:: হাইপেশিয়া :: রুকসানা/আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট :: অ্যাডা :: তসলিমা নাসরিন :: হুমায়ুন আজাদ :: দালাইলামা :: সুরের রাণী মমতাজ ::

বড় রাস্তার পাশের গলিতে কিঞ্চিৎ ভিতরদিকটায়, আলেকজান্দ্রিয়ার মাতালদল রোমান সাম্রাজ্যের সর্বনাশা পতনের পথে যাওয়ার জন্য কারা দায়ী এবং অরেস্টেসের মত অপরিপক্ক গভর্নর কিভাবে জনতার কাছে রাতে-দিনে নাকাল হয়ে যাচ্ছে, তা নিয়ে তুমুল তর্কে লিপ্ত হয়েছে। তর্ক না বলে প্রলাপ বলাই ভালো। হঠাৎ করে অপেক্ষাকৃত বয়স্কজন হাত তুলে সবাইকে চুপ করতে বলে এবং কান পেতে শুনতে চেষ্টা করে কোন দিক থেকে আওয়াজটা আসছে। মাতালদলের প্রলাপের শব্দ কমে আসলে রাস্তার উপর জনতার কোলাহল ক্রমাগত বাড়তে থাকলো। শহরের ভদ্রমহিলারা উঁকি মারলো বাসার ছাদ থেকে, ফেরিওয়ালারা তাদের কেনা-বেচা বন্ধ করে হতভম্বের মত তাকিয়ে থাকলো, বোতল হাতে বেরিয়ে এসে মাতালকূল শিরোমণি চেঁচিয়ে বললো, যা, নিয়ে যা বেজন্মাটাকে, জন্মের মত করে শিক্ষা দিয়ে দে। রাস্তার উপর দিয়ে টেনে-হিঁচড়ে, চুলের মুঠি ধরে, পাথর ছুঁড়ে ছুঁড়ে ভদ্রবসনা নারীকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে ক্রোধোন্মত্ত এক দল। যারা এখনো চিনতে পারেনি, জনতার ভীড় ঠেলে খানিকটা সামনে এসে তারা দেখতে পায়, রাস্তার ধূলো মেখে গড়িয়ে নিয়ে যাওয়া রক্তাক্ত এই নারী আর কেউ নয়, আলেজান্দ্রিয়ার বহুল আলোচিত ‘হাইপেশিয়া’

গ্রীকদেশীয় বিদ্বান বাবা থিয়নের কাছে গণিত আর জ্যোতির্বিজ্ঞানের জগৎ দেখার পাশাপাশি খুব ছোটবেলা থেকেই হাইপেশিয়া দেখেছিলো যুক্তির অপার সৌন্দর্য। আর সেই সৌন্দর্য প্রচারের জন্য আলেকজান্দ্রিয়ার মিউজিয়াম আর লাইব্রেরীকে বানিয়ে নিয়েছিলো নিজের পাঠশালা। তাঁর প্রজ্ঞার আলোয় আলোকিত হতে দুর-দূরান্ত থেকে আলেকজান্দ্রিয়ার সেই পাঠশালায় ছুটে এসেছিলো জ্ঞানপিপাসুরা। দিনে দিনে বাবার কাছ থেকে পাওয়া জ্ঞানের গন্ডি অতিক্রম করে হাইপেশিয়া বিচরণ করে দর্শনের অবাক রাজ্যে। অচিরেই খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে সমস্ত আলেকজান্দ্রিয়ায়, আস্তে আস্তে সাধারণ জনতা এসে মন্ত্রমুগ্ধের মত হাইপেশিয়ার মুখ থেকে শুনতে থাকে সক্রেটিস, প্লেটো আর দর্শনের যতসব অমৃতবাক্য।

ছবি:শিল্পীর কল্পনায় হাইপেশিয়া, ছবির সৌজন্যেঃ www.smithsonianmag.com

খোদ আলেকজান্দ্রিয়ার গভর্নর অরেস্টেস সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেন হাইপেশিয়ার সাথে। হাইপেশিয়ার ছাত্রদের মাঝেই আছে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসা অভিজাত আর প্রভাবশালীদের সন্তান-সন্ততিরা, যারা পরবর্তীতে প্রশাসনের নামী-দামী সব আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে। তাই, প্যাগান ধর্মাবলম্বীদের অনুরাগভাজন, সুন্দরী, সৌম্য, সম্ভ্রান্ত হাইপেশিয়ার সাথে প্রণয়ের ভাব জমাতেও কম চেষ্টা করেননি অরেস্টেস। কিন্তু যার রক্তের মাঝে জ্ঞানের পিপাসা আর যুক্তির আলোড়ন, প্রণয়ের প্রেমপ্রাসাদে বন্দী হবার তার সময় কোথায়। শুধু অরেস্টেস নয়, ব্যক্তিগত জীবনে অবিবাহিত হাইপেশিয়ার প্রেমে পড়েছিলো তার নিজের ছাত্রদের মধ্যকার অনেকেই, কিন্তু কঠিন ভাষায় তাদের কাছে অপারগতা আর অনীহা প্রকাশ করে হাইপেশিয়া। প্রেমপ্রত্যাশী এক যুবককে সকলের সন্মুখে ঋতুস্রাবের কাপড়ের টুকরো তুলে ধরে হাইপেশিয়া বলেছিলো, “দেখ, এই কাপড়ের টুকরায় তাকিয়ে দেখ! কই, আমিতো কোথাও সৌন্দর্য দেখতে পাই না, দৈহিক কামনা বাসনার মধ্যে সৌন্দর্য থাকতে পারে না।”

কিন্তু একজন নারীর অপরিসীম প্রভাব আর প্রতিপত্তিতে, অহংকারী-অনমনীয় মনোভাবে সবার আগে যে প্রতিষ্ঠানের গায়ে আগুন ধরে ওঠার কথা, যার অহমিকায় সবচেয়ে বেশি আঘাত লাগার কথা, জ্বলে উঠলো নব্য প্রতিষ্ঠিত এবং দ্রুত শাখা-প্রশাখা বিস্তারকারী সেই চার্চ। প্যাগান ধর্মাবলম্বী হিসেবে চিহ্নিত, ৩৭০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণকারী হাইপেশিয়ার এমন একটা সময়ে খ্যাতির শীর্ষে আরোহণ করলো যখন খ্রিস্টান আর প্যাগান ধর্মাবলম্বীরা পরস্পরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত; ঘাত-প্রতিঘাত চলতে লাগলো আলেকজান্দ্রিয়ার খিস্টান এবং অন্য ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায়ের মধ্যে। এসবের মধ্যে হঠাৎ একদিন রোমান সম্রাট থিওডোসিয়াস ডিক্রি জারি করে খ্রিস্টানধর্ম ছাড়া অন্য সবধর্মের আচার-আচরণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেন। সুযোগসন্ধানী, প্রতিহিংসাপরায়ণ আলেক্সান্দ্রিয়ার আর্চবিশপ থিওফিলাস এই সুযোগে সম্রাট থিওডোসিয়াস’র কাছ থেকে প্যাগান টেম্পল সেরাপিয়াম ধ্বংসের নির্দেশ আদায় করে নিলো।

এই ‘সেরাপিয়াম’-এ ছিলো হাইপেশিয়ার পাঠশালা; আলেকজান্দ্রিয়ার জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দু। ধর্মান্ধ উন্মত্তরা যুগ যুগ ধরে যেই জিনিসকে ভয় পেয়ে এসেছে, যখনি সুযোগ পেয়েছে সবার আগে যে জিনিসটা ধ্বংস করেছে, যেই জিনিসটা তাদের কাছে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের সেই আবাসস্থল-“পুস্তক”; যে পুস্তক মানুষকে প্রশ্ন করতে শেখায়, মানুষকে বিতর্ক করতে শেখায়, মানুষকে যৌক্তিক হতে শেখায়, অন্ধ বিশ্বাস থেকে সরে আসতে শেখায়। বার বার ধ্বংস হতে থাকা আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরীর পুস্তকগুলির অনেকাংশ সুরক্ষিত ছিলো এই ‘সেরাপিয়াম’-এ। উন্মত্ত খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা রোমান সৈনিকদের সহায়তায়, চার্চের প্রত্যক্ষ নির্দেশে আগুন জালিয়ে মুহূর্তেই ধূলোয় মিশিয়ে দিলো ‘সেরাপিয়াম’-এ রক্ষিত লক্ষ লক্ষ পুস্তকের পাতা। লুটপাট করতে শুরু করে দিলো যে যেদিকে পারলো। কিন্তু একদল মূর্খের কাছে লাইব্রেরীতে লুট করার কিই-বা আর থাকে, পুস্তকের পাতা-তো তাদের কাছে কাগজের উপর কালির আঁচড় ছাড়া কিছুই না। তাই যেখানে সেখানে ভাংচুর করে, যাদেরকে ভিতরে খুঁজে পেলো তাদেরকে হত্যা করে, তাদের রক্তে শরীর ভিজিয়ে খুনের নেশা মেটালো আক্রমণকারীর দল। অপরদিকে, যার কাছে পুস্তকের পাতা জীবনের চেয়েও দামী সেই হাইপেশিয়া সমস্ত শরীরে করে, দু’হাতে করে, যেভাবে যেমন করে পেরেছে পুস্তক আগলে ধরে পরিত্যাগ করলো তার প্রিয় পুস্তকাগার।

‘থিওফিলাস’-এর মৃত্যুর পর ৪১২ খ্রিস্টাব্দে তার যোগ্য উত্তরসূরী এবং নিজের ভাইয়ের ছেলে সিরাল আলেকজান্দ্রিয়ার আর্চবিশপ হিসেবে অধিষ্ঠিত হলো। অগ্রজদের দেখানো পথে হেঁটে, ধর্মকে নোংরা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে ‘সিরাল’ সফলভাবে ইহুদী ও অন্য ধর্মাবলম্বীদের আলেকজান্দ্রিয়া থেকে নির্বাসিত করতে সমর্থ হলো। কিন্তু আলেকজান্দ্রিয়ার গভর্নর রোমান সম্রাটের প্রতিনিধি ‘অরেস্টেস’কে তখনো হাতের মুঠোয় আনতে পারেনি ‘সিরাল’। তার উপর অরেস্টেস’র সাথে আছে খ্যাতিমান ও প্রভাবশালী ‘হাইপেশিয়া’ এবং তার সম্ভ্রান্ত উচ্চবর্গীয় অনুসারীবৃন্দ। নানা কৌশলে অরেস্টেস’কে চার্চের কাছে মাথা নত করার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে ‘সিরাল’ এবং তার অনুসারীরা বুঝে উঠে, হাইপেশিয়াকে ঠেকাতে না-পারলে অরেস্টেস’র সাথে সম্পর্ক প্রতিস্থাপনের সকল প্রচেষ্টা অর্থহীন হয়ে যাবে।

ধর্মকে পুঁজি করে ফুলে-ফেঁপে ওঠা ‘সিরাল’ দিনে দিনে সাধারণ মানুষের উপর তার প্রভাব বাড়াতে থাকে একটু একটু করে। অন্যদিকে, খ্রিস্টান ধর্ম যাকে নিজের অবস্থান থেকে একবিন্দুও টলাতে পারেনি, প্রগতিশীল চিন্তায় অভ্যস্ত সেই হাইপেশিয়া দিনে দিনে চার্চের আক্রোশের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। বন্ধু-বান্ধব, গুণগ্রাহী এমনকি শেষ পর্যন্ত ‘অরেস্টেস’-ও তাকে অনুরোধ করে নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা এবং শিক্ষাদান থেকে বিরত থেকে সে যেন চার্চের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করে। কিন্তু যুক্তি আর জ্ঞানের আলো যাকে একবার আলোকিত করে ফেলেছে সেকি আর কোনোদিন অন্ধকারের পথে পা বাড়াতে পারে। কোন কিছুই ‘হাইপেশিয়া’কে হার মানাতে পারলো না, অনড় থাকলো সে নিজের অবস্থানে। এমন তেজস্বী, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, বিদূষী, মহীয়সী নারীকে বরদাস্ত করতে পারে সে ক্ষমতা অন্তত বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা কোনো উপাসনালয়ের থাকতে পারে না। অবশেষে,‘সিরাল’-এর ঈশারায় তার অনুসারী ধর্মের সৈনিকদের আক্রমেণের লক্ষ্যে পরিণত হয় আলেকজান্দ্রিয়ার আলোকবর্তিকা হাইপেশিয়া। সুযোগের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে ৪১৫ খ্রিস্টাব্দের মার্চের প্রকাশ্য দিবালোকে ‘সিরাল’-এর একদল অন্ধ অনুসারী রাস্তায় হঠাৎ পেয়ে গেলো ‘হাইপেশিয়া’-কে।

ছবি:আলেকজান্দ্রিয়ার রাস্তায় লাঞ্ছিত হাইপেশিয়া।
ছবির সৌজন্যেঃ http://www.smithsonianmag.com

চুলের মুঠি ধরে রথগাড়ী থেকে নামিয়ে সিরাল’র অনুসারীরা সহস্র জনতার মধ্যদিয়ে টানতে টানতে তাঁকে এবার নিয়ে যাচ্ছে খ্রিস্টানদের তথাকথিত উপাসনালয় সেজারিয়াম-এ। আলেকজান্দ্রিয়ার মাতালেরা আরো খানিকটা উচ্ছ্বসিত হয়ে এবার দলবেঁধে সমস্বরে বলতে থাকলো, যা, নিয়ে যা, জন্মের মত করে শিক্ষা দিয়ে দে। অন্যদিকে, প্রিয় শিক্ষকের অপরিসীম অপমান শিষ্যরা শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো আর চোখের পানি মুছলো। প্রতিবাদ করতে গেলে ধর্মান্ধের দলের সন্মুখে পড়ে প্রাণ দেয়া ছাড়া এ-মুহূর্তে অন্য কোনো উপায় নেই।

উৎস্যুক জনতার সাথে সাথে তারাও তাকিয়ে দেখলো, প্রচন্ড এক লাথি দিয়ে হাইপেশিয়াকে ছুঁড়ে ফেলা হলো সিজারিয়াম’র মেঝেতে। দুইপাশ থেকে দুইজন টেনে ছিঁড়ে ফেললো পরিধেয় বস্ত্র। বিবস্ত্র হাইপেশিয়া লজ্জায় মুখ ঢাকার জন্য খুঁজে ফেলো না কোনা আড়াল। কাঁপতে থাকা হাইপেশিয়ার জন্য উন্মত্ত ধর্মবীররা এবার মেঝে থেকে হাতে তুলে নিলো পাথরের ফলক। একদল পাথর দিয়ে আঁচড়ে আঁচড়ে তুলে ফেললো তাঁর শরীরের সমস্ত চামড়া। ততক্ষণে যন্ত্রণায় কাতর হাইপেশিয়া’র আর্তনাদে ভারী হয়ে গেছে সিজারিয়াম’র ভিতরটা। কিন্তু চার্চের সাথে বিরোধ সৃষ্টিকারী এই অহংকারী নারীর জন্য শুধু এতটুকু শাস্তিইতো যথেষ্ট নয়। হিংস্র মানব সন্তানেরা হায়েনার মত চার পাশ থেকে টেনে খন্ড-বিখন্ডিত করে ফেললো হাইপেশিয়া’র সমস্ত শরীর। অনেক আগেই মৃত্যুর অন্ধকারে তলিয়ে গেছে আলেকজান্দ্রিয়ার আলো। তবু হায়েনাদের যেন ক্রোধ মিটেনা। তাই, ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পুড়িয়ে ছাঁই করা হলো। তারপর আলেকজান্দ্রিয়ার আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে দেয়া হলো হাইপেশিয়া’র দেহভস্ম, আকাশ-বাতাসকে জানিয়ে দেয়া হলো চার্চের সাথে বিরোধে লিপ্ত হবার কি পরিণতি।

তথ্যসূত্র
ফেব্রুয়ারী ২৮, ২০১১
[email protected]

** কাহিনীর বেশ কিছু অংশ নিয়ে মতবিরোধ আছে, বিভিন্ন সূত্রে বিভিন্নরূপে বর্ণিত হয়েছে এই কাহিনী, আমি সূত্রগুলো যথাসম্ভব বিশ্লেষণ করে নিজের মত করে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি।

পরবর্তী পর্ব (রুকসানা)