কুসুম ভেবে পায়না এতো দূরে এই জনমানব শুন্য জায়গাটা রমিজ মিয়ার কেন পছন্দ! পাহাড় ঘেরা জঙ্গলের একটি ছোট্ট টিলা। টিলার ঠিক মাঝখানে বিশাল ছাতার মত বড় একটা বট গাছ। ঠান্ডা বাতাসে পাহাড়ী জঙ্গলী ফুলের গন্ধ। টিলার চুঁড়া থেকে দেখলে, দূরের ঐ আঁকাবাঁকা পীচঢালা পথটাকে চকচকে সাপের মত মনে হয়। দিনের বেলা মৃদু হাওয়ায় বটগাছের পাতাগুলোর ছন্ধময় নৃত্য, টিলার পাশ ঘেঁষে বয়ে যাওয়া অবিরাম ঝর্ণার শব্দ, নীরব নিস্তব্ধ রাতে, ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক, জোনাকীর আলো, জঙ্গুলে এই জায়গাটা এখন কুসুমের নিজেরও ভাল লাগে। বট গাছের বড়বড় জড়গুলো অনেক দূর পর্যন্ত ছড়ানো। এখানে আসার পর থেকে, গাছটির নির্দিষ্ট একটি জড়ের উপর দু’পা ছড়ায়ে বসে কুসুম তার জীবনের সুখ দুঃখের হিসেব মিলাতো। কুসুম ঐ দূরে তাকায়। যে দিকে তাকালে মনে হয় পাহাড় আর দুরের আকাশ মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। ওদিকে আঁকাবাঁকা রেল লাইন। এখানে বসলে প্রায়ই শব্দ শোনা যায়, ঝিক ঝিক,ঝিক ঝিক। কুসুমের ভাল লাগে। এখন সে আট মাসের গর্ভবতী। নিত্যদিনের মতো আজও এসে, গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছে জীবনের হিসেব মিলাতে। কুসুম পেছনের দিনগুলোর দিকে তাকায়। আরো পাঁচ দশটা মেয়ের মতো তারও ছিল বুক ভরা আশা, চোখভরা সপ্ন। কুসুম মাঝে মাঝে সপ্ন দেখতো, তার সুন্দর একটি ফুটফুটে ছেলে হবে, তাকে মা বলে ডাকবে।
একরাতের বৈশাখী ঝড়ে নদীতে ঢল নেমে আসলো, আর চোখের সামনেই নদীপাড়ের তাদের ছোট্ট ঘর খানি অথৈ জলে খড়কুটোর মতো ভেসে গেল। তারপর কাজের সন্ধানে এখানে আসা। কিন্তু পাহাড়ের এই টিলা ছাড়া রমিজ কি জগতের আর কোথাও যায়গা পেলোনা? কুসুম মনে মনে ভাবে- রমিজ আজকাল এমন করে কেন? কথায় কথায় রাগ করে, অকারণে মারধর করে, আশ্লীল ভাষায় গালাগালি করে। তবে কি রমিজ জেনে গেছে তার পেটের বাচ্চার বাবা কে? তাকে কি বলবে সেই রাতের কথা? না কি ঐ মানুষটাই রমিজকে সব বলে দিয়েছে? না, না, রমিজ জানতে পারলে বাচ্চা সহ তাকে মেরে ফেলবে। রমিজের অস্বাভাবিক আচরণে কুসুমের মনের সন্দেহ ঘোঁচেনা। রমিজ কি বিশ্বাস করে এ তার সন্তান? জলিল তাকে কিছু বলেনি তো? একদিন হয়তো সব জানাজানি হয়ে যাবে। ‘হউক, এ বাচ্চা আমার চাই, এ শুধুই আমার সন্তান, আমি তার মা’, কুসুম মনে মনে বলে।
কুসুম উঠে দাঁড়ায়, মাথাটা ভনভন করছে। ঘরে এসে মাটির বেড়ায় হেলান দিয়ে বসে পড়ে। পাঁচ বছর অতিবাহিত হওয়ার পরেও রমিজকে ডাক্তারী করানো গেলোনা। ডাক্তার বলেছিল রমিজের সমস্যা আছে, তার চিকিৎসা না করালে সে বাচ্চা দিতে পারবেনা। রমিজ তা মানতে রাজী নয়। এ তার পৌরুষত্বের ব্যাপার। কুসুম মা হতে চেয়েছিল, কিন্তু ঐ ভয়ংকর পথে হতে চায়নি। আট মাস আগের একটি রাত অভিশাপ না আশির্বাদ হয়ে এসেছিল কুসুম তার হিসেব মিলাতে পারেনা।
সেই রাতে রমিজ ঘরে ছিলনা। বাইরে প্রচন্ড ঝড়ের সাথে ছিল শিলা বৃষ্টি। রমিজের বন্ধু জলিল এসে বাঁশের দরজায় ধাক্কা মেরে বলে- ‘রমিজ বাড়ি আছো’? উনুনে ভেজা কাঠে আগুন জ্বালাতে ব্যস্ত কুসুম রান্নাঘর থেকে উত্তর দেয়- ‘সে তো এহনো ফিরে নাই ঠাকু ভাই’। দরজা ঠেলে জলিল ঘরে ঢুকে পড়ে। রমিজ রান্নাঘরে এসে বলে- ‘আইজ রাইতে হেই আর আইবোনা কুসুম’। ধীরে ধীরে আস্ত করে রমিজ তার শীতল হাতটা কুসুমের পিঠে রাখে। কুসুম মাথায় কাপড় টেনে উঠে দাঁড়ায়।
– কী করছো ঠাকু ভাই?
– কিছু না কুসুম। তুই কি জানস, তোর সোয়ামী তোরে এইহানে ক্যান নিয়া আইছে? চা বাগানের মাইয়্যা মাথিনরে হেই ভাল পায়। তারে নিয়া ফষ্টি-নষ্টি করনের লাইগ্যা তোরে এহানে নিয়া আইছে। তয় কুসুম তোর তো পোলা-পান অইবোনা, অসুবিধে কী? রমিজ কইছে তুই বন্দ্যা।
– না, না, আফনে আমার পথ ছাড়েন, আফনে ছইল্যা যান।
জলিল শক্ত হাতে কুসুমকে তার বুকে জড়িয়ে ধরে। জলিলের চোখে চোখ রেখে কাতর কণ্ঠে কুসুম মিনতি করে- ‘ঠাকু ভাই আফনে আমার সর্বনাশ কইরেন না’।
জলিল কোন সময় চলে গেছে কুসুমের মনে নেই। তেলশুন্য মাটির প্রদীপটাও নিভে গেছে। হয়তো জলিলই নিভিয়ে দিয়েছিল। শরীরে প্রচুর ব্যথা পাচ্ছে। কোন রকম অগোছালো শাড়ি গায়ে টেনে কুসুম শুইয়ে পড়ে। শেষ রাতে রমিজ বাড়ি ফেরে। রমিজ ডাক দেয়-
– কুসুম।
– আমার শরীলটা ভালা নাই।
– শরীল ভালা নাই কইলেই হইলো?
– আমি পারুম না, তুমি শুইয়া পড়ো।
রমিজকে বাধা দেয়ার একটুখানি শক্তিও কুসুমের গায়ে নেই। অবচেতন শরীরের উপর রমিজ কতক্ষন নির্যাতন চালালো কুসুম তার হিসেব রাখে নাই। শুধু জানে একরাতে তাকে দুবার ধর্ষণ করা হলো। পরের মাসেই কুসুম বুঝতে পারে তার কিছু একটা হয়েছে। দুই মাসের মাথায় নিশ্চিৎ জানতে পারে সে অন্তঃস্বত্বা। কুসুম কিংকর্তব্যবিমূঢ়, বুঝতে পারেনা এখন কী করবে? ঘটনা লুকানো যাবে হয়তো কিন্তু বাচ্চাটা? কুসুমের মাঝে মাতৃত্বের তীব্র আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠে। রমিজকে একদিন বলে দিয়েছিল, ‘আমি অন্তঃস্বত্বা, তুমি ছেলের বাবা হবে’। রমিজও শুনে খুশী হয়েছিল।

ক’দিন ধরেই কুসুমের বড় ক্ষিধে পায়। আজ ঘুম থেকে উঠে মাটির থালায় রাতের জলে ভেজানো ক’লোকমা ভাতে লবন আর পোড়া লাল মরিচ মেশায়ে যেই মাত্র মুখে তোললো অমনি রমিজ হাক দিলো- ‘এই তুই আগে খেলি ক্যান। বেশ্যা, মাগী, দুনিয়া খাইয়াও তোর পেট ভরেনা না’? বেশ্যা, মাগী গাল শুনে কুসুম আঁতকে উঠে। সাহসে কুলায়না জিজ্ঞেস করে রমিজ তাকে মাগী বললো কেন? পাঁচ বছর রমিজ তাকে বন্দ্যা বলে গালি দিয়েছে আর এখন গালি দেয় বেশ্যা বলে। রমিজ চলে যাবার পর একবার নিজের তলপেটে হাত বুলায়ে কুসুম শুধু বলে ‘তোমার ওসব হুননের কাম নাই বাবা, তুমি শুধুই আমার পোলা, আমি তোমার মা’। কুসুম যেন নিশ্চিৎ জেনে গেছে তার পেটের সন্তান ছেলে হবে।
ছোট বেলা আকাশে কালো মেঘ দেখলেই কুসুম ঘরের বাইরে চলে আসতো। গান গেয়ে বৃষ্টি ডেকে নামাতো। উঠোনে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভেজা তার নেশা ছিল। এখন মেঘ দেখলেই কুসুমের মনটা ভারী হয়ে আসে, যেন সব মেঘই ঝড়, শীলা বৃষ্টি নিয়ে আসে। আজ সন্ধ্যারাত থেকে সত্যিই মুষল ধারে বৃষ্টি নেমেছে। মধ্যরাত থেকে কুসুম তার পেটে ব্যথা টের পায়। শেষ রাতে প্রচন্ড ব্যথা শুরু হয়। কুসুম রমিজকে ডাকে, রমিজ সাড়া দেয়না। বারবার ডেকে ডেকে ক্লান্ত কুসুম বুঝতে পারে রমিজ উঠবেনা। কুসুমকে চরম শাস্তি দেয়ার জন্যে রমিজ বুঝি এই রাতেরই অপেক্ষায় ছিল। বাচ্চাকে বাঁচাতে হবে। কুসুম সিদ্ধান্ত নেয়, যে কোন উপায়েই হউক পাশের টিলায় পৌছুতে হবে। শেষ রাতের আবছা অন্ধকারে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে কুসুম রাস্থায় বেড়িয়ে আসে। নিকটতম টিলার ঘরের উঠোনে আসার পর কুসুম টের পায়, আর দাঁড়িয়ে থাকা পেটের সন্তানের জন্যে নিরাপদ নয়। ‘ও মা’গো’ বলে বিকট একটা চিৎকার দিয়ে কুসুম মাটিতে শুইয়ে পড়ে। তারপর কাঞ্চনের মায়ের অন্ধকার ঘরের কোণে সে কিভাবে এলো তার আর মনে নেই। প্রভাতের সূর্য্ এসে রাতকে বিদায় জানাতে আরো কিছুটা সময় লেগেছিল। এরপর কুসুম যখন পুরোপুরি চোখ মেলে তাকালো, তার সপ্নের শিশুটি তখন তার বুকের উপর। কুসুম হাসে, সেই হাসিতে ছিল জগতের সকল সুখ, সকল তৃপ্তি। কুসুম অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার সপ্নের শিশুটির দিকে।

সমাপ্ত।