ভারতের চারটি পর্বে ভোটগ্রহন এই মাত্র সমাপ্ত। ভারতের লোকসভা নির্বাচন, লোকবল, অর্থবল বা ব্যাপ্তি, যাই বলুন না কেন-এ হচ্ছে পৃথিবীর বৃহত্তম উৎসব।।

 

এটা জনগণের না জনগণকে টুপি পড়ানোর সার্কাস-তা আপাতত উহ্য থাক-তার আগে এই নির্বাচনের কিছু জানা অজানা তথ্য পেশ করি

  • ৭২ কোটি ভোটার-৮ লক্ষ ২৫ হাজার বুথ। মোট 1,368,430 টী ভোট মেশিন ব্যাবহার করতে হয়েছে।

  • মোট সরকারি খরচ ২০০ মিলিয়ান ডলারের ওপরে। পার্থীরা বেসরকারি মতে খরচ করেছেন প্রায় চার বিলিয়ান ডলারের কাছাকাছি। যা আমেরিকান নির্বাচনের থেকেও বেশী। নির্বাচন বাবদ ওবামা খরচ করেছিলেন প্রায় দুবিলিয়ান ডলার-হিলারী দেড় বিলিয়ান।

  • নিরাপত্তা বাহিনী একসাথে অত বুথে দেওয়া যাবে না বলে চারটি পর্বে ভোট হয়েছে, রেজাল্ট বেড়বে সামনের শণিবার, ১৬ই মে। এত নিরাপত্তা সত্ত্বেও মাওবাদিরা দাপিয়ে বেড়িয়েছে। মোট ৪০জন ভোট কর্র্মী মাওবাদি গেরিলাদের হাতে নিহত হয়েছেন। মাওবাদি অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে অত্যন্ত সফল ভাবে ভোট বয়কট হয়েছে।

  • দুর্গম গীঢ় অরণ্যে শুধু একজন ( তাও তিনি সন্নাসী) ভোটারের জন্যেও পোলিং বুথ দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।

  • সচিত্র ভোটার পরিচয় পত্র-এবার সম্পূর্ণ বাধ্যতামূলক ছিল, ভারতের সব জায়গায়।

  • নাগাল্যান্ড এবং লাক্ষাদ্বীপে প্রায় ৯০% ভোটার তাদের অধিকার প্রয়োগ করেছেন। এটাই সর্বাধিক ভোট গ্রহনের হার। অন্যদিকে কাষ্মীরে ভোট পরেছে সব থেকে কম। প্রথম দফায় ৪৬% ভোট পড়লেও, পরের দুই দফায় তা ২৬% এসে দাঁড়ায় জঙ্গীদের হুমকিতে।

  • যারা পার্থী দাঁড়িয়েছেন, তাদের প্রায় সবাই কোটিপতি। কংগ্রেস পার্থীদের গড় সম্পত্তি -সাড়ে ছকোটি টাকা, বিজেপির পার্থীদের ৫ কোটি টাকা, অন্যান্য রাজ্য বা জাতিভিত্তিক দলগুলির পার্থীদের গড় ও পাঁচ কোটী টাকার ওপরে। অর্তাৎ পার্থীদের প্রায় সবাই ডলার মিলিয়নার। ভারতীয়দের গড় উপায় এখনো আমেরিকানদের ৩%-কিন্ত তাতে কি? ভারতের জনপ্রতিনিধিরা আমেরিকান কংগ্রেসম্যানদের কাছাকাছি চলে এসেছেন। আমেরিকান কংগ্রেসম্যানদের গড় তিন মিলিয়ান ডলারের কাছাকাছি। এর মধ্যে পশ্চিম বঙ্গের পার্থীরাই বোধ হয় সব থেকে গরীব। সিপিএম পার্থীদের গড় সম্পত্তি ৭৫ লাখটাকা ( ১৫০ হাজার ডলার) আর তৃণমূল পার্থীদের গড় সম্পতি ১কোটী ৩০ লাখ টাকা। অহ!

  • ব্যাবসায়ীদের সুবিধা পাইয়ে দিয়ে কোটি কোটি টাকা রোজগার করার জন্যে গরীবদের দুঃখে দুবাটি কান্না এবং প্রতিশ্রুতি-সংক্ষেপে এটাই ভারতের গণতন্ত্র। যেমন ধরুন কংগ্রেসের পার্থী হতে গেলে ছকোটি টাকার সম্পত্তি যেমন লাগে-ঠিক তেমনই কংগ্রেসের ইস্তাহার গরীবদের জন্যে প্রতিশ্রুতিতে ভর্ত্তি। মাসে তারা ২৫ কেজি চাল দরিদ্রসীমার নীচের ফ্যামিলিগুলিকে ৭৫ টাকায় ( তিনটাকা কিলো চাল) দেবে বলে প্রতিশ্রুতি বদ্ধ। দরিদ্র সীমার নীচে বসবাসকারী লোকেদের নূন্যতম ১০০ দিন কাজ দেবে ১০০ টাকা রোজে-নেগ্রা এই প্রজেক্ট এবারও চালু ছিল। তবে গরীবেরা কাজ পেয়েছে ২০ থেকে ৪০ দিন। কারন দেখা গেছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে যার হাতে কাজ দেওয়ার ক্ষমতা-সেই ব্যাক্তিটিই চাই না গ্রামের দরিদ্র লেবাররা ১০০ দিন কাজ পাক। ১০০ দিন কাজ পেলে তাদের ক্ষেতে কাজ করবে কে? আর ১০০ টাকা মজুরী তারা দেয় না-দেয় হয়ত ৫০টাকা। ফলে গ্রামে যে শ্রেনীটির হাতে ক্ষমতা-তারাই রুখে দিচ্ছে দরিদ্রযোজনার প্রজেক্টগুলি। যাইহোক, যেখানে লোকের দরকার শিক্ষা এবং চাকরী-সেখানে এইসব যোজনা ঘোষনা করে যদি ভোটে জিতে কোটিপতি হওয়া যায় খারাপ কি? চলুক যদ্দিন চলে চলুক।
     

ইস্যুঃ না সেরকম কোন ইস্যু ভিত্তিক হাওয়া এবার একদমই ছিল না। অর্থনীতির দিক দিয়ে কংগ্রেস যথেষ্ট ভাল দেশ চালিয়েছে গত পাঁচ বছর-কিন্ত তারা সন্ত্রাসবাদ থেকে জনগণকে নিরাপত্তা দিতে সম্পুর্ন ব্যার্থ। ফলে বিজেপি কিছুটা মাটি পেয়েছে। এবং নানান এক্সিট পোলে দেখা যাচ্ছে কংগ্রেস খুব বেশি হলে বিজেপির থেকে ৫ থেকে ১০টি আসন বেশী পাবে। ফলে সরকারে চাবিকাঠি ছোট দলগুলির হাতে। এদের মধ্যে বামফ্রন্ট ই তৃতীয় বৃহত্তম ছিল আগের বার-ফলে বামসুপ্রীমো প্রকাশ কারাত তৃতীয় ফ্রন্ট গড়ে উদ্যোগী হন। কিন্তু তা অচিরেই চতুর্থ শ্রেনীর সার্কাসে দাঁড়ায়-কারন, প্রতিটা দলই মসনদে ক্ষমতা চাই। ন্যায় নীতি-বা তারা কোনদলের সাথে যাবে, সেটা কেওই জানে না। জানে শুধু যাদের টাকা আছে। ঠিক এই কারনে, সংখ্যালঘু ভোট এখনো কংগ্রেসে আসে। কারন বাকি আর কোন পার্টি কি করবে-তাতে বিজেপির সুবিধা হবে কিনা-কেওই হলফ করে বলতে পারে না। যেমন চন্দ্রবাবু নাইডু মুসলিম ভোট পেতে প্রথমে বামেদের সাথে জোট বাঁধলেন। তৃতীয় ফ্রন্টের সার্কাস দেখানো হল সেখানকার মুসলিমদের। এর পর চন্দ্রবাবু দেখলেন তৃতীয় ফ্রন্টে ক্ষীর জমছে না। এখন বিজেপির দিকে পা বাড়িয়েছেন। তেমনই মুসলিম ভোট পেতে মায়াবতী বরুন গান্ধীকে জেলে ভরেছেন। কিন্ত ভোটের পর, শাঁসের আস্বাস পেলে, তিনিই বিজেপির সাথে চলে যেতে পারেন। যেমন আগে দুবার গেছেন। ফলে মুসলিমরাও যে তাকে এই ব্যাপারে বিশ্বাস করছে তা নয়-তাই মুসলিম ভোটের জোরে উত্তর প্রদেশে এবার কিছুটা মাটি খুঁজে পেয়েছে কংগ্রেস।
 

অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি দিল্লীর মসনদ দখল করতে হলে এই চারটি রাজ্যে ভাল ফল না করলে তা সম্ভব না-উত্তর প্রদেশ (৮০), মহারাষ্ট্র (৪৮), পশ্চিম বঙ্গ (৪২) এবং অন্ধ্রপ্রদেশ(৪২)। অর্থে এবার কারুরই কোন রাজ্যে কোন এডভ্যান্টেজ নেই-শুধু পশ্চিম বঙ্গে কংগ্রেস এবং জোট সঙ্গী তৃণমুল এবার প্রায় অর্ধেক সিট নিলেও নিতে পারে। যদিও বঙ্গবাসী সিপিএম বা তৃণমুল-কাওকে নিয়েই সন্তুষ্ট না।

ট্রেন্ডঃ

  • ভোটের পরে কি হবে বলা মুশকিল, তবে ধর্মের নামে রাজনীতি প্রায় মৃত। আদবানীজির টিমের দুজন বিশিষ্ট ব্যাক্তির সাথে দিল্লীতে দেখা হয়েছিল। হিন্দুত্বের টানে ভোট এখন আর ভাল আসছে না। তবে বিজেপি নিজেও বুঝতে পারছে কালের চাকার বিপরীতেই তাদের ঠেলছে আর এস এস। তারাও আই টী এবং মূলত ডেভেলেপমন্টের দিকেই জোর দিচ্ছেন-কিন্তু আর এস এসের চাপের কারনে, বিজেপি ঠিক তাদের সাম্প্রদায়িক ইমেজটা কাটাতে পারছে না। তবে এবার গোহারা হারলে, আদবানী হয়ত দলকে বোঝাতে পারবেন, হিন্দুত্ব ছেরে কম্পুটার নিয়ে না নামলে, দলের ভবিষ্যত কিছু নেই। আসলে বিজেপির সাপোর্টাররা যতই হিন্দুত্ব হিন্দুত্ব করে চেঁচাক না কেন-বিজেপির নেতাদের কিন্তু আমি দেখেছি পাক্কা ব্যাবসায়ী। একদম কংগ্রেসের মতন তারাও শুধু টাকা চেনে। আর টাকা বানাতে গেলে, যেন তেন প্রকারে দিল্লি দখল করতে হবে এটা বোঝে। ফলে কংগ্রেস যদি ডেভেলেপমেন্ট পলিটিক্স করে বেড়িয়ে যায়-তারাও হিন্দুত্বের আঁটি ধরে বসে থাকবে না।

  • কংগ্রেস জাতীয়তাবাদের চাবিটা বিজেপির কাছ থেকে নেওয়ার চেষ্টা করছে। কারন, তাদের সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্ক অত্যন্ত সলিড এখন। সংখ্যালঘুরাও দেখছেন একমাত্র কংগ্রেসই নিরাপদ-বাকি ছোট ছোট পার্টিগুলি হয় বিজেপির সাথে সরাসরি বা পরোক্ষ ভাবে ( যেমন সিপিএম) বিজেপিকে সুবিধা করে দিতে পারে।

  • আঞ্চলিক দলগুলির প্রভাব এই নির্বাচনে আবার বাড়ল। কেন্দ্রীয় বা জাতীয় দলগুলি যেমন কংগ্রেস বা বিজেপি বা সিপিএম সবাই আঞ্চলিক দলগুলির হাতে ক্ষমতা হারাচ্ছে দ্রুত। পশ্চিম বঙ্গে যেমন তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে সম্পূর্ন বিলিয়ে গেছে ‘জাতীয় কংগ্রেস’। বিহারে নিতীশ প্রায় কোনঠাশা করেছেন তার নির্বাচনী সঙ্গী বিজেপিকে। উড়িশ্যাতে বিজুত বিজেপিকে গলাধাক্কা দিয়ে বাড় করেদিলেন উড়ীয়্যা জাতিয়তাবাদের হাওয়ায়। আসলে এইসব জাতীয় দলগুলি রাজ্যের ভালমন্দ একদমই ভাবে না। সব জাতীয় দলের নেতারা দিল্লীতে বসে দুহাতে টাকা লোটে। ফলে এমন পরিণতি আসতই। এটা ভারতীয় গণতন্ত্রের খুব ভাল দিক যে দিল্লী দুর্বল হচ্ছে-এবং রাজ্যগুলির রাজনৈতিক শক্তি বাড়ছে।

  • জাতপাতের রাজনীতি করে- নীচু জাতের লোকেদের টুপি পড়িয়ে, টাকা লোটার জন্যে উত্তর ভারতে একগাদা জাতিভিত্তিক দল আছে-যেমন মুলায়েমের সমাজবাদি পার্টি, মায়াবতীর বহুজন সমাজবাদি পার্টি। এরা কংগ্রেসের হরিজন ভোট ব্যাঙ্ক ছিনিয়ে নিয়ে, উত্তর প্রদেশ, বিহারে ক্ষমতা দখল করে, রাজ্যগুলির দফারফা সেরেছে। কিন্তু সেই মুখোশও খুলে আসছে। এদের সমীকরন ছিল নীচু জাতের ভোট+মুসলীম ভোট একত্রিত করে কংগ্রেসকে হঠানো। কিন্ত সেটা করতে গিয়ে, বিজেপিকে প্রবল ভাবে সুবিধা করে দেওয়া হয়েছে- সংখ্যালঘুরা তা আস্তে আস্তে বুঝতে পারছে।ফলে এবার কংগ্রেস বহুদিনবাদে উত্তরপ্রদেশে আবার হারানো জমি পুনররুদ্ধার করার আশা রাখে।

ভারতীয় জনগণ কি ভাবছে-তা আর দুদিন বাদেই জানা যাবে। তারপরে ট্রেন্ড ব্যাপারটা আরো পরিস্কার হবে।