কর্ণফুলীর মোহনায় বসুন্ধরার বেসরকারী বন্দর

দিনমজুর

একঃ

চট্টগ্রাম বন্দরের উজানে কর্ণফুলীর মোহনায় যে স্থানে মার্কিন কোম্পানী স্টিভিডোরস সার্ভিসেস আমেরিকা বা এসএসএ বন্দর নির্মান করতে চেয়েছিল, ঠিক সে স্থানে নদীর বিপরীত তীরে, আজকে যখন দেশীয় কোম্পানী বসুন্ধরা গ্রুপ বেসরকারী বন্দর নির্মাণ করতে যাচ্ছে, তখন আমরা যারা এসএসএ বন্দরের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলাম তাদের অনুভূতি কি? এসএসএ বন্দরের বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলনের ভিত্তি কি কেবল জাতীয় নিরাপত্তার বিবেচনায় বেদেশী কোম্পানীর বিরুদ্ধচারণ নাকি মুনাফা কেন্দ্রীক অর্থনৈতিক ব্যাবস্থায় মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তির স্বার্থে যে প্রকৃয়ায় জনগণের সম্পদ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে ক্রমশ অকেজো করে দেয়া হয় তারও বিরুদ্ধতা করা? আজ থেকে পাঁচ বছর আগে চট্টগ্রাম বন্দর অভিমুখে তেলগ্যাসবিদ্যুতবন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতুত্বে যে লংমার্চ হয় তার মূল দাবী ছিলবন্দর বাঁচাও তাহলে আজকে এসএসএ বদলে বসুন্ধরা গ্রুপ বন্দর নির্মান করলে আমাদের চট্টগ্রাম বন্দর কি বাঁচবে? জাতীয় নিরাপত্তার বিবেচনাতেও বসুন্ধরা কি মার্কিন কোম্পানী এসএসএ চেয়ে অধিকতর নিরাপদ?

চট্টগ্রাম বন্দর এবং আমাদের জাতীয় অর্থনীতি
সাধারণত দুনিয়ার কোন স্বাধীন দেশেই প্রধান বন্দরসমূহ বেসরকারী পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দেওয়া হয় না। অর্থনীতির জীবনপ্রবাহ, সামরিক গুরুত্ব, সার্বভৌমত্ব ইত্যাদি প্রশ্নে প্রধান প্রধান বন্দরের কর্তৃত্ব সেজন্যই রাষ্ট্রের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে থাকে। তবে জাপানে প্রায় ২০০০ বন্দর রয়েছে, ভারতে দেড় ডজনের ওপর বন্দর, সমস্ত ক্ষেত্রে গোটা আমদানিরপ্তানি বাণিজ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ রেখে, সামরিক কৌশলগত বিষয় বিবেচনায় রেখে কিছু অপ্রধান এলাকায় অর্থনীতির মূলপ্রবাহের সাথে শাখাপ্রশাখা বিস্তারের স্বার্থে প্রাইভেট কন্টেইনার টার্মিনাল, ছোটখাট পোর্ট ইত্যাদি দেওয়ার নমুনাও রয়েছে। কিন্তু দেশের একমাত্র বন্দরকে অচল করে দিয়ে অর্থাৎ আন্তর্জাতিক জাতীয় বাণিজ্যভিত্তিক গোটা অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ বেসরকারী কোম্পানীর হাতে তুলে দেয়ার উদ্যোগ নজিরবিহীন। 

যে স্থানে বসুন্ধরার বন্দর নির্মাণের কথা বলা হচ্ছে তার ঠিক নটিক্যাল মাইল উজানে আছে চট্টগ্রাম বন্দর। আমাদের আরেকটি সমুদ্র বন্দর আছে খুলনায়। খুলনা থেকে চালনা এবং চালনা থেকে মংলায় বন্দর স্থানান্তরিত করার পর তা এখনও পর্যন্ত স্থায়িত্ব পায়নি। পলি জমে এখানে জাহাজ ভীড়া খুব কঠিন। দেশের অন্যান্য অংশের সাথে এর যোগাযোগব্যবস্থা খুব দুর্বল। ফলে, বর্তমানে, বন্দরের ক্ষমতার ৯০ ভাগই অব্যবহৃত পড়ে আছে। সেজন্য চট্টগ্রাম বন্দরই, কার্যত, দেশের একমাত্র সমুদ্র বন্দর। আমাদের আমদানিরপ্তানির ৯২ ভাগই হয়ে থাকে বন্দর দিয়ে। বন্দর অচল হলে গোটা অর্থনীতিই অচল হবে। 

চট্টগ্রাম বন্দরের ভৌগোলিক অবস্থান, এর ব্যবসায়িক গুরুত্ব
শুধু আমাদের অর্থনীতির নিরিখেই নয়, ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে ব্যবসায়িকসামরিক দিক দিয়েও চট্টগ্রাম বন্দর খুব গুরুত্বপূর্ণ।চট্টগ্রামের পাশেই আছে মিয়ানমার, ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরা মিজোরাম। এখান থেকে, এই দুটো রাজ্যের লাগোয়া, যাদেরকে এক সাথে সাত বোন (সেভেন সিস্টার্স) বলা হয়, সেই আসামমেঘালয়অরুনাচলনাগাল্যান্ডমনিপুরের দূরত্বও খুব বেশি নয়। অন্তত কলকাতা বন্দরের তুলনায় অনেক কম। ভারতের কাছ থেকে ট্রানজিট পেলে নেপাল, ভূটানের জন্যও চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার খুব লাভজনক। প্রস্তাবিত এশিয়ান হাইওয়ের কারণে, এমনকি, চীনের জন্যও বন্দর বেশ গুরুত্বপূর্ণ। মিয়ানমারের সাথে চীনের দীর্ঘ সীমান্ত আছে। তাছাড়া, আমাদের পঞ্চগড় থেকে ভারতের শিলিগুড়ি করিডোর পেরুলেই চীনের সীমান্ত। মাত্র ১৭ মাইলের দূরত্বকে চিকেন নেক বা মুরগীর বাচ্চার গলার সাথে তুলনা করা হয়ে থাকে। 

চট্টগ্রাম বন্দরের এই ব্যবসায়িক গুরুত্বের কারণে এর ওপর বহু আগেই দেশীবিদেশী লুটেরাদের নজর পড়েছে। ১৯৯৬ সালে বিশ্বব্যাংক বন্দর খাতকেউন্মুক্তকরার পরামর্শ দেয়। সেবছর ব্রিটেনের পোর্ট ভেঞ্চার লিঃ, চায়না ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি পোর্ট অব সিঙ্গাপুর অথরিটির সমন্বয়ে গঠিত কনসোর্টিয়ামএর থেকে সেখানে ব্যক্তিমালিকানায় বন্দর নির্মাণের প্রস্তাব দেওয়া হয়। অবশ্য, তখন দেশের উত্তপ্ত পরিস্থিতি সম্ভাব্য গণপ্রতিরোধের ভয়ে সরকার ওই প্রস্তাব গ্রহণ থেকে বিরত থেকেছিল। একই ভাবে কর্ণফুলীর মোহনায় বেসরকারী বন্দর স্থাপনের চেষ্টা করেছিল মার্কিন সংস্থা স্টিভিডোরস সার্ভিসেস আমেরিকা(এসএসএ) ১৯৯৯ সাল থেকে টানা তিন বছর দেশিবিদেশী নানা চাপ প্রয়োগ করা হয় বন্দর স্থাপনের জন্য। কিন্তু তেলগ্যাসবিদ্যূতবন্দর রা জাতীয় কমিটির নেতুত্বে তীব্র আন্দেলন গড়ে উঠলে সে উদ্যোগ ভেস্তে যায়। এরই ধারাবহিকতায় সর্বশেষদেশীয়বসুন্ধরা কোম্পানীকে ব্যবসায়ীকঅর্থনৈতিকভৌগলিকরাজনৈতিক বিবেচনায় স্পর্শকাতর একটি স্থানে বেসরকরী বন্দর নির্মানের অনুমোদনের এই পায়তারা। 

যেভাবে বসুন্ধরাকে বন্দর নির্মানের অনুমতি দেয়া হচ্ছে
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কর্ণফুলীর দক্ষিণ তীরে বিশাল জায়গা প্রাইভেট পোর্ট নির্মাণের জন্য লিজ প্রদানের লক্ষে ২০০৫ সালে টেন্ডার আহ্বান করে। সিটি কর্পোরেশন তাতে অংশ নেয়। কর্পোরেশন সর্বোচ্চ দরদাতা হলেও বন্দর কর্তৃপ নির্ধারিত দিনে সবার সামনে টেন্ডার বাক্স খোলেনি। পরে গোপনে কর্পোরেশনের দর জেনে নিয়ে বসুন্ধরাকে দিয়ে সংশোধিত টেন্ডার জমা দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়। কর্পোরেশন থেকে এই টেন্ডার প্রক্রিয়ায় জালিয়াতির অভিযোগ লিখিতভাবে জানানো হয়েছে বন্দর কর্তৃপকে। 

ইস্টওয়েস্ট প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট প্রাইভেট লিমিটেড থেকে ছয়টি আরসিসি জেটি নির্মানের প্রস্তাব পাওয়ার চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপ নৌবিভাগের প্রধান উপসংরক্ষক ক্যাপ্টেন নাজমূল হাসানকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে। কমিটির অন্যান্য সদস্য ছিলেন প্রধান অর্থ হিসাব কর্মকর্তা, পরিচালক(পরিবহন), উপপ্রধান প্রকৌশলী এবং উপব্যবস্থাপক(ভূমি) কমিটি বসুন্ধরার ছয়টি জেটি নির্মানের প্রস্তাবের বিপরীতে তিনটি জেটি নির্মানের সুপারিশ সহ প্রতিবেদন জমা দেয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রস্তাবিত জেটি নির্মান হলে নাকি চট্টগ্রাম বন্দরের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হবে না! এছাড়া ওই জেটিগুলো থেকে প্রতিবছর বিভিন্ন ধরনের মাসুল বাবদ বন্দরের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় হবে এবং বন্দরের জাহাজ জটের কিছুটা নিরসন হবে! 

অন্যদিকে কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণের জন্য বসুন্ধরা গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ইস্ট ওয়েস্ট প্রপার্টি লিমিটেড ২৫০ একর জায়গা লিজ নেয়। লিজ চুক্তি স্বারিত হয় ২০০৬ সালের জুন মাসে। ২০০৭ সালের জুলাই থেকে ২০০৯ সালের জুলাই পর্যন্ত বছরের জন্য লিজ নেয়া হয়। প্রতি বছর কোটি ৫০ লাখ টাকা করে দুবছরে লিজের পাওনা বাবদ মোট ১৭ কোটি টাকা পরিশোধ করার কথা। কিন্তু বসুন্ধরার অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ইস্ট ওয়েস্ট প্রপার্টি লিমিটেড পর্যন্ত বেশিরভাগ টাকা পরিশোধ করেনি। পুরো এক বছরের বকেয়া বাবদ ইতিমধ্যে বন্দর কর্তৃপরে ১১ কোটি টাকা পাওনা হয়ে গেছে। কিন্তু বসুন্ধরা কর্তৃপ কেবল জেটি নির্মানের অনুমোদন পেলেই লিজের টাকা পরিশোধ করবে বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে। 

সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, কোন্ বিধির ভিত্তিতে বন্দর কর্তৃপ বসুন্ধরা গ্রুপকে জেটি নির্মানের অনুমতি দেবে, তার কোন সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় বন্দর কর্তৃপ একটি খসড়া নীতিমালা অনুমোদনের জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। এটি অনুমোদিত হলে কর্ণফুলীর মোহনায় বসুন্ধরার বন্দর নির্মানে আর কোন বাধা থাকবে না।

বন্দরের নামে ভূমি দস্যুতা:
লিজ নেয়ার পর থেকে আনোয়ারার রাঙ্গাদিয়া এলাকায় বন বিভাগের বিশাল ভূমি গ্রাস করে ফেলে ইস্ট ওয়েস্ট প্রপার্টি লিমিটেড। বিশাল প্যারাবন নির্বিচারে নিধন করা হয়। এর ফলে ওই এলাকার জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। বন বিভাগ বসুন্ধরা গ্রুপের এই ভূমি গ্রাসের বিরুদ্ধে পৃথকভাবে ১০টি মামলা করেছে। এর পরও থেমে থাকেনি জবরদখল। এখনও সমানে ভূমি গ্রাস চলছে। লিজ নেয়া ভূমিতে কোন গাছ অবশিষ্ট রাখেনি বসুন্ধরা গ্রুপ। কেটে কেটে সাবাড় করেছে। ২৫০ একর লিজ নেয়া ভূমির মধ্যে ২শএকরই চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের জায়গা। আবার কর্ণফুলী নদী থেকে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে বিশাল জায়গা ইতিমধ্যে ভরাট করে ফেলা হয়েছে। মৎস্য চাষের জন্য লিজ দেয়া জলাশয়ও ভরাট করে ফেলা হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা যারা একসনা লিজ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে মাছ চাষ করে আসছিলেন তাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী লেলিয়ে দিয়ে উচ্ছেদ করেই তারা ক্ষান্ত হয়নি; অনেকের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। এতে লোকজন এলাকাছাড়া হয়ে গেছেন। 

নদীমুখের বন্দর মালিকানাধীন ২৫০ একর জায়গা কৌশলে দখলে নেয়ার পর বসুন্ধরা গ্রুপ বেপরোয়াভাবে আরও বেশি পরিমাণ ভূমি দখল করে ফেলে। দখল করা ভূমির পরিমাণ এক হাজার একর বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। বন্দর থানাধীন মৌজা মাঝেরচরের নং সিটের (জেএল নং৩৩) রাঙ্গাদিয়া নং৩১ অংশের ১০২, ১০৩, ১০৪, ১০৫, ১০৬, ১০৭, ১০৯, ১০৮, ১১০, ১১১, ১১২, ১১৩ নং বিএস দাগ এবং রাঙ্গাদিয়া নং৩১ গোবাদিয়া নং৩২ অংশের ১১৪ নং বিএস দাগের প্রায় ৩শএকর ব্যক্তিমালিকানাধীন জায়গাজমি বিভিন্নভাবে দখল করে নেয়া হয়। অন্যদিকে নং খাস খতিয়ানভুক্ত বিএস , ১০১, ১১৪ দাগাদির ৪০৪ দশমিক ৪৪ একর জমি থেকে বৈরাগ গুচ্ছগ্রামে পুনর্বাসিত ৪০ পরিবারকে ৪০ একর জমি বন্দোবস্ত করে দেয় সরকারের পে চট্টগ্রাম কালেক্টর। গুচ্ছগ্রামের পুনর্বাসিতদের তুলে দিয়ে এই ৪০ একর জমিও দখল করে নেয়া হয়েছে। এছাড়া বন্দর থানাধীন মৌজা পশ্চিম তুলাতলীর (জেএল নং৩৪) বিএস নং দাগের প্রায় ৩শএকর সরকারি খাস জমি, বন্দর বন বিভাগের শত শত একর জমি লিজের নামে দখল করে নেয়া হয়েছে। এভাবে ব্যক্তিমালিকানাধীন সরকারি খাস জমি, গুচ্ছগ্রামের জমি, বন্দর বন বিভাগের জায়গাজমি মিলিয়ে প্রায় হাজার একর জায়গা নানা কৌশলে দখল করে নিয়েছে বসুন্ধরা গ্রুপ। 

অযত্ন অবহেলা করে চট্টগ্রাম বন্দরকে পঙ্গুত্বের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে
১৯৬১ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে ১৭ টি জেটি ছিল। এর মধ্যে থেকে ১৩ নং জেটি ছিল কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর। ১৭ নং জেটি বিস্ফোরক সামরিক সরঞ্জামাদি হ্যান্ডলিং করা হত। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ১০ নং জেটি বিধ্বস্ত হয়। ১৯৯১ সালের ঘুর্নিঝড়ে বিপর্যস্ত হয় ১৪, ১৫, ১৬ ১৭ নং জেটি। পর্যন্ত এগুলো পুনর্নির্মিত হয়নি।
বন্দরে ১৯৭৭ সাল থেকে কন্টেইনারে মাল পরিবহন শুরু হয়। তখন টা দিয়ে শুরু করে গত বছর (২০০৭) চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেইনার ওঠানোনামানো হয়েছে। বন্দরের মতা বাড়ানোর লক্ষে ১৯৯৫ সালে চট্টগ্রাম বন্দরকর্তৃপ নিজস্ব অর্থায়নে ৭০২ কোটি টাকা ব্যয়ে ৬০০ মিটার বার্থসহ নিউমুরিং টার্মিনাল নির্মাণ ১৯৯৬ সালে ৩০৫ কোটি টাকা ব্যয়ে গ্র্যান্টি ক্রেন (প্রতিকূল আবহাওয়ায়ও যেক্রেন সক্রিয় থাকে)সহ ১৪২ টি যন্ত্রপাতি ক্রয়ের উদ্যোগ নেয়। ব্যাপারে তারা সরকারের অনুমতি চায়। কিন্তু ক্ষোভের বিষয় হল, অর্থমন্ত্রণালয় লিকুইডিটি সার্টিফিকেট দিলেও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় তার অনুমতি দেয় নি। 

কর্নফুলী নদী খননের জন্যপতেঙ্গাকর্ণফুলীনামে টি ড্রেজার ছিল।পতেঙ্গাপুরনো হয়ে যাওয়ায় এবংকর্ণফুলীঝড়ে বিধ্বস্ত হওয়ায় নিলামে বিক্রি হয়েছে।খনকনামে যে ড্রেজারটি আছে তা দিয়ে নদীর মধ্যভাগ খনন করা গেলেও জেটির সম্মুখভাগ খনন করা যায় না। তারপরও ড্রেজার কেনার ব্যবস্থা হয় নি। 

চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে সরকারের বিমাতাসুলভ আচরণ এখানেই শেষ নয়। এরকম আরও বহু নজির আছে। এর আগে চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি রপ্তানিকারকদের দ্বারা সৃষ্ট যেকন্টেইনার জটজাহাজ জট’-এর কথা বলা হলো তা কমানোর জন্য বন্দর কর্তৃপ৯৮ সালের দিকে বন্দরের প্রচলিত নিয়ম মোতাবেক নির্ধারিত ১৫ দিনের বেশি জাহাজ বা কন্টেইনার বন্দরে অবস্থান করলে জরিমানা আদায়ের প্রথা চালু করে। এর ফলে ওই সমস্যা কিছু কমেও আসে। কিন্তু কিছু দিন যেতে না যেতেই এক রহস্যময় কারণে সরকার বন্দর কর্তৃপকে তা প্রত্যাহারে বাধ্য করে। 

এত কিছুর পরেও চট্টগ্রাম বন্দর একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান। বন্দর কর্তৃপ কখনো সরকারের কাছ থেকে এক পয়সাও অনুদান নেয় নি। বরং৮৪-’৯৮ পর্যন্ত সরকারি তহবিলে ২৩৫ কোটি টাকা দিয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপ অধ্যাদেশ, ১৯৭৬এর ৩৫ ধারা অনুযায়ী সরকার বন্দর তহবিল থেকে কোন টাকা নিতে পারে না। অথচ ১৯৯৯ সালে তৎকালীন সরকার প্রায় জোর করে বন্দর তহবিল থেকে ১৫০ কোটি নেওয়ার চেষ্টা চালায়। বন্দরের শ্রমিককর্মচারীসহ বিভিন্ন মহলের প্রতিবাদের মুখে তা সম্ভব হয় নি। সরকার তখন ক্ষেপে গিয়ে আইন করে বন্দরের ওপর ৪০% কর্পোরেট ট্যাক্স আরোপ করে, যা বন্দরকে চাপে ফেলে লোকসানি খাত হিসেবে প্রমাণ করার একটা চক্রান্ত। 

ধরনের চক্রান্ত আরো আছে। দেশে বিমানসহ সরকারি আধাসরকারি কোনও প্রতিষ্ঠানকেই তার প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি বা মালামাল কেনার জন্য সারচার্জ দিতে হয় না। অথচ চট্টগ্রাম বন্দরকে যে কোন সরঞ্জাম ক্রয়ের সময় তা দিতে হয়। উপরন্তু, চট্টগ্রাম বন্দরের নামে বিদেশ থেকে কোন ঋণ বা অনুদান পেলেও সরকার তা থেকে % – ১৪% সুদ আদায় করে। 

চট্টগ্রাম বন্দরের যথাযথ আধুনিকায়ন হলে নতুন কোন বন্দরের প্রয়োজন হবে না
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (সিপিএ) বিশ্ব ব্যাংক নিয়োজিত বন্দরবিশেষজ্ঞপ্রতিষ্ঠান মট ম্যাকডোনাল্ডের ১৯৯৮ সালের পরামর্শানুসারে ভবিষ্যৎ বর্ধিত কন্টেইনার হ্যান্ডলিং সমস্যা মোকাবিলার জন্য বেশ কিছু প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। সে অনুসারে ১ম পর্যায়ে, বর্তমান কন্টেইনার টার্মিনাল (সিসিটি)- ৪টি গ্যান্টি ক্রেন, আর.টি.জি.রিচ স্টেকারসহ আধুনিক সরঞ্জামাদি ব্যবহার করা হয়। উল্লেখ্য, গ্যান্ট্রি ক্রেন অন্যান্য আধুনিক যন্ত্রপাতি ছাড়াই সিসিটিতে ২০০০২০০১ আর্থিক সালে লক্ষাধিক কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করা হয়েছে। বর্তমানে ১৫ টি গ্যান্ট্রি ক্রেন দিয়ে সিপএ সিসিটি লক্ষের ওপরে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করতে পারছে। নতুন যন্ত্রপাতি ব্যবহার করলে প্রত্যেকটি ফিডার জাহাজ দিনের স্থলে দিনে জাহাজের কার্যক্রম শেষ করে বন্দর ত্যাগ করতে পারবে বহিঃনোঙ্গরে কন্টেইনারবাহী কোন জাহাজ জট থাকবে না। মট ম্যাকডোনাল্ড এর রিপোর্ট অনুসারে আগামী ২০১০ সালে বাংলাদেশে কন্টেইনার গমনাগমন করবে প্রায় ১১ লক্ষ ৩০ হাজার। যা বর্তমান চট্টগ্রাম বন্দরের বিদ্যমান কন্টেইনার টার্মিনাল (সিসিটি) দিয়ে হ্যান্ডলিং করা সম্ভব হবে। মট ম্যাকডোনাল্ডের পরামর্শনুসারে ২য় পর্যায়ে সিপিএ ১০০০ মিটার দীর্ঘ নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) নির্মাণ করে ১২ টি গ্যান্ট্রি ক্রেন বসালে প্রায় ২২ কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করতে পারবে। তখন সিপিএ একাই ২০৪৬ সাল পর্যন্ত দেশের প্রয়োজনীয়তা মিটাতে সম হবে। ৩য় পর্যায়ে ১১১৩ নং জেটিকে কন্টেইনার টার্মিনালে রূপান্তরিত করে টি গ্যান্ট্রি ক্রেন বসালে আরো ১১ লক্ষ কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করা যাবে। অর্থাৎ বন্দরের পর্যাপ্ত জায়গায় কন্টেইনার ইয়ার্ড নির্মাণ আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে বছরে প্রায় ৪৪ লক্ষ কন্টেইনার অনায়াসে হ্যান্ডলিং করা যাবে। 

পৃথিবীর বিভিন্ন বন্দরে কন্টেইনার এর গড়অবস্থানকাল ২৪/ ৪৮, সর্বোচ্চ ৭২ ঘন্টা। আমদানিকারকেরা যথাসময়ে বন্দর থেকে কন্টেইনার খালাস না করার ফলে চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেইনার এর গড় অবস্থানকাল দাঁড়ায় প্রায় ১৫ দিন। যদি তা, আইসিডি নির্মাণ অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে, দিনে কমিয়ে আনা হয় তাহলে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং এর পরিমাণ পূর্বের হিসাব থেকে দ্বিগুণ বেড়ে গিয়ে ভবিষ্যতে ৮৮ টি ইউ হবে। তদুপরি যদি বর্তমানে / হাই স্টেকিং (উচ্চতায় রাখা) এর পরিবর্তে সাসটেইনার ব্যবহার করে সিংগাপুর, হংকংসহ পৃথিবীর অন্যান্য বন্দরের ন্যায় কন্টেইনার / হাই স্টেকিং করে রাখা হয় তাহলে ভবিষ্যতে বন্দরে বছরে কয়েক কোটি কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করা সহজেই সম্ভব হবে। 

বসুন্ধরার বন্দরের প্রভাব হবে খুবই ভয়ঙ্কর
সবার জানা আছে, বর্তমানে বন্দরের ১৩ নং জেটি এলাকায় কর্ণফুলী নদীতে পানির গভীরতা হ্রাস পাচ্ছে। পূর্ণ জোয়ার ছাড়া জেটিসমূহে জাহাজ আসাযাওয়ায় অসুবিধা হচ্ছে। নদী বিশেষজ্ঞদের মতামত না নিয়ে অনেকটা অপরিকল্পিতভাবে কর্ণফুলী নদীর ওপর শাহ আমানত সেতু নির্মিত হয়েছে। সেতুর পিলারে স্রোত বাধা পেয়ে ওই হাল দাঁড়িয়েছে। ব্রিটিশ আমলে নির্মিত কালুরঘাট সেতুর প্রভাবও একই, চাক্তাই এলাকা পর্যন্ত কর্ণফুলী নদীর নাব্যতা হ্রাস পেয়েছে। এখন কর্ণফুলীর মোহনায় বসুন্ধরার বন্দর নির্মিত হলে অবস্থাটা কি দাঁড়াবে? 

কর্ণফুলীর একেবারে মোহনায় বন্দরের মত বড় একটা স্থাপনা নির্মিত হলে নদীর স্রোত অবশ্যই বাধা পাবে। ফলে উজানে, নদীর তলদেশ, ধীরে ধীরে ভরাট হয়ে যাবে। তখন চট্টগ্রাম বন্দরকে সচল রাখা দুরূহ হয়ে পড়বে। কর্ণফুলীর মোহনায় চ্যানেলের দৈর্ঘ্য ২০০২৫০ মিটার। প্রস্তাবিত বন্দরের প্রস্থ যদি ৬০ মিটার হয় তখন জাহাজ চলাচলের জন্য বাকী থাকে ১৪০১৯০ মিটার। ওই নদীতে উক্ত স্থানে জাহাজ চলাচলের জন্য সর্বোচ্চ জোয়ারের সময় থাকে দুই থেকে আড়াই ঘন্টা। সময়ে যদি বসুন্ধরার কোন জাহাজ, যার দৈর্ঘ্য আনুমানিক ১৭০ মি. –১৮০ মিটার, নোঙর বা জেটি থেকে বের হওয়ার লক্ষে ওই স্থানে ঘুরে তাহলে বাকী সামান্য জায়গা দিয়ে অন্য কোন জাহাজ চলাচল করতে পারবে না। কখনও সাইক্লোন বা কোন দুর্ঘটনার কারণে যদি কোন জাহাজ মূল চ্যানেলে ডুবে যায় তাহলে বন্দরের মূল চ্যানেল বা প্রবেশদ্বার বন্ধ হয়ে যাবে। স্মরণ রাখা দরকার, প্রস্তাবিত ওই বসুন্ধরারবন্দরের উজানে শুধু চট্টগ্রাম বন্দরই নয়, আছে ইস্টার্ন রিফাইনারি, ফুড সাইলো, বিমান নৌ বাহিনীর ঘাঁটি প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। জাহাজ চলাচল ক্ষতিগ্রস্ত হলে এই প্রতিষ্ঠানগুলোও অকেজো হবে। তাছাড়া প্রস্তাবিত বসুন্ধরা বন্দরের অবস্থানও সিসিটি চেয়ে সুবিধাজনক জায়গায়। ফলে বাস্তবে যা ঘটবে, হয় উভয়ের মধ্যে কন্টেইনার জাহাজ ভীড়ানো নিয়ে সংঘাত হবে। অথবা সিসিটি বসে বসে রোদ পোহাবে। আর ফলাফল হিসাবে বন্দরের প্রায় ২০০ কোটি টাকার কার্গো হ্যান্ডলিং যন্ত্রপাতি অন্যান্য স্থাপনা, ঢাকাস্থ বন্দরের ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপো, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন, বাংলাদেশ রেলওয়েসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কয়েক হাজার কোটি টাকার স্থাপনা পরিত্যক্ত হবে। চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে বর্তমানে প্রতি বছর যে টাকা আয় হয় তন্মধ্যে প্রায় ২০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা থাকে যা বন্ধ হয়ে যাবে। সবচেয়ে বড় যে ক্ষতি হবে, তা হল, এভাবে চট্টগ্রাম বন্দর একসময় একটি চরম লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। আমাদের শাসকদের প্রচলিত নীতি অনুসারে, ওই লোকসান ঘুচাতে, বন্দরটিও বেসরকারি খাতে দিয়ে দেওয়া হবে। সে সাথে বেকার হবে বন্দরের সাথে সংশ্লিষ্ট ৫০ হাজার মানুষ; নিদারুন দুরবস্থায় পড়বে তাদের পোষ্য আরও কয়েক মানুষ। আমাদের আমদানিরপ্তানিও ওই লুটেরাদের হাতে জিন্মী হয়ে যাবে। 

শেষ কথা
আমরা জানিনা বসুন্ধরাকে সরকার ঠিক কি কি শর্তে এবং কতদিনের জন্য বেসরকারী বন্দর নির্মান এবং পরিচালনার অনুমোদন দিতে চাচ্ছে। আমরা জানিনা চট্টগ্রাম এবং মংলায় দুটি বন্দর থাকা সত্বেও কোন ধান্দায় বসুন্ধরা এখানে বন্দর নির্মান করতে চাচ্ছে এবং বন্দর নির্মানের জন্য যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন পড়বে তার যোগান কি কেবল বসুন্ধরা দেবে নাকি আন্তর্জাতিক লগ্নীপুজিরও এতে অংশগ্রহন থাকবে? তবে আমরা মনেকরি পুজির কোন জাতীয়তা নেই, জাতীয়তা বিচারে মুনাফাখোর পুজিমালিকেরও কোন ভালমন্দ ভেদ নেই, মুনাফার প্রয়োজনে পুজিমালিক, তা সে দেশীয় হোক আর বিদেশী হোক, পারেনা এমন কোন কাজ নেই। যে বন্দর বসুন্ধরা আজকে নিজে পরিচালনা করবে বলে বানাতে চাচ্ছে, কালকে যে সে তা কোন বিদেশী কোম্পানীর হাতে তুলে দিবে না তার নিশ্চয়তা কি? মুনাফার স্বার্থে বসুন্ধরা যে কর্ণফুলীর মোহনায় জাহাজ জট তৈরী করে রেখে গুরুত্বপূর্ণ পণ্য আমদানীরপ্তানী নিয়ন্ত্রণ করতে চাইবে না তারও বা নিশ্চয়তা কি? কাজেই আমাদের প্রধান বন্দরের মুখে বেসরকারী বন্দর নির্মাণ করে সরকারী বন্দরকে ক্রমশ অচল এবং অপ্রয়োজনীয় করে তোলা, বন্দর নির্মানের নামে কর্ণফুলীর মোহনায় বন এবং জলাভূমি দখল করে রমরমা হাউসিং ব্যবসার পায়তারা করা, আমদানীরপ্তানী বাণিজ্যের নিয়ণ্ত্রণ বেসরকারী মালিকের হাতে তুলে দেয়া ইত্যাদির বিরুদ্ধে এসএসএ বন্দর নির্মাণের বিরুদ্ধে যেমন দুর্বার আন্দোলন গড়ে উঠেছিল এবারও একই ভাবে বসুন্ধরার বেসরকারী বন্দর নির্মাণের বিরুদ্ধে অবিলম্বে জনগণের প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার কোন বিকল্প নেই। 

সূত্র: লেখাটি তৈরী করা হয়েছে তেলগ্যাসবিদ্যূৎবন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির ২০০৩ সালের চট্টগ্রাম বন্দর অভীমুখে লংমার্চ উপলক্ষে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল(বাসদ) কর্তৃক প্রকাশিত ভ্যানগার্ডবুলেটিন এবং প্রথম আলো, ডেসেম্বর ২০০৮ সংখ্যা যুগান্তর, ডিসেম্বর,২০০৮ সংখ্যা অবলম্বনে।