দেশের সর্ব্বোচ্চ জবাবদিহিতার কাঠগড়া হচ্ছে আমাদের অতিকাঙ্খিত জাতীয় সংসদ। প্রধানমন্ত্রী শাসিত গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার ভিত্তিস্বরূপ। সম্প্রতি নির্বাচন পূর্ব প্রচারকালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করে সমগ্রদেশে বিশেষ করে তরুণ এবং কিশোর সমাজে যে আলোড়ন তুলেছেন, তা এদেশের অগ্রগতি এবং একুশ শতকের রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনের দিগন্তব্যাপী উজ্জ্বলতা কিনা, এখনই বলা মুশকিল। তবে প্রাণসঞ্চারী এই আহবান যে বিমর্ষ এবং দারিদ্রক্লিষ্ট জাতিকে নিরাশার হতবিহ্‌বলতা থেকে তুলে এনে আশার আলো জ্বেলেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। আশা-নিরাশার দোলাচলে একটু একটু করে ভেসে গন্ত্যব্যে হয়তো আমরা পৌঁছুবো, কিন্তু এই অগ্রযাত্রাকে গতিময় করতে, কন্টকমুক্ত রাখতে দরকার কতোগুলো ঢাল। কারন ইতিহাস বলে এজাতির অগ্রগতি কখনো কন্টকমুক্ত ছিলোনা এবং সম্ভবতঃ ভবিষ্যতেও থাকবেনা। এর বহুবিধ কারণ আছে, সাধেই আমাদের জাতীয় কবি ঝাকড়া চুলের বাবরী দুলিয়ে গেয়েছিলেন,

“দুর্গমগীরি কান্তার মরু দুস্তর পারাপার হে/
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশিতে যাত্রিরা হুঁশিয়ার।“

অধুনা সংবাদপত্রে বিশিষ্টজনেরা রাষ্ট্রযন্ত্রের স্টিয়ারিংধারীদের অনেক অনেক বিষয়ে সদাই সতর্ক করে যাচ্ছেন। এর প্রয়োজনও আছে। কারণ, প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি সমুহ এবং তদীয় আন্তর্জাতিক স্বার্থান্বেষী মহল তো চুপ করে নেই। ওদের নোংড়া হাত এ সরকারের ঠিক কতোটা ভেতর পর্যন্ত প্রলম্বিত সময়েই তা বুঝা যাবে। নইলে সাম্প্রতিক কালে বি. ডি. আর. সহ যে সব ঘটনা গুলো একে একে ঘটে গেলো আর নিয়ন্ত্রনহীন পাগলা ঘোড়ার মতো ছাত্রলীগের এহেন নেতিবাচক দামালপনা সামান্য আলোর রেশ পাওয়া এই জাতিকে হঠাৎ খানিকটা শংকিত করে তুলেছে বৈকি। কাজেই সভাবতঃ মনেই হচ্ছে, সরকার যন্ত্রের ভেতরের কলকব্জা গুলোর মধ্যে কোথায় যেন সমন্বয় হীনতা কাজ করছে। মাঝে মাঝেই মাননীয় মন্ত্রী-এম. পি দের ঠোকাঠুকি, কিংবা মন্ত্রীর মহোদয় গনের অলঙ্ঘনীয় নির্দ্দেশ উপেক্ষা কিন্তু সেই ঈঙ্গিত খানিকটা দিচ্ছে বলেই মনে হয়। তবে জনসাধারনের যে ব্যাপক প্রত্যাশা এ সরকারের প্রতি রয়েছে তাতে দ্বিমত পোষনের কোন সুযোগ নেই। আসলে জাতির পিতার কন্যা হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীই আজ এদেশের মানুষের প্রত্যাশার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিনত হয়েছেন অনেকাংশে। কাজেই চলমান সরকারের সাফল্যের অংশিদারীত্বের সংকট না থাকলেও ব্যার্থতার সকল বোঝা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকেই বহন করতে হবে। আর তাই স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনা, অবাধ তথ্য সরবরাহ এবং সর্ব্বপরি দেশের আপামর জনসাধারনের পরিবর্তিত প্রত্যাশা সহ তাদের সকল আকাঙ্খার পরিনতি, পরিবর্তন, সংশোধন এবং পরিবর্ধনের তথ্য সম্পর্কে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে সদা তৎপর থাকতেই হবে। আর এ সংক্রান্ত চলমান কি কি প্রকৃয়া রয়েছে, কি হতে পারতো আর কি করা যেতে পারে সীমিত ভাবে তার খানিকটা তুলে ধরার চেষ্টা করবো।

যে বিষয়টাকে আমি সবিশেষ গুরুত্বে তুলে ধরতে চাই তা হলো আমাদের রাজনৈতিক দৈন্যতা। আমার কৈশোরে জাতীয় রাজনীতিতে যাঁদের নাম শুনেছিলাম অথবা যাঁদের খ্যাতি ছিলো ছাত্র-রাজনৈতিক অঙ্গনে, তাঁদের অধিকাংশ হয় আজ আর রাজনীতিতে সক্রিয় নন, কিংবা পতিত রাজনীতির অঙ্গন থেকে নিয়েছেন বিদায়, অথবা পতিত হয়েছেন নতুবা জীবন বিসর্জন দিয়েছেন পতিত রাজনীতির কালো অন্ধকারে। তাছাড়া এককালে রাজনীতিতে চৌকষ এবং মেধার সংযোজন হতো, কালক্রমে সে রীতি বদলে গেছে। তদস্থলে এখন সংযোজিত হচ্ছে ‘ক্যাডার’ নামীয় কিছু উশৃংখল যুবক। এরা হালে রাজনীতি বলতে বুঝে চাঁদাবাজী, জবরদখল, মারপিট এবং অসামাজিক কার্যক্রম। আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের ছাত্র, তখন দেখেছিলাম এদের কতিপয়ের স্বেচ্ছাচারিতা। তথাকথিত ছাত্র নেতারা, গোটা ক্যম্পাসে অতিশয় প্রভাবশালী, ক্যান্টিনে, রেস্তোরায় কিংবা চাঁনখার পুলের হোটেলে রসিয়ে খেয়ে বিল পরিশোধ না করা, ট্রাক থেকে কাপড়ের থান কিংবা আটার বস্তা নামিয়ে নেয়া, যত্রতত্র চাঁদাবাজী করা, শিক্ষক বৃন্দের সঙ্গে অসদ্‌আচড়ন করা এবং মস্তানী করে ত্রাস সৃষ্টি করা এগুলো ছিলো এদের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যপার! এগুলোই তাদের বীরত্বের প্রতীক! শিক্ষাঙ্গনে এসে এগুলোই তাদের বিশেষ অর্জন! এদের অধিকাংশেরই বয়েস ত্রিশ থেকে চল্লিশোর্ধ। এদের সাথে যুক্ত হতো সাধারন নিয়মিত ছাত্র-ছাত্রী। সুতরাং নিয়মিতরা হতো এদের অনুগামী। ছাত্র রাজনীতির পাট চুকিয়ে এরা অনেকেই যুক্ত হয়েছেন জাতীয় রাজনীতিতে। এদের বেশীর ভাগকেই আমি দেখেছি লাইব্রেরী সায়েন্স কিংবা অনুরূপ কোন বিষয়ের ছাত্রত্ব নিতে, ভাবখানা এরকম, এগুলো গুরুত্ত্বহীন বিষয়, সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে বৈধতার জন্যেই উক্ত বিভাগ গুলোতে তাদের আধিক্য থাকতো! শিক্ষাটা যেহেতু মুখ্য ছিলো না, সুতরাং প্রকৃত শিক্ষার আলো এদের কখনো স্পর্শ করেনি। কাজেই ধরেই নেওয়া যায়, যে চর্চাটি তারা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে করেছে, জাতীয় রাজনীতিতে অন্তর্ভূক্তির পরে স্ব স্ব এলাকায় একই চর্চা তারা করেছে, ক্ষেত্রবিশেষে আরোও কদর্য এবং নির্মমতায়! নিজ দলের মনোনয়ন নিয়ে এরা জাতীয় সংসদের সদস্যও হয়েছে। সঙ্গত কারনেই এদের মনোবৃত্তি এবং চেতনা আমাদের জাতীয় আকাঙ্খাকে ধারন করেনা। এরা জাতিকে কোন দিক নির্দ্দেশনাও দিতে পারে না, পাড়ার কথাও নয়। সুতরাং মহান জাতীয় সংসদে এদের ভুমিকা কি হবে, আত্মম্ভরিতা, দলবাজী আর একান্ত ব্যক্তিগত স্বার্থের পসার বাড়ানো ছাড়া? তাহলে স্পষ্ট হলো যে, প্রকৃত অর্থে এরা আমাদের জাতীয় সংসদে সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিনিধিত্ত্ব করেনা। দেশে যাঁরা প্রথিত যশা আলোকিত জন, তাঁদের চিন্তা-চেতনা, আদর্শ-ব্যক্তিত্বকে ধারন করা কিংবা তাঁদের নির্দ্দেশিত লক্ষ্যে অবিচল থেকে দেশ এবং জাতিকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষমতা কিংবা দক্ষতা কোনটাই এদের নেই। সেকারনেই জাতির আকাঙ্খা এবং নেতৃত্বের মাঝে কোন সমন্বয় নেই। নেই কোন সম্পর্ক কিংবা সমীকরণ টানবার জো। সুতরাং এদিক থেকে জাতির অনেক কিছু থেকেও কান্ডারী বিহীন! একটি ঘুর্নীপাকে আবর্তিত এবং পর্যুদস্ত! আর গোটা রাজনৈতিক অঙ্গনে রয়েছে একধরনের মেধাশুণ্যতা। সেই কারনেই দেখুন বৃটেনের পার্লিয়ামেন্ট মেম্বারদের জনগনের ট্যক্সের টাকার অপব্যবহারের জেরে সে দেশের জাতীয় সংসদের স্পীকার ইতোমধ্যেই পদত্যাগ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউনের ত্রাহীমধুসূদন দশা! পার্লিয়ামেন্ট মেম্বাররা যা করেছেন তা আবার নাকি প্রচলিত আইন বিরুদ্ধও ছিলো না। মিলিয়ে নিন এবার আমাদের দেশের পরিস্থিতি! স্বয়ং আমাদের বিগত স্পীকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তায় আবার আইন পরিপন্থী অতি দরীদ্র দেশের ততধীক দরীদ্র জনের ট্যক্সের অর্থের ব্যক্তি স্বার্থে ব্যবহার এবং পুকুর চুরি! ভাবা যায়? আমরা সাধারন মানুষেরা এদের নাম উচ্চারণের আগে ‘মাননীয়’ ব্যবহার করি! আবার এই ব্যবহারটি আইনসিদ্ধও বটে! এবার বুঝুন তাদের আত্মমর্যাদাবোধের মাপকাঠি! গত ৭ই জুনের ‘দৈনিক জনকন্ঠে’ “কৃষকের আত্মহত্যায় নেত্রকোনার গ্রামে চলছে মাতম” শিরনামে একটি সংবাদ পড়েছিলাম। বেচারী কৃষক তাঁর গ্রামের কৃষকদের স্বার্থ কতিপয় প্রভাবশালীদের হাত থেকে উদ্ধারে ব্যার্থ হয়ে অবশেষে ক্ষোভে, অভিমানে আত্মহননের পথ বেছে নেন। সাম্প্রতিক কালের আরেকটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনার দিকে তাকানো যাক। দক্ষিন কোরিয়ার সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হলে, সকল অনৈতিকতার দায় কাঁধে নিয়ে জনগনের কাছে ক্ষমা চেয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেন। আমি কাউকেই আত্মহননে প্ররোচিত করতে চাই না। কিন্তু দুটি বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করতে চাই। প্রথমতঃ একজন দরীদ্রদেশের ততধিক দরীদ্র কৃষকের আত্মবলীদানের নেপথ্য কারন আর এক ধনী দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের আত্মবলীদানের নেপথ্য কারনের বিপরীত মুখীনতা! দ্বিতীয়তঃ শিক্ষা এবং তার অন্তর্নিহিত বোধের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাক্তির সামাজিক গুরুত্ব এবং আত্মমর্যাদাবোধ! প্রথম ক্ষেত্রে কৃষক তাঁর দায়িত্ববোধ এবং স্বদেশ প্রেমের মহীমায় চোখে আঙ্গুল দিয়ে আমাদের আইনের অসারতা এবং প্রভাবশালীদের রাষ্ট্রীয় ছত্রছায়ায় নির্লজ্জ্ব প্রভাব বিস্তারের বাঙ্ময় উচ্চারণ! এদিকে রাষ্ট্রপতি মহোদয় তাঁর আত্মমর্যাদা বোধের ব্যাবচ্ছেদ কার্যক্রমে টেনে দিয়েছেন সুদীর্ঘ যোতি চিহ্ন! হয়তো সামাজিক মর্যাদাবোধের সুউচ্চ প্রসাদের অন্দরমহলে চলছিলো নিদারুন দাবাদহ, সেই অসহ্য দহন থেকে পরিত্রানের সর্ব্বশেষ উপায় হিসেবেই আত্মমর্যাদাবোধের শানিত তরবারিতে সব কিছু খান্ খান্ করে দিয়েছিলেন। আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে কৃষক নিজের অসহায়ত্ব, সীমাবদ্ধতার কথা জেনেও নিজেকে বিলীন করে রাষ্ট্রের কাছে, তার মর্যাদার কাছে রেখে গেলেন প্রশ্ন। “আমার জীবনের বিনিময়েও কি রাষ্ট্র এই অনৈতিক প্রভাবের বিরুদ্ধে অবশিষ্ট অবহেলিতের পাশে এসে দাঁড়াবে না?” কৃষক তাঁর আত্মমর্যাদার পরীক্ষায় উত্তীর্ন হয়েছে, এবার রাষ্ট্রকে তার বোধের পরিচয় নিয়ে আসতেই হবে সামনে। ঐ দেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি তাঁর কর্মময় জীবনে যে ভুলই করেননা কেন, জীবনের অন্তিম মুহূর্তের আত্মবোধের পরীক্ষায় সমহীমায় প্রজ্জ্বলিত হয়েছেন! দেশ বাসীর অনিঃশেষ শ্রদ্ধাবোধের অর্ঘ্য দিয়েই তাঁর শেষ যাত্রা কুসুমাস্তির্ন হয়েছে। এই দুক্ষেত্রেই আসলে প্রকাশিত হয়েছে শিক্ষার মহীমা, যথপোযুক্ত মর্যাদাবোধের আলোয়। তথা কথিত ব্যারিস্টারের ব্যারিস্টারী শিক্ষা এটি নয়, এটি আত্মপোলব্ধি, আত্মজাগরণের শিক্ষা।

দেশের সর্ব্বত্র ছড়িয়ে আছে সরকারী অফিস এবং বিভিন্ন সেবা দানকারী সংস্থা। এ সরকারের লক্ষ্য ছিলো সরকারের উপরে জনগনের আস্থা বাড়িয়ে তোলা। স্বাভাবিক কারনেই বর্তমান সরকারের প্রতি গনমানুষের আস্থার মাত্রা বেশী, মানে হলো, প্রত্যাশা আকাশ ছোঁয়া! কিন্তু বিগত দিন গুলোর পরিসংখ্যান কি বলে? আস্থা কি বেড়েছে? আমার ধারনা মানুষের মাঝে দিন দিন হতাশা বাড়ছে। কারন, প্রত্যাশা অনুযায়ী সরকারী প্রতিষ্ঠানে জনগনের পরিসেবার মাত্রা বাড়েনি। বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা কমেছে। গত জুন ৮, ২০০৯ এর দৈনিক প্রথম আলোতে দেখলাম সিরাজগঞ্জে একদল কুলাঙ্গার ফতোয়াবাজ এক নির্যাতিতাকে তারই ভাইএর হাতে ১০১ বেত্রাঘাত করেছে! কিংবা গত ১৭ই জুলাই প্রথম আলোয় দেখুন একটি খবর “বাবাকে দিয়ে ছেলের দু’চোখ তুলে নিল সমাজপতিরা”। ক’দিন আগে RAB-র হাতে বিনা বিচারে ঢাকা পলিটেক্‌নিকের দুই ছাত্রের মৃত্যু একটি অশনিসংকেত। তায় আবার মন্ত্রী মহোদয় বলেছেন তাঁর সরকার আমলে বিনা বিচারে কোন মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি! মন্ত্রী মহোদয়ের কি ধারনা আমজনতা চোখ বন্ধ করে আছে? বহিঃশত্রু যদি দেশে কোন দুর্ঘটনা ঘটিয়ে যায় মন্ত্রী মহোদয় কি দায় এড়াতে পারবেন? আজকের (অগাষ্ট ২, ২০০৯) দৈনিক জনকন্ঠে প্রবন্ধকার রণেশ মৈত্রের “একটি যথার্থ মূল্যায়ন” শিরঃনামে যে প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে, দেখুন- দেশের বর্তমান হালহকিকত আর গন মানুষের সংশয়ের তীলক হিসেবে প্রবন্ধটিকে বিবেচনা করা যায় কিনা। এ সরকারের ছ’মাসেরও বেশী সময়ে যদি এইসব সমাজবিরোধীদের দৌড়াত্ত্ব থেকেই যায় তাহলে ধরে নিতেই হবে যে চলমান সরকারের হাত যথেষ্ট দুর্বল। একবিংশ শতকের দেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে মাঠে নেমেছেন, মানুষ গুলোকে ষোড়শ শতকের ঠাউরে নেওয়াটা বোধ হয় ঠিক হচ্ছেনা! মাঠ পর্যায়ে সরকারের অনুসৃত নীতিমালা প্রকৃত অর্থে কার্যকর হচ্ছে না। শুধু এক্ষেত্রেই নয়, আমি নিশ্চিন্ত যে অপরাপর সরকারী সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান গুলোতেও একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে। আমার ছোটবোন তার পরিবার নিয়ে আজ সকালে দিনাজপুর থেকে ট্রেনে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছে। যাত্রাপথে তাদের খোঁজ নিতে গিয়ে জানলুম তারা তখন হিলি বর্ডারের কাছে, তারা প্রথম শ্রেনীর রিজার্ভেশন কামরায় অথচ বেশ হৈচৈ আর ট্রেনের ঘনঘন হুইসেলের শব্দে জানতে চাইলাম কি ব্যপার, শুনে তো আমার আক্কেল গুড়ুম! ওরা বল্‌লে, যে শত শত চোরাচালানীর সঙ্গে জড়িতরা বিপুল পরিমান চোরাই ভারতীয় কাপড়, সার এবং অন্যান্য দ্রব্য সহ ট্রেনে উঠছে, যদিও সেখানে সম্ভবতঃ উক্ত ট্রেনের কোন নির্ধারিত বিরতি নেই। সব থেকে অবাক হবার ব্যপার হলো, হাজার হাজার বি. ডি. আর. সদস্য সেখানে উপস্থিত থাকলেও তারা নিছকই দর্শক! হায়রে আমার দেশ, আমার দেশ প্রেমিক দেশ-রক্ষাবাহিনী আর প্রশাসন! বিগত জোট আমলে নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের অব্যবহিত পরপর যে নারকীয় পরিস্থিতি দেশময় বিরাজ করছিলো, তখনতো পূর্ববর্তী সরকারের প্রশাসনই বহাল ছিল। কই তখনকার বিগত সরকারের প্রশাসনতো সেটাকে সামলাবার কোন উদ্যোগ নেয় নাই। নির্বাচন অব্যবহিত পর পর তাহলে সমগ্র প্রশাসন তৎকালীন নবাগত সরকারের থলের মধ্যে ঢুকে গেলো! আর এ সরকারের ছয় ছ’টি মাস অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও প্রশাসন কাজ করছে না? এটি কি বিশ্বাস যোগ্য? একটি বড় ধরনের প্রশ্নের অবকাশ এখানে থেকেই যায়। ব্যপক জননন্দিত, জনপ্রিয় এই সরকারের যাত্রা ভঙ্গের ঘটনা ঘটছে না তো? মানে বাঘের ঘরে ঘোগের বাসার মতো কিংবা নিজের পা কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করার মতো কিছু? সরকার যন্ত্র সতর্ক তবুও আমার সংশয় যেন কাটছে না। সম্ভবতঃ মাননীয় প্রধান মন্ত্রী প্রাচীর বেষ্টিত হয়েছেন! যা পরিস্থিতির সাপেক্ষে খুবই স্বাভাবিক। আগেই বলেছি ব্যার্থতা সবই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর! সফলতার ভাগ নেবার প্রার্থীর অভাব হবেনা! কাজেই সাবধানতার অবকাশ কিন্তু এখানে রয়েই যায়।

সাম্প্রতিক কালে সদাসয় সরকার জনস্বার্থে অনেক অনেক কল্যানমুখী কাজের পরিকল্পনা করেছেন তাদের নির্বাচনী মেনিফেস্টো অনুযায়ী। যেমন ধরাযাক, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম, জাতীয় শিক্ষানীতি প্রনয়ন, নারী অধিকার আইন, বিদ্যুৎ সমস্যার মোকাবিলা, সরকারী কর্মকর্তা বৃন্দের বেতন ভাতা এবং সরকারী-বেসরকারী শিক্ষক বৃন্দের বেতন কাঠামো সংক্রান্ত বিল, বাজার নিয়ন্ত্রন, সার সংকটের সমাধান, অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ, পরিবেশ দুশন রোধ, যানবাহন ও রাস্তা-ঘাট আধুনিকীকরণ, ব্যঙ্ক-বীমা, অফিস-আদালত ডিজিটালাইজেশনের আওতায় আনা ভারত ও মায়ানমারের সংগে গভীর সমুদ্র-সীমা বিতর্কের মিমাংসা, জাতীয় বাজেট এবং সর্ব্বপরি সাম্প্রতিক ইস্যু ভারতের টিপাইমুক বাঁধ প্রকল্পের ব্যাপারে স্থির সিদ্ধান্তে আসা ইত্যাদি। পত্র-পত্রিকায় যতদূর দেখেছি, দেশের সাধারন মানুষ থেকে বিভিন্ন পর্যায়ের বিশেষজ্ঞদের অভিমত হলো এই টিপাইমুখ বাঁধ আমাদের জন্যে কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে। তথাপি মাননীয় মন্ত্রীদের কেউ কেউ উচ্চকিত হয়ে বলছেন, বাংলাদেশ এতে লাভবান হবে! ধরাযাক নদীর পানি ভারত প্রত্যাহার করবেনা বলে চুক্তিবদ্ধ হলো, পরবর্তীতে চুক্তির বরখেলাপ করলে বাংলাদেশের কি করনীয় থাকবে? এব্যপারে এদেশের জনগনের স্পষ্ট ধারনা থাকা চাই, তাছাড়া বিষয়টির সাথে পরিবেশের সরাসরি সম্পর্ক থাকায় এটি দায়িত্ত্বশীল বিশেষজ্ঞদের প্যনেলে (যাঁরা ভবিষ্যতে সমস্যা দেখা দিলে দায়িত্ত্ব এড়িয়ে যাবেন না) সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আজকের (অগাষ্ট ২, ২০০৯) দৈনিক জনকন্ঠে আরোও একটি প্রবন্ধ কিছুটা আশার সঞ্চার করলেও কয়েকটি জায়গায় আশংকা বোধ করতেই হয়। পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা (ওয়ারপো)-র প্রাক্তন মহাপরিচালক কাজী গোলাম মোস্তফা যদিও “টিপাইমুখ ড্যাম হলে বাংলাদেশ কি সত্যি মরুভূমিতে পরিনত হবে?” শিরঃনামের প্রবন্ধে দেখিয়েছেন যে, কথিত ফুলেরতলা ব্যরেজ নির্মিত না হলে শুকনো মৌসুমে স্বাভাবিক প্রবাহ ছাড়াও বর্ষা মৌসুমে বন্যার সম্ভাবনা ব্যাপক হারে হ্রাস পাবে। কিন্তু তার পরেও শুকনো মৌসুমে ভাটি অঞ্চলের মাটির গভীরে জলের স্তরের তারতম্যের হার কিভাবে পরিবর্তিত হবে তার সুনির্দ্দিষ্ট কোন তথ্য আছেকি? আছেকি এমন কোন পরিসংখ্যান, যেখানে বাতাসের স্বাভাবিক আর্দ্রতার হার কিভাবে পরিবর্তিত হবে, অথবা এই আর্দ্রতার তারতম্য (যদি বড় আকারের কিছু হয়) আমাদের সিলেট অঞ্চলের বন এবং বন্যপ্রকৃতি তথা আবহাওয়া জনিত পরিবর্তন কিভাবে ঘটবে? আমার ধারনা এধরনের স্পর্শকাতর বিষয়ে সরকার প্রধানের কাছে দেশের আপামর জনগনের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থানটি স্পষ্ট হওয়া উচিত। বাস্তবে তা হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ স্বার্থান্বেসী মহল অপেক্ষায় আছে দাবার চৌকষ চালটির অপেক্ষায়! আর এখানেই সরকারের ভেতরে ওত পেতে থাকা সূঁচ গুলো ফাল হয়ে বেড়িয়ে আসতে চাইবে। শুধুমাত্র এই কাদা মাটির আন্তরিক অভিপ্রায়টি আমলে না আসার জন্যে অনেক অনেক মূল্য হয়ত গুনতে হতে পারে ততধিক কোমল এদেশের অসহায় মানুষ গুলোকে! সহস্র বছর ধরে এজাতির অনুরূপ অভিজ্ঞতাই বার বার হয়েছে। ফারাক্কা বাঁধ এবং এর প্রতিক্রিয়া এর প্রমান! সুতরাং ব্যপক বিতর্ক এবং বিশেষঞ্জ পর্যায়ের জরীপ, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম সম্ভবতঃ আরোও পরিষ্কার ধারনা তৈরীতে সহায়ক হবে সরকারের নীতি নির্ধারক মহলের কাছে।

আসলে ভারি অভাগা এদেশের প্রায় চৌদ্দ কোটি মানুষই! বাকি এক দেড় কোটির বৃহদংশই কোন না কোন ভাবে নিজেদের গুছিয়ে নিয়েছেন। আর বাকীরা ক্ষমতার কাছাকাছি থেকে ক্ষমতার অপব্যবহারে, রাষ্ট্রীয় সুযোগ কুক্ষিগত করে, দেশকে এবং দেশের আপামর মানুষজনকে নিজেদের স্বার্থে যথেচ্ছ ব্যবহারে লাভবান হয়েছেন! গত ১০ই জুনের দৈনিক গুলো খুলে দেখুন, দেখবেন একটি সংবাদ শিরঃনাম হয়ে আছে, “মন্ত্রী-সাংসদদের বাড়ি উঠে গেছে, সাধারন মানুষ প্লটই পাচ্ছেনা!”। শুধু মন্ত্রী-সাংসদ নয় প্রশাসনের কিছু আমলা আর কর্থা ব্যক্তিরাও আছেন! এ ধরনের স্বার্থ উদ্ধারের কর্মকান্ড ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে, পত্র-পত্রিকায় তার আলামত স্পষ্ট! আবার আগামীতে পালা বদলের যখন সময় হবে আপনারা (রাজনীতিবিদেরা) এই নিরীহ মানুষ গুলোকে টেনে নিয়ে পথে নামাবেন আর আপনাদের স্বার্থেই এরা পথে বলি হবে। কিছুদিন পরে আবারও সেই একই সচিত্র সংবাদ আমরা পত্রিকার পাতায় দেখবো, “রাঘব বোয়ালদের উঁচু বাড়ি গুলো আরো উঁচু হয়েছে আর আমজনতার জন্যে কিছুই অবশিষ্ট নেই!” মাননীয় প্রধানমন্ত্রীই বলুন, সেই একই দৃশ্য আপনিও দেখে এসেছেন আর তাই আজ ব্রত করেছেন বাঙ্গালীর ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য। কিন্তু মীর জাফরেরা ছড়িয়ে আছে চতুর্দিকে! আপনার ভাগ্যহত জনগনের দিকে চেয়ে তাদের আকাঙ্খা বাস্তবায়নে গুরুত্ত্ব দিতে বলুন আপনার প্রশাসনকে!

কিন্তু প্রশ্ন হলো একটি স্বাভাবিক পদ্ধতিতে তো আপনি জানবেনই আপনার আমজনতার আকাঙ্খা, তবে তার ভিত্তি টা তো নিশ্চিন্ত হওয়া জরুরী। আপনি প্রধান মন্ত্রী থাকুন কিংবা আরো সম্মানীয় বড় কেউ অথবা বিরোধী দলীয় নেত্রী, জন আকাঙ্খা তো আপনার নখদর্পনে থাকা চাই-ই চাই। এটি সম্ভব বিভিন্ন ভাবে পরিকল্পনার সমন্বয়ে। যা আপনার সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দর্পন হতে পারে। যেখান থেকে আপনি পেতে পারেন আপনার জনতার আকাঙ্খা, আবেগ। আপনার প্রতি তাদের নির্ভরতা এমনকি রাগ কিংবা বিরাগ!

যে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন আপনি তাদের দেখিয়েছেন সেটিকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত উদ্দীপনা এবং নিজস্ব ডিজিটালাইজড্ কর্ম পরিকল্পনার ব্যাপ্তির মাধ্যমে। আমি বলতে চাইছিলাম যে, দেশের জাতীয় সংসদ যেহেতু সর্ব্বোচ্চ নীতি নির্ধারনী ফোরাম। সেই জাতীয় সংসদকে ডিজিটালাইজেশনের আওতায় আনাটা বোধ হয় এই মুহুর্তে জরুরী।

আমরা যদি বিশ্বের অপরাপর দেশ গুলোর দিকে তাকাই, তাহলেই এর বিশেষত্ত্ব আমাদের নজরে আসবে। যেমন ধরাযাক দক্ষিন কোরিয়ার ই-পার্লিয়ামেন্ট, নাইজেরিয়া, সেনেগাল, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম, রোয়ান্‌ডা, ইথিওপিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আ্যমেরিকার দেশ গুলো সহ প্রায় সত্তরটির মতো দেশে আংশিক বা পূর্ণভাবে ই-পার্লিয়ামেন্টিরী পদ্ধতির অনুসরণ করা হচ্ছে। এতে করে যা ঘটেছে, দেশ গুলোতে প্রশাসনিক দক্ষতা বাড়ার সাথে সাথে প্রয়োজনীয় তথ্যের ঘাটতি হ্রাস সহ দুর্নীতি এবং অপ্রয়োজনীয় বিতর্কের প্রায় পরিপূর্ণ অবসান ঘটেছে। আসলে এই ই-পার্লিয়ামেন্টের পূর্বশর্ত হলো, প্রয়োজনীয় অবাধ তথ্যের যথেষ্ট সরবরাহ। তার জন্য চাই ডিজিটাল লাইব্রেরী ব্যবস্থা ই-লাইব্রেরী সুবিধা সহ। যেখানে বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত বড় বড় লাইব্রেরী, বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষনা প্রতিষ্ঠান গুলোর সাথে চুক্তিমোতাবেক থাকতে হবে অবাধ তথ্য সরবরাহের সুনিশ্চিত ব্যবস্থা। সেই সাথে গড়ে তুলতে হবে ইলেক্ট্রনিক ভোটের ব্যবস্থা। সুতরাং পাকাপাকি ই-গভার্নেন্স ব্যবস্থার ভিত্তি এখানেই রচিত হবে। সংহত গনতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি যে সংশয়, এর অবসান ঘটবে অনেকাংশে।

বলাই বাহুল্য যে, যে গনতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্যে যুগ যুগ ধরে বাঙ্গালী লড়াই করছে, আজও অধরাই থেকে গেছে, বাঙ্গালী মানুষ হিসেবে তার মৌলিক অধিকারের সুষম ছায়ায় পৌঁছুতে পারেনি আজও। সেই কবে মনের গভীরতম প্রদেশ হতে উত্থিত দুঃখবোধ আর উদ্গত ক্ষুব্ধতায় আমাদের মৌনী কবি বলেছিলেন,

“হে বঙ্গভূমি, সাত কোটি সন্তানেরে রেখেছো বাঙ্গালী করে, মানুষ করোনি!”

সত্যিইতো আমরা মানুষ হতে পারিনি যে! কবির সেই অমোঘ বাণী আজও সমান দৃঢ়তায় সত্য! ১৯৭২ এর ১০ই জানুয়ারী এই বাঙ্গালী জাতির পিতা স্বদেশ ভূমিতে ফিরেই পরম শ্রদ্ধায় মমতায় আমাদের আত্মার মৌনী কবিকে উদ্দেশ্য করে সৃষ্টির আনন্দাবেগে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘হে কবি গুরু, দেখে যাও, তোমার বাঙ্গালী আজ সত্যিই মানুষ হয়েছে!’ পিতা মানুষ হবার স্বীকৃতি দিয়ে গেলেও মানুষ যে আমরা হইনি তার প্রমান রেখেছি সেই পিতৃহত্যার কালো অধ্যায় রচনার মধ্যদিয়ে ৭৫-এ। এই সত্যকে আরোও জাজ্বল্যমান দেখতে পাই এখানে, যখন …এয়ারপোর্টে ফিদেল ক্যস্ট্রো মানুষ হিসেবে আমাদের পশুত্বকে ইঙ্গিত করে বাংলাদেশের এক দল সাংবাদিককে কে বলেছিলেন,

“তোমরা তোমাদের জাতির পিতাকে হত্যা করেছো”।

সেই পশুত্ত্বের পুরু চামড়া এবার এজাতির পৃষ্ঠদেশ হতে ছাড়িয়ে নিতে হবে! সেই কালও হয়তো সমাসীন। কিন্তু কি করে তা হবে? প্রয়োজন কতকগুলি মামুলী অথচ সুদূরপ্রসারী ভাবনা, আর দরকার এদের সময়োচিত যথাযথ বাস্তবায়ন। ই-পার্লিয়ামেনট পদ্ধতির অনুকল্প হিসেবে ডিজিটাল পার্লিয়ামেন্ট পদ্ধতির প্রচলন। এর আনুসঙ্গীক তুলনামুলক ব্যায় এবং ব্যবস্থাপনা কিঞ্চিৎ বেশী এবং জটিল, তথাপি এর ইতিবাচক প্রভাব দেশ-কাল এবং সম্প্রদায়ের উপড়ে উঠে গিয়ে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করে। দৃষ্টিভঙ্গী উদারনৈতিক, আন্তর্জাতিক এবং কালজয়ী হতে বাধ্য। অন্ততঃ পক্ষে আমাদের মতো এমনতরো অনভিপ্রেত অকাল-পতিত জাতির জন্যেতো বটেই। নিখাদ যান্ত্রিক সিদ্ধান্ত! প্রথমতঃ এইজন্যে প্রযোজ্য যে, প্রতিটি নির্বাচনেই গনতন্ত্রের ধ্বজা উড়িয়ে অবশেষে একধরনের স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতা ক্ষমতার মস্‌নদ পশ্চাদ্‌দেশ স্পর্শ করা মাত্রই আমাদের পেয়ে বসে! ওদিকে মস্‌নদের দিকে চেয়ে তেরোহাত লালায়িত জিহ্‌বা প্রলম্বিত বিরোধীদের শ্যান দৃষ্টি! আস্থা-বিশ্বাস, যুক্তি-বুদ্ধিবৃত্তির লেশ মাত্র সেখানে থাকেনা। থাকেনা কারন, তথ্য ঘাটতি বা বিভ্রাট কিংবা তথ্য-বিকৃতি! অথবা দেদার মিথ্যাচার! নইলে দেখুন, বাকশাল বিতর্ক, রাজাকারের নাগরিকত্ত্ব বিতর্ক, জন্মদিনের বিতর্ক, স্বাধীনতার ঘোষক বিতর্ক, জাতীয়তার বিতর্ক…., বিতর্কের শেষ নেই! কিন্তু কেনো? এগুলোকি নিস্পত্তিকৃত ইস্যূ নয়? তবুও বিতর্ক কেনো? কেনো এই কাল ক্ষেপন? এ নিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে কেনো অর্থনাশ? একশ্রেণীর বুদ্ধি ব্যবসায়ীর কতো শত-হাজার-লক্ষ-কোটি ডলারের লেনদেন এতে হয়েছে, অছে এর পরিসংখ্যান? আর আছেও তেমন বুদ্ধি ব্যাবসায়ী, অঢেল! এরা জানে না, বাঙ্গালীর সামাজিক, রাজনৈতিক আর বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের গতি প্রকৃতি? তবে কেনো এই ভড়ং? বাঙ্গালীর সত্ত্বার ভেতরে সেই অনাদিকাল ধরেই যেমন স্বাধীন চেতনার পাশাপাশি মহৎ মানবিকতার উষ্ণ প্রস্রবন শিরায়-ধমনীতে প্রবাহমান তেমনি মীর জাফরের কালচে শনিতের ক্ষীনধারাও বইছে পাশাপাশি! পায়ের তলা হতে উত্থিত ঐ পিশাচ যখন শিরঃপীড়ার কারন হয় তখনই এ জাতির অহঙ্কারের গায়ে লেপিত হয় কলঙ্কের কালো অন্ধকার! সেই কালো অন্ধকার যাতে আর কখনো নেমে না আসে, এ জাতির ভাগ্যবিপর্যয়ের সাথে আর যাতে আপনাদের নাম গুলো জড়িয়ে না থাকে, মহাকালের শকুনীরা যাতে এ জাতির ভাগ্যাকাশে আর পাখা মেলতে না পারে তার ব্যবস্থা করুন।

শিক্ষা-বিস্তারের পাশাপাশি এই ভাগ্যাহত জনগোষ্ঠীর সুদূরে চোখ মেলবার, দূর দেখবার আর মনটাকে আপন হৃদয়ের বাইরে মেলেদেবার ব্যবস্থা করা জরুরী। জনগন আপনাদের পাশেই থাকবে। আগেই বলেছি প্রায় চৌদ্দকোটি ভাগ্যাহত জনগোষ্ঠীর দেশে কিভাবে ওদের ভাগ্য ফেরাবেন, কি ওদের আকাঙ্খা, জেনে নিন সরাসরি। শেয়ার করুন আপনার আইডিয়া, ওদের প্রতিক্রিয়া দেখুন তার পরে জাতীয় সংসদে বসুন ওদের ভাগ্যপরিবর্তনের বিল পাশের জন্যে। মোটেও কঠিন কাজ নয়। কঠিন হলো, ওদের হয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া। গুরুত্ত্ব দিন আজকে যারা তরুণ, যারা কিশোর তাদের। আপনার ছেড়ে যাওয়া হাল তো ওরাই ধরবে! প্রযুক্তি অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে। কোন গোপনীয়তার কি দরকার আছে? কি গোপন করবেন? কার কাছে? আপনি জানেন না যে, আপনার মাটির তলায়, জলের গভীরে, সমুদ্রতটে কিংবা পাহাড় চূড়ায় কি লুকিয়ে আছে, অন্যেরা জানে! সুযোগ করে দিন আপনার অনাগত সন্তানদের, ওরাও যেনো জনতে পারে। ওরাও যেন আধুনিক প্রযুক্তির স্রোতধারায় মিশে এ বিশ্বকে অনাগত ভবিষ্যতের বাস যোগ্য করে গড়ে তুলতে পারে। গোপনীয়তার নামে ওদের জ্ঞানাহরনের সদিচ্ছা থেকে, প্রগতির আলোয় বিকশিত হবার সুযোগ থেকে, তামাম দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবেন না। আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর একটি ছাঁয়া-সংসদ গঠনের মধ্যদিয়ে আপনি তিনটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করিয়ে নিতে পারেন।

১। একটি বিকল্প আরশী, যেখানে আপনি আপনার ভাগ্যাহত জাতির মুখ দেখতে পারেন, জানতে পারেন ওদের অভিপ্রায়, আকাঙ্খা, হতাশা আর দুঃখবোধ।
২। আর একটি আয়নায় আপনি ওদের মুখোমুখি হতে পারেন, জানাতে পারেন আপনার অভিপ্রায়, আপনার পরিকল্পনা!
৩। আর তৃতীয়টি হলো, আপনার এই কর্মপ্রয়াশের মধ্যদিয়ে অবধারিত ভাবে জন্মনেবে একটি কাঙ্খিত স্রোত, আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর, কর্ম্মোদ্দোগী ও কৌশলী এবং প্রতিযোগী মনোভাবাপন্ন তরুণ প্রজন্মের!

আজকের জাতীয় সংসদে সরকার গঠনকারী দলীয় সাংসদবৃন্দ যেখানে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারেন না, পারেন না নিজের মুক্ত-চিন্তা, মুক্ত-বুদ্ধির চর্চা করতে। সেখানে পতিত, গলিত ভিতের উপরে ওরাই গড়ে তুলবে স্বপ্নের দেশ! আজকের অকর্মন্য, সুবিধাবাদের হাত থেকে প্রশাসনিক চেয়ার গুলোর দখল বুঝেনেবে আগামী দিনের ন্যয়নীতির ভিত্তিতে যুক্তি গ্রাহ্য প্রশাসনিক ভিত্তির বুনিয়াদ রচনা করতে। শামিল হবে প্রগতির পথে বিশ্বায়নের যুগে অগ্রযাত্রায়। এই অগ্রযাত্রার দ্বার উন্মোচন এখন জরুরী-

  • ইন্টারনেট ভিত্তিক ছাঁয়া সংসদ গঠন করুন, যা এখনি করা যেতে পারে। বয়স, পেশা, ধর্ম-বর্ণ, শিক্ষাগত যোগ্যতা, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বাংলাদেশের নাগরিক প্রত্যেকেই এই সংসদের সদস্য হবার যোগ্য হবেন শুধুমাত্র ভোটার আইডেন্টিটি কার্ড থাকা সাপেক্ষে।
  • এই ছাঁয়া সংসদের মেয়াদ হবে সর্ব্বোচ্চ দু’বছর। সারা বছর ধরেই রেজিষ্ট্রেশন চালু থাকবে। পুরনো সংসদের মেয়াদ শেষ হবার আগেই কোন এক নির্দ্দিষ্ট সময়ে স্বয়ংক্রিয় ভাবে নতুন সংসদ গঠিত হবে এবং পুরনো সংসদ বিলুপ্ত হওয়ার সাথে সাথে নতুন সংসদ চালু হবে। আবেদনকারীর সংখ্যা কোন কারনে প্রয়োজনের তুলনায় কম হলে পুরনো সংসদ হতে পেশা, জেলা, সফল অংশগ্রহন এবং শিক্ষাগত যোগ্যতার ভিত্তিতে পুনঃনির্বাচিত হতে পারে।
  • শিশুরা এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বাবা-মা এর মাধ্যমে আবেদন করতে পারবে।
  •  একটি অন-লাইন রেজিষ্ট্রেশন ফর্ম (আবেদনকারীর নাড়ি-নক্ষত্র সম্বলিত) এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। যেখানে কম্পিউটার স্বয়ংক্রিয় ভাবে প্রার্থীর প্রদত্ত তথ্য সংরক্ষিত ভোটার ID-কার্ডের ডাটাবেজ হতে মিলিয়ে নেবে।
  •  প্রত্যেক জেলা থেকে ১৫ বা ততোধিক (দেশের সকল শ্রেণী-পেশা থেকে অন্ততঃ একজন) করে সম্মানিত সদস্য এই ছাঁয়া সংসদের সদস্য হবেন। প্রত্যেক ছাঁয়া সংসদ সদস্যের সতন্ত্র ID এবং Password (স্বয়ং ক্রিয় ভাবে প্রদত্ত) থাকবে। দেশের প্রত্যেকটি সরকারী-বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ, ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজ, কৃষিকলেজ, সরকারী-বেসরকারী ইনস্টিটিউট সমুহ সহ গবেষনা প্রতিষ্ঠান গুলোকে আলাদা জেলার মর্যাদা দেওয়া যেতে পারে।
  •  কম্পিউটারের যান্ত্রিক পদ্ধতিতেই এই সদস্যবৃন্দ নির্বাচিত হবেন। একই ভোটার আইডেন্টিটি নাম্বার পরপর দু’টার্মের বেশী নির্বাচিত হবে না।
  •  এলাকা ভিত্তিক সমস্যা গুলোই এরা তুলে ধরবেন, তবে বিভিন্ন জাতীয় ইস্যু গুলোতেও তাঁরা তাঁদের আন্তরিক মতামত রাখতে পারেন। তাঁদের মতামত গুলো জনসমক্ষে উন্মুক্ত থাকবে, তবে তা আবশ্যই স্ব স্ব ID-র বিপরীতে থাকবে।
  •  এই সম্মানিত ছাঁয়া সংসদের সদস্যবৃন্দকে মাঝে মাঝে জাতীয় সংসদ চলাকালীন সময়ে অতিথি গ্যালারীতে আমন্ত্রন জানানো যেতে পারে, অভিঞ্জতা অর্জনের জন্যে। বিশেষ করে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী যারা ছাঁয়া সংসদের সদস্য হবেন, অগ্রাধিকার পেতে পারেন। এতে করে বাস্তব রাজনৈতিক অভিঞ্জতা অর্জন সহ অনেক মেধাবী দেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে আগামী দিনের প্রস্তুতি নিতে পারবেন। দেশ মেধাবী ও দেশ-প্রেমীক রাজনীতিক পাবে বলে আশা করা যায়।
  •  অন-লাইনে এই ছাঁয়া-সংসদের মতামত এবং তার স্ট্যাটিস্টিকস জাতীয় সংসদ চলাকালীন এক বা একাধিক বড় পর্দায় প্রতিনিয়ত প্রদর্শিত হবে। যাতে মাননীয় জাতীয় সংসদের সদস্যবৃন্দ সংসদ চলাকালীন এই ছাঁয়া সংসদের মতামত গ্রাহ্য করতে পারেন। ধরে নেয়াই যেতে পারে যে এই ছাঁয়া সংসদের মতামত প্রকৃতপক্ষে দেশের আপামর জনসাধারনের সাধারন মতামত।
  •  এই ছাঁয়া সংসদেই আবার থাকতে পারে মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর মনোনীত পনের হতে পঞ্চাশ সদস্যের কিচেন কেবিনেট। তাঁদের আলাদা মতামতের স্ট্যাটিস্টিকসও বিশেষ বিবেচনার জন্যে উপস্থাপিত হতে পারে। তবে এসবই অন-লাইনে জনসাধারনের জন্যে সার্বক্ষনিক উন্মুক্ত থাকবে।
  •  এভাবেই দেশের জাতীয় সংসদের সাথে, দেশের নীতি নির্ধারকবৃন্দের সাথে, এদেশের প্রতিটি নাগরিকের একটি সার্বক্ষনিক প্রত্যক্ষ যোগ-সুত্র স্থাপিত হতে পারে।
  •  তবে ছাঁয়া সংসদের সিদ্ধান্ত নিশ্চয়ই জাতীয় সংসদের নীতি নির্ধারকবৃন্দের বিবেচনার জন্যে বাধ্যতামূলক নয়, কিন্তু এই সিদ্ধান্ত সমূহ মাননীয় জাতীয় সংসদের সাংসদ বৃন্দের কর্মস্পৃহায় এবং দেশের কল্যানে গঠনমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহনে উৎসাহ এবং উদ্দীপনা যোগাবে নিঃসন্দেহে।
  •  আর সবশেষে, এই ছাঁয়া সংসদের কার্যক্রম আমাদের মহান জাতীয় সংসদের একটি সতন্ত্র সেল ই-পার্লিয়ামেন্টের সাথে পাশাপাশি পরিচালনা করবেন।

এই সাম্প্রতিক কালেই ব্যাপক লিঙ্গ-বৈষম্য জনিত সহিংসতা যখন আফ্রিকার দেশ, কেনিয়াকে ব্যাপক ভাবে পর্যুদস্ত করে তোলে, তখন সচেতন নারী সমাজের মধ্যহতে এর প্রতিবাদ প্রতিরোধও সত্ত্বেও সামাজিক ভাবে শিক্ষার ব্যাপক অভাব এই ক্ষীন প্রয়াসকে একসময় ম্লান করে দেয়। ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এক সময় গড়ে ঊঠে “ওমেন স্যাডো পার্লিয়ামেন্ট –কেনিয়া”(১)। হোমা’বে, বুসিয়া, দক্ষিন টারকানা, পূর্ব লামু এবং পশ্চিম লামু সহ বিভিন্ন উপদ্রুত জেলার সম্প্রদায় ভিত্তিক সংগঠন সমূহ একত্রিত হয়ে গড়ে তোলেন এই পার্লিয়ামেন্ট। লক্ষ্য ছিলো, সম্প্রদায় গুলোর মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, শিক্ষার প্রসার ঘটানো বিশেষ করে লিঙ্গ বৈষম্য জনিত সহিংসতার প্রেক্ষাপটে মানবাধিকার বিষয়ক নীতিমালার সমূহের স্পষ্ট উচ্চারণ, আর এই মানবাধিকারের স্বপক্ষে সুস্পষ্ট অবস্থান এবং আইনকে আশ্রয় করে এই দুষ্টচক্রের দ্বারা সংঘটিত সহিংসতার বিরুদ্ধে নারী সম্প্রদায়ের ঘুরে দাঁড়ানো সহ আত্মরক্ষার কৌশল। অবশেষে সফলতার মুখ দেখে কেনিয়া, ব্যাপক ভাবে হ্রাস পায় এই লিঙ্গ বৈষম্য জনিত সহিংসতা, নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে এতদ্‌ সংক্রান্ত সচেতনতা মূলক এবং জড়িত অপরাধী চক্রের উন্মোচিত মুখোশ সম্বলিত রিপোর্ট। গড়ে উঠে এক নির্ভিক যোগাযোগ সমগ্র সমাজ ব্যাপী, এধরনের সহিংসতার বিপরীতে শুধু মাত্র ব্যাপক নারী শিক্ষার প্রসার ও প্রপাগান্ডার মাধ্যমে, যা সম্ভব করে তুলেছিলো এই ওমেন স্যাডো পার্লিয়ামেন্ট। সম্প্রতি গত ২৯শে এপ্রিলের ইয়েমেন টাইমস-এ(২) একটি প্রবন্ধে মাহমুদ আসামায়ে সে দেশের নারী সমাজের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক ভুমিকার লক্ষ্যে জাগরণ সৃষ্টিতে সদ্য গঠিত ওমেনস স্যডো পার্লিয়ামেন্ট এর তৎপরতা এবং উদ্দেশ্য নিয়ে লিখেছেন। সেখানে এই পার্লিয়ামেন্ট সৃষ্টির কারণ হিসেবে তার চেয়ারওমেন, হানান ওয়োরসমায়া বলেছেন, “সমাজের অপর অংশের সামাজিক মর্যাদা এবং অধিকার নিশ্চিতকরাই আসলে কাজ। আমরা দেখেছি কি অব্যাহত গতিতে সমাজের এই অংশের বিরুদ্ধে সহিংসতা নেমে আসছে“।

২০০৭ সালের নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের কাছে হেরে যাবার পর ১৮টি বিরোধীদলের ৫০ জন নেতা সমন্বয়ে কিরঘিস্তানে গড়ে তোলেন তারা বিকল্প ছাঁয়া সংসদ(৩)। জনগনের ব্যাপক সাড়া মেলে এতে। একসময় রুলিং প্রেসিডেন্ট কুরমানবেক ব্যাকিয়েভ এবং তার দল এই বিকল্প পার্লিয়ামেন্ট কে অবৈধ ঘোষনা করলেও ব্যাপক জনসমর্থন তখন বিকল্প পার্লিয়ামেন্টের পক্ষে ক্ষমতাসীনদের ভয়ঙ্কর চাপের মুখে ফেলে। বাধ্যহয় ক্ষমতাসীনরা সেসময় ব্যাপক রাজনৈতিক সংস্কারে। দেশে ইতিবাচক রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটে। দেশে দেশে এমনিধারার বিকল্প পন্থার উদ্ভব ঘটে জাতির ক্রান্তিকালে। আমাদেরও হয়েছিলো সম্প্রতি। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ত্ব সংকট উত্তরকালে সংকটের ভয়াবহতা ভুলে গিয়ে সমগ্র জতিকে পুনরায় ততধিক সংকটের মুখে ঠেলে দেন। আমরা কথায় কথায় বিশ্বের বৃহত্তম গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের কথা তুলে আনি। সম্প্রতি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক এবং স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস্ ইনস্টিটিউট এর গবেষনা সমন্বয়কারী, বর্তমানে ইন্ডিয়াস ইউনিভার্সিটি গ্রান্ড কমিশন এর ইমিরিটাস প্রফেসর সত্যব্রত রায় চৌধুরী সম্প্রতি এশিয়া মিডিয়াতে একটি প্রবন্ধে ভারতের গনতন্ত্রকে সিউডো ডেমোক্রেসি(৪) বলে উল্লেখ করেছেন। আসলেই তাই, গনতন্ত্রে যদি আইন প্রনয়নকারী বৃন্দের সাথে ব্যাপক জনগনের সম্পৃক্ততা না থাকে তাহলে সুসংহত গনতন্ত্রিকতার অবকাশ কোথায়? আর সেই কারনেই দেখুন, অপ্রত্যাশিত ভাবেই সেই বৃহত্তর রাষ্ট্রেই প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে কতোনা মানবিক বিপর্যয়! বিশেষ করে হতদরীদ্র শ্রেনীর মধ্যে। এর বেশীর ভাগ কারন অর্থনৈতিক অসমবন্টন এবং সমাজের উচ্চবিত্তের অনৈতিক কার্যকলাপ। কারন, বস্তুতঃ জবাবদীহিতার আইনী দুর্বলতা এবং ত্রুটি যা মূলতঃ চলমান আপাতঃদৃশ্যমান গনতান্ত্রিক ব্যবস্থার পদ্ধতি থেকে উদ্‌গত। আর তাই এই উট্‌কো বিপর্যয় থেকে রক্ষার একমাত্র ব্রহ্মাস্ত্র হলো ই-পার্লিয়ামেন্টারী পদ্ধতি।

সম্প্রতি আদ্দিস আবাবায় অনুষ্ঠিত দক্ষিন কোরিয়ার ন্যশনাল আ্যসেমব্লীর সেক্রেটারী জেনারেল, মিঃ পার্ক কী ডং, গত এপ্রিল ২০০৯-এ আ্যসোসিয়েশন অব সেক্রটারীস জেনারেল অব পার্লিয়ামেন্টস এর মিটিং এ “Promoting E-parliament in the Global Era” শিরঃনামে(৫) একটি বক্তৃতা করেন। প্রসঙ্গক্রমে তিনি সেখানে যে মন্তব্যটি করেন, তা বাস্তবিক-ই প্রনীধান যোগ্য। তিনি বলেন,

‘The transition to e-democracy in the era of democratization and informatization is a tide that we cannot turn. Countries in the world are partners in this transition. When we think of us, not me, we can grow together’.

হ্যাঁ, বাস্তবিকই প্রকৃত গনতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকাশ এবং এর পরিব্যাপ্তির উপরেই আসলে নির্ভর করছে আগামী সফল জ্ঞ্যন বিজ্ঞানে উৎকর্ষিত বিশ্ব। সেখানে কোন ধরনের পিছুটান, সামাজিক ন্যয়নীতি হীনতা, বৈষম্য এবং বিভাজন হবে এই অগ্রযাত্রার মূল প্রতিবন্ধক। কারন বিশ্বকে ক্ষুদ্‌পীড়িত রেখে হয়তো আর ব্যাপক ভিত্তিক জ্ঞ্যনচর্চা সম্ভব হবেনা অদূর ভবিষ্যতে। সম্প্রতি সার্ন এর অনভিপ্রেত কণা-পদার্থ বিদ্যার মৌলিক গবেষনায় ছেদ কিংবা আন্তঃনাক্ষত্রিক গবেষনার বিষয় গুলো প্রকৃত পক্ষে সেই ইঙ্গিতইতো দিচ্ছে!

সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড ই-পার্লিয়ামেন্ট রিপোর্ট ২০০৮(৬) এ বিশ্বের ১৩০টিরও বেশী দেশের কোন না কোন ভাবে এই ই-পার্লিয়ামেন্টারী পদ্ধতির ব্যবহার জনিত সুফল গুলোকে তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ জনগন কিভাবে রাস্ট্র এবং তার সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গনতন্ত্র বিকাশে ভুমিকা রাখছে তা বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। শুধু তাই নয় এর সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে ই-গভার্ননেন্স এবং আই সি টি-র ব্যবহার। অবাধ অবারিত তথ্য এবং রেফারেন্স, সাথে সাথে জন সম্পৃক্ততা সরকারী ব্যবস্থাপনাকে করে তুলেছে অর্থবহ। সেই কারনে এই রিপোর্টে ই-পার্লিয়ামেন্ট এর সংগায় বলা হয়েছে,

“One can therefore define an e-parliament as a legislature that is empowered to be more transparent, accessible and accountable through ICT. It empowers people, in all their diversity, to be more engaged in public life by providing higher quality information and greater access to its parliamentary documents and activities. It is an organization where connected stakeholders use information and communication technologies to support its primary functions of representation, law-making and oversight more effectively. Through the application of modern technology and standards and the adoption of supportive policies, it fosters the development of an equitable and inclusive information society.”

তবে হ্যাঁ এই ই-পার্লিয়ামেন্ট পদ্ধতির যেমন ইতিবাচক দিক রয়েছে তেমনি কিছু আপাতঃ প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে। যেমন, ই-পার্লিয়ামেন্টারী পদ্ধতির প্রচলনের সাথে সাথে এর আন্তর্জাতিক একটি পরিমন্ডল গড়ে উঠবে। যেখানে স্থানীয় আইন প্রনয়ক বৃন্দ তাবৎ বিশ্বের আইন প্রনয়ক বৃন্দের যোগাযোগের পর্যায়ে আসবেন, সেক্ষেত্রে তাঁদের মর্যাদাগত বিষয় গুলো বিবেচ্য হবে। বিবেচিত হবে ব্যক্তিগত আয় সংক্রান্ত তারতম্য। যদিও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভেতরে থেকেই এগুলো প্রতিপালিত হবে, নির্ভর করবে স্ব স্ব দেশের বার্ষিক আয় নির্বাহের উপর, তথাপী এ সংক্রান্ত দ্বন্দ্ব গুলোকে এড়িয়ে যাওয়া সমীচিন হবে না।

সার্থক ই-পার্লিয়ামেন্টারী পদ্ধতিতে দরকার যথোপযুক্ত রসদের, রসদের ঘাটতি এ ব্যবস্থাকে দুঃসহনীয় এমনকি বিপজ্জ্বনকও করে তুলতে পারে। যেহেতু রাষ্ট্রীয় সর্ব্বোচ্চ সংস্থা, সুতরাং এর কৌশল গত নিরাপত্তা যেমন গুরুত্ত্ব পূর্ন তেমনি এর যোগযোগ এর ক্ষমতা এবং কারিগরী দিকটাও হতে হবে সর্ব্বোন্নত অতএব ব্যায় বহুল। যাঁরা এই দিকটির রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্ত্বে থাকবেন তাদের ব্যক্তিগত উৎকর্ষতাও হতে হবে প্রশ্নাতীত। কাজেই অনুমিত হচ্ছে এর জটিলতার কতক বিষয়, তবে মনে হয় দ্রুত বিকাশমান ICT এর প্রতিবন্ধকতা গুলো এখনকার মতোই বা আরো সফলতার সাথে মোকাবেলা করতে সক্ষম হবে।

তবে একথা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে বিশ্বের দেশে দেশে গনতান্ত্রিক ব্যবস্থার ডিজিটাল এবং লজিক্যাল উন্নয়ন ঘটেই চলেছে। ICT-র প্রসারের সাথে সাথে হচ্ছে গনতন্ত্রায়নের পথও উন্মুক্ত। আশার কথা এই যে, এব্যবস্থায় আজ হোক কাল হোক প্রত্যেককেই সামীল হতে হবেই। আভ্যন্তরীন কারনেতো বটেই আন্তর্জাতিক ঘটনাবলী, পরিবেশ, প্রতিবেশ সহ আগামী দিনের বৈঞ্জানীক অগ্রযাত্রাও এ ব্যবস্থার বাধ্যবাদকতার নিয়ামক হয়ে দাঁড়াবে। আর তাই এতদ্ লক্ষ্যে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অগ্রযাত্রার প্রতিবন্ধকতা অপসারনে আজ আমাদের তৎপর হয়ে উঠতে হবেই। সম্ভবতঃ এর কোন বিকল্প নেই।

তথ্যসূত্রঃ

1. http://ocha.unog.ch/capprojectspdf/reports/
publicreports.aspxappealid=848&rtype=APS&
projectcode=KEN-09/P-HR
2. http://www.yementimes.com/article.shtml?i=1256&p=local&a=3
3. http://www.jamestown.org/single/?no_cache=1&tx_ttnews%5Btt_news%5D=33462
4. http://www.asiamedia.ucla.edu/article.asp?parentid=5806
5. http://www.asgp.info/Resources/Data/Documents/
LPNRXETKRWWKDSGBIUWYPBPIDYPSVF.doc
6. http://unpan1.un.org/intradoc/groups/public/documents/ UN/UNPAN029400.pdf