কয়েক হাজার বছর ধরে ভারতীয় অনুভূতির মৌলিক সূত্রানুধাবন করে এ-কথা নির্দ্বিধায় বলা চলে, প্রাকৃতজন তথা সাধারণ মানুষদের জগৎ-জীবন সংক্রান্ত একান্ত ভাবনাগুলোর অন্যতম বিষয়বস্তু হলো লোকায়ত বোধ তথা বস্তুবাদী চিন্তা। এই লোকায়ত চিন্তা আবর্তিত হয়েছে এই মর্তালোকেরই নানা প্রাপঞ্চিক বিষয়াদিকে ঘিরে। এ কথা অস্বীকারের জো নেই, আজকের দিনে আমরা যে মুক্ত, উদার, নৈর্ব্যক্তিক, নির্বারিত ও প্রগতিশীল ভাবনার উপর দাঁড়িয়ে বিজ্ঞান-সাহিত্য-দর্শন-শিল্পকলার অনুশীলন করে চলেছি তার শেকড়টা  কিন্তু গ্রথিত ঐ প্রাচীন লোকায়ত চিন্তার মাঝে। এই লোকায়ত চিন্তা কোন দেবলোকের পরমসত্তাকে অবলম্বন করে গড়ে ওঠেনি; এজন্য এটা কোন ইন্দ্রপুরীর রহস্য ঘেরা কল্প-কথন নয় বরং তা প্রকটিত হয়েছে এই মর্তেরই চিরচেনা বস্তুসকলকে আবর্তন করে। আমাদের পরিচিত এই দৃশ্যমান বাস্তবতায় ধরা পড়া বিষয়াদিই এই পুরোগামী চিন্তার প্রাণ। যদিও প্রাচ্য-প্রতীচ্যের মনীষীদের অনেকেই ভারতীয় ভাবনাকে নিছক আধ্যাত্মিকতার আকর হিসেবে চিহ্নিত করেছেন তবু নির্লেপ অনুসন্ধানে এ অভিযোগের বিশেষ কোন সত্যতা মেলেনি। অনেক গবেষক বলেছেন-

The materialist school of thought in India was as vigorous and comprehensive as materialistic philosophy in the modern world. Spiritualism was dominant in the thought of India but there were people in ancient India who hold views against the existing belief and observances.

অতি প্রাচীন কাল থেকেই আধ্যাত্মচিন্তাা পাশাপাশি বস্তুবাদীচিন্তারও ভারতীয় মানসকে সমান ভাবে পরিপ্লুত করেছে। বলা যায় সমকালে পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী ধারার বেশীরভাগ উপাদানই ভারতীয় বস্তুবাদের মাঝে লুকিয়ে আছে।

আজকের আমরা যে আউল-বাউল-কর্তাভজা, মরমিয়া, সুফি, নাথ, বৈষ্ণব, সহজিয়া, বামাচার, বলাহাড়ি, সাহেবধনী, কাপালীক, মহাযানী মত-মতবাদের সাথে পরিচিত, কালিক বিবর্তনে সেটার অনেক দিক আধ্যাত্মবাদের সাথে বিচূর্ণিত হলেও, মূলগতভাবে তা যে ঐ বস্তুবাদী ভাবনারই উপজাত তা বোধকরি অনেকেরই জানা। লোকায়ত দর্শন এই মর্তবাসী গা-ঘামানো খেটে খাওয়া মানুষদের জগৎ সংক্রান্ত ঐহিক চিন্তা। জীবন সম্পর্কে নির্দ্ধিত অভিমত তথা নিবিড় উপলব্ধি। শুধু তাই নয় এটা পরিণত হয়েছে আমাদের সমস্ত প্রগতিশীল, উদার ও সংস্কারবিহীন বিজ্ঞান ভাবনার একান্ত ভিত্তিভূমিও। বহুযুগের ওপার থেকে চলে আসা এই স্বাধীন ও ঐহিক চিন্তার শেকড়ানুসন্ধানই হবে এই প্রবন্ধের মূল কাজ। এছাড়াও আমরা দেখব পাশ্চাত্যের সমকালীন বস্তুভাবনা থেকে আমাদের পৌরাণিক এই জীবন-ঘনিষ্ট উপলব্ধি কোন অংশেই অপ্রাচুর্যময় ছিল না।

 

এক.

লোকায়ত শব্দটির আছে নানামূখী দ্যোতনা। কেউ বলেছেন, ‘লোকেষু আয়তো লোকায়ত:’। অর্থাৎ যা সাধারণ মানুষের মাঝে পরিব্যপ্ত তাই লোকায়ত। আবার কেউ বলেছেন,  আমাদের এই প্রাত্যক্ষিক জগতের নামই লোক। যতটুকু আমরা দেখতে পারি সেটুকুই লোকের পরিব্যাপ্তি। দার্শনিক এম. হিরিয়ানাও (M. Hiriyanna) বলেছেন, লোকায়ত শব্দের অর্থ আমাদের সাধারণ অভিজ্ঞতার মধ্যে সীমিত জগৎ চিন্তা (restricted to the world of common experience)। ধারণা দুটিকে এক করলে লোকায়ত চিন্তার অর্থ দাঁড়ায়- অতি সাধারণ মানুষদের জগৎ, জীবন ও প্রকৃতি সংক্রান্ত বস্তুবাদী চেতনা। এটা পুরোপুরি ইহলোক সংক্রান্ত ভাবনা। যারা পরলোকের ধার ধারেনা, ধর্মে-কর্মে খুব বেশি মতি নেই, মোক্ষ নির্বাণের জন্য উ˜্গ্রীব হয় না তারাই লোকায়তিক। যুক্তিমদ্ বচনং গ্রাহ্যং- অর্থাৎ যুক্তিই লোকায়ত চিন্তার প্রাণ। Rhys Davids বলেছেন, সাধারণ লোকের মাঝে প্রচলিত নানা বিষয় অবলম্বনে রূপায়িত শাস্ত্রের নাম লোকায়ত। তবে তিনি বিশেষ এই শাস্ত্রটিকে ব্রাহ্মণ্য বিদ্যারই অংশ হিসেবে বিবেচনা করেছেন। আচার্য সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত লোকায়ত বিদ্যাকে তর্ক বা বিতন্ডা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তাঁর মতে, এটি প্রাচীন ব্রাহ্মণ্য বিদ্যার বিরুদ্ধে একটা বিপ্লবী চিন্তা। লোকায়তিক আর প্রাকৃতজনের মাঝে বড় কোন বিভেদ নেই। অনেক আগে ভারতীয় দার্শনিক শঙ্করাচার্য এই দুই ধরনের সম্প্রদায়কে অভিন্ন সূত্রে মূল্যায়ন করেছিলেন। শারীরিক ভাষ্যে তিনি বলেছেন, ‘দেহমাত্রং চৈতন্য বিশিষ্টামাত্মেতি প্রাকৃতাজনা লোকায়তিকাশ্চ প্রতিপন্না:।’ অর্থাৎ চৈতন্য বিশিষ্ট দেহই আত্মা এই লৌকিক তত্ত্ব প্রতিপাদনের দ্বারাই অসংস্কৃত প্রাকৃতজনই লোকায়াতিক নামে পরিচিত। কখনও কখনও এটা স্বভাববাদ, যদৃচ্ছবাদ কিংবা ভূতবাদ নামেও সাধারণের কাছে পরিচিত।

লোকায়াতিকদের নাম দেয়া হয়েছে দৃষ্টিবাদী। বিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদী (Logical positivist) দের মূল বক্তব্যের সাথে এঁদের কোন তফাৎ নেই। তাঁরা যেমনি বলেছেন, ‘ the meaning of a proposition is a method of its verification. ’ অন্যদিকে লোকায়াতিকরা বলেছেন, ‘ প্রত্যক্ষমেব প্রমাণম’। অর্থাৎ প্রত্যক্ষের বাইরে কোন ধরনের অনুমানকে জ্ঞানের চৌহদ্দিতে আনা সম্ভব নয়। কেননা অনুমান ভ্রান্তি ঘটায়, মানুষকে প্রতারিত করে। এ ব্যাপারে প্রত্যক্ষবাদীদের সাথে লোকায়তিকদের আশ্চর্য একটা মিল হল, প্রত্যক্ষবাদীরা যেমনি তীব্র সমালোচনার মুখে তাদের প্রত্যক্ষনীতি থেকে কিঞ্চিত সরে এসেছিলেন, ঠিক একই রকমভাবে পরবর্তিকালের লোকায়াতিক যেমন, ধীষণ, পুরন্দর প্রমুখ দার্শনিকেরা তাদের তীব্র  অভিজ্ঞতা বিষয়ক অবস্থানকে সংশোধন করেছিলেন। অর্থাৎ সংশোধিত নীতি অনুযায়ী তারা বাস্তব জগতের অনেক কিছুর বাস্তবতা মেনে নিয়ে অনুমানমূলক জ্ঞানকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করা থেকে বিরত থেকেছেন। যাই হোক, ইংরেজিতে আমরা যাকে মেটিরিয়ালিজম বলি লোকায়ত চিন্তা তার থেকে ভিন্ন কিছু নয়। তবে পাশ্চাত্যের বস্তুবাদ থেকে আমাদের এই চিন্তা অনেকটা সরল হলেও বেশ পুরোনো। পাশ্চাত্যের মতো আমাদের এই চিন্তার নিচ্ছিদ্র সাংগঠনিক ভিত্তি না থাকলেও এটা যে পৃথিবীর অতি প্রাচীনতম প্রগতিশীল ও শ্র“তি-স্মৃতি বিরোধী মানবিক ভাবনা তা বোধকরি অনেকেরই জানা। অধ্যাপক যতীন সরকার এ ধরনের বস্তুবাদী চিন্তাকে নাম দিয়েছেন সরল বস্তুবাদ (naive materialism)। তবে এটাতে বস্তুবাদের অনেকটা সরলরূপ পরিগৃহিত হলেও , বস্তুবাদের মর্মার্থটা কিন্তু এর অতিরিক্ত কিছু নয়। সে কারণে এটাকে বলা যায় মৌলিক বস্তুবাদ (radical materialism)। বস্তুত দর্শনে যে বস্তুবাদ নিয়ে আলোচনা করি লোকায়ত চিন্তার মধ্যে সেই ভাবনার সাথে যোগ হয়েছে আরো বেশ কয়েকটা উপাদান। বিশেষ করে মানুষের চিন্তার ইতিহাসে যেসব সমাজ মনোস্তাত্ত্বিক চলকগুলো কাজ করে সেগুলোর ব্যক্তি নিরপেক্ষ ও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় লোকায়ত দর্শনে। এজন্য লোকায়ত দর্শন শুধুমাত্র দর্শন তত্ত্বের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; এর ব্যাপ্তি প্রসারিত হয়েছে মানুষের বেড়ে ওঠা সমাজ বাস্তবতাকে অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে। পন্ডিত দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় এই চিন্তা-চেতনাকে স্রেফ বস্তবাদী আখ্যা দিয়ে বলেছেন, এটা প্রমাণের জন্য বেশি একটা ঘোরালো যুক্তিতে যাওয়ার দরকার নেই। মানুষের প্রত্যক্ষে যতটুকু ধরা পড়ে লোকায়তিকরা সেটুকুকেই সত্যি বলে স্বীকার করে। তারই নাম লোক। আর যা লোক তাই সত্য।

লোকায়ত চিন্তা জগদ্বিষয়ক যৌক্তিক মানুষদের সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক অনুভূতি। সব ধরনের শাস্ত্রমুক্ত, স্বাধীন ও সংস্কারবিহীন প্রাচীনতম আধুনিক অনুসন্ধিৎসা হলো এই চিন্তা। বৈকৃত, অন্ধ ও বিধ্বংসী চিন্তার বিরুদ্ধে এ এক তুমূল বিগ্রহ। লোকায়ত চিন্তার যে তত্ত্ববিদ্যক দিক আছে তা থেকে বোঝা যায়, বস্তুই এখানে আসল। বস্তু থেকেই সবকিছুর সৃষ্টি আবার বস্তুতেই তার পরিণতি। এর পেছনে অন্য কোন শক্তি বা সত্তার হাত নেই। পরলোক, পরপার, স্বর্গ, নরক, আত্মা এসব নিছক কল্পনা মাত্র। দেহ ও আত্মার মাঝে অহেতুক এক ভেদরেখা টানা হয়েছে। আত্মা মানুষের সচেতন কর্মকান্ডের সমন্বিত ফলাফল। অজড়, অনিত্য, শাশ্বত আত্মা বলতে আমরা যাকে চিন্তা করি তা সবৈব কল্পনা নির্ভর অনুমান মাত্র। সমকালীন বাউলের মুখে এই কথারই প্রতিধ্বনি শোনা যায় এভাবে-

‘ বস্তুকেই আত্মা বলা যায়
আত্মা কোন আলৌকিক বস্তু নয়।
বিভিন্ন বস্তুর সমন্বয়ে/ আত্মার বিকাশ হয়ে।
জীবন রূপেতে সে জীবেতে রয়।
অসীম শক্তি তার
যে তাহার করে সমাচার/
সাধিয়া ভবের কারবার বস্তুতে যার লয়।’

নিছক অন্ধ-বস্তু কীভাবে সূক্ষ্ম চেতনার জন্ম দিতে পারে তার ব্যাখ্যাও আমরা পাই তাঁদের কাছে। তাঁরা বলেন জগৎটা চতুর্ভূতের সমাহার। মাটি, বাতাস, জল এবং আগুন- এই মৌলিক চারটি বস্তুর সমন্বয়ে আমাদের এই বস্তু জগৎ গড়ে উঠেছে। যে কোন বস্তুকে তা-সে জীবিতই হোক কিংবা মৃতই হোক, এই চারটি উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত হতেই হবে। এই দর্শনের আদিগুরু  বৃহস্পতির বিখ্যাত উক্তিটি হলোÑ ‘বস্তুই জগতের সব প্রাণের আধার’ (out of mater came forth life)। চেতনা দেহেরই গুণ। সুতরাং দেহ ও চেতনা মৌলিকভাবে আলাদা কিছু নয়। দেহের বিনাশের সংগে সংগে তার চেতনারও অবলুপ্তি ঘটে। তাই আত্মা, জন্মান্তর, মোক্ষ, নির্বাণ ইত্যাদি শব্দগুলো কষ্টকল্পিত ভাবনা বৈ কিছু নয়। ‘প্রমানেষু প্রত্যক্ষং শ্রেষ্টং’ অর্থাৎ প্রত্যক্ষই শ্রেষ্ট প্রমাণ। প্রমাণ ব্যাতিরেকে সবকিছুই অগ্রহণযোগ্য। অনুমান আমাদেরকে ভ্রান্তি ঘটায়। রজ্জুকে অনেক সময় সাপ বলে মনে হয়; দূরে ধোঁয়া দেখে আগুন অনুমান করলেও তা অনেক সময় ভুল হয়। লোকায়ত চিন্তার মূল বক্তব্যটা সম্ভবত একটা স্লোকে উদ্ধৃত হয়েছে-
 

‘ণ স্বর্গো নাপ বর্গো বা নৈবাত্মা পারলৌকিক:।
নৈব বর্ণাশ্রমাদীনং ক্রিয়াশ্চ ফলদায়িকা:।’

লোকায়ত চিন্তা বৈদান্তিকতার তীব্র আবেশনের বিরুদ্ধে রীতিমত এক বিদ্রোহ। বলা যায় বহু যুগ ধরে ভারতীয় চিন্তা প্রাধিকারাবিষ্ট মানুষকে যে শুধুমাত্র শাস্ত্রাভিমূখী করেছে, তার বিরুদ্ধে এই উপলব্ধি একটা চ্যালেঞ্জ। এটা একটা সমাজবাদী ভাবনাও বটে। সব মানুষকে বর্ণ-গোত্র-জাত-পাত নির্বিশেষে এক ভাবাও যেন লোকায়ত চিন্তার অন্যতম বৈশিষ্ট। আধুনিক লোকায়তিক লালনের মুখে এই সাম্যের বাণী উচ্চারিত হয়েছে বলিষ্টরূপে-

‘এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে/
যেদিন হিন্দু-মুসলমান/ বৌদ্ধ খ্রিস্টান জাতি গোত্র নাহি রবে ॥
শোনায়ে লোভের বুলি/
নেবে না কাঁধের ঝুলি/
ইতর আতরাফ বলি/
দূরে ঠেলে না দেবে/
আমির ফকির হয়ে এক ঠাঁই/
সবার পাওনা খাবে সবাই/
আশরাফ বলিয়া রেহাই/ ভবে কেউ নাহি পাবে।’

তাবে ভারতীয় চিন্তার ইতিহাসে লোকায়াতিকদের এই প্রগতিশীল অভিগমনটা কিন্তু মোটেও স্বস্তিদায়ক ছিল না। তাদেরকে নাস্তিক, বিতন্ডা, আনীক্ষিকী, হৈতুক প্রভৃতি নামে গালিগালাজ করা হয়েছে। মনু সংহিতায় বলেছেÑ ‘পাষন্ডি বিকর্মস্থান বৈডাল ব্রতিকান শঠান/ হৈতুকান বকবৃত্তীন চ বাউমাত্র নীপি নীচিয়েত।’ অর্থাৎ যারা হৈতুক, পাষন্ড, শঠ বিড়ালতপস্বী, তাদের সাথে বাক্যালাপ নিষিদ্ধ। তবে শাস্ত্রিয় কড়া অনুশাসনের মাঝেও এই পরাকৃত ভাবনা কিভাবে তার স্বাতন্ত্র বজায়  রেখে সামনে এগিয়েছে সেটা রীতিমত এক বিষ্ময়কর ব্যাপার। শত বিপত্তির মাঝেও এই চিন্তা নানা পথ উপপথ অতিক্রম করে জ্ঞানের মূল স্রোতের সাথে মিশেছে। কাজেই প্রাচ্যের সব বিজ্ঞান-ভাবনার মূল কেন্দ্রবিন্দু এই লোকায়ত দর্শন। আজ এই উপমহাদেশ জুড়ে যতটুকু উদার, স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও রীতি ভাবনা বজায় আছে তার সিংহভাগ কৃতিত্ব এই মৌলিক চিন্তার।

তিন.
ভারতীয় চিন্তার আবর্তন ঘটেছে বেদকে ঘিরে। কিছু কিছু চিন্তা বেদানুগত, কিছু বেদ বিরোধী। যেসব চিন্তা প্রবলভাবে বেদাকৃষ্ট সেগুলো হল বেদান্ত, ন্যায়, সাংখ্য, যোগ বৈশেষিক ও মীমাংসা। এগুলোকে ষড়দর্শন বলা হয়। এদের মাঝে কেউ বেদের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্বকে মেনে নিয়েছে আবার কেউবা মৃদু আপত্তির পরও বেদকে অস্বীকার করতে চায়নি। এ-বাদে চার্বাক, বৌদ্ধ ও জৈন সম্প্রদায় নামে যে দর্শন ও ধর্মগোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল তারা সরাসরিভাবে বেদের প্রাখর্যকে অস্বীকার করেছে। লোকায়ত চিন্তা বলতে আমরা ইতোমধ্যে যার সাথে পরিচিত হয়েছি সেটা এই নিম্নোক্ত ত্রয়ী দর্শনের কেতাবী উপাধি।

জৈন দার্শনিক হরিভদ্র সূরীর ‘ষড়দর্শনসমুচ্চয়’ গ্রন্থ থেকে জানা যায় লোকায়ত চিন্তা ও চার্বাক ভাবনা এক ও অভিন্ন। অষ্টম শতকে কমলশীলও লিখেছেন চার্বাক ও লোকায়ত একই গোষ্ঠীর দুটি ভিন্ন নাম। আবার মাধবাচার্যের সর্বদর্শন সংগ্রহ ও কৃষ্ণ মিশ্রের ‘প্রবোধচন্দ্রদয়’ থেকেও নিশ্চিত হওয়া গেছে লোকায়ত ও চার্বাক দর্শনের মাঝে কোনই বিভেদ নেই। দার্শনিক সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত মনে করতেন, লোকায়ত চিন্তার মাঝ দিয়েই চার্বাক দর্শনের সাথে আমাদের পরিচয় হয়েছে। পি. টি. রাজু অত্যন্ত জোরালোভাবে মন্তব্য করেছেন লোকায়ত, চার্বাক ও বৃহষ্পতি নাম- তিনটি একই ব্যাক্তির।

লোকায়ত চিন্তার উৎস সন্ধানে আগে এর ঐতিহাসিক অপরিহার্যতার দিকে দৃষ্টি দেব। আগেই লক্ষ করেছি তৎকালীন আধ্যাত্মবাদ বা ভাববাদকে চরমভাবে অগ্রাহ্য করে এই ধরনের দর্শন ভাবনার সূত্রপাত হয়েছিল। ভাববাদ হলো এই জগৎ সংক্রান্ত এমন একটা মতবাদ যেখানে মনে করা হয়, জগতের আদি উপাদান চেতনা বা ভাব। বস্তুর স্বাধীন অস্তিত্ব এখানে চরমভাবে অস্বীকৃত।

কঠ উপনিষদে ভাববাদের মূল বক্তব্যটা বুঝি প্রকাশিত হয়েছে এভাবে, ‘যদিদং কিষ্ণ জগৎ সবং প্রাণ এজাতি নি:সতম’ (এই জগতের সকল বস্তু প্রাণ থেকে এসেছে)। ভাববাদী কল্পনার পেছেনে আছে একটা সুদীর্ঘ আধ্যাত্মবোধ। বস্তুবাদী চিন্তকরা বলেছেন, বাস্তব অস্বীকৃত এক উদ্ভট দর্শন হলো ভাববাদ। এটি মানুষকে পা দিয়ে না হাঁটিয়ে মাথা দিয়ে হাঁটানোর এক হাস্যকর প্রচেষ্টা। এই দৃশ্যমান বাস্তবতাকে বেমালুম অস্বীকার করে সেখানে বসানো হয়েছে এক অস্পষ্ট আজগুবি কাল্পনিক শক্তির। ভাববাদ অতি সরল মানুষদের চিন্তাহীন আকুতি। ভাববাদের মাঝে লুকিয়ে আছে অত্যন্ত ভীত সন্ত্রস্ত এক মন। ‘এটাকে দেখতে লাগে শুম্ভ-নিশুম্ভের সেই পৌরাণিক সেনাপতির মত। এর মাথা কেটে ফেললে মরণ হয় না; কাটা মাথা ছিটকে পড়া প্রতিটা রক্ত বিন্দু থেকে জন্ম নেয় আরেকটা দৈত্যের।’ একথা থেকে স্পষ্ট হয়েছে ভাববাদ মানুষের মনের অত্যন্ত সঙ্গোপনে রক্ষিত এক অমোচনীয় আধ্যাত্মবোধ। তবে অবশ্যই এর একটা দীর্ঘ সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা আছে। তবে তার আগে আমাদের দেখতে হবে যে মনস্তাত্ত্বিক কারণে ভাববাদ মানুষকে আষ্টে-পৃষ্টে বেঁধে ফেলে তার প্রকৃত তাৎপর্যটা কী?
মানুষ এই প্রকান্ড বিশ্বজগতে বড্ড অসহায়। তাছাড়া জগতটা নিজেও অনেকটাই রহস্যাবৃত। এর নানাবিধ জটিলতা উন্মোচনের আগে যে বহুবিধ ভয় তার মনে সক্রিয়ভাবে কাজ করে তার থেকে তৈরি হয় অতি প্রাকৃতিক শক্তির কল্পনা। এই অজ্ঞেয় দৈব শক্তির প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের নিমিত্তে মানব মনে জন্ম নেওয়া কল্পনার দার্শনিক অনুভূতির নাম ভাববাদ। তবে ভাববাদের আরেক ধরনের ব্যাঞ্জনা আছে। যারা সমাজের উচ্চ কোটিতে অবস্থান করছে তাদের ক্ষমতার পাকাপাকি বন্দোবস্তের জন্য নানা ছল চাতুরীর এক অপকৌশল হল এই রাজন্য দর্শন। সমাজের একেবারে প্রান্তিক মানুষদেরকে কখনই এই দর্শন স্পর্শ করেনি। যার ফলে যাদের গায়ে মাটির গন্ধ আছে তারাই অহেতুক কল্পনায় সময় নষ্ট করেনি। এজন্য লোকায়ত চিন্তার মানুষ বস্তুবাদী ভাবনার বাইরে কোন কল্পনা বিলাসের সংগে যুক্ত হয়নি। লোকায়ত শব্দটার বৈভাষিক অর্থ যুক্তিটাকে আকট্য রূপ দিয়েছে। ল্যাটিন খঁপঁং ও লিথুনিয়ান খধঁপঁং শব্দের সংগে লোকায়ত শব্দের কোথায় একটা মিল পাওয়া যায়। এর প্রকৃত অর্থ দাঁড়ায় চাষের জন্য জংগল পরিষ্কারের জায়গাÑ ধ পষবধৎরহম ড়ভ ভড়ৎবংঃ। এ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় জমি বা মাঠের সাথে প্রত্যয়টির প্রাতশাব্দিক মিল আছে। এই ঐতিহাসিক গাটছড়া আমাদের অনুমান করায়, লোকায়ত দর্শন অতি সাধারণ মানুষদের আদি ও অকৃত্রিম বোধেরই সরল রূপ।

চার.
ভারতীয় প্রাচীন সমাজের সাথে যেহেতু বস্তুবাদী ও ইহলৌকিক চেতনার সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ, সে কারণে এই সমাজকে বুঝতে গেলে নজর দিতে হবে এর প্রাচীনতম গ্রন্থ  ঋক্বেদের দিকে। ঋকবেদ ভারতীয় সমাজ তো বটেই পৃথিবীর প্রাচীনতম গ্রন্থগুলোর অন্যতম। এটা শুধু সনাতন ধর্মের প্রথম গ্রন্থই নয়, এ অঞ্চলের আর্য ধর্ম তথা আর্য সভ্যতার এক অনন্য প্রতিচ্ছবিও। অধ্যাপক হেরম্যান জেকোবির মতে এর রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দে। ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় অবশ্য জানিয়েছেন ঋকবেদের রচনা হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব এক হাজার থেকে ন’শ অব্দের মাঝে। তবে বিশেষ একটা ঐতিহাসিক সত্য এর রচনা কাল নির্দেশে সহায়তা করেছে। বেদ হলো আর্যদের গ্রন্থ। আর্য জাতি সিন্ধু উপত্যকাবাসীদের পরাস্ত করে স্থায়ী বসবাস শুরু করলে রচিত হয় ঋক্বেদ। সে হিসেবে এর রচনাকালকে খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চদশ শতক ধরে নিলে বিশেষ কোন মতান্তরের সুযোগ থাকে না। সমাজবিজ্ঞানীরা যে সমাজকে সাম্যবাদী সমাজ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, বৈদিক সমাজ মূলত এই সাম্যবাদী সমাজেরই পরের ধাপ। বৈদিক সমাজ থেকেই বিভক্তিযুক্ত সমাজের বিষয়টা নজরে আসে। ঋকবেদের পুরুষ সুক্তের দশম মন্ডলের দ্বাদশ ঋক্ – এ শ্রেণী বিভক্তির ধারণা খুঁজে পাওয়া যায়। এখানে স্পষ্টত: সমাজের মানুষকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছেÑ দ্বিজ ও শুদ্র। ইতিহাস অনুসন্ধিৎসুরা বলছেন, আর্যরা ভারত আগমনের পর স্থানীয়দের পরাস্ত করার ফলে নিজেরা হয়ে পড়ে শাসক। বিজীত অনার্যরা নিপীড়িত ও শোষিত হওয়ার ফলে সমাজের চোখে হয়ে দাঁড়ায় ‘নীচ’, অর্বাচীন তথা অপাঙক্তেয়। এরাই শুদ্র। দ্বিজ ও শুদ্র আসলে বিজয়ী ও বিজীতদেরই নাম। খুব সংগত কারণেই বিজয়ীরা সৃষ্টি করেছে গ্রন্থ। তৈরি হয়েছে ক্ষমতা পরিচালনার পাকাপাকি ব্যবস্থা। গবেষকরা নিশ্চিত হয়েছেন ব্রাহ্মণ দর্শনই ভাববাদ। আর বস্তুবাদ হলো প্রজা বা সাধারণ মানুষের চিন্তা। শুদ্রদের একমাত্র কাজ ব্রাহ্মণদের খুশি করা। একারণেই আমরা আগে দেখেছি সমাজের তথাকথিত এই ‘নীচু’ মানুষদের একমাত্র কাজ খাদ্য তৈরি করা তথা ফসল ফলানো। এরা সত্যিকার অর্থে প্রান্তিক মানুষ। ছুতোর, মেথর, মুচি, ভূঁইমালি, কলু, কাহার, বাগদী, সর্দার, বিদূষক, বিট, নরসুন্দর, তাঁতী, কামার, কুমোর, জেলে, জোলা, বেদে প্রভৃতিরাই  সমাজের সেই তথাকথিত নীচু মানুষ। এদের ছিল লোকজ ধর্ম তথা লোকায়িত মূল্যবোধ। ভন্ডামি বা সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা এদের নেই। অন্যের অনিষ্ট তারা বোঝে না। গা-গতর ঘামানো এইসব মানুষরাই বাংলার আদি ও অকৃতিম ভাবনা লালনকারী। এরাই বংশ পরম্পরায় নানা শাখা উপশাখায় বিভক্ত হয়ে বাংলার লোকায়ত দর্শন ধারণ করে বেঁচে ছিল, এখনও আছে। বিশেষ কোন আধ্যাত্মচিন্তা তাদেরকে স্পর্শ করেনি। কারণ এরা বুজরুকী বা অতি প্রাকৃতিক চিন্তাধারায় বিশেষ কোন সময় দেয়নি।

বাঙ্গালির লোকায়ত দর্শন তথা লোকায়ত সংস্কৃতি বহু বছরের নানা উপকরণের সংমিশ্রণের ফল। যার দরুণ এর মধ্যে গণতান্ত্রিক চিন্তা ছিল, পরার্থবাদী তথা মানবিক ভাবনা। সর্বোপরি আচ্ছন্ন করেছিল ঐহিকতা বা ইহজাগতিকতা। তবে মনে রাখা দরকার বহুযুগ ধরে নানা রকম চিন্তা ধারার মিলন-মিশ্রণে আমরা যে মত-মতবাদগুলোর সাথে পরিচিত হয়েছি তার গণতান্ত্রিক চরিত্র বজায় থাকার কারণ কিন্তু এই অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ। কেননা বিশেষ কোন শাস্ত্র কিংবা গ্রন্থ তাকে গ্রাস করতে পারেনি। ফলে এটা মোটামুটি তার স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছে। অধ্যাপক রমেন্দ্রনাথ লিখেছেনÑ ‘বাঙালীর দর্শনকে যদি সামগ্রিকভাবে বাঙালী সংস্কৃতির দর্শন বলা যায় তবে তাতে প্রায় বলা যায় এ ধরনের মিলন-মিশ্রণ বা সিনক্রেটিজম সব যুগে হয়েছে, এবং প্রাক-বৈদিক তান্ত্রিকতা যুক্ত হয়েছে, কখনো বৈষ্ণব প্রতীকগুলোর সাহায্যে সুফী তত্ত্বের ভাব ব্যক্ত হয়েছে। এই সংমিশ্রণ বা সংশ্লেষণ এ কারণে গুরুত্বপূর্ণ যে, তাতে যেমন সৃজনধর্মীতা বিশেষত পুথি সাহিত্য, একটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার আন্ত-ধর্মীয় (ইন্টার রিলিজিয়াস) মাত্রা অর্জন করেছে তেমন তা গণমানুষের মন স্বত:স্ফূর্তভাবে কাড়তে পেরেছিল বলে সামগ্রিকভাবে একটা গণতান্ত্রিক ঐহিক, সামুহিক এবং উপযোগতান্ত্রিক মাত্রা ও মূল্য অর্জন করেছিল। লোকায়ত চিন্তা ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সব মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টার ফলে এটার ভিতর খুঁজে পাওয়া গেছে মানবিক চরিত্রের সব গুণ। সব রকম ভেদরেখা অতিক্রম করে সাম্যের জয়গান ধ্বনিত হয়েছে। অনেকে অবশ্য বলেছেন লোকায়ত চিন্তার মূলভান্ডারটা কিন্তু ঐ আধ্যাত্মভান্ডার ঋ্বেদেরই মাঝে। কেননা ঋক্বেদের ভিতর যে অগণিত দেব-দেবীকে তুষ্ট করার নিমিত্তে আরাধনা করা হয়েছে সেই আরাধ্য বিষয় কিন্তু বস্তু বা দ্রব্য। খাদ্য বা বস্তুগত সুখ চাওয়া ছাড়া ঋক্বেদের ভিতর অন্যকোন বিশেষ আধ্যাত্ম চিন্তা নেই। অধ্যাপক যতীন সরকার গবেষণায় দেখিয়েছেন, ঋক্বেদের মাঝে আছে প্রাচীন সমাজতান্ত্রিক ধারার বৈশিষ্টগুলো। এটা লৌকিক ঐতিহ্যের উৎসও বটে। তিনি লিখেছেন,

‘প্রাকৃতিক দিক দিয়ে ঋক্বেদ আদিম সমাজের লৌকিক কামনামূলক সাহিত্য ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই, নি:সন্দেহে এ সাহিত্য লৌকিক ঐতিহ্যেরই অনুভূক্ত। খাঁটি লোক সাহিত্য গণমানুষের মুখে মুখে রচিত ও লোক পরম্পরায় শ্র“তিতে সংরক্ষিত। ঋক্বেদ তাই।’

বেদোত্তর যুগেও দেখা যায় ভাববাদ ও বস্তুবাদের দ্বন্দ্ব। উপনিষদ যুগে বস্তুবাদের অন্যতম ধারক ছিলেন ঋষি উদ্দালক ও ঋষি বিরোচন। জার্মান চিন্তাবিদ ওয়ালটার রুবেন বলেছেন বস্তুবাদের  সমগ্র ইতিহাসে ঋষি উদ্দালক ছিলেন অগ্রদূত। সম্ভবত তিনি ছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ৬৪০-৬১০ অব্দের মানুষ। অর্থাৎ পাশ্চাত্যের প্রথম দার্শনিক থেলিসেরও আগের মানুষ ছিলেন তিনি। সুতরাং বলা যায় প্রাচ্যের বস্তুভাবনার বয়স প্রতীচ্যের চেয়ে ঢের পুরোনো। এখানকার সাহিত্য ও জীবন ভাবনার নানা নিদর্শনের মাঝেও এসবের অনেক উদাহরণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। খ্রিস্টিয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দির মাঝে রচিত চর্যাপদগুলোর মাঝেও এসব ভাবনার অনেক আলামত পাওয়া যায়। এগুলো সমসাময়িক ও তার পূর্বেকার সমাজ জীবনের অতি সাধারণ চিত্র। এগুলো দুর্বোধ্য ও আলঙ্কারিক হলেও মূল কথাবার্তাগুলো বেশ ঋজু। বিভিন্ন সিদ্ধাচার্য যেমনÑ লুইপাদ, কুক্কুরীপাদ, গুগুরীপাদ, শান্তিপাদ, কাহ্নুপাদ, বীনাপাদ, দারিকপাদ, তাড়কপাদ প্রমূখ ব্যক্তি এসব রচনা করেন। যদিও এসবের ভিতর দিয়ে দুরূহ আধ্যাত্মিকতা প্রকাশিত হয়েছে তবু বাংলার আউল-বাউল-সহজিয়া-বৈষ্ণব, নাথ সম্প্রদায়, সুফি চিন্তা ধারার মূলভাব উঠে এসেছে এখানে। বাউল সম্প্রদায় যে মানবপ্রেমের কথা বলে চলেন তার মূলভাব পাওয়া যায় এসব পদকর্তার রচনার মাঝে। মনের মানুষকে অনুসন্ধানকরা বাউলদের কাজ। এই মানুষ কোথায় থাকে? মনের মাঝে। অন্য কোথাও এর হদিস পাওয়া যায় না। তাই মনের মানুষ মনের মাঝে কর অšে¦ষণ। এটা এক ধরনের অনাধ্যাত্মিক জীবনবোধ। নিজেকে খোঁজা। বাউলরা বলছেন- 

‘নদনদী হাতড়ে বেড়াও অবোধ আমার মন
তোমার ঘরের মাঝে বিরাজ করে বিশ্বরূপী সনাতন ॥’
কিংবা ‘জীবে জীবে চাহিয়া দেখি সবই যে তার অবতার
ও তুই নূতন লীলা কি দেখাবি যার নিত্যলীলা চমৎকার।’

নিজের মাঝেই পাওয়া যাবে সবকিছু। যে জীবনদেবতাকে মানুষ হন্যে হয়ে তলাশ করছে: তাকে পাওয়া যাবে এই আট কুঠুরীর মাঝে। শাস্ত্রের বিরুদ্ধে এধরনের কথাবার্তা রীতিরকম এক বিদ্রোহ। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের সূত্রপাতের পরেও আমরা যে এ ধরনের জীবনবোধের পরিচয় পেয়েছি সেটা ঐ প্রাচীন লোকায়ত ভাবনারই ফলাফল বলে ধারণা করা যায়। আমরা প্রাচীন তান্ত্রিকতার সাথে পরিচিত হওয়ার পরপরই একটা বিষয় ভুল করি। মনে করি তান্ত্রিকতা বুঝি নিñিদ্র আধ্যাত্মিকতা ছাড়া কিছু নয়। কিন্তু তান্ত্রিকতা হলো লোকায়ত চিন্তারই আরেকটা রূপ। এর সাথে জড়িয়ে ছিল কৃষি কেন্দ্রিক জাদু অনুষ্ঠানের বিভিন্ন ঘটনা। দেহতত্ত্ব সাধনা ও তান্ত্রিকতা মূলত: একই বিষয়ের দুটি রূপ। দেবীপ্রসাদ লিখেছেন, ‘মানবীয় প্রজননের সাহায্যে বা সংস্পর্শে প্রকৃতির উৎপাদনকে আয়ত্তে আনার পরিকল্পনা।’ তার মতে মানবীয় প্রক্রিয়া আর প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া একই। সন্তান উৎপাদন রহস্য ও শস্য-উৎপাদন রহস্য প্রকারন্তরে সমজাতীয়। এজন্য মানবীয় ব্যাপারগুলোকে উপলব্ধি করতে হবে। নিজের দেহ এজন্য লোকায়ত দর্শনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সহজিয়ারা তাই বলেছেন, ‘সকলের সার হয় আপন শরীর/ নিজ দেহ জানিলে আপনে হবে স্থির ’। পাঁচকড়ি বন্দোপাধ্যায় মূল কথাটা বলে দিয়েছেন এভাবেÑ‘যাহা আছে দেহ ভান্ডে, তাহাই আছে ব্রহ্মান্ডে ’। দেহের মাঝে ব্রহ্মান্ড পাওয়া যায়; পাওয়া যায় আলেক সাঁই; এটাই বাউল সাধনার আসল কথা। তাই এটাকে ব¯ুÍবাদী চেতনা না বলে পার আছে ?

পাঁচ.
আগেই দেখেছি ভারতীয় জড়বাদী ধারণা বিশ্বের অন্যান্য প্রগতিশীল চেতনার থেকে বহু প্রাচীন। তবে এটা শুধু প্রাচীনই নয় অনেক আধুনিক ভাবনার প্রেরণাদায়ক ব্যাপারও বটে। পাশ্চাত্যের সাম্প্রতিক কালের বস্তুবাদী ধারার প্রায় সবগুলোরই মূল বক্তব্যের সাথে লোকায়ত চিন্তার আশ্চর্য মিল আছে। একথা অস্বীকার করলে অন্যায় হবে গোটা বিশ্বের মাঝে স্বাধীন, মুক্ত, চেতনশীল ও জ্ঞানতাত্ত্বিক ভাবনার উপরিসৌধের উপর দাঁড়িয়ে যে আজ নিরন্তর সামনে এগিয়ে চলছে তার ভিত্তিটা ঐ শাস্ত্রবিরোধী জড় ভাবনা। কেননা শাস্ত্র মানুষকে বন্দী করেছে ছোট্ট এক এলাকায়, মানুষ ক্ষুদ্রতি ক্ষুদ্র হতে হতে সংকীর্ণতার অন্ধকারে হারিয়ে যেতে বসেছে। সুপ্রাচীন কাল থেকে মানুষকে বন্দী করার কৌশল ডিঙিয়ে লোকায়ত চিন্তা সাধারণ মানুষদের জীবন বোধে পরিণত হয়েছে। সাধারণ  মানুষ বুঝেছে গায়ে খাটা ছাড়া তাদের অন্য কোন দর্শন নেই। সভ্যতা এগিয়েছে মানুষের কর্মের ভিতর দিয়ে, আর জ্ঞান বৃদ্ধি পেয়েছে বস্তুর সঙ্গে মনের সদা মিথস্ক্রিয়ায়। সেজন্য শ্রম ছাড়া অন্য কিছুই নেই। নেই কোন মুক্তি।

‘না কুছ দেখা ভাব- ভজনমে
না কুছ দেখা পোথিমে
ক হৈঁ কবীর সুনো ভাই সন্তো
জো দেখা সো রোটিমে ॥’
ভজন-পুজন-গ্রন্থাদিতে কিছু দেখা যায় না। শোন সাধুগণ, সবকিছু দেখা যায় রুটিতে।