[সাবেক চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়ের সক্রিয় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধকে বহুবছর ধরে বিভ্রান্তির ঘেরাটোপে রাখা হয়েছে। খাটো করে দেখা হয়েছে পাহাড়ি জনগণের মুক্তিযুদ্ধ তথা ১৯৭১ সালে তাদের সব ধরণের চরম আত্নত্যাগের ইতিহাস। একই সঙ্গে সারাদেশে আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের আত্নত্যাগকেও অনেক ক্ষেত্রে অবমূল্যায়ন করার অপপ্রয়াস চালানো হয়। এ কারণে লেখার শিরোনামে ‘অন্য আলোয় দেখা’ কথাটি যুক্ত করা হয়েছে। বলা ভালো, এটি মুক্তিযুদ্ধের ওপর কোনো গুঢ় গবেষণাকর্ম নয়; এটি নিছকই পাহাড়ের মুক্তিযুদ্ধের ওপর একটি আলোচনার অবতারণা মাত্র।]

দ্বিতীয় পর্ব

পাহাড়িদের প্রতিরোধ লড়াই, ১৯৭১

পুনর্বার বলা ভালো, ১৯৭১ সালে ত্ৎকালীন চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় যেমন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন, তেমনি মং রাজা মং প্রু “ সেইন আবার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছেন। সে সময় রাজা মং প্রু “ সেইন মুক্তিবাহিনীর জন্য নিজ প্রাসাদ উজাড় করে দেন। মুক্তিযোদ্ধারা তার প্রাসাদে থেকেই যুদ্ধ করেছিলেন, বহু সাহায্য পেয়েছিলেন। এছাড়া পাহাড়ি নেতা এমএন লারমা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করেন। চাকমা রাজার কাকা শ্রী কেকে রায়ও ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক। কিন্তু শুধু সন্দেহের বশে তাকে ত্রিপুরায় আটক করা হয়েছিল। পাহাড়িদের মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় অধ্যায়টি আমরা চলতি তৃতীয় ও শেষ পর্বে আলোচনা করছি।

‘৭১ এর ২৫ মার্চ পাকিস্তানী সামরিক জান্তা গণহত্যা শুধু করলে সারাদেশের মতো পাহাড়েও তরুণ ছাত্র-যুবারা মুক্তিযুদ্ধের সর্বাত্নক প্রস্তুতি গ্রহণ করে। এই প্রতিরোধ লড়াইয়ে সে সময় বাঙালিদের পাশাপাশি পাহাড়ি আদিবাসীরা সমানভাবে অংশ নিয়েছিলেন। কাজেই ত্রিদিব রায় ও তার অনুসারী মুষ্টিমেয়দের পাকিস্তানপন্থী ভূমিকাকে কেন্দ্র করে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রাম বা সারাদেশের আদিবাসীদের মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাঁথাকে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। বরং কার্যত অমন চেষ্টা উগ্র জাতিগত বিদ্বেষ ও ইতিহাস বিকৃতিকেই উস্কে দেয় মাত্র।

খোদ সরকারের রাঙামাটি জেলার তথ্য বাতায়নে বলা হচ্ছে:

১৯৭১ এর মার্চ মাসে রাঙ্গামাটি জেলা সদরে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়েছিল রাঙ্গামাটি সরকারী কলেজের ত্ৎকালীন ছাত্রনেতা গৌতম দেওয়ান এবং সুনীল কান্তি দে এর নেতৃত্বে।

মুক্তিযুদ্ধকালীন রাঙ্গামাটি জেলার বিলাইছড়িতে অবস্থিত ফারুয়া ও শুকরছড়ির মোহনায় পাক সামরিক ঘাঁটি ছিল। সেখানে পাঞ্জাবী, রাজাকার, আলবদরসহ ২৫০ জন সৈন্য অবস্থান করত। সেখানে পাক সেনাবাহিনীর কয়েকটি স্টীমার ও গানবোটও ছিল। আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে পাইলট মান্নানসহ মুক্তি বাহিনীর একটি দল পাহাড়ী এলাকায় পথ হারিয়ে রাতের অন্ধকারে ফারুয়াস্থ পাক বাহিনীর ক্যাম্পের অভ্যন্তরে এসে পড়ে। তারা চাকমাদের সহায়তায় নৌকায় করে শুকরছড়ি এলাকায় নিরাপদ স্থানে পৌঁছে যায়।

১৭ ডিসেম্বর মিত্র বাহিনীর পূর্বাঞ্চল কমান্ডের অধিনায়ক জেনারেল সিং ওভান এবং শেখ ফজলুল হক মনি ভারতীয় হেলিকপ্টারযোগে রাঙ্গামাটির পুরাতন কোর্ট বিল্ডিং মাঠে অবতরণ করেন। এখানে তাঁদের অভ্যর্থনা জানান ত্ৎকালীন ছাত্রনেতা গৌতম দেওয়ান, আবদুর রশীদ, মোঃ ফিরোজ আহম্মদ, মনীষ দেওয়ান (পরবর্তীতে কর্ণেল)সহ হাজারো ছাত্র-জনতা।

[লিংক]

এতে পাহাড়িদের প্রতিরোধ লড়াইয়ের পাশাপাশি সাধারণ নিরস্ত্র পাহাড়ি জনতার চরম আত্নত্যাগের কথা তুলে ধরে আরো বলা হয়:

পাক বাহিনীরা পার্বত্য জেলা সদর রাঙ্গামাটি ও মহকুমা সদর রামগড় এবং বান্দরবান দখল করার পর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহে ঘাঁটি স্থাপন করে এবং ঘাঁটিসমূহ সুদৃঢ় করে নেয়। তারা বিভিন্ন এলাকায় শাখা কমিটি গঠন করে তাদের মাধ্যমে পার্বত্য এলাকায় রাজাকার বাহিনী ও হিলরাজ বাহিনী গঠন করে এবং বিভিন্ন এলাকায় হানা দিয়ে বর্বর অত্যাচার চালায় ও ঘরবাড়ী জ্বালিয়ে দেয়। পাকবাহিনী রামগড়, গুইমারা, মানিকছড়িসহ বিভিন্ন ক্যাম্পে পাহাড়ী রমনীদের জোর পূর্বক ধরে নিয়ে অমানুষিকভাবে ধর্ষণ করে এবং ক্যাম্পে উলঙ্গ অবস্থায় বন্দী করে রাখে।

১নং সেক্টরের আওতায় সর্বপ্রথম ৫ মে ২৫ সদস্য বিশিষ্ট পার্বত্য চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা দল গঠন করা হয়। এই দল গঠনের নেতৃত্ব দেন হেমদা রঞ্জন ত্রিপুরা। এটি পরবর্তীতে একটি পূর্ণাঙ্গ কোম্পানী হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। শ্রী ত্রিপুরাকে কোম্পানী কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। এই কোম্পানীর অধীনে গ্রুপ নং- ৯১, ৯২, ৯৩, ৯৪ এবং ৯৫ সংযুক্ত করা হয়। উক্ত গ্রুপগুলির ট্রেনিং কেন্দ্র ছিল ভারতের অম্পি নগর এবং ১নং সেক্টর হেডকোয়ার্টার হরিণা। ১নং সেক্টরের অধীনে হরিণা থেকে ৩০ কিঃ মিঃ দূরবর্তী সীমান্ত এলাকা ভারতের বৈষ্ণবপুরে আগস্ট মাসের প্রথম দিকে সাব-সেক্টর স্থাপন করা হয়। সেখানে অবস্থানরত গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় গেরিলা আক্রমণ পরিচালনা করা হয়।

পার্বত্য এলাকায় অবস্থানের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের চলাচলের সুবিধা, শত্রুপক্ষের ঘাঁটি আক্রমণ এবং পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনার সুবিধার্থে বর্তমান খাগড়াছড়ি জেলার অন্তর্গত নাকাপা, কুমারীপাড়া, পাগলা পাড়া, মানিকছড়ি, ডাইনছড়ি, যোগ্যাছলা ও গাড়ীটানা এলাকার গহীন অরণ্যে মুক্তিবাহিনীর গোপন ক্যাম্প বা আশ্রয়স্থল করা হয়। এই সমস্ত গোপন গেরিলা ক্যাম্পে ঐ এলাকার হেডম্যান কার্বারীসহ সকল স্তরের জনগণ খাদ্যশস্য সরবরাহ করত এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন ঐ সমস্ত এলাকার জনগণ মুক্তিযোদ্ধাদেরকে পাকবাহিনীর গতিবিধি এবং তাদের অবস্থান সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করে সাহায্য করত।

[লিংক]

অন্যদিকে, মুক্তিযুদ্ধে গৌরবময় অবদান রাখা এমএন লারমা ও মং রাজা রাজা মং প্রু সাইন প্রসঙ্গে বিশিষ্ট আদিবাসী গবেষক মঙ্গল কুমার চাকমা তার ‘মুক্তিযুদ্ধে পার্বত্যাঞ্চলের জুম্ম জনগণ ও প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয়’ নামক ’ লেখায় জানাচ্ছেন :

… সারাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে সাথে জুম্ম ছাত্র-যুবকরাও আন্দোলনে যোগ দিতে সংগঠিত হতে থাকে। ত্ৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। জুম্ম ছাত্র-যুবকদেরও উদ্বুদ্ধ করেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য। ১৯৭০ সালে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী-লীগের প্রাথী কোকনদাক্ষ রায়ও (রাজা ত্রিদিব রায়ের কাকা) মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে গিয়েছিলেন। এ-সময় কয়েকশো জুম্ম ছাত্র-যুবকও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে ত্রিপুরা রাজ্যে গিয়েছিলো। প্রথম অবস্থায় তারা অনেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণও করেছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে এইচ টি ইমামের প্ররোচনায় জুম্ম ছাত্র-যুবকদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযোগ বন্ধ করে দেয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এ-সময় ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় কোকনদাক্ষ রায়কেও কোনো অজুহাত ছাড়াই গ্রেফতার করা হয়। ফলে অনেক জুম্ম ছাত্র-যুবক মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে না পেরে পার্বত্য চট্টগ্রামে ফেরত আসে।…

[লিংক]

মঙ্গল কুমার চাকমা আরো জানান:

মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন মং সার্কেলের ত্ৎকালীন রাজা মং প্র¦ সাইন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে-সাথে যখন শতো-শতো লোক পরিবার-পরিজন নিয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিতে যাচ্ছিল, তখন তিনি খাগড়াছড়ি জেলার মানিকছড়িস্থ রাজবাড়ীতে তাদের খাওয়া-দাওয়া-সহ নানাভাবে সহায়তা প্রদান করেন। পাক-সেনারা রামগড় দখল করার পূর্বেই তিনি ত্রিপুরা পালিয়ে যান। সেখানে গিয়েও তিনি বসে থাকেননি। কর্ণেলের ব্যাজ পরে তিনি কুমিল্লার আখাউড়াতে যুদ্ধ করেছিলেন। সেজন্য পাক সেনারা মানিকছড়িতে এসে রাজবাড়ী, ত্ৎসংলগ্ন বৌদ্ধ মন্দির ও গ্রামের জুম্মদের ঘারবাড়ী ধ্বংস ও লুটপাট করে।

ত্ৎসময়ে ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেল (ইপিআর) বাহিনীতে কিছু জুম্ম ছিলো। তারা সবাই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে রমণী রঞ্জন চাকমা রামগড় সেক্টরে পাকবাহিনীর সাথে যুদ্ধে নিহত হন। সিপাহী হেমরঞ্জন চাকমা বগুড়া সেক্টরে নিখোঁজ হন। তার লাশও পাওয়া যায়নি। সিপাই অ্যামি মারমাও বগুড়া সেক্টরে যুদ্ধে শহীদ হন। পাক-বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে অসম সাহসিকতার জন্য বান্দরবানের অধিবাসী ত্ৎকালীন ইপিআরের রাইফেলম্যান উখ্য জিং মারমাকে যুদ্ধের পরে বীরবিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। তিনি এখনও বেঁচে আছেন। অভাব-অনটনের মধ্যে কষ্টকর জীবন অতিবাহিত করছেন বান্দরবান শহরে।

সে-সময় পূর্ব পাকিস্তান পুলিস-বাহিনীতেও কিছু জুম্ম চাকরীরত ছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম বিমলেশ্বর দেওয়ান ও ত্রিপুরা কান্তি চাকমা-সহ ২০ / ২২ জন জুম্ম সিভিল কর্মকর্তা ও কর্মচারী ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এঁদের মধ্যে বরেন ত্রিপুরা, কৃপাসুখ চাকমা ও আনন্দ বাঁশী চাকমা ছিলেন অন্যতম।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মেজর জিয়াউর রহমান তাঁর বাহিনী ও ইপিআর বাহিনী নিয়ে রাঙ্গামাটি হয়ে ত্রিপুরা পাড়ি দিয়েছিলেন। জিয়া বাহিনী-সহ রাঙ্গামাটি পৌঁছলে জুম্ম জনগণই তাদেরকে খাদ্য ও অন্যান্য রসদ যুগিয়েছিলো। রাঙ্গামাটি জেলার বন্দুকভাঙ্গায় যেখানে বর্তমানে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আবদুর রউফের সমাধিক্ষেত্র রয়েছে, সেখানে পাকবাহিনীর সাথে যুদ্ধের পর মেজর জিয়া তাঁর বাহিনী নিয়ে জুম্মদের গ্রামের ভিতর দিয়ে নানিয়ারচর, মহালছড়ি ও খাগড়াছড়ি হয়ে রামগড় সীমান্তে চলে যান। সে-সময় গ্রামে-গ্রামে জুম্ম গ্রামবাসীরা মেজর জিয়ার বাহিনীকে খাদ্য-সহ নানাভাবে সহায়তা করেছিলো। কথিত আছে, খাগড়াছড়ি জেলার কমলছড়ি গ্রামের পাশ দিয়ে চেঙ্গী নদী পার হওয়ার সময় নদীতে হাঁটু পানি থাকায় যাতে জুতা-প্যান্ট ভিজে নষ্ট না হয় সে-জন্য কমলছড়ি গ্রামের জনৈক মৃগাঙ্গ চাকমা মেজর জিয়াকে পিঠে তুলে নদী পার করে দেন। জিয়ার বাহিনীকে সহায়তা দেয়ার জন্য পাক-বাহিনী মহালছড়ির সভ্য মহাজন, গৌরাঙ্গ দেওয়ান ও চিত্তরঞ্জন কার্বারীকে ধরে নিয়ে যায়। পাকবাহিনী তাদেরকে আর ফেরত দেয়নি। তাদের লাশও পাওয়া যায়নি। শুধু তাই নয়, এজন্য অনেক জুম্ম নারী বিভিন্ন জায়গায় পাক সেনা সদস্যের ধর্ষণেরও শিকার হয়।

[লিংক]

পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সে সময় যে অল্প কয়েকজন পাহাড়ি আদিবাসী নিরাপত্তা বিভাগে সরকারি চাকরিতে ছিলেন, তাদের মধ্য অন্যদম শহীদ খগেন্দ্র নাথ চাকমা (দ্রষ্টব্য: সূচনা ছবি, তন্দ্রা চাকমা)। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় কুমিল্লার মুরাদনগরে সার্কেল ইন্সপেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে শ্রী খগেন্দ্র নাথ চাকমা পাকিস্তানী বাহিনীর কর্তৃক নিহত হন।

অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারা দেশের প্রায় ৭৫ টি ভাষাগত সংখ্যালঘু জনজাতি্‌ আদিবাসী- মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ইউকে চিং হচ্ছেন একমাত্র বীরবিক্রম উপাধিপ্রাপ্ত আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা। তিনিও সীমান্ত রক্ষী বাহিনী, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস– ইপিআর’ এ কর্তব্যরত অবস্থায় ১৯৭১ সালে ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ইপিআরের নায়েক হিসেবে তিনি রংপুরের হাতিবান্ধা বিওপিতে কর্মরত ছিলেন। সেখান থেকে রংপুর ৬ নম্বর সেক্টরে মেজর বাশারের নেতৃত্বে নয়জন বাঙালি ইপিআর সৈনিককে নিয়ে পাটগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধ করেন। দেশকে পাক হানাদার মুক্ত করতে বিওপিতে কর্মরত একজন বিহারি ও দুজন পাঞ্জাবিকে হত্যা করেন তিনি। টানা নয় মাস সম্মুখ যুদ্ধ করে দেশকে শত্রুমুক্ত করেন ইউকে চিং। তবে যদিও অভাব-অনটন এখন ৭৭ বছর বয়সী এই বীরবিক্রমের নিত্য সঙ্গী। অসংখ্য পদক বা সরকারি সন্মাননা — কোনটিই এই বীর যোদ্ধার বাকি জীবন ও সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারছে না (দ্রষ্টব্য ছবি: বাংলানিউজ টোয়েন্টফোর ডটকম)।

[লিংক]

স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে ভাষাগত সংখ্যালঘু জনজাতি গোষ্ঠিগুলো উপেক্ষিত থেকে যাওয়ার ধারাবাহিকতায় বরাবরই মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের পাতায় উপেক্ষিত থেকে যায় আদিবাসী, উপেক্ষিত থেকে যায় ১৯৭১ এর তাদের প্রতিরোধ লড়াই, সব ধরণের আত্নগ্যাগ, এমন কি মুক্তিযুদ্ধের শেষপ্রান্তেও এসে মুক্তিযোদ্ধা ও বাংলাদেশ রাইফেলস — বিডিআর নামধারী কতিপয় বিপথগামী দুর্বৃত্তের হত্যাযজ্ঞ, যা এই ধারাবাহিকের প্রথম পর্বে বর্ণনা করা হয়েছে।

তাই বাংলাদেশ যেমন বহু জাতি, বহু ভাষা ও বহু সংস্কৃতির দেশ, এদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসও তেমনি বহু জাতি, ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষের আত্নত্যাগের ইতিহাসে বর্ণিল।

—-

সংযুক্ত:
এক। মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসী, সংকোলন, গুরুচণ্ডালি ডটকম।

দুই। দেশের ৭৫ টি আদিবাসী জাতি: বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহায়তায় সারাদেশে অনুসন্ধান চালিয়ে আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাস গত ২৮ নভেম্বর ২০১০ জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে সরকারের উদ্দেশ্য তাদের সুপারিশ তুলে ধরে। ‘আদিবাসী জাতিসমূহের সাংবিধানিক স্বীকৃতি বিষয়ক সুপারিশমালা’ শীর্ষক বক্তব্যে ককাস ৭৫টি ভাষিক সংখ্যালঘু জনজাতির তথ্য প্রকাশ করে।

এই ৭৫টি আদিবাসী জাতিসমূহ হচ্ছে: ১. অধিকারী, ২. অসম/অহম/অহমীয়া, ৩. ওঁরাও/উঁরাও, ৪. কন্দ/কন্ধ/খন্দ কড়া, ৫. কাউর, ৬. কুর্মি/মাহতো, ৭. কর্মকার, ৮.কড়া/করোয়া, ৯. কর্নিদাস, ১০. কোচ, ১১, কোল, ১২. খারিয়া/ খেরিয়া, ১৩. খুমি/খামি, ১৪.খিয়াং, ১৫. খাসি, ১৬. খারওয়ার, ১৭. গন্ড/ গন্ডি/গঞ্জু, ১৮. গড়াইৎ/গড়াত, ১৯. গারো, ২০. গোর্খা, ২১, গৌড়, ২২. চন্ডাল, ২৩. চাকমা, ২৪. চাক, ২৫. ছত্রী, ২৬. ডালু, ২৭. ডোম, ২৮. ত্রিপুরা/টিপরা, ২৯. তঞ্চগ্যা, ৩০. তুরি/ তুরিয়া, ৩১. তেলী, ৩২. নুনিয়া, ৩৩. পল্ল/পলিয়া, ৩৪. পাত্র, ৩৫. পাহান, ৩৬. পাহাড়িয়া, ৩৭. পাংখু/পাংখোয়া, ৩৮. পুন্ড্র/ পোদ, ৩৯. বম, ৪০. বর্মণ, ৪১. বাউরি, ৪২. বাগদী/ বাকতি, ৪৩. বানাই, ৪৪. বাড়াইক, ৪৫. বাদিয়া/বেদিয়া, ৪৬. বীন/বিন্দ, ৪৭. বোনাজ/বুনা, ৪৮. ভর, ৪৯. ভূমিজ, ৫০. ভূঁইয়া, ৫১. ভূঁইমালী, ৫২. মারমা, ৫৩. মারমি/মুরমি, ৫৪. মালো/মাল, ৫৫. মাহালী, ৫৬. মাহাতো, ৫৭. মনিপুরী, ৫৮. মিরধা, ৫৯. মুন্ডা, ৬০. মুরারি/মুরিয়ারি, ৬১. মুষহর, ৬২. ম্রো/মুরং, ৬৩. রাওতিরা, ৬৪. রবিদাস, ৬৫. রাখাইন, ৬৬. রাজোয়াড়, ৬৭. রাই, ৬৮. রাজবংশী, ৬৯. রানা-কর্মকার, ৭০. লুসাই, ৭১. লোহার/লহরা, ৭২. শবর, ৭৩. সাউ, ৭৪. সান্তাল/সাঁওতাল এবং ৭৫. হাজং।

ককাসের তথ্য অনুযায়ী, এই জনজাতিসমূহের আনুমানিক লোকসংখ্যা প্রায় ২৫ লাখ।

তিন। একটি প্রাসঙ্গিক দাবিনামা:

সরকারের উদ্দেশ্য মণিপুরী সমাজ কল্যাণ সমিতি’র ১৪ দফা দাবির অন্যতম —

১। যাচাই বাছাইক্রমে মণিপুরী শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নাম মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের তালিকাভুক্ত করণ। পর্যায়ক্রমে তা সকল ক্ষুদ্র জাতিসত্বার জন্য কার্যকর করা।

২। ঐতিহাসিক বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন, মহান ভাষা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ও অংশগ্রহনকারী বীর মণিপুরী বীর মুক্তিযুদ্ধাদের নাম তালিকা খচিত দৃষ্টি নন্দন ‘স্বাধীনতা স্তম্্ভ’ মণিপুরী অধুøষিত মৌলবীবাজারের কমলগঞ্জস্থ মণিপুরী ললিতকলা একাডেমী প্রাঙ্গনে নির্মাণ। অনুসন্ধানক্রমে অন্যান্য সকল ক্ষুদ্র জাতিসত্বার এমন গৌরবের কিছু থেকে থাকলে তা বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করা।…