প্রথমাংশ

দ্বিতীয়াংশ

এবার তবে গহনে সাঁতার

গুণি উদ্বিগ্ন প্রহর

যুগের চিতায় দগ্ধ বিকলপক্ষ পাখির চোখে পঙ্গুতার রাত নেমে এলেও উড্ডয়নাকাঙ্ক্ষা তাক করে থাকে দিবালোকের দিকে। এরকম বিরূপ সময়কালে নীড় বাঁধতে হয় ভস্মস্তূপেই– কারণ স্বপ্নের ছায়া আজও বেঁচে আছে মরীচিকাময় হলেও। জাগে দূর অতীত, নারীরূপী গীতরসধারা। ভালোবাসার সুর-প্রস্রবনে লুকিয়ে থাকা দহনের তৃষা– অনেকানেক মেঘ, রজনী, চাঁদ ডিঙিয়ে ঝরে গেছে। মরে গেছে বাসনা-ব্যঞ্জনা। সব পর্যবসিত তাই ফাঁকিতে। কিন্তু তবু, সে নারী– সে মৃত্তিকা মাধুর্যময়ী। বন্ধন আর বঞ্চনা পাশাপাশি ফলে বলে ভস্মস্তূপে মণ্ডিত এ মৃত্তিকাকেই আপাতত ঠিকানা করতে হয়। আর তখন কাশ্মিরী মেয়ের কাছে কিছু আলো চাওয়াও অপরাধ মনে হয় না। কিন্তু এ এমন এক কাল যে, মেয়ে হয়েও তার সাপের মতো চোখ, ধারালো দাঁত, বিষময় দৃষ্টি। মৃত্যু-তুহীন কতো দীর্ঘ হবে তবে এ বিরহ ও জঠরাগ্নির শিখা ? এসব ক্লেদে পুড়ে পুড়েই তবু ভীষণরকম বাঁচা। আকাশ দেয় না কোনো বন্ধুতার ছায়া, আশ্রয়– গতিতে নেমে আসে যতি। ভাঙা ডানাই হয় ভরসা। দাঁত খিচিয়ে ব্যঙ্গ করে দুর্বোধ্য সময়– প্রেম নেই কোথাও, শুধু বণিকবৃত্তি। কুকুরতুল্য এক ধীকৃত-যাপন। তবু, কেউ একজন বাদ্শাযাদীর আগমন আশায় কতোরকম স্বপ্নই না চাড়া দিয়ে ওঠে মনে। স্বপ্ন দেখায় কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। হোক কেউ হারু মিয়ার বস্তিবাসী বিড়ি-বাঁধা কামলা। প্রোলেটারিয়ানদের কীসের নিষেধাজ্ঞা, লজ্জাই বা কীসের– যেখানে উলঙ্গ বক্ষের উপর দিয়ে দাবড়িয়ে চলে যায় আরবীয় ঘোড়া ? যাদের চকচকে সোনার ঘড়ি, উঁচু অট্টালিকা, তাদের সাথে বন্ধকী জীবনধারীদের একটি সেতু রচনার ভাবনাও আপোষকামী মস্তিষ্কে জাগে কান্তিকর অবসরে। যেই স্বপ্ন-সেতু প্রণোদিত করতে পারে আকাশে নীড় বাঁধবার জন্যে– কোনো চাঁপাফোটা চৈত্রে। জেগে ওঠা আদিম বাসনা নিয়ে এসেছে যে হাওয়ার বারতা, অন্ধগভীর রাত্রিতেও তো সে হাওয়া আড়াল-আলোর কামনা জাগিয়ে তুলতে পারেই– যদিও ভিখারির মুরোদ ভিক্ষাদানে নিহিত নেই, থাকবার কথা নয়। একটি রেনকোটের ইচ্ছাও তবু দুর্মর হয়, হতে পারে। কিন্তু রোমান্টিক এই স্বপ্নই সব নয় মানুষের, তার চেয়েও বড় হয় ক্ষুধা। লাগাতার জঠরোত্তাপ সংগ্রামী করে তুলে ধুম্রবরণ দগ্ধদিনের বাসিন্দাদের, লজ্জাহীন চাতুরী আর অভিনয়ের বিরুদ্ধে। হায়, অসাম্য তবু দীর্ঘজীবী হয়! ব্যর্থ হয় সব মুক্তির উড়াল। নেমে আসে স্বপ্ন দেখায়ও কান্তি। আহ অপঘাত, ভ্রান্ত-প্রহর!

প্রান্তিক অবসরে

কতোদিন এসেছে, গেছে। সেসব দিনই চাপিয়ে দিয়ে গেছে এই উপনিবেশের জগদ্দল। এই ভার থেকে বাইরে বেরুনোর জন্যেই না নানারঙ স্বপ্ন বোনা, যদিও মঞ্জিল জানা নেই। আর এর মধ্যে বাইশে শ্রাবণ জুড়ে মৃত্যু নেমে আসে। যে-মৃত্যু, গৌরবে বেঁচে থাকবার যোগায় আরো আরো প্রেরণা। এ মৃত্যু-বীজ নবদিনের জন্মের সম্ভাবনা নিয়ে মাটিতে ঘুমাবে। অস্তপারের আকাশকেও তাই জানিয়ে রাখা যায় প্রণতি। কেননা দুই শতাব্দীর গ্লানি চোখ ভরা– জল্লাদ মীরনের তীক্ষ্ণ তলোয়ারের ঝলসানি– ঘৃণা। হায় সিরাজ, হায় সিরাজ! প্রান্তর ব্যাপে ধ্বনিত হয়ে ওঠে ব্যাপ্ত হাহাকার।

ক্ষীণতর প্রাতিভাসিকতা

দামামা বিশ্বযুদ্ধের। জঙ্গি বিমান-বোমা-বেয়নেট। রক্তের স্রোত স্বপ্নহীন করে দিয়েছে সুবর্ণ আগামীকে। শরতের দশমী রাত তাই ঝরায় কেবল আঁখিজল। হায় বেদনা– একদিকে মনুষ্যনিধনে কামান দাগিয়ে মানুষ ব্যয় করে অঢেল অর্থ– অন্যদিকে দেহের বিন্দুবিন্দু ঘাম ঝরিয়ে, ক্ষয় মেনে নিয়ে বারোজন একসেরে আধপেটা খেয়ে বাঁচার মহড়া। যারা অপরের রক্তপান করতে সঙ্গীন উঁচু করে দণ্ডায়মান ; তাদের চেয়ে এরা আরো বড়ো যোদ্ধা বৈকি! কিন্তু বঞ্চনা তো পদে পদে সমাসীন। না, এ ক্ষুধা ও যুদ্ধনগরী রেখে বরং পঁচিশ বছর পূর্বের পিরোজপুরে বেড়িয়ে আসা ভালো শঙ্করপাশা গ্রামে– মধুমতি তীরে, হোক তা মনে মনে। না থাকুক আজ সেখানে ঘুঘুর অশান্ত ডাক, ঘাসের গালিচা। সবুজ মাঠ তবু আছে, আছে কাজেম বয়াতীর গৃহ, দফাদার বাড়ি। নাই যদিও রাতভর লোকপালা-জাগা, বাঁশির ভাটিয়ালী। বদলে গেছে দিন। যারা সে-সময়ে মক্তবে পাঠ মকশো করত, তারা আজ কাটা চামচের ঝনঝন তোলে, মাথা বেচে দিয়ে বাঁচায় প্রাণ। কিন্তু ভয় এখানেও ; কারণ, মৌমাছির গুঞ্জন নয়, আকাশ থেকে নিক্ষেণযোগ্য বোমার আতঙ্ক গ্রামেও পরিব্যাপ্ত। গ্রাম নয় যেনো ওটা গ্রামের লাশ। ফিরে আসা কলকাতায়। ওয়েলিংটন স্কোয়ারে, এসপ্লানেডের মোড়ে মোড়ে ক্রূর হাসির শুধুই চাবুক। বিগত হয়ে যাওয়া শত প্রাণ, শত মমি কাঁদে। সরীসৃপের মতো হন্তারক ঘুরে বেড়ায়। হাজারো মৃত-আত্মার পাহারায় হাতে মশাল নিয়ে নতুন দিনের সন্ধানে তাই যাত্রাপাত। অনাগত সেই সূর্য-পরিক্রম দিনের জন্যেই তো এই বেঁচে থাকা।

নবতার দিকে দৃপ্ত পদক্ষেপ

মৃত্যুমুখী দিনের সীমায় আরো কতবারই যে নতুন দিনের জন্যে অপেক্ষা করেছে মানুষ। আবারও তবে অপেক্ষা। একাধটু সম্ভাবনা তো ঝিলিক দিয়েও উঠছে। যদিও বারবার ঝড় আসে, বারবার ভূলুণ্ঠিত হয় কামনা-বাসনা। মানুষ তবু নির্লজ্জের মতো আবারও আশায় মাতে। তার চেয়ে বরং এই ভালো, পলাশরূপী ঝরা বাসনারা এসে ইস্পাত কঠিন দিন রচনার সমস্ত ভার ছিন্ন করে দিক। কত কিছুই তো ছিল আমাদের। রূপালী জোয়ারে ভাসা সমুদ্র, দূর বনানীর ছায়া। সেসব রচিত ছিল যাদের স্বপ্ন-সূতোয়– আজ তারা নেই, দুর্বিষহ দিনের সৈনিক তারা আজ স্মরণ-নির্ভর। আগামী প্রজন্ম যদি বিগত সব স্বপ্নের উপর বাঁধে ঘর– তাদের প্রতিও রেখে যেতে হবে সমর্থন। চাওয়া পাওয়া তো অশেষ। সকল প্রাপ্তির শেষেই মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে নব-নব প্রয়োজন। তারারা আবার পার হয়ে আসে যুগের বেড়ী, আবারও উজ্জ্বল হয় পরীদের চোখ। সীমান্ত ঘিরে বিরোধ নেমে আসে আবারও। ফলে সুর নয়– বিদ্রোহী হুঙ্কারই প্রাসঙ্গিক। কোনো বাঁশি নয়, অসিই প্রার্থিত। অহিংসা-মন্ত্র পিছে থাক, এবার হিংস্র প্রতিরোধ। মৃত্যু দলিত হোক বাঁচার পণের কাছে। ছলচাতুরীর আড়ালে ফণা ধরে থাকা কেউটের প্রতি কোনো সহমর্মিতা নেই। আগুন হয়ে কাজেই জ্বলে ওঠা রাজপথ প্রকম্পিত করে দিয়ে। জনতার মনের আগুন সহজে নেভে না। ক্ষমাহীন এ আগুনের জোয়ার হানা দেবে একদিন সিংহ দরোজায়। রাজপথে হাজার জনতার সাথে শামিল হবে আরো আরো হাত। দিনে দিনে জমিয়ে তোলা দুর্বহ পাপের বোঝা লঘু করবার পণে আজ এই গণরোষ। এই মানববন্ধন। মৃত্যু আসে নেমে। কিন্তু সব মৃত্যু মরে যাওয়া তো নয়। কেননা ‘মানুষ মরে গেলে তবুও মানব থেকে যায়…’। ঘরে ঘরে রেখে যায় জীবনের উন্মাদনা। এই উন্মাদনা, মৃত্যুহীন মানবের নাম-ধাম, নির্ভিক নবীনকে করে তোলে বহ্নিমান। আর এই বহ্নিই রাতের পাহাড় থেকে খসিয়ে দেয় পাথরের মতো অন্ধকার– যে অন্ধকার গোটা ভারত জুড়ে দু’শো বছর শুয়ে ছিল অতিকায় সাপের মতোন। রেড রোডে ঝলসে ওঠে উদয়াচল। বাজে নতুন দিনের ঘণ্টা। (চলবে)