনসমুচ্চয়’ গ্রন্থ উল্লেখযোগ্য হলেও বস্তুবাদ অর্থে চার্বাক শব্দের সুস্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায় কমলশীলের ‘তত্ত্বসংগ্রহ পঞ্জিকা’ গ্রন্থে, যা কমলশীলের ‘পঞ্জিকা’ নামে খ্যাত। কমলশীলের এই বিশাল গ্রন্থ মূলত তাঁর গুরু শান্তরক্ষিত রচিত ‘তত্ত্বসংগ্রহ’ গ্রন্থের ব্যাখ্যা। শান্তরক্ষিত ভারতীয় দর্শনের প্রথা অনুসারে পরমত খণ্ডন করে স্বীয় মত স্থাপন করার লক্ষ্যে প্রচলিত দার্শনিক মতগুলো খণ্ডন করে স্বীয় বৌদ্ধ মতের সমর্থনে ‘তত্ত্বসংগ্রহ’ গ্রন্থটি রচনা করেন। কিন্তু ওখানেও লোকায়ত হিসেবে বস্তুবাদী মতের সমালোচনা থাকলেও চার্বাক শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায় না। কিন্তু কমলশীলের ‘পঞ্জিকা’য় এই বস্তুবাদ সুস্পষ্টভাবেই চার্বাক নামে অভিহিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি চার্বাকমতের প্রবক্তা হিসেবে পুরন্দর নামে জনৈক পূর্ববর্তী দার্শনিকের নামও উল্লেখ করেছেন। চার্বাকী সাধারণ ধারণার ব্যতিক্রম হিসেবে এই পুরন্দর লৌকিক অনুমানকে প্রমাণের অন্তর্ভুক্ত করেছেন, যদিও অলৌকিক কোন ধারণাকে এই অনুমানের মাধ্যমে স্বীকৃতি দিতে তাঁর অসম্মতির পরিচয় পাওয়া যায়। তবে পুরন্দর রচিত কোন গ্রন্থের কথা আদৌ জানা যায় না।
.
চার্বাক মতের প্রধানতম সমালোচক নবম শতকের ন্যায়-বৈশেষিক সম্প্রদায়ের প্রখ্যাত প্রতিনিধি জয়ন্ত ভট্ট। জয়ন্ত ভট্টের পাণ্ডিত্য যেমন প্রগাঢ়, যুক্তি ও বিচার যেমন প্রখর, তেমনি তাঁর আশ্চর্য লেখার কায়দা বা রচনা কৌশলের বন্যায় যেন বিপক্ষমতকে একেবারে ভাসিয়ে নেবার মতো। স্বীয় মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি তাঁর রচিত ‘ন্যায়মঞ্জরী’ গ্রন্থে অন্যতম বিপক্ষ মত খণ্ডনে চরম বস্তুবাদী মত বোঝাতে সুস্পষ্টভাবে চার্বাক শব্দ ব্যবহার করেছেন। এবং তার সঙ্গে রকমারি বিশেষণ যোগ করে মতটি নিয়ে তিনি হাসি-তামাশা ঠাট্টা বিদ্রূপ করতেও পিছপা হননি। কোথাও তিনি চার্বাককে হাবাগোবা অর্থে ‘বরাক’ বলে উল্লেখ করেছেন ‘চার্বাকাস্তু বরাকাঃ’ উদ্ধৃতি দিয়ে, কোথাও বা চার্বাককে তুখোড় প্রতারক অর্থে ‘ধূর্ত’ বলে বর্ণনা করেছেন। আবার কোথাও ‘সুশিতিতরাঃ’ বিশেষণও ব্যবহার করেছেন। জয়ন্ত ভট্টের এরকম বিচিত্র বিশেষণ ব্যবহার থেকে ঐতিহাসিকেরা চার্বাকদের বিভিন্ন প্রাচীন গোষ্ঠির উপস্থিতির অনুমানও করে থাকেন। তবে একাধিক গোষ্ঠি থাকলেও জয়ন্ত ভট্টের লেখায় চার্বাক শব্দ চরম বস্তুবাদেরই নিদর্শক হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে।
.
খ্রীস্টিয় অষ্টম শতকে রচিত জৈন দার্শনিক হরিভদ্র সূরীর ‘ষড়দর্শনসমুচ্চয়’ নামকরণেই বোঝা যায় সেকালের ছটি প্রখ্যাত দার্শনিক মতের বিচারমূলক পর্যালোচনা এই গ্রন্থের বিষয়বস্তু। এই পর্যালোচনার ভিত্তিতে জৈন মতের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণই এর উদ্দেশ্য। সেকালের প্রখ্যাত ছটি দার্শনিক মতের অন্যতম ছিলো বস্তুবাদী লোকায়ত মত। হরিভদ্র কোথাও চার্বাক শব্দটি উল্লেখ না-করলেও বুঝতে অসুবিধা হয় না যে ‘ষড়দর্শনসমুচ্চয়’ গ্রন্থে চার্বাক এবং লোকায়ত অভিন্ন। এই ‘ষড়দর্শনসমুচ্চয়’ গ্রন্থের বিশদ ব্যাখ্যা হিসেবে আনুমানিক চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতকের প্রখ্যাত জৈন দার্শনিক গুণরত্ন রচনা করেন বিখ্যাত ‘তর্করহস্যদীপিকা’ টীকাগ্রন্থটি। এটারও উদ্দেশ্য ছিলো অন্যান্য দার্শনিক মত আরো বিশদভাবে বিচার করে জৈন মতই সবচাইতে সেরা এরূপ সিদ্ধান্ত করা। এই অন্যান্য মতের অন্যতম চরম বস্তুবাদেরও বিস্তৃত বিচার করা হয় এ গ্রন্থে এবং গুণরত্নের রচনায় এই বস্তুবাদ চার্বাক নামেই অভিহিত হয়েছে।
একইভাবে বেদব্যস বা বাদরায়ন রচিত ‘ব্রহ্মসূত্র’-র প্রখ্যাত ভাষ্যকার রামানুজ একাদশ শতকে তাঁর রচিত ভাষ্যগ্রন্থে বস্তুবাদী দর্শনকে চার্বাক নামেই অভিহিত করেছেন।
.
তবে বিভিন্ন দার্শনিক মতের পর্যালোচনা হিসেবে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ গ্রন্থটি হলো চতুর্দশ শতকের অদ্বৈত বৈদান্তিক দর্শনকার সায়ণ মাধবাচার্যের ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’। অদ্বৈত বেদান্তই যে শ্রেষ্ঠ দার্শনিক মত- এটি প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যেই সেকালে প্রচলিত আরো পনেরোটি দার্শনিক মত বিচারমূলকভাবে খণ্ডন করার বিস্তৃত প্রয়াস এই গ্রন্থ। এ লক্ষ্যে তিনি সর্বপ্রথম যে মতটি খণ্ডন করার প্রয়োজন অনুভব করেছেন তা হলো বস্তুবাদী দর্শন। এবং মাধবাচার্য তাকে চার্বাক নামেই উল্লেখ করেছেন। এজন্যেই তাঁর গ্রন্থের প্রথম পরিচ্ছেদের শিরোনাম ‘চার্বাক-দর্শনম’।
.
চার্বাক বলতে যে এক প্রখর বস্তুবাদী দর্শনই বোঝায়- এ ধারণাই হয়তো পরবর্তীকালের ভারতীয় সাহিত্যে খুবই প্রসিদ্ধি লাভ করে। এমন কি দার্শনিক সাহিত্য পেরিয়ে এই ধারণার প্রভাব যে নাট্যসাহিত্যকেও প্রভাবিত করেছে তার প্রমাণ একাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে কৃষ্ণমিশ্র রচিত রূপক নাটক ‘প্রবোধচন্দ্রোদয়’। এ নাটকের বস্তুবাদী দর্শনের প্রতীক চরিত্রটির নাম ‘চার্বাক’।
.
চার্বাক নামের উৎস খুঁজতে গিয়ে চার্বাক শব্দটির দু’রকম মানে দাঁড় করাবার চেষ্টাও চোখে পড়ে। প্রথমতঃ ‘চারু বাক্’ থেকে চার্বাক, এবং দ্বিতীয়তঃ ‘চর্ব’ (অর্থাৎ চর্বণ) থেকে চার্বাক। প্রতিপক্ষের কটাক্ষ বা বিদ্রূপ থেকেই এই মানে তৈরির প্রবণতা লক্ষ্যণীয় বলে কারো কারো ধারণা। কেননা ব্যাকরণের সাধারণ নিয়ম অনুসারে কোনটাই টেকে না বলে পণ্ডিতদের অভিমত।
.
খ্রীস্টিয় সপ্তম বা তার পরবর্তীকালে ভারতীয় সাহিত্য ও দর্শনে প্রখর জড়বাদী মতবাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এই ‘চার্বাক’ শব্দটি সুপরিচিতি লাভ করলেও প্রাচীন সাহিত্যে এ শব্দটি একেবারেই নিরব। বিশিষ্ট চিন্তাধারাকে স্বনামে পরিচিত করার উপযোগী ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কোন চার্বাকের অস্তিত্বের সমর্থনে কোন তথ্যের একান্তই অভাব বলে চার্বাক নামটির উৎস নিয়ে একটা অনুন্মোচিত রহস্যের জট থেকেই যায়। তবে প্রাচীন সাহিত্য হিসেবে মহাভারতের শান্তিপর্বে রাজধর্মানুশাসন প্রসঙ্গে চার্বাক নামে এক রাক্ষসের উপাখ্যান আছে (মহাভারত : ১২/৩৮/২২-৩৬)। ‘সাক্ষ্য, শিখী এবং ত্রিদণ্ডী’ ব্রাহ্মণরূপী এ রাক্ষস চার্বাক ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের পরম শত্র“ দুর্যোধনের সখা এবং প্রচলিত ব্রাহ্মণ্যমতের তীব্র সমালোচক হিসেবে চিত্রিত হয়েছে। মহাভারতকে আমরা বর্তমানে যে আকারে পাই তার রচনাকালের পূর্ব সীমা খ্রীস্টপূর্ব চতুর্থ এবং শেষ সীমা খ্রীস্টিয় চতুর্থ শতক বলে সাধারণত ধরে নেয়া হয়। আর মহাভারতের এই অংশের রচনাকাল আনুমানিক খ্রীস্টিয় চতুর্থ শতক। চার্বাক দর্শনের ইতিহাস বা চার্বাকের উৎস খুঁজতে গিয়ে আগ্রহী গবেষকদের দৃষ্টি মহাভারতের এই উপাখ্যানের দিকেই আকর্ষিত হয় স্বাভাবিকভাবে। কিন্তু এখানে জড়বাদ বা নাস্তিক্যবাদ সম্বন্ধে কোন কথা নেই। বরং যুধিষ্ঠিরের রাজসভায় এই চার্বাকের স্বল্পস্থায়ী উপস্থিতি রাজা যুধিষ্ঠিরকে অপমান করতেই ব্যয়িত হয়েছে, যার পরিণামে সভায় ক্রমাগত ব্রাহ্মণদের রোষাগ্নিতে দগ্ধ হয়ে তাঁর জীবনাবসান ঘটে। মহাভারতের উপাখ্যানটি এরকম-

‘পাণ্ডবগণের পুরপ্রবেশকালে সহস্র সহস্র পুরবাসী-প্রজা দর্শনাকাঙ্ক্ষী হইয়া তথায় আগমন করিতে লাগিল। …ঐ সময় সহস্র ব্রাহ্মণ প্রীতিপ্রফুল্লচিত্তে ধর্মরাজকে আশীর্বাদ করিতে লাগিলেন। ঐ সমুদয় ব্রাহ্মণের মধ্যে দুর্যোধনের সখা দুরাত্মা চার্বাক রাক্ষস ভিক্ষুকরূপ ধারণ পূর্বক অবস্থান করিতেছিল। ঐ পাপাত্মা পাণ্ডবগণের অপকার করিবার বাসনায় ব্রাহ্মণগণ নিস্তব্ধ হইলে তাঁহাদিগকে কোন কথা জিজ্ঞাসা না-করিয়াই নির্ভীকচিত্তে উচ্চৈঃস্বরে গর্বিতবাক্যে যুধিষ্ঠিরকে সম্বোধন পূর্বক কহিল,-

.
চার্ব্বাক উবাচ।
ইমে প্রাহুর্দ্বিজাঃ সর্ব্বে সমারোপ্য বচো ময়ি।
ধিগ্ভবন্তং কু-নৃপতিং জ্ঞাতিঘাতিনমস্তু বৈ।। (মহাভারত : ১২/৩৮/২৬)
কিং তে রাজ্যেন কৌন্তেয় ! কৃত্বেমং জ্ঞাতিসঙ্ক্ষয়ম্ ।
ঘাতয়িত্বা গুরূংশ্চৈব মৃতং শ্রেয়ো ন জীবিতম্ ।। (মহাভারত : ১২/৩৮/২৭)
ইতি তে বৈ দ্বিজাঃ শ্র“ত্বা তস্য দুষ্টস্য রক্ষসঃ।
বিব্যথুশ্চু ক্রুশুশ্চৈব তস্য বাক্যপ্রধর্ষিতাঃ।। (মহাভারত : ১২/৩৮/২৮)
ততস্তে ব্রাহ্মণাঃ সর্ব্বে স চ রাজা যুধিষ্ঠিরঃ।
ব্রীড়িতাঃ পরমোদ্বিগ্নাস্তুষ্ণীমাসন্ বিশাংপতে!।। (মহাভারত : ১২/৩৮/২৯)।
যুধিষ্ঠির উবাচ।
প্রসীদন্তু ভবন্তো মে প্রণতস্যাভিযাচতঃ।
প্রত্যাসন্নব্যসনিনং ন মাং ধিক্কর্ত্তুমর্হথ।। (মহাভারত : ১২/৩৮/৩০)
ততো রাজন্ ! ব্রাহ্মণাস্তে সর্ব্ব এব বিশাংপতে!।
ঊচুর্নৈষ দ্বিজোহস্মাকং শ্রীরস্তু তব পার্থিব!।। (মহাভারত : ১২/৩৮/৩১)
জজ্ঞুশ্চৈব মহাত্মানস্ততস্তং জ্ঞানচক্ষুষা।
ব্রাহ্মণা বেদবিদ্বাংসস্তপোভির্বিমলীকৃতাঃ।। (মহাভারত : ১২/৩৮/৩২)।
ব্রাহ্মণা ঊচুঃ।
এষ দুর্য্যোধনসখা চার্ব্বাকো নাম রাক্ষসঃ।
পরিব্রাজকরূপেণ হিতং তস্য চিকীর্ষতি।। (মহাভারত : ১২/৩৮/৩৩)
ন বয়ং ব্রূম ধর্ম্মাত্মন্ ! ব্যেতু তে ভয়মীদৃশম্ ।
উপতিষ্ঠতু কল্যাণং ভবন্তং ভ্রাতৃভিঃ সহ।। (মহাভারত : ১২/৩৮/৩৪)
ততস্তে ব্রাহ্মণাঃ সর্ব্বে হুঙ্কারৈঃ ক্রোধমূর্চ্ছিতাঃ।
নির্ভর্ৎসয়ন্তঃ শুচয়ো নিজঘ্নুঃ পাপরাক্ষসম্ ।। (মহাভারত : ১২/৩৮/৩৫)
স পপাত বিনির্দগ্ধস্তেজসা ব্রহ্মবাদিনাম্ ।
মহেন্দ্রাশনিনির্দগ্ধঃ পাদপোহঙ্কুরবানিব।। (মহাভারত : ১২/৩৮/৩৬)
পূজিতাশ্চ যযুর্বিপ্রা রাজানমভিনন্দ্য তম্ ।
রাজা চ হর্ষমাপেদে পাণ্ডবঃ সসুহৃজ্জনঃ।। (মহাভারত : ১২/৩৮/৩৭)
.
অর্থাৎ :
চার্ব্বাক বলিল- ‘পাণ্ডুনন্দন! এই ব্রাহ্মণেরা সকলে আমার উপরে বাক্য স্থাপিত করিয়া বলিতেছেন, (আমার মুখে বলিতেছেন)- ‘আপনি জ্ঞাতিহত্যাকারী ঘৃণিত রাজা; সুতরাং আপনাকে ধিক্ । ২৬।
কুন্তীনন্দন! এইরূপ জ্ঞাতি ক্ষয় করিয়া এবং গুরুজনদিগকে বধ করাইয়া, আপনার রাজ্যদ্বারা কি হইবে। আপনার এখন মৃত্যুই ভাল- জীবন নহে’। ২৭।
তখন ব্রাহ্মণেরা সকলেই সেই দুষ্ট রাক্ষসের এই প্রকার বাক্য শুনিয়া এবং তাহার পূর্ব্বোক্ত বাক্যে আক্রান্ত হইয়া ব্যথিত হইলেন ও আক্রোশ প্রকাশ করিতে লাগিলেন। ২৮।
তাহার পর সেই ব্রাহ্মণেরা সকলে ও সেই রাজা যুধিষ্ঠির লজ্জিত ও বিশেষ উদ্বিগ্ন হইয়া, কিছুকাল নীরব থাকিলেন। ২৯।
তৎপরে যুধিষ্ঠির বলিলেন- ‘ব্রাহ্মণগণ! আমি অবনত হইয়া, আপনাদের প্রসন্নতা প্রার্থনা করিতেছি। আপনারা আমার উপরে প্রসন্ন হউন’। আমার মৃত্যু অতিনিকটবর্ত্তী; সুতরাং আমার উপরে ধিক্কার দেওয়া আপনাদের উচিত নহে’। ৩০।
তদনন্তর সেই ব্রাহ্মণেরা সকলেই একযোগে বলিলেন- ‘রাজা ! এই ব্রাহ্মণটা আমাদের কেহই নহে। আপনি জীবন ধারণ করুন, আপনার রাজলক্ষ্মীও চিরস্থায়িনী হউক। ৩১।
তাহার পর বেদবিদ্বান্ ও তপোবলে নির্ম্মলচিত্ত সেই মহাত্মা ব্রাহ্মণেরা জ্ঞানদৃষ্টিদ্বারা চার্ব্বাককে চিনিতে পারিলেন। ৩২।
ব্রাহ্মণেরা বলিলেন- ‘মহারাজ ! দুর্য্যোধনের সখা চার্ব্বাকনামক এই রাক্ষস পরিব্রাজকরূপে দুর্য্যোধনেরই হিতসাধন করিবার ইচ্ছা করিতেছে। ৩৩।
ধর্ম্মাত্মা ! আমরা এরূপ কথা বলি নাই। অতএব আপনার এইরূপ নিন্দার ভয় তিরোহিত হউক এবং ভ্রাতৃগণের সহিত আপনার মঙ্গল হউক। ৩৪।
তাহার পর সেই পবিত্র ব্রাহ্মণেরা সকলে ক্রোধে উত্তেজিত হইয়া, ভর্ৎসনা করিতে থাকিয়া, হুঙ্কারদ্বারা সেই পাপাত্মা রাক্ষসটাকে মারিয়া ফেলিলেন। ৩৫।
তখন ইন্দ্রের বজ্রদগ্ধ অঙ্কুরযুক্ত বৃক্ষের ন্যায় সেই রাক্ষসটা বেদবাদী ব্রাহ্মণগণের তেজে দগ্ধ হইয়া পতিত হইল। ৩৬।
তৎপরে সেই ব্রাহ্মণেরা বিশেষ সম্মানিত হইয়া, যুধিষ্ঠিরের অভিনন্দন করিয়া, যথাস্থানে প্রস্থান করিলেন এবং যুধিষ্ঠিরও সুহৃজ্জনের সহিত আনন্দিত হইলেন। ৩৭।

.
এমন এক দুরাত্মা পাপী রাক্ষসের নামের সঙ্গে বস্তুবাদী দর্শনটিকে জুড়ে দিলে সাধারণ পাঠকের মনে দর্শনটির প্রতি সহজেই আতঙ্ক ও বিদ্বেষ সঞ্চারিত হবার কথা। এ কারণেই এই জড়বাদী দর্শনটিকে চার্বাক নামে উল্লেখ করার প্রথা গড়ে উঠেছিলো কিনা তা বিপ্রতীপ দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবনার বিষয় হতেই পারে। তবে চার্বাককে ব্রাহ্মণদের ক্রোধের বলি করে উপাখ্যানটি এই ব্রাহ্মণবেশী দুর্যোধনসখার মধ্যে ব্রাহ্মণবিরোধী এক মনোভাবের ইঙ্গিত দেয়। আর এ ইঙ্গিতটাকে স্পষ্টতর করে তোলে মহাভারতেরই অন্তর্গত অন্য এক উপাখ্যান, যার মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণ ব্রহ্মার প্রসাদপুষ্ট অপর এক চার্বাকের সঙ্গে যুধিষ্ঠিরের রাজসভায় উপাগত এই চার্বাকের অভিন্নতা প্রদর্শন করেন। (মহাভারত: ১২/৩৯/৩-১১) । উপাখ্যানটি এরকম-

বাসুদেব উবাচ।
ব্রাহ্মণাস্তাত ! লোকেহস্মিন্নর্চ্চনীয়াঃ সদা মম।
এতে ভূমিচরা দেবা বাগ্বিষাঃ সুপ্রসাদকাঃ।। (মহাভারত : ১২/৩৯/২)
পুরা কৃতযুগে রাজন্ ! চার্ব্বাকো নাম রাক্ষসঃ।
তপস্তেপে মহাবাহো ! বদর্য্যাং বহুবার্ষিকম্ ।। (মহাভারত : ১২/৩৯/৩)
বরেণ চ্ছন্দ্যমানশ্চ ব্রহ্মণা চ পুনঃ পুনঃ।
অভয়ং সর্ব্বভূতেভ্যো বরয়ামাস ভারত !।। (মহাভারত : ১২/৩৯/৪)
দ্বিজাবমানাদন্যত্র প্রাসাদ্বরমনুত্তমম্ ।
অভয়ং সর্ব্বভূতেভ্যো দদৌ তস্মৈ জগৎপতিঃ।। (মহাভারত : ১২/৩৯/৫)
স তু লব্ধবরঃ পাপো দেবানমিতবিক্রমঃ।
রাক্ষসস্তাপয়ামাস তীব্রকর্ম্মা মহাবলঃ।। (মহাভারত : ১২/৩৯/৬)
ততো দেবাঃ সমেতাশ্চ ব্রাহ্মাণমিদমব্রুবন্ ।
বধায় রক্ষসস্তস্য বলবিপ্রকৃতাস্তদা।। (মহাভারত : ১২/৩৯/৭)
তানুবাচ ততো দেবো বিহিতস্তত্র বৈ ময়া।
যথাস্য ভবিতা মৃত্যুরচিরেণেতি ভারত !।। (মহাভারত : ১২/৩৯/৮)
রাজা দুর্য্যােধনো নাম সখাস্য ভবিতা নৃষু।
তস্য স্নেহাববদ্ধোহসৌ ব্রাহ্মণানবমংস্যতে।। (মহাভারত : ১২/৩৯/৯)
তত্রৈনং রুষিতা বিপ্রা বিপ্রকারপ্রধর্ষিতাঃ।
ধক্ষ্যন্তি বাগ্বলাঃ পাপং ততো নাশং গমিষ্যতি।। (মহাভারত : ১২/৩৯/১০)
স এষ নিহতঃ শেতে ব্রহ্মদণ্ডেন রাক্ষসঃ।
চার্ব্বাকো নৃপতিশ্রেষ্ঠ ! মা শুচো ভরতর্ষভ !।। (মহাভারত : ১২/৩৯/১১)।
.
অর্থাৎ :
কৃষ্ণ বলিলেন- ‘মাননীয় রাজা ! এই জগতে ব্রাহ্মণেরা সর্ব্বদাই আমার পূজনীয়। কারণ, ইঁহারা পৃথিবীচারী দেবতাস্বরূপ এবং ইঁহাদের বাক্যই বিষ, আবার প্রসন্নতা উৎপাদন করাও সহজ। ২।
মহাবাহু রাজা ! পূর্ব্বকালে সত্যযুগে এই রাক্ষস চার্ব্বাক বদরিকাশ্রমে বহু-বৎসর যাবৎ তপস্যা করিয়াছিল। ৩।
ভরতনন্দন ! তাহার পর ব্রহ্মা আসিয়া বর লইবার জন্য বার বার অনুরোধ করিলে, চার্ব্বাক সমস্ত প্রাণী হইতেই নিজের অভয় বর প্রার্থনা করিয়াছিল। ৪।
তখন অপমানিত ব্রাহ্মণ ভিন্ন অপর সমস্ত প্রাণী হইতেই সর্ব্বোত্তম অভয় বর তাহাকে ব্রহ্মা দান করিয়াছিলেন। ৫।
তৎপরে অসাধারণ বিক্রমশালী, নিষ্ঠুর কার্য্যকারী, মহাবল ও পাপাত্মা চার্ব্বাক ব্রহ্মার নিকট সেই বর লাভ করিয়া, দেবগণকে সন্তপ্ত করিতে লাগিল। ৬।
তাহার পর একদা দেবতারা সেই চার্ব্বাক রাক্ষসের প্রভাবে নিপীড়িত হইয়া, ব্রহ্মার নিকটে যাইয়া, চার্ব্বাকের বধের জন্য এই কথাই বলিলেন। ৭।
ভরতনন্দন ! তদনন্তর ব্রহ্মা দেবগণকে বলিলেন- ‘যাহাতে অচিরকালমধ্যে চার্ব্বাক নিহত হয়, সে বিষয়ে আমি উপায় করিয়াছি। ৮।
মনুষ্যলোকে দুর্য্যোধননামে এক রাজা জন্মিবেন এবং তিনি চার্ব্বাকের সখা হইবেন। কালক্রমে এই চার্ব্বাক সেই দুর্য্যোধনের সৌহার্দ্দসূত্রে আবদ্ধ হইয়া, ব্রাহ্মণগণের অবমাননা করিবে। ৯।
তখন বাক্শক্তিসম্পন্ন ব্রাহ্মণেরা চার্ব্বাকের অবজ্ঞায় ক্রুদ্ধ হইয়া, ব্রহ্মতেজেই পাপাত্মাকে দগ্ধ করিবেন; তাহাতেই চার্ব্বাক বিনষ্ট হইবে’। ১০।
ভরতশ্রেষ্ঠ রাজপ্রধান ! সেই চার্ব্বাক রাক্ষসই এই ব্রাহ্মণের তেজে বিনষ্ট হইয়া শয়ন করিয়াছে। অতএব আপনি ব্রহ্মহত্যা হইয়াছে বলিয়া অনুতাপ করিবেন না। ১১।

.
যুধিষ্ঠিরের সভায় সমাগত চার্বাকের বিনাশের মূলে কার্যকর ব্রহ্মার অভিশাপ এবং ব্রাহ্মণদের বিরোধিতার মাধ্যমে অভিশাপটিকে ফলপ্রসূ করার দায়িত্ব স্বয়ং চার্বাকেরই। উপাখ্যানের সাহায্যে এই সিদ্ধান্তকে দৃষ্টিপটে তুলে ধরার প্রয়াস এখানে স্পষ্ট।
.
চার্বাক নামে কোন ব্যক্তির কাহিনী মহাভারতের অন্যত্র বা অন্য কোন গ্রন্থেও আর দেখা যায় না। মহাভারতে চার্বাক নামের এই রাক্ষসের সামান্য উল্লেখ থেকে চার্বাক মতবাদের এরকম নামকরণের পক্ষে সুনিশ্চিত কোন যুক্তি বা সাক্ষ্য আদৌ আছে কিনা জানা নেই। তবে এটা মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে চার্বাক এখানে বৈদিক সংস্কৃতির বিরোধী দর্শনের এক মূর্ত রূপ। তাই বিরোধী প্রখর জড়বাদী মতের প্রতি বৈদিক সংস্কৃতির ধারক-বাহকদের তীব্র বিদ্বেষের বহিঃপ্রকাশ এমন চার্বাক নামকরণের মধ্যে দিয়ে ঘটে যাওয়া অসম্ভব না-ও হতে পারে।

(চলবে…)

[আগের পর্ব: ভারতীয় সাহিত্যে চার্বাক] [*] [পরের পর্ব: চার্বাক ও বৃহস্পতি]