আমার চোখে একাত্তর

 

ইরতিশাদ আহমদ 

 

(সপ্তম পর্ব)

 

(প্রথম পর্ব) , (দ্বিতীয় পর্ব) , (তৃতীয় পর্ব) , (চতুর্থ পর্ব) , (পঞ্চম পর্ব) , (ষষ্ঠ পর্ব)

 

মার্চের নয় তারিখে পল্টনে জনসভা করেন মওলানা ভাসানী  তিনি পাকিস্তানকে ভেঙ্গে দুটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনের দাবী জানান।  ভাসানী শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী না হয়ে বাংলার সংগ্রামী বীর হওয়ার আহবান জানান মনে রাখা দরকার,সেই দিনটি ছিল নয়ই মার্চ,সাতই মার্চের পরে মাঝখানে মাত্র একটা দিন গেছে।  কিন্তু সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করেছে এরি মধ্যে। 

 

মওলানা ভাসানী কেন শেখ মুজিবকে এই ধরনের আহবান জানিয়েছিলেন তার পেছনে ঐতিহাসিক কার আছে  শেখ মুজিবের রাজনৈতিক গুরু সোহরাওয়ার্দী পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে প্রধানমন্ত্রী হয়েই পূর্ব বাংলার স্বায়ত্বশাসনের দাবীর গুরুত্ব লাঘবের চেষ্টা চালান।  তখন তিনি বলেছিলেন, আটানব্বই পার্সেন্ট স্বায়ত্বশাসন তো দেয়া হয়েই গেছে, বাকী দুই পার্সেন্ট কোন ব্যাপার না। 

  

ভাসানীর আহবান অনুযায়ী অবশেষে শেখ মুজিব বাংলার সংগ্রামী বীর হয়েছিলেন,সন্দেহ নাই  কিন্তু পঁচিশে মার্চের আগে পর্যন্ত তাঁর মধ্যে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারী হওয়ার আকাঙ্খা একেবারেই ছিলনা একথা বলা যাবেনা    আমি আগেই বলেছি, শেখ মুজিবের নিজস্ব রাজনৈতিক অবস্থানের প্রেক্ষাপটে এতে দোষের কিছুই আমি খুঁজে পাই না।  তিনি হয়তো ভেবেছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলার সংগ্রামী বীর দুটোই একইসাথে হওয়া সম্ভব।

 

আমার বিশ্লেষণে শেখ মুজিবের তখনকার রাজনৈতিক কৌশল তাঁর রাজনৈতিক অবস্থানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হলেও বাংলার মানুষকে সঙ্কট থেকে রেহাই দেয় নি।  শেখ মুজিব সেদিন পূর্ব বাংলার নিরস্ত্র জনগণকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আক্রমন থেকে বাঁচাতে পারেন নি।  শেখ মুজিবের এই ব্যর্থতার মূলে ছিল তাঁর নিয়মতান্ত্রিক বুর্জোয়া রাজনীতি।

 

গান্ধী-স্টাইলের এই অহিংস-অসহযোগ টাইপের নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি স্বাভাবিক সময়ে পারলেও, সঙ্কটকালে খুব একটা কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে না।  আমার পর্যবেক্ষণে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে ভারত উপমহাদেশের তিনভাগে ভাগ হওয়াই প্রমাণ করে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে যতই অহিংসার লেবেল লাগানো থাকুক, সাধারণ জনগণ কখনোই হিংসার হাত থেকে রেহাই পায় না।  সাতচল্লিশে পায় নি ভারত-পাকিস্তানে, বাংলাদেশেও পায় নি একাত্তরে।

 

ইংরেজদের ভারত ছাড়তে বাধ্য করার কৃতিত্ব আমি শুধু গান্ধী এবং তাঁর রাজনীতিকেই দিতে রাজী নই।  সূর্য সেন, প্রীতিলতা, ক্ষুদিরামেরা বৃথাই জীবন দিয়েছেন আমি মানতে পারি না। ভিন্ন ধারার রাজনীতিক ছিলেন, তাই বলে সুভাষ বসুর অবদান কি অস্বীকার করা যায়?

 

শেখ মুজিবের সীমাবদ্ধতা সত্বেও, আসলে বলা উচিত সীমাবদ্ধতার কারণেই, যা করার ছিল তাই তিনি করেছিলেন।  বরং আমি বলবো, তিনি অসম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন সামরিক জান্তার মুখোমুখি হয়ে।  তাই এই সঙ্কটকে আমি বুর্জোয়া রাজনীতির সঙ্কটই বলবো।   

 

শুধু ব্যাক্তিত্ব আর সাহস দিয়ে সেদিন বুর্জোয়া রাজনীতির সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব ছিল না শেখ মুজিবের পক্ষে।  শুধু শেখ মুজিব আর তাঁর আওয়ামী লীগই নয়, এমন কি বামপন্থীরাও সেদিন তাঁদের বুর্জোয়া-প্রভাবিত রাজনীতির আবর্তে পড়ে ঘুরপাক খাচ্ছিলেন।  বামপন্থীদের হিমালয়সম ব্যার্থতার ইতিহাস না লিখলে এই আলোচনা কিছুতেই সম্পূর্ণতা পাবে না।

 

মস্কোপন্থী নামে পরিচিত বামপন্থীরাও আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনগুলোর মতোই কুচকাওয়াজ ইত্যাদি করে যাচ্ছিল।  পার্থক্য শুধু এরা জয় বাংলা শ্লোগানটা উচ্চারণ করতো না। কারণ জয় বাংলা জাতীয়তাবাদী শ্লোগানই শুধু নয়, ছিল আওয়ামী লীগের দলীয় শ্লোগান। আর পিকিংপন্থীরা ছিল নানা দল-উপদলে বিভক্ত।  তবে এদেরই দু-একটা সংগঠন গোপনে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। যদিও যুদ্ধটা কি ভাবে হবে, অস্ত্র কোত্থেকে আসবে, কে এ যুদ্ধে শত্রু, আর কেই বা মিত্র এ নিয়ে তাদের খুব একটা পরিস্কার ধারণা ছিল না।  আগেই উল্লেখ করেছি, সঙ্কট শুধু বুর্জোয়া রাজনীতিরই ছিল না, ছিল বামপন্থী বিপ্লবী রাজনীতিরও।  আসলে এরা পড়েছিল আরো বড় সঙ্কটে। 

 

আমি যে দলটির সাথে যুক্ত ছিলাম সেই বামপন্থী কম্যুনিস্ট সংগঠনটিও, আজ বুঝতে পারি, বুর্জোয়া রাজনীতির প্রভাবমুক্ত ছিল না।  যদিও বিপ্লবী পরিস্থিতি, যা তখন দেশে বিরাজ করছিল, বিপ্লবীদের জন্য সুবর্ণ সুযোগের সৃষ্টি করে।  সেই সুযোগ ছিল সেদিনের পূর্ব বাংলায়।  কিন্তু ছিল না সত্যিকারের বিপ্লবী সংগঠন ও প্রস্তুতি।  এতগুলো মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়ার জন্য বিপ্লবী বামপন্থীরা শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের সমালোচনা করেন কিন্তু এই পরিস্থিতি থেকে জনগণকে উদ্ধারের জন্য তাদেরও যে কোন পরিকল্পনা ছিল না এই সত্যটা সযতনে এড়িয়ে যান।  জাফর-মেনন-রনোরা পঁচিশে মার্চ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে দেশের মাটিতে শেষ জনসভা করেন পল্টন ময়দানে, এ নিয়ে গর্বও করেন, কিন্তু এতেই কি প্রমাণ হয় না যে, তাঁরাও বোঝেন নি জনসভা করার সময় অনেক আগেই পেরিয়ে গেছে।

 

বামপন্থীদের সমস্যার মূল কারণ ছিল আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর ওপরে অতিমাত্রায় নির্ভরতা।  সোভিয়েত রাশিয়া ও গণচীন এই দুই পরাশক্তি আর পশ্চিম বাংলার নক্সাল আন্দোলনের প্রভাবে তখন পূর্ব বাংলার বামপন্থীদের দিশাহারা অবস্থা।

 

মস্কোপন্থীদের সমস্যা ছিল কম, এবং তারা ছিল ঐক্যবদ্ধ।  তাদের নিজেদের মধ্যে দল-উপদল খুব একটা ছিল না।  এরা আগে থেকেই আওয়ামী লীগের বি-টিম হিসেবে পরিচিত ছিল।  আন্তর্জাতিক ভাবে সোভিয়েত রাশিয়ার সাথে ভারতের সখ্যতা ছিল, আর পাকিস্তানের সাথে ছিল আমেরিকার দহরম-মহরম।  তাই সংঘাতটা যেহেতু পাকিস্তানের সরকারের সাথে আওয়ামী লীগের, মস্কোপন্থীরা ছিল তুলনামূলক বিচারে সুবিধাজনক অবস্থানে।  আওয়ামী লীগ আগে পরে ভারত-সোভিয়েত অক্ষের সাহায্য নিতে বাধ্য হবে এটা নিশ্চয়ই তাদের হিসাবে ছিল।  তাই শেখ মুজিব এবং আওয়ামী লীগকে জাতীয়তাবাদী এবং যতটা পারা যায় সমাজতন্ত্রের প্রতি সহানুভুতিশীল রাখাটাই ছিল এদের কৌশল।  এই কৌশল কিছুটা হলেও সফল হয়েছিল বলা যায়।  (যুদ্ধের পরেও পঁচাত্তরে বাকশালের পতন হওয়া পর্যন্ত তারা এই কৌশল বজায় রাখে।) যদিও নামে কম্যুনিস্ট, কার্যত এরা বুর্জোয়া রাজনীতির লেজুড়বৃত্তিই করে যাচ্ছিল। সোভিয়েত রাশিয়ার পররাষ্ট্রনীতির ওপর এদের অতিমাত্রায়  নির্ভরশীলতার জন্য তখন বলা হতো মস্কোয় বৃষ্টি পড়লে এদের নেতারা ঢাকায় মাথার ওপরে ছাতা ধরেন। 

 

গণচীনের সাথে ভারতের সম্পর্ক ভালো ছিল না, সেই বাষট্টির যুদ্ধ থেকে।  তখন থেকেই পাকিস্তানের

সাথে চীন বন্ধুত্বের নীতি গ্রহণ করে নিজস্ব পররাষ্ট্রনীতির স্বার্থে,শত্রুর শত্রু বন্ধু এই নীতি অনুযায়ী। পূর্ব পাকিস্তানের চীনপন্থী কম্যুনিস্টরা তখন ভাসানীর নেতৃত্বে ডোন্ট ডিস্টার্ব আইউব নীতি অনুসারে নিজেদের কর্মসূচী প্রনয়ণ করে।  এটা নীতি ছিল না কৌশল ছিল তারাই ভালো বলতে পারবেন। তবে এটা যে একটা ভুল পদক্ষেপ ছিল তাতে কোন সন্দেহ নাই। ভাসানী কিছুদিনের মধ্যেই এই অবস্থান থেকে সরে আসেন এবং আইয়ুব খান-ফাতেমা জিন্নার নির্বাচনে ফাতেমা জিন্নার পক্ষে কোয়ালিশনে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতা হিসেবে অংশ নেন।  এই কোয়ালিয়শনে আওয়ামী লীগও ছিল। 

 

কিন্তু কম্যুনিস্টদের বিভ্রান্তি মনে হয় অত সহজে এবং অত তাড়াতাড়ি কাটে নি।  এই ধরণের বিভ্রান্তি, যার মূলে ছিল গণচীনের প্রতি মোহ, তাদেরকে আরো বড় ভুলের দিকে নিয়ে যায়। তখন থেকে তারা পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর সাথে পূর্ব বাংলার জনগণের দ্বন্দকে প্রধান দ্বন্দ মনে না করে ধনিক শ্রেণীর সাথে শ্রমিক-কৃষক শ্রেণীর দ্বন্দকে প্রধান দ্বন্দ মনে করতে শুরু করেন।  প্রায় একই সময়ে ঘটা নক্সালবাড়ী আন্দোলন এদের মধ্যে নাচুনি বুড়ির ওপর ঢোলের বাড়ির মতো প্রভাব ফেলে।  প্রায় সবকটি চীনপন্থী দল (তখন কমপক্ষে চারটির অস্তিত্ব ছিল) নক্সালবাড়ীর পথ ধরে শ্রেণীশত্রু খতমের লাইন নেয়।  এদের মধ্যে দুএকটা দল আবার একই সাথে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের কথাও বলতে থাকে এবং সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠার ডাক দিতে থাকে ।

 

নক্সাল আন্দোলনের সংগঠক চারু মজুমদারের নেতৃত্বাধীন দলের (ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টি এম এল) একটা শ্লোগান ছিল, চীনের চেয়ারম্যান, আমাদেরও চেয়ারম্যান  এ থেকেই বোঝা যায় আন্তর্জাতিকতার নামে এরা হঠকারিতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছিল।  চীন সরকারও রেডিও পিকিং-এর মাধ্যমে এদের পিঠ চাপড়াতো।  তবে চীন ভারতকে বিব্রত করার জন্যই এদেরকে উস্কানি দিত, আন্তর্জাতিক কম্যুনিস্ট রাজনীতির সাথে এর মনে হয় না কোন সম্পর্ক ছিল।  নক্সালদের সীমাহীন আত্মত্যাগ আর অসাধারণ বীরত্ব সত্বেও চারু মজুমদার আর কানু সান্যালের নেতৃত্বে এদের রাজনীতি ব্যাক্তি-পূজা আর কাল্ট-প্রভাবান্বিত হয়ে পড়ে।  তখনকার পূর্ব বাংলায় নক্সাল রাজনীতির অনুসারীদের মধ্যে সবচেয়ে জঙ্গী আর সশস্ত্র ছিল সিরাজ শিকদারের নেতৃত্বাধীন মাও রিসার্চ সেন্টার পরে যে দলটি পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি নামে পরিচিত হয়। মোহাম্মদ তোয়াহার নেতৃত্বাধীন দলটি (পূর্ব পাকিস্তানের কম্যুনিস্ট পার্টি- এমএল) ছাড়া বাকীগুলো একইসাথে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার ডাকও দেয়। 

 

এদের জন্য সবচেয়ে বিব্রতকর এবং ভ্যাবাচেকা খাওয়া অবস্থার সৃষ্টি হয় যখন চীন প্রকাশ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা শুরু করে এবং বলতে থাকে এর পেছনে ভারতের সাম্রাজ্যবাদী অভিলাষই দায়ী।  চীনপন্থীরা মনে করতো গণচীন সবসময়েই পৃথিবীর নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের বন্ধু, সাম্রাজ্যবাদের আতঙ্ক।  তারা ভগ্নহৃদয় নিয়ে দেখতে পেলো চীন তার পররাষ্ট্রনীতির স্বার্থে পাকিস্তানের মতো মার্কিন তাঁবেদার রাষ্ট্রের রক্ষকের ভূমিকায় নেমেছে।  যার জন্য চুরি করলাম, সেই বলে চোর এই হলো তখন চীনপন্থীদের মনের অবস্থা। সত্যিই সেইসময়টা ছিল পূর্ব বাংলার চীনপন্থীদের জন্য নিদারুণ দুর্দশার কাল।      

 

অবশেষে দেখা গেল, নয়মাস ব্যাপী যুদ্ধের সময় চীনপন্থীদের প্রায় সবকটি দলকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হতে।  এমন কি তোয়াহার নেতৃত্বাধীন দলটিও যারা যুদ্ধটাকে দুই কুকুরে কামড়াকামড়ি বলে মূল্যায়ন করেছিল, পাক হানাদারদের সাথে নোয়াখালি অঞ্চলে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে।  তাদেরকে যুদ্ধ করতে হয়েছিল শুধু পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধেই নয়, অস্ত্র ধরতে হয়েছিল মুক্তি বাহিনী, মুজিব বাহিনী, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী এবং অস্ত্রের প্রতিযোগিতায় এমন কি অন্যান্য চীনপন্থীদের বিরুদ্ধেও।  যুদ্ধের নয়মাসে বামপন্থীদের ভুমিকা এবং বিপাকে পড়া নিয়ে আলোচনায় পরে আবার আসবো।   

   

ফিরে যাওয়া যাক একাত্তরের মার্চের সেই দিনগুলোতে আলোচনার নামে কি ঘটছিল তখন ঢাকায়?  ইয়াহিয়া খান দলবল নিয়ে ঢাকায় এলেন।  তার আগেই টিক্কা খানকে নিয়োগ দেন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর হিসেবে।  যদিও পঁচিশে মার্চের আগে পর্যন্ত তাঁর গভর্ণরের শপথটা নেয়া হয় নি।  কারণ প্রতিবাদের মুখে হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বি,এ, সিদ্দিকি টিক্কা খানকে শপথ পড়াতে অস্বীকৃতি জানান। (পরে খুব সম্ভবত এপ্রিল মাসে বি,এ,সিদ্দিকিই তাকে শপথ পড়ান।)

 

সরকার একদিকে আওয়ামী লীগের সাথে আলোচনার তোরজোড় করছে আর অন্যদিকে পূর্ব বাংলায়  সেনাবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধির আয়োজন চালিয়ে যাচ্ছে।  ভয় আর অনিশ্চয়তার মধ্যে সাধারণ জনগণের দিন কাটছে।  ছাত্ররা জঙ্গী কর্মসূচী পালন করছে প্রতিদিন।  মিলিশিয়া বাহিনী গঠনের ঘোষণা দিয়ে কুচকাওয়াজ করছে সামরিক কায়দায়।  শেখ মুজিবও তাঁর ধানমন্ডির বাসভবনের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে  এইসব সদ্যগঠিত মিলিশিয়া বাহিনীর কাছ থেকে সামরিক কায়দায় স্যালুট নিয়ে আর দিয়ে চলেছেন নিয়মিত ভাবে।  এই ব্যাপারগুলোকে সেই সময়েই আমার কাছে বাস্তবোচিত মনে হয় নি।  এইভাবে একটা জাতি একটা সুসংগঠিত সুশৃঙ্খল আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত সামরিক বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করবে এটা আমার কাছে মনে হচ্ছিল অবিশ্বাস্য।

 

চট্রগ্রামে আমরা তখন দিন কাটাচ্ছি দারুন উৎকন্ঠা আর উত্তেজনা নিয়ে।  প্রায় প্রতিদিন বৈঠকে বসছি নেতাদের সাথে।  মার্চের মাঝামাঝি কোন এক সময়ে আমাদের বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের কয়েকজনকে চট্টগ্রাম কলেজের কেমিস্ট্রি ল্যাব থেকে বোমা বানানোর উপযোগী কিছু কেমিক্যাল বেছে বেছে তুলে আনার দায়িত্ব দেয়া হলো।  কাজটা মোটেও কঠিন কিছু ছিল না।  কিন্তু তখন বেশ এডভেঞ্চারাস মনে হয়েছিল, রোমাঞ্চকর একটা অনুভুতিতে মনটা ছেয়ে ছিল।  ল্যাবের পাহারায় ছিল একজন মাত্র সিকিউরিটি গার্ড, তাকে আমাদের দলের দুজন জোর করে দূরে কোথায়ও নিয়ে বসিয়ে রাখে।  ঘন্টা খানেকের মধ্যে আমরা কাজটা সেরে নিয়েছিলাম। আজ মনে হয়, আমরা কত অপরিপক্ক ছিলাম, আমাদের নেতৃত্বও কতটা অদূরদর্শী ছিল, ঐ রকম কয়েকটা পটকার মতো বোমা দিয়ে আমরা পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হওয়ার পরিকল্পনা করছিলাম!    

 

সেদিনের আর একটা ঘটনা আজো মনে পড়ে।  ল্যাবোরেটরিতে ঢোকার আগে আরেকটু রাত হওয়ার অপেক্ষায় আমরা পায়চারী করছিলাম কলেজের ক্যাম্পাসে।  এমন সময়ে, রাত এগারটা নাগাদ হবে, দেখলাম বাংলার অধ্যাপক মমতাজউদ্দিন আহমেদ তাঁর ফ্ল্যাটের দিকে যাচ্ছেন।  সাথে আরো দুএকজন মনে হয় ছিল। তিনি ক্যাম্পাসেই থাকতেন।  আমাদের দেখে থামলেন। ছাত্র হিসেবে আমরা তাঁর পরিচিত।  কিন্তু একবারও জানতে চাইলেন না, আমরা অত রাতে ওখানে কি করছি।  দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা উঠলো স্বাভাবিক ভাবেই।  বললেন, তিনি লালদীঘির ময়দান থেকে ফিরছেন, আজ তাঁর জল্লাদের দরবার নাটকটা ওখানে মঞ্চস্থ হয়েছে।  টিক্কা খানের গভর্ণর পদে নিয়োগ এবং শপথ নিতে না পারা, এসব ঘটনা নিয়ে প্রহসনমূলক একটা নাটক লিখেছেন তিনি।  সাংস্কৃতিক ফ্রন্টে মমতাজউদ্দিন স্যার ছিলেন সামনের কাতারে। তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, স্যার, আপনার কি মনে হয়, সশস্ত্র যুদ্ধ হবে? আমরা কি স্বাধীন হবো? সরাসরি উত্তর না দিয়ে তিনি বলেছিলেন, এটা বায়ান্ন নয়, একাত্তর হয়তো বলতে চেয়েছিলেন, আর প্রতিবাদ নয়, এবার প্রতিরোধ, এবার আর আমরা শুধু শহীদ হবো না।

____________________________________________

 

বুর্জোয়া শব্দটা বামপন্থীদের মুখেই বেশি শোনা যায়, তাই এই লেখায় বুর্জোয়া রাজনীতির উল্লেখ দেখে হয়তো অনেকেই মনে করবেন, আমি একটা বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গী থেকে একাত্তরের ঘটনাবলীর বিশ্লেষন করছি। অস্বীকার করছি না, আমার একটা বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গী আছে।  এই দৃষ্টিভঙ্গীটাকে আবৃত রাখার কোন কারণ আমি দেখি না।  তবুও একটু ব্যাখ্যা দেয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না।  বুর্জোয়া কথাটা এসেছে ফরাসী বুর্জ (bourg) শব্দ থেকে, যার অর্থ শহর।  তাই বুর্জোয়া শব্দের অর্থ শহুরে। শুধু শহুরে নয়, সচ্ছল শহুরে। গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী খেটে খাওয়া নিম্নবিত্ত সাধারণ জনগণের চেয়ে এবং শহরের দিন-আনা-দিন-খাওয়া বা খেতে-না-পাওয়া শ্রমিকদের চেয়ে এরা বেশি শিক্ষিত, অগ্রসর ও প্রভাবশালী।  সচ্ছল শহুরেরাই নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর সংগঠক।  স্বভাবতই বুর্জোয়া দলগুলো এদেরই রাজনৈতিক দল।  বুর্জোয়া রাজনীতি এদের শ্রেণীস্বার্থ রক্ষারই রাজনীতি।  জাতীয়তাবাদী  রাজনীতি প্রায় সবসময়েই বুর্জোয়া রাজনীতি, যদিও বুর্জোয়া রাজনীতি অনেকসময় জাতীয়তাবাদী নাও হতে পারে।  আওয়ামী লীগ একাত্তরে যে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ধ্বজাধারী ছিল  তাকে বুর্জোয়া রাজনীতি ছাড়া আর কিছু বলা যায় না।  বুর্জোয়া রাজনীতিতে স্বাভাবিকভাবেই নিজেদের জন্যে ব্যবসা-বানিজ্যে অধিক সুযোগ-সুবিধার দাবী থাকবে, শ্রমিক-কৃষকদের দাবী-দাওয়া তেমন প্রাধান্য পাবে না।  আওয়ামী লীগের ছয়দফায়ও ব্যবসা-বানিজ্যে বাঙ্গালীদের অধিকতর সুযোগ-সুবিধার দাবী প্রাধান্য পেয়েছিল।  শ্রমিক-কৃষকদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের কথা তেমন ছিল না।  বুর্জোয়া রাজনীতির লক্ষ্য থাকবে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে দাবী-দাওয়া আদায়ের।  শক্তি-প্রয়োগের রাজনীতি, জোর করে অধিকার আদায়ের রাজনীতি তাই সাধারণত বুর্জোয়া রাজনীতির পর্যায়ে পড়ে না।  

 

নভেম্বর ২৭, ২০০৯

(চলবে)