আবুল কাশেম

নানা কারণে এই ধারাবাহিক রচনাটি কিছুদিনের জন্য স্থগিত ছিল। বাকী অংশ এখন নিয়মিত প্রকাশের আশা রাখছি।

[রচনাটি এম, এ, খানের ইংরেজি বই থেকে অনুবাদিত “জিহাদঃ জবরদস্তিমূলক ধর্মান্তরকরণ, সাম্রাজ্যবাদ ও ক্রীতদাসত্বের উত্তরাধিকার” গ্রন্থের ‘ইসলামি ক্রীতদাসত্ব’ অধ্যায়ের অংশ এবং লেখক ও ব-দ্বীপ প্রকাশনের অনুমতিক্রমে প্রকাশিত হলো।]

ক্রীতদাসদের ভাগ্যঃ নির্মাণ ও স্থাপত্য কর্মে নিয়োগ

৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে মারা যাওয়ার আগে নবি মুহাম্মদ কয়েক হাজার ধর্মান্তরিত মুসলিমকে রেখে যান, যারা হামলা ও লুটপাটমূলক জিহাদে লিপ্ত হতো প্রধানত খাওয়া-পরার সংস্থান জোটাতে ও মুসলিম ভূখণ্ড বিস্তারের লক্ষ্যে। এ অল্পসংখ্যক মুসলিম যোদ্ধা অতি অল্প সময়ের মধ্যে একটা অভূতপূর্ব ও হতবাক-করা জয়ের অভিযান বাস্তবায়ন করে বিশ্বের বিশাল একটা অংশ মুঠোয় নিয়ে আসে। এ প্রক্রিয়ায় বিপুল সংখ্যক পরাজিত বিধর্মীকে ক্রীতদাস বানানো হয়, যাদের বড় একটা অংশ নিজস্ব ইচ্ছার বিরুদ্ধে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য হয়।

মাত্র ৬,০০০ আরব যোদ্ধা নিয়ে সিন্ধুতে প্রবেশ করে মোহাম্মদ বিন কাসিম এবং মাত্র তিন বছরে প্রায় ৩০০,০০০ ভারতীয় বিধর্মীকে ক্রীতদাস বানায়। একইরূপে মুসা (৬৯৮-৭১২) উত্তর আফ্রিকায় ৩০০,০০০ কৃষ্ণাঙ্গ ও বার্বারকে ক্রীতদাস বানান। সিন্ধুর প্রথম দিককার মুসলিম সম্প্রদায় অল্প সংখ্যক আরব প্রভু ও অধিকাংশ স্থানীয় ক্রীতদাস মুসলিমদের দ্বারা গঠিত ছিল। এ দু’টি মুসলিম গোষ্ঠী মিলে নতুন ইসলামিক রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামো বা প্রশাসন যন্ত্র গঠন করে। এ বিশাল উদ্যোগ পরিচালনায় তখনকার প্রযুক্তিহীন যুগে বিপুল জনশক্তির প্রয়োজন হতো। ফলে ক্রীতদাসকরণের মাধ্যমে বিধর্মী থেকে ধর্মান্তরকৃত বিপুল সংখ্যক মুসলিমদেরকে নানা কাজকর্মে নিযুক্ত করা হতো: যেমন নারীদেরকে যৌনদাসীরূপে ও পুরুষদেরকে মুসলিম সামরিক বাহিনী সম্প্রসারণে। মধ্যযুগীয় ঐতিহাসিক দলিল ‘মাসালিক’ জানায়: ভারতে ‘এমন কোনো কাজ ছিল না যা ফিরোজ শাহের ক্রীতদাসদের করতে হয়নি।’[১২৬] শুধু ভারতেই নয়, সর্বত্রই মুসলিম শাসকরা ক্রীতদাসকৃত স্থানীয়দেরকে একইভাবে কাজে লাগিয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মুসলিম শাসকদের অধীনে ক্রীতদাসদেরকে কল্পনা করা যায় প্রায় এমন সকল কাজেই নিযুক্ত করা হতো।[১২৭] বস্তুত ইসলামি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সমগ্র কর্মশক্তি ক্রীতদাসদের দ্বারা গঠিত ছিল, যা ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।

নির্মাণ ও স্থাপত্য কর্মে নিয়োগ: মুসলিম আক্রমণকারী ও শাসকরা বিজিত দেশগুলোতে প্রধান যে কাজে হাত দিতো সেটা ছিল জাঁকজমকপূর্ণ বিশাল বিশাল মসজিদ, মিনার, স্তম্ভ ও ইমারত নির্মাণ। সেগুলোর উদ্দেশ্য ছিল স্থানীয় বিধর্মীদের ঐতিহ্যকে ম্লান করে দিয়ে ইসলামের শক্তি ও মহিমা ঘোষণা করা। চাচনামা জানায় যে, কাসিম সিন্ধুতে প্রবেশ করে নির্মাণ কাজের যে উদ্যোগ নেয় মে সম্পর্কে হাজ্জাজকে লিখে জানায়: ‘বিধর্মীরা ইসলামে দীক্ষিত হয়েছে অথবা ধ্বংস হয়ে গেছে। পূজার স্থানগুলোতে মসজিদ ও এবাদতের অন্যান্য ইমারত নির্মাণ করা হয়েছে। বেদি দাঁড় করানো হয়েছে।’[১২৮] কুতুবুদ্দিন আইবেক কর্তৃক ভারতে মুসলিম শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত করার (১২০৬) এক দশক আগেই ১১৯২ সালের প্রথম দিকে দিল্লিতে নির্মাণ শুরু করা হয় সুদৃশ্য ‘কুওয়াতুল ইসলাম” (ইসলামের শক্তি) মসজিদটি। ইবনে বতুতা জানান: ‘কুওয়াতুল ইসলাম মসজিদের স্থানে একটি প্রতিমা মন্দির ছিল। শহরটি দখল করার পর একে মসজিদে রূপান্তরিত করা হয়।’[১২৯] আইবেক ১১৯৯ সালে দিল্লিতে ইসলামি প্রার্থনা বা নামাজের সময় ঘোষণার জন্য জমকালো ‘কুতুব মিনার’ নির্মাণের কাজ শুরু করেন। প্রত্যক্ষদর্শী বতুতা লিখেছেন: ‘ইসলামি জগতে কুতুব মিনারের সমতুল্য কিছু নেই।’[১৩০]

ইসলামের রাজনৈতিক শক্তি দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগেই ভারতে এসব বড় বড় নির্মাণ কর্মোদ্যোগ এটাই প্রতীয়মান করে যে, ইসলামের শক্তি ও মহিমা ঘোষণা করা ছিল বিজয়ের আবশ্যকীয় ও মূল লক্ষ্য। বিধর্মীদেরকে সর্বাধিক মর্যাদাহীন ও অবমাননা করার মানসেই বিধ্বস্ত মন্দির, চার্চ ও সিনাগগের যাবতীয় মাল-মসলা ও সাজ-সরঞ্জাম দিয়েই ইসলামি মসজিদ-মিনারের কাঠামোগুলো নির্মাণ করা হতো। একটি ফার্সি শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, ‘কুওয়াতুল ইসলাম’ মসজিদটি নির্মাণে ধ্বংসকৃত ২৭টি হিন্দু ও জৈন মন্দিরের সাজ-সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয়েছিল।[১৩১] অধ্যাপক হাবিবুল্লাহ কুতুব মিনার নির্মাণেও একইভাবে বিধর্মী ধর্ম-প্রতিষ্ঠানের সাজ-সরঞ্জাম ব্যবহার করার কথা জানান। ‘কুতুব মিনার’ নির্মাণে, তিনি লিখেছেন: ‘পাথরে খোদাইকৃত মূর্তিগুলো (হিন্দু দেব-দেবী প্রভৃতির) বিকৃত করা হয় অথবা উল্টিয়ে উপরের দিক নিচে দিয়ে তাদেরকে গোপন করা হয়েছে।’[১৩২]

ভারতের মুসলিম হানাদাররা জমকালো সব মসজিদ, মিনার, নগরদুর্গ ও সমাধিস্তম্ভ নির্মাণের কাজ শুরু করে ধর্মীয় তাৎপর্যের জন্য। পরবর্তীকালে সারা ভারতব্যাপী এর সাথে তারা যুক্ত করে জমকালো বিশাল বিশাল প্রাসাদ ও অন্যান্য ইমারত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব নির্মাণ কাজ অতি দ্রুততার সাথে সম্পন্ন করা হতো। অতিশয় উল্লাসে জিয়াউদ্দিন বারানী আমাদেরকে জানান: সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির সময়ে দুই-তিন দিনের মধ্যে একটা প্রাসাদ নির্মাণ করা যেতো; আর একটা নগর দুর্গ নির্মাণে লাগতো দুই সপ্তাহ। যদিও এটা অতিরঞ্জিত কথা, তথাপি এ তথ্য থেকে বুঝা যায় যে, এসব ব্যাপক ও বিশাল উদ্যোগের পিছনে বিপুল সংখ্যক লোক, যারা অবশ্যই ছিল ক্রীতদাস শ্রমিক, নিয়োগ করা হতো; এবং সে প্রযুক্তিবিহীন যুগে সেসব নির্মাণকর্ম যত দ্রুত সম্ভব সম্পন্ন করার জন্য তাদের উপর অমানুষিক চাপ দেওয়া হতো। সুতরাং এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে, সুলতান আলাউদ্দিন ৭০,০০০ ক্রীতদাস একত্র করেছিলেন, যারা লাগাতারভাবে তার নির্মাণ কাজে নিযুক্ত থাকতো। কুওয়াতুল ইসলাম মসজিদ ও কুতুব মিনার ছিল বিশাল উদ্যোগ ও কর্ম-প্রয়াসের দৃষ্টান্ত, কেননা ধ্বংসকৃত মন্দিরের সাজ-সরঞ্জাম অতি সাবধানে খুলে পুনঃব্যবহার করা কষ্টসাধ্য কাজ ছিল। নিজামী লিখেছেন: মন্দিরগুলো ভাঙ্গার জন্য হাতি ব্যবহার করা হতো, যার এক একটা পাথর সরাতে ৫০০ মানুষের প্রয়োজন হতো। অধিকাংশ সাবধানী কাজ মানব-হস্ত দিয়েই করা হতো এবং সেজন্যে বিপুল সংখ্যক ক্রীতদাস অবশ্যই নিয়োগ করা হয়েছিল।[১৩৩]

এছাড়াও নতুন নতুন শহর, প্রাসাদ ও ধর্মীয় কাঠামো নির্মাণে বিরাম থাকতো খুবই কম। প্রায়শই যখন নতুন সুলতান সিংহাসনে আসীন হতেন − যেটা ঘটতো ঘন ঘন বিরামহীন বিদ্রোহ ও ষড়যন্ত্রের কারণে, যা ভারতে ইসলামি শাসনের একটা বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল − সে নতুন সুলতান নিজস্ব স্মৃতি রেখে যেতে নতুন শহর ও প্রাসাদ নির্মাণে ব্রতী হতো। ইলতুতমিসের পুরনো নগরী ত্যাগ করে সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবন (শাসনকাল ১২৬৫-৮৫) দিল্লিতে নির্মাণ করেন বিখ্যাত কাছর-ই-লাল (রেড ফোর্ট) রাজপ্রাসাদটি; একইভাবে সুলতান কায়কোবাদ কিলুঘারি শহরটি নির্মাণ করেন। ইবনে বতুতার ভাষায়: ‘রাজার প্রাসাদ তার মৃত্যুর সাথে সাথে পরিত্যক্ত ও বিরান হবে এবং পরবর্তী রাজা নিজের জন্য আরেকটি নতুন প্রাসাদ গড়ে তুলবে − এটা হলো তাদের প্রথা।’[১৩৪] তিনি দিল্লি সম্পর্কে লিখেন: ‘বিভিন্ন সুলতানদের নির্মিত সন্নিহিত চারটি নগরীর সমন্বয়ে গঠিত হলো ‘দিল্লি’, যা সমগ্র মুসলিম প্রাচ্যের বৃহত্তম নগরী।’[১৩৫]

অধিকন্তু ঘিঞ্জি নগরীগুলোতে আধুনিক পয়ঃনিষ্কাশন ও আবর্জনা ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি না থাকায় দ্রুত অপরিচ্ছন্ন হয়ে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়তো এবং তদস্থলে নতুন শহর গড়া হতো। বতুতা ও বাবর দুজনেই আর্দ্র পরিবেশের কারণে পুরনো শহর ভেঙ্গে বা ধ্বংস করে নতুন শহর গড়ার কথা লিখেছেন। সেজন্য নতুন শহরে স্থানান্তরের প্রয়োজন পড়ে, যেখানে সবকিছু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও ছিমছাম থাকবে। বিপুল সংখ্যক ক্রীতদাসকৃত হিন্দুরাই ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করা এবং নতুন শহরগুলো নির্মাণের কাজে নিয়োজিত হতো, মূলত মুসলিমদের বসবাসের জন্য। ইতিমধ্যে বলা হয়েছে, সুলতান ফিরোজ তুঘলক তার কাজের জন্য ১৮০,০০০ ক্রীতদাস একত্র করেছিলেন। অধ্যাপক লালের হিসাব মতে, এদের মধ্যে রাজমিস্ত্রি ও স্থপতিকর্মীদের ১২,০০০ ক্রীতদাস কেবল পাথর কাটার কাজেই সম্ভবত নিয়োজিত ছিল। বাবর লিখেছেন: ‘আগ্রায় আমার নির্মাণ-কাজে মাত্র ৬৮০ জন লোক দৈনিক কাজ করতো। অপরদিকে আগ্রা, সিক্রী, বিয়ানা, ডুলপুর, গোয়ালিয়র ও কুলিতে (আলিগড়) আমার নির্মাণ কাজে ১৪৯১ জন পাথর কাটার লোক দৈনন্দিন কাজ করতো। একইভাবে হিন্দুস্তানে কাজ করছে অগণিত সংখ্যক প্রত্যেক শ্রেণীর কর্মী ও শিল্পী।’[১৩৬]

পুরো ইসলামি শাসন জুড়ে ভারতে মুসলিম শাসকরা নির্মাণ করেছেন বিশাল বিশাল মসজিদ, স্মৃতিস্তম্ভ, সমাধিস্তম্ভ, নগরদুর্গ, অট্টালিকা ও নগরী; শুধু নির্মাণই নয়, সেগুলোর মেরামতও করেছেন। তর্কাতীতভাবে ভারতে সর্বশ্রেষ্ঠ মুসলিম অবদান হলো বিশাল বিশাল স্থাপত্য ও স্মৃতিস্তম্ভ, যেগুলোর দ্যুতি আজও ভারতে আগত বিশ্বের সকল অঞ্চলের পর্যটকদেরকে বিস্মিত করে, আকৃষ্ট করে সকলকে। এবং এগুলোর সবই তৎকালে ক্রীতদাসকৃত ভারতীয়দের অবদান, যারা অগণ্য সংখ্যায় সেসব স্মৃতিস্মারক নির্মাণে সকল স্তরে বিনা শর্তে তাদের শ্রম ও দক্ষতা প্রয়োগ করতো, আর তাদের পিছনে মুসলিম প্রভুরা চাবুক হাতে নিরন্তর নিষ্ঠুর পাহারায় রত থাকতো।

মুসলিম বিশ্বের অন্যত্রও চমৎকার আকার-প্রকৃতির প্রাসাদ, স্মৃতিস্তম্ভ ও নগর নির্মাণে অনুরূপ কর্মকাণ্ড বিদ্যমান ছিল। মরক্কোয় পূর্ববর্তী শাসকরা গড়ে তুলেছিলেন চোখ-ধাঁধানো অট্টালিকা ও স্মৃতিস্তম্ভ সম্বলিত রাজধানী ফেজ, রাবাত ও মারাক্কেশে। সুলতান মৌলে ইসমাইল যখন ১৬৭২ সালে ক্ষমতা দখল করেন, তিনি মেক্নেসে একটা নতুন রাজধানী প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেন, যা আকার ও চমৎকারিত্বে তৎকালীন বিশ্বের সকল বৃহৎ নগরীকে ছাড়িয়ে যাবে। তিনি সেখানকার সমস্ত বাড়িঘর ও দালান-কোঠা ভেঙ্গে বিশাল এক এলাকা পরিষ্কার করার নির্দেশ দেন, যেখানে তিনি নির্মাণ করেছিলেন হতবাক-করা, চোখ-ধাঁধাঁনো নিজস্ব প্রাসাদ, যার দেওয়াল বিস্তৃত ছিল বহু মাইল। মেক্নেসের প্রাসাদ-নগরীটিতে নির্মাণ করা হয়েছিল ‘পরস্পরের সাথে যুক্ত সুবিন্যস্ত প্রাসাদরাজি, যেগুলো চতুর্দিকে পাহাড় ও উপত্যকার মাঝ দিয়ে একের পর এক সীমাহীনভাবে বিস্তৃত ছিল। সেখানে ছিল বিরাট আঙ্গিনা, সারিবদ্ধ গ্যালারি, মসজিদ ও প্রমোদকানন। তিনি (সুলতান) একটা বিশাল মূর হেরেম ও সে সঙ্গে আস্তাবল ও অস্ত্রাগার, ঝর্ণা, পুকুর ও অন্যান্য অহেতুক জিনিস নির্মাণের নির্দেশ দেন।’[১৩৭]

সুলতান মৌলে ইসমাইল রাজা চতুর্দশ লুই-এর ভার্সাই’তে অবস্থিত ইউরোপের বৃহত্তম রাজপ্রাসাদের চেয়ে বড় একটি প্রাসাদনগরী গড়ে তোলার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন। বাস্তবে তিনি ভার্সাই রাজপ্রাসাদের চেয়ে অনেক বড় একটি প্রাসাদ নির্মাণ করে ফেলেন। সুলতান মৌলে ইসমাইলের সাথে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর ও ইংরেজ বন্দিদেরকে মুক্ত করার জন্য কমোডর চার্লস স্টুয়ার্ট-এর নেতৃত্বে একদল ব্রিটিশ কূটনীতিক তার প্রাসাদে যান। তারা প্রাসাদটিকে ইউরোপের যে কোনো অট্টালিকার চেয়ে অনেক বৃহৎ দেখতে পান; এমনকি রাজা চতুর্দশ লুই’এর বৃহত্তম ও অত্যন্ত সমৃদ্ধিশালী প্রাসাদটিও এর চেয়ে অনেক ছোট মনে হয়েছিল তাদের কাছে। সবচেয়ে অবাককারী অট্টালিকাটি ছিল ‘আল-মনসুর প্রাসাদ’, যা ছিল ১৫০ ফুট উঁচু ও উজ্জ্বল-সবুজ টাইল দ্বারা অলঙ্কারিত কুড়িটি প্যাভিলিয়নে সুসজ্জিত করা।[১৩৮]

সুলতানের প্রাসাদটি নির্মিত হয়েছিল শুধু ইউরোপীয় ক্রীতদাসদের দ্বারাই, যাদেরকে সহায়তা করে স্থানীয় ক্রীতদাসকৃত অপরাধীরা। প্রাসাদটির পরিধি ছিল চার মাইল ও দেওয়াল ২৫ ফুট চওড়া। উইনডাস জানান: ‘‘প্রাসাদটি নির্মাণে প্রতিদিন ৩০,০০০ মানুষ ও ১০,০০০ গাধা নিয়োজিত ছিল।’’ প্রতিদিন সকালে এসে সুলতান কাজ পরিদর্শন করতেন ও সারাদিনের কাজের ধারণা দিতেন। ক্রীতদাসরা যথাসময়ে বরাদ্দ কাজ সমাপ্ত করার জন্য সতর্ক একাগ্রতার সাথে কাজ করতো। একটা প্রকল্প শেষ করতে না করতেই তিনি আরেকটি হাতে নিতেন। নির্মাণ কাজের মাত্রা এতই ব্যাপক ছিল যে, ‘‘আরব বা বিদেশী, পৌত্তলিক কিংবা মুসলিম − কোনো সরকারের অধীনেই এমন সুদৃশ্য প্রাসাদ দেখা যায়নি,’’ লিখেছেন মরক্কোর ইতিহাসবিদ এজ-জায়ানি। কেবলমাত্র প্রাসাদটির কেল্লা পাহারা দেওয়ার জন্যই ১২,০০০ সৈনিকের প্রয়োজন হতো।[১৩৯]

সুলতান মৌলে ইসমাইলের প্রাসাদে নির্মাণ কাজেও কোনো বিরাম ছিল না। সমাপ্তকৃত নির্মাণ কাজে কদাচিৎ সন্তুষ্ট সুলতান তা পুরোপুরি ভেঙ্গে ফেলে নতুন করে গড়ার নির্দেশ দিতেন। ক্রীতদাসদেরকে কাজে ব্যস্ত রাখার জন্য তিনি প্রাসাদের ১২ মাইল দেওয়াল ভেঙ্গে ফেলে তা পুনরায় নির্মাণের নির্দেশ দেন। এ ব্যাপারে তাকে কেউ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলতেন: ‘‘আমার রয়েছে ইঁদুর (ক্রীতদাস) ভর্তি একটা থলি; আমি থলিটা যদি নাড়া-চাড়া না করতে থাকি তাহলে তারা সেটা কেটে বের হয়ে যাবে।’’[১৪০]

সুলতান মৌলে ইসমাইলের উত্তরসূরী মৌলে আব্দাল্লাহ্ পিতার মতোই নিষ্ঠুর ছিলেন। ক্রীতদাসদেরকে কঠোর পরিশ্রমে ব্যস্ত রাখার জন্য তার পিতার নির্মিত অবাক-করা সব প্রাসাদ, যা ছিল ‘মেক্নেসের গৌরব ও আনন্দ’, সেগুলো ভেঙ্গে চুরমার করে সেখানে নতুন প্রাসাদ নির্মাণের আদেশ দেন তার ইউরোপীয় ক্রীতদাসদেরকে। কাজের সময় ক্রীতদাসদের চরমতম দুর্ভোগ হতো, এমনকি কাজ করতে করতে তারা মারা গেলে, তিনি এক ধরণের কুশ্রী আনন্দ পেতেন। ফরাসি নাগরিক আঁদ্রিয়ান দা ম্যানল্ট লিখেছেন: ‘‘ক্রীতদাসরা কাজ করার সময় তার একটা আনন্দজনক কাজ ছিল, ধ্বসে পড়তে যাচ্ছে এমন দেয়ালের নিচে অনেকগুলো ক্রীতদাসকে বসিয়ে রাখা এবং দেখা, কিভাবে তারা সে ধ্বংসস্তুরপের তলে পড়ে প্রাণ হারায়।’’ পেলো লিখেছেন: ‘‘তিনি তার ক্রীতদাসদের সঙ্গে নিষ্ঠুরতম ও ভয়াবহ আচরণ করতেন।’’[১৪১]

[আগামী পর্বে আলোচিত হবেঃ ক্রীতদাসদের ভাগ্যঃ সামরিক বাহিনীতে অন্তর্ভুক্তি]

সূত্রঃ

126. Lal (1994), p. 97

127. Reid A (1993) The Decline of Slavery in Nineteenth-Century Indonesia, In Klein MA ed., Breaking the Chains: Slavery, Bondage and Emancipation in Modern Africa and Asia, University of Wisconsin Press, Madison, p. 68

128. Sharma, p. 95

129. Gibb, p. 195

130. Ibid

131. Watson F and Hiro D (2002) India: A Concise History, Thames & Hudson, p. 96

132. Lal (1994), p. 84

133. Ibid, p. 84-85

134. Ibid, p. 86, 88

135. Gibb, p. 194-95

136. Lal (1994), p. 88

137. Milton, p. 100-01

138. Ibid, p. 102

139. Ibid, p. 104-05

140. Ibid

141. Ibid, p. 240-41

————–

চলবে—

ইসলামে র্বরতা (দাসত্ব অধ্যায় ১)

ইসলামে বর্বরতা দাসত্ব অধ্যায় ২)

ইসলামে র্বরতা (দাসত্ব অধ্যায় ৩)

ইসলামে র্বরতা (দাসত্ব অধ্যায় ৪)

ইসলামে র্বরতা (দাসত্ব অধ্যায় ৫)

ইসলামে র্বরতা (দাসত্ব অধ্যায় ৬)