আমার মাতৃভাষা বাংলা। আমি জন্ম থেকে এ-ভাষায় অভ্যস্ত অন্য অনেক নিম্নমধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্তের মতো যারা জন্মসূত্রে এটি পায় এবং নিজের অজান্তেই এটি ভালোবেসে ফেলে। এভাষায় কথা বলতে গিয়ে, এ-ভাষা নিত্যদিনের নানা কাজে ব্যবহার করতে গিয়ে, এতে প্রেম-অপ্রেম, দ্রোহ, ক্রোধ, ভালোলাগা, মন্দলাগা ইত্যাদি প্রকাশ করতে গিয়ে কখন যে অন্তর্গত রক্তস্রোতের সাথে মিশে গিয়ে এটা মর্মে পশেছে, তার ইতিহাস বা পুরাণ নিয়ে কপচাই নি কখনো, কারণ, উত্তর নেই। পৃথিবীতে সন্তান জন্ম দিয়েছেন অনেকেই, কিন্তু, মা আমার একজনই, তেমনি মাতৃভূমিও একটাই, আর মাতৃভাষাও। তাই, আমি হাজার ভাষা জানলেও (যদি জানতাম কখনো!) এই একটি ভাষাতেই সাবলীল এবং থাকবোও আমৃত্যু, যেমন মায়ের কাছে আমি (যাকে হারিয়েছি এবং হারিয়েছি সে-আশ্রয়)।এই বাংলা ভাষায় সচ্ছন্দ হওয়ার জন্য, বাংলা আমৃত্যু উত্তরাধিকার হিসেবে বহন করার জন্মগত দুষ্টির জন্য, বাংলায় মনোভাব প্রকাশ করে সহজ আনন্দ পাওয়ার অক্ষম অপরাধের জন্য আমি আমার শাস্তি চাই, আমার দৃষ্টান্তমূলক দণ্ড চাই, আমার প্রভূত প্রায়শ্চিত্ত চাই।

ছেলেবেলা থেকে, সম্ভবত অন্য বিনোদনের অভাবে এবং একমাত্র সন্তান হওয়ায় আমার মাতাপিতার কঠোর নিয়ন্ত্রণে থাকায়, বই-ই হয়ে ওঠে আমার অবসর কাটানোর একমাত্র মাধ্যম। আজ যখন শুনতে পাই অহরহ বইবিমুখিতার তথ্য এবং দেখতেও পাই চারপাশে, তখন কেমন যেন অবাক লাগে। অথচ, এটাই হয়েছে আজ স্বাভাবিক। দু’টি মলাটের, মাত্র দু’টি মলাটের মাঝখানে একটি পৃথিবী দেখতে পাওয়ার অপার রহস্যের কথা, যা নানা রূপে, নানা রসে, নানা রঙে ধরা দেয় পাঠকের কাছে, তা যে কেউ এড়িয়ে যেতে পারে, তা ভাবাটাই আমার কাছে অবিশ্বাস্য। শিশুসাহিত্য থেকে উত্তরাধুনিক কথাসাহিত্য বা ছড়াপদ্যকবিতা বা প্রবন্ধ, সবকিছুই আমার মনোহরণ করে। যাঁরা লেখেন, তাঁদের প্রতিও শ্রদ্ধানত হই, ভাবি “তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী”। সময় কাটাতে বা মননের ঊর্ধ্বগামিতা অন্বেষণে বা প্রতিক্রিয়াশীলদের বীভৎস ছায়া এড়ানোর বা তাড়ানোর যুদ্ধে আমি সর্বদাই ‘পুস্তকং শরণং গচ্ছামি।’ আর, অবশ্যই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই গ্রন্থটি বা লেখাটি চাই বাংলায়। কারণ, ওটিই যে হৃৎকন্দরে পশে আকুল করে মনপ্রাণ। বাংলা সাহিত্য বা লেখালেখির প্রতি আমার নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের জন্য, বাংলা ‘অপাঠ্য সব পাঠ্য’ পেলে তাতে মনপ্রাণ ঢেলে দেওয়ার জন্য, নিরন্তর বাংলায় অন্যদের লেখা পড়তে চাওয়ার নেহাৎ নগণ্য অথচ, ব্যক্তিগতভাবে তীব্র বাসনা পোষণ করার জন্য আমি আমার কঠোর কলঙ্ক চাই, আমার এই অপকর্মের তীব্রতর শাস্তি চাই, আমার জীবিত সত্তার নিদারুণ অপমান চাই।

যেহেতু, আমি পড়ার চেষ্টা করেছি অনবরত, তাই, সঙ্গদোষে লেখার অতি সামান্য অপচেষ্টাও করেছি যা না করলে পৃথিবীর বা বাংলার কোন ক্ষতিবৃদ্ধি হতো না বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আমি কথাসাহিত্য রচনার মতো কল্পনাশক্তিশালী নই, নই মহৎ প্রবন্ধ রচনার মতো জ্ঞান বা প্রখর যুক্তিবোধের অধিকারী, তারপরও মানসিক তাড়নায় হঠাৎ করে দু’চার কলম লিখে পরে লজ্জায় বা অবহেলায় লেখাগুলোকে অতএব নিজের বলে স্বীকার করতেই হয়। অন্য ভাষা যেহেতু একটি শিখতেই হয়েছে বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়ে পাঠগ্রহণকালে, তাই ওটির বিশ্ববিশ্রুত রত্নাবলির কিছুমাত্র নিজ ভাষায় রূপান্তরের বৃথা চেষ্টা করে যাই। আর, স্বপ্ন দেখি (কারণ, দুর্বলতম মানুষটিও ওটা দেখতেই পারে) হয়তো একদিন আমার একটা বই বের হবে। হাজারো লেখাও মনে ওঠে যা লেখা হয় নি, হয় তো কখনো হবেও না। তারপরও, একটু অক্ষম লোভ জাগে, একদিন হয়তো আমারও, হয়তো আমারও…। আমার এই অপটু কারুবাসনার জন্য, আমার গ্রন্থপ্রকাশের অসম্ভব কল্পনার জন্য, আমার অনুবাদের অশ্লীল ইচ্ছের জন্য আমি শাস্তি কামনা করি, আমার বালখিল্য লেখকস্বপ্নের অন্তহীন ধ্বংস প্রার্থনা করি, আমার সামান্য অস্তিত্ব চূড়ান্তভাবে নিশ্চিহ্ন করার দারুণ দাবি জানাই।

বাল্য থেকেই বাংলা গান শুনে আমার শ্রবণেন্দ্রিয় গড়ে উঠেছে। আরো বড় হয়ে ভালোবাসতে শিখেছি বাংলা সঙ্গীতের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারিগরদের। এবং, আজও ভালো বাংলা গানের আমি চিরভক্ত, যদিও ভালো বিশেষণটি বিতর্কের অংশ বটে। রবীন্দ্র-নজরুল বুকে নিয়ে, পঞ্চভাস্করের পর্ব পেরিয়ে, পঞ্চাশ-ষাটের দশকের স্মৃতিমেদুর মোহমুগ্ধতা সঙ্গে করে, সত্তুর এবং তৎপূর্ব ও তৎপরবর্তী গণসঙ্গীতের গণআচ্ছন্নতায় আবিষ্ট হয়ে আমি বর্তমান বাংলা গানের জগতের অধিবাসী। অবশ্য, হয়তো বয়েসের কারণেই হবে, আমি উত্তরাধুনিক বা নিরুত্তরাধুনিক বাংলা গানের জগতে অতটা বসত করতে পারি নি। অবশ্য, অন্য ভাষার গান শুনি নি বা শুনি না এমন নয়, তবে, সেমাত্রায় আন্তর্জাতিক হতে পারি নি অন্তত সঙ্গীতের ক্ষেত্রে। ঋতুপরিবর্তনের বৈচিত্র্যে, হৃদয়ের আকুল উন্মাদনা প্রকাশে, জয় বা শোক বা বিদ্রোহ বা ক্ষোভ বা ভালোলাগার অনুভূতি বাঙ্ময় করতে বা মুখর করাতে আমি বাংলা গানের প্রতিই আভূমিপ্রণত হয়েছি বারবার। এছাড়া, আমার বঙ্গরূপবিকাশী ও প্রকাশক এমন মমতামধুর জাতীয় সঙ্গীতটির যারা পরিবর্তন চায়, আমি তাদের বিপক্ষে রীতিমত গুরুতর অবস্থান নেয়ার প্রয়াসী। বাংলা গানের প্রতি নিঃসংকোচ পক্ষপাতিত্বের জন্য, আবেগ প্রকাশে ও প্রচারে অনবরত এর সাহায্য নেয়ার জন্য, এবং সর্বোপরি বাংলা গান শুনে ও জাতীয় সংগীতটি শুনে নির্লজ্জ আবেগ লোকগোচর করার জন্য এবং এগুলোর পরিবর্তনের বিরুদ্ধে মৌলবাদী অবস্থান নেয়ার কারণে আমি আমার নিজের জন্য কঠোর ভর্ৎসনা চাই, আমুণ্ডুপদনখ কশাঘাত চাই, নিরন্তর নরকে আমার নির্বাসন চাই।

বাংলা শুদ্ধভাবে বলা ও লেখা যে-জরুরি, তা আমি গর্বভরে স্বীকার করি। এবং, সবসময়ই এর শুদ্ধ রূপটি জানার ও শেখার চেষ্টা করি। এছাড়া, যেসব অন্ধকার ক্ষেত্রে এখনো বিতর্কের অবকাশ রয়ে গেছে, সেখানে বিদ্বৎসমাজের আলোকক্ষেপণ কামনা করি এবং, এ-নিয়ে বিজ্ঞদের পারস্পরিক মতের লড়াই রতিসুখসারে রত হওয়ার চাইতেও দারুণ উপভোগ করি। অবশ্যই, শেষমেষ একটি নির্দ্বন্দ্ব সমাধানও কামনা করি। লেখায় বাংলা বানানে ও ব্যাকরণে জ্ঞাত ভুল দেখলে মানসিক কষ্ট অনুভব করি এবং বাংলা উচ্চারণে অহেতুক ভিন্নভাষার শব্দ ও উচ্চারণধর্ষণ আমার মানসিক যন্ত্রণা বাড়ায়। প্রমিত বাংলা উচ্চারণ ও শালীন বাংলা লেখন আমার চিরআরাধ্য। আঞ্চলিক উচ্চারণ যাঁরা কথায় ঢুকিয়ে আত্মতৃপ্তি ও গৌরব অনুভব করেন এবং, আঞ্চলিক শব্দ, বাক্য ইত্যাদি বাংলা সাহিত্যে ও অন্য শিল্পমাধ্যমে ছড়িয়ে যাঁরা শিল্পসাহিত্যে নতুন আন্দোলন আনতে চান, আমি সবিনয়ে তাঁদের কাছ থেকে দূরেই থাকতে চাই। এবং, কোনভাবেই তাঁদের উক্তিগুলো যুক্তি বলে মেনে নিতে পারি না। তেমনি পারি না যাঁরা ‘বিরাজমান অশৃংখলার বদলে ভাষাতাত্ত্বিক নৈরাজ্য’ আনতে চান তাঁদের মতামতও সমর্থন করতে। প্রথমটির একটা নজির নেই:

“ফাহাদের বিসনায় শুইয়া আমি। ফাহাদ খাদ্য যোগাইতে গেসে। মাথাটা ঘুরতেসে। মনে হয় বমি হবে। বিসনায় বমি করলে ফাহাদ আমারে কতল করবে। তাড়াতাড়ি বাইরে আসি। বাথরুম ঘরের সমীপে। ঢুইকা আলো জ্বালাই। দেখি যে, আরেকটা ঘরে প্রবেশিত হইসি। মেঘলার ঘর। পড়ার টেবিল। অনেক বই। ড্রেসিং টেবিল। বিসনা। চেস্ট অব ড্রয়ারস ইত্যাদি। আমি বিসনাটা ছুঁই। এইখানে মেঘলা শোয়। গন্ধই অন্যরকম। আমি ওর মেকআপের দ্রব্যাদিগুলি ছুঁই। কলজে ধুকপুক কইরা মনে হয় এখন শরীর থেইকা বাহির হইয়া যাবে। মেঘলা ও ফাহাদ কথা বলতেসে। ওদের কণ্ঠস্বর নিকটে আসতেসে। আমার এইঘর থেইকা নির্গত হওয়া উচিত। পারি না। আস্তে গিয়া চেস্ট অব ড্রয়ারস খুলি। কাপড়গুলা স্পর্শ কইরা কইরা দেখি। সবচেয়ে নিচের ড্রয়ার থেইকা একটা দ্রব্য নিয়া পকেটে ঢুকাই। কাউরে কিছু না বইলা এদের বাড়ি থেইকা নির্গত হইয়া যাই।”

বাংলা বানান ও ব্যাকরণসংক্রান্ত ত্রুটিদূরীকরণ দেখতে আমার আগ্রহের জন্য, শিল্পসাহিত্যে আঞ্চলিক ভাষার প্রবল প্রতাপ কোঁচকানো ভুরু নিয়ে দেখার কুটিল অভ্যেসের জন্য এবং, অহরহ বাংলা লেখনে ও কথনে নিজের ভুলগুলো সনাক্ত ও শোধন করার মানসিকতা রক্ষার জন্য আমি নিজের দৃষ্টির অনন্তপার ক্ষীণতা চাই, আমার মানসিকতার ও জিহ্বার আমূল উৎপাটন চাই, আমার বুকের গভীরে জ্বলতে-থাকা ক্ষুদ্র, অপ্রশিক্ষিত ভাষাতাত্ত্বিকটির সহস্রখণ্ডে বিদীর্ণ নীরক্ত দেহাবশেষ চাই।

আজ পথে-ঘাটে যেদিকেই তাকাই, শুধু অন্যভাষার জয়গান শোনা যাবে, বাংলার নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের এমনকি নিজের বাসগৃহের নামফলকে দেখা যাবে শোনা যাবে বাংলার পরাজয়ের সুবর্ণ সেরেনাদ। একান্নটি অসরকারি বিশ্ববিদ্যাবিপণীবিতানের মধ্যে মাত্র চারটির নাম পাওয়া যাবে বাংলায়, প্রায় পঁয়তাল্লিশটি বেসরকারি অধিকোষের মধ্যে মাত্র চারটির নাম রাখা হয়েছে বাংলায়, মোটামুটি নয়টি দৃশ্য গণমাধ্যমের মধ্যে কেবল তিনটির নামকরণ করা হয়েছে বাংলায়, এমনকি সরকারিটিও এর ভেতরে নয়। এমনি অজস্র ইংরেজিমনস্কতায় স্বাধীন বাঙালি হার মানাবে অন্য সব জাতিকে। আর, ইংরেজিশিক্ষার কথা কী আর বলা! যিনি ভুল বাংলা ও ততোধিক পরিমাণে ইংরেজি (ভুলও হোক না) অবলীলায় এবং সুপ্রচুর পরিমাণে বলতে পারেন, তিনিই আজকাল শিক্ষিতের চরম নিদর্শন। ইংরেজি-বলা বাধ্যতামূলক ইংরেজিমাধ্যম বিদ্যালয়গুলোয় (বাংলায় কথা বললে অনেকগুলোয় অর্থদণ্ডের ব্যবস্থা আছে, স্পর্ধা!), বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে (মর্যাদারক্ষার খাতিরে), এমনকি সরকারি অন্তত একটি ক্ষেত্রে, সেনাবাহিনীতে (ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা)। এখন “…সবখানেই ইংরেজির ছড়াছড়ি, সম্মান; এবং আসছে আরবি ডুবছে বাঙলাভাষা। এখন মূর্খ চাষা ছাড়া আর কেউ বাঙলা বলে না, পতিতাও বিদেশি ভাষা শিখছে নানা টিউটরিয়ালে”। এর মধ্যে যারা বাংলার জয়গান শুনতে চায়, তারা স্রোতের বিপরীতপথযাত্রী। এবং, নিশ্চেতন। আমিও তাদেরই দলে, কেননা আর সময় নেই, প্রতিভা নেই পথ বদলানোর। ইংরেজিশিক্ষা দোষের বলার মতো আকাট ষাঁড়ের গোবর নই; তবে, ইংরেজি-হ্যাংলামোর বিপক্ষে। একটি ইংরেজিমাধ্যম বিদ্যালয়ের দু’টি ছাত্রের রচনা খাতা থেকে (রচনার শিরোনাম: My dream or aim in life) কিয়দংশ উদ্ধৃত-করা হল:
১.

“সবার একটা না একটা সপন থাকে। আমার সবার মতন এক সপন এছে এর আমি আইটা ছাড়া কছু করতে চাই না। আমার কৃকেটের কেরিয়ার আরমব হুইল জখন এমাকে ক্লাস ন এ স্কুল টিমের জন্ন ডাকসে। আমি তখন থিকে আমার এস্কুল জন্ন খেলা সুরু করলাম। আমি আমার এসকুলের সবচেয়ে ভাল হাতি সপিনার হলাম। আমি আমার সবচে প্রথম মেচে তিনটা wicket নিয়ে নিরমান কমপিটিশনে বেস্ট বোলারের প্রাইজ পাইলাম। চারপর থেকে আমার ইনটারেস্ট বারল আর আমি এখন আমার দেশের জন্ন খেলতে চাই।”

২.

“আমার সপন অনেক হই। আমি কালকে সপনা করেচি। আমি দেখসি কি আমার অনেক ভাল বনদু মরে গেচে। অর নাম হল সাতেল। আমি আমার গুমে অনেক কানচীলাম। সে একতি গারির আকসিদেনতে চিলেন। কুন সুমায় আমি উঠসি আর সকুলে গেচি আমি অকে দেখে আমি অনক খুসি ছিলাম।”

এর নাম বাংলা নয়; এর নাম ইংরেজিপ্রেম। এর উল্টোপিঠেই বাংলার প্রতি নির্লজ্জ অবহেলা। আমি ইংরেজি শুধু নয়, অন্য শত ভাষাও শিখতে চাই। কিন্তু, বাংলার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নয়। বাংলাদেশে বাংলা ভাষার হৃতসম্মান ফিরে পাওয়ার স্বপ্ন দেখি বলে, অন্য ভাষার চাইতে অন্তত আমার ভূখণ্ডে আমার রক্ত দিয়ে-কেনা ভাষার মর্যাদা পাওয়া উচিত মনে করি বলে এবং, আমার দেশের সন্তানেরা সবাই যুগযুগ ধরে বাংলা ভাষা শ্রদ্ধা করবে এই আশা রাখি বলে আমি আমার প্রচণ্ড পাপমোচন চাই, আমার অনন্য অপমান চাই, আমার রসাতলে গমন চাই।

একটি ভালো অভিধান বা একটি ভালো ভাষাতাত্ত্বিক গবেষণা বা বাংলার জনগোষ্ঠীর কাছে এ-ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা চিরস্থায়ী করার জন্য কোন প্রতিষ্ঠান এ-বাংলায় নেই। আমি সেরকম একটি প্রতিষ্ঠান কল্পনায় দেখি যা প্রতিভাদীপ্ত তরুণ ও প্রাজ্ঞবিজ্ঞ বয়োপ্রাপ্তদের পরিচালনায় ঋদ্ধ এবং বাংলা ভাষাসংক্রান্ত যেকোন সমস্যায় যার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য। কোন স্বৈরাচারী বন্ধনে ভাষা আবদ্ধ না রেখেও বাংলাসংক্রান্ত যেকোন প্রশ্নের উত্তর দেয়ার ক্ষমতা এর থাকবে। এর শাখা শুধু এই দেশে নয়, বিদেশেও প্রসারিত হতে দোষ কোথায়? বাংলা ব্যাকরণ, উচ্চারণ, লেখন ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রে এর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি প্রসারিত থেকে বাংলা ভাষাকে এটি নানান ব্যভিচার থেকে রক্ষা করবে। পরিভাষা রচনায়, অনুবাদগ্রন্থ প্রকাশনায়, বাংলা ভাষা শিক্ষার নানা কৌশল আবিষ্কারে ও এ-সংক্রান্ত গবেষণায় এটি হবে অদ্বিতীয়। এহেন বাস্তবতাবিবর্জিত স্বপ্ন দেখার কারণে, বাংলা ভাষা অহরহ বিকৃতির হাত থেকে রক্ষার চিন্তা করায় এবং, বাংলা ভাষা বিষয়ে জ্ঞানচর্চার কল্পনা করার কারণে আমার দণ্ডিত মৃতদেহের চূড়ান্ত অবমাননা হোক, আমার কুৎসিততম শাস্তি হোক, আমার ধ্বংসযজ্ঞ পৈশাচিকতায় স্মরণীয় হোক।

বিশ্বসাহিত্যে বাংলার স্থান নিরতিশয় অবমাননাকর। বিশ্বের প্রথম দশটি ভাষার মধ্যে ফরাসি নেই, অথচ, সেদেশের সাহিত্যিকেরা যা দিয়ে গেছেন, এবং এখনও যাচ্ছেন পৃথিবীর সাহিত্য আর দর্শনের ক্ষেত্রে, তার ঋণ পৃথিবীর জ্ঞানভাণ্ডার চোকাবে কখন? আর, বাংলার ধ্রুপদী বা সমসাময়িক সাহিত্য কতটুকুই বা পৃথিবীতে প্রচার পায়, পেয়েছে? আমার বড় সাধ আমাদের ভাষায় রচিত সাহিত্য বা দর্শন বা আমাদের ইতিহাস বা অন্যজাতীয় লেখালেখি বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়বে। বালিকা থেকে বৃদ্ধা সবাই পড়বে আমাদের কথা, জানবে আমাদের চিন্তনক্ষমতা, কল্পনাশক্তি। স্বেচ্ছায় আমাদের ভাষা শিখবে অনেকেই; অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধির আশায় নয়, এর সৌন্দর্যে আর শক্তিকে বিমোহিত হয়ে। এধরনের আকাশকুসুম কল্পনা পোষণ করার জন্য, বাংলার বৈশ্বিক জয় প্রার্থনার জন্য, এর আকর্ষণীশক্তির প্রাবল্যবৃদ্ধির দাবি করার জন্য আমি আমার দাহ্যাবশিষ্ট ভস্মের চরম অবমাননা চাই, আমার বিন্দুমাত্র অবশেষ এবাংলার মাটিতে না-রাখার অধিকার চাই, আমার ইন্দ্রিয়সমূহের শীতলতম নিষ্ক্রিয়তা চাই।

মানুষের দ্রোহ-ক্রোধ-অন্যায়বিরোধী সংগ্রাম আমায় শ্রদ্ধাপ্লুত করে। রাজনীতির বিমানবিকীকরণ হলেও মানুষের মৃত্যুর পরও যে মানব থেকে যায়, এই বিশ্বাসে আমি অন্ধমূর্খবিশ্বাসী। ক্ষমতাপ্রেম ও -লোলুপতার হাত থেকে আমরা রক্ষা করতে পারি নি আমাদের প্রিয় ভাষাঅর্থনীতিসংস্কৃতি তথা দেশ ও মানবের অস্তিত্ব। ঘৃণায় কুঁকড়ে যাই মাঠে-ময়দানে ও রাজমহলে-গণমাধ্যমে স্বেচ্ছাপাষণ্ডদের সদাপট বিচরণ দেখে, আবার আশান্বিত ও শপথকঠিন হয়ে ওঠার চেষ্টা করি গণশক্তির আকাশছোঁয়া প্রত্যয় ও সাফল্যের ইতিহাস স্মরণে ও দর্শনে। অথচ আজ, হায়, লুণ্ঠিত হয়ে গেছে সেই জনযুদ্ধের ফলাফল। যাঁরা একুশের প্রথম প্রহরে শহিদানের পুণ্যস্মৃতিতে পুষ্পতর্পণ করেন, তাঁরা সন্তানদের নিরাপদে শিক্ষাগ্রহণের জন্যে প্রেরণ করেন ভিনদেশে, ভিনভাষায় দক্ষ করে তুলতে, যাতে করে তারা ফিরে এসে আমাদের পদতলে দলিত করতে পারেন, কিংবা দুঃসময়ে মাতা-পিতৃঋণ শোধ করে তাঁদের দিতে পারেন নিরাপদ আশ্রয়। এই ‘মহান রাজনীতিবিদ’দের শহিদ মিনারে দেখার প্রবল বিতৃষ্ণা জন্ম দেয় আমার কষ্টরোধী বিবমিষার। দেশের দায়িত্বে নিয়োজিত এই পূতচরিত্র ব্যক্তিত্বদের দ্বিমুখী স্বভাব সম্পর্কে ঘৃণাপ্রকাশের জন্যে, নিজের ভাষার ও দেশের প্রতি বিরোধিতার পরও তাঁদের হাতে ভাষাশহিদদের সম্মানপ্রকাশের কট্টর ভণ্ডামি প্রবলভাবে অপছন্দ করার জন্যে, বাংলার সাংস্কৃতিক সম্মানরক্ষায় ব্যর্থতার কারণে তাঁদের তীব্রভাবে অভিযুক্ত করার কারণে আমি আমার সত্তার বিপুল বিক্রমে বিবস্ত্রকরণ চাই, প্রকাশ্য দিবালোকে আমার বর্বর বিচার চাই, আমার মুখের ওপর গণনিষ্ঠীবন বর্ষণ চাই।

নিতান্তই নিরাপদেই বলা যায় যে, আজ এই বাংলায় কখনো একুশে আসতো না। আমাদের পূর্বপুরুষেরা আমাদের অনেক লজ্জা থেকে বাঁচিয়ে গেছেন ’৫২ থেকে ’৭১ আগেভাগেই সৃষ্টি করে। তাই, আমাদের একটি অবশ্যকর্তব্য তাঁদের সেসব মহৎ কীর্তির চতুর্দশ পুরুষ নরকস্থ করা। আমরা একুশের আন্তর্জাতিক মর্যাদা নিশ্চিত-করার জন্য নির্ভর করি ভিনদেশে অবস্থিত বাঙালিদের ওপর, আমরা আন্তর্জালে বাংলা লেখার জন্য এখনো প্রণোদনা পাই না, আমরা আন্তর্জালিক জ্ঞানকোষটিতে বাংলা ভুক্তি নিজ থেকে দেয়া দূরে থাক, এমনকি প্রদত্ত ইংরেজি থেকে অনুবাদ করারও সময় পাই না, আমরা একটি আন্তর্জাতিক ভাষা প্রতিষ্ঠান উদ্বোধনের পর সেটি প্রায় দশ বছর ফেলে রাখি। আর না-ই বলি। আজ একুশে শুধু একটি আবেগের উচ্চারণ, যেটি বাইশ থেকে পরিত্যক্ত। স্লোগান তোলা খুব সহজ, কিন্তু, কাজ-করা বড়ই কঠিন। তাই, আমরা বাংলার মর্যাদা রক্ষায় তৎপর বলে যত লেখালেখি করি, তার কোটিভাগের একভাগও গঠনমূলক কাজে হাত দেই না। আর, আমিও তার থেকে দূরে কোথায়? তবুও ভাবি, একুশের অন্তর্গত চরিত্রে সেই শক্তি আছে যা আমার প্রিয় বাংলা ভাষাটি সহস্র অমর্যাদা থেকে উন্নীত করবে বিশ্বজনীন সম্মাননায়। কিন্তু, এই ক্ষোভ, এই ঘৃণা স্পর্শ করে আমায়ও:

“ছিঃ ছিঃ ছিঃ, একুশ কি পত্রিকা বাহির করিবার জন্য জন্মিয়াছিল? ছড়া, কবিতা, গল্প লিখিবার জন্য? আপনাদের কি একটু লজ্জা নাই, মৃতের প্রতি কৃতজ্ঞতা নাই, সম্ভ্রমবোধ নাই?…না পারিলে [থাকিলে], আর কিছু নয়-এই খেলা-খেলা একুশে ফেব্রুয়ারি বন্ধ করুন। সুবোধ বালকের মতো ঘরে বসিয়া থাকুন, পান চিবাইতে-চিবাইতে অফিস করুন, প্রেমিকাকে লইয়া টি-এস-সির চত্বর মধুময় করিয়া তুলুন। কিন্তু, খবরদার, সালাম বরকত জব্বারদের নাম মুখে আনিবেন না।”

এই কৃষ্ণবাস্তবতার পরেও একুশের এই অমর চেতনায় বিশ্বাসী হওয়ার কারণে, একুশে শুধু একটি পাঞ্জাবি-সুতি শাড়ি-ফুল-মিছিলশোভিত দিন মনে না করার কারণে, একুশে বাংলার সম্মান চিরঅক্ষুণ্ন, চিরঅম্লান রাখবে, এই আশাবাদ ব্যক্ত করার কারণে আমি আমার দণ্ড চাই, আমার শাস্তি চাই, আমার অবমাননা চাই।