পারভেজ হুদভয়ের চোখে মুম্বই সন্ত্রাস পরবর্তী পাকিস্তান

দিগন্ত সরকার

পারভেজ হুদভয়ের একটা সময়পোযোগী সাক্ষাকার বাংলায় অনুবাদ করে দিলামএম-এই-টি থেকে পি-এইচ-ডি করা পারভেজ হুদভয় ১৯৭৩ সাল থেকে পাকিস্তানের কায়েদে আজম বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়ার পদার্থবিদ্যার অধ্যাপকইনি পাকিস্তানে মশাল নামে একটি সংগঠনেরও পরিচালকএই সংগঠনের কাজ হল নারীশিক্ষার প্রসার ও পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধিবিজ্ঞান-সচেতনতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে নির্মিত ওনার ১৩ পর্বের ডকুমেন্টরিও পাকিস্তান টিভিতে প্রচারিত হয়েছে২০০৩ সালে বিজ্ঞানশিক্ষা প্রসারের ওপর কাজ করার জন্য ইউনেস্কো থেকে উনি বিশেষ পুরষ্কার পান

 

নিচের সাক্ষাকারটি নিয়েছেন ক্রিশ্চিনা ওটেন, জার্মান ফোকাস পত্রিকার জন্য এটা প্রকাশিত হয়েছে কাউন্টারকারেন্টসে, গত ১৫ই ডিসেম্বর


 

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক মুম্বই হামলার পরে ক্রমাগত খারাপ হয়েই চলেছেযুদ্ধ লাগার সম্ভাবনা কতটা?

জনগণের দাবী সত্ত্বেও মনমোহন সরকার সীমান্ত পেরিয়ে কোনো আক্রমণ করেনিদেশে অনেকের সমালোচনা সত্ত্বেও পাকিস্তান সরকার লস্কর-ই-তৈবার বিরুদ্ধে কিছু ব্যবস্থা নিচ্ছেহয়ত এখন আর কিছু হবে না, তবে এখনকার মত কোনো সম্ভাবনা না থাকলেও আরো একবার একই রকমের হামলা হলে ব্যাপারটা যুদ্ধের আকার ধারণ করতেই পারে

লস্কর-ই-তৈবার সাথে আর সন্ত্রাসী দলগুলোর তফা কোথায়? পাকিস্তান কি সত্যিই এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে?

আজ থেকে বছর পনের আগে আই-এস-আই আর আর্মির হাত ধরে কাশ্মীরে ভারতীয় সেনার বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম করার জন্য লস্করের গোড়াপত্তনআজকের দিনে এরা খুব বিরল প্রজাতির সন্ত্রাসী দল যাদের পাকিস্তানী রাষ্ট্র বা সেনাবাহিনী সম্পর্কে কোনো অভিযোগ নেই, কিন্তু বাকি সকলেই এদের শত্রু হয়ে গেছেএখন শুনছি পাকিস্তান কিছু লস্কর সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছেসময়ই বলে দেবে এটা আন্তর্জাতিক চাপ কমানোর চেষ্টা না সত্যিকারের সন্ত্রাসদমন প্রচেষ্টাযদি সত্যিকারের প্রচেষ্টা হয়ে থাকে, তাহলে কিছু সময়ের মধ্যেই আর্মি আর আই-এস-আই এর সাথে এদের শত্রুতা দেখা দেবে, যেমনটা হয়েছিল জৈশ-ই-মহম্মদের ক্ষেত্রে

 

মুম্বাই গণহত্যা সম্পর্কে পাকিস্তানের জনগণের প্রতিক্রিয়া কি?

৯/১১ এর পরে যেমন আনন্দোসব দেখা গিয়েছিল, সে জায়গায় মুম্বই হামলার পরে পাকিস্তানি জনগণ প্রাথমিকভাবে ভারতের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলকিন্তু ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলো যখনই পাকিস্তানকে দোষ দেওয়া শুরু করল, তখন প্রথমে ক্রোধ ও পরে অস্বীকারের রাস্তায় হাঁটতে থাকে সবাইপাকিস্তানের মাটি থেকেই আক্রমণের ছক কষা হয়েছে এ দাবী তারা মানতে নারাজজনপ্রিয় টিভি-নিউজ ব্যক্তিত্বরা সবাই টিভিতে এসে একের পর এক ষড়যন্ত্র তত্ত্ব খাড়া করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েবছর কয়েক আগে এই ব্যক্তিত্বরাই কান্দাহার বিমান ছিনতাই মামলায় র‘-এর ছায়া দাঁড় করিয়ে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছিল, যার কোনোটাই ধোপে টেঁকেনিপাকিস্তান যে কারগিলের ঘটনায় জড়িত, তা-ও এরা হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলসমঝোতা এক্সপ্রেসের বোমা হামলার উল্লেখ করে এখন তারা একে একে হিন্দু জঙ্গী গোষ্ঠী, আমেরিকা বা ইহুদীদের দোষারোপ করে

 

পাকিস্তান অনেককাল ধরেই বলে আসছে যে ভারতের দিক থেকে হামলার আশঙ্কা করলে তারাই প্রথম নিউক্লিয়ার হামলা করবেপাকিস্তানে সেরকম কোনো সম্ভাবনা দেখছেন আপনি?


মুম্বাই হামলার সপ্তাহখানেক আগে জারদারি আশ্বস্ত করেছেন যে পাকিস্তান কখনই প্রথমে নিউক্লিয়ার আক্রমণ করবে নাভারতও বছর দশেক আগেই এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেতবে জারদারির এই দাবী ভিত্তিহীন কারণ পাকিস্তান আর্মির পক্ষ থেকে এরকম কোনো বক্তব্য রাখা হয় নিসবাই জানে, পাকিস্তানে আর্মির হাতেই নিউক্লিয়ার বোমা আছেঅনেকদিন ধরেই বিভিন্ন বিশেষজ্ঞরা পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সিমুলেশন করে সিদ্ধান্তে এসেছেন যে কোনোভাবে যুদ্ধ শুরু হলে নিউক্লিয়ার বোমাতে গিয়েই যুদ্ধ শেষ হবে

 

সন্ত্রাসীরা আফগানিস্থান আর সেখানের পশ্চিমি সেনাদের ছেড়ে কেন ভারতকে লক্ষ্য হিসাবে বেছে নিল?


লস্করের মূল ঘাঁটি হল লাহোরের কাছে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে অবস্থিত মুর্দিকে শহরেএই শহরে এদের আছে একটা বড় ট্রেনিং ক্যাম্প আর সমাজসেবক সংস্থালস্করের অধিকাংশ সদস্যই পাঞ্জাবী, তাই এরা আফগানিস্থানে লড়াই করার পক্ষে অনুপযুক্ত, কারণ এরা সহজে পাশতুন বা আফগানদের সাথে মিশে যেতে পারে নালস্কর হল ভারতমুখী ও কাশ্মীরমুখী একটি সন্ত্রাসী দল কিন্তু, পাকিস্তানের অন্যান্য জঙ্গীগোষ্ঠীদের মতই এরাও ভারত, আমেরিকা আর ইসরায়েলের মধ্যে বোঝাপড়া আছে বলে মনে করেতাই, এরা সবাই এই দেশগুলোর শত্রু

 

মুম্বই-সন্ত্রাসীদের হামলার দাবী কি ছিল?

সব জিম্মিদের হত্যা করা হয়েছে আর কোনো দাবী সরকারীভাবে প্রকাশিত হয় নিলস্কর বা সমধর্মী পাকিস্তানি জঙ্গীগোষ্ঠীদের উদ্দেশ্য খুবই পরিষ্কারএই ক্ষেত্রে, ভারতের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কেন্দ্রস্থল হিসাবে মুম্বইকে আক্রমণ করা হয়েছে, হয়ত ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাধিয়ে দেওয়াও উদ্দেশ্য ছিলভারত-সীমান্তে পাকিস্তানী সেনা সরালে তাদের দলের তালিবানদের সুবিধা হবেভারতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে হিন্দু দক্ষিণপন্থীদের হাত শক্ত করাও এদের লক্ষ্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে, কারণ এর ফলে এদের দলে আরো নতুন মুখ পাওয়া সোজা হবেসবেশেষে, অমুসলিমদের বিরুদ্ধে ক্ষোভের উদ্গিরণও ঘটেছে এই আক্রমণে

 

 

পশ্চিমা সাংবাদিকেরা বলছেন আল-কায়দা আর লস্কর-ই-তৈবা এখন যৌথ কার্যক্রম চালাচ্ছে, এ বিষয়ে আপনার মত কি?


এদের উদ্দেশ্য একই রকম হলেও সামান্য কিছু মতাদর্শগত তফা থাকতেই পারেসন্ত্রাসীদের দুনিয়ায় সামান্য মতাদর্শের পার্থক্যই দুই দলের মিলিত কার্যক্রমের জন্য যথেষ্ট প্রতিবন্ধকতা হয়ে দেখা দিতে পারেএখনও অবধি এদের যৌথ কার্যক্রমের কোনো পরিচয় পাওয়া যায় নি, তাই এই ধারণাকে আমি এখনও সন্দেহাতীত বলে মনে করি না

 

এই সন্ত্রাসে কাশ্মীরের ভূমিকা কতটা?

কাশ্মীরে ১৯৮৭ থেকেই বিপ্লব চলছে১৯৮৭ সালের ভোটে ব্যাপক আকারে কারচুপির ফলে এক গণবিক্ষোভ সৃষ্টি হয় যা ভারত সেনা পাঠিয়ে বলপূর্বক দমন করে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এই সুযোগে এক গোপন যুদ্ধ শুরু করে ভারতের বিরুদ্ধে ইউনাইটেড জিহাদ কাউন্সিল বলে এক ২২টি পাকিস্তানী সংগঠনের সমবায় সংস্থা সেনা ও আই-এস-আই-এর সহায়তায় তাদের কার্যকলাপ চালিয়ে যায়এদের সহায়তায় জেনারেল মুশারফ ১৯৯৯ সালে কারগিলে যুদ্ধ শুরু করেনএতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্ষতি হলেও পাকিস্তানও শেষমেষ সেনা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়জেনারেল মুশারফ যুদ্ধে বিজয়ীর মর্যাদা পান, আর ভীরু বলে চিহ্ণিত হন নওয়াজ শরিফএর পরের ঘটনা সবারই জানা

 

পাকিস্তানি সমাজের কোন অংশ আল কায়দা আর ওসামা বিন লাদেনকে সমর্থন করে?


বালুচিস্তান আর সিন্ধে ওসামার প্রতি সমর্থন পাঞ্জাব আর উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের তুলনায় অনেক কমমজার কথা হল পাকিস্তানের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী নিজেরা পশ্চিম-ঘেঁষা জীবনযাপণ করেন আবার ওসামার প্রতি সমর্থন বা পশ্চিম-বিদ্বেষও তাদের মধ্যেই বেশীআমি খুবই অবাক হই যখন তালিবান আত্মঘাতী ঘাতকেরা দেশের মসজিদ, শোকসভা, হাসপাতাল, মেয়েদের স্কুল আক্রমণ করে বা নিরীহ পুলিশদের মেরে ফেলে অথচ তাদের বিরুদ্ধে কিছু শোনা যায় নাজনগণ এতটাই আমেরিকা-বিরোধী যে এই ঘটনাগুলোও তাদের মনে দাগ কাটে নাঅনেক সময় পাকিস্তানী বামপন্থীরাও তালিবানদের সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী শক্তি বলে ভুল ভেবে বসে

 

এ বিষয়ে আপনার মতামত কি? এই তালিবানদের কি সত্যিই পাকিস্তান-সমাজে কিছু অবদান আছে?

 

পৃথিবীর সর্বত্র মানুষ যা চায় পাকিস্তানীদেরও তাই দাবীখাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান, চাকরি-বাকরি, উন্নত বিচারব্যবস্থা ও উন্নয়নমুখী সরকার আর সুরক্ষাএর সাথে আছে শিক্ষা ও চিন্তা ও ধর্মাচরণের স্বাধীনতা যা ইউনিভার্সাল হিউম্যান রাইটস ডিক্লারেশনে আছেএর পরে আসে দেশের সার্বভৌমত্ব, বিদেশনীতি ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইস্যুএ কারণে, পাকিস্তানে এই তালিবান-গোত্রীয়রা কোনো অবদান রেখেছে বলে মনে হয় নাতারা পরিবার-পরিকল্পনা-বিরোধী, সংখ্যালঘু-বিরোধী, নারীশিক্ষার বিরোধীবহির্বিশ্ব সম্পর্কে এদের কোনো জ্ঞান নেই, জানার কোনো ইচ্ছাও নেইতারা শুধু যুদ্ধের মাধ্যমেই সমাধান খোঁজেপাকিস্তানে এবারের ভোটে স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া গেছে যে জনগণ এদের পছন্দ করে না

 

 

২০০২ এর জানুয়ারীতে পারভেজ মুশারফ ঘোষণা করেছিলেন যে পাকিস্তানের জমি ব্যবহার করে কেউ সীমানা পেরিয়ে আক্রমণ চালাতে পারবে নাসেই প্রতিশ্রুতি কি রাখা হয়েছিল?


এই ঘোষণার পরে সত্যিই সীমানা পেরিয়ে আক্রমণ অনেকটা কমে গিয়েছিল, কিন্তু কোনোভাবেই নির্মূল হয়ে যায় নিঅক্টোবরের ভূমিকম্পের পরে আমি নিজে ত্রাণের কাজে আজাদ কাশ্মীরের বিভিন্ন অংশে ঘুরে এসেছি দেখেছি লস্কর-ই-তৈবা, জৈশ-ই-মুহম্মদ বা সিপাহী-ই-সাহেবা আর অন্যান্য নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন ত্রাণ বিলি করছেএদের ত্রাণ বিতরণের পরিকল্পনা পাকিস্তান সরকার বা আর্মির চেয়ে অনেকগুণ উন্নত এমনকি আহত সেনাদেরও এরা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করেছে অথচ, পারভেজ মুশারফকে কয়েক মাস পরে এ কথা বলাতে দেখলাম উনি রেগে যাচ্ছেন, যেন এই দলগুলো নিয়ে আলোচনাও নিষিদ্ধ

 

পাকিস্তানে কিছু গোষ্ঠী আছে যারা আমেরিকা-বিরোধী ও কড়া ধর্মীয় আইন প্রবর্তন করার পক্ষে, আর উল্টোদিকে দেশের সরকার আমেরিকার বন্ধুদেশ বলে নিজেদের দাবী জানায়এই মেরুকরণের কারণ কি? পাকিস্তানে উগ্রবাদের উত্থানে এই মেরুকরণের ভূমিকা কতটা?

পাকিস্তানে মৌলবাদী শক্তির উত্থানের মূলে আছেন আমেরিকা ও রোনাল্ড রেগানের সমর্থিত পাকিস্তানী জেনারেল জিয়া উল হকআজ থেকে বছর পঁচিশেক আগে, এই দুই নেতা হাত মিলিয়ে আফগানিস্তানে সোভিয়েতদের তাড়ানোর জন্য দেশে উগ্রবাদী শক্তির বীজ বপন করেনসেই সময়ে মৌলবাদের প্রসারে আমেরিকা খুশীই হত, কারণ সেই প্রসার তাদের লক্ষ্যপূরণের মাধ্যম হিসাবে কাজ করতসেই একই সময়ে, জেনারেল জিয়ার আমলে সারা দেশে একটা সামাজিক পরিবর্তন দেখা দেয় সব সরকারি অফিসে নামাজ পড়া বাধ্যতামূলক করা হল, জনসমক্ষে অপরাধীদের বেত্রাঘাত করা শুরু হল, রমজানে উপোস না করলে শাস্তির ব্যবস্থা করা হল, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের সময় ইসলাম সম্পর্কিত জ্ঞানেরও পরীক্ষা নেওয়া শুরু হল এবং সব মুসলিমদের জন্য জিহাদ বাধ্যতামূলক করা হলকিন্তু আজকে সেই উগ্রবাদীদের সাথেই সরকারের লড়াইতে যেতে হয়েছে, আবার সেই আমেরিকারই নির্দেশেদেশের আর্মি ও সরকার আমেরিকার সাথে থাকলেও তাই জনগণ স্বাভাবিকভাবেই আমেরিকা বিরোধী

 

প্রেসিডেন্ট জারদারি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে উনি উগ্রবাদীদের খুঁজে তাদের ট্রেনিং ক্যাম্প ধ্বংস করবেনকিন্তু কাজে সেরকম কোনো লক্ষণ দেখছি নাউনি কি এর চেয়ে বেশী কিছু করতে চান না? নাকি এর থেকে বেশী কিছু করার ক্ষমতাই ওনার নেই?
 

আসল ক্ষমতা পাকিস্তানের আর্মির হাতেএই উগ্রবাদীদের সাথে লড়াইতে দুহাজার সেনা মারা পড়েছেতাও আর্মি ভেতর থেকে নিশ্চিত নয় যে এই উগ্রবাদীরা পাকিস্তান দেশটাকে বাঁচিয়ে রাখার পরিপন্থীআমি এদের এই দ্বিধার কারণ বুঝিবছরের পর বছর ধরে আর্মিতে এই বুঝিয়ে লোক নেওয়া হয়েছে যে তারা ভারতের সাথে যুদ্ধ করবে ও ইসলামকে রক্ষা করবেকার্যত, এখন তারা লড়াই করছে এমন এক দলের সাথে যারা ইসলামের আরো বড় রক্ষকশুধু তাই নয়, আর্মিকে এখন ভারতের সাথে যুদ্ধও করতে হচ্ছে নাএই ধোঁয়াশা থেকেই তাদের ডিমরালাইজেশন আর তার সাথে যোগ হয়েছে গণসমর্থনের অভাবউত্তর-পশ্চিম সীমান্তে পাকিস্তানী সেনাদের অনেকেই তাই যুদ্ধের আগেই আত্মসমর্পণ করে দিচ্ছে

 

সরকারের উগ্রবাদ-বিরোধী যুদ্ধ কি আপনি সমর্থন করেন?

 

জীবনে এই প্রথমবারের মত আমি মনে করি আর্মিকে সমর্থন করা দরকার, যতক্ষণ তারা নিরীহ লোকদের ছেড়ে শুধু উগ্রবাদীদের খুঁজে মারতে পারবেদুঃখের বিষয়, নিজেদের কাজ কমানোর জন্য আর্মি এখন কোনো গ্রামে কিছু উগ্রবাদী আছে বলে সন্দেহ করলেই গোটা গ্রামশুদ্ধু উড়িয়ে দিচ্ছেএরকম নিরীহ মানুষ হত্যা করা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়

 

পাকিস্তান একসময় তালিবানদের অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছেআল-কায়দার সদস্যদের ধরে দেবার জন্য সদস্যপিছু পাকিস্তানকে সি-আই-এ টাকা দেয়সেই টাকা নাকি পাকিস্তান উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে তালিবানদের সাহায্য করার জন্য ব্যবহার করে?

আর্মি তালিবানদের হাতে পর্যুদস্ত হলেও তারা এখনও “ভাল” আর “খারাপ” তালিবানদের মধ্যে তফা করে। “ভাল” তালিবানেরা শুধু আমেরিকা, ন্যাটো ও ভারতীয়দের লক্ষ্য করে আক্রমণ চালায়, আর “খারাপ” তালিবানেরা পাকিস্তানের আর্মির বিরুদ্ধেও আক্রমণ চালিয়ে যায়যখন আমেরিকানরা আফগানিস্তান থেকে চলে যাবে, এই “ভাল” তালিবানেরা তখন আফগানিস্তানের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্কে সাহায্য করবেজালালুদ্দিন হাক্কানি এরকমই এক “ভাল” তালিবান নেতাআবার মৌলানা ফজলুল্লাহের মত নেতা হলেন “খারাপ” তালিবান কারণ এরা পাকিস্তান আর্মিকেও ছেড়ে কথা বলেন নাআর্মি সাধারণত এদের “ভারতের চর” আখ্যা দিয়ে প্রচার চালায়

 

পাকিস্তান নিউক্লিয়ার স্টেটএই নিউক্লিয়ার বোমা তালিবান বা আল কায়দার হাতে চলে যাবার সম্ভাবনা কতটা?


আমি বেশী চিন্তিত এই ভেবে যদি কোনোভাবে কিছু নিউক্লিয়ার বোমা তৈরীর অন্তর্বর্তী পদার্থ (সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম) তাদের হাতে চলে যায়মজার কথা পশ্চিমের দেশগুলো আজকাল নিউক্লিয়ার অস্ত্র তৈরীতে ততটা মনযোগী নয়নিউক্লিয়ার বোমা আজ আর ক্ষমতার মেরুকরণ করে না, কারণ সুস্থচিন্তার কোনো রাষ্ট্র কখনই এই বোমা ব্যবহার করতে পারবে নাএর ফলে আজকে নিউক্লিয়ার বোমা পৃথিবীর সব প্রান্ত থেকেই সম্পূর্ণ দূর করা সম্ভব জঙ্গীদের হাত থেকে বোমা বাঁচানোর এই একটা পথই খোলা আছে

 

আঞ্চলিক ভারসাম্য রক্ষার্থে ভারত কি করতে পারে?

 

ভারতের কোনোমতেই পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে যাওয়া উচিত নয়এমনকি যদি ভারত জেতেও, তাহলেও তাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বিশাল হবেকোনো ছোটো হামলাও আঞ্চলিক স্বার্থবিরোধী হবে, কারণ এর ফলে জঙ্গীদের সাথে আর্মির আঁতাত আবারও মজবুত হবেআর কোনো ছোটো হামলার প্রতিক্রিয়া অনেক বড় হয়ে দেখা দিতে পারেপাকিস্তানে জঙ্গীঘাঁটি বন্ধ করে দেবার দাবী আমি সমর্থন জানাই, কিন্তু সেই কাজটা পাকিস্তানের নিজেরই করা উচিতআঞ্চলিক ভারসাম্যের জন্য, পাকিস্তান ও ভারত, উভয় দেশেরই উচিত নিজের নিজের দেশ থেকে দক্ষিণপন্থী ও মৌলবাদী শক্তিকে কড়া হাতে উচ্ছেদ করা

 

এই লড়াই-এর অন্তিম ফলাফল সম্পর্কে আপনার ভবিষ্যবাণী কি? পাকিস্তানে উগ্রবাদীরাই জিতবেন, না পশ্চিমারাই আর্মির সাহায্যে তাদের পরাজিত করতে সক্ষম হবেন?
 

সমস্যা খুবই গুরুতর কিন্তু সমাধান অসম্ভব কিছু নয়গত এক দশকে আমেরিকার সাম্রাজবাদী নীতি ও ইরাক আক্রমণের ফলে জনমানসে আমেরিকা বিরোধী এক মনোভাব তৈরী হয়েছে যার ফলে যারাই আমেরিকার বিরোধিতা করছে তাদেরই তারা সমর্থন করতে পিছপা হচ্ছে নাপাকিস্তানীরা তালিবানদের সামাজিক ও আচার-আচরণগত নীতি সমর্থন করে নাঅথচ তারা আমেরিকা-বিরোধী বলে গণসমর্থন পায়আমি আশা রাখছি বারাক ওবামা ক্ষমতায় এলে আমেরিকা পাকিস্তানের যে ক্ষতি করেছে তার কিছু ক্ষতিপূরণ করবেকিন্তু মূল কথা হল, পাকিস্তানীদের নিজেদেরই এই সমস্যা সমাধান করতে হবে, বুঝতে হবে কোনো সভ্য দেশ হিসাবে দাঁড়াতে গেলে এসব চলে নাপাকিস্তানকে পশ্চিমা সমর্থন কিছুটা গোপন রাখতে হবে হয়তএকই ভাবে, পাকিস্তানকে আলাদা করে শাস্তি দিলে বা কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিলে তালিবান বা সমগোত্রীয়রা রাষ্ট্রের আরো বেশী ক্ষমতা দখল করে ফেলবেপাকিস্তানের ক্ষেত্রে এর চেয়ে বড় কোনো দুশ্চিন্তার কারণ নেই