জীবজগতে মানুষেরা যে প্রাইমেট বর্গের অন্তর্ভুক্ত সেটা আমরা সবাই জানি। মানুষ ছাড়াও আরো বেশ কিছু প্রাণী রয়েছে প্রাইমেট বর্গের মধ্যে। যেমন বানর ও এপ। গরিলা, ওরাংওটাং শিম্পাঞ্জিদের এপ বলা হয়। মানুষ ও বানর যেহেতু প্রাইমেট বর্গের মধ্যে আছে তাহলে এটা কি বলা যায় মানুষ আর বানর অভিন্ন? কিংবা মানুষ হচ্ছে বানর অথবা বানরই হচ্ছে মানুষ? মোটেও তা নয়। কেন নয়? উদাহরণ দেয়া যাক। ভারত বা বাংলাদেশের মতো দেশে বিভিন্ন ভাষার, বিভিন্ন ধর্মের লোক বাস করে। ভারতে বাংলা, হিন্দি, উর্দু, তামিল, গুজরাটি, খাসি, মালয়ালাম প্রভৃতি ভাষার লোক বাস করে। এই লোকেরা যেমন সবাই ভারতের নাগরিক কিন্তু ভাষাগত দিক দিয়ে তারা আলাদা। বাংলাদেশেও বাংলা ভাষীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অবস্থান থাকলেও বিভিন্ন আদিবাসী যেমন মণিপুরী, চাকমা, গারো, মারমা প্রভৃতির নিজস্ব ভাষা রয়েছে। আমরা প্রত্যেকে বাংলাদেশের নাগরিক হলেও ভাষাগত, নৃগোষ্ঠীগত দিক দিয়ে পার্থক্য রয়েছে। তেমনি মানুষ, বানর, এপ প্রত্যেকে প্রাইমেট বর্গের হলেও তাদের প্রত্যেকেরও কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে।

Kingdom: Animalia
Phylum: Chordata
Subphylum: Vertebrata
Class: Mammalia
Subclass: Theria
Infraclass: Eutheria
Order: Primates
Suborder: Anthropoidea
Superfamily: Hominoidea
Family: Hominidae
Genus: Homo
Species: sapiens

জীবজগতে মানুষের শ্রেণীবিন্যাস

শ্রেণীবিন্যাসবিদরা প্রাইমেট বর্গের কিছু চরিত্র নির্ধারণ করেছেন। যেমন স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে প্রাইমেট হচ্ছে বিশেষ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জীব যাদের হাত-পা গাছে গাছে চলে ফিরে বেড়াবার জন্য অত্যন্ত উপযোগী। আঙুলগুলো কমবেশি নাড়াতে পারে। বুড়ো আঙুলকে অন্যান্য আঙুলের বিপরীতে নিতে পারে। নখরের পরিবর্তে বিকাশ ঘটেছে নখের এবং এই জীবদের সংবেদনশীল হাতের তালু রয়েছে। প্রাইমেট বর্গের জীবরা হাত-পা ও আঙুল দিয়ে যেমন গাছের ডাল আঁকড়ে ধরতে পারে, তেমনি আবার হাত দিয়ে কোনো জিনিস বা খাদ্য মুখে তুলতে পারে। দেহের বাহু ঘোরাতে পারে। চলাফেরার সময় দুটি পা (পশ্চাদপদ) প্রধান ভূমিকা পালন করে। যার ফলে এই জীবদের অনেকে অর্ধ-খাড়া বা প্রায় খাড়া হয়ে দাঁড়াবার ক্ষমতা অর্জন করেছে। মানুষই প্রাইমেটদের মধ্যে একমাত্র জীব যারা পুরোপুরি দ্বিপদী। সম্পূর্ণ সোজা হয়ে চলাফেরা করে থাকে। প্রাইমেটদের চোখ দুটো অপেক্ষাকৃত কাছাকাছি। ফলে দেখার সময় তাদের দর্শন ক্ষেত্রের অধিক্রমণ করতে পারে বলে তাদের দৃষ্টিশক্তি ক্রিমাত্রিক। তারা খাদ্য, গাছের ডালপালা ও অন্যান্য বস্তুর ব্যবধান খুব ভালোভাবে নির্ণয় করতে পারে। প্রাইমেটদের মধ্যে সব ধরনের খাবারের উপযোগী দাঁত এবং পরিপাকযন্ত্র বিকাশ লাভ করেছে। তাদের দেহের আকারের তুলনায় মস্তিষ্কের আকার বড়। এবং প্রাইমেট বর্গের জীবেরা জটিল সামাজিক জীবন যাপন করতে সক্ষম। (দ্রষ্টব্য : বিবর্তনের পথ ধরে, পৃ ১৪৩)।

জীববিবর্তনের দৃষ্টিতে মানুষ বানর থেকে এপদের সাথে অনেক ঘনিষ্ট আত্মীয়। বলা যায় জীবজগতে আত্মীয়তার দিক থেকে এপরা হচ্ছে মানুষের প্রথম-তুতোভাই, এবং বানর হচ্ছে দ্বিতীয় বা তৃতীয় তুতোভাই। আবার এপদের মধ্যে শিম্পাঞ্জির সাথে মানুষের আত্মীয়তার সম্পর্ক বেশি ঘনিষ্ট, তারপর গরিলা এবং শেষে ওরাংওটাং। মানুষের বংশধারা এবং শিম্পাঞ্জির বংশধারা আজ থেকে প্রায় ষাট থেকে সত্তর লক্ষ বছর আগে সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। বিজ্ঞানীরা এ বিষয়টি এ বিষয়টি খুব ভালোভাবে নিশ্চিত হয়েছেন বর্তমানকালের জীবিত প্রাইমেটদের সাথে মানুষের অঙ্গসংস্থানের তুলনামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে। সাথে অতীতকালের প্রাইমেটদের ফসিল পরীক্ষার মাধ্যমে এবং মানুষের সাথে প্রাইমেটদের ডিএনএ, প্রোটিন ও অন্যান্য জৈবঅণু তুলনামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে। আধুনিককালে ডিএনএ ও প্রোটিন গবেষণার মাধ্যমে প্রাইমেটের বিবর্তন ধারা সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি এবং সঠিক তথ্য-উপাত্ত জানা সম্ভব হচ্ছে।

চার্লস ডারউইন তাঁর ‘অরিজিন অব স্পিসিজ’ (১৮৫৯) গ্রন্থে মানুষের বিবর্তন সম্পর্কে কিছু বলেননি। শুধু এক জায়গায় লিখলেন ভবিষ্যতে এই বিষয়ে আলোকপাত করা হবে। পরবর্তীতে তিনি কোনো হোমিনিড ফসিল না দেখলেও ‘ডিসেন্ট অব ম্যান’ বইয়ে (১৮৭১) ডারউইন প্রাকৃতিক নির্বাচনের আলোকে মানুষের বিবর্তন সম্পর্কে ঘোষণা করেছিলেন। ডারউইন এই বইয়ে বললেন মানুষ ও এপরা সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভূত হয়েছে এবং ঐ সাধারণ পূর্বপুরুষরা ‘মানুষ’ ছিল না। খুব সম্ভবত আফ্রিকা হবে সেই সাধারণ পূর্বপুরুষদের বাসস্থান। ডারউইনের এই ধরনের বক্তব্যের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। অনেক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন ধর্মবাদী থেকে শুরু করে সংশয়বাদী বিজ্ঞানীরা। মানুষ ও এপের ‘মিসিং লিংক’ কোথায়? কোথায় সেই মধ্যবর্তী জীবের ফসিল যাদের মধ্যে এপ এবং মানুষের বৈশিষ্ট্য রয়েছে?

ডারউইনের পূর্বে তাঁর সুহৃদ টমাস হাক্সলি মানুষের বিবর্তন সম্পর্কে সুস্পষ্ট সিদ্ধান্তের কথা প্রচার করেছিলেন তাঁর “Man’s Place in Nature” বইয়ে। ডারউইন ও হাক্সলি মূলত জীবিত আফ্রিকান এপ ও আধুনিক মানুষের অ্যানাটমির তুলনামূলক পরীক্ষা থেকে এ ধরনের সিদ্ধান্তে পৌঁছে ছিলেন। ডারউইনের ধারণা ছিল আফ্রিকা হবে হোমিনিডদের জন্মভূমি। অবশ্য ডারউইনের পর্যবেক্ষণে সাদৃশ্যের পাশাপাশি আধুনিক মানুষের সাথে এপদের কিছু বৈসাদৃশ্যও ধরা পড়েছি। তিনি এগুলো লিপিবদ্ধ করেছিলেন। যেমন : (১) মানুষ দ্বিপদী, আর এপরা চতুষ্পদী (quadrupedal) (২) মানুষের রয়েছে ক্ষুদ্র ছেদক দন্ত আর এপের রয়েছে বড় ছেদক দন্ত (৩) মানুষ হাতিয়ার তৈরি এবং ব্যবহার করতে পারে, যেখানে এপরা এ বিষয়ে অক্ষম (৪) মানুষের মস্তিষ্ক অনেক বড়, আর এপদের মস্তিষ্ক অনেক ছোট।

ডারউইনের মনে প্রশ্ন দেখা দিল জীবিত আফ্রিকান এপ ও আধুনিক মানুষ যদি একই উৎস থেকে উদ্ভূত হয়ে থাকে তাহলে মানুষের এই স্বতন্ত্র দ্বিপদী বৈশিষ্ট্য কি এমন উপকারী হয়ে দেখা দিয়েছিল যা টিকে গেছে শেষমেশ? ডারউইন নিজে আবার উপসংহারে পৌঁছালেন পূর্বের মানুষেরা বেশিরভাগই মাংস ভক্ষণ করতো, পাথর বা শক্ত গাছের টুকরো দিয়ে জীবজন্তু হত্যা করতো। ফলে দ্বিপদী বৈশিষ্ট্য মানুষের হাতকে (অগ্রপদ) মুক্তি দিয়েছিল। পাথরের তৈরি অস্ত্র বা শক্ত গাছের গুড়ি বহন করতে, ব্যবহারে সহায়তা করেছিল। হাত দিয়ে হাতিয়ার নির্মাণের সুযোগ করে দিয়েছিল। আর হাতিয়ার দিয়ে যখন প্রাণী হত্যা করতে লাগলো ও মাংস কাটতে সহায়তা পেল তখন ক্রমে শিকারের জন্য বড় ছেদক দন্তও প্রয়োজনীয়তা হারালো। ডারউইন এও ভাবলেন মানুষের বুদ্ধিমত্তার বিকাশে হাতিয়ার উৎপাদন এবং এগুলির ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আর বড় মস্তিষ্ক মানুষের ভাব প্রকাশের জন্য ভাষার ব্যবহারের ফল।

পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে আজ থেকে প্রায় ছয় বা সাত মিলিয়ন আগে প্রাইমেটের অন্তর্ভুক্ত সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে মানুষের বংশানুক্রম (লিনিজ) এবং শিম্পাঞ্জির বংশানুক্রম আলাদা হয়ে গিয়েছিল। মানুষের লিনিজের সেই পূর্বপুরুষদের জীববিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ‘হোমিনিড’ অথবা ‘হোমিনিন’। ডারউইন মারা যান ১৮৮২ সালে। তাঁর মৃত্যুর সময়কালেও কোনো হোমিনিড ফসিল সম্পর্কে প্রত্নজীবিজ্ঞানীদের কাছে স্পষ্ট তথ্য ছিল না। যদিও ডারউইন ডিসেন্ট অব ম্যান বইয়ে অনুমান করেছিলেন এ ধরনের হোমিনিড ফসিল ভবিষ্যতে পাওয়া যেতে পারে।


চিত্র : আর্নেস্ট হেকেল (১৮৩৪-১৯১৯)

ঊনবিংশ শতাব্দীতে ডারউইনই শুধু একমাত্র নেতৃস্থানীয় বিজ্ঞানী ছিলেন না যে মানুষের উদ্ভব ও বিবর্তন কোথায় হয়েছে সে সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করছিলেন। জার্মানির প্রসিদ্ধ শারীরবিজ্ঞানী আর্নেস্ট হেকেল (১৮৩৪-১৯১৯) ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে মানুষের উদ্ভব ও বিবর্তন কোথায় হয়েছে সে সম্পর্কে পৃথক ভাবনা নিয়ে দৃশ্যপটে হাজির হন। হেকেল ছিলেন ডারউইনের ভাবশিষ্য। হেকেল মন্তব্য করেন আফ্রিকার গ্রেট এপদের তুলনায় এশিয়ার গ্রেট এপের (ওরাংওটাং) সাথে আধুনিক মানুষের অ্যানাটমির অভূতপূর্ব মিল রয়েছে। তাই হয়তো আফ্রিকা নয় বরং এশিয়া হবে হোমিনিড পূর্বপুরুষের জন্মভূমি। এমন কী আর্নেস্ট হেকেল প্রথম হোমিনিড পূর্বপুরুষ দেখতে কেমন হবে সে সম্পর্কে বর্ণনা করেন এবং এদের জন্য আলাদা জিনাসের নামও প্রস্তাব করেন। ‘Pithecanthropus’ (পিথেকানথ্রোপাস) মানে ‘এপ-মানব’।


চিত্র : ইয়োজিন ডিবোয়া

আর্নেস্ট হেকেলের আদি মানুষের বিবর্তন ওপর রচিত “The History of creation; or The development of the earth and its inhabitants by the action of natural causes” বইটি (১৮৭৩) পাঠ করে ডাচ (নেদারল্যান্ড) নাগরিক ইয়োজিন ডিবোয়া (২৮ জানুয়ারি ১৮৫৮ – ১৬ ডিসেম্বর ১৯৪০) প্রত্নজীববিদ্যায় যারপরনাই উৎসাহী হয়ে উঠেন। তখন তিনি সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ। ডিবোয়া ডারউইনের অরিজিন অব স্পিসিজ বইটি গোগ্রাসে গিলে খেয়েছেন ছাত্রজীবনে। বয়স তখন তার সবে উনিশ। আমস্টারডাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মেডিকেল স্কুলে মাত্র ভর্তি হয়েছেন। ২৬ বছর বয়সে মেডিকেল স্কুল থেকে ডিগ্রি লাভ করেন এবং একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানাটমি বিভাগে প্রভাষক পদে যোগ দেন। শিক্ষকতা পেশায় যোগ দিলেও ইউজিনের মনের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে লালিত-পালিত হচ্ছে ফসিল সংগ্রহের তীব্র ইচ্ছা। লেখাপড়ার পাট চুকে যাওয়ার পর এই দুর্দান্ত ইচ্ছা যেন উপছে আসতে লাগলো। শেষমেশ ধৈর্য্য ধরতে না পেরে কিছুদিনের মাথায় বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকুরি ছেড়ে দিলেন ইয়োজিন। বউ-বাচ্চা নিয়ে পাড়ি দেয়ার সুযোগ খুঁজতে লাগলেন ইন্দোনেশিয়াতে। ইন্দোনেশিয়াতে পাড়ি দেবার কারণ হচ্ছে হেকেলের মতো তিনিও বিশ্বাস করেছিলেন এশিয়াতেই হয়তো পাওয়া যাবে মানুষের আদি পূর্বপুরুষের নমুনা। ওই সময় ইন্দোনেশিয়া ছিল নেদারল্যান্ডের উপনিবেশ। নাম ছিল ডাচ ইস্ট ইন্ডিস। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকুরির মতো এই নিরাপদ আর সম্মানজনক জীবন ছেড়ে দিয়ে কোথাকার কোন অদৃশ্য ভাঙা হাড়গোড়ের পিছনে ছুটার ‘পাগলামি’ দেখে স্বাভাবিকভাবেই ডিবোয়ার আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশিরা ভড়কে গেলেন। তারা নানাভাবে বুঝিয়ে সুঝিয়ে শান্ত করতে চাইলেন। কিন্তু কোনো কিছুতেই কাজ হল না।

অবশেষে ১৮৮৭ সালের ডিসেম্বর মাসে ডিবোয়া স্বপরিবারে চলে আসেন ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপে। স্থানীয় সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসকের চাকুরি জুটে গিয়েছিল তাঁর। হাসপাতালের চাকুরির ফাঁকে ফাঁকে ফসিলের সন্ধানে ঘুরে ঘুরে বেড়াতেন ডিবোয়া। কিন্তু এতেও তার মন ভরলো না। ফসিলের সন্ধানে তিনি পর্যাপ্ত সময় দিতে পারছিলেন না। রোগী দেখবেন না কি ফসিল খুঁজবেন? কোনো কাজই মন দিয়ে করতে পারছিলেন না। তাই ডিবোয়া উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানালেন তাঁকে এই দিবাকালীন চাকুরি থেকে অব্যহতি দেয়ার জন্য আর ডাচ সরকারের পূর্ণকালীন প্রত্নজীববিজ্ঞানী হিসেবে নিয়োগ দেয়ার জন্য। কর্তৃপক্ষ আগে থেকে জানতো ডিবোয়ার কথা। কিছুটা সদয়ও ছিল তাঁরা। ফলে অনুমতি মিলে গেল ঝটপট। ডিবোয়া তখন দুজন পুরকৌশলী ও পঞ্চাশ জনের কর্মীবাহিনী নিয়ে পুরো সুমাত্রা দ্বীপে চিরুনি তল্লাশি শুরু করে দিলেন ফসিলের সন্ধানে।

কিন্তু হাড়ভাঙা এতো পরিশ্রমের ফলাফল শূন্য। কোনো ফসিলের সন্ধানই তার ভাগ্যে জুটল না। হতাশ ডিবোয়া একসময় অসুস্থ হয়ে পড়লেন। অনেকে পরামর্শ দিলেন এই অনিশ্চিত-অর্থহীন এবং প্রায় ব্যর্থ জীবন ছেড়ে পুনরায় নেদারল্যান্ডে ফিরে যাবার জন্য। ভালোভাবে খেয়ে পড়ে নিরাপদ জীবন যাপন করা যাবে। কিন্তু ডিবোয়ার একরোখা মনোভাব হলো ফসিল আবিষ্কার না করে তিনি কখনো দেশে ফিরবেন না। হঠাৎ একদিন ডিবোয়ার কাছে খবর আসলো সুমাত্রার পাশের দ্বীপ জাভায় নদীর তীর ঘেষে একটা এলাকায় নাকি কিছু পুরানো হাড়গোড় পাওয়া যাচ্ছে। তৎক্ষণাৎ চাঙা হয়ে উঠলেন ডিবোয়া। আবার সামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করলেন সুমাত্রা ছেড়ে তাকে যেন জাভা দ্বীপে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়। এবারো অনুমতি মিলে গেল। আর ডিবোয়া সময় নষ্ট না করে দ্রুত কর্মীবাহিনী নিয়ে জাভার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেলেন।

জাভায় পৌঁছে খবর পেলেন ত্রিনিল নামের একটি গ্রামের পাশ দিয়ে সলো নদীর তীরে নাকি কিছু হাড়গোড় পাওয়া গেছে। নদীটি প্রায় মৃতপ্রায়। ডিবোয়ার আর অপেক্ষার তর সইছিল না। তখন সময়টা ১৮৯১ সালের গ্রীষ্মের শেষের দিক। ফসিলের সন্ধানে সবাই হইহই করে নেমে পড়ল। এবারো অনেক খোঁড়াখুড়ি করে মানুষের একটি পেষক দাঁত (molar) ছাড়া আর কিছু পাওয়া গেল না। তবে এত সহজে হতদ্যোম হলেন না। তার মন বলছিল এবার কিছু একটা পাওয়া যাবেই। তাই ডিবোয়া কার্যক্রম গুটিয়ে নিলেন না। টানা প্রায় দুই মাস ধরে বিরামহীন পরিশ্রমের পর ডিবোয়ার দল একটি ছোট্ট ‘ক্রেনিয়াম’ পেল। সাথে পেল একটি ঊরুর হাড় আর শরীরের কিছু হাড়ের খণ্ডাংশ। নিচের চোয়াল ছাড়া উপরের করোটি বা খুলিকে ক্রেনিয়াম বলে। ইয়োজিন ডিবোয়া ওই সময় মানব অ্যানাটমির একজন পুরোদস্তুর বিশেষজ্ঞ ছিলেন। তাই ক্রেনিয়ামটি দেখে বোঝতে পারলেন এতদিন ধরে তিনি যা খুঁজে চলছেন এবার সেটা তার হাতের মুঠে।

ডিবোয়ার উদ্ধার করা ক্রেনিয়ামটি আধুনিক মানুষের (Homo sapiens) কোনো করোটি নয়। করোটির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি দেখতে লম্বা তবে এর নিম্নমুখী ব্রেনকেস। এপদের মত ভ্রূচুড়া বড় ও উঁচু তবে উল্লেখ করার মত এর কোনো কপাল ছিল না। ক্রেনিয়ামটির আয়তন প্রায় ৮৫০ সিসি (কিউবিক সেন্টিমিটার)। সে হিসেবে এর মধ্যে মগজ বা ঘিলুর পরিমাণ হবে কমবেশি দুই পাউন্ড এবং আয়তন প্রায় ১০০০ সিসি। এক পাউন্ডে ৪৫৪ গ্রাম। তাই এটি আধুনিক মানুষের কোনো করোটি নয়। আধুনিক মানুষের ক্রেনিয়ামের আয়তন ১৩০০ সিসি। ব্রেনের ওজন তিন পাউন্ড ও আয়তন ১,৪৫০ সি.সি। শিম্পাঞ্জির ব্রেনের আয়তন প্রায় ৪০০ সিসি। অর্থাৎ উদ্ধারকৃত ক্রেনিয়ামটি কোনো শিম্পাঞ্জিরও (এপ) নয়।

আবার ডিবোয়া দেখলেন আধুনিক মানুষের ঊরুর হাড়ের সাথে ফসিলটির ঊরুর হাড়ের গুরুত্বপূর্ণ কিছু মিল রয়েছে। অর্থাৎ হাঁটতে পারে এমন দ্বিপদী ব্যক্তির হাড় এটি। এখন প্রশ্ন দেখা দিল, ফসিলটি কিসের? কোনো এপেরও না, আধুনিক মানুষেরও না। তাহলে এপ ও মানুষের মধ্যের কোনো জীবের? এটা কি সেই বহুল আলোচিত “মিসিং লিংকে”র ফসিল? এমন অজস্র প্রশ্ন ঘোরপাক খেতে লাগলো ইয়োজিন ডিবোয়ার মনের মধ্যে। তিনি মনে মনে ভাবতে লাগলেন আর্নেস্ট হেকেলের ভবিষ্যদ্বাণী যেন সফল হতে চলছে তাঁর এই আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে। ডিবোয়া তাই হেকেলের ঘোষিত নামের সাথে মিল রেখে ফসিলটির নাম দিলেন ‘Pithecanthropus erectus’। অর্থাৎ ‘সোজা হয়ে হাঁটতে পারে এপ-মানব’।

ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপে ফসিলটি পাওয়া গিয়েছে বলে একে ‘জাভা-মানব’ বলেও ডাকা হতে লাগলো। পরবর্তীতে ফসিলটির বয়স ডেটিং করে জানা গেল এটি প্রায় ১.৮ মিলিয়ন বছরের পুরানো। মানে ঐ ফসিলের ব্যক্তিটি আজ থেকে প্রায় ১৮ লক্ষ বছর আগে এ পৃথিবীতে বসবাস করতো।

ডিবোয়ার আবিষ্কার সারা বিশ্বের প্রত্নজীববিজ্ঞানীদের কাছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করলো। এর মধ্যে বেশিরভাগই ছিল নেতিবাচক আর সংশয়ী বক্তব্য।

যাহোক বছর খানেক বাদে আরো কিছু হোমিনিড ফসিল পাওয়া গেল জাভা দ্বীপসহ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। বর্তমানে বেশিরভাগ নৃবিজ্ঞানী এবং প্রত্নজীববিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন ডিবোয়া’র আবিষ্কৃত ফসিলটি স্বতন্ত্র কোনো জিনাসের (গণ) অন্তর্ভুক্ত নয় এটি আমাদের জিনাসেরই (Homo) অন্তর্ভুক্ত। তবে আলাদা প্রজাতি। এর বৈজ্ঞানিক নাম Homo erectus। ডিবোয়ার আবিষ্কৃত ফসিলটি সবচেয়ে প্রাচীন হোমিনিড ফসিল নয়। এর থেকেও অনেক প্রাচীন হোমিনিড ফসিল বিভিন্ন সময় আবিষ্কৃত হয়েছে। এমন কী Homo জিনাসের অন্তর্ভুক্ত প্রথম প্রজাতিও নয় এই ফসিলটি। তবে মূল কথা হচ্ছে আফ্রিকা ও ইউরোপের বাইরে থেকে আবিষ্কৃত প্রথম হোমিনিড ফসিল হচ্ছে ইয়োজিন ডিবোয়ার ফসিল।

ডিবোয়া ভুলভাবে ভেবেছিলেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে হয়তো সবচেয়ে প্রাচীন হোমিনিড ফসিল পাওয়া যাবে। ডিবোয়ার ভুল কিভাবে সংশোধিত হলো সে আলোচনাতে আমরা পরবর্তীতে যাবো। সে যাহোক ডিবোয়ার ভাবনায় ভুল থাকলেও তার এই আবিষ্কার মোটেও অগুরুত্বপূর্ণ নয়। আমাদের হোমো জিনাসের বিবর্তনে এই ফসিলের প্রমাণ যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ডিবোয়ার সময়ে তিনিই প্রথম বিজ্ঞানী যিনি মানুষের বিবর্তন ও পূর্বপুরুষের উদ্ভব সংক্রান্ত অনুকল্পগুলো সরাসরি পরীক্ষার জন্য একটি গবেষণা পরিকল্পনা তৈরি করেন। ডিবোয়ার দৃষ্টিতে মানুষের বিবর্তনীয় সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য ফসিল-ই হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ। ঊনবিংশ শতাব্দীতে তিনিই একমাত্র বিবর্তনীয় বিজ্ঞানী ডারউইন, হেকেল, হাক্সলি ও অন্যান্যদের মতো শুধু জীবিত প্রাইমেটদের তুলনামূলক অ্যানাটমি পরীক্ষা করেন নি। মানব-বিবর্তনের অনুকল্প পরীক্ষার জন্য ফসিল সংগ্রহ থেকে এগুলোকে ব্যবহার করেছেন। এর ফলে নৃবিজ্ঞানের জগতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়। মানুষের পূর্বপুরুষের বিবর্তন নিয়ে নৃবিজ্ঞানে ‘Paleoanthropology’ নামে নতুন শাখার জন্ম হয়।

ইয়োজিন ডিবোয়া আর জাভা মানব সম্পর্কে জানতে হলে দেখুন :
Pat Shipman, 2002, The Man who Found the Missing Link: Eugène Dubois and His Lifelong Quest to Prove Darwin Right, Harvard University Press.