প্যালের ঘড়ি

এই সুন্দর ফুল, সুন্দর ফল কিংবা মিঠা নদীর পানিতে নাম জানা হরেক রকমের মাছ- সবকিছু কী নিখুঁত চমৎকারিত্বপূর্ণ। এতো সুন্দর, এতো জটিল প্রাণীজগতের দিকে তাকালে বোঝা যায় এগুলো এমনি এমনি আসেনি- এদের এভাবেই তৈরী করা হয়েছে। ঈশ্বরের অস্তিত্বের সপক্ষে সন্দেহাতিতভাবে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত যুক্তি এটাই। বিভিন্ন ভাষায়, বিভিন্ন ভাবে বর্ণনা করা হলেও যুক্তির মূল কাঠামো একই। সেটা হলোঃ 1

১। কিছু কিছু জিনিস- যেমনঃ জীবনের গঠন বৈচিত্র এতো জটিল (কিংবা এতো নিপুন) যে এটা আকস্মিক দূর্ঘটনার মাধ্যমে এমনটা হয়নি তা বোঝাই যায়।
২। একমাত্র কোনো স্রষ্টার প্রত্যক্ষ কারণেই এমনটা হতে পারে।
৩। সুতরাং ঈশ্বর আছেন।

আরেকটু ভিন্নভাবে বলা যায়ঃ

১। বিশ্বজগৎ বা জীব-বৈচিত্র প্রমান করে, এরকম হবার পেছনে অবশ্যই কোনো কারণ রয়েছে।
২। সুতরাং এই কারণের কারক বা জীব-বৈচিত্র বা বিশ্বসৃষ্টির দিক নির্দেশক হিসেবে অবশ্যই একজন আছেন।
৩। তিনিই ঈশ্বর।

প্রকৃতি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে স্রষ্টার অস্তিত্ব খোঁজার দীর্ঘ ইতিহাসের সূচনা গ্রিকদের দ্বারা (2) হলেও সাধারণের মাঝে এতো জনপ্রিয় করার পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান ধর্মবেত্তা ও দার্শনিক উইলিয়াম প্যালের (১৭৪৩-১৮০৫)। প্যালে জ্যোতির্বিজ্ঞান দিয়েই তার চিন্তাভাবনা শুরু করলেও খুব দ্রুত বুঝে উঠেছিলেন, বুদ্ধিদীপ্ত স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রমানের জন্য জ্যোতির্বিজ্ঞান উপযুক্ত মাধ্যম নয় (3)। তার কাছে উপযুক্ত মাধ্যম মনে হয়েছিল জীব বিজ্ঞানকে। নিজের ভাবনাকে গুছিয়ে সৃষ্টির পরিকল্প যুক্তি বা’ডিজাইন আর্গুমেন্ট নিয়ে তিনি ১৮০২ সালে প্রকাশ করেন “Natural Theology, or Evidence of Existence and Attributes of the Deity, collected from the Appearances of Nature”(4)। ধর্ম ও দর্শনের এই বিখ্যাত বইয়ে প্যালে রাস্তার ধারে একটি ঘড়ি এবং পাথর পরে থাকার উদাহরণ দেন। তিনি বলেন, এই ব্যাপারে সবাই একমত হবে যে, পাথরটি প্রকৃতির অংশ হলেও ঘড়িটি একটি নির্দিষ্ট কাজ (সময় গণনা) সম্পাদন করার জন্য কারও দ্বারা তৈরী করা হয়েছে।

পূর্ববর্তী অন্যান্য প্রাকৃতিক ধর্মাবেত্তার মতো প্যালেও জীবজগতকে পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে জীবের অভিযোজনের ক্ষমতা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। প্যালে লক্ষ্য করেছিলেন যে, প্রতিটি জীবদেহে নির্দিষ্ট কাজ করবার জন্য নির্দিষ্ট অংগ-প্রত্যঙ্গ রয়েছে, যা জীবটিকে একটি নির্দিষ্ট পরিবেশে টিকে থাকতে সহায়তা করে। তিনি জটিল জীবদেহকে কিংবা চোখের মত প্রত্যঙ্গকে ঘড়ির কাঠামোর সাথে তুলনা করার মাধ্যমে দেখাতে চেয়েছিলেন স্রষ্টার সুমহান পরিকল্পনা, উদ্দেশ্য আর নিপুণ তুলির আঁচড়।

এই যুক্তির নাম সৃষ্টির পরিকল্প যুক্তি বা ‘ডিজাইন আর্গুমেন্ট’। দুইশ বছর পেরিয়ে গেলেও এই যুক্তি আজও সকল ধর্মানুরাগীরা নিজ নিজ ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমানে ব্যবহার করে আসছেন। কয়েক সপ্তাহ আগেই ঈশ্বর আছে কী নেই এই আলোচনায় আমার এক বন্ধু আর সহ্য করতে না পেরে উঠে দাঁড়িয়ে সবাইকে একমিনিটের জন্য তার কথা শুনতে অনুরোধ করলো। এক যুক্তিতেই সকল সন্দেহকে কবর খুড়ে দেবার অভিপ্রায়ে সে শুরু করলো- ধর যে, তুই রাস্তা দিয়ে হাঁটছিস, হঠাৎ দেখলি তোর সামনে একটি পাথর আর ঘড়ি পড়ে আছে …। প্যালের ঘড়ির মৃত্যু নাই।

জীবজগতের জটিলতা নিয়ে অতিচিন্তিত সৃষ্টিবাদীরা জটিলতার ব্যাখ্যা হিসেবে আমদানী করেছেন ঈশ্বরকে। ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন- সুতরাং সবকিছু ব্যাখ্যা হয়ে গেছে বলে হাত ঝেড়ে ফেললেও তাদের তত্ত্ব তৈরী করে যায় আরও মহান এক জটিলতা। তর্কের স্বার্থে যদি ধরেও নেই, সবকিছু আসলেই খুব জটিল এবং এই জটিলতা একজন সৃষ্টি করেছেন তাহলে তো সেই সৃষ্টিকর্তাকে আরও হাজারগুণ জটিল হতে হবে। তিনি কীভাবে সৃষ্টি হলেন?

প্যালের ঘড়ি ছাড়াও লেগো সেটের মাধ্যমে একই যুক্তি উপস্থাপন করা হয়। ধরা যাক, লেগো সেট দিয়ে তৈরী করা হল একটি গ্রীন লাইন স্ক্যানিয়া মডেলের বাস। একজন দেখেই বুঝবে, বুদ্ধিমান মানুষ লেগো সেটের মাধ্যমে বাসটি তৈরী করেছে। এখন কেউ যদি বাসের লেগোগুলো আলাদা করে একটি বস্তায় ভরে ঝাঁকাতে থাকে তাহলে কী আদৌ কোনোদিন বস্তা থেকে আরেকটি বাস বের হয়ে আসবে? আসবেনা।

উপরোক্ত উদাহরণে সৃষ্টিবাদীরা বাস তৈরীর দুটি প্রক্রিয়ার “ধারণা” দেন আমাদের, একটি বুদ্ধিমান কোনো স্বত্তার হস্তক্ষেপে দ্বারা (যার তৈরী হওয়া নিয়ে সৃষ্টিবাদীরা চিন্তিত নন, যতটা চিন্তিত বাস নিয়ে), আরেকটি বস্তায় ভরে ঝাঁকি দেওয়া। কিন্তু বস্তায় ভরে ঝাঁকি দেবার ধারণার বদলে আমাদের হাতে প্রাণীর জগতের জটিলতা ব্যাখ্যা করার জন্য স্বয়ংসম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব রয়েছে, শত সহস্র পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে যেই তত্ত্বের সত্যতা নিশ্চিত করা হয়েছে, যেটি সকল প্রাকৃতিক নিয়মের সাথে খাপ খায়। এই তত্ত্বের নাম ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব।

বিবর্তন তত্ত্ব

১৮২৭ সালে চার্লস ডারউইন (মৃত্যুঃ ১৮৮২) যখন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালে প্রবেশ করেন ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে পড়াশোনা করার জন্য তখন তাকে রবাদ্দ করার হয় ৭০ বছর আগে প্যালে যে কক্ষে থাকতেন সেই কক্ষটিই (5) । ধর্মতত্ত্বের সিলেবাসে ততদিনে অর্ন্তভুক্ত হয়ে যাওয়া প্যালির কাজ ডারউইনকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। তিনি বলেন,

“ইউক্লিডের রচনা আমাকে যেরকম মুগ্ধ করেছিল ঠিক সেরকম মুগ্ধ করেছিল প্যালের বই”(6)

পরবর্তীতে এই ডারউইনই প্যালের প্রশ্নের বৈজ্ঞানিক জবাব দানের মাধ্যমে এই যুক্তিকে সমাধিস্থ করেন।

প্রাণীজগতে বিবর্তন হচ্ছে এই ব্যাপারটি প্রথম ডারউইন উপলব্ধি করেন নি। তৎকালীন অনেকের মধ্যেই ধারণাটি ছিল, তার মধ্যে ডারউইনের দাদা ইরাজমাস ডারউইন অন্যতম (7)। এপাশ ওপাশে ধারণা থাকলে বিবর্তন কেন ঘটছে এই প্রশ্নে এসেই আটকে গিয়েছিলেন তাদের সবাই। ১৮৫৯ সালে ডারউইন তার বই “দ্য অরিজিন অফ স্পেসিজ” প্রকাশ করেন (8)। ৪৯০ পাতার এই বইয়ে ডারউইন উপযুক্ত প্রমান দিয়ে ব্যাখ্যা করেন বিবর্তন কী, বিবর্তন কেন হয়, প্রাণীজগতে বিবর্তনের ভূমিকা কী। এই লেখায় বিবর্তন নিয়ে দীর্ঘ আলোচনার উদ্দেশ্য আমার নেই। কিন্তু সৃষ্টিবাদী বা ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন প্রবক্তাদের ভুল-ত্রুটি ব্যাখ্যা ও তাদের বক্তব্যের অসারতা সর্বোপরি প্রাণীর প্রাণী হবার পেছনে ঈশ্বরের হাতের অনস্তিত্ব প্রমানের আগে পাঠকদের বিবর্তন তত্ত্বের সাথে সংক্ষিপ্ত প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি।

প্রথমেই দেখে নেয়া যাক বিবর্তন কাকে বলে এবং এটি কিভাবে ঘটে।

বিবর্তন: বিবর্তন মানে পরিবর্তন। সময়ের সাথে সাথে জীবকূলের মাঝে পরিবর্তন আসে। প্রকৃতির বর্তমান অবস্থা , জীবাশ্মের রেকর্ড , জেনেটিক্স, আনবিক জীববিজ্ঞানের মত বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার গবেষণা থেকে এটি স্পষ্ট বোঝা গেছে। গাছ থেকে আপেল পড়ার মতোই বিবর্তন বাস্তব- এ নিয়ে আর কোনও সন্দেহ নেই।

বৈচিত্র্যময় বংশধর সৃষ্টি: সাধারণ একটি পূর্বপুরুষ থেকে অসংখ্য শাখা-প্রশাখা বিস্তারের মাধ্যমে বিবর্তন ঘটে। প্রতিটি শাখা-প্রশাখার জীব তার পূর্বপুরুষ থেকে খানিকটা ভিন্ন হয়। মনে রাখা উচিত বংশধরেরা কখনও হুবহু তাদের পিতামাতার অনুরূপ হয় না, প্রত্যেকের মাঝেই খানিকটা বৈচিত্র্য তথা ভ্যারিয়েশন বা প্রকরণ তৈরি হয়। আর এই বৈচিত্র্যের কারণেই সদা পরিবর্তনশীল পরিবেশে অভিযোজন নামক প্রক্রিয়াটি কাজ করতে পারে। অসংখ্য বৈচিত্র্যের মধ্যে পরিবেশে সবচেয়ে উপযোগীরাই টিকে থাকে।

ধীর পরিবর্তন: পরিবর্তন সাধারণত খুব ধীর একটি পক্রিয়া। দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে বিবর্তনের মাধ্যমেই নতুন প্রজাতির জন্ম হতে পারে।

প্রজাতির ক্রমবর্ধন (multiplication of speciation): এক প্রজাতি থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে অনেক নতুন প্রজাতির উদ্ভব ঘটতে পারে। সে কারণেই আজকে আমরা প্রকৃতিতে এত কোটি কোটি প্রজাতির জীব দেখতে পাই। আবার অন্যদিকে যারা সদা পরিবর্তনশীল পারিপার্শ্বিকতার সাথে টিকে থাকতে অক্ষম তারা বিলুপ্ত হয়ে যায়। প্রকৃতিতে প্রায় ৯০-৯৫% জীবই বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

প্রাকৃতিক নির্বাচন: চার্লস ডারউইন এবং আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস স্বাধীনভাবে বিবর্তনের যে প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেছিলেন তা এভাবে কাজ করে:

ক) জনসংখ্যা সদা সর্বদা জ্যামিতিক অনুপাতে কেবল বাড়তেই চায়।
খ) কিন্তু একটি প্রাকৃতিক পরিবেশে জনসংখ্যা সমসময় একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থাকতে হয়।
গ) সুতরাং পরিবেশে একটি “অস্তিত্বের সংগ্রাম” থাকতেই হবে। কারণ উৎপাদিত সকল জীবের পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়।
ঘ) প্রতিটি প্রজাতিতেই বৈচিত্র্য তথা ভ্যারিয়েশন আছে।
ঙ) অস্তিত্বের নিরন্তর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে চলার সময় যে প্রজাতির গুলোর মাঝে পরিবেশে টিকে থাকার জন্য অধিক উপযোগী বৈশিষ্ট্য আছে তারাই সর্বোচ্চ সংখ্যাক বংশধর রেখে যেতে পারে। আর যাদের মাঝে পরিবেশ উপযোগী বৈশিষ্ট্য কম তাদের বংশধরও কম হয়, আবার এক সময় তারা বিলুপ্তও হয়ে যেতে পারে। বিবর্তনের প্রেক্ষাপটে এই প্রক্রিয়াটিকেই বলা হয় “প্রভেদক প্রজননগত সাফল্য” (৯)।

শেষ পয়েন্টটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রাকৃতিক নির্বাচন এবং এর মাধ্যমে ঘটা বিবর্তনীয় পরিবর্তন একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে ঘটে। সেই নির্দিষ্ট পরিবেশে কে সবচেয়ে বেশি বংশধর রেখে যাতে পারে তথা কে সবচেয়ে সফলভাবে নিজের জিনকে পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত করতে পারে, তার উপরই বিবর্তনের পক্রিয়া নির্ভর করে।বিবর্তনের কোনও নির্দিষ্ট লক্ষ্য নেই, প্রজাতির প্রগতি কোনদিকে হবে, বা এর মাধ্যমে আদৌ কোন কৌশলগত লক্ষ্য অর্জিত হবে কিনা এ সম্পর্কে প্রাকৃতিক নির্বাচনের কিছুই বলার নেই। এমনকি বিবর্তনের মাধ্যমে মানুষ সৃষ্টি হতেই হবে বা বুদ্ধিমত্তা নামক কোনকিছুর বিবর্তন ঘটতেই হবে এমন কোন কথাও সে বলে না। বিবর্তনের কোন সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে উঠে না, বা কোন পিরামিডের চূড়ায় উঠতে চায় না। এমন ভাবার কোনো কারণ নেই যে, মানুষ তৈরির জন্য এতকাল ধরে প্রাকৃতিক নির্বাচন কাজ করেছে। বরং বিবর্তনের মাধ্যমে সৃষ্ট অসংখ্য লক্ষ্যহীন শাখা-প্রশাখারই একটিতে মানুষের অবস্থান। তাই নিজেদের সৃষ্টির সেরা জীব বলে যে পৌরাণিক ধারণা আমাদের ছিল সেটারও কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। কারণ সেরা বলে কিছু নেই, সর্বোচ্চ বলা যেতে পারে, মানুষ সবচেয়ে উন্নত মস্তিষ্কের অধিকারী, যেটা হয়তো টিকে থাকার জন্য আমাদের বাড়তি সুবিধা দিচ্ছে। আর মানুষের এতো উন্নতির পেছনেও মূল কারণ কিন্তু প্রভেদক প্রজননগত সাফল্য। আমরা অনেক বংশধরের জন্ম দিতে পারি এবং এমনকি তারা পূর্ণবয়স্ক হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তাদের ভরণ পোষণও করতে পারি। এই বৈশিষ্ট্য কিন্তু উল্টো জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আবার আমাদের বিলুপ্তও করে দিতে পারে।

বিবর্তন শুধুই একটি তত্ত্ব নয়

বিবর্তনকে উদ্দেশ্য করে সৃষ্টিবাদীদের করা সবচেয়ে প্রচারিত সন্দেহ, বিবর্তন শুধুই একটি তত্ত্ব, এর কোনও বাস্তবতা নেই। সত্যিই কি তাই? বিজ্ঞানীরা বাস্তবে ঘটেনা, এমন কোনও কিছু নিয়ে কখনও তত্ত্ব প্রদান করেন না। বাস্তবতা কাকে বলে? কোন পর্যবেক্ষণ যখন বারংবার বিভিন্নভাবে প্রমানিত হয় তখন তাকে আমরা বাস্তবতা বা সত্য (fact) বলে ধরে নেই।
প্রাণের বিবর্তন ঘটছে। প্রতিটি প্রজাতি স্বতন্ত্রভাবে সৃষ্টি করা হয়নি, বরঞ্চ প্রাণের উদ্ভবের পর থেকে প্রতি নিয়ত পরিবেশের বিভিন্ন প্রভাবের কারণে এক প্রজাতি বিবর্তিত হয়ে অন্য প্রজাতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। এইপরা রাতে ঘুমালো, সকালে উঠে দেখলো তারা সবাই হোমোসেপিয়েন্স এ রুপান্তরিত হয়ে গেছে- এমন না, এটি লক্ষ বছরে পরিবেশে টিকে থাকার জন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিবর্তনের ফসল। প্রজাতি এক রূপ থেকে আরেক রূপে বিবর্তিত হতে পারেনা, এটা এই যুগে এসে মনে করাটা পাপ, যখন দেখা যায়, চৈনিকরা যোগাযোগ খরচ বাচানোর জন্য গোল, গোল তরমুজকে চারকোণা করে ফেলেছে। কবুতর, কুকুরের ব্রিডিং সম্পর্কেও আমরা সবাই অবগত। মাত্র কয়েক প্রজন্মেই এক প্রজাতির কুকুর থেকে আরেক প্রজাতির উদ্ভব হয়, সেখানে পরিবেশ পেয়েছে লক্ষ- কোটি বছর। হোয়াই ইভুলিউশন ইজ ট্রু বইটিতে লেখক জেরি কোয়েন বলেন,
প্রতিদিন, কয়েকশত পর্যবেক্ষণ এবং পরীক্ষা বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশিত হয় … এবং এদের প্রতিটি বিবর্তনের সত্যতা নিশ্চিত করে। খুঁজে পাওয়া প্রতিটি জীবাশ্ম, সিকোয়েন্সকৃত প্রতিটি ডিএনএ প্রমান করে একটি সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে প্রতিটি প্রজাতির সৃষ্টি হয়েছে। প্রাক ক্যাম্বরিয়ান শিলায় আমরা স্তন্যপায়ী কোনও প্রাণীর জীবাশ্ম পাইনি, পাইনি পাললিক শিলার একই স্তরে মানুষ এবং ডাইনোসরের জীবাশ্ম। লক্ষাধিক সম্ভাব্য কারণে বিবর্তন ভুল প্রমানিত হতে পারতো, কিন্তু হয়নি- প্রতিটি পরীক্ষায় সে সাফল্যের সাথে প্রমানিত হয়েছে।

সুতরাং আমাদের পর্যবেক্ষণলব্ধজ্ঞানের মাধ্যমে আমরা জানি বিবর্তন ঘটে এটি একটি বাস্তবতা। এখন পর্যবেক্ষণলব্ধ জ্ঞানকে ব্যাখ্যা করার জন্যই প্রয়োজন হয় বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের। যেমনঃ গাছ থেকে আপেল পড়ে, এটি একটি বাস্তবতা, একে ব্যাখ্যা করা হয় নিউটনের মহার্কষ তত্ত্ব দ্বারা। তত্ত্ব কোনও সাধারণ বাক্য নয়, বাস্তবতার ব্যখ্যা করার জন্য বিজ্ঞানীরা প্রথমে একটি হাইপোথিসিস বা অনুমিত তত্ত্ব দাঁড় করান। পরবর্তীতে এই অনুমিত তত্ত্বকে অন্যান্য বৈজ্ঞানিক সূত্রের মাধ্যমে আঘাত করা হয়। যদি সকল আঘাত থেকে যুক্তিযুক্ত ভাবে একটি অনুমিত তত্ত্ব বেঁচে ফিরতে পারে এবং যখন প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ প্রমান একে সমর্থন করে তখন একে একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব উপাধি দেওয়া হয়। বিবর্তনকে যে তত্ত্ব দ্বারা ব্যাখ্যা করা হয়, তার নাম ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব’।

প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব নিয়ে ডারউইন একদিকে যেমন নিঃসংশয় ছিলেন অপরদিকে ছিলেন দ্বিধাগ্রন্থ। কারণ লক্ষ- কোটি প্রজাতির মধ্যে কোনো নির্দিষ্ট একটি প্রজাতির এই তত্ত্বের বাইরে উদ্ভব হওয়া এই তত্ত্বকে বাতিল করে দিতে যথেষ্ট। দীর্ঘ বিশ বছর বিভিন্ন প্রমাণ সংগ্রহের পর একটি বিশেষ ঘটনার কারণে ডারউইন ১৮৫৮ সালে তত্ত্বটি প্রকাশ করেন (10)। তারপর থেকেই বিবর্তনবাদ বিজ্ঞানীদের ছুরির নীচে। গত দেড়শ বছর ধরে বিভিন্ন ভাবে বিবর্তন তত্ত্বকে পরীক্ষা করা হয়েছে, এটি কখনওই ভুল প্রমানিত হয়নি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, প্রতিটা নতুন ফসিল আবিষ্কার বিবর্তন তত্ত্বের জন্য একটি পরীক্ষা। একটি ফসিলও যদি বিবর্তনের ধারার বাইরে পাওয়া যায় সেই মাত্র তত্ত্বটি ভুল বলে প্রমানিত হবে। একবার বিজ্ঞানী জেবি এস হালডেনকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল কিভাবে বিবর্তনকে ভুল প্রমাণ করা যায়? উত্তরে হালডেন বলেছিলেন,(11)

কেউ যদি প্রক্যাম্বরিয়ান যুগে খরগোশের ফসিল খুঁজে পায়।

বলা বাহুল্য এ ধরনের কোন ফসিলই এ পর্যন্ত আবিস্কৃত হয় নি। না হওয়ারই কথা, কারণ বিজ্ঞানীরা বিবর্তনের যে ধারাটি আমাদের দিয়েছেন তা হল :

মাছ –> উভচর –> সরীসৃপ –> স্তন্যপায়ী প্রানী।

খরগোশ যেহেতু একটি পুরোপুরি স্তন্যপায়ী প্রাণী, সেহেতু সেটি বিবর্তিত হয়েছে অনেক পরে এবং বিভিন্ন ধাপে (মাছ থেকে উভচর, উভচর থেকে সরিসৃপ এবং সরিসৃপ থেকে শেষ পর্যন্ত খরগোশ), তাই এতে সময় লেগেছে বিস্তর। প্রাক ক্যাম্বরিয়ান যুগে খরগোশের ফসিল পাওয়ার কথা নয়, কারণ বিবর্তন তত্ত্ব অনুযায়ী এ সময় (প্রিক্যাম্বরিয়ান যুগে) থাকার কথা কতকগুলো আদিম সরল প্রাণ – যেমন নিলাভ সবুজ শৈবাল, সায়নোব্যকটেরিয়া ইত্যাদি (ফসিল রেকর্ডও তাই বলছে)। আর স্তন্যপায়ী প্রাণীর উদ্ভব ঘটেছে ট্রায়োসিক যুগে (প্রিক্যাম্বরিয়ান যুগ শেষ হওয়ার ৩০ কোটি বছর পরে)। কাজেই কেউ সেই প্রিক্যাম্বরিয়ান যুগে খরগোশের ফসিল খুঁজে পেলে তা সাথে সাথেই বিবর্তনতত্ত্বকে নস্যাৎ করার জন্য যথেষ্ট হত।

তত্ত্বের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য অনুমান করা। যার মাধ্যমে এটিকে ভুল প্রমানের সুযোগ থাকে। আধুনিক পিঁপড়াদের পূর্বপুরুষের ফসিল কোথা থেকে পাওয়া যাবে সেইটা বিবর্তন তত্ত্ব দিয়ে অনুমান করে সত্যতা যাচাই করা হয়েছে। ডারউইন নিজেই বলে গিয়েছিলেন,মানুষের পূর্বপুরুষের জীবাশ্মের সন্ধান মিলবে আফ্রিকায় এবং জীবাশ্মবিজ্ঞানীরা সন্ধান পেয়েছেন এমন অনেক জীবাশ্মের। একটি অনুমানও যদি ভুল হতো তাহলে আমরা নিমেষেই বিবর্তনকে ঝেড়ে ফেলে দিতে পারতাম, কিন্তু হয়নি। তত্ত্বের গুরুত্বপূর্ন সকল অনুমানের তালিকা পাওয়া যাবে এখনে- http://tinyurl.com/4bh3n

তবে এতসব কিছুর মধ্যে আমার প্রিয় একটি উদাহরণ। ডারউইনের তত্ত্ব মতে, প্রাকৃতিক নির্বাচনের কাজ করতে হাজার হাজার কোটি কোটি বছরের প্রয়োজন। কিন্তু বই প্রকাশের সময়ও সকল মানুষ বাইবেলীয় ব্যাখা অনুযায়ী মনে করতো, পৃথিবীর বয়স মোটে ছয় হাজার বছর। ১৮৬৬ সালে বিখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী উইলিয়াম থমসন (পরবর্তী লর্ড কেলভিন উপাধিতে ভূষিত) বিবর্তন তত্ত্বকে চ্যালেঞ্জ করে বসেন। থমসন রাসায়নিক শক্তি এবং মাধ্যাকর্ষণ এই দুইটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই আলাদা আলাদাভাবে সূর্যের বয়স নির্ধারণ করে দেখান, মাধ্যাকর্ষণ বল ব্যবহার করলে সূর্যের বয়স সবচেয়ে বেশী পাওয়া যায় এবং সেটাও কিনা হচ্ছে মাত্র কয়েক’শ লক্ষ বছর। এছাড়াও তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র ব্যবহার করে থমসন এটাও প্রমান করেন যে,মাত্র কয়েক লক্ষ বছর আগেও পৃথিবীর তাপমাত্রা এতই বেশী ছিল যে সেখানে কোনরকম প্রাণের উৎপত্তি ঘটা ছিল একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার। তার সুতরাং বিবর্তন হবার কারণ হিসেবে ডারউইন যে প্রাকৃতিক নির্বাচন এবং এটির যে কোটি বছরের ক্রিয়াকালের কথা বলছেন,তা অবাস্তব।

মজার ব্যাপার হলো,সেই সময় নিউক্লিয়ার শক্তি সম্পর্কে অজ্ঞাত ছিলে পদার্থবিজ্ঞানীরা। বিংশ শতকের প্রথমদিকে শক্তির এই রূপ আবিষ্কার হবার পর বিজ্ঞানী বুঝতে পারলেন,ক্রমাগত নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ায় শক্তি উৎপাদনের মাধ্যমে সূর্য এবং সকল তারা কোটি বছরেরও বেশি সময় একটি সুস্থিত শক্তির উৎস হিসেবে বিদ্যমান থাকে। সুতরাং কেলভিন বুঝতে পারলেন, সূর্য এবং পৃথিবীর বয়স নির্ধারণের জন্য তার করা হিসেবটি ভুল। তিনি আনন্দের সাথে বিবর্তন তত্ত্বের উপর চ্যালেঞ্জ প্রত্যাহার করে নেন। সুতরাং বিবর্তন তত্ত্বকে এমন একটি শক্তির উৎসের অনুমানদাতাও বলা যায়! (12) উল্লেখ্য বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এসে পৃথিবীর নির্ভূল বয়স নির্ধারণ করা হয়, যা প্রায় সাড়ে চারশ’ কোটি বছর।

বিবর্তনের সত্যতাঃ

সত্যতা প্রমান করা যায় সবদিক দিয়েই, তবে এইখানে আমরা মানুষের বিবর্তন নিয়েই আলোচনা করে দেখি বিবর্তন তত্ত্বের দাবীরা কতোটা সঠিক। বিবর্তনের প্রমান হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে ফসিল রেকর্ডকেই ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু আনবিক জীববিদ্যা এবং কোষবংশগতিবিদ্যা উদ্ভাবনের পর এখন আর ফসিল রেকর্ডের কোন দরকার নেই। জীনতত্ত্ব দিয়েই চমৎকারভাবে বলে দেওয়া যায় আমাদের বংশগতিধারা। জীববিজ্ঞানের এই শাখাগুলোর মাধ্যমে, আমাদের পূর্বপুরুষ কারা ছিল, তাদের বৈশিষ্ট্য কেমন ছিল, দেখতে কেমন ছিল তারা সব নির্ণয় করা হয়েছে। দেখা গেছে ফসিল রেকর্ডের সাথে অক্ষরে অক্ষরে মিলে গিয়েছে সেটা।

জীববিজ্ঞানীরা আমাদের পূর্বপুরুষের যেই ধারাটা দিয়েছেন সেটা হলোঃ

মানুষ –> নরবানর –>পুরোন পৃথিবীর বানর –> লেমুর

প্রমান একঃ

রক্তকে জমাট বাঁধতে দিলে একধরণের তরল পদার্থ পৃথক হয়ে আসে, যার নাম সিরাম। এতে থাকে এন্টিজেন। এই সিরাম যখন অন্য প্রাণীর শরীরে প্রবেশ করানো হয় তখন উৎপন্ন হয় এন্টিবডি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মানুষের সিরাম যদি আমরা খরগোশের শরীরে প্রবেশ করাই তাহলে উৎপন্ন হবে এন্টি হিউমান সিরাম। যাতে থাকবে এন্টিবডি। এই এন্টি হিউমান সিরাম অন্য মানুষের শরীরে প্রবেশ করালে এন্টিজেন এবং এন্টিবডি বিক্রিয়া করে অধঃক্ষেপ বা তলানি উৎপন্ন হবে। যদি একটি এন্টি হিউমান সিরাম আমরা যথাক্রমে নরবানর, পুরোন পৃথিবীর বানর, লেমুর প্রভৃতির সিরামের সাথে মেশাই তাহলেও অধঃক্ষেপ তৈরী হবে। মানুষের সাথে যে প্রানীগুলোর সম্পর্কের নৈকট্য সবচেয়ে বেশি বিদ্যমান সেই প্রানীগুলোর ক্ষেত্রে তলানির পরিমান বেশি হবে, যত দূরের তত তলানীর পরিমান কম হবে। তলানীর পরিমান হিসেব করে আমরা দেখি, মানুষের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি তলানী পাওয়া যাচ্ছে, নরবানরের ক্ষেত্রে আরেকটু কম, পুরানো পৃথিবীর বানরের ক্ষেত্রে আরেকটু। অর্থাৎ অনুক্রমটা হয়-

মানুষ- নরবানর- পুরোন পৃথিবীর বানর- লেমুর।

অঙ্গসংস্থানবিদদের মতে উল্লিখিত প্রাণীদের মধ্যে সর্বাধিক আদিম হচ্ছে লেমুর, আর সবচেয়ে নতুন প্রজাতি হচ্ছে মানুষ। তাই মানুষের ক্ষেত্রে তলানির পরিমাণ পাওয়া যায় সবচেয়ে বেশি আর লেমুরের ক্ষেত্রে সবচেয়ে কম। দেখা যাচ্ছে বিবর্তন যে অনুক্রমে ঘটেছে বলে ধারণা করা হয়েছে রক্তরস বিজ্ঞানের ‘অ্যান্টিজেন এন্টিবডি’ বিক্রিয়াও সে ধারাবাহিকতাকেই সমর্থন করে।

প্রমান দুইঃ

চোখ মেলে তাকিয়ে দেখুনঃ

১। প্রকৃতিতে মাঝে মাঝেই লেজ বিশিষ্ট মানব শিশু জন্ম নিতে দেখা যায়। এছাড়াও পেছনে পা বিশিষ্ট তিমি মাছ, ঘোড়ার পায়ে অতিরিক্ত আঙ্গুল কিংবা পেছনের ফিন যুক্ত ডলফিন সহ শরীরে অসংগতি নিয়ে প্রাণীর জন্মের প্রচুর উদাহরণ পাওয়া যায়। এমনটা কেন হয়। এর উত্তর দিতে পারে কেবল বিবর্তন তত্ত্বই। বিবর্তনের কোন এক ধাপে অংগ লুপ্ত হয়ে গেলেও জনপুঞ্জের জীনে ফেনোটাইপ বৈশিষ্ট্য হিসেবে ডিএনএ সেই তথ্য রেখে দেয়। যার ফলে বিরল কিছু ক্ষেত্রে তার পূনঃপ্রকাশ ঘটে।

২। বিবর্তন তত্ত্ব অনুযায়ী পুর্ব বিকশিত অংগ-প্রত্যঙ্গ থেকেই নতুন অঙ্গের কাঠামো তৈরির হয়। বিভিন্ন মেরুদন্ডী প্রাণীর সামনের হাত বা অগ্রপদের মধ্যে তাই লক্ষ্যনীয় মিল দেখা যায়! ব্যাঙ, কুমীর, পাখি, বাদুর, ঘোড়া, গরু, তিমি মাছ এবং মানুষের অগ্রপদের গঠন প্রায় একই রকম।

৩। পৃথিবীতে অগুনিত প্রজাতি থাকলেও সবচে মজার ব্যাপার হলো, ভেতরে আমরা সবাই প্রায় একই। আমরা সবাই “কমন জিন” শেয়ার করে থাকি। পূর্বপুরুষের সাথে যত বেশি নৈকট্য বিদ্যমান, শেয়ারের পরিমানও তত বেশি। যেমন, শিল্পাঞ্জি আর আধুনিক মানুষের ডিএনএ শতকরা ৯৬% একই, কুকুর আর মানুষের ক্ষেত্রে সেটা ৭৫% আর ড্যাফোডিল ফুলের সাথে ৩৩%।

৪। চারপাশ দেখা হলো। এবার আসুন একবার নিজেদের দিকে তাকাই।

ক) ত্রয়োদশ হাড়ঃ বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে ভর্তি হবার সুযোগ পেলো আমার এক বন্ধু। বাক্স পেটরা বন্দী করে সে চলে গেল ট্রেনিং এ চট্রগ্রামের ভাটিয়ারিতে। ছয় সপ্তাহ ডলা খাবার পর মিলিটারি একাডেমির নিয়ম অনুযায়ী একটি ফাইনাল মেডিক্যাল পরীক্ষা হয়। সেই পরীক্ষায় আমার বন্ধুর দেহ পরীক্ষা করে দেখা গেলো, তার পাঁজরে এক সেট হাড় বেশি। আধুনিক মানুষের যেখানে বারো সেট হাড় থাকার কথা আমার বন্ধুর আছে তেরোটি। ফলস্বরূপ তাকে মিলিটারি একাডেমির প্রশিক্ষণ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হলো।
পরিসংখ্যান থেকে পাওয়া যায়, পৃথিবীর আটভাগ মানুষের শরীরে এই ত্রয়োদশ হাড়ের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। যেটি কিনা গরিলা ও শিল্পাঞ্জির শারিরিক বৈশিষ্ট্য। মানুষ যে, এক সময় প্রাইমেট থেকে বিবর্তিত হয়েছে এই আলামতের মাধ্যমে সেটিই বোঝা যায়।

খ) লেজের হাড়ঃ মানুষের আদি পূর্বপুরুষ প্রাইমেটরা গাছে ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য লেজ ব্যবহার করতো। গাছ থেকে নীচে নেমে আসার পর এই লেজের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে। কিন্তু আমাদের শরীরে মেরুদন্ডের একদম নীচে সেই লেজের হাড়ের অস্তিত্ব পাওয়া যায়।

গ) আক্কেল দাঁতঃ পাথুরে অস্ত্রপাতি আর আগুনের ব্যবহার জানার আগে মানুষ মূলতঃ নিরামিশাষী ছিলো। তখন তাদের আক্কেল দাঁতের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও আমাদের তা নেই, যদিও আক্কেল দাঁতের অস্তিত্ব এখনও রয়ে গেছে।

ঘ) অ্যাপেন্ডিক্সঃ আমাদের পূর্বপুরুষ প্রাইমেটরা ছিল তৃনভোজি। তৃণজাতীয় খাবারে সেলুলোজ থাকে। এই সেলুলোজ হজম করার জন্য তাদের দেহে এপেনডিক্সে বেশ বড় ছিল। ফলে সিকামে প্রচুর পরিমান ব্যাকটেরিয়ার থাকতে পারতো যাদের মূল কাজ ছিল সেলুলোজ হজমে সহায়তা করা। সময়ের সাথে আমাদের পূর্বপুরুষদের তৃনজাতীয় খাবারের উপর নির্ভরশীলতা কমতে থাকে, তারা মাংসাশী হতে শুরু হলে। আর মাংসাশী প্রাণীদের অ্যাপেন্ডিক্সের কোন প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন বৃহৎ পাকস্থলীর। ফলে অপেক্ষাকৃত ছোট অ্যাপেন্ডিক্স এবং বড় পাকস্থলীর প্রাণীরা সংগ্রামে টিকে থাকার সামর্থ লাভ করে, হারিয়ে যেতে থাকে বাকিরা। পূর্বপুরুষের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে সেই অ্যাপেন্ডিক্স আমরা এখনও বহন করে চলছি।

ঙ) গায়ের লোম: মানুষকে অনেক সময় ‘নগ্ন বাঁদর’ বা ‘নেকেড এপ’ নামে সম্বোধন করা হয়। আমাদের অনেক বন্ধুবান্ধবদের মধ্যেই লোমশ শরীরের অস্তিত্ব দেখা যায় এখনো। আমরা লোমশ প্রাইমেটদের থেকে বিবর্তিত হয়েছি বলেই এই আলামত এখনো রয়ে গেছে।

প্যালের চোখ

বিবর্তনতত্ত্বের সমালোচনাকারীরা সবচেয়ে বেশি আঙুল তুলেছেন মানুষের চোখের দিকে। চোখের মতো এমন নিখুঁত এবং জটিল একটি যন্ত্র কিভাবে দৈব পরিবর্তন (র্যা ন্ডম মিউটেশন), প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যেমে সৃষ্টি হতে পারে? হোকনা শত সহস্র বছর।

একটি ক্যামেরার মতো চোখেরও আলোকরশ্মি কেন্দ্রীভূত করার জন্য লেন্স, আলোকরশ্মির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আইরিস, আর এই আলোকরশ্মি থেকে ছবি আবিষ্কার করার জন্য একটি ফোটোরিসেপ্টর প্রয়োজন। এই তিনটি যন্ত্রাংশ একসাথে কাজ করলেই কেবলমাত্র চোখ দিয়ে কিছু দেখা সম্ভব হবে। যেহেতু বিবর্তন তত্ত্বমতে, বিবর্তন প্রক্রিয়া চলে স্তরে স্তরে- তাহলে লেন্স, রেটিনা, চোখের মণি সবকয়টি একসাথে একই ধরনের উৎকর্ষ সাধন করলো কীভাবে? বিবর্তন সমালোচনাকারীদের প্রশ্ন এটাই।

ক্যাম্বরিয়ান যুগে শরীরের উপর আলোক সংবেদনশীল ছোট একটি স্থানবিশিষ্ট প্রাণীরা আলোর দিক পরিমাপের মাধ্যমে ঘাতক প্রাণীদের হাত থেকে বেঁচে যাবার অতি সামান্য সুযোগ পেত। সময়ের সাথে সাথে এই রঙিন সমতল স্থানটি ভেতরের দিকে ডেবে গিয়েছে, ফলে তাদের দেখার ক্ষমতা সামান্য বেড়েছে। গভীরতা বাড়ার পাশাপাশি পরবর্তীতে আলো ঢোকার স্থান সরু হয়েছে। অর্থাৎ দেখার ক্ষমতা আরও পরিষ্কার হয়েছে। প্রতিটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরিবর্তন প্রানীকে সামান্য হলেও টিকে থাকার সুবিধা দিয়েছে।
সুইডেনের লুন্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড্যান এরিক নিলসন গবেষণার মাধ্যমে বের করে দেখান যে, কীভাবে কোনও প্রাণীর শরীরের উপর আলোক সংবেদনশীল ছোট এবং রঙিন স্থান পরবর্তীতে মানুষের চোখের মতো জটিল যন্ত্রে পরিবর্তিত হতে পারে।

উপরের ছবি দুটি লক্ষ্য করুন। একটি অন্ধকার রুম। পেছনে একটি বাতি জ্বলছে। সবচেয়ে বামে একটি সমতল কাগজ লাগানো। যার মাধ্যমে আমরা শুধু বুঝতে পারছি আলো আছে। কিন্তু কোথা থেকে আলো বের হচ্ছে কিংবা বাতিটি কোথায় তেমন কিছুই জানা যাচ্ছে না। তারপরের পিংপং বলটিতে আলো প্রবেশের স্থানটি চওড়া আর গভীরতা কম। তারপরেরটায় স্থানটি আগেরটার চেয়ে সংকুচিত এবং গভীরতা বেশি। সর্ব ডানেরটায় আলো প্রবেশের স্থান সবচেয়ে সংকুচিত এবং গভীরতা সবচেয়ে বেশি। আর এটি দিয়েই আমরা সবচেয়ে ভালোভাবে আলোটির উৎস বুঝতে পারছি।

এখন প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব অনুযায়ী, প্রতিটি পরিবর্তনই প্রাণীকে কিঞ্চিৎ হলেও আক্রমণকারীর হাত থেকে বাঁচার সুবিধা প্রদান করেছে। যারা সামান্য দেখতে পাচ্ছে তাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেড়েছে, বেড়েছে তাদের সন্তান বংশবৃদ্ধির সম্ভাবনা। অপরদিকে অর্থবরা হারিয়ে গেছে। ধীরে ধীরে বংশানুক্রমে উন্নতি হয়েছে দৃষ্টিশক্তির। সময়ের সাথে সাথে শুরুর এই আলোক সংবেদনশীল স্থান রেটিনায় পরিণত হয়েছে, সামনে একটি লেন্সের সৃষ্টি হয়েছে।

ধারনা করা হয়, প্রাকৃতিক ভাবে লেন্সের সৃষ্টি হয়েছে যখন চোখকে পূর্ণকরে রাখা স্বচ্ছ তরলের সময়ের সাথে সাথে ঘনত্ব বেড়েছে। ছবিতে দেখুন সাদা অংশটি তৈরি হচ্ছে চোখকে পূর্ণ করে রাখা স্বচ্ছ তরলের মাধ্যমে। তরলের ঘনত্ব যত বেড়েছে লেন্সের গঠন ততো ভালো হয়েছে, দৃষ্টিশক্তি প্রখর হয়েছে।

স্বচ্ছ তরলে পরিপূর্ণ।

স্বচ্ছ তরলে পরিপূর্ণ।

তরল ঘন হচ্ছে

তরল ঘন হচ্ছে

ঘন হতে হতে লেন্সের সৃষ্টি

ঘন হতে হতে লেন্সের সৃষ্টি

বলে রাখা প্রয়োজন বিজ্ঞানীদের তৈরি করা চোখের বিবর্তনের প্রতিটি স্তর বর্তমানে জীবিত প্রাণীদের মধ্যেই লক্ষ করা যায়। এছাড়াও শুধুমাত্র আলোক সংবেদনশীল স্থান বিশিষ্ট প্রাণী ছিল আজ থেকে ৫৫ কোটি বছর আগে। বিজ্ঞানীরা গণনা করে বের করেছেন, এই আলোক সংবেদনশীল স্থানটি মানুষের চোখের মতো হবার জন্য সময় প্রয়োজন মাত্র ৩৬৪ হাজার বছর।

ডিজাইন না ব্যাড ডিজাইনঃ

মানুষের চোখের অক্ষিপটের ভেতরে একধরনের আলোগ্রাহী কোষ আছে যারা বাইরের আলো গ্রহণ করে এবং তারপর একগুচ্ছ অপটিক নার্ভের (আলো গ্রাহী জাল) মাধ্যমে তাকে মস্তিষ্কে পৌঁছোনোর ব্যবস্থা করে, ফলে আমরা দেখতে পাই। কিন্তু মজার ব্যপার হলো, অক্ষিপটের ঠিক সামনে এই স্নায়ুগুলো জালের মত ছড়ানো থাকে, সাথে সাথে এই স্নায়ুগুলোকে যে রক্তনালীগুলো রক্ত সরবরাহ করে তারাও আমাদের অক্ষিপটের সামনেই বিস্তৃত থাকে। ফলে আলো বাধা পায় এবং আমাদের দৃষ্টিশক্তি কিছুটা হলেও কমে যায়। স্নায়ুগুলোর এই অসুবিধাজনক অবস্থানের কারণে আমাদের চোখে আরেকটি বড় সমস্যা দেখা দিয়েছে। স্নায়বিক জালটি মস্তিষ্কে পৌঁছোনোর জন্য অক্ষিপটকে ফুটো করে তার ভিতর দিয়ে পথ করে নিয়েছে। এর ফলে সৃষ্টি হয়েছে একটি অন্ধবিন্দুর (blind spot)(13)

কুকুর, বিড়াল কিংবা ঈগলের দৃষ্টিশক্তি যে মানুষের চোখের চেয়ে বেশি তা সবাই জানে। মানুষ তো বলতে গেলে রাতকানা, কিন্তু অনেক প্রাণীই আছে রাতে খুব ভাল দেখতে পায়। আবার অনেক প্রাণীই আছে যাদের চোখে কোনও অন্ধবিন্দু নেই। যেমন, স্কুইড বা অক্টোপাস। এদের মানুষের মতই একধরনের লেন্স এবং অক্ষিপটসহ চোখ থাকলেও অপটিক নার্ভগুলো অক্ষিপটের পেছনে অবস্থান করে এবং তার ফলে তাদের চোখে কোনও অন্ধবিন্দুর সৃষ্টি হয়নি।
মানুষের চোখের এই সীমাবদ্ধতাকে অনেকেই “ব্যাড ডিজাইন” বলে অভিহিত করে থাকেন। অবশ্য যেহেতু চোখ দিয়ে ভালোভাবেই কাজ চালিয়ে নেওয়া যাচ্ছে তাই “ব্যাড ডিজাইন” এর মতো শব্দ প্রয়োগে নারাজ জীববিজ্ঞানী কেনেথ মিলার। তারমতে, চোখের এমন হবার কারণ বিবর্তন তত্ত্ব দিয়ে বেশ ভালো ভাবে বোঝা যায় (14)। বিবর্তন কাজ করে শুধুমাত্র ইতোমধ্যে তৈরি বা বিদ্যমান গঠনকে পরিবর্তন করার মাধ্যমে, সে নতুন করে কিছু সৃষ্টি বা বদল করতে পারে না। মানুষের মত মেরুদণ্ডি প্রাণীর চোখ সৃষ্টি হয়েছে অনেক আগেই সৃষ্টি হওয়া মস্তিষ্কের বাইরের দিকের অংশকে পরিবর্তন করে। বহুকাল ধরে বিবর্তন প্রক্রিয়ায় মস্তিষ্কের বাইরের দিক আলোক সংবেদনশীল হয়েছে, তারপর ধীরে ধীরে অক্ষিপটের আকার ধারণ করেছে। যেহেতু মস্তিষ্কের পুরোনো মূল গঠনটি বদলে যায়নি, তাই জালের মত ছড়িয়ে থাকা স্নায়ুগুলোও তাদের আগের অবস্থানেই রয়ে গেছে। কিন্তু অন্যদিকে স্কুইড জাতীয় প্রাণীর চোখ বিবর্তিত হয়েছে তাদের চামড়ার অংশ থেকে, মস্তিষ্কের অংশ থেকে নয়। এক্ষেত্রে ত্বকের স্নায়ুগুলো মস্তিষ্কের মত ঠিক বাইরের স্তরে না থেকে ভেতরের স্তরে সাজানো থাকে, আর এ কারণেই স্নায়ুগুলো চোখের অক্ষিপটের সামনে নয় বরং পেছনেই রয়ে গেছে। চোখের ক্ষেত্রে তাই গুড ডিজাইন বা ব্যাড ডিজাইন তর্ক অপ্রাসংগিক। এটাকে তো ডিজাইনই করা হয়নি।
বিবর্তনের পথে অনন্ত চল্লিশ রকম ভাবে চোখ তৈরী হতে পারতো (15)। আলোকরশ্মী সনাক্ত এবং কেন্দীভূত করার আটটি ভিন্ন উপায়ের সন্ধান দিয়েছেন নিউরো-বিজ্ঞানীরা (16)। কিন্তু পরিবেশ এবং প্রাকৃতিক নির্বাচনের যুদ্ধে অসংখ্য সমাধান মধ্যে একটি সমাধান টিকে গিয়েছে। সংক্ষেপে, চোখের গঠন যদি বাইরের কারও হস্তক্ষেপ ব্যতিত, শুধুমাত্র বস্তুগত প্রক্রিয়ায় উদ্ভব হতো তাহলে দেখতে যেমন হবার কথা ছিল ঠিক তেমনই হয়েছে। চোখের গঠনে কারও হাঁত নেই, নেই কোনও মহাপরাক্রমশালী নকশাকারকের নিপুনতা।

আগামী পর্বগুলোয় যা থাকবেঃ

বিহের হ্রাস অযোগ্য জটিলতা, অসম্ভব্যতা, মুক্তবাজার অর্থনীতি ও প্রাকৃতিক নির্বাচন, সেলফ অর্গানাইযেশন, আদম- হাওয়া কাহিনী ও নূহের মহাপ্লাবন।

তথ্যসূত্রঃ

১। Irreligion: A Mathematician Explains Why the Arguments for God Just Don’t Add Up – John Allen Paulos। পৃষ্ঠা নং ১০

২। একই বই, পৃষ্ঠা নং ১১

৩। ডারউইন দিবসে রিচার্ড ডকিন্স পরিচিতি- অভিজিৎ রায় https://blog.mukto-mona.com/?p=5042

৪। Natural Theology, or Evidence of Existence and Attributes of the Deity, collected from the Appearances of Nature (London: Halliwell, 1802)

৫। Before Darwin: Reconciling God and Nature (New Haven and London: Yale University Press, 2005), পৃষ্ঠা নং ২০

৬। একই বই, পৃষ্ঠা নং ৬

৭। বিবর্তনের সাক্ষ্যপ্রমাণ- ১ (জেরি কোয়েন –এর ‘বিবর্তন কেন বাস্তব’ অবলম্বনে), ইরতিশাদ। https://blog.mukto-mona.com/?p=5649

৮। The Origin of Species by Means of Natural Selection (London: John Murray, 1859)

৯। Why People Believe in Weird Things, তৃতীয় অধ্যায়, পৃষ্ঠা নং ১৪০

১০। GOD: The Failed Hypothesis, Victor Stenger, পৃষ্ঠা নং ৪৯

১১। এক বিবর্তনবিরোধীর প্রত্যুত্তরে, অভিজিৎ রায়, https://blog.mukto-mona.com/?p=936

১২। GOD: The Failed Hypothesis, Victor Stenger, পৃষ্ঠা নং ৫১

১৩। The Blind Watchmaker: Why the Evidence of Evolution reveals a Universe Without Design, Richard Dawkins (London, New York,: Norton, 1987) পৃষ্ঠা নং ৯৩

১৪। “Life’s Grand Design”, Kenneth R. Miller, পৃষ্ঠা নং ২৪-৩২

১৫। Climbing Mount Improbable, Richard Dawkins, চ্যাপ্টার “The Fortyfold Path to Enlightenment”

১৬। “Evolution of Eyes, Current Opinion in Neurobiology”, R. D. Fernald, পৃষ্ঠা নং ৪৪৪-৫০