পূর্ববর্তী পর্বের পর…

বারো

এবার কিছুক্ষণের জন্যে জেনোর ধাঁধাতে ফিরে যাব আমরা। ধাঁধাটির সূত্রপাত কোথায় সে ইঙ্গিত তো আগেই দিয়েছি। সেকালের পণ্ডিতরা বুঝতে পারছিলেন না ১,১/২,১/৪,১/৮,….,১/২*(ন),…এই যে অন্তহীন সংখ্যামালা, এগুলো তো যাচ্ছে না কোথাও—এদের কোন গন্তব্য নেই। শুধু তাই নয়, এগুলোকে যোগ করলে দাঁড়ায় আরেক অদ্ভূত জিনিসঃ
১+১/২+১/২*(২)+১/২*(৩)+….+১/২*(ন)+…
এরই বা শেষ কোথায়? অন্তহীন সংখ্যার যোগফল তো অন্তহীন হবারই কথা, তাই না?
আমরা যেন ভুলে না যাই যে যুগটা ছিল যীশুখৃষ্ঠের জন্মের দু’চারশ বছর আগে। এবং সমাজটি ছিল এমন যে বড় বড় পণ্ডিতরাও ভাবতেন ‘শূন্য’ আর ‘অসীম’ দুটোই অমঙ্গলের বার্তাবহ দুশমন, দুষ্ট লোকের কল্পনাতেই আশ্রয় পায় তারা, বাস্তবে নয়।
এই দুটি প্রশ্নকেই একটু উল্টেপাল্টে পরীক্ষা করা যাক। জেনোর ধাঁধাতে ১/২ একটি বিশেষ সংখ্যা। এটি ১/২ না হয়ে ১/৩ বা ১/৫ হতে পারত, কিম্বা অন্য যে কোনও ভগ্নাংশ, যার মান ১ এর কম, 0 এর বেশি। সর্বজনীনত্বের খাতিরে বরং ধরা যাক 1,x,x*(2), x*(3),…,x*(n),…, যেখানে x একটি সাঙ্কেতিক সংখ্যা যার মান শূন্য থেকে একের মাঝে। ‘অসীম’ নিয়ে যেহেতু কিঞ্চিত্‌ সমস্যা আছে আমাদের সেহেতু n সংখ্যক সংখ্যা নিয়ে আমরা অসীম পর্যন্ত না গিয়ে
1+x+x*(2)+x*(3)+…..+x*(n-1), ……………(১)
এই সীমিত রাশিটির যোগফল বের করার চেষ্টা করব। ছোটবেলার স্কুলে পড়া বিদ্যা দিয়েই আমরা অনায়াসে বুঝে ফেলতে পারছি যে সংখ্যাগুলো পরস্পরের সঙ্গে একটা গুণোত্তর প্রগতিসূত্রে বাঁধা। এধরণের গুণোত্তর রাশি নতুন কিছু নয়। বেবিলনিয়ানরা দুহাজার বছর আগেই এরকম রাশি নিয়ে চিন্তাভাবনা করেছিলেন। মিশরের ‘আহমেস প্যাপিরাস’( আঃ১৫৫০ খৃঃপূঃ)নামক গণিতগ্রন্থে একটি গুণোত্তর রাশির বর্ণনা পাওয়া যায়। মজার ব্যাপার হল যে আহমেসে যে পদ্ধতি দেওয়া আছে প্রায় একই পদ্ধতি ব্যবহার করেছিলেন ইতালির ফিবুনাচি তাঁর ১২০২ সালের গ্রন্থটিতে। আরকিমেডিস(আঃ২২৫ খৃঃপূঃ) নিজেও একটি অধিবৃত্তের আয়তন বের করতে গিয়ে (১) এর মত রাশি ব্যবহার করেছিলেন, যাতে x এর মান ছিল ১/৪।
n যদি ছোট হয়, তাহলে হাতে গুণেই ফলাফল বের করে ফেলা যায় রাশিটির যোগফল। কিন্তু গাণিতিকরা হলেন কুঁড়ে প্রকৃতির লোক—সবসময়ই একটা সহজ পথ বের করার মতলবে থাকে। এই সহজ পন্থা বা চালাকিটির গাণিতিক নাম হল ‘ফর্মূলা’ বা আর্যা। দেখা যাক ওপরের (১) জন্যে এমন একটি আর্যা বের করা যায় কিভাবে। প্রথমতঃ x=0 হলে ওপরের সবগুলো x শূন্য হয়ে থাকে কেবল প্রথম সংখ্যাটি, অর্থাত্‌ ১। এবার ধরুন x=1. তাহলে সবগুলো সংখ্যাই ১ এর সমান। যেহেতু সর্বমোট সংখ্যা হল n, সেহেতু তার যোগফলও n.
এবার মনে করুন x শূন্য বা এক কোনটাই না। তাহলে কি হবে। সুবিধার জন্যে রাশিটির একটা নাম দেওয়া যাক—ধরুন S(x). ( বন্ধনীর ভেতরে x বেচারিকে আটকে ফেলার উদ্দেশ্য হল x এর মান বদলালে যে S এর মানও বদলাতে বাধ্য সেটাই আগে থেকে বলে দেওয়া ) এখন আমরা ওপরের রাশিটিকে নতুন করে লিখবঃ
S(x)= 1+x+x*(2)+…..+x*(n-1).  ……………(২)
দুধারে x দিয়ে গুণ করলে দাঁড়ায়
xS(x)= x+x*(2)+……+x*(n-1)+x*(n). ……………(৩)

 

এপর্যায়ে আমরা (১) থেকে (২) বিয়োগ করব। ডানদিকে x থেকে x*(n-1) পর্যন্ত ওপরে-নিচে কাটাকুটি হয়ে বাকি থাকে কেবল ১ আর একেবারে শেষেরটি, x*(n).
সুতরাং ফল দাঁড়াচ্ছেঃ
(1-x)S(x)=1-x*(n).  ……………(৪)

উদ্দিষ্ট লক্ষ্যে প্রায় পৌঁছে গেছি আমরা। বাকি রইল কেবল (1-x) দিয়ে ভাগ করা দুদিকে।(ভাগ করা কাজটি কিন্তু ভেবেচিন্তে করা দরকার, সেটা নিশ্চয়ই মনে আছে পাঠকের)। যাই হোক আপাতত ওসব জটিল ভাবনা চিন্তায় না গিয়ে সোজা হিসেবে দেখা যাচ্ছেঃ
S(x)=(1-x*(n))/(1-x). …………… (৫)
অলস গাণিতিকের জন্যে একটি শিশুবোধ দাওয়াই বা ফর্মূলা বেরিয়ে গেল—কষ্ট করে এতগুলো সংখ্যা যোগ করবার প্রয়োজন নেই, (৫) এর কল্যানে চট্‌ করে সেরে ফেলা যায় কাজটি। যেমন ধরুন, জেনোর ধাঁধার ক্ষেত্রে x হল ১/২।
তাহলে
S(1/2)=(1-1/(2*(n))/(1-1/2)=2(1-1/2*(n))  ……………(৬)
আরকিমেডিসের বেলায় x=1/4. সেক্ষেত্রে S(1/4)=4/3(1-1/4*(n)). দশ বছরের বাচ্চাও বেশ মজা পেয়ে উঠবে। তবে দশ বছরের বাচ্চা হয়ত যেটা ভাববে না সেটা এক মৌলিক প্রশ্নঃ (৪) নম্বর সূত্রটি কি সবক্ষেত্রে প্রযোজ্য? না, তা নয়। অন্তত সোজা পূরণ ভাগের ব্যাপার নয় সেটা। প্রথমত দেখা যাক যাক ০ আর ১ থেকে কি পাই।
S(0)=1/1=1, যা মিলে যাচ্ছে আগেকার পাওয়া ফলাফলের সঙ্গে। এবার x =1 বসানো যাক। (৪) দিচ্ছে 0/0, যার কোন অর্থ নেই। অথচ (১) আর (২) থেকে সোজা হিসেব করেই আমরা পেয়েছিলাম S(1)=n. তাহলে কি বোঝায় 0/0 আর n এক জিনিস? না, তাই বা হয় কিভাবে? n তো যে কোন পূর্ণ সংখ্যা হতে পারে। তার অর্থ 0/0 ভগ্নাংশটির কোন নির্দিষ্ট মান নেই, যা আমরা আগে উল্লেখ করেছিলাম একবার। এ এক ধাঁধা বটে! এর পূর্ণ সমাধান পেতে অনেক অনেক শতাব্দী অপেক্ষা করতে হয়েছিল গণিতজগতকে। এর মূলে আছে সেই শূন্য দিয়ে ভাগ করবার নিষিদ্ধ ব্যাপারটি। x যদি 1 হয়, 1-x তাহলে শূন্য হবে, এবং সেটা দিয়ে (৪) এর দুপাশে ভাগ করা রীতিমত বেআইনি। এই ডামাডোল থেকে আমাদের উদ্ধার করে দিয়েছে নিউটন আর লাইবনিজের আবিষ্কৃত নতুন শাস্ত্র—ক্যালকুলাস। তবে এদুই মহারথীর কেউই ঠিক 0/0 এর রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেননি; সেটা করেছিলেন সপ্তদশ শতাব্দীর গাণিতিক জ্যাঁ বার্নুলি (যদিও এর কৃতিত্ব নিয়েছিলেন ফ্রান্সের আরেক কৃতি গাণিতিক লোপিতাল(১৬৬১-১৭০৪), এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে সেনামেই পরিচিত এই জনপ্রিয় সূত্রটি)। সে প্রসঙ্গে আমরা যাব ক্যালকুলাসের মূল বিষয়গুলো নিয়ে একটু আলাপ আলোচনার পর।
আচ্ছা, x যদি 0 আর 1 এর মধ্যে কোন সংখ্যা হয় তাহলে x*(n) এর মান কি দাঁড়ায়? মনে করুন, x হল ১/৩। তাহলে ১/৩*(২)=১/৯, ১/৩*(৩)=১/২৭, ১/৩*(৪)=১/৮১, ১/৩*(৫)=১/২৪৩,… , অর্থাত্‌ দ্রুত ছোট হয়ে যাচ্ছে এর মান, n এর মান যত বাড়ছে। সুতরাং n যদি লক্ষ কোটি বা তারও বেশি কোনও সংখ্যা হয় তাহলে ভগ্নাংশটির কি দশা হবে? একেবারে তুচ্ছ, তাই না? যাকে অঙ্কের ভাষায় বলা যায় নগণ্য, negligible. এই যে n বেড়ে বেড়ে অসীমের দিকে ছোটা আর সাথে সাথে x*(n) এর মান ছোট হতে হতে শূন্যের দিকে ছোটা, এর মধ্যেই চুপিসারে এসে যাচ্ছে সেই ‘শূণ্য’ আর ‘অসীম’। শুধু তাই নয়, আরো একটি বড় আইডিয়ার অঙ্কুর গজিয়ে উঠছে—, যাকে গণিতের ভাষায় বলা হয় লিমিট (limit). ভাসা ভাসাভাবে আমরা এখনি বলে দিতে পারি যে n যখন অসীম লিমিটে যায়, x*(n) তখন যায় 0 লিমিটে। সাঙ্কেতিক ভাষায় এটাকেই আমরা লিখি এভাবেঃ
Limit x*(n)=0, যখন n যায় অসীম লিমিটে।
অবশ্য তার জন্যে শর্ত দরকার যে x কে একটি সত্যিকার ভগ্নাংশ হতে হবে ,মানে তার মান যেন ১ এর কম হয়। এই ‘কম হওয়া’ ব্যাপারটিকে আমরা ‘<’ চিহ্ন দিয়ে নির্দেশিত করি। বেশি হওয়াকে লিখি ‘>’ চিহ্নের সাহায্যে। সুতরাং 0 Limit S(x)=1/(1-x), যখন n যায় অসীম লিমিটে।
জেনোর ধাঁধার বেলায় যেহেতু x এর মান ১/২ সেহেতু S(1/2) এর লিমিট হল ১/(১-১/২) অর্থাত্‌ ২, অসীম নয়। সুতরাং ‘অসীম’সংখ্যক ধাপ অতিক্রম করতে হলেও খরগোশকে অসীম দূরত্বে যেতে হয়না, বা অসীম সময় ক্ষেপণ করতে হয়না, এক লাফেই পার হয়ে যায় দুই একক দূরত্ব বা দুই একক সময়ের মধ্যে—মাত্র তো ২ ফুট , ২ গজ বা ২ সেকেণ্ড বা ২ মিনিটের ব্যাপার। এই সামান্য ঘটনাটি সেকালের মহা মহা পণ্ডিতদের মাথায় ঢোকেনি, যার একটাইও কারণ—শূন্য আর অসীমের অস্তিত্ব নিয়ে সমস্যা, এবং লিমিটের কোন ধারণা না জন্মানো।
অথচ কাজে কর্মে কিন্তু লিমিট বারবারই উঁকি মারছিল পুরাকালের গবেষকদের মস্তিষ্কে। সে গল্প করব পরবর্তী অধ্যায়ে। আপাতত শুন্য আর অসীম নিয়ে আরো কিছু সময় কাটানো যাক। উপরের আলোচনা থেকে এটা বোঝা যাচ্ছে যে
S(x)= 1+x+x*(2)+….+x*(n)+… (৭)

যদি দিকদিগন্ত পার হয়ে অসীম পর্যন্ত চলে যায়, তাহলেও এর একটা সীমিত মান আছে, 1/(1-x), যার অর্থ দাঁড়ায়ঃ
S(x)=1/(1-x). (৮)
এই উদাহরণ থেকে পাঠক যেন ভেবে না বসেন যে ১ এর চেয়ে কম এরকম অসীম সংখ্যক সংখ্যার সব যোগফলই সীমার মধ্যে থাকবে। যেমন
১+১/২+১/৩+১/৪+…. (৯)
এই সহজ রাশিটি অসীমের দিকে যাচ্ছে ঠিকই, এবং সংখ্যাগুলোর মানও ছোট হতে হতে শূন্য হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও এটি কোন সসীম সংখ্যায় পৌঁছুচ্ছে না, বরং যাচ্ছে অসীমেরই দিকে। ক্যালকুলাসের ছাত্রদের যেটা শিখতে হয় সেটা হল যে অসীম রাশির সংখ্যাগুলো ক্রমান্বয়ে ছোট হয়ে যাওয়াই যথেষ্ঠ নয়, কত দ্রুত ছোট হচ্ছে সেটাই হল আসল প্রশ্ন। গুণোত্তর রাশির বেলার সে হারটি যথেষ্ঠ দ্রুত বলেই (৭) থেকে (৮) পর্যন্ত পৌঁছানো সম্ভব হল, কিন্তু (৯) এর বেলায় তা পারা গেল না, কারণ ১,১/২,১/৩,… এ সংখ্যাগুলোর শূন্যে যাওয়ার গতিটা বড় ঢিলে।
অসীম সংখ্যক সংখ্যার যোগফল নিয়ে কাজ করার আরো অনেক বিড়ম্বনা আছে। সংখ্যাগুলো যদি সব ধনাত্মক হয়, বা সব ঋণাত্মক, তবুও খানিক রক্ষা, মিশ্রিত হলে তো সেরেছে। যেমন ধরুনঃ
১-১+১-১+১-১+…. (১০)
এর যোগফল কি হবে? আদৌ কোনও যোগফল আছে কিনা? প্রথম দৃষ্টিতে মনে হবে এতে ভাববার কি আছে? (১০) এর প্রথম জোড়ার যোগফল ০, দ্বিতীয় জোড়া, তৃতীয় জোড়া, চতুর্থ, পঞ্চম,….,এভাবে যেতে যেতে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে সবগুলো জোড়া থেকে একই ফল পাচ্ছি আমরাঃ শূন্য।
অর্থাত্ঃ
(১-১)+(১-১)+(১-১)+….=0. ……………(১১)
এতে ভুল থাকার কি আছে? কিন্তু না, এত সহজে ছাড়া পাবার উপায় নেই। বন্ধনীগুলোকে (১১) এর মত করে না বসিয়ে একটু অন্যভাবে বসানো যাক। যেমন;
১-(১-১)-(১-১)-(১-১)-….. (১২)
এখন কি দেখছি আমরা? সবগুলো বন্ধনীবদ্ধ সংখ্যাদ্বয় কাটাকুটি করে শূন্য হয়ে যাচ্ছে, থাকছে শুধু প্রথম সংখ্যাটি, অর্থাত্‌ ১। সুতরাং (১২) এর যোগফল মনে হচ্ছে ১। কিন্তু একটু আগেই তো দেখলাম যোগফল শূন্য। শূন্য আর ১ এক হয় কি করে? কোনটা সত্য? সত্য হল যে কোনটাই সত্য নয়, আবার দুটোই সত্য। তার অর্থ এধরণের যোগবিয়োগযুক্ত রাশি বড়ই ঝামেলা সৃষ্টি করে। বড় বড় মাথাওয়ালা ব্যক্তিদেরও মাথা ঘামিয়ে ফেলে। সুতরাং সে প্রসঙ্গ এখানেই শেষ করব। এগুলো শিখবার জায়গা প্রথম বর্ষের ক্যালকুলাস নয়, তারও একধাপ ওপরের কোর্স, যাকে বলা হয় রিয়েল এনালিসিস, বেশ কঠিন বিষয়, সেখানে ঢুকতে হবে।

তেরো

আমার ছাত্রজীবনে ক্যালকুলাস শেখা শুরু হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে। বিসমিল্লাতেই যে জিনিসটা শিখতে হয়েছিল আমাদের সেটা হল লিমিট, কারণ্ লিমিটই হল ক্যালকুলাসের ভিত্তি। প্রথম সংগাটিই দাঁড়িয়ে আছে লিমিটের ঘাড়ের ওপর। একে এড়ানোর কোন উপায় নেই। প্রকৌশল আর ফলিত বিজ্ঞানের ছাত্ররা লিমিট পছন্দ করে না (তারা মনে করে এটা অনর্থক সময় নষ্ট ছাড়া কিছু নয়), ডাক্তাররা ভাবে এটা অনাবশ্যক, কলার ছাত্রদের মনোভাব লিমিট একটি রসকষহীন শুষ্ক বিষয় যা মানবচিত্তের বিকাশ সাধনে বিন্দুমাত্র সহায়তা করে না। আর প্রথম বর্ষের গণিত ছাত্ররা? বেচারিদের কোন গত্যন্তর নেই। পড়েছি মোগলের হাতে, খানা অবশ্যই খেতে হবে সাথে। আক্কেল হারিয়েছিলাম বলেই তো অঙ্কতে অনার্স নেওয়া, এখন তিতে ওষুধটা আগেভাগে গিলে ফেলাই ভাল। তাই আমরা গিলে ফেলতাম। চোখ বুঁজে। মনে পড়েনা আমি বা আমার সহপাঠীদের এমন কেউ ছিল কিনা যে হলপ করে বলতে পারত সে সত্যি সত্যি বুঝেছিল লিমিট জিনিসটা আসলে কি। মুখস্ত করা এক জিনিস আর সত্যি সত্যি বুঝে ফেলা আরেক জিনিস। এমনিতেই আমাদের দেশে বোঝার চেয়ে পড়া আর মুখস্তের ওপরই জোর বেশি, তার ওপর লিমিটের মত একটি দুরূহ বিষয় যা নিয়ে পুরাকালের বড় বড় পণ্ডিতদেরও মাথার তালু দিয়ে ধোঁয়া ছুটত। আমি সারাজীবন অঙ্ক পড়িয়েছি—ক্যালকুলাস আর লিমিট পড়িয়েছি অসংখ্যবার। অথচ এই আমিও লিমিট ব্যাপারটা অনার্সের একেবারে শেষ পরীক্ষা দেবার আগ পর্যন্ত ঠিক বুঝিনি। যন্ত্রের মত অঙ্ক কষে যেতে পারতাম, কিন্তু কোন আনাড়ি মানুষকে সহজ ভাষায় বোঝানো যায় এমন করে বুঝিনি। ‘ভাল করে শেখা’ বলতে এই বুঝি আমি—এটাই বোদ্ধির পরীক্ষা—রাস্তার মানুষকে রাস্তার ভাষাতেই জটিল একটা বিষয় ব্যাখ্যা করে বোঝাতে পারা, সেটাই পাণ্ডিত্যের লক্ষ্ণণ। সেই শেখাটুকু আমার শেখা হয়েছে ক্যানাডায় শিক্ষকতা শুরু করার বেশ কিছু পরে।
কিন্তু কেন? কেন লিমিটকে ঘিরে এত রহস্য? মিথ্যে প্রবঞ্চনায় বারবার কেন বিভ্রান্ত করা মেধাবী অমেধাবী সবাইকে সমানভাবে? প্রথম কারণ এতে ‘শূন্য’ দেখা দেয় খেলার সঙ্গী হবার জন্যে, ধরা দেওয়ার জন্যে নয়। সে এসেও ধরা দিতে চায় না। এখানে ‘শুন্য’ আসে 0/0 এর ভয়ঙ্করী মূর্তি নিয়ে, অথচ পুরোপুরি তা’ও নয়। এ এক অদ্ভুত জিনিস। ‘শূন্যের’ কাছে যাব, অতি কাছে, যত কাছে তোমার কল্পনায় আসে তত কাছে, তবুও ঠিক শূন্যের গায়ে উপুড় হয়ে পড়ব না। প্রিয় তোমার সুবাসটুকু দাও শুধু আমাকে, ছোঁয়াটুকু নয়, এই যেন লিমিটের কামনা।
ছোট্ট একটা উদাহরণ দিই। ভারতীয় গাণিতিক ভাস্কর তাঁর স্বদেশী ব্রম্মগুপ্তের ভুল সংশোধন করে বলেছিলেন, সঠিকভাবেই, যে ১/০ বা (১/৫৫৫৬)/০ জাতীয় ভগ্নাংশের মান হল অসীম। কিন্তু ধরুণ কোনও বিশেষ সংখ্যার উল্লেখ না করে আমরা চাচ্ছি x শুন্যের দিকে অগ্রসর হলে 1/x, এই ভগ্নাংশটি কোন পথে ধাবিত হবে তা জানতে? অর্থাত্‌
Limit(1/x), as x0? (১৩)

একমূহুর্ত অমনযোগী হলেই কিন্তু ফাঁদে পড়ে যাবেন—বলবেন, কেন, এটা তো পরিষ্কারই দেখা যাচ্ছে অসীম। ১/০ যদি অসীম হয় তাহলে ওপরের লিমিটটি অসীম হবে না কেন? বলছি না যে আপনি ভুল বলছেন, না, ভুল নয়, আংশিক ভুল। অসীম বলতে আমরা বুঝি অসীম বড় কোন সংখ্যা, অর্থাত্‌ ধনাত্নক অসীম। সেটা ঠিক যদি (১৩) এর লিমিটটিতে x শূন্যের দিকে যায় ডানদিক থেকে, যার অর্থ ধনাত্নক দিক থেকে। কিন্তু লিমিট বলতে তো ডানদিক বাঁদিক উভয়দিক বোঝাতে পারে। বাঁদিক থেকে যদি x আসে শূন্যের দিকে তাহলে তো এটা ধনাত্নক অসীম থাকছে না, থাকছে ঋণাত্নক অসীম। এ থেকে কি সিদ্ধান্তে পৌঁছুব আমরা? দুটো লিমিটই ঠিক? না, তা নয়। এখানে সঠিক সিদ্ধান্ত হল যে ওপরের লিমিটটির আসলে কোনও অস্তিত্ব নেই। এই যে লিমিটের অস্তিত্ব থাকা বা না থাকা এর ওপরই গা ছড়িয়ে আছে এনালিসিস শাখাটির অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, যার প্রথমিক পর্যায়ের নাম হল ক্যালকুলাস।
ক্যালকুলাসের একেবার গোড়াতে যে আইডিয়াটা সেটা হল ‘ক্ষুদ্র সংখ্যা’। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় infinitesimal. সেই যে বললাম, শূন্যের নিকটতম প্রতিবেশী অথচ শূন্য নয়, যা চালাক মানুষকেও বোকা বানিয়ে ফেলে। বেশ কয়েক শতাব্দী ধরে মানুষ এই আইডিয়াটি নিয়ে হিমশিম খেয়েছে।এটা নিয়ে কাজ করেছে, ব্যবহার করেছে দৈনন্দিন প্রয়োজনে, কিন্তু স্পর্শ করতে সাহস পায়নি। গরম লোহার মত, যা নাহলে দাকুড়াল বানানো যায়না, অথচ ছোঁয়া মানে নির্ঘাত হাত পোড়ানো।
‘ক্ষুদ্র সংখ্যা’র ব্যবহার আজকের নয়, সেই পুরাকাল থেকেই চলে আসছে।

চৌদ্দ

ব্যবহারিক প্রয়োজন বলতে কি বোঝায়? আহার্য। পরিধেয়। আলোবাতাস, জল, বৃষ্টি। বাসগৃহ। জমিজমা। জমিজমার মাপজোক করতে হয়। গৃহের দৈর্ঘপ্রস্থ মাপতে হয়। প্রাচীন মিশরীয়রা সেভাবেই জ্যামিতি আবিষ্কার করেছিলেন। সেভাবেই তাঁরা প্রথম সূচনা করেছিলেন সরলরেখা, সমতল, ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ, কোণ, সমকোণ, এসব পদাবলী। একই সময় চীন, ভারতবর্ষ, এবং অন্যান্য জাতির চিন্তাবিদদের মাথায় অনুরূপ ভাবনা জেগে থাকতে পারে, তার কোনও লিপিবদ্ধ ইতিহাস আমার জানা নেই। সরলরেখার দৈর্ঘ বলতে কি বুঝায় সেটা আমরা জানি, একটা পাঁচ বছরের শিশুও সেটা বোঝে। দৈর্ঘ মাপার জন্যে আছে মাপনদণ্ড (রুলার),আমেরিকায় ইঞ্চি, ফুট, গজ, ইত্যাদি, ক্যানাডা-ইউরোপে মিটার-সেন্টিমিটার কিলোমিটার। অবশ্য দৈর্ঘ বলতে কি বুঝায় সে’ও এক মৌলিক প্রশ্ন। সক্রেটিস হলে হয়ত বলতেনঃ দৈর্ঘ মাপার আগে বাপু, আমাকে বুঝিয়ে দাও ‘দৈর্ঘ’ শব্দটার অর্থ কি। বর্তমান যুগের বিশুদ্ধতাবাদী তাত্বিক গাণিতিকরা ( pure mathematicians) বলবেনঃ দৈর্ঘ? কিসের দৈর্ঘ? সেটটা কি? ওটা কি ফাঁকা ফাঁকা, না, একটানা (discrete or continuous) ? পরিমাপনীয় (measurable), না অপরিমাপনীয় ? সেসব প্রশ্নের উত্তর দিতে আপনার ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা দাঁড়াবে। বিশুদ্ধ গাণিতিকরা বড় খুঁতখঁতে জাতি—আগেকার দিনের দার্শনিকদের মত। যুক্তির শক্ত গাঁথুনিতে বাঁধা না হলে কিছুতেই তাদের তুষ্টি হয় না। আপাতত আমরা সেই যুক্তিযুদ্ধ থেকে দূরত্ব বজায় রাখব।
আলোচনার সুবিধার জন্যে দু’চারটে তথ্য আমরা স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরে নেব—বিশেষ করে ইউক্লিডের বইতে যেসব তথ্য দেওয়া আছে, ধরে নেব যে সেগুলো বিনা প্রশ্নেই মেনে নেওয়া যায়। তাহলে একটা সমকোনী চতুর্ভুজের আয়তন হল তার ‘দৈর্ঘ’ ও ‘প্রস্থে’র গুণফল।( লক্ষ্য করুন যে দৈর্ঘ ও প্রস্থ দুটি শব্দতেই আমি ‘ ‘ চিহ্ন ব্যবহার করেছি। তার কারণ চতুর্ভুজের কোন বাহুটা তার দৈর্ঘ, কোনটি প্রস্থ, সেটা নেহাত্‌ই দর্শকের দৃষ্টিভঙ্গীর ওপর নির্ভর করে)। আমরা এ’ও ধরে নেব যে একটা ত্রিভুজের আয়তন হল তার দৈর্ঘ ও প্রস্থের গুণফলের অর্ধেক। এই সামান্য দুতিনটে তথ্য জানা থাকলেই এক আশ্চর্য উপায়ে ক্যালকুলাসের দুটি মুখ্য শাখা, অন্তরকলন (differential calculus), এবং সমাকলন (integral calculus),—তাদের একটা প্রাথমিক ধারণা দাঁড় করানো যায়। এ দুয়ের মাঝেই চুপটি করে লুকিয়ে আছে ‘শূন্য’ আর 0/0 জাতীয় অনির্ণেয় সংখ্যার বীজ।
ধরুন একটি সমদ্বিবাহু (isosceles) ও সমকোণী (right-angle) ত্রিভুজ, যার দৈর্ঘ-লম্ব দুইই ৮ সেন্টিমিটার। ভূমিতে ক হল এককোনায়, খ আরেক কোনায়, আর গ হল লম্বের মাথায়। অর্থাত্‌ ক থেকে গ রেখাটি ত্রিভুজের অতিভুজ। ইউক্লিডের জ্যামিতি থেকে আমরা জানি এর আয়তন হল (৮*৮)/২=৩২ বর্গসেন্টিমিটার।

এখন এক কাজ করা যাক। ভূমির ঠিক মধ্যিখানে, অর্থাত্‌ ক থেকে চার একক দূরত্বে যে বিন্দুটি সেখান থেকে একটা লম্ব আঁকা যাক যেটা মিশছে, ধরুন, অতিভুজ কগ রেখাটির ই বিন্দুতে। ই থেকে ভূমির সমান্তরাল একটি রেখা আঁকুন খগ অবধি। এটা মনে করুন ফ বিন্দুতে মিশল। এভাবে গঠিত যে বর্গক্ষেত্রটি পেলাম আমরা তার আয়তন কত? ৪*৪=১৬, সোজা হিসাব। পুরো ত্রিভুজটির অর্ধেক। অনুমান হিসেবে চলনসই, কিন্তু খুব সূক্ষ্ণ অনুমান নয়। তার চেয়ে ভাল অনুমান পেতে হলে ভূমিতে আরো বেশি খণ্ডবিন্দু নিতে হবে। দুভাগ না করে সমান করে যদি চার ভাগ করেন, তাহলে বর্গক্ষেত্র পাবেন না, পাবেন সমকোণী চতুর্ভুজ যাদের সম্মিলিত আয়তন (সেটা আপনি অনায়াসে বের করে নিতে পারবেন) দাঁড়াবে ২৪ বর্গসেন্টিমিটার—আরেকটু কাছিয়ে আসা হল। ছবিটা একটু পরিষ্কার হচ্ছে, আশা করি। যতি বেশিসংখ্যক খণ্ডবিন্দু নেবেন ক আর খ এর মাঝে ততই ৩২ বর্গমিটারের কাছে যেতে পারবেন ফলশ্রুত চতুর্ভুজগুলোর সম্মিলিত আয়তন যোগ করে। রেখাটিকে কত মিহি করে ভাগ করতে পারবেন আপনি? যত সূক্ষ্ণ ইচ্ছে আপনার—একেবারে শূন্য না হলেই হয়। এই খণ্ডগুলো সব সমান মাপের হতে হবে তার কোন প্রয়োজন নেই, তবে সমান হলে গুণতে সুবিধা, তাছাড়া সমান-অসমান দুটিতে একই ফল পাওয়া যায় সচরাচর। ভূমিরেখার এই ছোট ছোট টুকরোগুলো অঙ্কের বইতে সাধারণত dx দিয়ে সাঙ্কেতিক চিহ্ন দিয়ে লেখা হয়। এই dx দৈর্ঘবিশিষ্ট রেখাখণ্ডের বাম বা ডানপ্রান্তের বিন্দুর দূরত্ব যদি হয় x, আর সেখানকার লম্বরেখাটির উচ্চতা হয় f(x) তাহলে সেই সরু চতুর্ভুজটির আয়তন হবে f(x)dx. সুতরাং এরকম সবগুলো আয়তন যোগ করলে একটি সংখ্যা দাঁড়াবে যাকে আমরা S f(x) dx ধরণের সাঙ্কেতিক ভাষায় লিখতে পারি। ( S দিয়ে sum অর্থাত যোগফল‌ বোঝাচ্ছে)এই dx সংখ্যাটি শূন্য না হয়েও শূন্যের একেবারে গায়ে গায়ে ঘেঁষে যাওয়ার অবস্থায় দাঁড়ালেও যদি এই যোগফল কোন সুনির্দিষ্ট সংখ্যাতে গিয়ে পৌঁছায় তাহলে সেই সংখ্যাটিকেই গণিতের সংগায় বলা হয় ইন্টেগ্র্যাল (এক্ষেত্রে ত্রিভুজের আয়তন)। তার অর্থ দাঁড়াচ্ছে যে আয়তনও একটি লিমিটঃ
Limit Sf(x)dx= area, dx-0 (১৪)

সজাগ পাঠক প্রশ্ন তুলতে পারেন, এবং অত্যন্ত যুক্তিযুক্তভাবেই, যে সামান্য একটা ত্রিভুজের আয়তন বের করতে অনর্থক এত পরিশ্রম করার কি দরকার ছিল যেখানে ইউক্লিডের জ্যামিতি বইতেই তার জবাব দেওয়া আছে পরিষ্কার ভাষায়? আমার উত্তরঃ ঠিক সেই কারণেই উদাহরণটি বাছাই করা—সবাই পরিচিত এর সঙ্গে। পরিচিত জিনিস দিয়ে একটা অপরিচিত আইডিয়া ব্যাখ্যা করা অনেক সহজ, আমার মতে। এটা সত্য যে ত্রিভুজের বেলায় কাটাকুটি, আন্দাজ-অনুমান এসবের কোনকিছুরই প্রয়োজন ছিল না, কিন্তু এর চেয়ে জটিলতর এলাকার আয়তন বের করতে হলে ইউক্লিড সাহেবের সাহায্যের জন্যে হাত বাড়ালে লাভ হবে না, সেখানে এই কাটাকুটি, আন্দাজ-অনুমানই বলতে গেলে একমাত্র উপায়। যেমন ধরুন একটা বৃত্তাকার মাদুড়ের আয়তন বের করতে বলছেন আপনার স্ত্রী। কিম্বা একটা বড়সড় কলাপাতার আয়তন বের করতে বলল কেউ। সেক্ষেত্রে ছোট ছোট চতুর্ভুজ বা ত্রিভুজ আকারের টুকরায় ভাগ করে শেষে লিমিটে চলে যাওয়া ছাড়া আর কি উপায় আছে আমি জানিনা।
লিমিট আইডিয়াটি বলতে গেলে বেশ আধুনিক, সপ্তদশ শতাব্দীতে ধীরে ধীরে অঙ্কুরিত হয়ে উনবিংশ শতাব্দীতে এসে পূর্ণ গৌরবে বিকশিত হয়ে ওঠে। কিন্তু অনেকগুলো ছোট চতুর্ভুজ যোগ করে বৃত্ত জাতীয় কোনও জটিল এলাকার আনুমানিক আয়তন বের করার চেষ্টা আজকের নয়, অনাদিকাল থেকে চলে আসছে। খৃঃপূঃ সপ্তম শতকে জন্মলব্ধ মিশরীয় গাণিতিক আহমেস বৃত্তের আয়তন বের করার চেষ্টা করেছিলেন দারুণ বুদ্ধিমত্তা ও অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় দিয়ে। প্রথমে একটি নয় একক ব্যাসবিশিষ্ট বৃত্ত নিয়ে সেটাকে আটকালেন ঠিক নয় একক লম্বা বর্গক্ষেত্রের ভেতর। খুব মোটা অনুমান হিসেবে এই বর্গের এলাকায় আর বৃত্তের এলাকায় খুব একটা তফাত্‌ নেই। তবে তাতে তিনি সন্তুষ্ট থাকলেন না। বর্গের চারকোনাতে চারটে স্পর্শক টেনে তৈরি করলেন চারটে সমদ্বিবাহু ত্রিভুজ। এই চারটে ত্রিভুজের আয়তন বের করা এমন কোন শক্ত ব্যাপার নয়। সেই সম্মিলত আয়তনকে তিনি বিয়োগ করে ফেললেন পুরো বর্গের আয়তন থেকে। এভাবে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন তিনি যে নয় একক ব্যাসবি্শিষ্ট বৃত্তের আয়তন আর একটি আট একক দৈর্ঘবিশিষ্ট বর্গক্ষেত্রের আয়তন সমান। সেটা অবশ্য ঠিক নয়, কিন্তু এতে করে গণিতের একটি সর্বজনীন অমূলদ সংখ্যা, ‘পাই’, যার আবিস্কারের পেছনে সবচেয়ে বেশি প্রেরণা ছিল বৃত্তের, এবং যার আনুমানিক মান হিসেবে ধরা হয় ২২/৭ সংখ্যাটিকে, আহমেসের গণনাতে সেটা বেরিয়ে এল ১৯/৬। তাঁরটি হল ৩+১/৬, আর আসলটি হল ৩+১/৭। আশ্চর্য মিল, যখন চিন্তা করি দুয়ের মাঝে প্রায় ৪০০০ বছরের ফারাক। সেকালে মানুষ কি’ই বা জানতেন, তবুও তাঁদের উপজ্ঞা ছিল প্রখর, ‘আন্দাজ’ ছিল অসাধারণ। ঐতিহাসিকদের বিশ্বাস সেসময়কার মিশরী পণ্ডিতরা পিরামিডের ঘনতা বের করেছিলেন অঙ্ক কষে, যদিও তাঁদের ‘প্রমাণ’ কতখানি নির্ভরযোগ্য সেটা বিতর্কের বিষয়। সঠিক ফর্মূলাটি হলঃ পিরামিডের (উচ্চতা*ভূমির আয়তন)/৩=ঘনফল। এতে কোনও সন্দেহ নেই যে মিশরীদের জানা ছিল এটি, সে যেভাবেই হোক। এরিস্টটোলের মতে এল নির্ভুল প্রমাণ দিয়েছিলেন গ্রীক গাণিতিক ডেমোক্রিটাস( জঃ ৪৬০ খৃঃপূঃ, আঃ), যদিও সে দাবিটাও প্রমাণসাপেক্ষ। আধুনিক লেখকদের মতে হয়ত একটা প্রমাণ তিনি দিয়েছিলেন, কিন্তু সম্ভবত বর্তমান যুগের উন্নতমানের যুক্তির আলোতে ধোপে টেঁকার মত ছিল না। ভারতবর্ষের আর্যভট্ট নিজেও একটা সূত্র দিয়েছিলেন পিরামিডের ঘনত্বের জন্যে, কিন্তু তাঁর ফর্মূলাতে ৩ এর জায়গায় ছিল ২ ( হয়ত ত্রিভুজের উদাহরণ দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার কারণেই)। গাণিতিকভাবে বিশুদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য প্রমাণ, সেটা পিরামিডের ঘনত্বই হোক আর বৃত্তের আয়তনই হোক, ক্যালকুলাসের সমকক্ষ আর কিছু নেই। অন্তত এখনও পর্যন্ত।
খেয়াল করুন যে আমরা এখনও ক্যালকুলাসের দ্বিতীয় শাখাটি নিয়ে টুঁশব্দ করিনি—অন্তরকলন ক্যালকুলাস। স্কুলকলেজের পাঠ্যসূচীতে প্রথমে শেখানো হয় অন্তরকলন, তারপর সমাকলন। আমরা ঠিক উলটো পথটা বাছাই করলাম এখানে, কারণ মৌলিক যুক্তিতর্কের দিক থেকে অন্তরকলনই হল বেশি জটিল। এতে, পর্দার আড়ালে, আছে সেই 0/0 এর ব্যাপারটি, যদিও কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রছাত্রীরা দু’তিন ক্লাস করার আগে টেরই পায় না সেই জটিলতাটুকুর উত্‌স কোথায়, বা আদৌ কোন জটিলতা আছে কিনা। যান্ত্রিক দক্ষতার সাথে অঙ্ক কষে ভাল নম্বর পাওয়া এক জিনিস, আর তার মর্মমূলে গিয়ে সারবস্তুটুকু উদ্ধার করতে পারা অন্য জিনিস। একটু আগেই তো বললাম, লিমিট এক রহস্যময় জিনিস। প্রথম বছর তারা শেখে, দ্বিতীয় বছর মুখস্ত করে, যাতে কাজ চালানোর দক্ষতা আসে, তৃতীয় বছর তারা ভাবে এতদিনে ব্যাপারটা সত্যি সত্যি বোঝা গেল। কতগুলো জিনিস আছে সংসারে যেগুলো বুঝতে একটু সময় লাগে। শুধু বইপুস্তক আর শিক্ষক অধ্যাপকই যথেষ্ট নয়। তার জন্যে লাগে মানসিক ও বৌদ্ধিক পরিপক্কতা, একটু সৃজনশীলতাও। হ্যাঁ, এটা আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস যে কোন সৃজনশীল মানুষের কাজ ভাল করে বুঝতে হলে নিজেরও খানিক সৃজনশীলতা থাকা দরকার। সেটা শিল্পকলাই বলুন আর গণিত বিজ্ঞানই বলুন। স্রষ্টার মস্তিষ্কের ভেতরে প্রবেশ করার আগে কি কেউ পুরোপুরি বুঝতে পারে কারো কাজ?
অন্তরকলন বোঝাতেও আমি সেই একই ত্রিভুজের উদাহরণ ব্যবহার করব। সহজ, চোখে দেখা যায়, অথচ একটা মোটামুটি ধারণা সৃষ্টি হয়ে যায়। এবার আমরা ত্রিভুজের আয়তন নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করব না। আমরা কল্পনা করব যে সমকোনী ত্রিভুজটির অতিভুজ একটা পাহাড়ী জায়গার খাড়া রাস্তা। ক থেকে গ পর্যন্ত উঠতে পাহাড়ের গা বেয়ে উঠতে হলে আমাদের জানা দরকার কতখানি চড়াই, তার ঢল(slope)কত। কিভাবে বের করব সেটা? সোজা! লম্ব খ-গ রেখাটির দৈর্ঘকে ভাগ করুণ ভূমিস্থ ক-খ রেখাটির দৈর্ঘ দিয়ে। একেই আমরা বলি ‘ঢল’। খেয়াল করুন যে ‘ঢল’ যদি শূন্য হয়, তাহলে একবারে সমতল, অর্থাত্‌ কোনরকম চড়াই-উত্‌রাই নেই। আবার যদি অসীম হয় তাহলে কি হবে? তার অর্থ খাড়া পাহাড়, একেবারে লম্বালম্বি উঠে গেছে। ‘অসীম’ সংখ্যা কিন্তু এসে গেল এখানে। কেন হল এরকম? হল এজন্যে যে পর্বত খাড়া হওয়া মানে খ বিন্দুটি ক এর নিকটে আসতে আসতে একেবারে মিশে যাবার উপক্রম হচ্ছে, আর ওদিকে খ-গ রেখাটির দৈর্ঘ মোটেই বদলাচ্ছে না। তার অর্থ একটা সসীম সংখ্যাকে একটা অত্যন্ত ক্ষুদ্র সংখ্যা দিয়ে ভাগ করা হচ্ছে। সেই কারণেই ভগ্নাংশটি মহাশূন্যের পানে ছুটে যাচ্ছে সোল্লাসে।
যেহেতু ত্রিভুজটি গোড়া থেকেই ছিল সমদ্বিবাহু ও সমকোনী, আমরা জানি যে লম্ব/দৈর্ঘ=১, কারণ ক-খ আর খ-গ দুটি রেখারই সমান দৈর্ঘ। এবার কল্পনাতে আপনি খ-গ রেখাটির সমান্তরলতা বজায় রেখে তাকে সরিয়ে আনুন কেন্দ্রের পাশে, অর্থাত্‌ ক এর কাছে। দুটি দৈর্ঘই সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তাদের অনুপাত থাকছে একই। কাছে বলতে কিন্তু কাছেই বুঝাচ্ছি আমি, মানে যত কাছে আসা সম্ভব, যতক্ষণ না অবশ্য হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায় ক এর ঘাড়ের ওপর। ক্ষুদ্র ত্রিভুজটি বড়টির সুসদৃশ হলেই হল—অর্থাত্‌ বাহুগুলোর অনুপাতে যেন কোন রদবদল না হয়। এবার মাপ নিয়ে দেখুন দুটি বাহুর দৈর্ঘ—এত ছোট হয়ে গেছে যে রুলার বসানোরও উপায় নেই বলতে গেলে। ধরা যাক ভূমিটুকুর দৈর্ঘ dx আর লম্বের দৈর্ঘ dy.সুতরাং অতিভুজটির ঢল দাঁড়াচ্ছে dy/dx, যা আমরা একটু আগেই দেখলাম। এবং যার মান আগের মতই অপরিবর্তিত—১।তাহলে কি আমরা লিখতে পারিনা
Limit (as dx-0) dy/dx=1? (১৫)
অবশ্যই পারি।
আশা করি আইডিয়াটির একটা ভাসা ভাসা ধারণা পাওয়া গেল—একটা ভগ্নাংশের লব আর বিভাজক যদি একেবারে শূন্য হয়ে যায়, তাহলে সে অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলে, তার কোন মানে থাকে না। কিন্তু যদি দুটোই সমান হারে ছোট হয়, তুচ্ছাতিতুচ্ছ শূন্যতায় পৌঁছায়, তাহলে তাদের যে অনুপাত, সেটির একটা ‘লিমিট’ থাকলে থাকতেও পারে, এবং সেই লিমিটের একটা জ্যামিতিক তাত্‌পর্য আছে বইকি—এক ক্ষেত্রে সেটা হতে পারে কোন রেখাবেষ্টিত সমতল ক্ষেত্র, আরেক ক্ষেত্রে হয়তবা রেখার ঢল।
উপরের উদাহরণটি একটা ছেলেমানসি উদাহরণ, মানছি, ছোট বাচ্চাও বুঝবে অনায়াসে। এবং সেই কারণেই নেওয়া। আমার বক্তব্য হল যে ত্রিভুজ আর সরলরেখা না হয়ে যদি বৃত্ত, পরিবৃত্ত, অধিবৃত্ত কিম্বা তার চেয়েও জটিল কোন রেখা হত, তাহলেও প্রায় একই যুক্তি চালানো যেত। ঢলের সংগাতে যা করা হয় সাধারণত, সেটা হল দুটি কাছাকাছি বিন্দু নেওয়া রেখাটির ওপর। এবং প্রথমে বিন্দুদুটিকে একটি সরলরেখাতে যুক্ত করে তার ঢল মাপা, ওপরে যে পদ্ধতিটা ব্যবহার করা হল, ঠিক সেই পদ্ধতিতে। তারপর সেই বিন্দুদ্বয়কে পরস্পরের কাছে টেনে নেওয়া, কাছে, আরো কাছে, যত কাছে আপনার কল্পনায় সম্ভব। সবশেষে সেই ঢলটির ‘লিমিট’ নেওয়া, ঠিক আগেরই মত করে। রেখাটি যদি যথেষ্ট ‘সুশীল’ হয়, অর্থাত্‌ হঠাত্‌ করে খাড়া হয়ে যায় না, বা বলা নেই কওয়া নেই, অকসাত্‌ কীলকের মত বেঁকে যায় না, অথবা রেখাটি সেই বিন্দুতে গিয়ে একেবারে উধাও হয়েও যায় না, তাহলে সেই লিমিটটিও সাধারণত ভদ্র ব্যবহার করবে, অর্থাত্‌ তার একটা মান থাকবে।
এই সহজ আইডিয়াগুলো আজকের মনমানসিকতায় খুবই তুচ্ছ মনে হয়, কিন্তু সপ্তদশ শতাব্দীর ঊষালগ্নে সেগুলো মোটেই তুচ্ছ ছিল না। বরং লোকে হাসাহাসি করত যখন কেও বলত। শূন্য অথচ শূন্য নয়, ‘ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র’ তবে একেবারে শূন্য নয়, এধরণের তো সেরেফ হেঁয়ালি, বলে অভিযীগ করত অনেকে। আইজ্যাক নিউটন নিজেও, infinitesimal শব্দটা মনে মনে ভেবেছিলেন, কিন্তু প্রকাশ্যে উচ্চারণ করতে সাহস পাননি, পাছে না কেও পাগল ভেবে বসে তাঁকে। সেজন্যে তাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলতে হয়েছে একই কথা—নানারকম উদ্ভট শব্দ প্রয়োগ করে। যেমন ‘ফ্লাক্সিওন’।
আইজ্যাক নিউটন মানবেতিহাসের সেরা জিনিয়াসদের একজন ছিলেন তাতে কারুরই কোনও সন্দেহ নেই–এত বড় মাপের মানুষ হাজার বছরে দুচারজনই জন্মায় দুনিয়াতে। ভিঞ্চি ছিলেন সেই ক্ষণজন্মা পুরুষদের একজন। তারপর গ্যালিলি। তারপরই আমি স্থান দিই এই লোকটিকে। সাধারণ মানুষদের কল্পনাতে নিউটন আর আইনস্টাইন যেন দুটি কিঙ্গবদন্তীয় যুবরাজ, ঈশ্বর যাদের নিজের হাতে তৈরি করেছিলেন, সর্বগুণে গুণবান, সর্বরূপে রূপবান, সর্বমেধায় মেধাবান। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ চিত্রতারকাদের মত। কিন্তু তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনের খবর অনেকেরই জানা নেই, এবং এক হিসেবে জানার দরকারও নেই। মহত্‌ সৃষ্টির স্মৃতিই হোক মহত্‌ স্রষ্টার জীবনকাহিনী, এটা আমি সবসময়ই বলে থাকি। তাঁদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে নাই বা করলাম অহেতুক ঘাঁটাঘাঁটি। তবুও কথা থাকে—বিশাল প্রতিভাই জাগায় বিপুল কৌতূহল। লোকটা কে? তিনি কি আমাদের মতই রক্তমাংসে গড়া মানুষ? আমাদের মতই ভাতকাপড় আর সংসারকর্ম নিয়ে চড়কির মত চিরঘূর্ণমান? হয়ত ঠিক তা নয়। তবে তাঁদের জীবনও অনেকসময় চিত্রতারকাদের মতই বিচিত্র মনে হয়। তাঁরা আমাদের মত রক্তমাংস আর সুখদুঃখ রোগশোকে গড়া মানুষ হয়েও আমাদের চেয়ে আলাদা।
নিউটনের কথাই ধরুন। কথিত আছে যে তিনি জন্মের প্রথম মুহূর্ত থেকেই পৃথিবীর আর সব নবজাতদের থেকে আলাদা ছিলেন। ১৬৪২ সালের ২৫শে ডিসেম্বর তাঁর জন্মদিন। অপূর্ণকালিক জন্ম। এত ছোট আকারের শিশু গোটা ব্রিটেনে সম্ভবত জন্মায়নি তার আগে—দুচার পাউণ্ডের বেশি ওজন ছিল না তাঁর। গ্রামের লোকেরা বলত নিউটনকে একটা মদের গ্লাশের ভেতর পুরে রাখা যাবে অনায়াসে। তাঁর কৃষক বাবামা কারুরই কোনও আশা ছিল না ছেলে বাঁচবে। কিন্তু ছেলে যে বেঁচে ছিল সেটা সারা পৃথিবীশুদ্ধ লোক জানে আজকে। দুর্ভাগ্যবশতঃ নিউটনের বাবা ছেলের কীর্তিকাহিনী কিছুই দেখে যেতে পারেননি—মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সে তিনি ইহলোক ত্যাগ করে চলে গেলেন যুবতী স্ত্রীর ওপর বৈধব্যের ভার গছিয়ে, নিউটনের জন্মেরও দুমাস আগে। দু’তিনবছর পর অবশ্য বিধবা আবার বিয়ে করেন স্থানীয় চার্চের পাদ্রীকে, যেটা বোধ হয় শিশু নিউটন খুব একটা পছন্দ করেননি। ছেলে চলে যায় নানার বাড়িতে। মনে মনে এমনই রাগ ছেলের যে কয়েক বছর পর যখন মা তাঁর ছেলেকে ডেকে পাঠান তখন মায়ের ডাকে সাড়া দেওয়া দূরে থাক, তিনি নাকি এমন হুমকি দিয়েছিলেন যে গ্রামে গেলে মায়ের ঘরে আগুন লাগিয়ে দেবেন। পরে অবশ্য মা-ছেলেতে মিটমাট হয়ে গিয়েছিল সব ভুলবোঝাবুঝি। এমনকি পরিণত বয়সে নিউটন দারুণ মাভক্ত হয়ে পড়েছিলেন, নিউটনের জীবনীকারদের অনেকেই সেটা উল্লেখ করেছেন।

নিউটনের মা কোনদিন ভাবেননি ছেলেকে স্কুলে পাঠাবেন—কৃষকের ছেলে কৃষিকর্ম করবে, ক্ষেতখামার গরুছাগল দেখবে, বাপদাদাচৌদ্দপুরুষ যা করে এসেছে, এই ছিল তাঁর মনোবাসনা। কিন্তু ছেলের যে চাষবাসের দিকে বিন্দুমাত্র মনযোগ নেই, অবসর সময়টা বরং গ্রামের লাইব্রেরিতে কাটানোতেই বেশি আগ্রহ সেটা তিনি জেনেও না জানার ভাব করে থাকতেন। বড় হলে সব ঠিক হয়ে যাবে–যেমন করে ভাবেন সব দেশেরই বাবামায়েরা। সৌভাগ্যবশতঃ নিউটনের এক কাকা ছিলেন চার্চের পাদ্রী। তিনি ভ্রাতুস্পুত্রের মেধার গন্ধ পেয়েছিলেন। বুঝতে পেরেছিলেন যে এছেলে হালচাষ করে সুখি থাকার মত নয়। তিনিই মাকে বুঝালেন যে নিউটনকে স্কুলে যেতে না দেওয়া অন্যায় হবে। মা মেনে নিলেন তাঁর যুক্তি—কত ভাগ্য আমাদের! তারপরই তাঁর লেখাপড়ার জীবন শুরু। কিন্তু স্কুলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কি নিউটনের বিশাল মেধার পরিচয় প্রভাতের রবিকরের মত উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল? মোটেও না। তাঁর চেয়েও ভাল রেজাল্ট করা ছেলে আরো দুচারজন ছিল একই ক্লাসে। বন্ধুবান্ধবও ছিল না বেশি। একা একা থাকতেই যেন বেশি পছন্দ করতেন। লাজুক, আড়ালকামী, লোকভয়, এর সবই ছিল তাঁর চরিত্রে, ছোটবেলায় শুধু নয়, পরিণত বয়সে যখন তিনি সারা ইউরোপব্যাপি গৌরবের চরম শিখরে আরূঢ়, তখনও। তাঁর স্কুলজীবনের সেই ছাড়া ছাড়া ভাব, সেই আপাতবৈরাগ্য, অন্য কারো সাথে মেলামেশা না করার প্রবণতা, তাঁকে সহজেই নানারকম হাসিঠাট্টা ব্যঙ্গবিদ্রুপের শিকার করে তুলেছিল। একবার স্কুলপ্রাঙ্গনে এক ছেলের সঙ্গে বেশ বড়রকমের ঝগড়া বেঁধে যায় তাঁর—ছেলেটি ছিল সেবছরের সেরা ছাত্র। সবার সামনে ভীষণভাবে অপমান করে তাঁকে, মারধোরও করে থাকতে পারে খানিক—স্কুলবয়সে ছেলেমেয়েদের কতই বা হিতাহিতজ্ঞান। মজার ব্যাপার যে সেই প্রকাশ্য অপমান আর লাঞ্ছনাই বোধ হয় নিউটনের ভেতরকার সুপ্ত বজ্রকে জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল। স্কুলের বাঁদর ছেলেমেয়েদের উত্‌পীড়ণে অস্থির হয়ে বাচ্চারা যেমন রাগে দুঃখে পণ করে মনে মনে যে একদিন তাকে দেখিয়ে দেবে সত্যিকার জোর কার গায়ে, তেমনি কোন পণ করেছিলেন কিনা নিউটন নিজের সঙ্গে জানিনা, কিন্তু সেই ঘটনার পর থেকে সেই যে পড়াশুনার জগতে ঢুকলেন তিনি, বলতে গেলে, সেখানেই আত্নবন্দী হয়ে থাকলেন সারা জীবন। সেই বছরই তিনি সেই উত্‌পীড়ক ছেলেটিকে হার মানিয়ে অনেক অনেক ওপরে চলে গেলেন যেখানে আরোহন করার সাধ্য ছিল না কারো। পাঠ্যবিষয়ের সবকিছুতেই সমান পারদর্শীতা অর্জন করেছিলেন নিউটন তেমন দাবি করা যাবে না, কিন্তু গণিত আর পদার্থবিজ্ঞান (সেযুগে যাকে natural philosophy বলা হত ব্রিটেনে, সম্ভবত ইউরোপের গ্রীকপ্রভাবিত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যেরই কারণে), এই দুটি বিষয়ে নিউটনের দখল সারা মহাদেশে আর কারো ছিল কিনা সন্দেহ, সেই স্কুলবয়সেই।
যাই হোক, স্কুল পাস করলেন তিনি কৃতিত্বের সাথেই, যদিও গণিত আর বিজ্ঞান ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে তাঁর স্বভাবজাত ঔদাসীন্যের কারণে সর্বমুখি সাফল্যের পরিচয় দেওয়া স্পম্ভব হয়ন। স্কুলপাসের পর তিনি গেলেন কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত কলেজ ট্রিনিটিতে ভর্তি হতে, ১৬৬০ সালে, যখন তাঁর বয়স আঠারো। ভর্তি তিনি অনায়াসেই হয়ে গেলেন, কিন্তু সেই লাজুক স্বভাব আর লোকচক্ষুর বাইরে থাকার সেই আজীবন প্রবণতা, দুয়ে মিলে কেম্ব্রিজেও কারো চোখে পড়ার মত দারুণ কিছু করে ফেলেননি। তার ওপর নিউটনের ছিল আর্থিক সমস্যা। মাসিক খরচ চালানোর জন্যে সেই ছাত্রাবস্থাতেই টুকিটাকি কাজ করতেন তিনি কলেজের কিচেন বা অধ্যাপক এলাকায়। স্কুলের মত কেম্ব্রিজেও নিউটন ছিলেন আর দশটা ছাত্রের মতই—অলক্ষণীয় ও অবিশিষ্ট। তবে নিজের ঘরের নিরালাতে বসে তিনি জ্ঞানসাধনা করেননি তা নয়। বলা হয় যে স্নাতক ছাত্র থাকা কালেই বেশ কিছু মৌলিক চিন্তা তাঁর মাথায় আসে যা তিনি কারো কাছে প্রকাশ করেননি বা কারো সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেননি সেসব বিষয়ে। এই আরেকটা অদ্ভুত স্বভাব ছিল লোকটার—ভীষণ গোপনপ্রিয়তা। সবসময় যেন একটা আতঙ্কে থাকতেন পাছে না কেউ তাঁর আইডিয়া চুরি‌ করে ফেলে। একটা অসুস্থ সন্দেহপরায়নতা, এমন অননূকুল উক্তিও করেছেন বেশ কিছু জীবনীকার।
১৬৬৫ সালে বি এ পাস করলেন বেশ কৃতিত্বের সঙ্গেই, যদিও তাঁর মত অসামান্য মেধাবী ছাত্রের কাছ থেকে যতটা সাফল্য আশা করার কথা সেটুকু সাফল্য হয়ত অর্জন করা হয়নি তাঁর। সম্ভবত একই কারণে—গণিত আর বিজ্ঞানবহির্ভূত বিষয়ের প্রতি অনাগ্রহ। কিন্তু গণিতে তিনি ছিলেন ক্লাসের উজ্জ্বলতম তারকা। অসম্ভব ভাল রেজাল্ট করেছিলেন গণিতে, কিন্তু সেখানেও সারা বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে যে নাম করে ফেলা, সবার চোখে তাক লাগিয়ে দেওয়া, সেটা হয়ে ওঠেনি, প্রধানত সেই লোকচক্ষুর-দূরে-থাকা স্বভাবেরই জন্যে। গোটা গণিত বিভাগের কেবল একটিমাত্র গূনীলোকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি—কেম্ব্রিজের সেসময়কার লুকাসিয়ান প্রফেসার আইজ্যাক ব্যারো। তিনিই ছিলেন একমাত্র শিক্ষক নিউটনের যিনি তাঁর ছাত্রটির ভেতরের আগুন দেখতে পেরেছিলেন। বুঝতে পেরেছিলেন এছেলে বড় কিছু করবে ভবিষ্যতে। যেটা তিনি জানতেন না তখন তা হল সেই ভবিষ্যত দুয়ারে এসেই গেছে। পৃথিবী এখনই কেঁপে উঠবার উপক্রম। অনাগত ভবিতব্য স্বাগতের অপেক্ষায় আঙ্গিনায় দাঁড়ানো।
১৬৬৫ সালের গ্রীষ্মকালে সারা দেশব্যাপী এক মারাত্নক ব্যাধির প্রাদুর্ভাব হয়—এমন সর্বনাশা সেই মহামারি যে গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ই বন্ধ হয়ে যায় অনির্দিষ্টকালের জন্যে। সে বন্ধ বন্ধই থাকল পুরো দু’বছর। নিউটন কলেজছুটির পরমুহূর্তেই চলে গেলেন গ্রামের বাড়িতে। শুধু গেলেনই না, বলতে গেলে, দরজা বন্ধ করে ধ্যানমগ্ন সাধুসন্ন্যাসীর মত জ্ঞানসাধনার একনিষ্ঠ ব্রততে আত্মনিমগ্ন হয়ে রইলেন। খাওয়া পরা ঘুম আরাম সব বাদ দিয়ে এক আবিষ্ট আত্মার মত বইখাতা আর অঙ্কের মধ্যে ডুবে থাকলেন। বিপুল এই পৃথিবীর কোথায় কি হচ্ছে, কোথায় কি ওলটপালট হচ্ছে, কে কোন রহস্যপুরির সন্ধান নিয়ে এল জড়জগতের মরমানবের জন্যে, তার কোনকিছুতেই তাঁর ছিল না বিন্দুমাত্র আগ্রহ। প্রথম যৌবনের পরিচিত আবেগ আর উচ্ছ্বাস নিউটনের জীবন থেকে ছিল সম্পূর্ণ নির্বাসিত। ওসবের কোন অনুভুতিই যেন ছিল না তাঁর। ইউরোপের প্রখ্যাত গাণিতিক ও আইনজ্ঞ মারকুই লোপিতাল নিউটনকে দেখতেন একরকম জোতিষ্কের মত, যেন এজগতের কেউ ছিলেন না তিনি। লোপিতালের বিখ্যাত উক্তিঃ I picture him to myself as a celestial genius. (আমার মানসপটে আমি তাঁকে দেখি দূর নীহারিকাবাসী এক নভোচারী প্রতিভা হিসেবে)।পরবর্তিকালের বিশ্ববিখ্যাত ব্রিটিশ কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ ট্রিনিটি কলেজ প্রাঙ্গনে নিউটনের প্রস্তরমূর্তি দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে লিখেছিলেনঃ

…Newton, with his prism and silent face
The marble index of a mind
Voyaging through the strange seas of thought alone.

আসলেও তাই। নিউটনের জীবনী পড়লে অবাক বিস্ময়ে বিহ্বল হয়ে থাকা ছাড়া উপায় থাকেনা সাধারণ মরণশীল মানুষের।
এবার বলি গ্রামের বাড়িতে সেই দু’টি অপ্রত্যাশিত ছুটির বছর তিনি কিভাবে কাটিয়েছিলেন। ১৬৬৫এর আগষ্ট থেকে ১৬৬৭ এর আগষ্ট—এই দু’টি বছরই ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে গৌরবময়, সবচেয়ে দিব্যজোত্যিপূর্ণ, সৃজনোল্লাসমুখর সময়কাল। বলা হয় যে ওই দু’টি বত্‌সরের মধ্যে যুবক নিউটন যা আবিষ্কার করেছিলেন তার সমতুল্য কাজ তাঁর ৮৪ বছরের দীর্ঘ আয়ুষ্কালে আর কখনও করা হয়নি, এবং সেকাজের সঙ্গে তুলনা হতে পারে এমন বিরল প্রতিভাধর মানুষ তাঁর আগে বা পরে জন্মগ্রহণ করেননি, অন্তত বিজ্ঞান-গণিতের ক্ষেত্রে। বর্ণনাটি নিউটনের নিজের ভাষাতেই দেওয়া ভালঃ

“In the beginning of the year 1665, I found the method of approximating series and the rule for reducing any [power] of any binomial to such a series [i.e.,binomial theorem]. The same year in May [probably while still at Cambridge] I found the method of tangents of Gregory and Slusius, and in November had the direct method of fluxions [differential calculus] and the next year in January had the theory of colours and in the May following I had the entrance into the inverse method of fluxions [ integral calculus] and in the same year I began to think of gravity extending to the orb of the moon…. and having thereby compared the force requisite to keep the moon in her orb with the force of gravity at the surface of the earth, I found them to answer pretty nearly. All this was in the two years 1665 to 1666 for in those years I was in the prime of my age for invention and minded mathematics and philosophy more than anytime since.”
( Portsmouth Collection,Sec.I,div.X, number 41, quoted from the article ‘Newton on Particles and Kinetics’ in The world of the Atom, ed.Henry A. Boorse and Lloyd Motz, Basic Books, Inc., publishers, New York and London,1966).

“ ১৬৬৫ এর গোড়াতে আমি দুটি জিনিস আবিষ্কার করলাম। একঃ সংখ্যার রাশিমালার যোগফল বের করার পদ্ধতি; দুইঃ দ্বিসংখ্যাবিশিষ্ট ঘাতকে (power) কিভাবে যোগরাশিতে প্রকাশ করতে হয় (binomial theorem বা দ্বিঘাতী সূত্র)।একই বছর মে’তে (সম্ভবত কেম্ব্রিজে থাকাকালেই) আমি পেলাম গ্রেগরি আর স্লুসিয়াসের স্পর্শক পদ্ধতি। নভেম্বরে পেলাম ফ্লাক্সিয়নের সরাসরি তত্ত্ব (অন্তর্কলন ক্যালকুলাস)। পরবর্তি জানুয়ারিতে আবিষ্কার করলাম বর্ণতত্ত্ব। সেই মে’তেই পেয়ে গেলাম অন্তরকলনের বিপরীতটি, সমাকলন। একই বছর চিন্তাভাবনা করতে লাগলাম মাধ্যাকর্ষণ শক্তি বিষয়টি নিয়ে—যে শক্তি চাঁদের অক্ষ পর্যন্ত বিস্তৃত। নিজ অক্ষপথে চন্দ্রগ্রহের নিয়মানুগ প্রদক্ষিণের জন্যে বিশ্বপৃষ্ঠ হতে যে পরিমাণ আকর্ষণ শক্তির
প্রয়োজন তার মাপজোক করে একটা সন্তোষজনক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো গেল। এ সবই আমি করতে পেরেছিলাম ১৬৬৫ থেকে ১৬৬৬, এই দুটি বত্‌সরের মধ্যে। ওটিই ছিল আমার উদ্ভাবনী জীবনের স্বর্ণযুগ। ওই সময়টুকুতে আমি যতটা মনযোগ দিতে পেরেছি গণিত আর দর্শনের ওপর ততটা আর কখনই দেওয়া হয়নি”।
মাত্র দুটি বছর! যৌবনে যা আমরা অলস দিবাস্বপ্নতেই কাটিয়ে দিই, যার কোন মূল্যই দেওয়া হয়না সময় থাকতে, সেই দুটি অমর বছরই তিনি উপহার দিয়ে চিরধন্য করে গেছেন বিশ্ববাসী গোটা মানবজাতিকে, জাতিধর্ম বর্ণ গোত্র নির্বিশেষে। সেকথা নিউটন নিজেও হয়ত জানতেন না তখন, মানুষ কি কখনও জানতে পারে তার সৃষ্টির পূর্ণ তাত্‌পর্য বা মূল্য কতটুকু পরবর্তি প্রজন্মের জন্যে? কিন্তু আমরা জানি নিউটন আর সকল স্রষ্টার চেয়েও বড় স্রষ্টা ছিলেন। অনেকে মনে করে, বিশেষ করে জ্ঞানসৃষ্টির যথার্থ প্রকৃতির সঙ্গে যারা পরিচিত নয়, যে আলবার্ট আইন্সটাইন নিউটনের বলবিদ্যাকে ‘ভুল’প্রমাণিত করে গেছেন। যারা একথা বলেন তাঁরা হয়ত বুঝবেন না যে নিউটনের বিজ্ঞান জানা না থাকলে আইনস্টাইনও হয়ত আইনস্টাইন হতে পারতেন না। জ্ঞানবিজ্ঞানের কোন শাখারই কোনও নতুন আবিষ্কার হঠাত্‌ করে আকাশ থেকে ঝরে পড়েনা। সবকিছুরই একটা পরিক্রমা আছে, একটা যৌক্তিক ধারাবাহিকতা আছে। নিউটনের বিস্ময়কর সৃষ্টিশীলতার ওপর মন্তব্য করতে গিয়ে অনেক ভাষ্যকারই ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন। অনেকে বলেছেন নিউটন এমনই নাছোড়বান্দা হয়ে লেগে থাকতেন একটা জিনিস নিয়ে, এবং দিনের পর দিন রাতের পর রাত না খেয়ে না নেয়ে না দেয়ে তা নিয়ে মনের ভেতরে বারবার ঘুরপাক খাওয়াতেন যে শেষ পর্যন্ত প্রকৃতিদেবী স্বয়ং তাঁর কাছে নতি স্বীকার করে তার সমস্ত রহস্য উদোম করে দিয়েছিলেন তাঁর কাছে। তিনি ছিলেন প্রকৃতির প্রিয়তম বরপুত্র, এধরণের মন্তব্যও করেছেন কেউ কেউ।
পাঠক হয়ত খেয়াল করে থাকবেন যে নিউটন তাঁর ‘দুটি বছরের’ বয়ান শোনাতে আরেকটি মস্ত বড় আবিষ্কারের কথা উল্লেখ করতে বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন, বা তিনি ওটাকে একেবারেই উল্লেখযোগ্য মনে করেননি। সেটা হল পদার্থের গতি সম্পর্কীয়—গতির চালিকাশক্তির উত্‌স কোথায়। কি সমীকরণ তাদের পালন করতে হয় পরস্পরের মধ্যে—যাকে আমরা বইপুস্তকে গতিসূত্র (laws of motion) বলে জানি , সেগুলোও সেই ছোট্ট দুটি বছরের মধ্যেই করা। সে যে কি সুদূরপ্রসারী কাজ তার মর্ম শুধু পদার্থবিদরাই জানে না, প্রতিটি প্রকৌশলি, প্রতিটি বিজ্ঞানসাধককে জানতে হয়, বিশ্বব্যাপী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সকল ছাত্রছাত্রীকে জানতে হয়, মুখস্ত করতে হয়। মোটমাট তিনটি সূত্র তাতেঃ
(১) জাড্যনীতি (law of inertia),যেটা আসলে গ্যালিলির সূত্র বলেই ধরা হয়( আগের এক অধ্যায়ে আমরা উল্লেখও করেছি সেটা)—একটা জিনিস যদি অলসভাবে কোথাও ঠায় বসে থাকে তাহলে তাকে ‘ঠেলে’ নড়ানো ছাড়া অন্য কোনভাবে নড়াতে পারবে না কেউ। অর্থাত্‌ তাকে ‘জোর’ করে সরাতে হবে। ঠায় বসা না থেকে যদি কেউ ধীরবেগে দৌড়ুতে থাকে সরলরেখাতে তাহলেও তার ‘ধীরতা’ বদলাবার জন্যে একটু ঠেলা দেওয়া প্রয়োজন। নিউটন এটিকে তার সূত্রাবলির প্রথম সূত্রের সম্মান দিলেন।
(২) ভর*ত্বরণ=শক্তি (mass*acceleration=force)।
(৩) ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া একবারে সমান সমান ও বিপরীতমুখি (action and reaction are equal and opposite)।
এই তিনটি সূত্রতে মিলে বিশ্বভুবনে যা কিছু চলে বা একেবারে চলেই না, কিম্বা চললেও ভীষণ ঢিমেতালে, যে শক্তি নিজেকে কোনকিছুর ওপর আরোপ করে তাকে চালাতে চেষ্টা করে, তার সবকিছুর ওপরই নিরবচ্ছিন্ন রাজত্ব করে গেছে নিউটনের ত্রিসূত্রমালার এই আশ্চর্য আলোকবর্তিকাটি। অথচ এই অসামান্যরকম ‘সামান্য’ জিনিসটির কথা তাঁর মনেই ছিল না আত্নজীবনী লেখার সময়! এমনই বিস্ময়কর ছিল নিউটনের মেধাজগতের দৃশ্যবিচিত্রা।
তিনটি সূত্রের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় বোধ হয় দ্বিতীয়টি, যাকে সাধারণ ভাষায় গতির দ্বিতীয় সূত্র বলে আখ্যায়িত করা হয় (second law of motion )। তবে এসূত্রটি ততটা শক্তি হয়ত পেতনা যদিনা তিনি এটিকে তাঁর নিজেরই সদ্য আবিষ্কৃত অন্তরকলনের ভাষায় প্রকাশ করতে পারতেন। এই ভাষাতে সূত্রটি দাঁড়ায়ঃ
F=m dv/dt. ……………(১৬)
এখানে F হল শক্তি বা force, m হল ভর, আর v গতি বা velocity. নিউটনের সমসাময়িক যুগে কোন বস্তুর ভর গতির সঙ্গে বদলায় না, এটাই ছিল সর্বস্বীকৃত বিশ্বাস। সে কারণে উপরোক্ত সূত্রটিকে আরো একভাবে লেখা যেতে পারতঃ
F=dp/dt, ……………(১৭)
যেখানে p অক্ষরটি বোঝায় ভরবেগ বা momentum. আধুনিক বিজ্ঞানের দিক থেকে চিন্তা করলে কিন্তু (১৬) এর চাইতে (১৭) টিই বেশি শক্তিশালী, কারণ এটি অপরিবর্তিত থাকবে ভর গতির ওপর নির্ভরশীল হলেও, কিন্তু (১৬) থাকবে না। ( আইনস্টাইনের গতিবিজ্ঞানের প্রথম কাজটাই তো ছিল স্থান আর সময় উভয়কে গতিশীল করে ফেলা, যার ফলশ্রুতিতে ভর বেচারিকেও গতির মেজাজ অনুযায়ী ব্যবহার করা শিখতে হল।)
পাঠককে যে জিনিসটা বলা হয়নি এখনও সেটা হল ‘গতি’ শব্দটির গাণিতিক সংগা কি। ক্যালকুলাস বের হওয়ার আগে আসলে কোন সঠিক সংগা ছিলও না। গতির সঙ্গে নিউটনের ফ্লাক্সিয়ন আইডিয়াটির একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে সেটা অনুমান করা শক্ত নয়। এবং নিউটন ঠিক তা’ই করলেন। যেমুহূর্তে তিনি বুঝতে পারলেনট যে তাইতো, গতি তো ফ্লাক্সিওন ছাড়া কিছু নয়, তত্‌ক্ষণাত যেন তিনি দিব্যবানীপ্রাপ্ত হয়ে লিখে ফেললেনঃ
V=dx/dt, ……………(১৮)
এখানে x হল একটা বস্তুর অবস্থান, বা দূরত্ব কোনও কেন্দ্রবিন্দু থেকে, যেমন ডেকার্টের ভূমিস্থ অক্ষরেখা।

0——————.x.———x-axis
সেহিসেবে নিউটনের দ্বিতীয় সুত্রটি দাঁড়ায়ঃ
F=d*(2)(x)/ (dt*(2)),
বা f=(d/dt) (dx/dt), (১৯)
অর্থাত্‌ ত্বরণ হল অবস্থানের দ্বিতীয় অন্তরকলন (second derivative with respect to time). আজকে এগুলো ডালভাত আমাদের কাছে। সেযুগে ছিল রীতিমত বিপ্লব।
আমাদের আজকের আলোচনার মূল বিষয় থেকে খানিক ভিন্নদিকে চলে যাওয়া হচ্ছে হয়ত, তবে আশা করি নেহাত্‌ অপ্রাসঙ্গিকও মনে হবে না পাঠকের কাছে।

পনেরো

ফ্লাক্সিয়ন (fluxion) শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হল ‘প্রবহন’ বা ‘পরিবর্তন’—যা ক্রমাগত বইছে, পরবর্তিত হচ্ছে। আইডিয়াটি কি প্রসঙ্গে উদয় হয়েছিল ২৪ বছর বয়স্ক যুবকের মস্তিষ্কে জানিনা, কিন্তু এর প্রয়োগ যে গণিত আর বিজ্ঞানকে আগাগোড়া বদলে দিয়েছিল তাতে কোনও সন্দেহ নেই। দুঃখের বিষয় যে একে গণিতে ব্যবহারযোগ্য করার উদ্দেশ্যে যে গাণিতিক সঙ্কেত বা প্রতীক তিনি ব্যবহার করেছিলেন সেটা এমনই বিদঘুটে আর ব্যবহার-অযোগ্য ছিল যে একমাত্র তিনি এবং তাঁর কিছু ভক্ত ব্রিটিশ গণিতবিদ ছাড়া আর কেউ ব্যবহার করেছিলেন কিনা সন্দেহ। এখানে বিজ্ঞানের গাণিতিক ভাষার একটা মৌলিক
সত্য উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারছিনা। সেটা হল এই ‘প্রতীকের’ব্যাপারটি। তত্বের সাথে সেই তত্ব প্রকাশের সঙ্কেতকেও কিন্তু বিজ্ঞানমাফিক হতে হয়, যাতে করে প্রথমত তার একটা যৌক্তিক সঙ্গতি থাকে, দ্বিতীয়ত থাকে সহজ ব্যবহারযোগ্যতা, তৃতীয়ত থাকে পরবর্তীকালের গবেষকদের জন্যে ভাবসম্প্রসারণ বা অধিকতর সর্বজনীনতার পথে অগ্রসর হবার সহজ পন্থা। উদাহরণস্বরূপ ওপরের (১৬) আর (১৭)এর পার্থক্যটা লক্ষ্য করুন। একই সমীকরণ, আইনস্টাইনের আগপর্যন্ত। আইনস্টাইন এবং তাঁরও আগেকার দুচারজন গবেষকদের জন্যে (১৬) এর চেয়ে (১৭) ই হল বেশি মূল্যবান। তবে ষোড়শ শতাব্দীর শেষের দিকে বৃটেনে বসে কাউকে ক্যালকুলাস শিখতে বাধ্য হতে হলে নিউটনের সেই কিম্ভূতকিমাকার প্রতীকই ব্যবহার করতে হত। সৌভাগ্যবশতঃ নিউটনের অল্প কয়েক বছর পর প্রায় একই আইডিয়া জন্ম নিয়েছিল ইউরোপের আরেক মণিষীর মাথায়, যাঁর নাম গটফ্রিড লাইবনিজ ( ১৬৭৬-১৭১৬)। জার্মানীর এই আশ্চর্য প্রতিভাধর ব্যক্তিটি গণিতে যতটা পারদর্শী ছিলেন তার চেয়েও বেশি ছিলেন দর্শনশাস্ত্রে। এমনকি পদার্থবিজ্ঞানেও যথেষ্ট অবদান রেখে গেছেন। ক্যালকুলাসের মূল আবিষ্কারক যে নিউটন তাতে কারো কোন সন্দেহ নেই (সনতারিখ মেলালেই তো বের হয়ে যায় সেটা), প্রশ্ন হল লাইবনিজ কি নিউটনের আবিষ্কারের কথা শোনার আগে নিজে থেকেই ভেবেছিলেন কিনা এটা। যাই হোক এবিষয়েও কোন সন্দেহ নেই কারো মনে যে লাইবনিজ যে প্রতীক সঙ্কেত ব্যবহার করেছিলেন সেটা ছিল সত্যিকার ব্যবহারযোগ্য সঙ্কেত, এবং আমার আজকের প্রতিবেদনে এযাবত যেসমস্ত প্রতীক আমি ব্যবহার করলাম তার সবকটিই তাঁরই প্রবর্তিত প্রতীক। লাইবনিজের চিন্তায় dx, dy, dt এগুলো হল সেই ‘ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র’ সংখ্যা, যাকে গাণিতিক ভাষায় বলা হয় infinitesimal, যা স্বয়ং নিউটন সাহেবও খুব একটা সুদৃষ্টিতে দেখতেন না এবং যা নিয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী তর্কযুদ্ধ বেধে থেকেছে তাত্ত্বিকদের মাঝে। কিন্তু লাইবনিজ নির্দ্বিধায় তা গ্রহন করে নিলেন, এবং তার পূর্ণ সুযোগ নিয়ে গণিতের সম্পূর্ণ নতুন একটা শাখা তৈরি করে বিজ্ঞান আর গণিতকে তুমুল বেগে চলমান হয়ে উঠতে সাহায্য করলেন। তাইতো বলি, আইডিয়াই পৃথিবী বদলায়। মানুষ চলে যায়, কিন্তু তার আইডিয়া থাকে, যদি তা থাকবার মত হয় আদৌ।
এবার দুটি একটি উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাক নিউটন কিভাবে তাঁর ‘ফ্লাক্সিয়ন’দ্বারা অনেক অজানা বা কঠিন জিনিসের সহজ সমাধান নিয়ে এসেছিলেন। প্রথমেই নেয়া যাক যা পাঠক আগেই দেখেছেনঃ সেই সমদ্বিবাহু সমকোনী ত্রিভুজটি– ক থেকে খ, ভূমিতে, খ থেকে গ লম্বালম্বি—একই দৈর্ঘ দুটি রেখারই। কগ এই অতিভুজটির ঢল আমরা জ্যামিতির কাছ থেকেই পেয়েছি ১। এবার দেখা যাক আমাদের নতুনশেখা ক্যালকুলাস কি দেয় এবং কত সহজে। ডেকার্টের বীজগাণিতিক জ্যামিতি আমাদের দিচ্ছেঃ
Y=x, (২০)
কগ এর সমীকরণ—ক্যালকুলাস ব্যবহার করতে হলে এটি অপরিহার্য। এবার x বিন্দু থেকে অত্যন্ত ক্ষুদ্র একটি দূরত্ব নিন, যেমন dx, এবং সেখানে y এর যে পরিবর্তন সেটাকে বলুন dy. তাহলে (২০) আমাদের দিচ্ছে, কগ রেখাটিতে দুটির সম্পর্কঃ dy=dx.যার ফলে এ বিন্দুটিতে রেখাটির ঢল হল ১। যেহেতু ১ সংখ্যাটি কখনও বদলাবার নয়, এক বিন্দু থেকে আরেক বিন্দুতে যেতে সেহেতু রেখার ঢলেও কোন পরিবর্তন হবে না। সুতরাং সমস্ত রেখাটির একই ঢলঃ ১, যা আগেরটির সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে।
ছোট বাচ্চাকেও শেখানো যায়, তাই না? ছোট বাচ্চা হয়ত যেটা শিখতে পারবে না চট করে সেটা হল একই উদাহরণ প্রয়োগ করে ত্রিভুজটির ক্ষেত্রফল, যা ৩২ বর্গ একক বলে আগেই আমরা জেনেছি, তা বের করা ক্যালকুলাসের সাহায্যে। প্রথমত ভূমিটিকে সমান n ভাগে ভাগ করুন, n কে যথেষ্ট বড় ধরণের সংখ্যা হতে হবে, যে কোন বড় সংখ্যা হলেই চলবে আপাতত। তাহলে প্রতিটি ক্ষুদ্র অংশের দৈর্ঘ দাঁড়ালো 8/n. এবার r সংখ্যক অংশের দূরত্বে, অর্থাত্‌ মূল ক থেকে যার দূরত্ব হচ্ছে 8r/n সেখানে লম্বের দৈর্ঘও সেই একই—8r/n.সুতরাং সেখানে দাঁড় করানো ছোট একটি চতুর্ভুজের আয়তন হচ্ছে দৈর্ঘ*লম্ব, যার অর্থ, (8r/n)*(8/n)=(64/n*(2))*r. এখন আমরা r কে ক থেকে খ বিন্দুতে নিয়ে যাব অর্থাত্‌ 0 থেকে n পর্যন্ত। সুতরাং ত্রিভুজটির আনুমানিক ক্ষেত্রফল দাঁড়াচ্ছেঃ
Area= 64(1+2+3+….+n)/ (n*2). (২১)
ওপরের ১ থেকে ন অবধি সন্মান্তর রাশিটির যোগফল স্কুলের দশ বারো বছরের ছেলেমেয়েদেরও শেখা। সেটি ধার করে লেখা যায়ঃ
Area =64(n*(n+1))/n*(2)
=32+ 32/n. (২২)
এযাবত একবারও কিন্তু লিমিট বা infinitesimal জাতীয় শব্দ ব্যবহার করিনি। (২২) পর্যায়ে সেটি করা হবে। n কে যত ছোট করা সম্ভব করে যান, যতক্ষণ না তার অস্তিত্বই প্রায় বিলোপ হয়ে যায়। একেই তো বলি লিমিট, infinitesimal, তাই না? এই লিমিটে তাহলে 32/n সংখ্যাটির কি দশা দাঁড়াচ্ছে? প্রথম সংখ্যাটির তুলনায় একেবারেই তুচ্ছ। অর্থাত্‌ এর লিমিট হচ্ছে 0। এভাবেই ক্যালকুলাসে সমাকলন শাখা আমাদের আয়ত্তের মধ্যে এনে দিল সমতল ভূমির ক্ষেত্রফল বের করার সহজ উপায়। ত্রিভুজটির ক্ষেত্রে এ পথে যাওয়ার দরকার ছিল না, কিন্তু সরলরেখার চেয়ে হাজার জটিল রেখার ক্ষেত্রে ক্যালকুলাস ছাড়া অন্য কোন পথ এখনও পর্যন্ত কারো জানা নেই।
কোন কোন পাঠকের বিচারে ওপরের উদাহরণগুলো নেহাত্‌ ছেলেখেলা মনে হতে পারে। তাই আগের সেই অধিবৃত্তের উদহরণটি নিয়ে ক্যালকুলাসের কি দারুণ শক্তি তার একটা আবছা আভাস দেবার চেষ্টা করব। ধরা যাক অধিবৃত্তটির সমীকরণ হল
Y=x*(2), (২৩)
সুতরাং y+dy=(x+dx)*(2).
= x*(2)+2x*(dx)+(dx)*(2). (২৪)
এখন (২৪) থেকে (২৩) বিয়োগ করুন।

থাকছেঃ dy= 2x*(dx)+ (dx)*(2),
যাকে dx দিয়ে ভাগ করে পাইঃ dy/dx= 2x+ dx. (২৫)
এ পর্যায়ে লিমিটের সাহায্য ছাড়া উপায় নেই। dx আর dy উভয়কে শূন্যের দিকে পাঠালে ডানদিকে কি থাকে? শুধু 2x , কারণ dx তো শুন্যেই চলে যাচ্ছে। তার অর্থ হল এই (x,y) বিন্দুটিতে রেখাটির ঢল হল 2x. ধারণা করা যায় এভাবেই নিউটন তাঁর জীবনীতে বর্ণিত স্পর্শকপদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন।
এবার এই রেখাটিরই নিচের এলাকাটির ক্ষেত্রফল বের করার চেষ্টা করব লিমিটের সাহায্যে। আগেকার সেই ত্রিভুজের মত এটিরও ভূমি ধরা যাক ক থেকে ৮ একক দূরত্বে খ পর্যন্ত বিস্তৃত। তবে আগের মত খ থেকে গ অবধি যে লম্ব রেখাটি তার দৈর্ঘ বদলে গিয়ে দাঁড়াবে ৮ এর বর্গে, অর্থাত্‌ ৬৪। কথা হলঃ এই যে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত ও বাঁকা রেখাপরিবেষ্টিত এলাকাটি তার ক্ষেত্রফল কি। আগের সেই ত্রিভুজটির মত করেই ভূমিকে ভাগ করব n সংখ্যক ক্ষুদ্র অংশে যাতে মূল থেকে x একক ডানে এর দূরত্ব দাঁড়াচ্ছে 8r/n, এবং সেখানে তার উচ্চতা হল (8r/n)*(2)=64(r/n)*(2).সুতরাং মোটমাট গোটা এলাকাটির একটা আনুমানিক পরিমাপ লেখা যায় এভাবেঃ
Area=S (64(r/n)*(2))(8/n)= (512/n*(3)){1+2*(2)+
3*(2)+4*(2)+….+n*(2)}. (২৬)
{ }বদ্ধ রাশিগুলোর যোগফলের জন্যে স্কুলপাঠ্য বীজগণিত বইয়ের সাহায্য নিতে হবে। এটা
হলঃ (n(n+1)(2n+1))/6. (২৭)
বিশ্বাস হচ্ছেনা বুঝি? ছোট ছোট সংখ্যা নিয়ে গুণে দেখুন মেলে কিনা। ওই যে বললাম, গণিতের লোকেরা ভীষণ কুঁড়ে প্রকৃতির মানুষ, তাদের ফর্মূলা না হলে চলে না। তবে ফায়দাটা লক্ষ্য করুন। এবার যে সংখ্যাটি পাচ্ছি আমরা এই ক্ষেত্রফলের জন্যে সেটা হলঃ
Area =512 n(n+1)(2n+1)/6n*(3). (২৮)
এইখানে এসে আমরা সেই একই কাজ করব—লিমিট নেব nকে অসীমযাত্রায় পাঠিয়ে, মানে 1/n কে শূন্যের দিকে নিয়ে। শেষমেষ পাচ্ছি ৫১২/৩। এলাকাটির বর্গফল। ক্যালকুলাসের সমাকলন নিয়ম দিয়ে কষতে গেলে এত সময় লাগবে না এবং একই ফল পাওয়া যাবে।

ক্যালকুলাস নতুন বিদ্যা হলেও এরকম খণ্ড খণ্ড ভাগে বিভক্ত করে সেগুলোকে একসাথে যোগ করে ক্ষেত্রফল বের করার পদ্ধতি অতি পুরাতন সেটা তো আগেই বলেছি। পুরনো জ্ঞানের ওপর ভর করেই তো নতুন জ্ঞান জন্ম নেয়। নিউটন সেটা নিজেই স্বীকার করে গিয়েছেন।
গণিতের কলনশাস্ত্রের জন্মকাহিনীর একটা সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া হল। পরের অধ্যায়ে যাব সেই অস্বস্তিকর 0/0 এর প্রসঙ্গে, যাকে নিউটন বা লাইবনিজ কেউই সরাসরি মোকাবেলা করতে সাহস পাননি। কিন্তু তার আগে একটু পরচর্চা করা যাক, মানে উচ্চমানের গাণিতিক পরচর্চা।

কলনশাস্ত্রের জনক কে তা নিয়ে তুমুল বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল সেকালের ইউরোপে। একপক্ষ বলে নিউটন, আরেকপক্ষ লাইবনিজ। অনেকটা বাংলাদেশের ‘জাতির জনক’ সমস্যাটিরই মত। অবশ্য বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস যারা ভাল করে জানে তাদের মনে এ-নিয়ে কোনও সমস্যাই নেই, সমস্যা হল যখন একদল আরেক দলকে ঘায়েল করার চেষ্টায় গোটা ইতিহাসটাকেই বিকৃত করে ফেলে। কিন্তু সপ্তদশ শতাব্দীর ক্যালকুলাস বিতর্কে ব্যাপারটি অত সাদামাঠা ছিল না। সমস্যার গোড়াতে কিন্তু, অনেকের মতে, দায়ী ছিলেন নিউটন নিজেই। তাঁর সেই অতিমাত্রিক গোপনীয়তা, সেই স্বভাবসিদ্ধ সবাইকে-সন্দেহের-চোখে-দেখার প্রবণতা, পাছে না কেউ কিছু চুরি করে নেয় তাঁর কাছ থেকে সেই ভয়ে সবসময় তটস্থ হয়ে থাকা। সেসব কারণে ক্যালকুলাসের ওপর তাঁর যুগান্তকারী ফলাফলগুলো আবিষ্কারের বহু বছর পর, ১৬৯৩ খৃষ্টাব্দে, প্রকাশ করেছিলেন। ওদিকে লাইবনিজ আইডিয়া পেয়েছিলেন ১৬৭৫ সালে। তারপর সেগুলোকে ভাল করে সাজিয়ে গুজিয়ে প্রকাশযোগ্য করে ছাপতে দিলেন ১৬৮৪ সালে। খবর পেয়ে নিউটন ভাবলেন বেটা নিশ্চয়ই তাঁর রেজাল্ট চুরি করে নিজের নামে ছাপিয়ে দিয়েছে। অভিযোগটা যে একেবারে দুনিয়াছাড়া গাঁজাখুরি ব্যাপার ছিল তা’ও বলা চলে না। লাইবনিজ পেশাতে ছিলেন আইনজ্ঞ, ফরাসী নাগরিক পিয়ের ফার্মার মত, এবং ফার্মারই মত দারুণ বড়লোকের ছেলে—বিত্তবান ও প্রভাবশীল। তিনি পেশাগত কারণেই ১৬৭৩ থেকে ১৬৭৬ সাল পর্যন্ত পাকা তিনবছর কাটিয়েছিলেন লণ্ডনে। তার আগে নিউটনের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগও হত চিঠিপত্রের মাধ্যমে। নিউটনের ‘ফ্লাক্সিয়ন’ তত্বের খবর হয়ত তাঁর জানা ছিল, কিন্তু তার কোন প্রভাব পড়েছিল কিনা সেকথা কারো পক্ষেই হলপ করা বলা মুস্কিল। নিউটন তো ধরেই নিলেন যে লাইবনিজ সাহেব লণ্ডনে থাকাকালে কোন-না-কোন ভাবে বের করে নিয়েছে তাঁর গোপন আবিষ্কার। পয়সাওয়ালা জার্মান দুলালদের কি কোন বিশ্বাস আছে? সে কি ঝগড়া দুজনের! নিউটন যেমন ছিলেন সন্দেহপ্রবন, লাইবনিজ ছিলেন একটু উদ্ধত প্রকৃতির—ছেড়ে দেবার পাত্র মোটেও ছিলননা তিনি। সেই ঝগড়া শেষ পর্যন্ত সারা ইউরোপের আবহাওয়াকে বিষাক্ত করে তোলে। ব্রিটেন আর ইউরোপ কেউ কারো মুখদর্শন করবে না এমন অবস্থা।
বেশ কয়েক শতাব্দী লেগেছে দুপক্ষের মাথা ঠাণ্ডা হতে। ইতোমধ্যে আসল ক্ষতিটা হয়েছে ব্রিটেনেরই। ইউরোপ যেখানে আধুনিক গণিতের বিবিধ শাখাতে সাঁই সাঁই করে এগিয়ে যাচ্ছে, ব্রিটেন তখন নিউটনের অন্ধ অনুকরণে গতানুগতিকতার শেকলে আবদ্ধ হয়ে থাকল। সেই নিউটনীয় ধারারই ঢেউ লেগেছিল ভারতবর্ষসহ সমগ্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে। সম্ভবত সে কারণেই ভারতের গণিতচর্চাতে সত্যিকার কোনও গতি সৃষ্টি হয়নি গত কয়েক শতাব্দী। একই ধরণের সেকেলে ধারায় গদবাঁধা জিনিস নিয়ে মগ্ন থাকছি, এমনকি দেশ স্বাধীন হবার পরও।
রাজনীতির মত গণিতের ইতিহাসও কম বিচিত্র নয়!

ষোল

১৬৬১ খৃষ্টাব্দে ফ্রান্সের এক প্রতিপত্তিশীল অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ফ্রাঁসোয়া-আঁতোয়া দ্য লোপিতাল।(Guillaume-Francois-Antoine de l’Hopital)। আমাদের উপমহাদেশের বইপুস্তকে কখনও কখনও লেখা হয় L’Hospital, যার ফলে এর উচ্চারণটিও ল’হস্পিটাল হয়ে গেছে অধিকাংশ জায়গায়( আমি নিজেও ছাত্র থাকাকালে এই উচ্চারণই শিখেছি)। ছোটবেলায় স্কুলে পড়ার সময় থেকেই অঙ্কের প্রতি ভীষণ একটা আকর্ষণ জন্মায় লোপিতালের। স্পম্ভবত পারিবারিক কারণেই প্রাপ্ত বয়সে অঙ্কে না গিয়ে তাঁকে যেতে হয়েছিল সেনাবিভাগে। অশ্বারোহী বাহিনীর ক্যাপ্টেন পর্যন্ত পদোন্নতি হয়েছিল তাঁর। কিন্তু অচিরেই তাঁর মন ছুটে গেল সেই পুরনো প্রেম, অঙ্কের দিকে। সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে তিনি মজে গেলেন অঙ্ক নিয়ে। কিন্তু দীর্ঘকাল চর্চা না থাকাতে সবকিছু নতুন করে শিখবার উদ্যোগ নিতে হল। সারা মুল্লুকের সবচেয়ে নামকরা শিক্ষক খুঁজে পেলেন একজন, নাম ইউহান বার্নুলি(১৬৬৭-১৭৪৮)। আদিবাস বেলজিয়াম থেকে সুইজারল্যাণ্ডে চলে আসা বার্নুলি পরিবার ধনসম্পদে খুব একটা স্বচ্ছল ছিলেন না, কিন্তু ধনী ছিলেন মেধাসম্পদে। তিনি এবং বড়ভাই জেকব বার্নুলি( ১৬৫৪-১৭০৫), দুজনই ছিলেন সেযুগের শীর্ষস্থানীয় ইউরোপিয়ান গণিতজ্ঞ। ইউহান বার্নুলির ছেলে ড্যানিয়েল বার্নুলি (১৭০০-১৭৮২) ছিলেন আরেক মহীরুহ—‘কিনেটিক থিওরি অফ গেসেস’ নামক পদার্থবিদ্যার নতুন এক শাখাই সৃষ্টি করে ফেলেছিলেন তিনি। ড্যানিয়েলের বাপচাচা দুজনেরই নাম গণিতশাস্ত্রের সর্বত্র। সংখ্যাতত্ব(Number Theory) থেকে পরিসাংখ্যনিক গণিত(probability theory) সবকিছুতেই দুজনের কারো না কারো হাত ছিল। ইউহানের বিশেষরকম ব্যুত্‌পত্তি ছিল লাইবনিজের নতুন গণিত ক্যালকুলাসে। কিন্তু স্বাধীনভাবে গবেষণাকর্মে মগ্ন থেকে জীবনযাপন করার মত আর্থিক সচ্ছলতা ছিল না তাঁর। তাই লোপিতাল যখন তাঁকে শিক্ষক নিযুক্ত করার প্রস্তাব দিলেন তিনি সানন্দে সেটা গ্রহন করে নিলেন। লোপিতাল কোনও গাধাছাত্র ছিলেন, তা মোটেও নয়। চট করে সব শিখে ফেলতে পারতেন। প্রথম থেকেই বার্নুলির শেখানো ক্যালকুলাসের প্রতি দারুণ আকৃষ্ট হয়ে পড়লেন। বিষয়টির প্রতি এতই ঝোঁক হয়ে গেল তাঁর যে শিক্ষকের কাছে প্রস্তাব পেশ করলেন যে ক্যালকুলাস বিষয়ক যত কাজকর্ম আছে তাঁর সবগুলোই তিনি কিনে ফেলতে প্রস্তুত, যত টাকা চান তিনি ততই দেবেন। আর্থিক অনটনে পড়া ইউহান বার্নুলি ভাবলেন ক্ষতি কি—তাঁর মাথায় তো আরো নতুন আইডিয়া আসবে, কিন্তু এতুগুলো টাকা তো আসবে না এত সহজে। তিনি রাজি হয়ে গেলেন ছাত্রের প্রস্তাবে। একটা শর্ত ছিল ছাত্রের—কাগজগুলো যদৃচ্ছ ব্যবহারের অধিকার থাকবে তাঁর, অর্থাত্‌ বার্নুলির কাগজপত্রের যা কিছু ফলাফল তার ওপর সমস্ত স্বত্বাধিকার তিনি স্বেচ্ছায় সঁপে দিচ্ছেন লোপিতালকে। সেই কাগজগুলোতে যেসমস্ত ফলাফল ছিল, তার সঙ্গে নিজের কিছু চিন্তাভাবনা যোগ করে আঁতোয়া লোপিতাল রীতিমত একটা বই লিখে ফেললেন ক্যালকুলাসের ওপর— Analyse des infiniment petits নাম দিয়ে। সে বই প্রকাশিত হয় ১৬৯৬ সালে —ক্যালকুলাস শাস্ত্রের ওপর পৃথিবীর প্রথম পাঠ্যপুস্তক। সেবইতে বার্নুলির একটি গুরত্বপূর্ণ রেজাল্ট ছিল যার ওপর তাঁর স্বত্ব ছিল না বলে সেটি –‘লোপিতালস রুল’ বলে পরিচিত হয়ে এসেছে দুনিয়াশুদ্ধ ছাত্রছাত্রী আর শিক্ষক অধ্যাপকদের কাছে। নিজের আবিষ্কৃত রেজাল্ট ব্যবহার করে নেহাত্‌ টাকার জোরে অন্য এক ব্যক্তি খ্যাতি অর্জন করছে সেটা দেখে বার্নুলির যে খুব ভাল লাগছিল না সেটা তো সহজেই বোঝা যায়, কিন্তু চুক্তিবদ্ধ হওয়ার ফলে মুখ ফুটে কিছু বলারও উপায় ছিল না বেচারার। তারপর যখন লোপিতাল মারা যান ১৭০৪ সালে তখন আর চুপ করে থাকার প্রয়োজন বোধ করলেন না, ফাঁস করে দিলেন আসল ঘটনাটা। সেসময় লোপিতাল এতই বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিলেন যে বার্নুলির কথায় কেউ কান দেয়নি। না দেবার আরেকটা কারণও ছিল। তিনি নিজেও এরকম একটি কুকর্ম করেছিলেন একবার, তাও নিজের আপন ভাইএর সঙ্গে। বড় ভাইএর একটা কাজকে নিজের বলে চালিয়ে দিয়েছিলেন। বড় কথা, দিতে গিয়ে ধরাও পড়েছিলেন। তার ফলে তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে যায়। যাই হোক তাঁর মৃত্যুর পর পুরনো চিঠিপত্র ঘেঁটে পরবর্তীকালের গণিতকূল বুঝতে পেরেছিলেন যে আসলেই কাজটা ছিল ইউহান বার্নুলিরই। কিন্তু ততদিনে লোপিতাল নামটিই আঠার মত লেগে থাকে সূত্রটির সঙ্গে।
এবার দেখা যাক কি সেই সূত্র।
ধরা যাক x/x ভগ্নাংশটি। x যদি 0 না হয় তাহলে এর একটা অর্থ আছে–ওপরে নিচে কাটাকুটি করে ফল পেয়ে যাই ১। কিন্তু x যদি 0 হয় তাহলে তো বিপদ—ভগাংশটি অর্থ হারিয়ে একটা অনির্ণেয় বর্জ্যদ্রব্য হয়ে দাঁড়ায়। কোন মানেই থাকে না তার। যুগ যুগ ধরে বড় বড় পণ্ডিতরা যমের মত এড়িয়ে গেছেন একে। দার্শনিকরা তিরস্কার করেছেন যারা এটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করার সাহস পায়। নিউটন আর লাইবনিজের মত নবযুগের দিকদিশারী গণিতবিদরাও দূরত্ব বজায় রেখেছেন এর থেকে। কিন্তু লোপিতাল তাতে দমে যাননি ( ঐতিহাসিক কারণে লোপিতালকেই কৃতিত্ব দিতে হচ্ছে যদিও সকলেরই জানাজানি হয়ে গেছে এর মাঝে যে মূল আবিষ্কারক তিনি নন, ইউহান বার্নুলি)। তিনি বরং উলটো বললেন যে ভগ্নাংশের মান 0/0 হলে ক্ষতি নেই, যদি ওপর-নিচ দুটি ফাংশানই ‘কলনযোগ্য’ (differentiable) হয়, এবং অন্তরকলনের ফলশ্রুতিতে যদি নতুন ফাংশানদুটি একটা সুনির্দিষ্ট ফলাফল দেয়, x=0 বসাবার পর। অবশ্য যদি এমন হয় যে দ্বিতীয় পর্যায়েও সেই একই অবস্থা দাঁড়াচ্ছে, অর্থাত্‌ 0/0 ভগ্নাংশ দিচ্ছে, তাহলে আগে সেই একই প্রক্রিয়া দ্বিতীয়বার চালানো যাবে। এবং এভাবে যতবার দরকার ততবারই যাওয়া যাবে, যতক্ষন না শেষমেষ একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব—হয় কোন সসীম সংখ্যায় যাবে, নয়ত অসীম সংখ্যাতে; কিম্বা কোন লিমিটেই যাবে না। সবগুলোরই পেছনে কতগুলো আইনকানুন আছে–যেমন লিমিট থাকা বা না থাকা, কলনযোগ্য হওয়া বা না হওয়া( না হলে সেখানেই থেমে যেতে হবে), ইত্যাদি।
আরেকটি উদাহরণ নেওয়া যাকঃ x/x*(2).ওপরে নিচে দুজায়গাতেই শুন্য আসছে x যখন 0 হয়। সৌভাগ্যবশত x এবং x*(2) দুটিরই ডেরিভেটিভ আমরা অনায়াসে বের করে ফেলতে পারি। x এর ডেরিভেটিভ হল 1, আর x*(2) এর 2x—-এটা আগের পর্বের একটি উদাহরণ থেকে নেওয়া। সুতরাং লোপিতালের দাওয়াই অনুযায়ী পাওয়া যাচ্ছেঃ 1/2x. মহা বিপদ! ওপরে 1 যা আর বদলাবার নয়, আর নিচে হল 2x, যা x=0 তে 0ই থাকে। সুতরাং আমরা পাচ্ছিঃ

Limit (1/2x)—>অসীম,
যার কোন নির্দিষ্ট লিমিট নেই, ধনাত্নক অসীম হতে পারে, আবার ঋণাত্নক অসীমও হতে পারে , আগেকার সেই উদহরণটিরই মত। এক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত দাঁড়াবে, এর কোন লিমিট নেই x যখন 0 এর দিকে যায়।
পুরো নিয়মটা হল এরকমঃ

দুটি ফাংশান নিনঃ f(x) আর g(x). মনে করুন দুটোই 0 হয়ে যাচ্ছে, যখন x কে 0 ধরা হয়। তার মানে f(0)=g(0)=0. এবার মনে করুন উভয় ফাংশানকে অন্তরকলন করে পাওয়া গেল h(x) আর k(x), প্রথমটি ওপরে,দ্বিতীয়টি নিচে। এবার সেই একই কাজ করুন: x=0 ব্যবহার করুন। তাতে যদি কাজ হয়, তার অর্থ একটা নির্দিষ্ট কিছু পাওয়া যায়—কোন সসীম সংখ্যা বা অসীম সংখ্যা বা কোন নির্দিষ্ট সংখ্যাই নয়, তাহলে তো সমস্যা চুকেই গেল। নইলে একই পদ্ধতি দ্বিতীয়বার চালিয়ে যান–যতবার লাগে ততবার।
এই করেই শেষ পর্যন্ত যুগযুগান্তরের সেই বিভীষিকাময় ঘৃণ্য বস্তুটির একটা সম্মানজনক আশ্রয় হল। খেয়াল করুন যে লোপিতালের গাণিতিক দাওয়াইতে 0/0 কে এড়ানো তো হচ্ছেই না, বরং এটিকে রীতিমত কাজে লাগানো হচ্ছে, যদিও আড়ালে কিন্তু সেই একই জিনিস–লিমিট। ক্যালকুলাসের এমন কোন অংশ নেই যেখানে লিমিট পাবেন না আপনি। সুতরাং এটিকে এড়ানোর চেষ্টা না করে বরং পরিশ্রম করে শিখে ফেলাই ভাল, কি বলেন?