ঠিক করেছিলাম দর্শন শাস্ত্রের প্রান্তিক টুকিটাকি বিষয়গুলো নিয়ে একে একে ছোট ছোট কিছু পোস্ট দিব মুক্তমনায় । এর প্রেক্ষিতে এর আগের পোস্টে নিবেদন করা হয়েছে – ‘নাস্তিকতাও একটি ধর্ম হলে’ নামক নিবন্ধটি। প্রবন্ধটিতে দেখানো হয়েছে যে, নাস্তিকতাকে ধর্ম কিংবা বিশ্বাস হিসেবে চালাতে গেলে টিভির অফ বাটনকে আরেকটি চ্যানেল বলতে হবে, কিংবা টাক মাথাকে বলতে হবে চুলের রঙ! না, দর্শনের যুক্তি মানতে গেলে বলতেই হবে, নাস্তিকতা কোন বিশাসের ব্যপার নয়, বরং সংজ্ঞানুযায়ী এটি বিশ্বাসহীনতা কিংবা বলা যায় – বিশ্বাস হতে মুক্তি।

এই পর্বে পাঠকদের জন্য হাজির করা হচ্ছে ‘অক্কামের ক্ষুর’ নামক আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অভিব্যক্তি। আমার মনে আছে – মুক্তমনায় একবার আল মুর্শেদ সাহেব জানতে চেয়েছিলেন অক্কামের ক্ষুর ব্যাপারটা কি, আর কি করে এটি ঈশ্বর নামক ধারণাটিকেকে বাহুল্য হিসেবে বাতিল করে দেয়। দু একজন ব্লগার কিছু ছোটখাট প্রতিক্রিয়া জানালেও মূল বিষয়গুলো অনুচ্চই থেকে গিয়েছিলো। আমি আমার বই ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ (২০০৬, পুনঃ মূদ্রণ, অঙ্কুর প্রকাশনী) –এ এ সম্বন্ধে কিছুটা আলোকপাত করেছিলাম। মুক্তমনার পাঠকদের জন্য কিছুটা পরিবর্তিত এবং পরিবর্ধিত আকারে এখানে প্রকাশ করা হচ্ছে।

:line:

অক্কামের ক্ষুরকে দর্শনশাস্ত্রে অনেক সময় ‘মিতব্যয়িতার নীতি’ (Principle of Parsimony/Economy) কিংবা সরলতার নীতি (Principle of Simplicity) হিসেবে অভিহিত করা হয়।

সংক্ষেপে এর মূল নীতিটি হল :

Pluralitas non est ponenda sine neccesitate (Plurality should not be posited without neccssity).

বাংলা করলে দাঁড়ায়-

‘অনাবশ্যক বাহুল্য সর্বদাই বর্জনীয়’।

এই নীতি প্রয়োগ কিন্তু বিজ্ঞানে, ধর্মে, দর্শনে খুবই ব্যাপক। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ‘অক্কামের ক্ষুরের’ প্রয়োগ হরহামেশাই লক্ষ্য করা যায়। বিজ্ঞানীরা অক্কামের যে মূল নীতিটি অনুসরণ করেন তা হল- ‘যদি দুটি বৈজ্ঞানিক মডেল একই রকম ভবিষ্যদ্বাণী কিংবা ফলাফল প্রদান করে থাকে, তবে অপেক্ষাকৃত সহজ মডেলটি সমাধান হিসেবে গ্রহণ কর।’ একটা উদাহরণ দেয়া যাক। একটা সময় গ্রহদের অনিয়ত-গতিপ্রকৃতি জ্যোর্তিবিদদের কাছে বড় ধরনের তাত্ত্বিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল। কেপলার এই সমস্যা সমাধান করতে আমাদের সামনে হাজির করেছিলেন তিনটি সূত্র –

১) সূর্যকে একটি ফোকাস বিন্দুতে রেখে গ্রহসকল উপবৃত্ত পথে পরিক্রমণ করে
২) একই কাল ব্যবধানে গ্রহের যে কোন অবস্থানে সূর্য থেকে গ্রহ পর্যন্ত সংযোজী সরল রেখা একই পরিমাণ ক্ষেত্রফল রচনা করে থাকে।
৩) গ্রহসকলের সূর্যের চতুর্দিকে আবর্তনকালের বর্গ সূর্য থেকে তাদের মধ্যক দূরত্বের ঘণফলের আনুপাতিক।

আর পরবর্তীতে একই সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে কেপলারের এই তিনটি নিয়মের বদলে নিউটন আমাদের দিলেন একটি মাত্র সূত্র- ‘মহাকর্ষীয় ব্যস্তবর্গীয় নিয়ম’ (Inverse Law of Gravity) – যা দিয়ে গ্রহ উপগ্রহের চলাচলজনিত সমস্যাগুলোর একটা সহজ সমাধান পাওয়া গেল। দেখা গেল, এই একটি নিয়ম থেকেই কেপলারের পূর্বেকার নিয়মগুলো স্বতঃসিদ্ধভাবে বেরিয়ে আসে। কাজেই যখন থেকে নিউটনের মহাকর্ষ সূত্রটিকে ‘বৈজ্ঞানিক মডেল’ হিসেবে গ্রহণ করা হল, কেপলারের সূত্রগুলো ‘অনর্থক বাহুল্য’ হিসেবে পরিত্যক্ত হল সঙ্গত কারণেই। এটিই অক্কামের সূত্রের একটি খুবই সার্থক প্রয়োগ।

অক্কামের ক্ষুরের আরেকটি সার্থক প্রয়োগ দেখা যায় ইথারের ক্ষেত্রে। উনবিংশ শতাব্দীর পদার্থ বিজ্ঞানীরা আলো চলাচলের জন্য মাধ্যম হিসেবে ‘ইথার’ নামক একটি অদৃশ্য, ঘর্ষণহীন, রাসায়নিকভাবে নিষ্ক্রিয় এবং ‘সর্বভূতে বিরাজমান’ এক রহস্যময় পদার্থ কল্পনা করেছিলেন। তাঁদের ধারণা ছিল শব্দ চলাচলের জন্য যেমন মাধ্যমের প্রয়োজন, তেমনি আলো চলাচলের জন্যও একটি মাধ্যম থাকতেই হবে। তারা ধরে নিয়েছিলেন এই পুরো মহাবিশ্বটাই ডুবে রয়েছে ইথার নামক এক অদৃশ্য পদার্থের অথৈ মহাসমুদ্রে। আর এই ইথার নামক মাধ্যমের সাহায্যেই আলো অনেকটা শব্দের মতই তরঙ্গাকারে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু ১৮৮০ সালে মাইকেলসন-মর্লির বিখ্যাত পরীক্ষা আর তারও পরে ১৯০৫ সালে আলবার্ট আইনস্টাইনের ‘আপেক্ষিক তত্ত্ব’ তাত্ত্বিকভাবে ঈথারের অস্তিত্বকে নস্যাৎ করে দিল। গন্ধহীন, স্পর্শহীন রহস্যময় ‘ইথার’ ‘অহেতুক বাহুল্য’ হিসেবে পরিত্যক্ত হল।

অক্কামের ক্ষুরের ব্যাপকতর প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায় দর্শনেই। নাস্তিক্যবাদী দার্শনিকরা, অক্কামের ক্ষুরের প্রয়োগে যুক্তি দেখিয়ে থাকেন, ঈশ্বরের অনুমান নিতান্তই একটি অপ্রয়োজনীয় অনুকল্প। কিভাবে? নিম্নোক্ত দুটি হাইপোথিসিস বা অনুকল্প বিবেচনায় আনা যাক –

১) আমাদের সামনে এক জটিল মহাবিশ্বের অস্তিত্ব রয়েছে, যেটি প্রাকৃতিক নিয়মে (Natural Process) উদ্ভুত হয়েছে। অর্থাৎ,
* মহাবিশ্বের অস্তিত্ব – –> প্রাকৃতিক নিয়ম

২) আমাদের সামনে এক জটিল মহাবিশ্বের অস্তিত্ব রয়েছে, এবং একজন ‘ঈশ্বর’ও রয়েছেন যিনি এই মহাবিশ্ব তৈরি করেছেন। এখানে ‘ঈশ্বর’ স্বভাবতই একটি পৃথক সত্ত্বা হিসেবে দেখা দিচ্ছে। অর্থাৎ,
* মহাবিশ্বের অস্তিত্ব — > নিয়ম + ঈশ্বর

যদি এই দুইটি পথের মধ্যে একটিকে পছন্দ করতে হয়, তবে ‘অক্কামের সূত্র’ এদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত সহজটিকে সমাধান হিসেবে গ্রহণ করতে বলবে- অর্থাৎ প্রথম সমাধানটি এক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবে।

কেউ কেউ অবশ্য তৃতীয় একটি সমাধানকে অপেক্ষাকৃত সহজ হিসেবে বিবেচনা করতে পারেন-

আমাদের সামনে কোন জটিল মহাবিশ্বের অস্তিত্ব নেই- আসলে সবই মায়া আমাদের কল্পনা!

তবে এই তৃতীয় সমাধানটি আমাদের সলিপসিজমের (Solipsism) এর পথে নিয়ে যায় যা অধিকাংশ যুক্তিবাদীদের কাছে অগ্রহণযোগ্য।

জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অক্কামের ক্ষুরের চমৎকার একটি প্রয়োগ আমরা পাই যখন চার্লস ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে ঘটা বিবর্তন তত্ত্ব উইলিয়াম প্যালের ‘ডিজাইন আর্গুমেন্ট’ বা সৃষ্টির পরিকল্পিত যুক্তিকে বাতিল করে দিয়েছিলো। উইলিয়াম প্যালে (১৭৪৩-১৮০৫)’র বিখ্যাত বই ‘Natural Theology, or Evidence of Existence and Attributes of the Deity, collected from the Appearences of Nature’ এ প্রকাশিত হয় ১৮০২ সালে। ধর্মতত্ত্ব ও দর্শনের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে এটি গুরুত্বপূর্ণ একটি বই ছিলো সে সময়। জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়েও প্যালে ভেবেছিলেন বিস্তর, কিন্তু নিজেই শেষ পর্যন্ত বলেছিলেন ‘বুদ্ধিদীপ্ত স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য জ্যোতির্বিজ্ঞান উপযুক্ত মাধ্যম নয়’; এ ক্ষেত্রে প্যালের ‘উপযুক্ত মাধ্যম’ মনে হয়েছিল বরং জীববিজ্ঞানকে। আর পূর্ববর্তী অন্যান্য ন্যাচারাল থিওলিজিয়ানদের মতই প্যালেও জীবজগতকে পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে জীবের অভিযোজনের ক্ষমতা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। প্যালে লক্ষ্য করেছিলেন যে, প্রতিটি জীবদেহে নির্দিষ্ট কাজ করবার জন্য নির্দিষ্ট অংগ-প্রত্যঙ্গ রয়েছে, যা জীবটিকে একটি নির্দিষ্ট কোন পরিবেশে টিকে থাকতে সহায়তা করে। তিনি জটিল জীবদেহকে ঘড়ির কাঠামোর সাথে তুলনীয় মনে করেছিলেন, আর তার মধ্যেই দেখেছিলেন স্রষ্টার সুমহান পরিকল্পনা, উদ্দেশ্য আর নিপুণ তুলির আঁচর। আর চোখকে প্যালে অনেকটা জৈব-টেলিস্কোপ হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন। তাই খুব স্বাভাবিক ভাবেই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে, ঘড়ি কিংবা টেলিস্কোপ তৈরী করার জন্য যেহেতু একজন কারিগর দরকার, চোখ ‘সৃষ্টি করার জন্য’ও প্রয়োজন একজন অনুরূপ কোন কারিগরের। সেই কারিগর যে একজন ‘ব্যক্তি ঈশ্বর’ (Personal God)ই হতে হবে তা প্যালে খুব পরিস্কার করেই বলেছিলেন তার গ্রন্থে।

প্যালের এই ‘ঘড়ির কারিগরের যুক্তি’ দর্শনশাস্ত্রে পরিচিত ‘পরিকল্প যুক্তি’ বা ‘আর্গুমেন্ট অব ডিজাইন’ নামে। এই যুক্তি ঈশ্বর নামক একটি সত্তার অস্তিত্বের পেছনে অত্যন্ত জোরালো যুক্তি হিসেবে বিশ্বাসীরা ব্যবহার করতেন। ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বই প্রথমবারের মত এই ডিজাইন আর্গুমেন্টকে শক্তিশালীভাবে চ্যালেঞ্জ করে ভুল প্রমাণ করে দিয়েছিলো। ডারউইন প্রস্তাব করলেন জীবদেহকে কেবল ঘড়ির মত যন্ত্রের মত কিছু ভেবে বসে থাকলে চলবে না। জীবজগৎ যন্ত্র নয়; কাজেই যন্ত্র হিসেবে চিন্তা করা বাদ দিতে পারলে এর পেছনে আর কোন কোন ডিজাইন বা পরিকল্পনার মত ‘উদ্দেশ্য’ খোঁজার দরকার নেই। জীবজগতে চোখ বা এ ধরোনের জটিল প্রত্যঙ্গের উদ্ভব ও বিবর্তনের পেছনে ডারউইন প্রস্তাব করলেন এক ‘অন্ধ কারিগরের’, নাম প্রাকৃতিক নির্বাচন- যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে লাখ লাখ বছর ধরে ধাপে ধাপে গড়ে ওঠা পরিবর্তনের ফলে চোখের মত অত্যন্ত জটিল অংগ-প্রত্যংগ গড়ে ওঠা সম্ভব। এ প্রক্রিয়াটির নাম ক্রমবর্ধমান নির্বাচন (Cumulative selection)। একাধিক ধাপের এই ক্রমবর্ধমান নির্বাচনের মাধ্যমে যে ধাপে ধাপে যে জটিল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ উদ্ভুত হতে পারে তা ইতোমধ্যেই বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমানিত হয়েছে।

 

শুধু তাই নয়, এ পদ্ধতিতে আংশিকভাবে চোখের উৎপত্তি ও বিকাশ যে সম্ভব এবং তা বিভিন্ন প্রতিকুল পরিবেশে যে একটি জীবের টিকে থাকার সম্ভাবনাকে অনেকাংশে বাড়িয়ে তুলতে পারে তারও অজস্র উদাহরণ রয়েছে আমাদের চারপাশে। বিবর্তন তত্ত্ব ডিজাইন আর্গুমেন্টকে বাতিল করে দেয় বলেই আমরা আজ প্রজাতির ‘উৎপত্তির’ কথা বলি, ‘সৃষ্টি’র নয়। বিবর্তন তত্ত্বই প্রথমবারের মতো আমাদের দেখিয়ে দিলো যে, মানুষ সহ অন্যান্য জীবের উদ্ভবের পেছনে কোন স্বর্গীয় কারণ খোঁজার দরকার নেই; অন্যান্য পশুপাখি, গাছপালা প্রাকৃতিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এ পৃথিবীতে এসেছে,মানুষ নামের দ্বিপদী প্রাণিটিও ঠিক একই বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় এ পৃথিবীতে এসেছে, কোন ধরণের ‘সৃষ্টি’ (কিংবা সৃষ্টিকর্তার হস্তক্ষেপ) ছাড়াই। বিবর্তন তত্ত্ব কিভাবে সৃষ্টির পরিকল্প যুক্তি বা ডিজাইন আর্গুমেন্টকে সরাসরি বাতিল করে দেয়, সেটার তের পর্বের একটা চিত্রকল্প (written by Dylan Evans & Howard Selina) রাখা আছে আমাদের সাইটে (দেখুন এখানে)। এর দার্শনিক অভিব্যক্তি এতোই বিশাল ছিলো যে, অধ্যাপক ডকিন্স বলতে বাধ্য হয়েছিলেন যে, ডেভিড হিউম কিংবা বার্টান্ড রাসেলেরা ঈশ্বরের অস্তিত্বের যুক্তিগুলো বহুভাবে খণ্ডন করলেও ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বই তাকে ‘ intellectually fulfilled atheist’-এ রূপান্তরিত করতে পেরেছে অত্যন্ত সার্থকতার সাথে। দার্শনিক ডেনিয়েল ডেনেট সেজন্যই বিবর্তনতত্ত্বকে রাজাম্ল বা ‘ইউনিভার্সাল এসিড’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

যা হোক, লেখার এই পর্যায়ে এসে অক্কামের ক্ষুরের ইতিহাসটি পাঠকদের সামনে একটু ছোট করে বয়ান করতে চাচ্ছি। ‘অক্কামের ক্ষুর’ নামক এই অদ্ভুতুরে পরিভাষাটি আসলে এসেছে ইংরেজ দার্শনিক উইলিয়াম অকহামের (William Ockham, ১২৮৫ -১৩৪৯) এর নাম থেকে। অকহাম নিজে যদিও এই সূত্রটির উদ্ভাবক ছিলেন না, তবে এই সূত্রটি তিনি প্রায়শই বিভিন্নভাবে ব্যবহার করতেন বলে শোনা যায়। আর সেজন্যই তার নাম এই সূত্রের সাথে ওতপ্রোতভাবে এখন জড়িয়ে রয়েছে। আমি অবশ্য জানি না যে, নাপিতের ‘দাঁড়ি কামানোর ক্ষুরের’ মত ভয়স্কর একটা কিছুর আদলে তার নাম নিয়ে এই উদ্ভট পরিভাষা সৃষ্টির সাথে তিনি একমত হতেন কিনা, তবে তিনি চান বা না চান তার নামটি কিন্তু বিখ্যাত এই সূত্রের সাথে আজ ওতপ্রোতভাবেই জড়িয়ে রয়েছে। ‘অক্কামের ক্ষুর’ মধ্যযুগীয় দর্শনের এক গুরুত্বপূর্ণ নীতি হিসেবে বিবেচিত হয়।

রসিকজনেরা কিন্তু এই সূত্রটি নিয়ে নানা ধরনের রসিকতা করতেও ছাড়েননি। যেমন- কেউ কেউ এই সূত্রটিকে অভিহিত করেন ‘Kiss’ সূত্র (Keep it simple, stupid) হিসেবে। কেউবা এই সূত্রটির নির্যাসকে তুলে ধরেন এভাবে-

‘যখন কোথাও ঘোড়ার ডাক শোন, তখন ঘোড়ার কথাই মাথায় রেখো, জেব্রা বা জিরাফের নয়’।

বিখ্যাত চিত্রকর ও বিজ্ঞানী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি (১৪৫২ – ১৫১৯) ছিলেন অকহামের সমসাময়িক ব্যক্তিত্ব। তিনিও তার মত করে একটি ‘অক্কামের ক্ষুর’ তৈরি করেছিলেন। তাঁর রচিত ‘অক্কামের ক্ষুরটি’ ছিল এ রকম-

“Simplicity is the ultimate sophistication”

ইতিহাসে অক্কামের ক্ষুরের একটি সার্থক প্রয়োগের উল্লেখ পাওয়া যায় বিজ্ঞানী ল্যাপ্লাস এবং নেপোলিয়নের একটি মজার ঘটনায়। ঘটনাটি আমার এতোই মজার মনে হয়েছিলো যে, আমার প্রথম বই ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ শেষ করেছিলাম এ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটির উল্লেখে। তবে, ঘটনাটি আমার বানানো কিছু নয়। ঘটনাটি প্রথমে আমি পড়েছিলাম বিখ্যাত জ্যোতির্পদার্থবিদ মেঘনাদ সাহার ‘হিন্দু ধর্ম-বেদ-বিজ্ঞান’ সম্পর্কিত একটি চিত্তাকর্ষক বাদানুবাদ থেকে (আধুনিক বিজ্ঞান ও হিন্দুধর্ম : অনিলবরণ রায়ের সমালোচনার উত্তর, মেঘনাদ সাহা, মেঘনাদ রচনা সংকলন, শান্তিময় চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত, ওরিয়েন্ট লংম্যান, কলিকাতা, ১৯০৮ শকাব্দ, পৃষ্ঠা ১২৭-১৬৯ দ্রঃ) । বর্ণিত ঘটনাটি এরকম:

বিখ্যাত গণিতজ্ঞ লাপ্লাস তার সুবিখ্যাত ‘Mechanique Celeste’ গ্রন্থে গ্রহসমূহের এবং চন্দ্রের গতির খুব সন্তোষজনক ব্যাখ্যা প্রদান করেন। তিনি প্রমাণ করেন যে, গতিবিদ্যা ও মাধ্যাকর্ষণ দিয়ে পর্যবেক্ষিত সকল গ্রহগতির সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা দান সম্ভব। তিনি যখন গ্রন্থটি নেপোলিয়নকে উৎসর্গ করার জন্য অনুমতি চাইতে গেলেন, তখন নেপোলিয়ন রহস্য করে বলেন:

‘মসিঁয়ে লাপ্লাস, আপনি আপনার বইয়ে বেশ ভালভাবেই মহাকাশের গ্রহ-নক্ষত্রের চালচলন ব্যাখ্যা করেছেন; কিন্তু আমি দেখলাম আপনি কোথাও ঈশ্বরের উল্লেখ করেন নি। আপনার মডেলে ঈশ্বরের স্থান কোথায়?’

লাপ্লাস উত্তরে বললেন:

স্যার, এই বাড়তি অনুকল্পের কোন প্রয়োজন নেই।