খোকা মাকে শুধায় ডেকে, ‘এলেম আমি কোথা থেকে কোন্খেনে তুই কুড়িয়ে পেলি আমাকে?’-অতি বিচক্ষণ মা যে উত্তর দিয়েছে তাতে অবাধ্য খোকা খুশী হয়েছিল কিনা জানা যায় না। তবে খোকার এই জিজ্ঞাসা জগতের অত্যন্ত মৌলিক প্রশ্নাবলীর মধ্যে একটি সন্দেহ নেই। জ্ঞানের সামগ্রিক ইতিহাসে খোকার মত অবাধ্য মানুষগুলো বারবার জানতে চেয়েছে, আমরা কোথা থেকে এসেছি, কী আমাদের উৎস। মানুষের আগমনের অতি সাম্প্রতিক কালের বিজ্ঞান-চিত্র উন্মোচনের আগে তাদের হাতে ছিল অসম্ভব রকমের বাজে সব গল্পকথা। চীনের উপকথায় পাওয়া যায় মানুষ জাতির উদ্ভব ঘটেছে পান্ কু নামে এক ধরনের জীব-দেহের পোকা থেকে। মধ্য আমেরিকার পৌরাণিক গ্রন্থে পাওয়া যায় দেবতারা মানুষ তৈরির জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছিলেন। প্রথমে মাটি দিয়ে, তারপর কাঠ দিয়ে এবং পরিশেষে ভুট্টা দিয়ে তৈরি করলেন আদর্শ মানুষ। গ্রীসের পুরানো কাহিনীতে আছে দেবতারা প্রথমে বানিয়েছিলেন একদল সোনার মানুষ, সে-সময় এই পৃথিবীতে ছিল চির বসন্ত; মানুষ যা ইচ্ছে করত সে তাই পেত। জ্ঞানার্জনের জন্য ছিল অফুরান সময়। কিন্তু খেয়ালী দেবতারা এদের করলেন ধ্বংস, বানালেন রূপোর মানুষ। সৃষ্টি হলো নানা রকমের ঋতু। প্রকৃতি তখন অতটা সদয় ছিল না, দরকার পড়ল ঘর নির্মাণের কিন্তু তাদের আয়ু ছিল এতটা ক্ষীণ যে এসবের আগেই ঘটত মৃত্যু। সে সব দিন চলে গেল। তৈরি হল কাঁসার মানুষ-হাতে শক্ত ধাতুর অস্ত্র। দীর্ঘ দেহ আর আয়ু অতি ক্ষীণ – অবশেষে তৈরী হল হতভাগা এই মানুষ, যাদের কপালে লেখা ছিল অন্তহীন শ্রম – দেহ তৈরী লোহার। কালান্তরে সে লোহা গেল খয়ে, মরণ আসতে থাকল দ্রুত।

মানুষ এই কল্প-কথার উপর নির্ভর করতে পারেনি। ছয় দিনের মধ্যে এই বিরাট মহাবিশ্বের যাবতীয় কিছু সৃষ্টি হওয়ার কথাগুলো আজ অকেজো। দিনকে যুগ বানানোর চেষ্টা করা হলেও সেটাও অপর্যাপ্ত। শ্রদ্ধের পুস্তকাদি আবির্ভূত হওয়ার সময় পৃথিবী যতটা ছোট ছিল বলে ধারণা করা হতো, সময় গড়ানোর সাথে সাথে এর প্রসারতা গেল বেড়ে। বিশেষ করে অভিব্যক্তি সংক্রান্ত ধারণা যখন মানুষের মনে স্থায়ী জায়গা করে নিল, তখনি বাড়তে থাকলো এর বয়স। প্রতœতত্ত্ববিদেরা যখন ফসিলের উপর থেকে মাটি সরাতে থাকলেন তখন আস্তে আস্তে বেরিয়ে পড়ল এদের বয়স। সে বয়স কি দুই এক বছর নাকি? বলতে গেলে লক্ষ লক্ষ বছরের ধাক্কা। কিন্তু বিবর্তন বা অভিব্যক্তি বিষয়টা কী ?
অভিব্যক্তিবাদের মূল কথা হলো আমরা যে জগতে বাস করছি এবং যে প্রাণীকূলের পদভারে এই পৃথিবীটা এগিয়ে চলেছে বা যারা অতীতে ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়, আজ যারা অবলুপ্ত, তারা সবাই এক সাথে জন্ম নেয়নি। অত্যন্ত ক্রমিক, স্থির এবং ধারাবাহিক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে প্রাণীরা সমানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে-প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এগিয়ে যাওয়ার একটা ধাপে আমরা অবস্থান করছি। সুদূর ভবিষ্যতে এরকম ঠিকঠাক থাকবে এ মনে করার কোন কারণ নেই। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যথার্থই বলেছেন –

‘কেহ মনে করেন, এইখানেই আসিয়া শেষ হইল, আর অধিক অগ্রসর হইবে না, কিন্তু কে বলিতে পারে, এই মনুষ্যালয়ের উপর আর এক স্তর মৃত্তিকা পড়িয়া যাইবে না, ও এই মনুষ্য- সমাজের সমাধির উপর আর-একটি উন্নততর জীবের উৎপত্তি হইবে না।’

অভিব্যক্তি সংক্রান্ত সামগ্রিক ধারণায় পৌঁছানোর পূর্বে মানুষের বিশ্বাস ছিল বেশ কয়েকটা মতবাদে। এগুলো হল-

ক) অতি-প্রাকৃতিক মতবাদ
খ) সৃষ্টিবাদ
গ) স্বতঃজননবাদ
ঘ) বর্হিজাগতিক প্রাণের উৎপত্তি বিষয়ক মতবাদ

নমস্য পুস্তকগুলোতে প্রাণ সৃষ্টির যে কথা লেখা আছে সে গুলোই মূলত: অতি-প্রাকৃতিক মতবাদ ও সৃষ্টিবাদ। বাইবেল এ বলা হয়েছে-

‘তারপর ঈশ্বর বললেন,“আমরা আমাদের মতো করে এবং আমাদের সঙ্গে মিল রেখে এখন মানুষ তৈরি করি তারা সমুদ্রের মাছ, আকাশের পাখি, পশু, বুকে হাঁটা প্রাণী এবং সমস্ত পৃথিবীর উপর রাজত্ব করুক”। পরে ঈশ্বর তাঁর মত করেই মানুষ সৃষ্টি করলেন।’

হিন্দুদের পৌরাণিক গ্রন্থ যেমন ঋ্কবেদ, মনুসংহিতা, উপনিষদ কিংবা মহাভারতের পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা বর্ণিত আছে বিশ্বাসীদের কথা। এধরনের মতবাদের মধ্যে চিন্তার কোন ছিটে-ফুঁটাও নেই। শুধু বলা হয়েছে বিশ্বাস করতে।

কিছুটা বিশ্বাস তবে বেশ খানিকটা চিন্তাপূর্ণ ধারণার ফসল হলো স্বতঃজননবাদ বা স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণ উৎপত্তি বিষয়ক মতবাদ। অন্যান্য বিষয়ের মত এখানেও গ্রীক দার্শনিক অ্যারিস্টটল মাথা ঘামিয়েছেন। এই মতবাদের প্রবক্তা আসলে তিনিই। তিনি মনে করতেন অনেক বড় বড় প্রাণীর জন্ম হয় তাদের পিতামাতা থেকে কিন্তু ছোট ছোট প্রাণী যেমন মাছ, কিংবা পতংগের জন্ম হয় স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে। তিনি লক্ষ্য করেন দেখা যাবে কোন পুকুর যখন শুকিয়ে যায় তখন তো এর মধ্যে মাছ থাকার কথা নয় অথচ বৃষ্টিতে পুকুর ভরে গেলে এর মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় নানা প্রকারের ছোট ছোট মাছ। পতংগের ক্ষেত্রেও একই রকম ঘটনা ঘটে। তার ধারণা ছিল নানা রকমের কাঠ, প্রাণীর লোম, মাংস এমনকি প্রাণীর মলমূত্রের মধ্যেও অনেক প্রাণের অস্তিত্ব মেলে। পরবর্তী কালের অনেক জীববিজ্ঞানীও একই রকমের কথা বলেন। প্রথমদিকে তারা ধারণা করতেন প্রাণ সৃষ্টির প্রক্রিয়াটা বুঝি এক্কেবারে সহজ। একটা জারের মধ্যে খোলা অবস্থায় কিছু পঁচা মাছ-মাংস রেখে দিলেই তাতে পোকা হয়ে যায়। সুতরাং ব্যাপারটা একেবারে নস্যি! ভন হেলমন্ট নামে এক জীববিজ্ঞানী মানুষের ঘাম আর গমের ভুষি একত্রে ২১ দিন রেখে দিয়ে দেখেন তার মধ্যে ইঁদুর জন্ম নিয়েছে। কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণ উৎপত্তির প্রথম চ্যালেঞ্জ আসে ইতালীর এক বিখ্যাত চিকিৎসক ও জীববিজ্ঞানী ফ্রান্সেস্কো রেডি-র নিকট থেকে। রেডি এ নিয়ে বড়-সড় একটা পরীক্ষা চালিয়েছিলেন। তিনি একটি বাক্সের মধ্যে মরা সাপ রেখে কিছুদিন পঁচতে দেন। কয়েকদিন পর তিনি লক্ষ্য করেন সাপ গুলোর গায়ে ছোট ছোট শুককীটে ভরে গেছে। এর কয়েকদিন পর তিনি দেখেন এক মজার ঘটনা। দেখেন শুককিট গুলো সাপের সব মাংস খেয়ে নিজেদের চেহারা করেছে শক্ত গুটির মত। কয়েকদিন পর সেই গুটি ফেটে বেরিয়ে পড়ল অসংখ্য ছোট ছোট মাছি। রেডি এই ঘটনাকে হালকাভাবে নিলেন না। তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছান ঐ সাপের গায়ে যে মাছি গুলো বসেছিল হয়ত তাদের থেকেই শুককিটগুলো জন্ম নিয়েছে, যার ফলাফল স্বরূপ তৈরী হয়েছে মাছি। এর সাথে সাথে তিনি আরেকটাও পরীক্ষা চালান। একটি জারের মধ্যে মাছ, মাংস ভালো করে সিদ্ধ করে মুখ ঢেকে কয়েকদিন রেখে দেন। কিন্তু দেখা গেল কয়েকদিন পর এর মধ্যে কোন লার্ভা জন্মায়নি। এই পরীক্ষা থেকে রেডি সর্বশেষ এই সিদ্ধান্তে আসেন যে স্বতঃজনন বলতে যা বোঝায় তার যৌক্তিক ভিত্তিটা দুর্বল। পরবর্তীতে আরো কিছু জীববিজ্ঞানী স্বতঃ জনন মতবাদটি বাতিল করেন দেন।

স্বতঃজনন মতবাদটি যখন মানুষের কাছে অগ্রহণযোগ্য হয়ে উঠল তখন কিছু মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করল যে জীবনের উৎপত্তি হয়েছে এই পৃথিবীর বাইরে কোথাও। এই তত্ত্বের অন্যতম প্রবক্তা হলো সুইডিস বিজ্ঞানী আরহেনিয়াস (১৮৮৯-১৯২৭)। তিনি মনে করেন পৃথিবীর বাইরে কোথাও হয়তো জীবনের উৎপত্তি হয়েছে। সেখান থেকে কোন ভাবে এখানে বীজ এসেছিল। তবে এ মতবাদের পক্ষে যুক্তি যে একেবারেই ছিল না তা নয়। কারণ পৃথিবীতে মাঝে মধ্যে যে উল্কাপাত হয় তার মধ্যে বেশকিছু জৈবিক পদার্থের সন্ধান মিলেছে। তবে নানা কারণে এ মতবাদটিও অগ্রহণযোগ্যই থেকে গেছে।

জীবনের উৎপত্তি সংক্রান্ত সবচেয়ে বিজ্ঞান ভিত্তিক চিত্রে পৌঁছেছে মানুষ সাম্প্রতিককালে। এর নাম দিয়েছেন তারা জীবনের রাসায়নিক উৎপত্তির তত্ত্ব। জীববিজ্ঞানী জে. ডি. বার্নাল বলেছেন-

‘জীবন হচ্ছে এক অতি জটিল ভৌত রাসায়নিক তত্ত্ব যা একগাদা সুসংহত বা একীভূত ও স্বনিয়ন্ত্রিত রাসায়নিক ও ভৌত বিক্রিয়ার মাধ্যমে তার পারিপার্শ্বিকের বস্তু ও শক্তিকে স্বীয় বৃদ্ধির কাজে ব্যবহার করে।’

জীববিজ্ঞানীরা বলেছেন, জীবনের উৎপত্তি কোন অলৌকিক বিষয় নয়। জীবনের উৎপত্তি হয়েছে একটা দীর্ঘ ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। এই প্রক্রিয়াকে দু’টো পর্বে ভাগ করা যেতে পারে- একটি রাসায়নিক বিবর্তন (Chemical Evolution) ও অপরটি জৈব বিবর্তন (Organic Evolution)।

অজৈব অণু থেকে জৈব অণুর আবির্ভাব কিভাবে সম্পন্ন হয়েছে তা নিয়ে যুগ যুগ ধরে মাথা ঘামিয়েছে জীববিজ্ঞানীরা। রাশিয়ান প্রাণ রসায়নবিদ এ. আই. ওপারিন সর্বপ্রথম প্রস্তাব করেন, জীবন সৃষ্টির পূর্বে একটা দীর্ঘ রাসায়নিক প্রক্রিয়া সংঘটিত হয়েছে। এর জন্য প্রয়োজন ছিল পৃথিবীতে ভৌত রাসায়নিক অবস্থা। ১৯১২ সালে প্রকাশিত ‘ঞযব ঙৎরমরহ ড়ভ খরভব ’ গ্রন্থে তিনি জীবন তৈরীর প্রাণ রাসায়নিক ব্যাখ্যা প্রদান করেন। উক্ত গ্রন্থে তিনি অজৈব অণু থেকে জৈব অণু আবির্ভাবের ধারাবাহিক ও ক্রমিক বিবরণ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, পৃথিবীর আবহাওয়ামন্ডলের বিবর্তনের একটা পর্যায়ে জীবনের আবির্ভাব হয়েছে। জীবন তৈরির একই রকম ব্যাখ্যা প্রদান করেন ইংরেজ বিজ্ঞানী জে.বি.এস. হেলডেনও। জীবনের রাসায়নিক বিবরণ তত্ত্বটি পরবর্তীতে ওপারিন হেলডেন তত্ত্ব নামে পরিচিতি পায়। অবশ্য তারা এই ধারণাটা পেয়েছিলেন স্যার এফ.জি. হপকিন্স নামে একজন বিজ্ঞানীর নিকট থেকে। ওপারিনের এই ধারণার পরীক্ষণমূলক সমর্থন মেলে ১৯৫৩ সালে। স্টানলি মিলার ও তার শিক্ষক হেরাল্ড ওরে ১৯৫৩ সালে পরীক্ষাগারে কিভাবে পৃথিবী সৃষ্টির প্রাথমিক অবস্থায় জৈব রাসায়নিক যৌগ সৃষ্টি হতে পারে সেটা দেখান।

বিবর্তন প্রক্রিয়া এমন একটা স্বতঃস্ফূর্ত পরিবর্তন যার মধ্য দিয়ে জীবেরা সহজ, সরল অবস্থা থেকে জটিল ও গুণগতভাব সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থায় পদার্পিত হয়। আমরা জানি হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন সাধারণ তাপে বায়বীয় পদার্থ। এদের রাসায়নিক বিক্রিয়ায় তৈরী হয় জল। জলের গুণগত বৈশিষ্ট্য আবার এদের থেকে ভিন্ন। হাইড্রোজেন, অক্সিজেনের সাথে যদি কার্বন মিলিত হয় তাহলে তৈরী হয় চিনি বা শর্করা জাতীয় পদার্থ। এরপর কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেনের সাথে নাইট্রোজেন মিলিত হলে তৈরী হয় অ্যামাইনো এসিড। জীবন সৃষ্টির অন্যতম উপাদান হলো এই অ্যামাইনো এসিড। অ্যামাইনো এসিডকে বলে প্রোটিনের মনোমার। নানা সময়ে প্রোটিন তাদের ভৌত ধর্মের ভিন্নতা প্রদর্শন করলেও, তারা সবাই আর্দ্র-বিশ্লেষণে অ্যামাইনো এসিড তৈরি করে। এ ধরনের বিশ্লেষণ এসিড, ক্ষার ও এনজাইম দ্বারা তৈরী হয়। অ্যামাইনো এসিড এমন ধরনের জৈব এসিড যাতে কার্বক্সিল মূলক (COOH) যুক্ত কার্বন পরমাণুর সাথে অ্যামিনো মূলক (-NH2) যুক্ত থাকে।

গ্রীক শব্দ ‘প্রোটীয়াস’ থেকে প্রোটিন শব্দের উদ্ভব, যার অর্থ প্রথম। নামকরণটা যথার্থ। কারণ কোষের প্রোটোপ্লাজমের প্রথম উপাদান হলো প্রোটিন। প্রোটিন হলো উচ্চ- আণবিক ভর বিশিষ্ট জৈব যৌগ। এটা আর্দ্র বিশ্লেষিত হয়ে অ্যামাইনো এসিড (RCH(NH2)COOH) উৎপন্ন করে। অ্যামাইনো এসিডের পলিমার হলো প্রোটিন। প্রোটিনের মধ্যে রয়েছে পাঁচটি প্রধান মৌলিক উপাদান- কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন ও সালফার। অবশ্য সামান্য পরিমাণে আয়রণ, আয়োডিন, কপার, জিংক ইত্যাদিও থাকে। প্রাণের উদ্ভবের জন্য প্রোটিন অতি জরুরি একটা উপাদান। আমরা যে রবার কিংবা প্লাষ্টিক অথবা কৃত্রিম তন্তু দেখি এরা এইসব পলিমার জাতীয় অণু- যার একটাই অংশ বারংবার জুড়ে তৈরী হয়। আসলে প্রোটিনের অণুগুলো যে ক্ষুদ্র অংশের সমন্বয়ে গঠিত তারা এই অ্যামাইনো এসিড। বহু বছর ধরে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন ধরনের প্রোটিন থেকে অ্যামাইনো এসিডদের আলাদা করেছেন। যেসব অ্যামাইনো এসিড জুড়ে প্রোটিনের অণু গঠিত হয় তাদের মোট সংখ্যা কুড়ি। যে-কোন প্রোটিনের অণু গঠিত হতে এই কুড়ি রকমের অ্যামাইনো এসিডের প্রতিটিই খুব কম পরিমাণে প্রয়োজন পড়ে।

যে বায়োপলিমারের অণুরা বংশগতির ধারা সংরক্ষণ এবং কোষের প্রোটিন ও এনজাইম সংশ্লেষণের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে থাকে তাদেরকে নিউক্লিক এসিড বলে। কার্বন, হইড্রোজেন, নাইট্রোজেন, অক্সিজেনের সাথে ফসফরাস মিলিত হয়ে তৈরী হয় নিউক্লিওটাইডের অণু। নানা রকমের নিউক্লিওটাইডের অণু একত্রে শৃংখলাকারে সু-সংগঠিত হয়ে তৈরী হয় নিউক্লিক এসিড। নিউক্লিক এসিড দু’ প্রকার- ডি অক্সিরাইবো নিউক্লিক এসিড (Deoxy-ribo nucleic acid) সংক্ষেপে ডি. এন. এ ও রাইবো নিউক্লিক এসিড (Ribo nucleic acid) সংক্ষেপে আর.এন.এ।

অতিবিস্ময়কর ব্যাপার হলো এরা নিজেদের অনুলিপি বানাতে পারে এবং নিজেদের পুনরুৎপাদনের অদ্ভুত ক্ষমতা বহন করে। সরল প্রোটিনের অণু তৈরীর প্রক্রিয়ার অনুঘটক হিসেবে কাজ করে একটা একতন্ত্রী আর.এন.এ অণু। যে আর.এন.এ অণু তৈরী হয় তা আরো স্থায়ী হয় এবং বেশ লম্বা হতে থাকে এবং প্রতিরূপায়ণের দক্ষতা অর্জন করতে থাকে। এর মাঝে তৈরী হয় ডি.এন.এ অণু। ডি.এন.এ অণু আর.এন.এ অণু থেকে অধিক স্থায়ী হয় এবং এর কুন্ডুলী আরো বেশ লম্বা হতে থাকে যাতে লক্ষ লক্ষ নিউক্লাইড ধরে রাখতে পারে। এতে সঞ্চিত হতে থাকে বহু বহু তথ্য যা নিরাপদ ও স্থায়ী। যখন কোষ বিভাজিত হয় তখন এই ডি.এন.এ অণু গুলো নিজেদের অনুলিপি সৃষ্টি করে দ্বিগুণ হয় এবং সমান ভাবে বিভক্ত হয়ে যায়।

অভিব্যক্তির নিরন্তন খেলায় প্রথম তৈরী হলো আদিম প্রাণবস্তু অতি সহজ সরল ভাইরাস। এদের ক্রমবিকাশের এই পর্যায়ে তৈরী হল প্রোক্যারিয়োট (Prokaryotes) নামে এককোষী জীব। আদিম প্রাণবস্তুর এই আবির্ভাবের কাল এখন থেকে তিনশত কোটি বছর আগে। অভিব্যক্তির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় একটা স্তর থেকে অন্য একটা স্তরে উত্তরণ ঘটলে তা পূর্ববতী স্তর থেকে অধিক জটিল সাংগঠনিক কাঠামো ধারণ করে।

আদি প্রাণ তো হলো কিন্তু মানুষ? এককোষী অতি সরল ভাইরাস থেকে কী করে মানুষ তৈরী হতে পারে তা বিশ্বাস করতে চাইলো না কেও। ভাইরাস থেকে ইতর শ্রেণীর প্রাণীদের আবির্ভাবের কথা বিশ্বাস করানো গেলেও মানুষের উদ্ভবের কথা কিছুতেই বিশ্বাস করানো গেল না। কেননা মানুষ জানে সৃষ্টির সেরা জীব সে। তার বুদ্ধিবিবেক, মানবিকতা এবং পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার যে অদ্ভুত কৌশল সে জানে, তাতে কিছুতেই মনে হয় না মানুষ বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো কোন জন্তুর দূর সম্পর্কের জ্ঞাতি ভাই। বাইবেলে যেহেতু উল্লেখ আছে, ঈশ্বর তার নিজের মত করে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন সে কারণে মানুষকে হঠাৎ করে দেবতার আসন থেকে জান্তব স্তরে কে নামাতে চাইবে? শ’খানেক বছর আগেও মানুষের বিশ্বাসের মজবুত ভিতের উপর দাঁড়িয়ে অভিব্যক্তি সংক্রান্ত কোন তত্ত্ব দাঁড় করানো শুধুমাত্র কঠিনই ছিল না, ছিল বিরাট ঝুঁকি-পূর্ণ ব্যাপার। সেই কাজটিই করেছিল সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মানুষদের অন্যতম ইংরেজ বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন (১৮০৯-১৮৮২)। ডারউইন ১৮৫৯ সালে ‘On the Origin of Species by means of Natural Selection, or the Preservation of Favoured Races in the Struggle for Life’ নামে একটি বই লেখেন। প্রকাশক পরবর্তীতে ‘The Origin of Species’ নামে বইটার নামকরণ করেন। এই গ্রন্থটি ছিল অত্যন্ত তথ্য সমৃদ্ধ এবং তাঁর সুদীর্ঘ দিনের নানা পর্যবেক্ষণের ফসল। এখানে প্রকৃতির নির্বাচনের পথে নতুন করে কিভাবে প্রাণের সৃষ্টি হয় এবং তাঁর বিকাশ ঘটে তা নিয়ে তিনি আলোচনা করেন। তবে মানুষের উদ্ভবের বিষয়ে তিনি এখানে কিছু বলেননি, শুধু পরবর্তীতে আলোচনার একটা ইংগিত দিয়েছিলেন মাত্র। তার ২২ বছর পর ১৮৭১ সালে প্রকাশিত হয় ‘ The Descent of Man and Selection with Respect to Sex’ নামে একটি গ্রন্থ। গ্রন্থটি সাড়া জাগিয়েছিল দারুণভাবে। এর ছিল দু’টি ভাগ- একভাগে ছিল মানুষের বিবর্তন সক্রান্ত বিষয় অন্যভাগে ছিল যৌন ও প্রাকৃতিক নির্বাচন সংক্রান্ত ঘটনা। ডারউইনের অভিব্যক্তি সংক্রান্ত পুরো মতবাদকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলো-বংশবৃদ্ধির অতিরিক্ত হার, জীবন সংগ্রাম, প্রকারণ ও যোগ্যতমের জয়।

ডারউইন তার অভিজ্ঞতায় লক্ষ্য করেন এই পৃথিবীতে যত প্রাণের জন্ম হয় বাস্তবিকভাবে সবাই বেঁচে থাকে না । যদি সবাই বেঁচে থাকত তাহলে একটা প্রজাতির প্রাণীতেই জগত পরিপূর্ণ হয়ে যেত। কিন্তু তা হয় না। না হওয়ার কারণ হিসেবে তিনি মনে করেন, প্রতিটি প্রজাতির প্রতিটি প্রাণীর মধ্যে চলছে নিরন্তর সংগ্রাম। এ সংগ্রাম চলছে অন্তঃ প্রজাতি (intra-species) ও আন্তঃ প্রজাতি (inter-species)-র মধ্যে। কে কার আগে যাবে তা নিয়ে সর্বত্র চলছে যুদ্ধ। টিকে থাকার এই সংগ্রামের নাম দেন তিনি জীবন সংগ্রাম (Struggle for life)। দেখা গেছে যারা বাড়তি যোগ্যতা নিয়ে এ সংগ্রামে জয়ী হচ্ছে তারা নিজেদেরকে নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়াতে পারে। আর যারা খাপ খাওয়াতে পারে তারাই যোগ্য বলে বিবেচিত হয়। এর নাম যোগ্যতমের জয় (survival of the fittest)। প্রশ্ন হতে পারে, যে গুণাবলীর কারণে যোগ্যতম প্রাণীরা বেঁচে থাকে সেই গুণগুলো তারা কোথা থেকে পায়? ডারউইন বলেছেন এই গুণগুলো সম্পূর্ণরূপে জন্মগত। জন্মগত হওয়ার কারণে পরবর্তী প্রজন্মে এই গুণগুলো বাহিত হয়ে থাকে। তবে হুবহু প্রাণী পূর্ব প্রজন্মের গুণগুলো পায় না। এর মধ্যে বিভিন্ন কারণে ঢুকে পড়ে আরো কিছু নতুন বৈশিষ্ট্য। যার দরুন উদ্ভব ঘটে থাকে সম্পূর্ণ নতুন জাতের কোন প্রাণী। ডারউইন সামগ্রিক এই প্রক্রিয়ার নাম দেন প্রাকৃতিক নির্বাচন (Natural Selection)। তিনি প্রস্তাব করেন এই প্রাকৃতিক নির্বাচনের ফলেই একটা প্রজাতি থেকে অন্য নতুন একটা প্রজাতির উৎপত্তি ঘটে চলেছে।
কোটি কোটি বছর ধরে অত্যন্ত ধীর গতিতে অভিব্যক্তিক প্রক্রিয়ায় অসংখ্য প্রজাতির জীবের আবির্ভাব ঘটেছে এই পৃথিবীতে। এই সব জীবের মধ্যে অনেকের সাথে অনেকের রয়েছে নানা রকমের মিল। দেহগত, গঠনগত বা জীবাশ্মগত মিলের দিক খেয়াল রেখে জীববিজ্ঞানীরা প্রাণীদেরকে ভাগ করেছেন- পর্ব, শ্রেণী, বর্গ, উপবর্গ, অধিবর্গ, অধিগোত্র, গোত্র, উপ-গোত্র, গণ ও প্রজাতিতে। সবচেয়ে বেশি সাদৃশ্য রয়েছে প্রজাতির মধ্যে। একই প্রজাতির নানা পুরুষের সাথে নারীর মিলনে তৈরী হয় নতুন এক প্রাণের। এই জন্য সমগ্র মনুষ্যজাতি একই প্রজাতির আওতাভুক্ত। এরপর সবচেয়ে বেশী সাদৃশ্য পূর্ণ প্রজাতিদের নিয়ে ‘গণ’, সবচেয়ে বেশী সাদৃশ্যপূর্ণ ‘গণ’ নিয়ে ‘উপগোত্র’ ইত্যাদি গঠিত হয়।

বিবর্তনের মিছিলে প্রাণ সৃষ্টির স্বতঃস্ফূর্ত লীলায় এককোষী প্রাণী থেকে বহুকোষী অমেরুদন্ডী প্রাণী, অমেরুদন্ডী থেকে মেরুদন্ডী প্রাণী মাছ, মাছ থেকে উভচর প্রাণী, উভচর থেকে সরীসৃপ এবং সরীসৃপ থেকে পক্ষীসমূহ ও স্তন্যপায়ী প্রাণীর উদ্ভব ঘটেছে। বিবর্তনবাদীরা বলেছেন মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে অনেকটা আকস্মিকভাবে। এখন থেকে প্রায় ৭০ মিলিয়ন বছর আগে এই পৃথিবীতে নেমে এসেছিল দারুণ এক বিপর্যয়। আকাশ ভেঙে নেমে এসেছিল ভয়ংকর শৈত্য। সে সময় রাজত্ব ছিল সরীসৃপ প্রাণীদের রাজা ডাইনোসরদের। তারা দাপিয়ে বেড়াতো সারা পৃথিবীতে। কিন্তু যমদূতের মত শৈত্য নেমে আসায় করুণ মৃত্যু হল এইসব দানবদের। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো এরই মাঝে বেঁচে থাকলো উষ্ণ রক্তের প্রাণীরা। এতদিনে ডাইনোসরদের উৎপাতে যারা কোনমতে গাছ গাছালিতে বাস করত সে সব স্তন্যপায়ী প্রাণীরা আর পাখিরা উষ্ণ রক্তের অধিকারী হওয়ার দরুণ বেঁচে থাকল। পাখিরা বেশ আগে নিজেদেরকে অভিযোজিত করে নিয়েছিল বাতাসে। তারা থাকল, সাথে থাকল কিছু স্তন্যপায়ীরা। আমরা মানুষের যে শ্রেণীবিন্যাসের কথা জানি তাতে ঔসব বৃক্ষারোহী স্তন্যপায়ী প্রাণীরাই হল আদি প্রাইমেট বর্গের। সম্ভবতঃ সাত কোটি বছর আগেকার স্তন্যপায়ী প্রাণীদের অতি ক্ষুদ্র এক সদস্য গেছো ছুঁচোই আদি প্রাইমেট। পরবর্তীতে এই সব প্রাইমেটদের আকার বাড়তে থাকে। এরা হয় বানর ও এপ। নানা রকমের আবহাওয়ার পরিবর্তন, পরিবেশের বিপর্যয় ইত্যাদি কারণে কিছু প্রাণী ক্রমে ক্রমে দু’পায়ের উপর ভর দিয়ে চলতে থাকে। এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে উৎপন্ন হল হোমিনিড গোত্রের প্রাণীরা-যাদের সর্বশেষ হল মানুষ।

মানব বিবর্তনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য মেলে জীবাশ্মবিদ্যা থেকে। জীবাশ্ম শব্দের অর্থ জীবের ছাই। অন্যদিকে ফসিল শব্দের অর্থ যাকে মাটি খুঁড়ে তোলা হয়েছে। সে হিসেবে জীবাশ্ম বা ফসিল শব্দের মানে দাঁড়ায় বহু প্রাচীনকালের উদ্ভিদ বা প্রাণীর দেহাবশেষ, যাকে দেহের উপর থেকে মাটি সরিয়ে উদ্ধার করা হয়েছে। আসলে এই পৃথিবীর আদিম প্রাণ থেকে ক্রমান্বয়ে যে জীবনের মিছিল সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে তাতে যুগান্তরে স্তরে স্তরে থেকে গেছে তাদের দেহাবশেষ। দেখা গেছে মাটি সরিয়ে ক্রমান্বয়ে বিজ্ঞানীরা যত নিচের দিকে জীবের সন্ধান করেছেন ততই তারা সন্ধান পেয়েছেন সরল জীবদের জীবাশ্ম বা ফসিল। জীবাশ্ম থেকে জীবের যে গঠন, প্রকৃতি, বয়স কিংবা বুদ্ধিমত্তার যে পরিচয় পাওয়া যায় তা বিবর্তন বিদ্যাকে অনেক সমৃদ্ধ করেছে। অবশ্য জীবাশ্মবিদ্যার সাথে যুক্ত করতে হয়েছে বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার জ্ঞান।

জীববিজ্ঞানীরা এ পর্যন্ত গবেষণা থেকে যে আলামত উদ্ধার করেছেন তাতে অনুমান করা হচ্ছে মানুষ এবং নর বানরদের পূর্ব পুরুষ ছিল এক। নর বানর বলতে গিবন, ওরান ওটাং, গরিলা বা শিম্পাঞ্জিদের বোঝানো হয় যারা প্রাইমেটদের মধ্যে মানুষের সবচেয়ে কাছাকাছি। প্রায় তিন কোটি বছর আগে হয়তবা মানুষদের পূর্ব পুরুষ থেকে এরা আলাদা হয়ে গেছে।

বিবর্তন সম্পর্কে যাদের ছিটেফুঁটা ধারণা নেই তারা প্রায়ই একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করেন বানর থেকে যদি মানুষের উদ্ভব ঘটে থাকে তাহলে আজকাল এদিক ওদিক ঘুরে বেড়নো বানর গুলোর পেট থেকে কেন কোনো মানব শিশু জন্ম নেয় না ? এ ধরনের প্রশ্ন যারা করেন তাদের অজ্ঞতা এই কারণেই যে বিবর্তনবাদীরা যা বলেছেন অত্যন্ত আবেগের কারণে তারা তা লক্ষ্য করেননি। বিবর্তনবাদীরা কখনই বলেননি বানর বা এই ধরনের ইতর শ্রেণীর প্রাণী থেকে মানুষ হয়েছে। তারা বলেছেন জীবন নামক যে বৃক্ষ, তার যে ডালের শাখায় মানুষ ফলেছে সেই ডালের খুব কাছাকাছি যেয়ে ছোট কোন শাখায় এই ধরনের শ্রেণীর প্রাণীর উদ্ভব ঘটেছে। অর্থাৎ তারা খুব কাছাকাছি যেয়ে একে অন্যের থেকে পৃথক হয়েছে। আসলে তাদের আদি পুরুষ হয়ত ছিল এক। এখনও পর্যন্ত যে তথ্য পাওয়া গেছে তাতে দেখা যায় এখন থেকে ত্রিশ হাজার বছর আগের মানুষের যে দেহাবশেষ পাওয়া গেছে সেটাই প্রাচীন আধুনিক মানুষ। ১৮৬৮ সালে ফ্রান্সের বোর্দো নামক এক শহরের পাশে ক্রো-মানিয়ঁ (Cro-Magnon) নামে এক গুহায় কয়েকটা মানুষের কঙ্কাল পাওয়া যায়। এ ধরনের কঙ্কালের তাই নাম দেওয়া হয়েছে ক্রো-মানিয়ঁ মানব।

জার্মানীর রাইন নদীর অববাহিকায় ডুসেলডর্ফ শহরের নেয়ান্ডের উপত্যকা। ডুসেলডর্ফের পূর্ব দিকের এই অঞ্চলের নাম নেয়ান্তের টাল। কিছু মানুষ ১৮৫৬ সালে চুনাপাথরের একটি গুহা থেকে মানুষের সাদৃশ্য কিছু হাড়গোড় খুঁজে পায়। এগুলো মানুষের এত কাছাকাছি ছিল যে, অনেকে একে নেয়ান্তেরটাল মানব বলে অভিহিত করেন। এগুলো এখন থেকে একলক্ষ বছর আগেকার। ডারউইনের এক সমর্থক ব্রিটিশ জীববিজ্ঞানী টমাস হেনরি হাক্সলি (১৮২৫-১৮৯৫) জানালেন এগুলো বর্তমান মানুষদের পূর্বপুরুষ। কিন্তু প্রজাতিতে ভিন্ন। এজন্য এর নাম দিলেন হোমো নেয়ান্তের টালেন্সিস। এরা ছিল আকারে বেটে, পাও ছিল বাঁকা, মুখটা অনেকটা বনমানুষের মত। তবে এদের বুদ্ধি ছিল সম্ভবতঃ তীক্ষè। নিয়ান্তের টাল মানুষদের বসবাস ছিল ইউরোপে। আজ থেকে ৩৫,০০০ বছর আগে এরা বিলুপ্ত হয়ে যায় যখন আধুনিক মানুষের আবির্ভাব ঘটে।

কেউ কেউ মনে করেন আধুনিক মানুষেরা অন্য কোন জায়গা থেকে ইউরোপে এসে এদের হত্যা করে অথবা এও হতে পারে এই ধরনের মানুষ ক্রমবিবর্তনে আধুনিক মানুষ রূপে আবির্ভূত হয়ে এদের হত্যা করে নিজেদের রাজত্ব কায়েম করে। ওঝেন দুবোয়ো (১৮৫৪-১৯৪০) ছিলেন নামকরা একজন ওলন্দাজ জীবাশ্মবিদ। তিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে আদি হোমিনিডদের খুঁজে পাওয়ার জন্য গবেষণা কাজ শুরু করেন। সেই সময় ইন্দোনেশিয়া ছিল ওলন্দাজদের দখলে। এই কারণেই দুবোয়ো এই জায়গায় অনুসন্ধান কাজ শুরু করেন। ১৮৯১ সালে জাভাতে তিনি পেয়ে যান প্রাচীনকালের মানুষদের মাথার খুলি আর দাঁত। তবে তার মগজের পরিমাণ আজকের মানুষের মত না। দুবোয়ো এর নাম দেন পিথেকান থ্রোপাস ইরেক্টাস। চীনের বেইজিং শহরের কাছাকাছি এক জায়গায় ঠিক এই ধরনের মানুষদের দেহের অংশ পাওয়া যায়। বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন এই সব মানুষ হোমিনিড গোত্রের অন্তর্ভূক্ত যারা ১৫ লক্ষ বছর আগেকার। অনুসন্ধান করতে করতে বিজ্ঞানীরা আরো পিছনে চলে গেছেন। তারা বলেছেন হোমো ইরেক্টাস থেকেও প্রাচীন হোমিনিড হলো হোমো হার্বিলিস। ব্রিটিশ জীবাশ্মবিদ লুইস্ লিকি (১৯০৩-১৯৭২) আফ্রিকার তানজেনিয়াতে মাটি খুঁড়ে কিছু মানুষদের হাঁড় ও খুলি উদ্ধার করেন। তিনি এদের নামদেন হোমো হার্বিলিস। তিনি মনে করেন এগুলো ১৮ লক্ষ বছর আগেকার। অবশ্য গল্পটা এখানেই শেষ নয়। প্রায় ৪০ লক্ষ বছর আগেকার আরো আদিম মানুষদের সন্ধান মিলেছে। তবে তারা যতটা মানুষ ততটাই বনমানুষ। অর্থাৎ এদেরকে বলা চলে না মানুষ না বনমানুষ।