আমি ‘জীবন মানে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা’ নামে একটি সিরিজ শুরু করেছিলাম। সিরিজটিতে মূলতঃ ভায়োলেন্সের একটি নৃতাত্ত্বিক, সামাজিক বিশ্লেষণ হাজির কারার চেষ্টা ছিলো আধুনিক বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের পটভুমিকায়। দুইটি পর্ব আগে দেয়া হয়েছে। সে হিসেবে এই পর্বটি হওয়া উচিৎ ছিলো জীবন মানে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা -৩। কিন্তু সুপ্রিয় এবং শ্রদ্ধেয় গীতাদি (গীতা দাস) দ্বিতীয় পর্বটিতে অভিযোগ করলেন শিরোনামটি বেশি গতানুগতিক না সাদামাঠা হয়ে গেছে। তাই ম্যাড়ম্যাড়ে শিরোনাম বদলে একটু আকর্ষনীয় করার চেষ্টা করা হল এবারে। লুল পুরুষ শব্দটি নতুন শেখা (কৃতজ্ঞতা – বিপ্লব রহমান, বাংলা ব্লগের অপ-শব্দসমূহ…)। সঙ্গত কারণেই শিরোনামে এটি ব্যবহারের লোভ সামলাতে পারলাম না। 🙂

:line:

প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব

আমি আগের পর্ব শেষ করেছিলাম এই বলে যে, সাহসিকতার মত গুণগুলোকে আমাদের আদিম পুর্বপুরুষেরা যৌনতার নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের অজান্তেই নির্বাচিত করেছিলো। এখনো সেই গুণগুলোর উৎকর্ষতার চর্চাকে ইনিয়ে বিনিয়ে মহিমান্বিত করার অফুরন্ত দৃষ্টান্ত দেখি সমাজে। জেমসবন্ড, মিশন ইম্পসিবল কিংবা আজকের ‘নাইট এণ্ড ডে’র মতো চলচিত্রগুলো ফুলিয়ে ফাপিয়ে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়, যার কেন্দ্রে থাকে প্রায় অমানবীয় ক্ষমতাসম্পন্ন হিরোইক ইমেজের একজন পুরুষালী চরিত্র, যে অসামান্য বুদ্ধি, ক্ষিপ্রতা আর সাহসের মাধ্যমে একে একে হাজারো বিপদ পার হয়ে চলেছে, আর অসংখ্য নারীর মন জয় করে চলেছে।

তবে, শুধু জেমসবন্ডের ছবি নয়, বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণারত বিজ্ঞানীরা সমাজের বিভিন্ন প্যাটার্নের ব্যাখ্যা হিসেবে সম্প্রতি খুব চমৎকার কিছু বিশ্লেষণ হাজির করেছেন (সব কিছু নিয়ে পূর্ণাঙ্গ আলোচনা হয়তো সম্ভব নয়, আমি এই পর্বে এবং আগামী কিছু পর্বে মূলত আমার আলোচনা ভায়োলেন্স বা সহিংসতা বিষয়েই কেন্দ্রিভূত রাখার চেষ্টা করব)।

অধ্যাপক মার্টিন ড্যালি এবং মার্গো উইলসন ১৯৮৮ সালে একটি বই লেখেন হোমিসাইড নামে[1]। তাদের বইয়ে তারা দেখান যে, হত্যা, গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, শিশু হত্যা, অভিভাবক হত্যা, পুরুষ কর্তৃক পুরুষ হত্যা, স্বামী কর্তৃক স্ত্রী হত্যা, স্ত্রী কর্তৃক স্বামী হত্যা -সব কিছুর উৎস আসলে লুকিয়ে রয়েছে বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের ব্যাখ্যায়। সেই দৃষ্টিকোন থেকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যাক।

কেন সিণ্ডারেলার গল্প কম বেশি সব সংস্কৃতিতেই ছড়িয়ে আছে?

শিশুনির্যাতন বিষয়টাকে অভিভাবকদের ব্যক্তিগত আক্রোশ কিংবা বড়জোর সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক কারণ হিসেবে এ পর্যন্ত চিত্রিত করা হলেও, এর সার্বজনীন রূপটি আসলে অব্যক্ষাত ছিলো। কিন্তু অব্যক্ষাত থাকলেও অজানা ছিলো না। সবাই কম বেশি জানতো যে, প্রতিটি সংস্কৃতিতেই সিণ্ডারেলা কিংবা স্নো হোয়াইটের মত লোককথা কিংবা গল্পকাহিনী প্রচলিত, যেখানে সৎবাবা কিংবা সৎমা কর্তৃক শিশুর উপর নির্যাতন থাকে মূল উপজীব্য হিসেবে।

cinderella_snowwhite

ছবি – পৃথিবীর প্রায় সব সংস্কৃতিতেই সিণ্ডারেলা বা স্নো হোয়াইটের মত লোককাহিনী বা রূপকথা প্রচলিত আছে, যেখানে বিবৃত থাকে সৎ মার অত্যাচারের বেদনাঘন কাহিনী ।

ছোটবেলায় রুশদেশীয় উপকথার খুব মজার মজার বই পড়তাম। আশি আর নব্বই দশকের সময়গুলোতে চিকন মলাটে বাংলায় রাশিয়ান গল্পের (অনুবাদ) অনেক বই পাওয়া যেত। আমি সবসময়ই তীর্থের কাকের মত বসে থাকতাম নতুন নতুন গল্পের বই পড়ার আশায়। প্রতি বছর জন্মদিনের সময়টাতে তৃষ্ণা যেন বেড়ে যেত হাজারগুণে। কারণ, জানতাম কেউ না কেউ রুশদেশীয় উপকথার বই নিয়ে আসবে উপহার হিসেবে। অবধারিত ভাবে তাই হত। এমনি একটি জন্মদিনে একটা বই পেয়েছিলাম ‘বাবা ইয়াগা’ (Baba Yaga) নামে। গল্পটা এরকম- এক লোকের স্ত্রী মারা গেলে লোকটি আবার বিয়ে করে। তার প্রথম পক্ষের স্ত্রীর ছিলো এক ফুটফুটে মেয়ে। কিন্তু সৎ মা এসেই মেয়েটির উপর নানা ধরণের অত্যাচার শুরু করে। মারধোর তো ছিলোই, কিভাবে চিরতরে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়া যায় সেটারও পায়তারা চলছিল। শুধু তাই নয়, মেয়েটিকে ছলচাতুরী করে সৎমা তার বোনের বাসায় পাঠানোর নানা ফন্দি ফিকির করে যাচ্ছিল। সৎমার বোন আসলে ছিলো এক নরখাদক ডাইনী। যা হোক, গল্পে শেষ পর্যন্ত দেখা যায় – কোন রকমে মেয়েটি নিজেকে ঘোর দুর্দৈব থেকে বাঁচাতে পেরেছিল, আর মেয়েটির বাবাও বুঝে গিয়েছিল তার নতুন স্ত্রীর প্রকৃত স্বরূপ। শেষমেষ গুলি করে তার স্ত্রীকে হত্যা করে মেয়েকে ডাইনীর খপ্পর থেকে রক্ষা করে তার বাবা।

আমি জার্মান ভাষাতেও এ ধরনের একটি গল্প পেয়েছি যার ইংরেজী অনুবাদ বাজারে পাওয়া যায় ‘জুপিটার ট্রি’ নামে। সেখানে ঘটনা আরো ভয়ানক। সৎমা তার স্বামীর অনুপস্থিতিতে সৎ ছেলেকে জবাই করে হত্যা করার পর দেহটা হাঁড়িতে জ্বাল দিয়ে রেধে খেয়ে ফেলে। আর হাড়গোড়গুলো পুতে ফেলে বাসার পাশে এক জুপিটার গাছের নীচে। তারপর সৎমা নির্বিঘ্নে ঘুমাতে যায় সব ঝামেলা চুকিয়ে। কিন্তু জুপিটার গাছের নীচে পুতে রাখা ছেলেটার হাড়গোড় থেকে গভীর রাতে জন্ম হয় এক মিষ্টি গলার গায়ক পাখির। সেই পাখি তার কন্ঠের যাদুতে সৎমাকে সম্মোহিত করে বাড়ির বাইরে নিয়ে আসে আর শেষ পর্যন্ত উপর থেকে পাথর ফেলে মেরে ফেলে। এখানেই শেষ নয়। পাখিটি তারপর অলৌকিকভাবে সেই আগেকার ছেলেতে রূপান্তরিত হয়ে যায় আর তার বাবার (genetic father) সাথে সুখে শান্তিতে জীবন কাটাতে থাকে।

রুশ দেশের কিংবা জার্মান দেশের উপকথা স্রেফ উদাহরণ হিসেবে নেয়া হয়েছে। আসলে এধরণের গল্প কিংবা উপকথা সব সংস্কৃতিতেই কমবেশি পাওয়া যায়। এমনকি আমাদের সংস্কৃতিতেও রূপকথাগুলোতে অসংখ্য সুয়োরানী, দুয়োরাণীর গল্প আছে, এমনকি বড় হয়েও দেখেছি বহু নাটক সিনেমার সাজানো প্লট যেখানে সৎমা জীবন অতীষ্ট করে তুলছে একটি ছোট্ট মেয়ের। নিশ্চয় মনের কোনে প্রশ্ন উঁকি মারতে শুরু করেছে – কেন সবদেশের উপকথাতেই এ ধরণের গল্প ছড়িয়ে আছে? আসলেই কি এ ধরনের গল্পগুলো বাস্তব সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে, নাকি সেগুলো সবই উর্বর মস্তিস্কের কল্পণা? পশ্চিমে ঘটনাপ্রবাহের দিকে তাকানো যাক। আমেরিকার মতো জায়গায় বিবাহবিচ্ছেদের হার তুলনামূলকভাবে বেশি, স্টেপ বাবা কিংবা স্টেপ মা’র ব্যাপারটা একেবারেই গা সওয়া হয়ে গেছে, দত্তক নেয়ার ব্যাপারটাও এখানে খুব সাধারণ। কাজেই ধরে নেয়া যায় যে, এই সমস্ত অগ্রসর সমাজে সৎঅভিভাবক কর্তৃক শিশু নির্যাতনের মাত্রা কম হবে। সত্যিই তা কম, অন্ততঃ আমাদের মতো দেশগুলোর তুলনায় তো বটেই। কিন্তু ড্যালি এবং উইলসন তাদের গবেষনায় দেখালেন, এমনকি পশ্চিমেও সৎঅভিভাবক (step parents) কর্তৃক শিশু নির্যাতনের মাত্রার চেয়ে জৈবঅভিভাবক (biological parent)দের দ্বারা শিশু নির্যাতনের মাত্রা তুলনামূলকভাবে অনেক কম পাওয়া যাচ্ছে। অর্থাৎ, এমনকি অগ্রসর সমাজে সৎঅভিভাবকদের দ্বারা শিশু নির্যাতন কম হলেও জৈব অভিভাবকদের তুলনায় তা আসলে এখনো অনেক বেশিই। যেমন, পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, আমেরিকার আধুনিক সমাজেও জৈব অভিভাবকদের দ্বারা শিশু নির্যাতনের চেয়ে সৎ অভিভাবক কর্তৃক শিশু নির্যাতন অন্ততঃ ১০০ গুণ বেশি। ক্যানাডায় জরিপ চালিয়েও একই ধরণের ফলাফল পাওয়া গেছে। সেখানে স্বাভাবিক অভিভাবকের তুলনায় সৎঅভিভাবকদের নির্যাতনের মাত্রা ৭০ গুণ বেশি পাওয়া গেলো।

childabuse

childabuse1

ছবি – মার্টিন ড্যালি এবং মার্গো উইলসন তাদের গবেষনায় দেখিয়েছেন যে, সৎঅভিভাবক কর্তৃক শিশু নির্যাতনের মাত্রার চেয়ে জৈবঅভিভাবকদের দ্বারা শিশু নির্যাতনের মাত্রা সবসময়ই তুলনামূলকভাবে কম পাওয়া যায়।

আসলে বিবর্তনীয় প্রেক্ষাপটে চিন্তা করলে তাই পাওয়ার কথা। জৈব অভিভাবকেরা তাদের জেনেটিক সন্তান খুব কমই নির্যাতন বা হত্যা করে, কারণ তারা সহজাত কারণেই নিজস্ব জিনপুল তথা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধ্বংসের চেয়ে রক্ষায় সচেষ্ট হয় বেশি, কিন্তু সৎঅভিভাবকদের ক্ষেত্রে যেহেতু সেই ব্যাপারটি ‘জেনেটিকভাবে’ সেভাবে নেই,অনেকাংশেই সামাজিকভাবে আরোপিত, সেখানে নির্যাতনের মাত্রা অধিকতর বেশি পাওয়া যায়। ব্যাপারটা শুধু মানুষ নয়, অন্য প্রাণিজগতের ক্ষেত্রেও খুব প্রবলভাবে দৃশ্যমান। আফ্রিকার বণভূমিতে সিংহদের নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেখেন, সেখানে একটি পুরুষ সিংহ যখন অন্য সিংহকে লড়াইয়ে পরাজিত করে গোত্রের সিংহীর দখল নেয়, তখন প্রথমেই যে কাজটি করে তা হল সে সিংহীর আগের বাচ্চাগুলোকে মেরে ফেলে। আফ্রিকার সেরেঙ্গিটি প্লেইনে গবেষকদের হিসেব অনুযায়ী প্রায় শতকরা ২৫ ভাগ সিংহসাবক তার বৈপিত্রের খপ্পরে পড়ে মারা যায়[2]। একই ধরণের ব্যবহার দৃশ্যমান গরিলা, বাঘ, চিতাবাঘ প্রভৃতি প্রাণীর মধ্যেও। এখন মানুষও যেহেতু অন্য প্রানীদের মতো বিবর্তনের বন্ধুর পথেই উদ্ভুত হয়েছে, তাই তার মধ্যেও সেই ‘পশুবৃত্তি’র কিছুটা ছিটেফোঁটা থাকার কথা। অনেক গবেষকই মনে করেন, প্রচ্ছন্নভাবে হলেও তা পাওয়া যাচ্ছে। মার্টিন ড্যালি এবং মার্গো উইলসনের উপরের পরিসংখ্যানগুলো তারই প্রমাণ।ডেভিড বাস তার ‘দ্য মার্ডারার নেক্সট ডোর’ বইয়ে সেজন্যই বলেন[3] –

‘Put bluntly, a stepparent has little reproductive incentive to care for a stepchild. In fact, a stepparent has strong incentives to want the stepchild out of the way. A stepfather who kills a stepchild prevents that child’s mother from investing valuable resources in a rival’s offspring. He simultaneously frees up the mother’s resources for investigating in his own offspring with her.’

এই ব্যাখ্যা থেকে অনেকের মনে হতে পারে যে বৈপিত্রের হাতে শিশু হত্যাটাই বুঝি ‘প্রাকৃতিক’ কিংবা অনেকের এও মনে হতে পারে যে, সৎ অবিভাবকদের কুকর্মের বৈধতা অবচেতন মনেই আরোপের চেষ্টা হচ্ছে বুঝি। আসলে তা নয়।সিংহর ক্ষেত্রে যেটা বাস্তবতা, মানব সমাজের ক্ষেত্রেও সেটা হবে তা ঢালাওভাবে বলে দেওয়াটা কিন্তু বোকামি। আর মানব সমাজ এমনিতেই অনেক জটিল।জৈব তাড়নার বিপরীতে কাজ করতে পারার বহু দৃষ্টান্তই মানব সমাজে বিদ্যমান; যেমন পরিবার পরিকল্পণার মাধ্যমে সন্তান না নেয়া, অনেকের সমকামী প্রবণতা প্রদর্শন, দেশের জন্য আত্মত্যাগ, কিংবা আত্মহত্যার দৃষ্টান্ত, সন্তানদের পাশাপাশি মা বাবার প্রতি ভালবাসা, পরকীয়ার কারণে নিজ সন্তানকে হত্যা, সন্তান থাকার পরেও আরো সন্তান দত্তক দেয়া, আবার পরের ছেলে কেষ্টর মায়ায় কাদম্বিনীর গৃহত্যাগ (শরৎচন্দ্রের মেজদিদি গল্প দ্রঃ) সহ বহু দৃষ্টান্তই সমাজে আমরা দেখি যেগুলোকে কেবল জীববিজ্ঞানের ছাঁচে ফেলে বিচার করতে পারি না। মনে রাখতে হবে, আধুনিক বিশ্ব আর সিণ্ডারেলা আর সুয়োরাণীর যুগে পড়ে নেই; নারীরা আজ বাইরে কাজ করছে, ভিক্টোরিয় সমাজের তুলনায় তাদের ক্ষমতায়ন এবং চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় সামাজিক সম্পর্কগুলো দ্রুত বদলে যাচ্ছে।পাশ্চাত্য বিশ্বে বিবাহবিচ্ছেদ যেমন বেড়েছে, তেমনি পাল্লা দিয়ে দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে উঠছে ‘স্টেপ ড্যাড’ আর ‘স্টেপ মম’এর মত ধারণাগুলো। এমনকি সমকামী দম্পতিদের দত্তক নেয়ার দৃষ্টান্তও বিরল নয়। বহু পরিবারেই দেখা যায় জৈব অভিভাবক না হওয়া সত্ত্বেও সন্তানের সাথে অভিভাবকদের সুসপম্পর্ক গড়ে উঠাতে কোন বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। আর বৈপিত্রের দ্বারা সন্তান হত্যার পেছনে আদি জৈবিক প্রভাব যদি কিছু মানব সমাজে থেকেও থাকে, সেটার বিপরীত প্রভাবগুলোও ‘প্রাকৃতিক’ভাবে অঙ্কুরিত হতে হবে জিনপুলের টিকে থাকার প্রয়োজনেই। সেজন্যই দেখা যায় বিবাহবিচ্ছিন্ন একাকী মা (single mother) যখন আরেকটি নতুন সম্পর্কে জড়ান, তখন তার প্রাধান্যই থাকে তার সন্তানের প্রতি তার প্রেমিকের মনোভাবটি কিরকম সেটি বুঝার চেষ্টা করা। কোন ধরণের বিরূপতা লক্ষ্য করলে কিংবা অস্বস্তি অনুভব করলে সম্পর্কের চেয়ে সন্তানের মঙ্গলটাই মূখ্য হয়ে উঠে অধিকাংশ ক্ষেত্রে। আবার অনেক ক্ষেত্রে তার নতুন পুরুষটি প্রাথমিকভাবে ততটা বাঞ্ছিত না হলেও যদি কোন কারণে সন্তানের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠে, তবে সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে মার কাছে অগ্রগামীতা পেতে বাড়তি দূরত্ব অতিক্রম করে ফেলেন তিনি। আবার সম্পর্ক তৈরির পরে কখনো সখনো ঝগড়াঝাটি হলে স্থায়ীভাবে অযাচিত টেনশনের দিকে যেন ব্যাপারটা চলে না যায়, সেটিও থাকে সম্পর্কের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। এগুলো সবকিছুই তৈরি হয় টিকে থাকার জন্য বিবর্তনীয় টানাপোড়নের নিরিখে।

কেন দাগী অপরাধীদের প্রায় সকেলেই পুরুষ?

মার্টিন ড্যালি এবং মার্গো উইলসন তাদের বইয়ে দেখিয়েছেন যে, ইতিহাসের একটা বড় সময় জুড়ে মানবসমাজ আসলে একগামী ছিলো না, বরং সেসময় পুরুষেরা ছিলো বহুগামী। মানব সমাজ ছিলো পলিজাইনাস (polygynous) যেখানে শক্তিশালী কিংবা ক্ষমতাশালী পুরুষেরা একাধিক নারীকে বিয়ে করতে পারতো, কিংবা তাদের দখল নিতে পারতো[4]।পলিজাইনাস সমাজে কিছু সৌভাগ্যবান পুরুষ তাদের অতুলনীয় শক্তি আর ক্ষমতার ব্যবহারে অধিকাংশ নারীর দখল নিয়ে নিতো, আর অধিকাংশ শক্তিহীন কিংবা ক্ষমতাহীন পুরুষদের কপালে থাকতো অশ্বডিম্ব! যতো খারাপই লাগুক, এটাই ছিলো রূঢ় বাস্তবতা। নারীর দখল নেয়ার জন্য পুরুষে পুরুষে একসময় প্রতিযোগিতা করতে হতো; আর এই প্রতিযোগিতা বহুক্ষেত্রেই ‘শান্তিময়’ ছিলো না, বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই প্রতিযোগিতা রূপ নিতো রক্তাক্ত সংঘাতে, আর তার পরিনতি হত হত্যা আর অপঘাতে। পুরুষেরা সম্পদ আহরণ করতো কিংবা লড়াই আর যুদ্ধের মাধ্যমে শক্তিমত্তা প্রদর্শন করতো মূলতঃ নারীদের আকর্ষণের জন্য। যারা সম্পদ আহরণে আর শক্তি প্রদর্শনে ছিলো অগ্রগামী তারা দখল নিতে পারতো একাধিক নারীর। সম্পদ আর নারী নিয়ে এই প্রতিযোগিতার কারণেই সমাজের পুরুষদের মধ্যে বিভিন্ন ধরণের সহিংসতার চর্চার (সঙ্ঘাত, খুন, ধর্ষণ, অস্ত্রবাজি, গণহত্যা প্রভৃতি)প্রকাশ ঘটেছিলো। বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, পুরুষালি সহিংসতার বড় একটা উৎস আসলে নিহিত সেই চিরন্তন ‘ব্যাটেল অব সেক্স’-এর মধ্যেই। এমনকি আধুনিক কালে ঘটা বিভিন্ন অপরাধ এবং ভায়োলেন্সগুলোকেও বহু সময়েই এর মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যায়।

আধুনিক বিশ্বেও পুরুষেরা সম্পদ আহরণের জন্য, ক্যারিয়ারের জন্য, অর্থ উপার্যনের জন্য মেয়েদের তুলনায় অধিকতর বেশি শক্তি এবং সময় ব্যয় করে। কারণ এর মাধ্যমে তারা নিশ্চিত করে অধিকসংখ্যক নারীর দৃষ্টি, এবং সময় সময় তাদের অর্জন এবং প্রাপ্তি। অর্থাৎ, একটা সময় পুরুষেরা নারীর দখল নিতে নিজেদের মধ্যে শারীরিক প্রতিযোগিতা আর দ্বন্দ্বযুদ্ধে নিজেদের নিয়োজিত রাখতো, এখন সেটা পরিণত হয়েছে অর্থ, বৈভব, ক্যারিয়ার তৈরির লড়াইয়ে। বিত্তশালী ছেলেরা বিএমডাব্লু কিংবা রোলসরয়েসে চড়ে বেড়ায় নিজেদের বৈভবের মাত্রা প্রকাশ করতে, কিংবা হাতে ফ্যাশানেবল মোভাডো ঘড়ি কিংবা ব্র্যাণ্ডনেমের কেতাদুরস্ত কাপড় পরিধান করে, যার মাধ্যমে নিজেকে ‘শো অফ’ করে অন্য পরুষদের চেয়ে ‘যোগ্য’ হিসেবে প্রতিপন্ন করতে চায়। শুধু কেতাদুরস্ত কাপড় কিংবা ঘড়ি নয়, কথাবার্তা, চালচলন, স্মার্টনেস, শিক্ষাগত যোগ্যতা, রাজনৈতিক বা সামাজিক ক্ষমতা বা প্রতিপত্তি সবকিছুকেই পুরুষেরা ব্যবহার করে নারীকে আকর্ষণের কাজে। সেজন্যই বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, অর্থ-প্রতিপত্তি আর ক্ষমতায় বলীয়ান পুরুষেরাই বেশি পরকীয়ায় বেশি আসক্ত হন বেশি (এ নিয়ে পরবর্তী অনুচ্ছেদে আলোচনা করা হয়েছে)। যৌনতার এই ধরণের পার্থক্যের কারণেই পুরুষেরা সামগ্রিকভাবে অধিকতর বেশি ঝুঁকি নেয়, ঝুঁকিপূর্ণ কাজকর্ম, পেশা কিংবা খেলাধুলায় (কার রেসিং, বাঞ্চি জাম্পিং কিংবা কিকবক্সিং) জড়িত হয় বেশি, একই ধারায় অপরাধপ্রবণতার জগতেও তারা প্রবেশ করে অধিক হারে। এর সত্যতা মিলে সহিংসতা নিয়ে গবেষকদের বাস্তব কিছু পরিসংখ্যানেও। সাড়া বিশ্বে যত খুন খারাবি হয় তার শতকরা ৮৭ ভাগই হয় পুরুষের দ্বারা[5]। আমেরিকার মধ্যে চালানো জরিপে পাওয়া গেছে যে শতকরা ৬৫ ভাগ ক্ষেত্রে পুরুষ দ্বারা পুরুষ হত্যার ঘটনা ঘটে। শতকরা ২২ ভাগ ক্ষেত্রে পুরুষের হাতে নারী হত্যার ঘটনা ঘটে। খুন খারাবির ১০ ভাগ ক্ষেত্রে নারী হত্যা করে পুরুষকে, আর মাত্র ৩ ভাগ ক্ষেত্রে নারী হত্যা করে নারীকে[6]। সারা বিশ্বে পুরুষদের হাতে পুরুষদের হত্যার হার আরো বহুগুণে বেশি পাওয়া গেছে ভিন্ন কিছু পরিসংখ্যানে। যেমন, ব্রাজিলে শতকরা ৯৭ ভাগ ক্ষেত্রে, স্কটল্যাণ্ডে ৯৩ ভাগ ক্ষেত্রে, কেনিয়ায় ৯৪ ভাগ ক্ষেত্রে, উগাণ্ডায় ৯৮ ভাগ ক্ষেত্রে এবং নাইজেরিয়ায় ৯৭ ভাগ ক্ষেত্রে পুরুষ কর্তৃক পুরুষের হত্যার ঘটনা ঘটে থাকে[7]। এর মাধ্যমে পুরুষ –পুরুষ প্রতিযোগিতা, দ্বন্দ্ব, সংঘাত এবং জিঘাংসার বিবর্তনীয় অনুকল্পই সঠিক বলে প্রমাণিত হয়।

গড়পরতা নারীরা পুরুষদের চেয়ে কম ঝুঁকি নেয়। বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানী এনি ক্যাম্পবেল (Anne Campbell) মনে করেন, অনর্থক ঝুঁকি নেবার ব্যাপারগুলো মেয়েদের জন্য কোন রিপ্রোডাক্টিভ ফিটনেস প্রদান করে না[8]। আদিম কাল থেকেই ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত হয়ে নিজের জীবন বিপন্ন করার চেয়ে মেয়েরা বরং সন্তানদের দেখভাল করায় অর্থাৎ জিনপুল রক্ষায় নিয়োজিত থেকেছে বেশি। অনেক গবেষকই মনে করেন, মেয়েরা যে কারণে পুরুষদের মত ঘন ঘন সঙ্গি বদল করে না, ঠিক সেকারণেই তারা ঝুঁকিপূর্ণ কাজেও জড়িত হয় কম, কারণ, বিবর্তনগত দিক থেকে সেগুলো কোন প্রজননগত উপযোগিতা (reproductive benefit) প্রদান করে না। এ কারনেই মেয়েদের মানসজগৎ কম প্রতিযোগিতামূলক এবং সর্বোপরি কম সহিংস হিসেবে গড়ে উঠেছে। যে কোন সংস্কৃতি খুঁজলেই দেখা যাবে, নৃশংস খুনি বা সিরিয়াল কিলার পুরুষদের তুলনায় নারীদের মধ্যে একেবারেই কম, ঠিক যে কারণে পর্নোগ্রাফির প্রতি আসক্তি মেয়েদের মধ্যে কম থাকে পুরুষের তুলনায়।

কেন ক্ষমতাশালী (লুল)পুরুষেরা বেশি পরকীয়ায় আসক্ত হয়?

বিল ক্লিন্টন ২৪ বছর বয়স্ক মনিকা লিউনেস্কির সাথে নিজের অফিসে দৈহিক সম্পর্ক তৈরি করেছিলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেবার পর। ১৯৯৮ সালের ২১ শে জানুয়ারী তা মিডিয়ার প্রথম খবর হিসবে সাড়া বিশ্বে প্রচারিত হয়ে যায়।

bill_clinton_and_monica

ছবি-মনিকা লিউনস্কি এবং বিল ক্লিন্টন

অনেকেই অবাক হলেও অবাক হননি ডারউইনীয় ইতিহাসবিদ লরা বেটজিং (Laura Betzig)। তিনি প্রায় বিশ বছর ধরে ডারউইনীয় দৃষ্টিকোন থেকে রাজনীতিবিদদের কিংবা প্রভাবশালী চালচিত্র নিয়ে গবেষণা করে যাচ্ছিলেন[9],[10]। খবরটা শোনার পর তার প্রথম প্রতিক্রিয়াই ছিল, “কি, বলেছিলাম না?”[11]। তার এহেন প্রতিক্রিয়ার কারণ আছে। তিনি বহুদিন ধরেই বলার চেষ্টা করছিলেন যে, ইতিহাসে প্রভাবশালী এবং প্রতিপত্তিশালী পুরুষেরা তাদের ‘বৈধ’ স্ত্রীর পাশাপাশি সব সময়ই চেষ্টা করেছে অধিক সংখ্যক নারীর দখল নিতে এবং তাদের গর্ভে সন্তানের জন্ম দিতে। ইতিহাসে রাজা বাদশাহদের রঙ বেরঙের জীবন-কাহিনী পড়লেই দেখা যাবে, কেউ রক্ষিতা রেখেছে, কেউ দাসীর সাথে সম্পর্ক করেছিলেন, কেউ বা হারেম ভর্তি করে রেখেছিলেন অগনিত সুন্দরী নারীতে। সলোমনের নাকি ছিলো তিন শো পত্নী, আর সাত হাজার উপপত্নী। মহামতি আকবরের হারেমে নাকি ছিল ৫০০০ এর উপর নারী। ফিরোজ শাহ নাকি তার হারেমে প্রতিদিন তিনশ নারীকে উপভোগ করতেন। মরোক্কান সুলতান মৌলে ইসমাইলের হারেমে দুই হাজারের উপরে নারী ছিল, এবং ইসমাইল সাহেব বৈধ অবৈধ সব মিলিয়ে এক হাজারের উপর সন্তান সন্ততি তিনি পৃথিবীতে রেখে গেছেন[12]। রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার, দ্বিগবিজয়ী আলেকজান্ডার কিংবা চেঙ্গিসখানের নারী-লালসার কথাও সর্বজনবিদিত। তাদের সন্তান সন্তদিদের সংখ্যাও অসংখ্য। এর মাধ্যমে একটি নির্জলা সত্য বেড়িয়ে আসে, ইতিহাসের ক্ষমতাশালী পুরুষেরা তাদের প্রজননগত সফলতার (reproductive success) মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছিল বহুনারীর দখলদারিত্বকে। আজকে আমরা যতই ‘মনোগামিতা’র বিজয়কেতন উড়াই না কেন, পুরুষের ক্ষমতা বৃদ্ধির সাথে বহুগামিতার প্রকাশ ঘটে বহু ক্ষেত্রেই খুব অনিবার্যভাবে। কিংবা আরো পরিস্কার করে বললে বলা যায়, মানসিকভাবে বহুগামী পুরুষেরা নারীদের আকর্ষণ এবং ভোগ করার আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়িত করতে পারে যদি তাদের হাতে পর্যাপ্ত যশ, প্রতিপত্তি আর ক্ষমতা থাকে।

আমাদের দেশেও আমরা দেখেছি প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ, আজিজ মোহাম্মদ ভাই, জয়নাল হাজারির মত ‘লুলপুরুষেরা’ কীভাবে ক্ষমতা আর প্রতিপত্তিকে নারীলোলুপতার উপঢৌকন হিসেবে ব্যবহার করেছেন। শুধু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার শীর্ষে থাকা পুরুষেরা নয় অর্থ বিত্ত বৈভবে শক্তিশালী হয়ে উঠলে সাধারণ পুরুষেরাও কীভাবে আকর্ষনীয় নারীর দখলে উন্মুখ হয়ে উঠতে পারে জনপ্রিয় কথাশিল্পী হুমায়ুন আহামেদের জীবনালোচনা করলে এর সত্যতা মিলে। হুমায়ুন আহমেদ যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ‘সাধারণ’ শিক্ষক ছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়া ফ্ল্যাটে থাকতেন, এত পয়সাকড়ি ছিলো না, তখন গুলতেকিনকে নিয়ে সংসারী ছিলেন তিনি। কিন্তু অর্থ বিত্ত বাড়ার সাথে সাথে তার চাহিদাও বদলে গিয়েছিলো। তার কন্যার বয়সী শাওনের প্রতি তিনি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন।পরবর্তীতে তার স্ত্রীকে তালাক দিয়ে তার প্রেমিকা শাওনকে ঘরে তুলেন তিনি।

হুমায়ুন আহমেদ যে কাজটি বাংলাদেশে করেছেন সে ধরণের কাজ পশ্চিমা বিশ্বে পুরুষেরা বহুদিন ধরেই করে আসছেন। পাশ্চাত্যবিশ্বকে ‘মনোগোমাস’ বা একগামী হিসেবে চিত্রিত করা হলেও, খেয়াল করলে দেখা যাবে সেখানকার পুরুষেরা উদার বিবাহবিচ্ছেদ আইনের (Liberal divorce laws) মাধ্যমে একটার পর একটা স্ত্রী বদল করেন। ব্যাপারটাকে অনেকেই ‘সিরিয়াল পলিগামি’[13] (তারা আইনকানুনের বাধ্যবাধকতার কারণে একই সাথে একাধিক স্ত্রী রাখতে পারেন না, কিন্তু বিবাহবিচ্ছেদের মাধ্যমে একের পর এক সঙ্গি বদল করেন) হিসেবে অভিহিত করেছেন। সিএনএন এর প্রাইম টাইম নিউজ হোস্ট ল্যারি কিং ইতোমধ্যেই আটটি বিয়ে (সিরিয়ালি) করেছেন। আমাদের বিবর্তনের পথিকৃত সুদর্শন রিচার্ড ডকিন্সও তিনখানা বিয়ে সেরে ফেলেছেন সিরিয়ালি। অবশ্য মেয়েদের মধ্যেও এ ধরনের উদাহরণ দেয়া যাবে। যেমন – হলিউডের একসময়কার জনপ্রিয় অভিনেত্রী এলিজাবেথ টেলর (যিনি আটবার সঙ্গিবদল করেছেন), কিন্তু তারপরেও পরিসংখ্যানে পাওয়া যায় যে, পশ্চিমা বিশ্বে প্রভাবশালী পুরুষেরাই সাধারণতঃ খুব কম সময়ের মধ্যে উদার বিবাহবিচ্ছেদ আইনের সুযোগ একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করেন, নারীদের মধ্যে এই প্রবণতা তুলনামূলকভাবে কম। অর্থাৎ, ‘সিরিয়াল পলিগামি’র চর্চা পুরুষদের মধ্যেই বেশি, এবং ক্ষমতা আর প্রতিপত্তি অর্জনের সাথে সাথে সেটা পাল্লা দিয়ে বাড়ে।

বিভিন্ন ধর্মের প্রচারকদের জীবনী বিশ্লেষণ করলেও এর সত্যতা মিলবে। পদ্মপুরাণ অনুসারে (৫/৩১/১৪) শ্রীকৃষ্ণের স্ত্রীর সংখ্যা ষোল হাজার একশ। এদের সকলেই যে গোপবালা ছিলেন তা নয়, নানা দেশ থেকে সুন্দরীদের সংগ্রহ করে তার ‘হারেমে’ পুরেছিলেন কৃষ্ণ স্বীয় ক্ষমতার আস্ফালনে। হিন্দু ধর্মের ক্ষমতাবান দেবচরিত্রগুলো – ইন্দ্র থেকে কৃষ্ণ পর্যন্ত প্রত্যেকেই ছিলেন ব্যভিচারী,ক্ষমতাবান ব্রাহ্মণ মুণিঋষিরা ছিল কামাসক্ত, বহুপত্নিক এবং অজাচারী, এগুলো তৎকালীন সাহিত্যে চোখ রাখলেই দেখা যায়। এই সব মুণিঋষিরা ক্ষমতা, প্রতিপত্তি আর জাত্যাভিমানকে ব্যবহার করতেন একাধিক নারীদখলের কারিশমায়। ইসলামের প্রচারক মুহম্মদ যখন প্রথম জীবনে দরিদ্র ছিলেন, প্রভাব প্রতিপত্তি তেমন ছিলো না, তিনি খাদিজার সাথে সংসার করেছিলেন। খাদিজা ছিলেন বয়সে মুহম্মদের ১৫ বছরের বড়। কিন্তু পরবর্তী জীবনে মুহম্মদ অর্থ, বৈভব এবং সমরাঙ্গনে অবিশ্বাস্য সফলতা অর্জন করার পর অপেক্ষাকৃত কম বয়সী সুন্দরী নারীদের প্রতি আকৃষ্ট হন। খাদিজা মারা যাওয়ার সময় মহানবীর বয়স ছিল ৪৯। সেই ৪৯ থেকে ৬৩ বছর বয়সে মারা যাবার আগ পর্যন্ত তিনি কমপক্ষে হলেও ১১ টি বিয়ে করেন[14]। এর মধ্যে আয়েশাকে বিয়ে করেন আয়েশার মাত্র ৬ বছর বয়সের সময়। এ ছাড়া তার দত্তক পুত্র যায়েদের স্ত্রী জয়নবের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তাকে বিয়ে করেন (সে সময় আরবে দত্তক পুত্রের স্ত্রীকে বিয়ে করার রীতি প্রচলিত ছিল না, কিন্তু মুহম্মদ আল্লাহকে দিয়ে কোরেনের ৩৩:৪, ৩৩:৩৭, ৩৩:৪০ প্রভৃতি আয়াত নাজিল করিয়ে নেন); এ ছাড়া ক্রীত দাসী মারিয়ার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন (সে সময় মুহম্মদ হাফসাকে মিথ্যে কথা বলে ওমরের বাড়ি পাঠিয়েছিলেন বলে কথিত আছে[15]) যা হাফসা এবং আয়েশাকে রাগান্বিত করে তুলেছিলো; যুদ্ধবন্দি হিসেবে জুয়ারিয়া এবং সাফিয়ার সাথে সম্পর্ক পরবর্তীতে নানা রকম বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। বিভিন্ন বৈধ অবৈধ পথে নারীর দখল নিতে মুহম্মদ আগ্রাসী হয়েছিলেন তখনই যখন তার অর্থ প্রতিপত্তি আর ক্ষমতা বেড়ে গিয়েছিল বহুগুণে।

চলবে

——————————————————————————–

তথ্যসূত্রঃ

[1] Margo Wilson and Martin Daly, Homicide, Aldine Transaction, 1988

[2] Martin Daly and Margo Wilson, The Truth about Cinderella: A Darwinian View of Parental Love, Yale University Press.

[3] David M. Buss, The Murderer Next Door, Why the Mind is Designed to Kill, Penguin Books, 2005, p 177.

[4] Margo Wilson and Martin Daly, পূর্বোক্ত, pp 137-161

[5] David M. Buss, The Murderer Next Door, Why the Mind is Designed to Kill, Penguin Books, 2005

[6] David M. Buss, The Murderer Next Door, পূর্বোক্ত, পৃঃ ২২।

[7] Margo Wilson and Martin Daly, পূর্বোক্ত।

[8] Anne Campbell, Staying Alive: Evolution, Culture, and Women’s Intrasexual Aggression, Behaviour and Brain Sciences, v.22 , pp203-52

[9] Laura Betzig, Despotism and differential reproduction: A cross cultural correlation of conflict asymmetry, hierarchy, and degree of polygyny. Ethology and Sociobiology, 3: 209-221, 1982.

[10] Laura Betzig, Despotism and differential reproduction: A Darwinian View of History, Newyork, Aldine Transaction, 1986.

[11] Alan S. Miller and Satoshi Kanazawa, Why Beautiful People Have More Daughters: From Dating, Shopping, and Praying to Going to War and Becoming a Billionaire– Two Evolutionary Psychologists Explain Why We Do What We Do, Perigee Trade; Reprint edition, 2008

[12] Laura Betzig, Despotism and differential reproduction: A Darwinian View of History, পূর্বোক্ত।

[13] Quoted from Alan S. Miller and Satoshi Kanazawa, Why Beautiful People Have More Daughters:

“Contemporary westerners who live in nominally monogamous societies that nonetheless permit divorce are therefore in effect polygynous; they practice serial polygamy।”

[14] ইরানি স্কলার আলি দস্তি তাঁর ‘Twenty Three Years: A Study of the Prophetic Career of Mohammad’ গ্রন্থে প্রফেটের জীবনে ২২ জন রমণীর উল্লেখ করেছেন, এদের মধ্যে ১৬ জনকে তিনি বিবাহের মাধ্যমে অধিগ্রহণ করেন, এ ছাড়া তিনি সম্পর্ক করেছিলেন ২ জন দাসী এবং অন্য ৪ জনের সাথে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক ছিল।

[15] William Muir, ‘Life of Mahomet’ Vol.IV Ch.26 pp. 160-163