আবুল কাশেম
নানা কারণে এই ধারাবাহিক রচনাটি কিছুদিনের জন্য স্থগিত ছিল। বাকী অংশ এখন নিয়মিত প্রকাশের আশা রাখছি।

[রচনাটি এম, এ, খানের ইংরেজি বই থেকে অনুবাদিত “জিহাদঃ জবরদস্তিমূলক ধর্মান্তরকরণ, সাম্রাজ্যবাদ ও ক্রীতদাসত্বের উত্তরাধিকার” গ্রন্থের ‘ইসলামি ক্রীতদাসত্ব’ অধ্যায়ের অংশ এবং লেখক ও ব-দ্বীপ প্রকাশনের অনুমতিক্রমে প্রকাশিত হলো।]

ইসলামি ক্রীতদাসত্ব, খণ্ড ১১

লেখক: এম, এ, খান

রাজপ্রাসাদ ও দরবারে নিয়োগ: রাজকীয় প্রাসাদ ও দরবারে ক্রীতদাস নিয়োগের নিম্নোক্ত বিবরণ দিয়েছেন অধ্যাপক লাল (সংক্ষেপিত)।১৫০. রাজদরবারের বিভিন্ন বিভাগে বিপুল সংখ্যক ক্রীতদাস নিয়োগ করা হতো। তাদের মধ্যে বড় একটা সংখ্যা কাজ করতো গুপ্তচর হিসেবে। হাজার হাজার ক্রীতদাস নিয়োজিত হতো রাজস্ব আদায়ের জন্য রাজস্ব বিভাগে ও সরকারি সংবাদ আদান-প্রদানের জন্য ডাক বিভাগে। প্রাসাদেও বিপুল সংখ্যক ক্রীতদাস নিয়োজিত হতো। আকবর, জাহাঙ্গীর ও শাহজাহানের হেরেমে ৫,০০০ থেকে ৬,০০০ নারী (স্ত্রী ও উপপত্নীরা) থাকতো এবং তাদের প্রত্যেকের জন্য কয়েকজন থেকে বহু সংখ্যক ‘বাঁদী’ (ক্রীতদাস নারী) থাকতো পরিচর্যা করার জন্য। তাদের স্ত্রী ও উপপত্নীরা পৃথক পৃথক কামরায় থাকতো এবং তাদের পাহারায় থাকতো পর্যায়ক্রমে নারীরক্ষী, খোজাকৃত রক্ষী ও দারোয়ান।

ঢোল, ট্রামপেট বা ভেরী ও বাঁশি বাজানোর জন্যও ক্রীতদাসদের বড় একটা দল নিয়োজিত থাকতো। রাজকীয় ব্যক্তিত্বদের পাখা টেনে বাতাস করা ও মশা তাড়ানোর জন্যও ক্রীতদাসরা সার্বক্ষণিক নিয়োজিত থাকতো। শিহাবুদ্দিন আল-ওমারী লিখেছেন, সুলতান মোহাম্মদ শাহ তুঘলকের (মৃত্যু ১৩৫১) সেবায়:

‘ছিল ১,২০০ চিকিৎসক; ১০,০০০ বাজ পাখিওয়ালা, যারা ঘোড়ায় চড়ে পাখি শিকার খেলার জন্য প্রশিক্ষিত পাখি বহন করতো; পাখি ধরার জন্য ৩০০ ক্রীতদাস এগিয়ে গিয়ে শিকারের টোপ রাখতো; শিকারে তিনি যখন বের হতেন তখন তার সাথে থাকতো ৩,০০০ নবিশ; তার খাবার সঙ্গী ছিল ৫০০ লোক। তিনি পোষণ করতেন ১,২০০ সঙ্গীত-শিল্পী; এছাড়াও প্রায় ১,০০০ ক্রীতদাস সঙ্গীত-শিল্পী যারা গান শেখানোর দায়িত্বে নিয়োজিত থাকতো; এবং আরবি, ফারসি ও ভারতীয় ভাষার ১,০০০ কবি। রাজকীয় রন্ধনশালায় যোগান দেওয়ার জন্য প্রতিদিন ২,৫০০ ষাঁড়, ২,০০০ ভেড়া ও অন্যান্য প্রাণী জবাই করা হতো।’

এমন বিশাল কর্মকাণ্ডে ও রাজপ্রাসাদের অন্যসব টুকিটাকি কাজে কত সংখ্যক ক্রীতদাস দৈনন্দিন প্রয়োজন হতো তা লেখা হয়নি, তবে সেটা অনুমান করা অসম্ভব নয়। আমোদ-প্রমোদ, ক্রীড়া-কৌতুক, শিকার, বন্দুক-ছোঁড়া, কবুতর উড়ানো ও এরূপ কাজে বহু ক্রীতদাস নিয়োজিত হতো। সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির সংগ্রহে ৫০,০০০ কবুতর-বালক ছিল। মোরল্যান্ড লিখেছেন: ব্যাঙ ও মাকড়শা থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রাণীকে লড়াই শেখানোর জন্য ক্রীতদাস নিয়োগ করা হতো। সম্রাট হুমায়ুনের প্রতিদ্বন্দ্বী শের শাহ যদিও তেমন শক্তিশালী ও সুপ্রতিষ্ঠিত শাসক ছিলেন না, তথাপি তার ডাক যোগাযোগের জন্যই নিযুক্ত ছিল ৩,৪০০ ঘোড়া এবং তার আস্তাবলে ছিল প্রায় ৫,০০০ হাতি। প্রতিটি হাতিকে দেখ-ভাল করার জন্য সাতজন করে ক্রীতদাস নিয়োজিত থাকতো। সম্রাট জাহাঙ্গীর তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন: ইংল্যান্ড থেকে উপহার হিসেবে আনা তার এক একটি কুকুরকে দেখাশোনা করার জন্য চার জন করে ক্রীতদাস ছিল। ওদিকে আহমেদ বেন নাসিরি জানান: মরক্কোর সুলতান মৌলে ইসমাইলের আস্তাবলে প্রায় ১২,০০০ ঘোড়া ছিল এবং প্রতি ১০টি ঘোড়া দেখাশোনা করার জন্য দুইজন করে ক্রীতদাস নিয়োজিত থাকতো।[১৫১] সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য হারেম-রক্ষক হিসেবে কাজ করা পেলো জানায়: সুলতান মৌলে ইসমাইলের বিশাল হারেমে ৪,০০০ উপপত্নী ও স্ত্রী ছিল।[১৫২] স্পষ্টতই হারেম পাহারার জন্য বিপুল সংখ্যক ক্রীতদাস নিয়োজিত থাকতো।

[আগামী পর্বে আলোচিত হবেঃ ক্রীতদাসদের ভাগ্যঃ গৃহস্থালি ও কৃষিকর্মে নিয়োগ]
সূত্রঃ
150. Lal (1994), p. 99-102
151. Milton, p. 132
152. Ibid, p. 120
————–
ইসলামি ক্রীতদাসত্ব, খণ্ড ১২

লেখক: এম, এ, খান

গৃহস্থালি ও কৃষিকর্মে নিয়োগ: রাজকীয় প্রাসাদের কাজে হাজার হাজার ক্রীতদাস নিয়োজিত থাকতো। সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা, প্রাদেশিক গভর্নররা ও উচ্চপদস্থ সেনারা তাদের স্ব-স্ব দরবার ও গৃহস্থালির কাজে শত শত, এমনকি হাজার হাজার, ক্রীতদাস নিয়োগ করতো। সম্রাট জাহাঙ্গীরের এক কর্মকর্তাই রাখতেন ১,২০০ খোজা ক্রীতদাস। যুদ্ধাভিযান থেকে মুসলিম যোদ্ধারা তাদের অংশ হিসেবে অনেক ক্রীতদাস পেতো। তাদের কিছু অংশকে বিক্রি করে দিয়ে বাকিদেরকে গৃহস্থালির, গৃহের বাইরের ও অন্যান্য কাজকর্মে নিয়োগ করা হতো মালিকদের সবরকম আরাম-আয়েশের নিমিত্তে।

‘ওমরের সন্ধি’তে বিধৃত ইসলামি আইন অনুযায়ী অমুসলিমরা মুসলিম মালিকানাধীন ক্রীতদাস ক্রয় করতে পারতো না। অতএব মুসলিম-অধ্যুষিত দেশগুলোতে কেবলমাত্র মুসলিমরাই বৈধভাবে ক্রীতদাস কিনতে পারতো। ইসলামের প্রাথমিককালে সম্ভবত এ নিষেধাজ্ঞা কঠোরভাবে বাস্তবায়িত হতো। ইসলামের প্রাথমিক দশক ও শতাব্দীগুলোতে মুসলিম জনসংখ্যা ছিল কম। অপরদিকে তাদের বিজয়ের দ্রুততর সাফল্যের কারণে বিক্রির উদ্দেশ্যে আনীত ক্রীতদাসের সংখ্যা ছিল প্রচুর। ক্রীতদাসের এ অতিরিক্ত সরবরাহে এমনকি একেবারে সাধারণ মুসলিমও অনেক ক্রীতদাসের মালিক হতো, যে কথা ইতিপূর্বে বলা হয়েছে। কোনো কোনো অভিযানে বন্দির সংখ্যা এতই বেশি ছিল যে, তাদেরকে দলবদ্ধভাবে বিক্রি করতে হতো, যেমনটা করেছিলেন খলিফা আল-মুতাসিম ৮৩৮ সালে।

একেবারে সাধারণ দরিদ্র মুসলিম মালিকদের গৃহস্থালিতেও কয়েকজন থেকে বহু ক্রীতদাস কী কাজ করতো? স্পষ্টতই তাদেরকে নিয়োজিত করা হতো কল্পনাসাধ্য সকল শ্রমে ও টুকিটাকি কাজে: সকল প্রকার গৃহকর্ম ও দৈহিক প্রচেষ্টার প্রয়োজনমূলক যে কোনো কাজে, যেমন পশু চরানো, বাড়ির পিছনের আঙ্গিনায় ও ক্ষেত-খামারের কাজে। এরূপে ক্রীতদাসরা বিনামূল্যে মালিকদের জন্য আরাম-আয়েশ ও স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ এবং ভোগ-বিলাসের জীবনযাপনে সক্ষম করতে সর্বোপরি প্রয়াস করতো। লুইস জানান: ‘ক্রীতদাসরা, যাদের অধিকাংশই আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ, অর্থনৈতিক প্রকল্পসমূহে নিযুক্ত হতো ব্যাপক সংখ্যায়। ইসলামের আদিকাল থেকে দক্ষিণ ইরাকের লবণক্ষেত্রগুলো নিষ্কাষনের কাজে বিপুল সংখ্যক কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাস নিয়োগ করা হতো। দুরবস্থার কারণে তারা ধারাবাহিকভাবে বিদ্রোহ করে। মিশরের মধ্যাঞ্চল, সুদানের স্বর্ণখনি ও সাহারার লবণখনিগুলোতে কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসদেরকে নিয়োগ করা হতো।’[১৫৩] সিগল যোগ করেন: ‘তারা খানা-খন্দক খনন করতো, জলাশয়ের পানি নিষ্কাষন করতো, লবণক্ষেতের আবরণ পরিষ্কার করতো। তারা খামারে ইক্ষু ও তুলার চাষ করতো, এবং তাদেরকে গাদাগাদি করে রাখা হতো শিবিরে, প্রতিটিতে ৫০০ থেকে ৫,০০০ জন করে।’[১৫৪] ক্রীতদাসরা ভয়ঙ্কর বিদ্রোহ শুরু করলে মুসলিম শাসকরা পরে কোনো বিশেষ প্রকল্পে ব্যাপক সংখ্যায় ক্রীতদাস সমাবিষ্ট করার ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করেন।

উনবিংশ শতাব্দীর ইসলামি গিনি ও সিয়েরালিওনে ক্রীতদাস শহরগুলোর মালিকরা ক্রীতদাসদেরকে কৃষি খামারে কাজ করাতো।[১৫৫] পূর্ব-আফ্রিকায় সুলতান সাঈদ সাইয়িদের (মৃত্যু ১৮৫৬) ক্রীতদাসরা জাঞ্জিবার ও পেম্বা দ্বীপের বিরাট বিরাট লবঙ্গ খামারে কাজ করতো।[১৫৬] সিগল নেহেমিয়া লেব্টসিওনের উদ্ধৃতি দিয়েছেন যে, ‘পঞ্চদশ শতাব্দীতে উত্তরাঞ্চলীয় মরক্কোর বর্ধনশীল কৃষি-খামারে ক্রীতদাসের খুব চাহিদা ছিল।’ উনবিংশ শতাব্দে, বলেন সিগল: ‘তুলার দাম যখন খুব চড়া ছিল এবং সুদান থেকে ক্রীতদাস সরবরাহের ছিল প্রাচুর্য, তখন তারা মিশরে শস্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে ব্যবহৃত হয়; অপরদিকে বিপুল সংখ্যক ক্রীতদাস পূর্ব-আফ্রিকার উপকূলে শস্য উৎপাদনে এবং জাঞ্জিবার ও পেম্বা দ্বীপে লবঙ্গ উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়।’[১৫৭] উনবিংশ শতাব্দে প্রায় ৭৬৯,০০০ কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাস জাঞ্জিবার ও পেম্বা দ্বীপে আরবদের খামারে নিয়োজিত ছিল; সে সাথে ৯৫,০০০ ক্রীতদাসকে পূর্ব-আফ্রিকা থেকে শুধুমাত্র মাস্কারেমি দ্বীপপুঞ্জের আরব খামারে পাঠানো হয়।[১৫৮]

[আগামী পর্বে আলোচিত হবেঃ যৌনদাসত্ব ও উপপত্নী প্রথা]

সূত্রঃ
153. Lewis (2000), p. 209
154. Segal, p. 42
155. Rodney W (1972) In MA Klein & GW Johnson eds., Perspectives on the African Past, Little Brown Company, Boston, p. 158
156. Gann L (1972) In Ibid, p. 182
157. Ibid, p. 44-45
158. Ibid, p. 60-61
————–

ইসলামি ক্রীতদাসত্ব, খণ্ড ১৩

লেখক: এম, এ, খান

যৌনদাসত্ব ও উপপত্নী প্রথা

নারী ক্রীতদাসরা সাধারণত গৃহপরিচারিকা ও বাড়ির আঙিনার কাজকর্মে নিয়োজিত হতো; আর সুন্দরী তরুণী ক্রীতদাসীকে মালিকের যৌন আকাক্সক্ষাও পূরণ করতে হতো। এরূপে তারা শুধু শারীরিক শ্রম ও মালিকের যৌন লিপ্সাই মেটাতো না, নতুন সন্তান উৎপাদনের দ্বারা মুসলিম জনসংখ্যার বৃদ্ধিও ঘটাতো। যৌনদাসত্ব ইসলামে আদৌ তুচ্ছ বিষয় ছিল না। এ ব্যাপারে আল্লাহ কোরানে বারংবার মুসলিমদেরকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে এর চর্চার প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব প্রদর্শন করেছেন। নবি মুহাম্মদ কমপক্ষে তিনজন ক্রীতদাস-বালিকাকে তার উপপত্নীরূপে গ্রহণ করেছিলেন, যেমন বানু মুস্তালিক গোত্রের জুয়াইরিয়া (বুখারী ৩:৪৬:৭১৭), বানু কোরায়জা গোত্রের রায়হানা এবং মুহাম্মদের হুমকিপত্র পাওয়ার পর মিশরের গভর্নর কর্তৃক তাঁকে শান্ত করণের নিমিত্তে প্রেরিত মারিয়া। নবি বন্দিদের হিস্যা হিসেবে প্রাপ্ত তাঁর অংশ থেকেও ক্রীতদাস বালিকাদেরকে উপপত্নী হিসেবে রাখার জন্য তাঁর অনুসারীদের মাঝে বণ্টন করে দিতেন। এক দৃষ্টান্তে তিনি আলি (তাঁর জামাতা ও ইসলামের চতুর্থ খলিফা), ওসমান বিন আফ্ফান (তাঁর জামাতা ও তৃতীয় খলিফা) এবং ওমর ইবনে খাত্তাবকে (তাঁর শশুর ও দ্বিতীয় খলিফা) একজন করে ক্রীতদাস-বালিকা দিয়েছিলেন।[১৫৯] কোরানের ২৩:৫-৬ আয়াতের আলোকে দাসপ্রথার ব্যাখ্যায় ইসলামি পণ্ডিত আবুল আলা মওদুদী (মৃত্যু ১৯৭৯) লিখেছেন:

গোপনাঙ্গ রক্ষার সাধারণ বা সর্বজনীন আদেশ থেকে দুই প্রকারের নারীকে বাদ রাখা হয়েছে: (ক) স্ত্রীগণ, (খ) আইনগত বা বৈধভাবে কারো অধিকারে থাকা নারী অর্থাৎ ক্রীতদাস-বালিকা। এরূপে আয়াতটিতে (কোরানে ২৩:৫-৬) স্পষ্টরূপে আইন করা হয়েছে যে, একজন মুসলিম তার স্ত্রীর মতোই তার ক্রীতদাসীর সঙ্গে যৌন-সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে, অধিকার বা মালিকানার ভিত্তিতে, বিবাহের ভিত্তিতে নয়। বিবাহের শর্ত থাকলে ক্রীতদাস-বালিকাও স্ত্রীগণের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে এবং তাদেরকে পৃথকভাবে উল্লেখের প্রয়োজন পড়তো না।[১৬০]

ইসলামে যৌনদাসী প্রথার সংযোজন ও তার উপরোক্ত উদ্দেশ্যে সম্পর্কে ‘হেদাইয়াহ্’ বলে: নারী-ক্রীতদাস রাখার উদ্দেশ্য হলো ‘সহবাস ও সন্তান উৎপাদন।’[১৬১] কাজেই নারী-ক্রীতদাস ক্রয়ের ক্ষেত্রে শারীরিক সুস্থতা, নিয়মিত ঋতু ও সন্তান-ধারণ ক্ষমতার উপস্থিতি ইত্যাদি ছিল বিশেষ বিবেচ্য বিষয়। ‘হেদাইয়াহ্’ অনুসারে, নারী ক্রীতদাসের মুখে ও বগলে দুর্গন্ধ থাকলে তা সে ত্রুটিপূর্ণ বিবেচিত। স্পষ্টতই এর কারণ হল চুম্বন, আদর ও যৌন-সহবাসের জন্য সে যথার্থ নয়। কিন্তু পুরুষ ক্রীতদাসের ক্ষেত্রে এগুলো ত্রুটি নয়। ‘হেদাইয়াহ্’ আরো নির্দিষ্ট করেছে যে, একজন নারী-দাসীর দু’জন মালিক থাকলে সে যার সাথে যৌন-সম্পর্ক গড়ে তুলবে, তার সম্পদ বলে গণ্য হবে।[১৬২] ফতোয়া-ই-আলমগীরি নির্দিষ্ট করেছে যে, যদি কোনো নারী-ক্রীতদাসের স্তন খুব বড় বা যোনি খুব ঢিলা ও প্রশস্ত হয়, ক্রেতার অধিকার রয়েছে তাকে ফেরৎ দিয়ে মূল্য ফিরিয়ে নেওয়ার। স্পষ্টতই এর কারণ ছিল যে, মালিক এরূপ নারীর সঙ্গে যৌনমিলনে তার আশানুরূপ আনন্দ ও সন্তুষ্টি পেতো না। অনুরূপভাবে ক্রেতা তার কেনা ক্রীতদাসীকে ফেরৎ দিতে পারতো সে কুমারী বা অক্ষতযোনির কিনা তার ভিত্তিতে।[১৬৩]

নবি মুহাম্মদের সময়েই নারী-ক্রীতদাস বাছাইয়ের এরূপ প্রক্রিয়া শুরু হয়। নবির অভ্যাস ছিল নিজের জন্য অল্প বয়সের অনন্যা সুন্দরী বন্দি নারীকে পছন্দ করার। খাইবারে নিজের জন্য কিনানার স্ত্রী সাফিয়াকে তিনি পছন্দ করেন, যখন শুনতে পান যে সাফিয়া ছিল অনিন্দ্য সুন্দরী এক বালিকা এবং একমাত্র নবির উপযুক্ত। এভাবে তিনি তাঁর জিহাদী সহচর দাহিয়াকে বঞ্চিত বা আশাহত করেন, প্রথমত যার ভাগে পড়েছিল সাফিয়া।[১৬৪] আরেক দৃষ্টান্তে, হাওয়াজিন গোত্রের আটক নারী বন্দিদেরকে নবি তাঁর জিহাদী সঙ্গীদের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়ার পর গোত্রটি তাদের নারীদেরকে ফেরৎ নেওয়ার জন্য প্রতিনিধি পাঠায় নবির কাছে। তিনি ছয়টি করে উটের বিনিময়ে প্রত্যেক বন্দি-নারীকে মুক্ত করতে রাজী হন। তাঁর শিষ্য উইয়ানা বিন হিসন তার ভাগে পড়া সম্ভ্রান্ত পরিবারের এক সুন্দরী নারীকে ফেরৎ দিতে অস্বীকার করে। তার আশা ছিল যে তার বিনিময় মূল্য হবে আরো বেশি। তা দেখে মুহাম্মদের আরেক অনুসারী জুবায়ের আবু সুরাদ মহিলাটিকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য উইয়ানাকে বুঝায়: ‘তার মুখমণ্ডল ঠাণ্ডা ও তার স্তনযুগল ঝুলে পড়া; সে পোয়াতি হবে না ও তার দুগ্ধে পুষ্টি নেই।’ উইয়ানা এ ব্যাপারে নবির আরেক সাহাবা আল-আকরার কাছে অভিযোগ করলে আল-আকরা তাকে বুঝায়: ‘আল্লাহর কসম! তুমি না পেয়েছো তাকে কুমারীরূপে তার পরিপূর্ণ যৌবনে, না মধ্যবয়সের সুঠাম-শারীরিক অবস্থায়।’[১৬৫]

যৌনকর্মে নারী-ক্রীতদাসের ব্যবহার কোরান, সুন্নত ও শরীয়তে সুস্পষ্টরূপে অনুমোদিত, যা ছিল ইসলামের সমগ্র ইতিহাসব্যাপী ব্যাপকভাবে চর্চিত একটি প্রথা। সুতরাং ইসলামিক আইনবেত্তা, ইমাম ও পণ্ডিতবর্গ এ প্রথাকে লজ্জাহীনভাবে প্রকাশ্য অনুমোদন দিয়েছে আধুনিককালেও। মুহাম্মদের সময় থেকে লুণ্ঠিত মালামালের ভাগ পাওয়ার প্রলোভন ছাড়াও যৌনদাসীরূপে ব্যবহারের জন্য নারীদেরকে বন্দি করার লোভ মুসলিম জিহাদীদেরকে পবিত্র ধর্মযুদ্ধে অংশগ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ উদ্দীপকরূপে কাজ করেছে; কেননা ইসলামি আইন অনুযায়ী হত্যাকারীরা নিহতদের স্ত্রী-সন্তান ও সম্পদের মালিক হবে। স্যার উইলিয়াম মুইর মনে করেন: ইসলামে যৌনদাসীর অনুমোদন থাকায় ‘নারীদেরকে বন্দি করার আশা যুদ্ধের প্রলোভনরূপে কাজ করেছে, যারা বৈধ উপপত্নীরূপে গণ্য হবে ‘তাদের দক্ষিণ হস্তের মালিকানাধীনরূপে’।’[১৬৬]

মুহাম্মদের নিজস্ব উপপত্নী বা যৌনদাসিত্ব চর্চার সুত্রে পরবর্তী সময়ে মুসলিম সমাজে তা ব্যাপকভাবে চর্চিত প্রথায় পরিণত হয়, কেননা বন্দিদের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। মুসলিম জনগণ কতজন যৌনদাসী রাখতে পারবে, ইসলামি আইনে তার কোনো সীমা নেই। সুতরাং লিখেছেন টমাস হিউজেস: ‘একজন মুসলিম কতজন ক্রীতদাস-বালিকার সঙ্গে সহবাস করতে পারবে, তার আদৌ কোনো সীমা নেই। এ সীমাহীন যৌন-লিপ্ততাকে পবিত্রকরণ করার কারণে অসভ্য জাতিগুলোর মাঝে ইসলাম ধর্ম এতটা জনপ্রিয়তা পেয়েছে, এবং মুসলিম সমাজে দাসপ্রথাকে এতটা জনপ্রিয় করে তুলেছে।’[১৬৭] লুইস লিখেছেন: ‘এরূপে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রের নারী-ক্রীতদাসীদেরকে বিপুল সংখ্যায় যোগাড় করে উপপত্নী কিংবা শ্রমিক-দাসীরূপে ব্যবহার করার জন্য মুসলিম বিশ্বের হারেমগুলো ভরে তোলা হয়। কিন্তু এ দু’টি কাজের মধ্যে সর্বদা পরিষ্কার কোনো ভিন্নতা ছিল না। কিছু ক্রীতদাসীকে প্রমোদ-শিল্পী, যেমন গায়িকা, নৃত্যশিল্পী ও বাদ্যকর হিসেবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো।’[১৬৮] এ সত্যতা সম্পর্কে রোনাল্ড সিগল বলেন: ‘বহুসংখ্যক নারী-ক্রীতদাস প্রয়োজন হতো বাদ্যকর, গায়িকা ও নাচনেওয়ালি বানানোর জন্য। গৃহস্থালির কাজের জন্য অনেক নারী-ক্রীতদাসকে ক্রয় করা হতো, অনেককে ক্রয় করা হতো উপপত্নীরূপে ব্যবহারের জন্য। শাসকদের হেরেমে অসংখ্য ক্রীতদাসী থাকতো। কর্ডোভার মুসলিম খলিফা তৃতীয় আবদ আল-রহমান (মৃত্যু ৯৬১)-এর হেরেমে ৬,০০০ উপপত্নী আর কায়রোর ফাতেমী রাজপ্রাসাদের হারেমে এর দ্বিগুণেরও বেশি উপপত্নী ছিল।’[১৬৯] ভারতের মুসলিম শাসকরাও এক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিল না। এমনকি বিজ্ঞ সম্রাট আকবরের হারেমেও ছিল ৫,০০০ নারী; এদিকে জাহাঙ্গীর ও শাহজাহানের প্রত্যেকের হারেমে ছিল ৫,০০০ থেকে ৬,০০০। অষ্টাদশ শতাব্দীতে সুলতান মৌলে ইসমাইলের হারেমে ছিল ৪,০০০ স্ত্রী ও উপপত্নী।

স্পষ্টতই আফ্রিকা থেকে ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য থেকে ভারত − সর্বত্রই মুসলিম শাসকরা হাজার হাজার যৌনদাসী যোগাড় করেছিলেন। ইসলামের সুবর্ণ যুগে রাজদরবারের কর্মকর্তা, সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গ, উচ্চপদস্থ সেনা ও প্রাদেশিক গভর্নররা ডজন-ডজন থেকে শত-শত এমনকি হাজার-হাজার ক্রীতদাস রেখেছে। মুসলিম ইতিহাসবিদদের লেখা অনুযায়ী এমনকি দরিদ্র মুসলিম গৃহস্থ বা সাধারণ দোকানদারও অনেক সংখ্যায় ক্রীতদাস রাখতো। সাধারণত যুবতী নারী-ক্রীতদাসদের সবত্রই তাদের মালিকদের চাহিদামতো যৌনক্ষুধা মেটাতে হতো। এটা প্রতীয়মান হয় যে, উপপত্নীরূপে রাখার জন্য নারীদেরকে বন্দি করা ক্রীতদাস-শিকারমূলক ইসলামি জিহাদের প্রধান আকর্ষণ বা লক্ষ্য ছিল; কেননা আফ্রিকা থেকে মুসলিম বিশ্বে বিক্রির জন্য প্রেরিত ক্রীতদাসদের মধ্যে প্রত্যেক পুরুষের বিপরীতে ছিল দু’জন নারী। অথচ নতুন বিশ্বে (আমেরিকা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ) ইউরোপীয়দের দ্বারা পাচারকৃত ক্রীতদাসদের মধ্যে প্রতি একজন নারীর বিপরীতে ছিল দু’জন পুরুষ।

নারীর প্রতি মুসলিমদের কামাচ্ছন্নতা ও যৌন-লিপ্ততার বিষয়টি প্রকটভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনকালে ভারতে বসবাসকারী নিকোলাও ম্যানুকসি’র। তিনি দেখতে পান: ‘সব পুরুষ মুসলমানই নারীপ্রিয়, যাদের প্রধান বিনোদন ও প্রায় একমাত্র আনন্দ হলো নারী।’[১৭০] সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে (১৬০৫-২৭) ভারত সফরকারী ডাচ নাগরিক ফ্রান্সিসকো পেলসায়ের্ত হেরেমে মুসলিম শাসক ও সম্ভ্রান্তদের যৌন-লিপ্ততা সম্বন্ধে লিখেছেন:

‘প্রত্যেক রাতে আমির নির্দিষ্ট স্ত্রীর কাছে বা ‘মহলে’ গমন করেন; সেখানে তিনি তার স্ত্রী ও দাসীদের কাছ থেকে উষ্ণ স্বাগতম পান, যে উদ্দেশ্যে তারা সেজেছিলো। যদি গরমের দিন হয়, তারা তার শরীর চন্দনের গুড়া ও গোলাপজল দিয়ে মর্দন করে দেয়। ধীরে ধীরে পাখার বাতাস চলে। তার স্ত্রী সর্বদা পাশে বসে থাকে আর কিছু ক্রীতদাসী প্রভুর হাত-পা ঘষে, কয়েকজন পাশে বসে গান গায় বা বাজনা বাজায় ও নৃত্য করে কিংবা অন্যান্য আনন্দ-বিনোদন দেয়। অতঃপর যদি উপস্থিত কোনো সুন্দরী ক্রীতদাসীকে তার ভাল লাগে, তাকে ডেকে নিয়ে তিনি উপভোগ করেন। অসন্তোষ প্রকাশে অক্ষম বা সাহসহীন তার স্ত্রী মনের ভিতরে রাগে ফুলতে থাকে, পরে সে ঐ ক্রীতদাসীর উপর তার আক্রোশ প্রকাশ করবে।’[১৭১]

তবে স্ত্রী হেরেম থেকে কখনোই এরূপ সুন্দরী ক্রীতদাসীদেরকে বহিষ্কার করতে পারতো না, কেননা তাকে মুক্ত করার ক্ষমতা ছিল একমাত্র মালিকের (তার স্বামীর) হাতে। মরক্কোয় সুলতান মৌলে ইসমাইলের প্রাসাদের ডাচ ক্রীতদাসী মারিয়া তার মিতেলেন হেরেমে ক্রীতদাস-বালিকা ও উপপত্নীদের নিয়ে সুলতানের যৌন-প্রমোদে লিপ্ততার চাক্ষুস বিবরণ রেখে গেছেন। মারিয়া লিখেছেন: ‘আমি সুলতানের কক্ষে তার সামনে ছিলাম, যেখানে তিনি অন্তত পঞ্চাশজন নারীর সাথে শয্যা গ্রহণ করেছেন… যারা মুখমণ্ডল রং করা ও দেবীর সাজে সজ্জিতা অসাধারণ সুন্দরী; তাদের প্রত্যেকের হাতে নানা বাদ্যযন্ত্র।’ মারিয়া যোগ করেন: ‘তারা বাদ্য বাজালো ও গান করলো, এমন সুশ্রাব্য সুর-সঙ্গীত, যার মতো এত সুন্দর গান আমি কখনোই শুনিনি।’[১৭২]

সংক্ষেপে: ক্রীতদাসী উপপত্নী বা যৌনদাসী প্রথা, যা মূলত সবচেয়ে অমর্যাদাকর ও অমানবিক পতিতাবৃত্তির সমতুল্য, তা আধুনিক যুগ পর্যন্তও ইসলামি রীতি ও প্রথায় বিশিষ্ট স্থান পেয়েছে। অটোমান সুলতানরা ১৯২১ সালে সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি পর্যপ্ত সুন্দরী নারীতে পরিপূর্ণ হারেম বলবত রেখেছেন। ভারতবর্ষে মুসলিম আক্রমণকারীদের দ্বারা প্রথম বিজিত সিন্ধুর বাহাওয়ালপুর রাজ্যটি ১৯৫৪ সালে বিলুপ্ত হয়ে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পূর্বে এর সর্বশেষ নবাব তার হারেমে রেখেছিলেন ৩৯০ জন নারী। নবাব বয়স্ক হওয়ার পূর্বেই যৌন-অক্ষম হয়ে পড়লে তার বিপুল সংখ্যক উপপত্নী ও স্ত্রীর যৌন-চাহিদা মেটাতে সব রকমের উপকরণ ব্যবহার করতেন। পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী যখন তার প্রাসাদ দখল করে, তারা তার সংগৃহীত প্রায় ছয়শ’ ‘ডিলডো’ বা যৌন-উপকরণ পায়, যার কিছু ছিল মাটির তৈরি, কিছু ইংল্যান্ড থেকে আনা ব্যাটারি-চালিত। এ ঘটনা ঢাকতে সেনাবাহিনী গর্ত খুঁড়ে সেগুলোকে চাপা দেয়।[১৭৩] আজও আরব বাদশাহরা নিজ নিজ প্রাসাদে বড় আকারের হারেম রেখে চলেছেন।

[আগামী পর্বে আলোচিত হবেঃ খোজা ও গেলেমান]

সূত্রঃ

159. Ibn Ishaq, p. 592-93; Al-Tabari (1988 imprint) The History of Al-Tabari, State University of New York Press, New York, Vol. IX, p. 29

160. Maududi SAA, The Meaning of the Quran, Islamic Publications, Lahore, Vol. III, p. 241, note 7

161. Lal (1994), p. 142

162. Ibid, p. 145, 147

163. Ibid, p. 145

164. Ibn Ishaq, p. 511; Muir W (1894) The Life of Mahomet, Voice of India, New Delhi, p. 377

165. Ibn Ishaq, p. 593

166. Muir, p. 74, notes; also Quran 4:3

167. Huges, p. 600

168. Lewis (2000), p. 209

169. Segal, p. 39
170. Manucci N (1906) Storia do Mogor, trs. Irvine W, Hohn Murray, London, Vol. II, p. 240.

171. Lal (1994), p. 169-70

172. Milton, p. 120

173. Naipaul VS (1998) Beyond Belief: The Islamic Incursions among the Converted Peoples, Random House, New York, p. 332
————–

চলবে—

ইসলামে র্বরতা (দাসত্ব অধ্যায় ১)

ইসলামে বর্বরতা দাসত্ব অধ্যায় ২)

ইসলামে র্বরতা (দাসত্ব অধ্যায় ৩)

ইসলামে র্বরতা (দাসত্ব অধ্যায় ৪)

ইসলামে র্বরতা (দাসত্ব অধ্যায় ৫)

ইসলামে র্বরতা (দাসত্ব অধ্যায় ৬)

ইসলামে র্বরতা (দাসত্ব অধ্যায় ৭)

ইসলামে র্বরতা (দাসত্ব অধ্যায় ৮)

————–