মুসার হাত ধরে সেই যে নীলনদ পেরিয়ে এসেছিলাম, তারপর আর হাঁটা শেষই হয় নি আমার। সময় বদলেছে, জায়গা পালটেছে, শুধু পালটায় নি আমার অমোঘ নিয়তি। চিরতৃষিত, চিরক্ষুধার্ত হয়ে শুধু হেঁটেই চলেছি। নিজের জায়গা নেই আমার, নিজের নারীও। যা অর্জন করি, সবগুলোর ওপর নিয়ত অন্যদের অধিকার বড় হয়, জড়ো হয় আমার নিজের চাইতে। ‘৪৭-এও, ‘৬৪-তেও, ‘৭১-এও, ‘৯১-এও, ২০০১-এ্, আজ ২০১২-তেও।শুধু বনপোড়া হরিণের মত ছুটতে থাকি উন্মাতাল হয়ে, দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে। এ আমার জন্মদোষ, আজন্ম পাপ, আমৃত্যু আমার প্রায়শ্চিত্ত।

অপরাধ?

আমি সংখ্যালঘু। ধর্মীয় সংখ্যালঘু।

ফিরে যাই কুড়ি বছর আগের এক অন্ধকার রাতে। জানা নেই সেই রাতে তিথি কী ছিলো, কিন্তু আমার মনে সেটা চিরঅমাবস্যা। বাইরে ধর্মরক্ষকের দলের হিংস্র হুংকার। পবিত্র শান্তির ধর্মের দারুণ অবমাননা হয়েছে। তাই অন্য ধর্মের জাতকদের ওপর হামলা করে ধর্মের সম্মান উদ্ধার করতে হবে। একটা ঘরে আলো নিভিয়ে আমরা পাঁচটা মানুষ। আমার পাশে আমার ছোট কিশোরী বোনটা। অন্ধকারে তাকে দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু, তার সারা শরীর যে ঠান্ডা হয়ে গেছে, সেটা টের পাচ্ছি। নিশ্চিত ভাবে বুঝছি যে তার চেহারা ভয়ে নীল হয়ে গেছে। ঠান্ডা হাতটা আমার শরীরে রেখে সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলছে, “ওরা যদি এসে পড়ে, তাহলে কী হবে?” এর উত্তর জানা নেই আমার চাইতে বয়েসে অনেক বড় আমার জন্মদাতা বা জন্মদাত্রীরও, কিংবা হয়তো ভাবতেও চান না তাঁরা।

বছর পাঁচেক আগে এমনি ধর্মীয়-জাতীয়তাবাদী উন্মাদনা দেখলাম মুম্বাইতে। শিবাজি নিয়ে কিছু সমালোচনামূলক কথা বলায় শিবসেনার ছাত্র সংগঠন ভারতীয় বিদ্যার্থী সেনা সাইবার ক্যাফেতে অর্কুট নামের জনপ্রিয় একটি সাইট নিষিদ্ধ করে সব ক্যাফের বাইরে লিফলেট সাঁটায়। শিবসেনার সদস্যেরা হামলা চালায় নানান সাইবার ক্যাফেতে। ভাংচুর করে। দৃশ্যশ্রাব্য গণমাধ্যমে সেসব দৃশ্য বারবার প্রচারিত হয় আর আমি সেই কালো রাতের হিমশীতল সন্ত্রস্ত অবস্থা আবারো অনুভব করতে থাকি। আমার স্নায়ু শিথিল হয়ে আসে, আমার পেশীগুলো দারুণ ভারি ভারি ঠেকতে থাকে, মনে হয় পায়ের নিচ থেকে মাটি গেছে সরে, হৃৎপিণ্ড বুঝি বা থমকেই যাবে। বড় ভয় হয় আমার, খুব অসহায় লাগতে থাকে নিজেকে।

আজ এমনি লাগছিলো আবারো।

কাল মাঝরাত থেকেই হামলা চট্টগ্রামের ফতেয়াবাদ স্টেশনের পার্শ্ববর্তী লোকনাথ ব্রহ্মচারীর মন্দিরে। অপরাধ, নামাজের সময় ভক্তেরা মসজিদের পাশে শোভাযাত্রা করে যাচ্ছিলো। পরম করুণাময়ের শান্তিপূর্ণ উপাসনায় বিঘ্ন ঘটানোর উপযুক্ত প্রতিফলই পেয়েছে তারা। মন্দিরে আজ কোন একটা উৎসব ছিলো। সেসব আয়োজন সব পণ্ড। সামিয়ানা ছিঁড়ে লণ্ডভণ্ড। নপুংসক বিগ্রহ ক’টা ধূলিসাৎ। পৌত্তলিকতার ওপর শান্তির ধর্মের জয় হলো। এরকমই হওয়ার কথা, এরকমই হয়। সত্যধর্মের জয় অনিবার্য।

এতেই শেষ নয়।

আজ আবারো হাটহাজারী কালিমন্দিরে আগুন দেয়া হয়েছে। ভাংচুর করা হয়েছে হাটহাজারী কলেজের পাশের জগন্নাথ মন্দিরটি। হাটহাজারীর মাদ্রাসার ছাত্রেরা সোৎসাহে অংশ নিয়েছে এতে। বিধর্মীদলনে পবিত্র ক্রোধে উদ্দীপ্ত হয়ে সুনিশ্চিত ভাবে তারা পরকালের মহার্ঘ পাথেয় সংগ্রহ করে নিয়েছে। তাদের এমনি আরো সাফল্য কামনা করি। টায়ার পুড়িয়ে এবং অন্যান্য উপায়ে রাস্তা বন্ধ করে রাখা হয়েছে। জুম্মাবারের জেহাদি জোশই আলাদা! প্রশাসন সম্ভবত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এমনি উজ্জ্বল আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে বৃদ্ধাঙ্গুলি চুষছিলেন। সব গণমাধ্যম চুপ থেকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁদের এই দায়িত্বশীল ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন সংবিধান শিরে পবিত্র সত্যধর্মের বিজয় বিঘোষিত করে এবং শরীরে ধর্মনিরপেক্ষতার কবচ ধারণ করে।

শেষ খবর অনুসারে হয়তো সেনা মোতায়েন করা হবে। কী দরকার! সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় থাকুক না।

তবে এসবই শোনা কথা। সুতরাং, দেশে সম্প্রীতি বজায় আছে। সবাই শান্তিতে আছে, সুখে আছে।

শুধু আমার বুকের ভেতরটা কেমন জ্বলে পুড়ে যেতে থাকে। আমি দলিত নিষ্পিষ্ট পোকার মতো গ্রেগর সামসার মত শুধু নিচে, শুধু মাটিতে-ধুলোয় মিশে যেতে থাকি। নিজের অস্তিত্ব কেমন অযৌক্তিক, ভৌতিক, কুৎসিত মনে হতে থাকে। কেন যে আমি জন্ম নিলাম, সেটাই অপরাধ মনে হয়।

আমি যে সেই অশ্লীল বিশেষণে চিহ্নিত,ছিলাম আজন্ম, থাকবো আমৃত্যু, সংখ্যালঘু।