:: হাইপেশিয়া :: রুকসানা/আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট :: অ্যাডা :: তসলিমা নাসরিন :: হুমায়ুন আজাদ :: দালাইলামা :: সুরের রাণী মমতাজ ::

২০০১ সালের ঘটনা, নাগাসাকির শহরতলীর এক রেজিস্ট্রেশান সেন্টারে একে একে সব নাগরিক এসে ভোটার হয়ে যাচ্ছে, কেবলমাত্র শতবর্ষী নিহোজিন ছাড়া। কর্মকর্তারা ভোটার করতে চাইলেও কোনোভাবেই কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত সিস্টেম তাকে ভোটার হতে দিচ্ছে না। কারণ হিসেবে বলছে, তার না-কি ভোটার হবার বয়সই হয়নি। অথচ, এই সে-দিনের ছেলেপেলে নিহোজিন যাদেরকে হাসপাতালে জন্মাতে দেখেছে, এমনকি তাদের বাবা-মাকেও জন্মাতে দেখেছে, সেই দুইদিনের কিশোররাও তার চোখের উপর দিয়ে ভোটার হয়ে বাড়ী ফিরে যাচ্ছে। এমন বৃদ্ধ বয়সে, চুল-গোঁফ সাদা হয়ে যাবার পর, তার না-কি এখনো ভোটার হবার বয়স-ই হয় নি। শেষ বয়সে দুনিয়াশুদ্ধ লোক আর তাদের কি সব কম্পিউটার-সম্পিউটার তার সাথে বুঝি রসিকতাই শুরু করলো।

অন্যদিকে ১৯৯৬ সালের জুন মাসে, ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সী কৃত্রিম উপগ্রহের উদ্দেশে, অনেক টাকা ব্যায় করে আকাশে উড়ালো সাধের স্পেস রকেট অ্যারিয়ান-৫। উড্ডয়নের ৩৭ সেকেন্ড এর মাথায় তাদের কপাল পোড়ার সাথে সাথে আকাশে পুড়ে ছাঁই হলো সেই রকেট, আরো সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে অ্যারিয়ান-৫, ফ্লাইট নাম্বার ৫০১

                  ইউটিউব ভিডিওঃ অ্যারিয়ান-৫ বিস্ফোরণ

কিন্তু কি হয়েছিলো একশ বছর বয়স হবার পরও ভোটার হবার অযোগ্য নিহোজিন এবং পোড়াকপালি স্পেস রকেট অ্যারিয়ান-৫ এর। দুটি ঘটনাই আসলে কম্পিউটার বা সফট্ওয়্যার সম্পর্কিত। সাধারণত, কম্পিউটারে জন্মতারিখ দিতে বলা হয়, দিন/মাস/সাল এই আকারে; অর্থাৎ প্রথম অংশ জন্মতারিখ, পরের অংশ জন্মমাস এবং শেষ অংশে জন্মবছর। এই হিসেবে ১৯৪২ সালের জানুয়ারীর(প্রথম মাস) ৮ তারিখে জন্মগ্রহণ করা স্টিফেন হকিং এর জন্ম তারিখ হবে ০৮/০১/৪২। কিন্তু, যে দুর্ভাগা সফট্য়্যার ডেভলপার(প্রোগ্রামার) নাগাসাকির শহরতলীর ভোটারদের জন্য সফট্য়্যার তৈরী করেছিলো, তার কি আর খেয়াল ছিলো, এই জাপানিজ লোকগুলো যে কইমাছের প্রাণ নিয়ে পৃথিবীতে আসে; এরাতো আর যার-তার মত পয়ষট্টি বছর পার করেই প্যাভিলিয়নে ফিরে যাবে না। নাগাসাকির নাগরিক নিহোজিন জন্মগ্রহণ করেছিলো, ১৯০০ সালের জানুয়ারীর ২৫ তারিখে। সে-হিসেবে তার জন্মতারিখ ২৫/০১/০০। এই বছর অংশ ‘০০’ কে কম্পিউটার সফটওয়্যার ১৯০০ সাল এর বদলে ধরে নিয়েছিলো ২০০০ সাল। সেই জন্যই ২০০১ সালে নিহোজিন এর বয়স ১০১ বছরের বদলে হয়ে গিয়েছিলো মাত্র ১ বছর। বড় ধরণের ক্ষতির হাত থেকে নিহোজিন বেঁচে গেলেও বাঁচতে পারেনি অ্যারিয়ান-৫

অ্যারিয়ান এর সমস্যাটা ছিলো ভিন্ন ধরণের। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং এর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে সফটওয়্যার রিইউজ বা একটা অংশ একবার তৈরী করে সেটার বারবার করে ব্যবহার। উদাহরণ হিসেবে ধরতে পারেন, উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমের বহুল ব্যবহৃত ক্যালকুলেটরের কথা। উইন্ডোজ-৯৫, ৯৮, ২০০০, ভিসটা, সেভেন অনেক কিছুই এলো গেলো, কিন্তু প্রায় সবগুলোতে ক্যালকুলেটর কিন্তু একই থাকলো। এটিই হচ্ছে রিইউজ। এর মাধ্যমে কোম্পানীগুলো অনেক টাকা সাশ্রয় করে নেয়। আজকাল সফট্‌ওয়্যার তৈরী শুরু করার সময় ভবিষ্যত রি-ইউজ করবার কথা মাথায় রাখতে হয়, যেন আজকে যা বানানো হবে তা বছরের পর বছর অন্য কিছুর সাথে ভবিষ্যতে ব্যাবহার করা যায়। কিন্তু, সেভিংস্ কামস্ উইথ্ প্রাইস্, দাম কমানোর জন্য দাম দিতে হয়

অ্যারিয়ান-৫ এ যে সফটওয়্যার ইউজ করা হয়েছে, সেটা ছিলো আসলে পূর্ববর্তী অ্যারিয়ান-৪ সফটওয়্যার এর রিইউজ। আর সমস্যাটা ছিলো টাইপ কাস্টিংএ। ৬৪বিটের ( ৬৪টি ০ বা ১ রাখা যাবে, অনেক বেশি জায়গা) ফ্লোটিং পয়েন্ট টাইপের নাম্বারকে ১৬ (১৬টি ০ বা ১ রাখা যাবে, তুলনামূলক কম জায়গা) বিটের ইন্টিজার টাইপের নাম্বার-এ রুপান্তর করতে গিয়ে সমস্যাটার উদ্ভব হয়। ব্যাপারটা আরেকটু ব্যাখ্যা করা যাক। ধরুণ আপনার কাছে একটি জাহাজ, একটি ট্রাক এবং একটি প্রাইভেট কার আছে। পানিতে চলার জন্য জাহাজ, উঁচু নীচু রাস্তায় ট্রাক আর সমতল মসৃণ রাস্তায় চলার জন্য কার ব্যবহার করবেন। এখন যাওয়ার পথে যদি উঁচু রাস্তা পড়ে আপনি আপনার কারটি ট্রাকের উপর তুলে নিয়ে ট্রাক চালিয়ে চলে যেতে পারেন। আবার সামনে সমুদ্র পড়লে ট্রাকটিকে জাহাজে উঠিয়ে জাহাজ চালিয়ে নিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু কোনোভাবেই ট্রাকটিকে আপনি কারে উঠিয়ে নিতে পারেন না কিংবা জাহাজটিকে ট্রাকে করে নিয়ে যেতে পারেন না। ধরে নিন, অ্যারিয়ান-৪ এর ছিলো একটি কার, যাত্রা পথে সেটিকে একটি ট্রাকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। অপরদিকে, অ্যারিয়ান-৫ এর ছিলো একটি জাহাজ। কিন্তু, অ্যারিয়ান-৪ এর মত করে চলতে গিয়ে তারা সে জাহাজটিকে ট্রাকে উঠাতে চেয়েছিলো। ফল যা হবার তাই হলো, কোটি কোটি টাকার বিপর্যয়। আর, যে প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ এ অ্যারিয়ান-৪ বা অ্যারিয়ান-৫ এর সফট্‌ওয়্যারটি লেখা হয়েছিলো, সে প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজের নাম-‘অ্যাডা’

ইউনাইটেড স্টেটস্ এর ডিপার্টমেন্ট অব ডিফেন্স এর জন্য তৈরীকৃত অ্যাডা প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজের নামকরণ করা হয় লেডি অগাস্টা অ্যাডা বায়রনের স্মরণে, ১৯৮০ সালের ডিসেম্বারের ১০ তারিখে, তার জন্মদিন উপলক্ষ্যে। ১৮১৫ সালের ডিসেম্বারের এই ১০ তারিখেই বাবা বিখ্যাত ইংরেজ কবি লর্ড বায়রন এবং ইংল্যান্ডের সম্ভ্রান্ত ব্যারন পরিবারের মা অ্যানি ইসাবেল এর ঘরে জন্মেছিলেন অগাস্টা অ্যাডা বায়রন। অগাস্টা নামটা নেয়া হয়েছে বাবা লর্ড বায়রন এর সৎ বোন অগাস্টা লিহ এর নাম থেকে। লর্ড বায়রন এবং তার তথাকথিত শুভাকাংখীরা চেয়েছিলেন ঘর আলো করে এক পুত্র সন্তান আসবে। সেটাতো হলোই না, উপরন্তু, বিপুল পরিমাণ ঋণভারে জর্জরিত বায়রনের ক্রোধ আর রোষানলের স্বীকার হতে হলো স্ত্রী ইসাবেলকে। অবশেষে, বায়রনের আচরণে বিহবল ইসাবেল এক মাস বয়সী অ্যাডাকে নিয়ে নিজের বাবার বাড়ীতে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লর্ড বায়রন তার সন্তানের সাথে কোনো ধরনের সম্পর্ক রাখেননি, তার মৃত্যুকালে মেয়ে অ্যাডার বয়স ছিলো মাত্র নয় বছর।

                      চিত্রঃ অগাস্টা অ্যাডা কিং

ছোটবেলা থেকেই দুর্বল আর অসুস্থ, মায়ের কাছে বড় হতে থাকা অ্যাডা চৌদ্দ বছর বয়সেই প্যারালাইজড্ হয়ে পড়ে। পরবর্তী প্রায় একবছর টানা বিছানায় শুয়ে থেকে কাটাতে হয়েছে তাকে। কিন্তু, শত অসুস্থতা সত্ত্বেও লেখাপড়া থেমে থাকেনি। ছোটবেলা থেকে মায়ের ইচ্ছে, বড় হয়ে অ্যাডা ম্যাথমেটিশিয়ান হয়ে উঠবে। তাই যত টাকাই লাগুক না কেন, বিখ্যাত সব নামীদামি শিক্ষকের কাছে নিজ মেয়ের পড়াশোনার ব্যবস্থা করেন। সেই শিক্ষকের তালিকায় আছেন বিখ্যাত মিসেস সমারভিল, সুবিখ্যাত ডি’ মরগ্যান, যার -ডি’ মরগ্যানস ল- ম্যাথমেটিকস্, স্ট্যাটিক্টিকস্ কিংবা কম্পিউটার বিজ্ঞানের প্রাথমিক সূত্রগুলোর মধ্যে গণ্য হয়ে থাকে। অ্যাডার মা নিজেও ছিলেন উন্নত নৈতিকতা সম্পন্ন, বুদ্ধিমতী একজন মহিলা। ম্যাথমেটিকস্ এর উপর তার নিজেরও আকর্ষণ এবং দক্ষতা থাকায় মেয়েকেও ম্যাথমেটিশিয়ান হিসেবে গড়ে তুলতে চাইতেন; সাথে সাথে চাইতেন, মেয়ে যেন কোনোভাবে তার বাবার দোষগুলো নিজের মধ্যে পেয়ে না বসে। বাবা কবি লর্ড বায়রনের ব্যাক্তিগত জীবন সামাজিক দিক থেকে ছিলো অত্যন্ত আপত্তিকর। বিভিন্ন ধরণের নারী এবং পুরুষের সাথে সম্পর্ক থাকার সাথে সাথে তার বিরূদ্ধে অভিযোগ আছে বিবাহিত সৎ বোন অগাস্টা লিহ এর সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলার।

এরই মাঝে একদিন শিক্ষক মিসেস সমারভিলের বাসায় অ্যাডার দেখা হয়ে গেলো কম্পিউটারের জনক বলে বিখ্যাত চার্লস্ ব্যাবেজ্ এর সাথে। ব্যাবেজ্ সেই সময় তার বহুল আলোচিত এনালাইটিক্যাল ইঞ্জিন নিয়ে কাজ করছিলেন। পরবর্তীতে সুযোগ পেয়ে ব্যাবেজের সাথে কাজ করতে শুরু করেন অ্যাডা। সে-সময়য় ইতালিয়ান ম্যাথমেটিশিয়ান (পরবর্তীতে ইতালির নবম প্রধানমন্ত্রী) ম্যানাব্রিয়ার ব্যাবেজের এনালাইটক্যাল ইঞ্জিনের উপর একটি প্রবন্ধ রচনা করেন। অ্যাডার উপর দায়িত্ব পড়ে ম্যানাব্রিয়ার সেই প্রবন্ধ ইংরেজীতে অনুবাদ করার। ব্যাবেজের নির্দেশনায়, অনুবাদ করার সাথে সাথে, বোঝার সুবিধার্থে সেখানটাতে নিজস্ব কিছু ব্যাখ্যাধর্মী নোটও সংযুক্ত করেন অ্যাডা, যেখানে তিনি বর্ণনা করেন কিভাবে ব্যাবেজের এনালাইটিক্যাল ইঞ্জিন দিয়ে বার্নুলি নাম্বারসমূহ (বিশেষ বৈশিষ্ট সম্পন্ন এক ধরণের ম্যাথমেটিক্যাল নাম্বার) গণনা করা সম্ভব।

যদিও একের পর এক বার্নুলি নাম্বার গণনা করার এ-পদ্ধতিটি অ্যাডা অন্য একটি কাজ বর্ণনা করতে গিয়ে উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করেছেন মাত্র, তবুও এটিকেই বিশ্বের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রাম বা অ্যালগরিদম্ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, আর অ্যাডা বায়রনকে বলা হয়ে থাকে বিশ্বের সর্বপ্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার। উল্লেখ্য,অ্যালগরিদম্ হচ্ছে কোনো সমস্যা সমাধানের জন্য ধাপে ধাপে করা সমাধান পদ্ধিতি।

১৮৩৪ সালে আর্ল অব লাভলেস উইলিয়াম কিং এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলো অ্যাডা। তাই তার পুরো নাম হিসেবে ব্যবহৃত হয় অগাস্টাস অ্যাডা কিং, কাউন্টেস্ অব লাভলেস্, সংক্ষেপে অ্যাডা লাভলেস্। মাত্র ৩৬ বছর বয়সে ১৮৫২ সালের ২৭শে নভেম্বার মৃত্যুবরণ করেন অ্যাডা বায়রন। সমস্ত জীবদ্দশায় কোনো রকমের সম্পর্ক না থাকলেও, মৃত্যুর পর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী নিজের পিতা কবি লর্ড বায়রনের সমাধির পাশে সমাহিত করা হয় বিশ্বের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার, গুণবতী এই মেধাবী নারী অ্যাডা বায়রনকে।

পরবর্তী পর্ব

তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া
এপ্রিল ১৪, ২০১১
[email protected]