নিজের বিয়ে ভেঙ্গে দিল দ্বাদশী কন্যা

পশ্চিমবঙ্গের পিছিয়ে পড়া জেলা বাঁকুড়া। তারই আবার একটি পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের নাবালিকা কিশোরী পদ্মা রুইদাস যা করে দেখাল সত্যিই দৃষ্টান্তমূলক। পদ্মার বাবা পবন রুইদাস হতদরিদ্র মজদুর, সারা বছর ধরে কাজ জোটে না, মাঝে মাঝে দুচারদিন কোথাও কাজ পেলে দুটো পয়সা ঘরে আসে, বাকি দিনগুলি তে তার কাজ হাড়িঁয়া খেয়ে বউ এবং মেয়েদেরকে পেটানো। পদ্মার মা গীতা গ্রামেরই একটি বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করেন। মুলতঃ তার রোজগারেই বাড়িতে হাঁড়ি চড়ে রোজ। এরকম একটি অবস্থায় ১২ বছরের পদ্মার বিয়ে ঠিক করল তার অভিভাবকেরা। বর ভিন রাজ্য উত্তরপ্রদেশ থেকে উড়ে আসা বছর ২৪ এর এক অচেনা যুবক, নাম পাপ্পু সাগর। পাপ্পু এসেছিল বন্ধুর শ্বশুরবাড়ি। ফেরার সময় কথা বলে পদ্মার বাবা মায়ের সাথে, পদ্মাকে বিয়ে করে নিয়ে যেতে চায়। না, এমনি এমনি নয়, বিয়ের বিনিময়ে পদ্মার বাবাকে নগদ কয়েক হাজার টাকা দেবার প্রতিশ্রতি দেয়। সেই দিনেই বিয়ের আসর বসে স্থানীয় একটি কালি মন্দিরে মাত্র কয়েকজন প্রতিবেশীকে সাক্ষী রেখে। সেই দিনটি ছিল ২২ জুন, ২০০৯।

পরবর্তী ঘটনায় যাবার আগে পদ্মার বাসস্থান “মালিয়াড়া” গ্রামটির একটি সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া প্রয়োজন আছে। অন্যান্য গ্রামের চেয়ে বেশ বড় গ্রাম, দোকান-পাট, বাজার-ঘাট, বিদ্যালয় সবই আছে। দুর্গাপুর-আসানসোল শিল্পাঞ্চলের নিকটবর্তী হওয়ার সুবাদে গ্রামের মধ্যে কিঞ্চিৎ দুর্নীতি, কিঞ্চিৎ দলাদলি, মারপিট, রাজনীতি – সবেরই অনুপ্রবেশ ঢুকেছে। আশেপাশে বেশ কটি অবৈধ কয়লা খনি থাকায় এই অঞ্চলের প্রতিটি গ্রামে অনেকেই কয়লা চোরাচালানকারীদের সাথে যুক্ত। ফলে, মুলতঃ কৃ্ষিকাজকে অবলম্বন করে গড়ে ওঠা গ্রামটির সমাজ ব্যবস্থায় শহুরে ভিন্নমাত্রিক সামাজিক স্তরগুলি প্রচ্ছন্ন ভাবে বিদ্যমান। রুইদাস- রা এখানের আদি বাসিন্দা। এরা পেশাগতভাবে একসময় ছিলেন মুচি, বর্তমানে প্রায় সকলেই বাঁশ এবং বেতের ঝুড়ি, ধামা, কুলো বোনার কাজ করে যেন তেন প্রকারেন দিন গুজরান করেন। দেড়শোটি পরিবারের প্রায় এক হাজার লোকসংখ্যা নিয়ে রুইদাস পাড়া গ্রামেরই এক কোনায় নিতান্ত অবহেলায় দারিদ্রতার চরম সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে। শিল্পাঞ্চলের নিকটবর্তী হওয়ায় মালিয়াড়া সংলগ্ন এলাকায় নানা জাতের নানা ধর্মের মানুষের অবাধ যাতায়াত। এর সু প্রভাব এবং কু প্রভাব দুই আছে।

পদ্মা এত কম বয়সে বিয়েতে রাজি ছিল না। সে ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছে গ্রামের অনেক বাচ্চা মেয়েকে কম বয়সে বাইরের লোকেরা বিয়ে করে নিয়ে যায়, প্রথম প্রথম দু চারবার তারা বাপের বাড়িতে এলেও পরের দিকে আর খোঁজ মেলেনা। তার বড়দিদিরই তো নাবালিকা অবস্থায় তিন তিন বার বিয়ে দিয়েছে তার বাবা, প্রতিবারই দিদি পালিয়ে এসেছে শ্বশুরবাড়ি থেকে। কিন্তু হঠাৎ স্থির হওয়া বিয়েতে হতবম্ব পদ্মা প্রতিবাদ করার সময় টুকুও পায়নি। তাকে বধু বেশে মন্দিরের দিকে নিয়ে যাওয়ার সময় প্রতিবেশী দের শুধুমাত্র এইটুকু বলতে পেরেছিল “আমি বিয়ে করতে রাজি নই, এ বিয়ে বন্ধ কর”। প্রতিবাদে অনভ্যস্ত পড়শিদের মধ্যে দুএকজন প্রথমে এগিয়ে আসে। তারা ডেকে নিয়ে আসে স্থানীয় সমাজসেবী চায়না তেওয়ারীকে। এক দুই করে জড়ো হয় অনেকেই। প্রতিবেশীদের চাপের মুখে পড়ে অবশেষে পুলিশ আসে। পদ্মার বাবা-মা এবং পাপ্পু গ্রেপ্তার হয় সেদিন রাতেই।

মালিয়াড়ার নিকটবর্তী গ্রাম সারাঙ্গপুরে যুক্তিবাদী সমিতির একটি শাখা রয়েছে। পদ্মার ঘটনা শোনামাত্র তারা ঘটনাস্থলে যায়। শুধুমাত্র পদ্মাকে তাৎক্ষণিক সহানুভুতি জানানোর জন্য নয় বরং যুক্তিবাদী সমিতি পদ্মার ভবিষ্যৎ নিয়ে আরো বেশি ভাবিত হয়। মালিয়াড়া অঞ্চলে গড়ে ওঠা নারীপাচারকারীদের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদটির ফলাফল মোটেও ভাল হবেনা এটা আন্দাজ করেই পদ্মার পাশে দাঁড়িয়েছিল সমিতি। পাশে একটা সংগঠন দাঁড়িয়ে যাওয়ায় সে সাময়িক একটি শক্তি পেলেও বিয়ের পিঁড়ি থেকে উঠে আসা লগ্নভ্রষ্টা মেয়ের পক্ষে সেটিও যথেষ্ট নয় মনে করে সমিতির বাঁকুড়া জেলা কমিটির তরফ থেকে পদ্মা এবং তার সহযোদ্ধাদের সামাজিক স্বীকৃ্তি বৃদ্ধিতে ৫ জুলাই সকলকে মানবতাবাদী সম্মান প্রদানের ব্যবস্থা করে। ওই দিনটিতে অসংখ্য গ্রামবাসী এবং স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যাক্তিবর্গের উপস্থিতিতে একটি মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ১১ জন গ্রামবাসী পেল মানবিক কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার সাহসিকতার জন্য মানবতাবাদী স্মারক, এবং পদ্মা পেল একটি বিশেষ স্মারক। ঐ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন আরো দুই খ্যাতানামা ব্যাক্তিত্ব, একজন ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির সাধারণ সম্পাদক প্রবীর ঘোষ এবং হিউম্যানিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সুমিত্রা পদ্মনাভন। এই দুজনের উজ্জ্বল উপস্থিতি অনুষ্ঠান টিকে আরো বেশি বর্ণময় করে তুলেছিল। এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আলোচনায় উঠে এল পদ্মার ভবিষ্যত নিয়ে নানান গঠনমূলক প্রস্তাব। তবে পদ্মার মতামত কে বেশি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হবে বলে সেদিন সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয়। পদ্মা নিজেও পড়াশোনা করতে চায়। তাই সেদিনের আলোচনার দিন কয়েক পরেই সকলের সহযোগিতায় তাকে স্থানীয় বালিকা বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণী তে ভর্তি করা হয়। এর পরেও সমস্যা রয়ে গেল। সে খাবে কি? স্কুলে যাওয়ার দরুন বাবুর বাড়ীর কাজ চলে গেছে, এদিকে আদালত রায় দিয়েছে পদ্মাকে তার বাবা, মা র কাছে রাখা যাবে না ভবিষ্যতে আবার বিক্রি হয়ে যেতে পারে। নাবালিকা পদ্মা কে তার এক আত্মীয় পরিমল রুইদাসের কাছে গচ্ছিত রেখেছে আদালত। পরিমলেরও নুন আনতে পান্তা ফুরোয় সংসার। সে কতদিন টানতে পারবে একে? বাঁকুড়ার যুক্তিবাদীরা যখনই প্রশাসনিক স্তরে সাহায্য চাইতে গেছে সেখান থেকে উপদেশ দেওয়া হয়েছে ওকে কোনো সরকারী হোমে রেখে দিতে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের হোমগুলির যা কাহিনী শোনা যায়, ভরসা নেই। ১৫ কিলোমিটার দূরে একটি শিশুশ্রম বিদ্যালয় রয়েছে সেখানে দেওয়া যায় ঠিকই, এক্ষেত্রে বাধ সাধছে গ্রামবাসীরা। তাদের বক্তব্য নারীপাচারকারিদের রোষানলে থাকা মেয়েটিকে কিছুতেই রোজ রোজ এতটা দূরে পড়তে গিয়ে কাজ নেই, সে গ্রামে থাকলে নিরাপদ থাকবে।

গত কয়েক মাসে পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহল লাগোয়া অঞ্চলে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে পর পর প্রতিবাদ উঠে আসছে। রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাটিল এদের কয়েকজনের সাথে দেখাও করেছেন। নাবালিকা রেখা কালিন্দি কে ভারত সরকারের সমাজকল্যান দপ্তর বাল্যবিবাহরোধী ‘আইডল’ রূপে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এদের মধ্যে বাছাবাছা কয়েকজনকে মহাকরনে ডেকে পাঠিয়েছিলেন গত ৪ আগস্ট। এখানেও বামফ্রন্ট সরকার তাদের নির্লজ্জ রাজনীতির পরিচয় বহন করেছে, পদ্মা একজন পেশাগত ভাবে শিশুশ্রমিক এবং সিঁথিতে সিঁদুর পরার পরেও সে বিয়ে ভেঙ্গে দিতে সাহস করে জেনেও তার সহমর্মিতায় কেউ এগিয়ে আসেনি। না প্রশাসন না বুদ্ধবাবু নিজে। কেন? পদ্মার ভবিষ্যত গড়তে যুক্তিবাদী বা গ্রামবাসীরা সি পি এমের লোকাল কমিটির পার্টি অফিসে দরবার করেনি বলে? বাম সরকার যুক্তিবাদীদের সাথে তাদের বিরোধে দগ্ধ করল নিষ্পাপ মেয়েটিকে। ভারতীয় আইন অনুসারে, নাবালিকা বিবাহে শুধুমাত্র বরপক্ষ কণেপক্ষ শাস্তি পাবে তাই নয়, এই বিবাহে যারা আমন্ত্রিত এবং সাক্ষী থাকবে সবাই কমবেশি অপরাধী বলে গণ্য হবে। তাহলে পদ্মার বাবা মা জামিনে মুক্ত হল কিভাবে? দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিয়ে কোন মন্ত্রবলে প্রধান অভিযুক্ত পাপ্পু সাগরকে এলাকা ছেড়ে দেওয়ার সু্যোগ দেওয়া হল? প্রশাসন নিরুত্তর। এভাবে সামাজিক সমস্যাগুলিকে ধামাচাপা দিয়ে স্টেট স্ট্যাটিসটিক রিপোর্ট পরিচ্ছন্ন রাখতে বদ্ধপরিকর রাজ্য সরকার বিগত দিনগুলিতে জনগনকে কি পরিমান ঠকিয়ে এসেছেন তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। আমরা যারা গণআন্দোলন করি তারা হাড়ে হাড়ে টের পাই। যাই হোক, রেখা কালিন্দি, পদ্মা রুইদাস, আফসানা খাতুন, সুনীতা, অহল্যা- রা পথ দেখাচ্ছে গোটা দেশবাসীকে একথা অনস্বীকার্য।

কিন্তু হঠাৎ এমন সামাজিক পরিবর্তন? যে রাজ্যে ৩২ বছর ধরে একটি বামপন্থী সরকার থাকার পরেও শিশুপাচার-নারীপাচার, বেশ্যাবৃত্তি-উঞ্ছবৃত্তি তে দেশের প্রথম সারিতে, রাজ্যের হুজুগে পুজোর বাজেট কয়েক হাজার কোটি টাকা, সরকারের পরোক্ষ মদতে নিত্যনতুন কোটিপতি জ্যোতিষী জন্ম নিচ্ছে, তোষণপ্রিয়তা দূর্নীতি স্বজনপোষণের পুঁতিগন্ধময় পরিবেশ সুস্থ মানুষের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে, সেই রাজ্যের কোথায় কি এমন পট পরিবর্তন হল কারণ খুঁজতে গিয়ে যুক্তিবাদী সমাজবিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, আদিবাসী প্রধান জেলাগুলিতে মাওবাদী চিন্তাধারায় উদবুদ্ধ মানুষের মাধ্যমে স্বয়ম্ভর গ্রাম গঠনের যে চোরা স্রোত বইছে তারই ফলস্বরূপ যেমন এখানে সেখানে নেতা-আমলাদের দূর্নীতি ফাঁস হচ্ছে তেমনই সমাজ পরিবর্তনের রূপরেখাটিও তৈরি হচ্ছে অতি দ্রুততার সাথে। গত আট মাসের লালগড় আন্দোলন আর বাল্যবিবাহ রোধে নাবালিকাদের ফোঁস দুটি একই সূরে গাঁথা সে নিয়ে তাঁরা নিঃসন্দেহ। বক্তব্যের স্বপক্ষে তারা তুলে ধরেছেন অন্ধ্রপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, ছত্তিশগড়, বিহার, ঝাড়খন্ডের দেড়শো জেলার বিভিন্ন গ্রামগুলিকে, যেখানে গত সাত আট বছরে গড়ে ওঠা স্বয়ম্ভর গ্রামগুলিতে এত দ্রুততার সাথে আর্থ-সামাজিক পট পরিবর্তন হয়েছে যে ভাবা যায় না।

বত্রিশ বছর ধরে কমিউনিজমের বুলি কপচে আসা এ রাজ্যের ক্ষমতাসীন মার্কসবাদী কমিউনিস্ট নেতারা(নিন্দুকে বলে-‘কামিয়ে নিস’) এই সারসত্যটা বুঝতে পেরেই অস্তাচলে যাবার আগে শেষ বারের জন্য নখদন্ত বের করে আক্রমনে নেমেছে। তাদের লড়াই কোনো কালেই বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে ছিল না, এখনও নেই। বরং এখন তারা এবং তাদের বুর্জোয়া বন্ধুরা দলিত দলনের শেষ সীমায় এসে পৌঁছেচে। সামনের অস্থির বছর গুলিতে আরো অনেক কিছু দেখা বাকি আছে হলফ করে বলা যায়।