আমি কেন রক্ষণশীল নই ২
আমি কেন রক্ষণশীল নই ১

আগের পর্বের পরে…
৫।
উদারপন্থাকে রক্ষণশীলতা ও সমাজতন্ত্রের মাঝামাঝি অবস্থান বলাটা মোটের ওপর ভুল হলেও একটি বিশেষ ক্ষেত্রে একেবারে অযৌক্তিক নয়। রক্ষণশীলের আধ্যাত্মবাদ থেকে উদারপন্থী ততটাই দূরবর্তী, যতটা দূরবর্তী সে সমাজতন্ত্রীর ত্রুটিপূর্ণ যুক্তিবাদ থেকে। এই যুক্তিবাদী মনোভাবের বৈশিষ্ট্য হল যে সে সব সামাজিক সংগঠনকে ব্যক্তিগত যুক্তির আলোকে একটি বিশেষ গঠন দান করতে চায়। এই যুক্তিবাদকে উদারপন্থা সংশয়ের চোখে দেখে, রক্ষণশীলের মতই। উদারপন্থী ভালভাবেই জানে যে সবকিছুর উত্তর আমরা জানিনা, যেসব উত্তর আমাদের আছে তার নির্ভুলতা প্রশ্নাতীত নয়, এবং কিছু প্রশ্নের উত্তর কখনই মিলবে না। যুক্তি-সম্ভুত নয়, এমন প্রতিষ্ঠান বা অভ্যাসকে সমর্থন করতেও তার কার্পণ্য নেই, যদি সেগুলি উপকারী বলে প্রমাণিত হয়ে থাকে। রক্ষণশীলের সাথে তার পার্থক্য: এই অজ্ঞতাকে সে সততার সাথে মোকাবেলা করতে পারে, যুক্তির সীমাবদ্ধতার মাছকে ঐশ্বরিক জ্ঞানের শাক দিয়ে চাপা দেয়ার চেষ্টা সে করেনা। এটা স্বীকার করতেই হবে যে অনেক ব্যাপারে উদারপন্থী মূলত একজন সংশয়বাদী[১২]। অন্যদেরকে নিজেদের মত জীবন যাপন করতে দেবার সহনশীলতা জন্যে তার প্রয়োজন বেশ খানিকটা আত্ম-নিয়ন্ত্রণেরও।

এর মানে এই নয় যে উদারপন্থীকে অধার্মিক হতে হবে। সত্যিকারের উদারপন্থার সাথে ধর্মের কোন বিরোধ নেই (এবিষয়ে ফরাসী বিপ্লবের যুক্তিবাদের সাথে তার পার্থক্য বিরাট), এবং উনবিংশ শতাব্দীর মহাদেশীয় (ইউরোপীয়) “উদার”পন্থার অনুদার ধর্মবিরোধিতা আমাকে দুঃখিত করে। এধরণের ধর্মবিরোধিতা যে উদারপন্থার জন্য অবধারিত নয়, সেটার প্রমাণ উদারপন্থার বৃটিশ পূর্বসূরী, অর্থাৎ হুইগরা। বরঞ্চ, ধর্মানুরাগটা যেন একটু বেশিই ছিল এদের। কিন্তু উদারপন্থার সাথে রক্ষণশীলের পার্থক্য হল, তার নিজের আধ্যাত্মিক বিশ্বাস যতই জোরদার হোক না কেন, সে কখনই অন্যের উপর সেটা চাপানোর অধিকার দাবি করেনা, এবং ধর্মীয় ও ঐহিক ব্যাপারকে সে সম্পূর্ণ ভিন্ন রাখার পক্ষপাতী।

৬।
কেন যে আমি রক্ষণশীল নই, আশা করি তা আর অস্পষ্ট নেই। তবে অনেকে ভাবতে পারে, “উদারপন্থী” বলতে তারা যা বোঝে তার সাথে আমার অবস্থানের কোন সম্পর্ক নেই। ফলে আজকের দিনে স্বাধীনতার পার্টির জন্য “উদারপন্থী” নামটা উপযোগী কিনা, আবার এই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে আমাকে। বাস্তবতা হচ্ছে, সারা জীবন নিজেকে উদারপন্থী হিসেবেই পরিচয় দিয়ে আসলেও ইদানিং সেটা করতে দ্বিধাবোধ করছি। এর কারণ দ্বিবিধি। প্রথমত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই অভিধার ব্যাপারে প্রকট বিভ্রান্তি; দ্বিতীয়ত, মহাদেশীয় যুক্তিবাদী উদারপন্থা বা এমনকি উপযোগিতাবাদী ইংরেজ উদারপন্থার সাথে আমার ক্রমবর্ধমান মতপার্থক্য।

উদারপন্থা বলতে যদি তাই বোঝানো হয় যা বুঝেছিলেন একজন ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ যখন তিনি ১৮২৭ সালে লিখেছিলেন, ১৬৮৮ এর বিপ্লব ছিল “সেসব নীতির জয় যাদেরকে আজকের দিনে উদারপন্থী বা সাংবিধানিক বলা হয়”[১৩] বা যদি কেউ লর্ড অ্যাকটনের সাথে একমত হয়ে বার্ক, ম্যাকলেগ্লাডস্টোনকে শীর্ষ তিন উদারপন্থী হিসেবে বিবেচনা করে, বা হ্যারল্ড লাস্কির মত টকভিললর্ড অ্যাকটনকে “উনবিংশ শতাব্দীর বিকল্পরহিত উদারপন্থী”[১৪] হিসেবে ঘোষণা দিতে পারে, তাহলে আমিও একজন গর্বিত উদারপন্থী। নিজের পাতে ঝোল টেনে এই উদারপন্থাকে “আসল” উদারপন্থা বলার লোভটাও এড়ানো কঠিন। কিন্তু সত্যিকে অস্বীকার করে লাভ নেই। আমি যাঁদের কথা উল্লেখ করলাম, তাঁদের মতামতের ঘোর বিরোধি ছিলেন বেশির ভাগ মহাদেশীয় উদারপন্থী এবং মহাদেশীয় উদারপন্থীদের লক্ষ্য ছিল পৃথিবীতে একটি পরিকল্পিত যৌক্তিক কাঠামোর প্রতিষ্ঠা করা, মুক্ত প্রবৃদ্ধি নয়। ইংল্যান্ডে উদারপন্থী নামধারীদের ক্ষেত্রেও একই কথা সত্য, অন্তত লয়েড জর্জ-এর শাসনামল থেকে। অতএব আমার “উদারপন্থা”-র সাথে আজকের দিনে ওই নামধারী রাজনৈতিক আন্দোলনগুলির কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। এই নামের সাথে যেসব ঐতিহাসিক অনুসঙ্গ জড়িয়ে গেছে তার প্রেক্ষিতে নামটিকে অপব্যবহারের হাত থেকে উদ্ধার করার চেষ্টাটাই অপচেষ্টা কিনা, এটাও একটা ভাল প্রশ্ন। আমার নিজের ক্রমশ বিশ্বাস জন্মাচ্ছে যে দীর্ঘ আনুসাঙ্গিক ব্যাখ্যা ছাড়া এই শব্দের ব্যবহার কেবল বিভ্রান্তিই বাড়ায়, এবং আজ এই অভিধাটি শক্তির উৎস নয়, দুর্বলতার উৎস।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উপায়ান্তর না দেখে কেউ কেউ “লিবার্টারিয়ান” নামটি ব্যবহার করা শুরু করেছে। জানিনা, এটাই হয়ত সমাধান, কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে আমি এর ঘোর বিরোধি। এটির সুস্পষ্ট কৃত্রিমতা এবং ঠেকনা দেয়া ভাব আমার কানে বাজে। আমি চাই এমন একটা নাম যা জীবনমুখী দলকে পরিচয় দান করবে, যে দলের রাজনীতি হবে মুক্ত প্রবৃদ্ধি ও বাধাহীন বিবর্তনের। কিন্তু বহু মাথা ঘামিয়েও সুবিধাজনক কোন নাম আমি বের করতে পারিনি।

৭।
মনে রাখা দরকার, আমি যেসব নীতির কথা বলছি সেগুলি যখন প্রথম পশ্চিমা বিশ্বে প্রচলিত হওয়া শুরু করে, তখন এই মতাবলম্বীদের একটা বহুপরিচিত নাম ছিল। নামটি হল “হুইগ”। ইংরেজ হুইগরাই সারা ইউরোপের উদারপন্থার পথিকৃত [১৫] এবং হুইগ ধারণাগুলি বহন করে নিয়ে গিয়েই মার্কিন উপনিবেশ-স্থাপনকারীরা অবশেষে স্বাধীনতা অর্জন ও সংবিধান রচনা করে[১৬]। বস্তুত, ফরাসী বিপ্লবের ফলে হুইগদের মধ্যে টোটালিটারিয়ান গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রী ভাবধারার ছোঁয়াচ লাগবার আগে ওই নাম দিয়েই স্বাধীনতার পার্টি পরিচিত হত।

তার জন্মভূমি ইংল্যাণ্ডে এই নামের মৃত্যু হয়েছে দুটি কারণে। প্রথমত, এই নীতিগুলি একটা সময়ে আর কোন একটা বিশেষ পার্টির নীতি থাকেনি। দ্বিতীয়ত, এই নামধারীরা কালের বিবর্তনে আর হুইগ নামের যোগ্য থাকে নি। উনবিংশ শতাব্দীতে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে হুইগ পার্টিগুলির কার্যকলাপ র্যাডিকলদের মধ্যে তাদের নাম ডোবায়। কিন্তু তারপরও আদি নামটি হুইগ-ই, এবং “উদারপন্থা” শব্দটা হুইগবাদের স্থান দখল করেছে ফরাসী বিপ্লবের ভুল ও যুদ্ধংদেহী যুক্তিবাদ স্বাধীনতাবাদীরা আত্মীকরণ করে ফেলবার পরে। আমাদের লক্ষ্য যেহেতু ওই ঐতিহ্যকে অতি-যুক্তিবাদ, জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্রের প্রভাব মুক্ত করা, অতএব হুইগবাদ নামটিই হচ্ছে ঐতিহাসিক ভাবে সঠিক। বস্তুত, যতই আমি রাজনীতির বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাস সম্বন্ধে পরিচিত হই, ততই উপলব্ধি করি আমি আর কিছুই না, একজন “পুরোনো হুইগ” (জোর “পুরোনো” শব্দটার উপরে)।

নিজেকে পুরোনো হুইগ বলার অর্থ এই নয় যে আমি সপ্তদশ শতাব্দীর শেষে ফেরত যেতে চাই। যে ধারণাগুলি ওই সময়ে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল, সেগুলি অন্তত সত্তর-আশি বছর আগে পর্যন্ত নানান ভাবে বিকশিত হয়েছে, যদিও কোন একটি বিশেষ দলের আওতায় নয়। এর পরে জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে প্রসার ঘটেছে তার আলোকে এই ধারণাগুলিকে আরো সফল ও সন্তোষজনক ভাবে পুনর্ব্যক্ত করা সম্ভব অবশ্যই, কিন্তু মূল নীতিগুলি সেই পুরোনো হুইগদেরই।

হুইগ নামধারী পার্টিগুলির পরবর্তী কার্যকলাপের ফলে কেউ কেউ সন্দেহ পোষণ করেছেন, আদতে হুইগ নীতি বলে আলাদা কিছু আছে কিনা। কিন্তু আমি লর্ড অ্যাকটনের সাথে একমত, “এই নীতির পিতৃপুরুষেরা অনেকেই কুখ্যাত, কিন্তু মিউনিসিপাল আইনের চেয়েও উচ্চতর আইন আছে, তাদের এই বিশ্বাস থেকেই হুইগবাদের জন্ম, আর এটাই ইংরেজদের শ্রেষ্ঠ অর্জন ও বিশ্বের জাতিগুলির জন্য তাদের উপহার”[১৭]। এই নীতির উপরেই অ্যাংলো-স্যাক্সন জাতিগুলির সাধারণ ঐতিহ্য দাঁড়িয়ে আছে। এই নীতি থেকেই মহাদেশীয় উদারপন্থা তার ভাল উপাদানগুলি পেয়েছে। এই নীতিই মার্কিন সরকারব্যবস্থার ভিত্তিভূমি। এর বিশুদ্ধ রূপ যুক্তরাষ্ট্রে পাওয়া যাবে জেফারসনের র্যাডিকালবাদ বা হ্যামিলটনঅ্যাডামসের রক্ষণশীলতায় নয়, বরং “সংবিধানের পিতা” জেমস ম্যাডিসনের মতামতে[১৮]

অবশ্য এই পুরোনো নামের পুনরুত্থান রাজনৈতিক বাস্তবতায় সুবুদ্ধির পরিচায়ক কিনা তা আমার জানা নেই। অধিকাংশ লোকের কাছে এই নামের বিশেষ কোন অর্থ যে আর নেই, এটা বোধহয় খারাপ নয়, বরং সুবিধাজনক। যারা বৌদ্ধিক ইতিহাসের সাথে পরিচিত, তাদের কাছে অবশ্য এই নামটিই মনে হয় সবচেয়ে অর্থবহ। সত্যিকারের রক্ষণশীল ও সমাজতন্ত্রী-থেকে-রক্ষণশীলে-রূপান্তরিত, উভয় দলের কাছেই “হুইগ” নামটা বিশেষ বিতৃষ্ণার উদ্রেক ঘটায়, এটা উল্লেখ করবার মত। কারণ এখান থেকে স্পষ্ট যে তারা খুব ভালভাবেই জানে তাদের আসল শত্রু কারা। এই নামটি সেই নির্বিকল্প নীতিগুলির জন্য প্রযোজ্য যেগুলি সবসময় এবং সর্বাবস্থায় স্বৈরাচারের বিপক্ষে।

৮।
এসব নাম-টাম আদতে গুরুত্বপূর্ণ কিনা, এপ্রশ্ন অসংগত নয়। যুক্তরাষ্ট্রে হয়ত নামটা আসলেই ততটা তাৎপর্যপূর্ন নয়। এখানে মোটের ওপর সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি স্বাধীনতা-বাদী, ফলে পুরোনো নীতিকে ধরে রাখাই অনেক ক্ষেত্রে আমাদের কাজ। অতএব স্বাধীনতার পক্ষাবলম্বনকারীরা নিজেদের রক্ষণশীল ডাকলে হয়ত খুব একটা সমস্যা নেই, যদিও সহজাত রক্ষণশীলদের সাথে নিজেদের গুলিয়ে ফেলাটা বিব্রতকর বইকি। কারণ একমতাবলম্বী হওয়াই যথেষ্ট নয়, মতটির প্রতি সমর্থন কোন দৃষ্টিকোণ থেকে আসছে সে প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ — নীতিগুলি পুরোনো বলে, নাকি সেগুলি প্রাচীনত্ব-নিরপেক্ষভাবে সমর্থযোগ্য বলে? সমষ্টিবাদের বন্যাকে প্রতিরোধ করতে গিয়ে এটা ভুললে চলবে না যে স্বাধীনতাবাদ সম্মুখদর্শী, পুরনোর প্রতি রোমান্টিক নস্টালজিয়া এর উৎস নয়।

কিন্তু ইউরোপে রক্ষণশীলদের সাথে স্পষ্ট পার্থক্য সূচিত করা একেবারে অপরিহার্য, কারণ সেখানকার রক্ষণশীলেরা সমষ্টিবাদের বহু নীতি আত্মীকরণ করে ফেলেছে — এবং এই মনোভাব এতদিন ধরে পলিসি নিয়ন্ত্রণ করে এসেছে যে সমষ্টিবাদী প্রতিষ্ঠানগুলি ডালভাত হয়ে গেছে, এমনকি “রক্ষণশীল” দলগুলি বহু ক্ষেত্রে এগুলির গর্বিত স্রষ্টা[১৯]। এই পরিস্থিতিতে স্বাধীনতাবাদীকে স্পষ্ট ভাবে রক্ষণশীল বিরোধি হতে হবে, গ্রহণ করতে হবে একটি র্যাডিকাল অবস্থান, যার লক্ষ্য হবে কুসংস্কার ও অধিকারবাজির সমূল বিরোধিতা করা, এমনকি জনসমর্থনের বিপরীতে গিয়েও। কুপ্রথা সুদীর্ঘকালের প্রথা বলেই ভাল কিছু হয়ে যায় না।

আগ বাড়িয়ে ঝামেলা না পাকানোর নীতি রাজনীতিবিদের জন্য ভাল উপদেশ হতে পারে হয়ত, কিন্তু দার্শনিকের পক্ষে এতে সন্তুষ্ট থাকা সম্ভব নয়। দার্শনিক হয়ত পলিসির পরিবর্তনে ধীরতাকে মেনে নিতে পারে, এবং তাও জনগণের ইচ্ছাক্রমেই, কিন্তু স্রেফ বর্তমান জনমত একটি অবস্থানের পক্ষে বলেই সেটা হজম করতে পারে না। এখনকার অবস্থা ঠিক উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের মতই, যখন মূল প্রয়োজন হল স্বতঃস্ফূর্ত প্রবৃদ্ধির পথের বাধাগুলি দূর করা, যেসব বাধার জন্ম দিয়েছে মানবচরিত্রের দুর্বলতা। এই অবস্থায় উদারপন্থী দার্শনিকের ভরসা সেই মানুষগুলি যারা মৌলিক ভাবেই “প্রগতিশীল”, আজ ভুল দিকে হয়ত যাত্রা করলেও নিজের বিশ্বাসকে খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করার ইচ্ছা অন্তত যাদের আছে।

আশা করি আমার “পার্টি” শব্দের ব্যবহারে কেউ বিভ্রান্ত হননি। আমি স্রেফ বুঝিয়েছি একদল মানুষকে যারা একটি বিশেষ বুদ্ধিবৃত্তিক ও নৈতিক অবস্থানকে রক্ষা করে চলবে। কোন বিশেষ দেশের রাজনৈতিক কামড়াকামড়ি আমার লেখার বিষয় নয়। এই লেখায় যেসব নীতির কথা তুলে ধরা হয়েছে, তাদের ভঙ্গুর অবয়বকে একত্রিত করে কিভাবে জনপ্রিয় আন্দোলন গড়ে তোলা যায়, সেটা রাজনৈতিক দার্শনিকের কাজ নয়, ও ব্যাপারে “সেসব চতুর চাণক্য, যাদেরকে রাজনীতিবিদ বা কূটনীতিবিদ নামে প্রায়ই অভিহিত করা হয়, যারা প্রতিদিনের হাওয়া বদলের প্রেক্ষিতে পদ্ধতি পরিবর্তন করে”[২০] তাদেরকেই দায়িত্ব দিতে হবে। রাজনীতির দার্শনিকের কাজ হবে শুধুমাত্র জনমত গঠন করা, জনসংগঠনের নেতৃত্ব দেয়া নয়। এই মুহূর্তে রাজনৈতিক ভাবে কি সম্ভব-অসম্ভব সে বিষয়ে চিন্তা না করে যদি দার্শনিকের নিয়ত অবস্থান হয় “সেসব সাধারণ নীতি যারা চিরদিনের”[২১] তাদের পক্ষে, কেবলমাত্র তাহলেই সে তার দায়িত্বপালনের আশা করতে পারে। এই অর্থে রক্ষণশীল রাজনৈতিক দর্শন বলে আদৌ কিছু হয় কিনা সে ব্যাপারে আমি সন্দিহান। ক্ষেত্রবিশেষে রক্ষণশীলতার ব্যবহারিক উপযোগিতা থাকতে পারে, কিন্তু সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের কোন কাঠামো তা আমাদের দিতে পারে না।

a

ফুটনোট

[১২] দেখুন Learned Hand, The Spirit of Liberty, আই. ডিলার্ড সম্পাদিত (নিউ ইয়র্ক ১৯৫২) পৃ ১৯০: “যার সত্তা স্বাধীনতাবাদী সে নিজের সঠিকতার ব্যাপারে খুব বেশি নিশ্চিত নয়”। আরো দেখুন অলিভার ক্রমওয়েলের বিখ্যাত মন্তব্য, যা পাওয়া যায় Assembly of the Church of Scotland-কে তাঁর লিখিত পত্রে (আগস্ট ৩, ১৬৫০): “অনুরোধ করছি, যীশুর নামে, আপনাদের ভুল হতে পারে এটাও একটু বিবেচনায় রাখুন ”। এটা উল্লেখের বিষয় যে ব্রিটেনের ইতিহাসের একমাত্র “স্বৈরশাসক”-এর সবচেয়ে স্মরণীয় উক্তি এটা।

[১৩] এইচ. হালাম, Constitutional History (১৮২৭) (“Everyman” সংস্করণ), খণ্ড ৩, পৃ ৯০। অনেক সময় দাবী করা হয় যে “লিবারাল” (উদারপন্থী) শব্দটি এসেছে লিবারালেস নামে উনবিংশ শতাব্দীর স্পেনীয় দলটির নাম থেকে। আমার অবশ্য মনে হয় এর উৎস অ্যাডাম স্মিথ, যেমন ধরুন The Wealth of Nations, খণ্ড ২, পৃ ৪১: “মুক্ত আমদানি ও রপ্তানির লিবারাল ব্যবস্থা” বা পৃ ২১৬: “প্রত্যেক মানুষকে তার আপন মনে নিজ আগ্রহে কাজ করতে দেয়া — সমতা, স্বাধীনতা ও ন্যায়ের লিবারাল নীতির উপর ভিত্তি করে”।

[১৪] মেরি গ্ল্যাডস্টোনকে লিখিত লর্ড অ্যাকটনের পত্র, পৃ ৪৪। আরও দেখুন টকভিলের ব্যাপারে তাঁর মতামত, যা পাওয়া যাবে Lectures on the French Revolution (লণ্ডন ১৯১০) পৃ ৩৫৭ তে: “টকভিল বিশুদ্ধতম উদারপন্থীদের একজন — উদারপন্থী এবং শুধুমাত্র উদারপন্থী, গণতন্ত্রের প্রতি গভীরভাবে সন্দিহান, এবং সন্দিহান সাম্যবাদ, কেন্দ্রীকরণ ও উপযোগিতাবাদের প্রতি”। একই ভাবে দেখুন Nineteenth Century, XXXIII (১৮৯২), পৃ ৮৮৫। এইচ. জে. লাস্কির মন্তব্য পাওয়া যাবে The Social and Political Ideas of Some Representative Thinkers of the Victorian Age, এফ.জি.সি. হার্নশ সম্পাদিত (লন্ডন, ১৯৩৩), এর “Alexis de Tocqueville and Democracy” প্রবন্ধে (পৃ ১০০): “আমার মনে হয়, টকভিল ও অ্যাকটন যে উনবিংশ শতাব্দীর বিকল্পরহিত উদারপন্থী, এ দাবীর প্রতিউত্তর দেয়া সম্ভব নয়”।

[১৫] অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতেই একজন ইংরেজ পর্যবেক্ষকের পক্ষে বলা সম্ভব হয়েছিল, “বিদেশী যে লোকই ইংল্যাণ্ডে আসুক না কেন, হোক সে ডাচ, জার্মান, ফরাসী, ইতালীয় বা তুর্কী, কিছুদিন আমাদের মধ্যে থাকবার পরেই সে হুইগ হয়ে যায়” (এই উদ্ধৃতি পাওয়া যাবে জি. এইচ. গাটরিচের English Whiggism and the American Revolution-এ (বার্কলে, ক্যালিফোরনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস, ১৯৪২) পৃ ৩)

[১৬] উনবিংশ শতাব্দীতে “হুইগ” শব্দটির যেভাবে ব্যবহার হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, তাতে লোকে ভুলে গেছে অষ্টাদশ শতাব্দীতে এই নাম ব্যবহৃত হত সেসব নীতি বোঝাতে যাদের সাহায্যে মার্কিন বিপ্লব চালিত হয়েছে, অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা, লিখিত হয়েছে সংবিধান। হুইগ দলগুলিতেই তরুণ জেমস ম্যাডিসন ও জন অ্যাডামস-এর রাজনৈতিক শিক্ষানবিসি হয়েছে (দেখুন ই. এম. বার্নসের James Madison [নিউ ব্রান্সউইক, নিউ জার্সি, রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস, ১৯৩৮], পৃ ৪); এই হুইগ নীতিই ছিল, জেফারসন আমাদের জানিয়েছেন, সেসব আইনজীবিদের মূল নীতি যারা দলে দলে Declaration of Independence এ সই করেছে এবং যারা Constitutional Convention এ শক্তিশালী সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল (দেখুন Writings of Thomas Jefferson [“Memorial ed.” ওয়াশিংটন ডি.সি., ১৯০৫], খণ্ড XVI, পৃ ১৫৬)। হুইগ নীতি এতই প্রচলিত ছিল যে এমনকি ওয়াশিংটনের সৈন্যেরা পর্যন্ত হুইগদের ঐতিহ্যবাহী নীল-হলদে ইউনিফর্ম পরে যুদ্ধে গেছে। এ রংয়ের ব্যবহার করেছে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ফক্সাইটরা, এবং এই রং আজও দেখতে পাওয়া যায় এডিনবরা রিভিউ-এর প্রচ্ছদে। যদি এই সমাজতন্ত্রী প্রজন্ম হুইগবাদকে তার প্রিয় লক্ষ্যে পরিণত করে, তাহলে আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত ওই নামটির সম্মান পুনরুদ্ধার করা। আজ এই নামটাই শুধু বর্ণনা করে গ্ল্যাডস্টোন উদারপন্থীদের, মেইটল্যান্ড, অ্যাকটন ও ব্রাইসের প্রজন্মকে, যারা ছিল শেষ প্রজন্ম যাদের কাছে সমতা বা গণতন্ত্র নয়, মূল লক্ষ্য ছিল স্বাধীনতা।

[১৭] লর্ড অ্যাকটন, Lectures on Modern History (লন্ডন, ১৯০৬) পৃ ২১৮। আমি অ্যাকটনের বাক্যগুলিকে কিছুটা আগ-পিছ করেছি অর্থটা সংক্ষেপে স্পষ্ট করার জন্য।

[১৮] দেখুন এস. কে. প্যাডওভারের Introduction to The Complete Madison (নিউ ইয়র্ক, ১৯৫৩), পৃ ১০: “আজকের পরিভাষায় ম্যাডিসনকে বলা যায় মাঝামাঝি ধরণের উদারপন্থী, আর জেফারসনকে র্যাডিকাল হিসেবে স্বীকার করতে হবে”। এটা সত্য এবং গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে ই.এস. করউইনের মন্তব্য (“James Madison: Layman, Publicist, and Exegete,” New York University Law Review, XXVII, ১৯৫২, পৃ ২৮৫) যেখানে উনি উল্লেখ করেছেন ম্যাডিসনের পরবর্তী কালে “জেফারসনের প্রকাণ্ড প্রভাবের কাছে আত্মসমর্পন”-এর কথা।

[১৯] দেখুন ব্রিটিশ রক্ষণশীল দলের পলিসি পত্র, The Right Road for Britain (লণ্ডন ১৯৫০), পৃ ৪১-৪২, যেখানে যুক্তিসংগতভাবেই বলা হয়েছে “সংখ্যাগরিষ্ঠ রক্ষণশীল জোট সরকারের নতুন জনসেবামূলক পরিকল্পনাগুলি রক্ষণশীল দলের পূর্ণ সমর্থন পেয়েছে…(আমরা) পেনশন, অসুস্থতা ও বেকারত্ব ভাতা, শিল্প কারখানায় অনাচার ভাতা এবং রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য সেবার নীতিমালা তৈরি করেছি”।

[২০] অ্যাডাম স্মিথ, The Wealth of Nations, ১ম খণ্ড, পৃ ৪৩২।

[২১] উপরে দেখুন।